কমলকুমার মজুমদার শিল্পীমানস

শোয়েইব জিবরান

কমলকুমার মজুমদারের জন্ম ১৯১৪ সালের ১৭ নভেম্বর কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে। পিতা প্রফুল¬চন্দ্র মজুমদার, মা রেণুকাময়ী মজুমদার। পিতামহ বরদাকান্ত মজুমদার, তাঁদের স্থায়ী নিবাস চব্বিশ পরগণা জেলার টাকীতে। কমলকুমারের জন্মকালে তাঁর পিতা পুলিশ অফিসার হিসেবে কলিকাতায় কর্মরত, থাকতেন ভাড়া বাড়িতে। সাঁওতাল পরগণার রিখিয়ায় তাঁরা বাড়ি করেছিলেন। এ হিসেবে কমলকুমারের শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত হয় বিচিত্রস্থানে। বাবা, মা, ঠাকুমা ও বাবার মামা শরৎচন্দ্র রায় চৌধুরীর অমল আশ্রয়ে। কখনো বকুলবাগানে, রাসবিহারী এভিন্যু, ব্লকমনস্ট্রিটের নাগরিক পরিবেশে আবার খোলা আকাশের রিখিয়ায়। কমলকুমারের শৈশব কৈশোর অতিবাহিত হয় শিল্পসাহিত্যের অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশে। তাঁর পরিবারের প্রতিটি স্থানেই সাহিত্য, সংগীত, অভিনয়, চিত্রকলার চর্চা ছিল। মা রেণুকাময়ীর ছিল শৈল্পিক অভিরুচি। কমলকুমার শৈশব স্মৃতিচারণে বলেছেন :


আমার মার কণ্ঠস্বরে মুগ্ধতা ছিল, যেখানে স্বরস্থান সুডৌল, রূপান্ত, যে এবং যখন ঐ স্থানে আসিত বিতরসি দিক্ষুগণে। ইহা দেশরাগে এখন সকাল হয়। অদ্ভুত সক্ষ্মতা আমাদের ভর করিত কি পর্যন্ত দুঃসাহসে আমরা ঘোষণা করিতাম, কেশব ধৃত রাম শরীরং জয় জগদীশ হবে। ৩

কমলকুমারের ভাই-বোনেরা সাহিত্যরুচি লাভ করেছিলেন প্রথমত মায়ের সত্রেই। শিল্পী শানু লাহিড়ীর স্মৃতিচারণে :

মায়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। পড়ার খুব ঝোঁক। খাটের তলায় নিয়মিত পড়তেন, লিখতেন। প্রচুর বই। বাংলা বই, ইংরেজি বই। বলতে কি প্রথম জীবনে সাহিত্যপ্রীতি মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। মা এতো সাহিত্যপাঠ করতেন, আলোচনা করতেন যে আমরা সেই সময়েই অনেক ভারি ভারি জিনিষ জেনে গিয়েছিলাম। ৪

সাহিত্য, ধর্ম ও পুরাণের সাথে সম্পৃক্তি ঘটে এ শৈশবেই। প্রতিদিন ভোরে রেণুকাময়ী একপাশে কমলকুমার, একপাশে নীরদ মজুমদারকে রেখে স্তোত্র গাইতেন,রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী পড়ে শোনাতেন, এমনকি মাইকেল মধুসদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) মেঘনাদবধকাব্য (১৮৬১) পড়ে শোনাতেন। শানু লাহিড়ী সাক্ষাৎকারে বলেছেন:

ছোটবেলা থেকে পলাশীর যুদ্ধ, রামায়ণ, গোরা, পথের দাবী, মেঘনাদবধ এমনি সব ভারি বইয়ের আলোচনা শুনেছি আমি। ৫

কমলকুমার তাঁর চরিত্রের বিপরীতমুখি দুইধারা একদিকে সক্ষ রুচিবোধ ও শৈল্পিক অভিরুচি অন্যদিকে উদ্দামতা, খামখেয়ালিপনা, উৎকটতার সাথে চরিত্রের স্বাধীনচেতা, অনমনিয়তা পেয়েছিলেন মা বাবার সত্রেই। মা চাইতেন ছেলেরা শৈল্পিক অভিরুচি নিয়ে বড় হোক। চরিত্রবান হোক। বাবা চাইতেন ছেলেরা তাদের খুশিমত বড় হোক। একেবারে শৈশবেই কমলকুমারের বেপরোয়াপনাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন পিতা। চেয়েছেন সন্তান আপনার মত বড় হোক :

মা একটু রাগি ছিলেন, বাবা সবসময় ছেলেদের সেভ করতেন। দাদাকে তো কতবার বাঁচিয়েছেন বাবা। একদিন দাদা কতকগুলো মেয়ের ছবি, ন্যুড নয় তখন ন্যুড খুব একটা বেরুতো না সিনেমার পত্রিকায়। অমনি কতকগুলো ছবি রান্নাঘরের ঘুলঘুলিতে রেখেছে সেঁটে। মা তো রেগে আগুন। দাদার চরিত্রের অধোগতি দেখে এলোপাতাড়ি মারে আর কি! বাবা সেই সময় অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। বললেন, ওগুলো আমি সেঁটেছি। ওগুলো আমার। বাবা চাইতেন ছেলেরা নিজের খুশিমত বড় হোক। মা চাইতেন ছেলেরা চরিত্রবান হোক। ৬

কমলকুমাররা ব্লকমন স্ট্র্রিটের যে বাসায় ভাড়া থাকতেন তার উপরের তলায় রুচিবান ধনাঢ্য কেউ একজন থাকতেন। সে ঘরে তৎকালীন বিখ্যাত লেখক লেখিকারা আসতেন, সাহিত্য সভা হত। মহিলার সাহিত্য সংগ্রহও ছিল বিশাল। তাছাড়া, তিনি ঐ সময়ের বিখ্যাত বাংলা ও ইংরেজি পত্র পত্রিকাও রাখতেন:

আমরা যে ঘরের এক তলায় থাকতাম তার ওপরের তলায় উত্তর পাড়ার এক মহিলা, রাণী রাসমনির বাড়ির কেউ, ঐ মহিলা থাকতেন, বাড়ির মালিক। আমরা ওপরের মা বলতুম। চিরকাল ওপরের ‘মা’ বলতাম। ওপরের বাড়িতে সে যুগের সম¯ লেখক, লেখিকারা আসতেন। মহিলা লেখকরা আসতেন। রাধারাণী দেবী আসতেন। ওপরের কাকা খুব বিলিতি ম্যাগাজিন পড়তেন। দাদা খুব সেই ম্যাগাজিন দেখতেন। ৭

এ-বাড়ির সত্রেই কমলকুমার বালক বয়সেই সে যুগের বিখ্যাত বিখ্যাত লোকদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন। কমলকুমারের মনে সে বয়সের স্মৃতি আজীবন জাগরুক ছিল :

ছেলেবেলাতে আমাদের ব্লকম্যান স্ট্রীটের বাড়িতে, আমরা নিরূপমা দেবী, সরলা দেবী, শরৎ বাবু বহু গণ্যমান্যকে আসিতেন দেখিয়াছি তাহাদের প্রণাম করিয়াছি। তখনকার এই সকল জমায়েত স্মৃতি এবং ঐ সমালোচনা ও লেখা পাঠ আমাদের সর্বসময় জাগাইয়া রাখিয়াছে। ৮

৭/৮ বৎসর বয়সে কমলকুমার ও ভাই নীরদ মজুমদার চব্বিশ পরগণা জেলার বিষ্টুপুর ‘শিক্ষাসংঘে’ ভর্তি হন। কমলকুমার তাঁর শিক্ষাজীবনেও শৈশবের মতোই উচ্ছ্বিংখল বেপরোয়া কিন্তু মেধার পরিচয় প্রদান করেন। স্কুল পালানো, শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি, মারামারি, বাবার হাতের লেখা নকল করে ছুটি নেয়া সবই করেছেন। কিন্তু পড়াশুনায় সর্বত্রই রেখেছেন অসাধারণ মেধার ছাপ। ছোটবোন চিত্রশিল্পী শানু লাহিড়ীর ভাষ্যে :

দাদাদের বয়স তখন ৭/৮ বছর। তখন থেকেই পুলিশের এক ভদ্রলোকের স্ত্রীর কাছে ফ্রেঞ্চ শিখতো। স্কুলে থাকতো না প্রায়ই, পালিয়ে আসতো। খুব বদমায়েস। দুষ্টুমি করতো সবসময়। একবার কি কারণে বোর্ডিং -এ সুপারকে মেরেছিল খাবার টেবিলে। ছুটে আসতে আসতে খাবার টেবিলের সমস্ত খাবার, কাঁচের প্লেটগুলো ছুঁড়তে ছুঁড়তে এসেছিল। সেই স্কুল ছাড়লো। তারপর ক্যাথিড্রাল মিশন স্কুল। সেখানেও এক ইতিহাস। রোজ রোজ বাবার নামে নিজে লিখে চিঠি দিত, স্কুল পালাত। ... তখন দাদা সেভেন কি এইটে পড়ে। তারপর স্কুল ছাড়িয়ে বললেন হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টের কাছে যাও। এক্সপার্ট তো প্রথম দিনেই বললেন এতো অলরেডি এক্সপার্ট। তারপর সেটাও ছেড়ে ঢুকলেন ভবানীপুর টোলে। ৯

এই ভবানীপুর টোল কমলকুমারের জীবনে প্রচণ্ড ছাপ ফেলে। কমলকুমারের জীবনে যে ভগবৎ সাধনা, ব্রাহ্মণ্যচেতনার পরিচয় পাওয়া যায় তার সচনা এ সংস্কৃত টোলে। মা ঠাকুমার প্রভাবে শৈশবেই কমলকুমার ভগবৎ সাধনার দিকে ঝুঁকেছিলেন। এ টোলে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। মাথা ন্যাড়া করে, টিকি রেখে ধর্ম, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য পাঠ করেন। এ সময়কার কথায় শানু বলেছেন :

একদিন দু’ভাই টোল থেকে ফিরে এল ন্যাড়া মাথা, টিকি রেখে। সবাই বলে কি ব্যাপার বাবা মা কেউ মারা গেছেন নাকি। বাবা মাও অবাক। দাদারা বললেন, টোলে পড়লে অমনি টিকি রেখেই পড়তে হবে। দেখ কাণ্ড। অনেকদিন সংস্কৃত পড়ে দু’ভাই। তারপর লেখাপড়ার পাঠ চুকলো। ১০

লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে কমলকুমার পৃথিবীর বৃহত্তর পাঠশালায় নাম লেখান। শৈশবে মায়ের সাথে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন, বাবার সাথে হিমালয়। ভাই নীরদকে নিয়ে সাইকেলে অনেক দর। ১৯৩৪ সালে মুঙ্গেরে ভূমিকম্ হলে নীরদকে নিয়ে রিলিফ টীমের সাথে যাত্রা করেন। এ ভূমিকম্পে মানুষের দুর্দশা কমলকুমার অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন। এ ভূমিকম্পের বর্ণনা কমলকুমার তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা উষ্ণীশ প্রথম সংখ্যায় ছেপেছিলেন। সে বছরই মামাবাড়ি লক্ষ্মৌ আসেন। লক্ষ্মৌ এক বছর ছিলেন। এখান থেকে পরে মুলতান যান। মুলতানে মদ, নিষিদ্ধ পাড়ায় গমন এ সকল অভিজ্ঞতা লাভ করেন। পরের বছরই ১৯৩৬ সালে রাজশাহিতে বেড়াতে আসেন। রাজশাহির খেতুরির মেলায় আউল বাউলদের সাথে মেশেন। পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চলের চাষা মেটেদের সাথে মেশেন। লোককথা, লোকছড়া, বাউলদের শব্দের গঢ়ার্থে ব্যবহার লক্ষ করেন :

এখানে দেখিয়াছি বঙ্গের সর্বত্র হইতে লোক আসিত এবং শব্দ লইয়া আলোচনা হইত। ইস্টিমারের ঢেউ, টেলিগ্রাফ, একমণ (ওজন), স্কুল, আবার কত না গঞ্জ শহরের নাম আসিয়াছে ক্রমাগত সাটে পরিবর্তিত হইতেছে। ১১

তারুণ্যের এ-সময়টা কমলকুমার ভ্রমণ, পত্রিকা সম্পাদনা, নাট্য পরিচালনা ইত্যাদিতে ব্য¯ থাকেন। এসময়ই কাঁচা হাতে লালজুতো, মধু, প্রিন্সেস ছোটগল্প রচনা করেন। এ রচনাগুলোতে কমলকুমারের স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েনি।

যৌবনের সচনায় কমলকুমার জাহাজে এক্সপোর্ট, ইমপোর্ট, মাছের ভেড়ি, ডি. ডি. টি. প্রভৃতি ব্যবসা আরম্ভ করেন। এ সকল ব্যবসায় তিনি সাময়িক সাফল্যও লাভ করেন। হাতে আসে কাঁচা টাকা। এ টাকায় কমলকুমার চূড়ান্তভাবে বেহিসেবি, বিলাসী হয়ে ওঠেন। পোশাকে-আশাকে, চলাফেরায় একেবারে অভিজাত বাবু। এ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন শানু :

পোশাকে-আশাকে দাদা ছিলেন ভীষণ বাবু, স্মার্ট। মার্শেল স্মিথ বলেন যে, জিন্নার পর ভারতবর্ষে এত ওয়েল ড্রেসড ভারতীয় আর দেখেননি। এ সময় প্রচুর টাকা আয় করতেন। আমার দিদির বিয়ের সমস্ত খরচটাই দিয়েছেন দাদা। কত যে ব্যবসা করেছেন তার হিসেব নেই। ডি. ডি. টি. এক্সপোর্ট, ইমপোর্ট, মাছের ভেড়ি, কতকিছু। ১২

চার্লস বার ছিলেন কমলকুমারের প্রিয় অভিনেতা। তখন তিনি কথাবার্তায়, চালচলনে অনুকরণ করতেন বারকেই। এ সময়ই কমলকুমার চলচ্চিত্র, সংগীতের প্রতি মনোযোগী হন। কিন্তু, কমলকুমারের স্বচ্ছল ও এ বাবুভাব বেশিদিন টেকেনি। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তার ঢেউ এসে লাগে কলিকাতায়। ১৯৪১ সালে জাপানি বোমার ভয়ে কমলকুমার পরিবারের সাথে রিখিয়ায় যাত্রা করেন। এ রিখিয়ার প্রভাব কমলকুমারের জীবনে অপরিসীম। এ রিখিয়ার পটভূমিতেই কমলকুমার রচনা করেন পিঞ্জরে বসিয়া শুক (১৩৭৬) উপন্যাস। এছাড়া অসংখ্য ছোটগল্পে রিখিয়ার পরিবেশ পটভূমি ছড়িয়ে আছে। রিখিয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে দয়াময়ী মজুমদার লিখেছেন :

এটি সাওতাল পরগণায়। জায়গাটা বিহারের অন্তর্গত। শাল মহুয়ার জঙ্গল আর কোথাও কোথাও ইউক্যালিপটাসের সারিও দেখা যেত। ছোট বড় টিলা এবং পাহাড়। কিছুদরে ছিল চিলকা হ্রদ। সর্বত্রই লালমাটি খুবই ভাল। ১৩

এ পরিবেশেই কমলকুমার আবিষ্কার করেছিলেন সুঘরাইকে, আর চেঞ্জারে আসা মনিবপত্নী ও তাদের বাবু লোকজনদের। রিখিয়া এ সময় কলিকাতার অভিজাত অনেক জ্ঞানীগুণীজনদের সমাবেশে পরিণত হয়েছিল। তখনতার প্রতিষ্ঠিত কবি বিষ্ণু দে থেকে তরুণ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সকলই রিখিয়ায় এসেছিলেন। রিখিয়ায় তখন গড়ে উঠেছিল এক শিল্পীসংঘ। কমলকুমারের গৃহ অঙ্গনে গড়ে ওঠে প্রেক্ষাগৃহ। কমলকুমার নিজেই দেন ক্যাফে দ্য রেকিও নামে একটি রেঁস্তোরা। সাহিত্যচর্চা, নিত্য আড্ডা আর শরণার্থীদের হৈ হুল্লোড়ে ভরে ওঠে রিখিয়া। কমলকুমারের বোন গীতা ও প্রতিবেশী দয়াময়ী মিলে এখানে প্রকাশ করেন দেয়াল পত্রিকা। সে সত্রে কমলকুমারের সঙ্গে পরিচয় হয় দয়াময়ী মজুমদারের যা প্রেম থেকে পরিণয়ে পরিণত হয় ১৯৪৭ সালে।

কমলকুমার এখানেই পরিচিত হন সাঁওতাল গরীব দুঃখী মানুষজনদের সাথে। সাঁওতাল ব্রাত্যজনেরা তাকেই স্বচ্ছল মানুষ বলে জানে যে বর্তনে খায়, বালিশে ঘুমায়। এ পরিবেশে চেঞ্জারে আসা বাবু লোকজনদের সামনে ছেড়াগেঞ্জি গায়ে, পাখি হাতে দাঁড়ায় পিঞ্জরে বাসায় শুক -এর সুঘরাই।

কমলকুমার এ-সময় (১৯৪১) এফ এ পাশ করেন এবং পরের বছর ১৯৪২ সালে কলিকাতায় আসেন কর্মানুসন্ধানে। কলিকাতায় কমলকুমারের আসা ও কর্মানুসন্ধানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য :

আমি এখন কলিকাতায় একা! কলিকাতায় পাঠ চুকিয়া গিয়াছে। ... সকলে রিখিয়ায় আমি রিখিয়া হইতে এখানে (গরংড়ৎব জড়ধফ) বাতাসাকের বাড়ির পিছনে তিনতলায় এক ঘর ভাড়া করিয়া থাকি - বাতাসাকই ঠিক করিয়া দেয়, রান্নার পাঠ তখন নাই। স্নান করিয়া কর্মানুসন্ধানের পথে খাওয়া সারিতাম নিজামে। ১৪

কিন্তু কমলকুমার মজুমদার তেমন কোনো কাজ পাননি। বেকার কমলকুমার এ সময় শিল্পসাহিত্যের আড্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময় পুরোটাই কাটে আড্ডায়। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজ, খালাসীটোলার মদের দোকান, চিত্তরঞ্জন এভিন্যুর কফি হাউজ, পরিতোষ সেন, বিষ্ণু দে প্রমখ চিত্রশিল্পী কবিদের বাড়ি, সিগনেট প্রেসএবং শেষদিকে চতুরঙ্গ, সুবর্ণরেখা অফিস।

কমলকুমার এ সময় নিজের শিল্পমাধ্যম স্থির করতে পারেননি। চিত্রকলা, নাটক, সংগীত, সাহিত্য বিচিত্র মাধ্যমে বিচরণ করছেন। এ ধারার সমসাময়িকদের সাথে আড্ডায় মিথস্ক্রিয়া করছেন। সবগুলো মাধ্যমের লোকজনের আড্ডায় তিনি মধ্যমনি :

১৯৪২ - ৪৩ সাল থেকে আমাদের আড্ডা সন্ধে বেলায় কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজে বসা শুরু হল। ... আড্ডার নাটের গুরু ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। ১৫

কফি হাউজের আড্ডার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল চলচ্চিত্র। এ আড্ডায় একত্রিত হতেন সত্যজিৎ রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন, পৃথ্বীশ নিয়োগী, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এ আড্ডা থেকেই ১৯৪৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। এ সোসাইটির উদ্যোগে ঘরে-বাইরে ছবি করার পরিকল্পনা করা হয়। পরিচালক হওয়ার কথা ছিল হরিসাধন দাশগুপ্তের এবং সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যের। কমলকুমার শিল্পনির্দেশক :

‘ঘরে বাইরে’ ছবির পরিকল্পনা হচ্ছে জেনে কমলবাবু মেতে উঠলেন। চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে আর কমলবাবু ডিটেল যুগিয়ে যাচ্ছেন। ১৬

কমলকুমারের চলচ্চিত্র নিয়ে পরিকল্পনা ছিল ব্যাপক। এ সময় তিনি ছবি পরিচালনার কথা ভেবেছেন, চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা চলচ্চিত্র (১৯৫০) প্রকাশ করেছেন :

কমলবাবুর নিজেরও ফিল্ম করার ইচ্ছে ছিল। সম্ভবত কোনো কোনো বিশেষ কাহিনীর চিত্ররূপ তিনি কল্পনা করতে ভালবাসতেন। দুটি কাহিনীকে আশ্রয় করে কিছুসময় ও চিন্তাও তিনি ব্যয় করেছিলেন। সে দুটি হল শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’। দুটিরই জন্য নাকি দু’হাজারের উপর ফ্রেমস্কেচ করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে ‘অভাগীর স্বর্গ’র জন্য করা খান পঞ্চাশেক স্কেচ আমাকে দেখিয়েছিলেন। ১৭

১৯৪৮ সালে ফরাসি চিত্রকর আগু¯ রেনোয়ার পুত্র দ্য রিভার খ্যাত জঁ রেনোয়া কলিকাতায় ঐ ছবির শ্যুটিং করতে এলে কমলকুমার তাঁকে ছবির বিষয়ে, ভারতে লোকশান নির্বাচনের বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন, উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি রেনোয়াকে বলেছিলেন :

বাংলাদেশে ছবি করতে হলে হোটেলে থাকলে চলবে না। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে, রাস্তাঘাটে ঘুরতে হবে, রোদে পুড়তে হবে, একপেট খেয়ে গরমকালে বটগাছের ছায়ায় ঘুমোতে হবে, জলে ভিজতে হবে, গঙ্গার রূপ দু’চোখ ভরে দেখতে হবে। ১৮

কিন্তু ১৯৫৫ সালে বন্ধু সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে এবং একই সাথে সুনাম অর্জন করলে কমলকুমার চলচ্চিত্র থেকে হঠাৎ একেবারে সরে আসেন। ছবিটি দেখার পর এমনকি সত্যজিৎ রায়ের সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ করে দেন :

১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাবার পর অনেকবার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও কমলবাবুর মনে ছবিটি দেখা সম্বন্ধে কোন উৎসাহ সঞ্চার করতে পারিনি। ... শেষে একদিন যখন সত্যিই দেখলেন, তখন হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। ১৯

চলচ্চিত্রে সত্যজিতের প্রতিষ্ঠা ও কমলকুমারের সরে আসার ঘটনার মধ্যে দিয়ে কমল মনের গভীর কূটৈষার (পড়সঢ়ষবী) দিকটি ধরা পড়ে।

চলচ্চিত্রে সত্যজিতের প্রতিষ্ঠা কমলকুমারকে ঈর্ষান্বিত করেছিল বলে আমাদের মনে হয়। সত্যজিৎ রায়কে এমনিতে তিনি আড়ালে ঢ্যাঙাবাবু বলে ডাকতেন, এমনকি একদিন সত্যজিৎ উপযাচক হয়ে কথা বলতে গেলে কমলকুমার তাঁকে অপমানসচক উত্তর দেন :

আগে প্রায় সাক্ষাৎ হত; কোন একটা বিশেষ কারণে দীর্ঘকাল ছেদ পড়ে। ভদ্রলোককে দেখে অসুস্থ মনে হওয়াতে জিগ্যেস করলাম কী হয়েছে। বললেন হাঁপানি। তা জন্য কী করেন জিজ্ঞেস করতে বললেন- রাত্তিরে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রশ্ন করলাম চিকিৎসে করান না ? কমলবাবু বললেন- না সাফরিং এর মধ্যে একটা গ্র্যাঞ্জর আছে। ২০

সত্যজিৎ বিশেষ কারণে সম্পžর্কচ্ছেদের কথা বললেও আমরা বুঝতে পারি কারণটি কি। কারণটি সত্যজিৎ পর্বের উদ্ধৃতিতেই বলেছেন - ‘কমলকুমার ছবিটি দেখার পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেন’। সত্যজিতের চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠায় কমলকুমার বুঝেছিলেন এ পথ তাঁর নয়। তাঁর মাধ্যম ভিন্ন, স্বাতন্ত্রের, একক প্রতিষ্ঠার। কিন্তু অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৫৯) উপন্যাস প্রকাশের পর্ব পর্যন্ত কমলকুমার নির্দিষ্ট কোনো শিল্প মাধ্যমে স্থির হতে পারেননি। এসময় তিনি নাট্যচর্চা ও চিত্রকলায় মনোনিবেশ করেন। চিত্রকলা ও ক্রাফট্সের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। যদিও সচেতনভাবে চিত্রশিল্পী হওয়ার কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিল বলে মনে হয় না।

সত্যজিতের পথের পাঁচালী মুক্তি ও কমলকুমারের অন্তর্জলী যাত্রা প্রকাশের পর কফি হাউজে কমল সত্যজিৎ আড্ডা ভেঙে যায়। এরপর খালাসীটোলার মদের আড্ডায় কমলকুমার নিয়মিত হয়ে ওঠেন। তখন পাণ্ডিত্যে জ্ঞানের গভীরতায়, শিল্প সাহিত্যের অড্ডায় তাঁর ঈর্ষণীয় দখল :

খালাসীটোলার সেরা আকর্ষণ ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। তাঁকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল শিল্প মনস্ক অথচ নানান বয়েসী নানান মেজাজের মানুষের সেই যৌথ পরিবার। ২১

এই খালাসীটোলায় তৎকালীন কলিকাতার শিল্প সাহিত্যের বিখ্যাত অখ্যাত সবাই আসতেন। কিন্তু কমলকুমারই এ খালাসীটোলাকে মাতিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। মলত তাঁর জন্যই খালাসীটোলা সাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে :

বস্তুত স্বর্গীয় ও আরাধ্য কমলকুমার মজুমদারের জন্যই খালাসীটোলা বাংলা সাহিত্যে এল খ্যাত হল। ২২

খালাসীটোলা কমলকুমারের জন্য বিখ্যাত হলেও কমলকুমার এখানে বেশিদিন আড্ডা দেননি। খালাসীটোলার আড্ডা ভেঙে যাওয়ার পর কমলকুমারের আড্ডাগুলো মলত হয়ে ওঠে সাহিত্যকেন্দ্রিক। চতুরঙ্গ পত্রিকা অফিস ও সুবর্ণরেখা প্রকাশনা সংস্থা কেন্দ্রিক। এর আগে সিগনেট প্রেসের মালিক দীলিপকুমার গুপ্তের বাড়িতেও আড্ডা বসেছিল। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাট্যদল হরবোলা। এ হরবোলাকে কেন্দ্র করে কমলকুমার নাট্যপরিচালনায় অনেকদিন জড়িয়েছিলেন। কিন্তু ও নাটকেও স্থির হননি। ততোদিনে তাঁর বেশকিছু ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে এবং সাহিত্যেও তাঁর প্রতিষ্ঠাভূমি তৈরি হতে শুরু করেছে। তখন তাঁর আড্ডাগুলো মলত হয়ে ওঠে সাহিত্যকেন্দ্রিক। এ আড্ডাগুলো জমতে থাকে চতুরঙ্গ ও সুবর্ণরেখায়। সর্বশেষ ১৯৫৯ সালে নহবৎ শারদীয় সংখ্যায়অন্তর্জলী যাত্রা প্রকাশিত হলে সাহিত্যে কমলকুমারের স্বতন্ত্রপ্রতিষ্ঠাভূমি নিশ্চিত হয়ে যায়।

কমলকুমার অর্ধজীবন ক্ষ্যাপার মতো পৃথক প্রতিষ্ঠাভূমির, শিল্পমাধ্যম, মাধ্যমের রূপ ও রীতি পরশ পাথরের মতো খুঁজছিলেন। সাহিত্যই তাঁর সে যথার্থ স্থান হয়ে ওঠে। কিন্তু সাহিত্যে এ নতুন রূপরীতি, স্বাতন্ত্রিক স্বর খুঁজে পাওয়া কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। এর পেছনে কমলকুমারের পর্ব বর্ণিত ঘটনাবলি, দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি ও সন্ধান যেমন ছিল, তেমনি ছিল সমসাময়িক রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক, সাহিত্যিক ও বৈশ্বিক পটভূমি।

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার কর্তৃক পোলান্ড আক্রমণের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সচনা হয়। এ যুদ্ধের সাথে ভারতবর্ষের সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন যখন প্রতিরোধে সক্রিয় যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন ভারতের ভাগ্য এর সাথে সরাসরি জড়িয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে ভারতও যুদ্ধরত হিসেবে পরিগণিত হয়। বিশেষত, ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে জাপান যখন কলিকাতায় বোমাবর্ষণ শুরু করে তখন কলিকাতাবাসী তথা বাঙালিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গ তথা কলিকাতায় বিচিত্রমুখি ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভারতের স্বাধীনতা স্পৃহা চূড়ান্তরূপে প্রকাশিত হয়। কিন্তু স্বাধীনতার প্রশ্নে, বিশ্বযুদ্ধ প্রশ্নে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, সুভাষ বসুর ফরোয়ার্ড ব্লক ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এমনকি পারস্পরিক বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে। কলিকাতার রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে। একই সময় দেখা দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বিপাক :

উনিশ’শ বিয়াল্লিশ এর আগস্ট আন্দোলন, ডিসেম্বরে জাপানীদের কলকাতায় বোমা বর্ষণ ইত্যাদির পর থেকে বর্হিবিশ্বে যেমন যুদ্ধে গতি জার্মানীর বিরুদ্ধে তীব্র হয়ে ওঠে, তেমনি ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে তা একাধিক বিদ্রোহ-বিপ্লবে, সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতায়, শাসকগোষ্ঠী পর্যুদস্ত হতে থাকে। এর মধ্যে আসে খরার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দামোদরে বন্যা, মেদিনীপুরে প্রচণ্ড সর্ববিধ্বংসী ঝড় এবং বৃটিশ শাসকের ও তার ক্রীড়নক নির্বাচিত সরকারের অব্যবস্থা ও দুর্নীতিগ্র¯তার পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে খ্যাত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, মহামারী। ২৩

যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, বেকার সমস্যা দেখা দেয়। হাজার হাজার লোক গ্রাম ছেড়ে কলিকাতায় এসে ভীড় জমাতে থাকে। এ বুভুক্ষু, নিরাশ্রয়, নিরন্ন মানুষের ছবি কমলকুমারের মনে গভীর ছাপ ফেলে। বিশেষত, দুর্ভিক্ষ ও সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা কমলকুমারের জীবন ও সাহিত্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

খেলার প্রতিভা উপন্যাসে নিরন্ন-ভূখা মানুষের যে শহরমুখি স্রোতের বর্ণনা, ‘ফ্যান দাও’ বলে যে আর্তনাদ আমরা পাই তা এ সময়েরই করুণচিত্র। কমলকুমার রাজনীতিকে খুব অপছন্দ করতেন। চিঠিতে লিখেছেন :

আমার বিষয়েতে বলিয়া থাকি, যাহাতে আমার বিশ্বাস, যে কোন রাজনীতিতেই আমি বিশ্বাস করি না (নিশ্চয়ই রাজনীতি লইয়া গল্প বলি বা করি) উহা পাজী বলিয়া আমার গ্রাম্য ধারণা। ২৪

কিন্তু পাজী রাজনীতির বিষফল তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। বিশেষত, ১৯৪২ -এর আন্দোলন, ৪৩ ও ৪৬ সালের সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা কমলকুমার বিষাদ ও ক্ষোভ নিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন :

আমি ৪২ দেখিয়াছি যেদিন আমার পরনে মানে গলার টাই খুলিয়া পুড়াইয়া দিল, পথে সেদিন মেশিন গানিং হইল, গুলি অনবরত চলিতে থাকে, তাহা ব্যতীত রায়েট যে কি অর্থাৎ কি হিন্দু কি মুছলমান শালারা যে কি দুশ্চরিত্র হইতে পারে আর ইংরেজ বাঞ্চতরা যে কি শয়তান, কতবড় হারামী। ২৫

এই যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, তৎকালীন কলিকাতায় শিল্পীদের মনে গভীর দাগ ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সারা বিশ্বব্যাপী শিল্পসাহিত্যের রূপ বদলে ফেলে। ধর্ম, নৈতিকতা, মানবিক বোধে নামে ধস। এ পরিবর্তন শিল্প-সাহিত্যের বিষয় ও প্রকরণকেও বদলে দিয়েছিল। এই নব উত্থিত বা¯বতায় শিল্পসাহিত্যের স্বরূপ কি হবে এ প্রশ্ন সকল শিল্পীর মনে জেগেছিল। ১৯৪৪ সালে গঠিত হয়েছিল ক্যালকাটা গ্রুপ। এর শিল্পীরা তখন সরে এসেছিলেন বেঙ্গল গ্রুপের ছবির স্নিগ্ধতা, পেলবতা থেকে। কমলকুমার ছিলেন এ ক্যালকাটা গ্রুপের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি, সাহিত্যের রূপ নিয়েও তাঁদের ভাবতে হয়েছিল :

যুদ্ধের কলকাতা, মন্বন্তর, মুদ্রাস্ফীতি, গোরা সৈনিকের দাপট, ব্লাক আউট জর্জরিত ভারতবর্ষের বর্তমানিকতার রূপায়ণে শিল্পকলার রূপ কেমন হবে, নবোদ্ভূত সমাজ সমস্যা রূপায়ণে আধুনিক শিল্পকলার ভূমিকা কী হবে -এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সম¯ শিল্পীকে বলাবাহুল্য কমলকুমারকেও। তেমনি রাস্তা নির্ধারণের ক্ষেত্রও তিনি ছিলেন পুরোধা। ২৬

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপে অনেকগুলো শিল্প আন্দোলনের সচনা হয়েছিল। কমলকুমার এ সম্পূর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু, সম্ভবত প্রভাবিত হয়েছিলেন একটি আন্দোলনের দ্বারা। আন্দোলনটি ঠিক বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল নয়। তবে, অনেকটা অভিঘাত পরবর্তী সাহিত্যচেতনার পালাবদল। আন্দোলনটি হল ফরাসি উপন্যাসের নতুন নভেল (ঘড়াঁবধঁ জড়সধহ) আন্দোলন। যদিও এ আন্দোলন নিয়ে কমলকুমার স্বভাবগতভাবেই নাক উঁচু করে কথা বলেছেন। কিন্তু প্রভাব অবশ্যম্ভাবী ছিল:

বিদেশে (ফ্রান্সে) নতুন নভেল ১৯৫৫ হইতে এক ধয়া উঠিয়াছে। এখানে কোথাও অন্যকিছু দিয়া পাতাভর্তি হইয়াছে। ২৭

কিন্তু কমলকুমার এখানে নতুন নভেল আন্দোলনকে অনেকটা উড়িয়ে দিলেও তাঁর বা¯ব আচরণ ও কাজ চরিত্রগত স্ববিরোধীতাকেই প্রমাণিত করে।

কমলকুমারের সাথে এ আন্দোলনের পুরোধা নাতালি সারোৎ ও ক্লদ সিঁম -এর পত্র যোগাযোগ ছিল। কমলকুমার তাঁর সহোদর শিল্পী নীরোদ মজুমদারের মাধ্যমে এদের লেখা সংগ্রহ করেছেন, যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। ১৯৭০ সালে নাতালী সারোৎ (ঘধঃযধষর ঝধৎৎধঁঃব) কলকাতায় এলে লোকনাথ ভট্টাচার্যের বাসায় কমলকুমার তাঁর সাথে কথা বলেন। শুধু কথা নয় কমলকুমার ফরাসি ভাষায় সারোতের সাথে নতুন নভেল আন্দোলন ও ফরাসি সাহিত্য নিয়ে গভীর আলোচনা করেন :

ফরাসি ‘নব উপন্যাসে’ (যার পুরোধায় ছিলেন নাতালী সারোৎ, যেটা আন্দোলন হিসেবে আজ ইতোমধ্যে সমাপ্ত ও তাই সাম্পূ্রতিক ইতিহাসের পর্যায়ভুক্ত মাত্র) নরনারীর প্রেমের প্রতিফলনের প্রকৃতি নিয়ে এবং আলোচনার সত্রে কমলকুমার তখন নাতালী সারোতের সঙ্গে তুলনামলকভাবে মার্গারিৎ দুরাস (গধৎমঁবৎরঃঃব উঁৎধং) প্রসঙ্গে পাড়েন - আমি তো কোন ছার, চমকে যান নাতালী সারোৎ নিজেও এবং ঐ সভায় সারোৎ কমলকুমারের আলোচনায় স্বীকার করেন তিনি মার্শেল প্রু¯ ও ভার্জিনিয়া উলফ দ্বারা প্রভাবিত। ২৮

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি কমলকুমার কত গভীরভাবে সারোৎ তথা নুতন নভেল আন্দোলনের রচনাপাঠ করেছিলেন।

হেনরি পিয়ের ঈড়হঃবসঢ়ড়ৎধৎু ঋৎবহপয খরঃবৎধঃঁৎব গ্রন্থে ঘড়াঁবধঁ জড়সধহ আন্দোলন সম্পর্কে যে কয়টি লক্ষণের কথা বলেছেন তার মধ্যে অন্যতম হল এ আন্দোলনের লেখকরা পর্ববর্তী সম¯ সাহিত্য সৃষ্টি অস্বীকার করেছিলেন। উপন্যাসে ঘটনা বা কাহিনী নয় সক্ষ্মাতিসক্ষ্ম বর্ণনাই হয়ে উঠেছিল প্রধান। এ কাজে তাঁদের প্রধান অবলম্বন ছিল ভাষা। ভাষার প্রচলিত কাঠামো, বাক্য বিন্যাসরীতি, বিরামচিহ্ন কোনো কিছুই রক্ষা করতে চাননি তাঁরা। তাঁরা উপন্যাসে বিষয়ের চেয়ে ভাষাকে গুরুত্ব দেয়ায়, তাঁরা ঔপন্যাসিকের বদলে একেকজন হয়ে উঠেছিলেন ভাষার কারিগর।

কমলকুমারের রচনারীতি ও সাহিত্যভাবনায় এ লক্ষণসমহ দেখতে পাওয়া যায়। কমলকুমারের সমকালে আরো কয়েকটি আন্দোলনের মধ্যে উলে¬খযোগ্য হচ্ছে হাংরি জেনারেশন। কিন্তু, কমলকুমারকে প্রভাবিত করার মতো মেধাবী ঐ আন্দোলনে ছিল না। এলেন গিন্সবার্গ কলকাতায় এলেও তিনি তাঁকে গুরুত্ব দেননি। কমলকুমার বরঞ্চ পর্ববর্তী চিত্রকলার কিউবিজম আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বলেছেন:

আমি ঠিক এনালিটিক কিউবিজমের পক্ষপাতী। ২৯

কিউবিস্ট শিল্পীরা বস্তুর পরিচিত ফর্ম ভেঙে তাদের অন্তর্নিহিত বা¯বতাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ফলে কিউবিস্ট আন্দোলন যেমন ফর্মসর্বস্ব হয়েছিল তেমনি কমলকুমারের রচনায় ও প্রকরণসর্বস্বতা লক্ষ করা যায়। এছাড়া ইমেপ্রেশনিজম আন্দোলনও তাঁকে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে হয়। বস্তু বা প্রকৃতিকে ভিন্ন আলোয় ভিন্নভাবে দেখার কৌশল কমলকুমারের রচনায় লক্ষ্যযোগ্য। কলিকাতার ষাট দশকের হাংরি জেনারেশন, শ্রুতি, ধ্বংসকালীন কবিতা আন্দোলন, নিউলিত ম্যুভমেন্ট প্রভৃতি কাব্য আন্দোলন ও ছোটগল্পে নতুনরীতি, শাস্ত্রবিরোধী, নিম সাহিত্য প্রভৃতি আন্দোলন অনেক অর্বাচীন। কমলকুমারকে সম্ভবত এ আন্দোলনগুলো প্রভাবিত করেনি। তবে, অপেক্ষাকৃত তরুণ এদের অনেকের সাথে কমলকুমারের আলাপ ও মিথস্ক্রিয়া হয়েছিল।

কমলকুমার তাঁর সমকাল, সমকালের প্রত্যক্ষ কল্লোল ও কোলাহল দ্বারা যতটা না প্রভাবিত হয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন পরোক্ষ তথা অধীতবিদ্যার মাধ্যমে। কমলকুমারের একাডেমিক পড়াশুনা যতই হোক না কেন, তার অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার ব্যাপ্তি ও বিশালতা নিয়ে সমকালীন বুদ্ধিজীবী মহলে বিস্ময়ের সীমা ছিল না।

লোকনাথ ভট্টাচার্য, অশোক মিত্রের মতো পণ্ডিতজন তো বটেই বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দের মতো বিশ্বসাহিত্যের পাঠকরা পর্যন্ত তার পঠনবিশ্ব সম্পর্কে বিস্ময় জ্ঞাপন করেছেন। অশোক মিত্র সাক্ষাৎকারে বলেছেন :

প্রশ্ন : কমলকুমারের শিক্ষাগত যোগ্যতা এমন কিছু ছিল না। তিনি কি কুণ্ঠিত হতেন আপনাদের মত উচ্চশিক্ষিত মানুষদের সাথে মিশতে ?

উত্তর : তাঁর মতো শিক্ষিত মানুষ আমি দেখিনি। তাছাড়া তার কতদর পড়াশুনা কখনো জিজ্ঞাসা করিনি। করার দরকার মনে হয়নি। ফরমাল এডুকেশন বেশি ছিল না, কিন্তু তিনি জানতেন না কী ?

... কমলবাবু জিনিয়াস। অসাধারণ পাণ্ডিত্য এমন মানুষ কয়েকটিই দেখেছি। দু’একজনকে দেখেছি। তার সঙ্গে তর্ক করতে যাবে এমন সাহস কার আছে এমন পাণ্ডিত্য। ৩০

কমলকুমার শৈশব থেকেই ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন, টোলে শিখেছিলেন সংস্কৃত। এছাড়া ইংরেজি, বাংলা ভাষায় দক্ষতা তো ছিলই। সংস্কৃত ও বাংলা জানার কারণে ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্য পাঠের দ্বার অবারিত হয়েছিল। এবং ফরাসি ও ইংরেজির কারণে বিশ্বসাহিত্য। কিন্তু, কমলকুমারের এ বিশাল পঠনবিশ্বের বিস্তৃত বর্ণনা কোথাও আমরা পাই না, মাঝে মাঝে বিভিন্ন রচনাকর্মের উলে¬খে ক্ষীণ আলোকিত হই। তবে, শেষ বয়সে নির্বাচিত বই শিরোনামের একটি রচনায় তার প্রিয় বই ও ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছিলেন। এ তালিকাটি কমলমানস উপলব্ধির জন্য জরুরি। অন্যান্য রচনার মতো ‘মাধবায় নম’ ‘তারা ব্রহ্মময়ী’ বলে রচনার সচনা। রামকৃষ্ণ ও রামপ্রসাদ ভক্তি, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগরের ভাষা তথা কমা, সেমিকোলন পর্যন্ত ভালোলাগার বিষয়টি তাৎপর্যপর্ণ। কমলকুমার ভাষা প্রসঙ্গ, বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গ আমরা পরবর্তী অধ্যায়সমহে আলোচনা করব। কিন্তু, কমলমানস গঠনে স্বস্তিবচন, রামকৃষ্ণ, কেশব চন্দ্র, রামপ্রসাদ ভক্তি প্রসঙ্গ এখানে আলোচনার দাবি রাখে।

কমলকুমার তাঁর প্রথম সার্থক উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রার ভূমিকাতে লিখেছেন :

এই গ্রন্থের ভাববিগ্রহ রামকৃষ্ণের, ইহার কাব্যবিগ্রহ রামপ্রসাদের। রামপ্রসাদ আমাদের শুদ্ধ মন আনিয়া দেন। (অ. যা. ভূমিকা)

খেলার প্রতিভা উপন্যাসের সচনায় লিখেছেন :

মাধব যে তুমি মহাপ্রভুতে, মাগো যে তুমি বর্গভীমা, ঠাকুর জয় রামকৃষ্ণ। যে এখন আমরা এখানেতে নিজেরে বিহারিব; যাহা ঘটিল, তাহারে নির্মাণ করি; এবং এই অভিমান ভূয়া না হউক, যে মানে, আমাদের বোধিত হনের যেমন ধারা, যেমন প্রকৃতি, যেমন উপাদান, যেমন ভিৎ তাহা এইটিতে উলে¬খিত থাকিবেক; যে আমরা হই অতীব সরল, যেইটি হয় আমাদের সব। (খ. প্র. পৃ. ৩৪৫)

রচনার শীর্ষে এই স্বস্তি বচন, মা তারাময়ী বন্দনা, কিংবা রামকৃষ্ণের প্রতি ভক্তি সাহিত্যে প্রভূত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কমল সমালোচক তাঁকে পৌত্তলিক বলে আখ্যায়িত করেছেন :

... ভারতীয় পৌত্তলিক চেতনা কমলকুমারের রচনায় চালিকাশক্তি। কমলকুমারের চৈতন্য ও রামকৃষ্ণের আস্থা এবং হিন্দুত্বের ধারণার কেন্দ্রবিন্দু এই পৌত্তলিক জীবন দর্শন। ৩১

নবনীতা দেবসেন কমলকুমারের ভাষা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং এ চর্চাকে প্রায় বাতুলতা বলেছেন। কিন্তু, তিনি ভাষাকে নষ্ট করার জন্য নয়, ভাষার মাধ্যমে কমলকুমার যে ভাব ব্যক্ত করেছেন তাকে বলেছেন প্রতিক্রিয়াশীল :

বাংলা ভাষার গায়ে আলতো ঢিল ছুঁড়ে কমলকুমার কোনদিন বাংলা ভাষার ক্ষতি করতে পারবেন না। কিন্তু তার ভাষার অন্তরালে যে ভাবধারাটি প্রবাহিত, যে মল্যবোধ নিহিত, তা সমাজের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক হতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাটি প্রগতি বিদ্বেষী ইতিহাসবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল। ৩২

কিন্তু এতদিনের কমলকুমার-চর্চায়, কমল রচনা পাঠে একথা প্রতিনিয়তই প্রতিভাত হচ্ছে সমালোচকদের এ অভিমত অনেকটাই খণ্ডিত। আমাদের বিবেচনায় কমলকুমারের এ স্বস্তিবচন লেখা, রামকৃষ্ণ বা তারাময়ীর নাম নেয়া অনেকটাই নতুন সাহিত্য সংরূপ নির্মাণের প্রয়াস। এর সাথে চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকতে পারে মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রকরণ বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের বা রোমান্সধর্মী প্রণয়োপাখ্যানের কবিগণ কাজের শুরুতে দেবী বা আল্লাহ, নবী, পীর ফকিরের নাম বন্দনা করেছেন। চর্যাপদেও এ ভণিতা দুর্লক্ষ নয়। এ হিসেবে কমলকুমারের গদ্য রচনায় নতুন রূপে এ ঐতিহ্য গ্রহণ অস্বাভাবিক নয়।

অপরপক্ষে, বাংলা সাহিত্য পশ্চিমা সাহিত্য বিশেষ করে, ইংরেজি সাহিত্য প্রভাবিত যে আধুনিকতার সচনা ও বিকাশ, কমলকুমার তার ঘোর বিরোধী ছিলেন:

কমলকুমার মনে করেন যে ভারতবর্ষে ইংরেজ আগমন, উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক নবজাগরণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্ষতিকর জীবনযাত্রার প্রতিবাদে তিনি গ্রহণ করেছেন রামপ্রসাদ, ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিমের ধর্মবোধকে; রামপ্রসাদ ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ লোকায়ত জীবন চর্চায় প্রজ্ঞামথিত অভিজ্ঞতায় তিনি আলোড়িত। ৩৩

পশ্চিমা, বিশেষত ইংরেজি উপন্যাসতাত্ত্বিক ও তত্ত্বকেও তিনি অপছন্দ করতেন। উপন্যাসতাত্ত্বিক ই. এম. ফরস্টার কমলকুমারকে চিঠি লিখলে তিনি গুরুত্ব দেননি। তাঁর সম্পর্কে অন্যত্র লিখেছেন :

একবার এখানে মি: ই. এম. ফ্রসটার এক লেখকের বাড়িতে আসেন। কালীঘাটের পাণ্ডার মতন তখনকার লেখকদের দেখি ফিরিঙ্গি ধরিতে। আমরা কহিলাম ঐ লেখককে যাহার গৃহে ঐ ইংরেজ লেখক আসেন, মহাশয় উহাকে কি প্রশ্ন করিবেন, রবিবাবুকে কেন তামাশা করিয়াছেন - এবং উনিই বা নিজে কি পদের লেখক ... উহারা ভাবে ইংরাজই সব। ৩৪

একথা ঠিক, প্রবল স্বাতন্ত্র্যবোধ, ইতিহাস ঐতিহ্য সচেতন, শেকড়চারী কমলকুমার ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসন ও শিল্প-সংস্কৃতিতে পশ্চিমা আধুনিকতা পছন্দ করেননি। সেজন্য ভারতীয় লোকায়ত ঐতিহ্য-প্রয়াসী কমলকুমার স্বভাবতই রামমোহন পর্ববর্তী বাংলা শিল্পসাহিত্য উত্তরাধিকারকেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছেন এবং সে ঐতিহ্যকে সাহিত্যে পুনর্জাগরণের চেষ্টা করেছেন। এ পুনর্জাগরণের পুননির্মাণের একটি অংশ হতে পারে এ স্বস্তি বচন, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ।

রামমোহন থেকে কল্লোলের কোলাহল পর্যন্ত যে বাংলা সাহিত্য তা মলত পশ্চিমা সংস্কৃতিশাসিত। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ত্রিশের কবি ও ঔপন্যাসিকবৃন্দ যে পথ বেছে নিয়েছিলেন কমলকুমারের পথ তাঁদের থেকেও ছিল ভিন্ন। এক্ষেত্রে, রবীন্দ্র উপন্যাসের উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের স্থানে কমলকুমার প্রান্তিক ব্রাত্যজন, রবীন্দ্রনাথের নিরাকার পরমব্রহ্ম, জীবনদেবতার স্থানে কমলকুমার মা আনন্দময়ীকে বেছে নিয়েছিলেন। ত্রিশ দশকের কবি, ঔপন্যাসিকরা রবীন্দ্র বিরোধিতায় যেখানে ঈশ্বরকে অস্বীকার, অস্তির স্থানে নেতিকে গ্রহণ করেছেন, কমলকুমার সেখানে করেছেন বিকল্প শক্তি গ্রহণ। এক্ষেত্রে কমলকুমার গ্রহণ করলেন লোকায়ত সংস্কৃতি, জীবনবোধ ও ধর্মচেতনাকে। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে কমলকুমারের স্বাতন্ত্র্য তুলনারহিত, একক, অদ্বিতীয়, বিতর্কে কণ্ঠকাকীর্ণ নিঃসঙ্গ নির্মাণ।

কমলকুমার তাঁর জীবদ্দশায়ই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি পুরুষ। আড্ডায়, পাণ্ডিত্যে, রসিকতায়, পরনিন্দা, পরচর্চায় ও নতুন নতুন কাহিনী সৃষ্টিত তিনি নিজেই কাহিনী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। পরনিন্দা, পরচর্চা ও অপরের চরিত্রহরণকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্প পর্যায়ে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রবীন্দ্রনাথ, সমকালীন কবি বুদ্ধদেব বসু থেকে অনুজপ্রতিমদেব নিয়েও তিনি ঠাট্টা রসিকতা করতেন। কিন্তু আড়ালে যাকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করতেন দেখা গেল কাজের ক্ষেত্রে তিনি তাকেই সম্মান করছেন। সামনে এলে সম্মান করে কথা বলছেন। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ বলেছেন:

... আপাতবিরোধী এতগুলো দিক তার মধ্যে ছিল যেমন আর কোন মানুষের মধ্যে দেখিনি। ৩৫

রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন বলে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘বেম্মো’ বলে অবজ্ঞা করতেন। অথচ শানু লাহিড়ী বলেছেন কমলকুমার প্রায় সময় হেলেদুলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে ছবি বানানোর কথা ভেবেছেন, রবীন্দ্রনাথের নাটক অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মঞ্চায়ন করেছেন :

তিনি রামকৃষ্ণ বলেই ব্রাহ্মদের বিরোধী, যে কারণেই রবীন্দ্রনাথকেও বেম্মো বলে অবজ্ঞা দেখান, অথচ মুক্তধারা অভিনয়ের সময় তিনি স্থির করেছিলেন একটি শব্দ ও বাদ বা বদল করা চলবে না। ৩৬

সত্যজিৎ রায় ছিলেন কমলকুমারের অন্যতম বন্ধু, গুণগ্রাহী। তাঁরা দু’জনে মিলে ফিল্ম সোসাইটি করেছেন, ছবি পরিচালনার পরিকল্পনা করেছেন। সত্যজিৎ ব্রাহ্ম হওয়ায় হিন্দুদের অনেক সংস্কৃতি সংস্কার জানতেন না। পথের পাঁচালী তৈরির সময় বল্লালী বালাই ইন্দিরা ঠাকুরণ চরিত্রে সে হিন্দু সংস্কারগুলো আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন, ডিটেল যুগিয়েছেন। অথচ, আড়ালে তিনি সত্যজিৎকে ঢ্যাঙাবাবু ডাকতেন। পথের পাঁচালী মুক্তি পাবার পর দেখতে পর্যন্ত নারাজ ছিলেন। সত্যজিতের চলচ্চিত্র নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী মাতামাতি তখন কমলকুমার তার চলচ্চিত্র জ্ঞান নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। খালাসীটোলার মদের আড্ডায় উদয়ন ঘোষের সাথে আলাপ চারিতায় বলেছেন :

১. কমলদা, এতযে প্রশ্ন করি আপনাকে, বিরক্ত হন না তো ?

২. আমি তো ছাত্র, উত্তর দানে ছাত্রকে কি বিরক্ত হলে চলে ?

৩. আরেকটা প্রশ্ন করি ?

৪. করুন, ঠাকুর।

৫. ছবি আর চলচ্চিত্রে কি তফাৎ ?

৬. এ প্রশ্ন তুমি ঢ্যাঙ্গাকে কর ....

৭. ঢ্যাঙ্গা ?

৮. ঢ্যাঙ্গা চেনো না ? তোমাদের হরবোলার মানিকবাবু। ৩৭

কিন্তু কমলকুমার অপর কারোমুখে সত্যজিতের নিন্দা সহ্য করতে পারতেন না।

বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত ও বুদ্ধদেব বসুর সাথে তার ছিল প্রীতি-শ্রদ্ধার সম্পর্ক। সুধীন দত্ত রিখিয়ায় গেলে কমলকুমারের বাড়িতেই উঠতেন। রিখিয়ায় সুধীন দত্তের জন্য অধীর আগ্রহ অতিথির জন্য ঘরদোর ঝাড়মোছার কথা কমলকুমার নিজের চিঠিতেই লিখেছেন। অথচ সুধীন দত্ত সম্পžর্কে আড্ডায় বলেছেন :

বুঝলেন বাবু আপনাদের সুধীন দত্ত একটা চোর। ৩৮

ত্রিশ-চল্লিশ দশকের কবি সাহিত্যিকদের সম্পর্কে কমলকুমারের ধারণা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তিনি তাঁদের পাশ্চাত্যমুখিতাকে এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে অজ্ঞতাকে বিচিত্র স্থানে সমালোচনা করেছেন। ত্রিশের কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে এবং ত্রিশ-চল্লিশের দশকের কবিদের সম্পর্কে তাঁর ধারণার পরিচয় :

ঘটনা বলি, একদিন কয়েক বছর পর্বে ইন্দ্রনাথের দোকানে বসিয়া আছি হঠাৎ আমাদের সে প্রশ্ন করিল কাহার কাহার মহাভারত ইংরেজিতে আছে। আমরা কহিলাম কেন? কোন ... মেটে ফিরিঙ্গি এ টুকু বলিতেই সে নিুকণ্ঠে কহিল ‘অমুকের’ লোক দাঁড়াইয়া আছে এবং মাস কয়েক পর শুনিলাম তিনি মনোজ্ঞ মহাভারত কথা লিখিতেছেন। এরূপ আমাদের দেশীয় পণ্ডিত। ৩০-৪০ এর কবি পণ্ডিতরা ইদানিং উপনিষদ চর্চা করিতেছে ইহারা জবর প্রগতিশীল সাম্যবাদী। ইহারা আমাদের পর্বগামী। আমরা ইহাদের নিকট কিছুই পাই নাই। ৩৯

আমরা বুঝতে পারি এ মনোজ্ঞ মহাভারত কথার লেখক বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু কমলকুমারকে তাঁর বই উপহার দিলে সে বই কমলকুমার টেবিলের নড়াচড়া বন্ধ করার জন্য পায়ার নিচে রাখার কথা বলেছেন। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদকে বলেছেন উড়ি অনুবাদ এবং শাটুলকে দিয়ে মদ্যশালায় এ আবৃত্তি সকলকে শুনাবেন বলেছেন। অথচ বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে রেখো মা দাসেরে মনে শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। এ প্রবন্ধ যখন প্রেসে ছাপা হয়, তখন প্রেসে প্রুফ দেখতে গিয়ে বলেছেন, এ লেখাটি বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে লেখা কোথাও যেন ভ্রান্তি না থাকে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় পংক্তি থেকে নিজের ছোটগল্পের শিরোনাম রেখেছেন। øেহাস্পžদ কবিদেরও সমালোচনা করেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছেন:

একদিন শক্তিকে (চট্টোপাধ্যায়) ইন্দ্রের দোকানেতে ধরিয়াছি, বল, বাঙলার পদ্য বল। মোটামুটি নাম বল এবং একের পর তা চর্যা হইতে বৈষ্ণব পদাবলী, রামপ্রসাদ, ঈশ্বরগুপ্ত, মধুসদন, বলদেব। তবে শক্তি বেচারা স্বীকার করিল যে সে জানে না। ৪০

কমলকুমার রাজনীতি বিমুখ ছিলেন। অথচ রাজনীতির সকল বিষয়েই সজাগ ছিলেন। রাজনৈতিক সংকটে কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মর্মস্পžর্শী ভাষায় লিখেছেন পর্ব বাংলার সংগ্রাম বিষয়ে। শোষিত, প্রান্তিকজনদের নিয়ে সারাজীবন লিখেছেন। তার বন্ধু, ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই ছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির। অথচ কমিউনিস্ট পার্টি ও এ সম্পর্কিত রচনার বিষয়ে তিনি অসহিষ্ণু ছিলেন। তাঁদের চরিত্র হননে তৎপর ছিলেন :

কফি হাউজের স্মৃতির মধ্যে কমলবাবুর কথার ধারের কথাটাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। জনৈক বামপন্থী কবি সম্বন্ধে তার মন্তব্য হল - ভদ্রলোক সোশ্যাল কনটেন্ট না থাকলে নস্যি নেন না। চাষী মজুরদের হাল সম্পর্কে শহরের মার্কসিস্ট বাবুরা উৎকণ্ঠিত সে কথা চাষী মজুর জানে কী ? কমলবাবুর ভাষায় - ব্যাঙের একটা ল্যাতিন নাম আছে ব্যাঙ তা জানে কি? ৪১

কমলকুমারের এই আপাত স্ববিরোধ, চরিত্রের প্যারাডক্স ও কমপ্লেক্স -এর ভেতরই লুকিয়ে আছে কমলমানসের মল রহস্য।

কমল জীবনীকার হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন এটা কমলকুমারের মুখোশ। সত্যজিৎ রায় লিখেছেন :

তিনি যেন অত্যন্ত সাধারণভাবেই একটি রুক্ষ অমার্জিত, আটপৌরে চেহারায় নিজেকে সবার সামনে হাজির করতেন। ৪২

এই স্ববিরোধী, রুক্ষ অমার্জিত চেহারা কমলকুমারের জন্য অবশ্যম্ভাবী ছিল। আমাদের বিবেচনায় কমলকুমারের রচনার বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যতাঁর এ স্ববিরোধী, রুক্ষ, অমার্জিত চেহারার রহস্যের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্বে কমলকুমারের সাহিত্যে আগমন, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেয়া সঙ্গত কারণেই জরুরি।

পর্বেই আমরা উলে¬খ করেছি কমলকুমারের পরিবার ছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের। শৈশবেই তাঁদের পারিবারিক পরিমণ্ডলে সাহিত্য নাটক চর্চার রীতি ছিল। সে রীতিতেই তিনি শৈশবে নাটক চর্চায় জড়িত হন।

১৯৩২ সালে দুর্গাপজায় প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করেন রিখিয়ায়। নাট্যকার ও পরিচালক কমলকুমার নিজেই। ১৯৩৭ সালে ৮, রামময় রোড, ভবানীপুর থেকে উষ্ণীষ, সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প লালজুতো প্রকাশ করেন, দ্বিতীয় সংখ্যায় মধু ও তৃতীয় সংখ্যায় প্রিন্সেস গল্প প্রকাশ করেন। আমরা জানি এ গল্পগুলো অত্যন্ত সাধারণ মাপের। লালজুতোয় ক্ষীণ হলেও অন্য দুটো গল্পে কমলকুমারের পরবর্তী রচনা সম্ভাবনার কোন ছিটেফোটাও ধরা পড়েনি। কাহিনীবিন্যাস, চরিত্রায়ন ও ভাষা সবই অত্যন্ত সাদামাটা, তরল, সমকালীন গল্পের তুলনায়ও দুর্বল।

কমলকুমার স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যে ন্যূনতম দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। এমতাবস্থায়, তিনি মলত জড়িয়ে পড়েন ব্যবসা ও চাকরির খোঁজে। কোনোটাই তাঁর হয়নি। ফলাফল অবসর আড্ডা। এ বিষয়ে পর্বেই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ সময় তিনি চলচ্চিত্র ও নাটক চর্চায় মেতে ওঠেন। সম্ভবত প্রিন্সেসও মধু গল্পের সমকালে রচনা করেন শবরীমঙ্গল উপন্যাস। উপন্যাসটির দুর্বল গঠন, ভাষা ও গাঁথুনি তারি সাক্ষ্য বহন করে। এর কোনোটিই তাকে সাফল্য এনে দেয়নি। স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত হওয়া তো দরের কথা। দীর্ঘ বিরতির পর ১৩৫৫ সালে সাহিত্যপত্র পত্রিকায় প্রকাশ করেন গল্প জল। এ জল গল্পে কমলকুমারের নিজস্বতা প্রথমে ফুটে ওঠে। এ গল্পের :

‘কানাই’ কানাই হয় তার নাম। সে ফজল মোল্লা নয় এবং যে ফজল হয় ভাল লোক পরের ধান কাটে না, কেননা খোদা তার উপর দয়া রাখেন। (জল)

গল্পের প্রথম বাক্যই কমলকুমারের উপস্থিতি আমাদের জানিয়ে দেয়। চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় এ গল্প সম্পর্কে লিখেন বাংলা গদ্যে চিত্র। তারপর প্রকাশিত হয় একে একে তেইশ ও মল্লিকা বাহার গল্পদ্বয়। জল, তেইশ ও মল্লিকা বাহার গল্প বাংলা সাহিত্যে কমলকুমারকে অনেকটা স্বাতন্ত্রে চিহ্নিত করে দেয়। কিন্তু, কমলকুমার তখনও সাহিত্যে স্থির হতে পারেননি। তিনি তাঁর নিজস্ব প্রকাশ মাধ্যম খুঁজছেন। এসময় তিনি চিত্রকলা, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাট্যদল হরবোলা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের এ সময় শিল্পকলার সবগুলো শাখাই তখন উত্তাল। বিভূতিভূষণের মৃত্যু হলেও মানিক তারাশঙ্কর এ সময় নতুন নতুন মোড় ফেরানো মলধারার উপন্যাস রচনা করছেন। কল্লোলযুগের সকল লেখকেই প্রায় সচল, সতীনাথ ভাদুড়ী ও বনফুল লিখছেন নিরীক্ষামলক উপন্যাস। কবিতায় জীবনানন্দসহ ত্রিশোত্তর অন্যান্য প্রধান কবি সক্রিয়। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে নন্দলাল বসু, রাম কিঙ্কর, যামিনী রায়, বিনোদ বিহারী। উচ্চাঙ্গ সংগীতে আলাউদ্দিন খাঁ, রবিশঙ্কর। রবীন্দ্রসংগীতে রাজেশ্বরী দত্ত, কণিকা বন্দোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র। শ্যামাসংগীতে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, লোকসংগীতে নির্মলেন্দু চৌধুরী, নৃত্যজগতে উদয়শঙ্কর, নাটকে শম্ভুমিত্র। দল হিসেবে বহুরূপী, গণনাট্য সঘ ও লিটল থিয়েটার।

শিল্প সাহিত্যের এই উত্তাল সময়ে কমলকুমারের পক্ষে নতুন কিছু করা চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। চিত্রকলা, সংগীত বা নাটক তিনি সারাজীবন চর্চা করেছেন। কিন্তু সম্ভবত পেশা হিসেবে নিতে চাননি। কিন্তু পেশা হিসেবে চলচ্চিত্রকেই নিতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু, পথের পাঁচালীর মুক্তি ও তাঁর বিশ্বজয় কমলকুমারের এ পথকে রুদ্ধ করে দেয়, তিনি চলচ্চিত্র থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে আসেন।

এ অবস্থায়ই প্রকাশিত হয় তার প্রথম সার্থক উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৫৯)। এ উপন্যাসটি রচনার প্রস্তুতি তিনি পর্ব থেকেই গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয়। কেননা, সত্যজিৎ রায়কে ক্যানিং ঘাটে নৌকার গায়ে আঁকা চোখ ও জলের ঢেউয়ে সে চোখকে সিক্ত করার যে বর্ণনা কমলকুমার দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন, তা থেকে এ প্রস্তুতি বুঝা যায়।

পর্ববর্তী জল গল্পে কমলকুমার প্রথম স্বতন্ত্র বাংলা গদ্যের সচনা করেন। যা পরবর্তী তেইশ মল্লিকা বাহার গল্পে সমৃদ্ধ হয়েছে। আমাদের বিবেচনায় অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসেই সকল দিক থেকে কমলপ্রতিভা ও নিরীক্ষার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তিনি সকল অর্থেই এ উপন্যাসে মুন্সিয়ানা, স্বাতন্ত্রের পরিচয় দেন। এ উপন্যাসেই ভাষা ও ভাবের মনিকাঞ্চন যোগ ঘটেছিল এবং কমলকুমারের তৎকালীন ও বর্তমান সকল প্রতিষ্ঠার ভিত্তি এ উপন্যাস। কমলজীবনীকারের মতে :

‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বাংলা ভাষা এবং উপন্যাসের প্রবাহে এক অভিনব সংযোজন। এই উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নানা বিরূপ মন্তব্য আর খ্যাতি অখ্যাতির নায়ক হয়ে উঠলেন কমলকুমার। ৪৩

যে খ্যাতি অখ্যাতি এতদিন ছিল ব্যক্তি কমলকুমারকে ঘিরে এ উপন্যাসের কারণে তিনি হয়ে ওঠেন সাহিত্যিক খ্যাতির নায়ক। বাংলা উপন্যাস ধারায় তার স্বতšআসন নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তাঁর পরবর্তী ৭টি উপন্যাসসহ অন্যান্য রচনার প্রকাশ এ খ্যাতিকে আরো উজ্জ্বতর করেছে, তাঁকে আরো স্বাতন্ত্রিক মহিমায় মহিমান্বিত করেছে।


১. কমলকুমারের পিতা পুলিশ অফিসার, মা সাহিত্যমতি। অনমনীয় একগুয়ে পিতা চেয়েছেন কমলকুমার বড় হোন নিজ খেয়ালে, মা চেয়েছেন সন্তানরা বড় হোক শৈল্পিক অভিরুচি নিয়ে। সুতরাং কমলকুমার তাঁর চরিত্রের খামখেয়ালিপনা একগুয়েমি পেয়েছিলেন পিতার প্রশ্রয়ে, সাথে যুক্ত হয়েছিল সাহিত্যিক অভিরুচি; যা পরিণত বয়সে শিল্পসাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে অনেকটা শৈল্পিক স্বেচ্ছাচাররূপে। স্বাধীনচেতনা, স্বাতন্ত্রের অভীপ্সার বীজ শৈশবেই বপিত।

২. শৈশবেই মায়ের কাছে রামায়ণ, মহাভারত থেকে মেঘনাদবধ-কাব্য শুনেছেন। বাসায় মিশেছেন তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পজনদের সাথে। বোন শানু লাহিড়ীর কথায় ‘ভারী ভারী জিনিষ’ শৈশবেই জেনেছেন। সুতরাং সক্ষ্ম সাহিত্যরুচির সচনা মা ও পরিবার থেকেই। পরবর্তীতে ফরাসি, সংস্কৃত, ইংরেজি ও বাংলা ভাষা কমপক্ষে এ চারটি ভাষাদক্ষতা তাঁর পঠনবিশ্বকে বহুধা বিস্তৃত করেছে।

৩. শৈশবে পেয়েছিলেন দ্বিমুখি ধারার বিদ্যায়তনিক শিক্ষা। একদিকে ‘মাথা ন্যাড়া করা’ ধর্ম সংস্কৃত শিক্ষা, অন্যদিকে ইউরোপীয় মিশনারিজ পরিচালিত আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষা। যৌবনে স্যুট পরে ‘বাবু’ হওয়া, চার্লস বারকে অনুসরণ করা, পরিণত বয়সে ধতি, পাঞ্জাবি পরা, পশ্চিমাজ্ঞানের সাথে কাশীরাম দাসকে মেলানো - এ সত্রেই বাঁধা। নাতালী সারোতের সাথে রাম প্রসাদ ভক্তি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। অস্বাভাবিক নয় বঙ্কিমবাহিত উপন্যাসের পশ্চিমী ফ্রেমে ভারতবর্ষীয় প্রান্তিক ব্রাত্যজনের অন্তরাত্মার উন্ম¥ীলন।

৪. শৈশবে লক্ষ্মৌ, মুলতান থেকে ‘প্রণম্য হিমালয়’ পর্যন্ত গমন, কৈশোরের পর্ববঙ্গের রাজশাহী মেলায়, মুঙ্গেরে, বিহারে ভূমিকম্প কিংবা জনগণনা বিভাগে চাকরি উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের মাটি ও প্রান্তিক জনদের সাথে গভীরভাবে মেশা তাঁর দৃষ্টিশক্তিকে একইসাথে গভীর ও শেকড় প্রোথিত করেছিল।

৫. যৌবনে অবিরাম আড্ডা, সবগুলো শিল্প মাধ্যমের সম্ভাবনাময় ও প্রতিষ্ঠিতজনদের সাথে মিথস্ক্রিয়া এবং বিচিত্র শিল্প মাধ্যমের চর্চা তার রচনাকে বহুবর্ণিল করেছিল। একই সাথে নিজের প্রকাশ মাধ্যম গ্রহণে দ্বির্ধান্বিতও করেছিল।

৬. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তমান ও ঘোর কঠিন পরিস্থিতিতে শিল্পের প্রকাশ ধরন কী হবে এ প্রশ্ন পৃথিবীর সকল শিল্পীর মতো তাঁকেও বিচলিত করেছিল। কমলকুমারের শিল্প মাধ্যম গ্রহণের ক্ষেত্রে অস্থিরতা ছিল। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রকে গ্রহণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের প্রতিষ্ঠা এ পথ রুদ্ধ করে দেয়। শিল্পের অন্যান্য শাখায় পর্বে উল্লিখিতদের প্রতিষ্ঠা তাঁকে নিরুৎসাহিত করে ছিল। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় প্রচলতার ধারায় তাঁর যোগ দেয়ার রুচিও ছিল না।

৭. ‘জল’ গল্পের ভাষা নিরীক্ষা থেকে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র শিল্প সাফল্য প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে সাহিত্যকেই গ্রহণে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

৮. সমকালে তাঁর অতুলনীয় পাণ্ডিত্য ও সৃষ্টিশীলতা তাঁকে নিঃসঙ্গতার চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিল। শিল্পী হিসেবে প্রাপ্য সম্মান না পাওয়া এবং কম মেধাবীদের লোকখ্যাত হওয়া সম্ভবত তাঁকে অভিমানী করেছিল। এক্ষেত্রে তাঁর ভেতর তৈরি হয়েছিল এক ধরনের কমপ্লেক্স। অভিমানী মনের আহত বেদনা ও গভীর কমপ্লেক্সের বহিঃ প্রকাশই সম্ভবত ঘটেছে আড্ডায় অন্যদের নামে মিথ্যে বলা, নিন্দাবাদ ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভেতর দিয়ে। স্বভাবগত প্রতিভা ও বর্ণনা করার অদ্ভুত ক্ষমতা তার এ কমপ্লেক্স প্রকাশরীতিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছিল।

৯. ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্যের প্রধান অন্বেষা ও অন্বিষ্ট বিষয় ছিল রবীন্দ্র প্রভাব বলয় অস্বীকার ও অতিক্রম। রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা ও চিন্তার মূল সুতো ছিল ইউরোপীয় ভাবধারার সাথে সম্পৃক্ত। ত্রিশ ও ত্রিশোত্তর সাহিত্যিকগণ এ প্রভাবকে এড়াতে পশ্চিম বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যেরই দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা রবীন্দ্র অস্তি স্থানে নিয়ে এসেছিলেন নেতি চেতনা। একেশ্বর, জীবনদেবতার স্থানে নিরীশ্বরবাদিতা, চল্লিশের দশকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী চেতনা।

কমলকুমার এর কোন পথেই পা দেননি। তিনি রবীন্দ্র উপন্যাসের মধ্যবিত্ত জীবন জটিলতার স্থানে এনেছিলেন প্রান্তিকজনের জীবনজিজ্ঞাসা, ব্রাহ্মধর্মীয় নিরাকার একেশ্বরবাদের স্থানে সাকার মা, ভাবের স্থলে ভক্তি। রচনার শুরু স্বস্তিবচন লেখা সম্ভবত তাঁরই প্রতিফলন। ইংরেজি সাহিত্যের বদলে তিনি হাত বাড়িয়েছিলেন ফরাসি সাহিত্যের দিকে। এক্ষেত্রে ফরাসি নতুন নভেল আন্দোলন, কিউবিজম, ইমপ্রেসনিজম, শিল্প আন্দোলনের নির্যাস গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষত, নুতন নভেল আন্দোলনকারীদের মতো ভাষা নিরীক্ষাই তাঁর প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।

১০. বস্তু বা বিষয়কে বর্ণনার অদ্ভুত ক্ষমতা, ভাষা নিরীক্ষার সাথে অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের করণ কৌশলের প্রয়োগ তাঁর রচনাকর্মকে করে তুলেছে বহুবর্ণিল, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ব্যক্তির যাপিতজীবন ও শিল্পের অভিনবত্ব সমকালে তাঁকে করেছে নিঃসঙ্গ একক এক নির্মাতা।







তথ্যসূত্র

১. কমলকুমার মজুমদার, অপ্রকাশিত চিঠির উদ্ধৃতি, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, “কবিতীর্থ” (উৎপল ভট্টাচার্য সম্পাদিত) ২০তম সংখ্যা, কলিকাতা, জানুয়ারি ১৯৯৯, পৃ. ১৪
২. শানু লাহিড়ী, ‘সাক্ষাৎকার’, “উত্তরাধিকার”, (অমিতদাস, অনিরুদ্দ ভৌমিক সম্পžাদিত), জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৯৭, পৃ. ১৮
৩. শানু লাহিড়ী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭
৪. শানু লাহিড়ী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮
৫. শানু লাহিড়ী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮
৬. কমলকুমার মজুমদারের উদ্ধৃতি, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার : জীবন ও শিল্প (অপ্রকাশিত পিএইচ ডি অভিসন্দর্ভ), বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান, ১৯৯০, পৃ. ০৩
৭. শানু লাহিড়ী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭
৮. ঐ, পৃ. ১৭
৯. কমলকুমার মজুমদারের উদ্ধৃতি, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪
১০. শানু লাহিড়ী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০
১১. দয়াময়ী মজুমদার, ‘আমার স্বামী কমলকুমার মজুমদার’, “জন্মস্মারক ৮৫”, কলিকাতা, পৃ. ৯
১২. কমলকুমার মজুমদারের উদ্ধৃতি, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায় , প্রাগুক্ত, পৃ. ৮
১৩. রাধা প্রসাদগুপ্ত, ‘আমাদের কালের আড্ডা’, “ঝাঁকি দর্শন”, দেশ, ০৯.০৮.৮৮
১৪. সত্যজিৎ রায়, কমলবাবু, কমলকুমার রচনা ও স্মৃতি (সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত) নর্থ ব্রাদার্স, কলিকাতা, ১৯৮২, পৃ. ১৫০
১৫. সত্যজিৎ রায়, প্রাগুক্ত পৃ. ১৪৮
১৬. রাধা প্রসাদগুপ্ত, ‘কমলকুমার মজুমদার : কিছু পুরনো কথা’, “শব্দপত্র”, (শুভ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত), কলিকাতা, সেপ্টেম্বর ১৯৮৪, পৃ. ৭
১৭. সত্যজিৎ রায়, কমলবাবু, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫০
১৮. সত্যজিৎ রায়, কমলবাবু, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬
১৯. অভি সেন গুপ্ত, ‘কেন খালাসীটোলা’, “কৌরব” ৯২, খালাসীটোলা সংখ্যা, (কমল চক্রবর্তী সম্পাদিত), কলিকাতা, মার্চ ২০০৩, পৃ. ১২৮
২০. সমরেন্দ্র সেন গুপ্ত, ‘এসেছিলে তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে’, “কৌরব”, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬০
২১. বীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বাংলা কথা সাহিত্যের একাল (১৯৪৫-১৯৯৮), পু¯ক বিপনী, কলিকাতা, ১৯১৮, পৃ. ১৫
২২. কমলকুমার মজুমদার, ২৬.৬.৭০ তারিখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি, প্রকাশ “প্রতিবিম্ব”, কলিকাতা, পৃ. ২
২৩. কমলকুমার মজুমদার, ১৭.১২.৭১ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি, প্রকাশ মিনিবুক, কলিকাতা, প্রকাশ তারিখ নেই, পৃ. ৩
২৪. হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার : জীবন ও শিল্প, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০
২৫. কমলকুমার মজুমদার, ‘লেখা বিষয়ক’, “জার্নাল ৭০”, ৫ম সংখ্যা, পৃ. ২২
২৬. লোকনাথ ভট্টাচার্য, ‘সঞ্চয় বলতে স্মৃতিই’, “উত্তরাধিকার”, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১
২৭. কমলকুমার মজুমদার, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি, প্রাগুক্ত
২৮. আশোক মিত্র, ‘সাক্ষাৎকার’, “উত্তরাধিকার”, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪
২৯. রফিক কায়সার, কমলপুরাণ, একুশে পাবলিকেশন্স লি., ঢাকা ২০০১, পৃ. ৪
৩০. নব নীতা দেবসেন, ‘পিঞ্জরে বসিয়া পাঠক অথবা সিদ্ধ তান্তিকের শব্দ সাধনা’, “চতুরঙ্গ”, মাঘ-চৈত্র ১৩৮৪, পৃ. ২৫০
৩১. রফিক কায়সার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪
৩২. হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, উদ্ধৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫
৩৩. সত্যজিৎ রায়, ‘কমলবাবু’, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬
৩৪. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অর্ধেক জীবন, আনন্দ, কলিকাতা ২০০২, পৃ. ১১৭
৩৫. কমলকুমার ও উদয়ন ঘোষের সংলাপ, ‘খালাসীটোলার মদের আড্ডায়’, “কৌরব” ৯২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩
৩৬. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অর্ধেক জীবন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৮
৩৭. কমলকুমার মজুমদার, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি, কমলকুমার মজুমদার ‘মুখ ও মুখোশের দ্বন্দ্ব’, “কবিতীর্থ” ১৮, কলিকাতা, আশ্বিন ১৩৯৬, পৃ. ৭১
৩৮. ঐ, পৃ. ৭২
৩৯. সত্যজিৎ রায়, ‘কমলবাবু’, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৯-১৫০
৪০. সত্যজিৎ রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬
৪১. হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার : জীবন ও শিল্প, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮
৪২. কমলকুমার মজুমদার, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি, কমলকুমার মজুমদার : জীবন ও শিল্প, ঐ, পৃ. ৩৬১
৪৩. ঐ, পৃ. ৩৬১
৪৪. কমলকুমার মজুমদার, ১৯.৭.১৯৭০ তারিখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা পত্র, প্রকাশ-“প্রতিবিম্ব”, কলিকাতা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৫, পৃ. ৬
৪৫. কমলকুমার মজুমদার, ১২.৩.১৯৭৩ তারিখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা পত্র, প্রকাশ- ঐ, পৃ. ৮
৪৬. কমলকুমার মজুমদার, সাক্ষাৎকার, ‘সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদারের সাথে কথাবার্তা’ (যাঁরা গড়েছেন), “উত্তরাধিকার”, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১
৪৭. ঐ পৃ. ৪২
৪৮. ঐ পৃ. ৪১
৪৯. কমলকুমার মজুমদার, বঙ্গীয় শিল্পধারা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, দীপায়ন, কলিকাতা, বৈশাখ ১৪০৫, পৃ. ৩
৫০. ঐ পৃ. ১৭
৫১. কমলকুমার মজুমদার, ২৬.৬.১৯৭০ তারিখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা পত্র, প্রকাশ-“প্রতিবিম্ব”, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫
৫২. কমলকুমার মজুমদার, সাক্ষাৎকার, “উত্তরাধিকার”, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩
৫৩. কমলকুমার মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা পত্র, প্রকাশ- “প্রতিবিম্ব”, প্রাগুক্ত, পৃ. ২
৫৪. কমলকুমার মজুমদার, ‘পরিপ্রেক্ষিত’, “দর্পন”, ৬ মে ১৯৬৬
৫৫. ঐ
৫৬. কমলকুমার মজুমদার, উদয়ন ঘোষের সাথে সংলাপ, ‘খালাসীটোলায় আমি এক প্রডিগ্যাল খালাসী’, ‘‘কৌবর’’, খালাসীটোলা সংখ্যা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯
৫৭. ঐ পৃ. ৬৮
৫৮. ঐ পৃ. ৬৭
৫৯. কমলকুমার মজুমদার, হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি, ‘প্রভাবিত কমলকুমার মজুমদার’, “উত্তরাধিকার” (কমলকুমার সংখ্যা), প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭১
৬০. কমলকুমার মজুমদার, উদয়ন ঘোষের সাথে সংলাপ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ