দৌড়পালা

অনিল ঘোষ

এ কাহিনিতে আবুরাজ মন্ডল নামে এক ঘোড়ার সহিস আছে, আর আছে গাজি সাহেব নামে প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ঘোড়ার মালিক। দুজনের মধ্যে যে ‘বিশেষ’ সম্বন্ধ, সেকথা জানে ছ-আনি, ন-আনি, কুমারডাঙার মানুষজন। জানে এ অঞ্চলের মাটি-ঘাস-আকাশ-বাতাস। সম্বন্ধটা শুধু ঘোড়াকেন্দ্রিক তা নয়, এর মধ্যে আছে অনেক ডালপালা, অনেক প্যাঁচ-পয়জার।

গাজি গিয়াসুদ্দিন আনসার আর আবুরাজ গ্রাম সম্বন্ধে প্রতিবেশী হলেও দুজনের মধ্যে রয়ে গেছে আশমান-জমিন ফারাক। একই মাটিতে বসবাস, একই জল হাওয়ায় ঘোরাফেরা পাশাপাশি, ঘেঁসাঘেঁসি-- অথচ গাজির অর্থ-বিত্ত-প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে আবুরাজ নিতান্ত নালায়েক। বলা ভালো খড়কুটো। এই ফারাকটা অন্য সকলে মানলেও আবুরাজ মানতে চায়নি কখনও। এ যেন সেই কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড়বাজির গল্প। সেই অসম দৌড়ের দর্শক ন-আনির প্রায় চল্লিশ ঘর বাসিন্দা (যেহেতু শ্রেণীগত বিচারে গাজি সাহেব বাকি সব ঘরের সঙ্গে তুলনীয় নয়, তাই ওঁকে চল্লিশ ঘরের মধ্যে ধরা হয় না, প্রায় বলা হয়)।

আমরা যে কাহিনির কথা বলছি, তার শুরু আবুরাজের এগারো বছর বয়সে। সে কালে আজকের মতো না হলেও আমির-গরিব ব্যাপারটা বোধহয় সর্বকালের, সর্বত্র। ঘটনাটা এইরকম : গাজি সাহেবের বাগানে পাড়ার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা আম পাড়ছির ঢিল ছুঁড়ে। আমের সময় এটা রোজকার ব্যাপার। যাদের নেই তারা হামলে পড়বেই। বিশেষত, বাচ্চাদের কাছে যত না আমের প্রয়োজন, তার থেকে বেশি বোধহয় ঢিল ছুঁড়ে মজা উপভোগ। ব্যাপারটা যখন সহ্যের সীমা ছাড়ায়, তখনই হয় মুশকিল। গাজিকে নিরীহ ভাববার কোনও কারণ নেই। তাঁরও রাগ আছে। চোখের সামনে বাগান তছনছ হচ্ছে দেখে কাঁহাতক সহ্য হয়! বাচ্চাগুলো প্রথমত অনধিকার প্রবেশ করেছে। দ্বিতীয়ত, ওরা যেন গাজির অস্তিত্ব-প্রভাব-প্রতিপত্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ঢিল একটা প্রতীক মাত্র। এতটা সহ্য করা যায় না, বাচ্চা হলেও। সেই দুপুরবেলায় গাজি বিরক্তিতে শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করলেন, বেত্তমিজ--!

ব্যস, আর যায় কোথা! গাজির বাড়ি লোকজন কম নেই। মাইনে করা লোক সব। ওরা লাঠিসোটা হাতে ‘রে-রে’ করে তেড়ে এল। মুখে চিৎকার, ধর শালাদের, মার শালাদের--।

বাচ্চাগুলোও কম বিচ্ছু নয়। চোখের পলকে হাওয়া সব। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজে মিটল না। গাজির লোকেরা তো চোর তাড়াতে আসেনি, চোর পাকড়াও করে চরম শিক্ষা দিতে এসেছিল। ওরা ‘ধর ধর’ করতে করতে আবুরাজের ভিটেয় ঢুকে পড়ে। ছোট্ট আবুরাজ তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে গুলতি দিয়ে পাখি মারার চেষ্টা করছিল। আর পড়বি তো পড়, গাজির লোকেরা ওর উপরেই হামলে পড়ল। ‘ধরেছি ব্যাটাকে’ বলে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল গাজির বাড়ির দিকে। আবুরাজ শুনবে কেন! ওই বয়সে তারও রোখ কম নয়। হাত-পা ছুঁড়ে, চেঁচিয়ে চিল্লিয়ে বাধা দিতে লাগল। এগারো বছরের ছেলের গায়ে যেন দুনো তেজ। গাজির খিদমত খাটা লোকগুলো ওকে বাগে আনতে প্রায় হিমসিম খায়। শেষে উপায় না পেয়ে মারধোর শুরু করে দেয়।

সেই সময় আবুরাজের ফুফু রাজিয়া বাড়ি ছিল। চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় ভাইপোকে মার খেতে দেখে একেবারে ছিটকে ওঠে। উঠোনের কোণে পড়ে থাকা ভোঁতা কোদাল তুলে তেড়ে যায়। মুখে অবিশ্রান্ত গালাগাল, ওরে ও খানকির ছা, ওরে সেগোমারানির পুত-- ওই কচির উপর মরদানি ফলাচ্ছিস! বাপের ব্যাটা হোস তো আমার নেগে লড়বি আয়, মার দুধ খাস তো আয় শালোরা, দেকি গাজি তুদের কত্ত ভাত-পানি দেছে!

রাজিয়ার রণমূর্তি দেখে গাজির লোকেরা থমকে যায়। আবুরাজকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে যায় ওরা। ফিরলে হবে কী! রাজিয়ার তখন রাগ-রোষ সব মাথায় চড়ে বসেছে। আর তার লক্ষ্য হল গাজি। ওই তো নাটের গুরু। রাজিয়া আশমান-জমিন সাক্ষী রেখে আল্লার কিরা কেটে বলতে লাগল, ওরে হারামি, পয়সা হইছে বল্যে মাটিতে আর পা পড়ে না! ওইটুকু কচির উপর বীরত্ব ফলাতি এইচিস! তোর দোজখেও জাগা হবে না। হাতে কুঠ হবে, মুকি পোকা পড়বে। তোর দুসরা বিবি বাঁজা হবে (গাজির দ্বিতীয় বিবি সত্যিই বাঁজা। লোকে বলে এটা রাজিয়ার অভিশাপ)। তোর শালো কাফনও জোটপে না--।

রাজিয়া এত রেগে গেছে যে, ওর সামনে দাঁড়ানোর হিম্মত কারও ছিল না। চেঁচিয়ে চিল্লিয়ে পাড়া মাত করে দিচ্ছিল। শেষমেষ আবুরাজের বাপ হামিদ উপায় না পেয়ে এক বালতি জল ঢেলে দেয় ওর মাথায়।

ঘটনাটা বেখাপ্পা ছিল। নিরীহ একটা ছেলের এইভাবে মার খাওয়া যে অন্যায়, এটা মানল সবাই। কিন্তু গাজির ভয়ে টুঁ শব্দটি করল না কেউ।

কিন্তু সবাই মানলেও রাজিয়া মানল না। ওই ফুফুই ছোট্ট আবুরাজের মনে মাথায় একটা বিষপোকা ছেড়ে দেয়, আর বুকে জ্বালিয়ে দেয় প্রতিশোধের আগুন। লোকে বলে, গাজির সঙ্গে আবুরাজের এই যে চরম শত্রুতার ইতিহাস, এটা আসলে রাজিয়ারই অবদান। এর পিছনে একটা কাহিনি আছে। সেটা এইরকম :

রাজিয়া আর গাজি প্রায় সমবয়সি। এক সময় রাজিয়ার আকাশে গাজি ফালি চাঁদ হয়ে দেখা দিত। মনের বাগানে গাজির নামে ফুল ফুটত, প্রজাপতি উড়ত, গুণগুণ গান চলত খুব। রাজিয়ার খুব আশা ছিল, গাজির দ্বিতীয় বিবি হওয়ার সুযোগ ওরই হবে। কিন্তু নসিব খারাপ। একদিন ভোরবেলায় ব্যান্ডের বাজনায় সচকিত হয়ে দেখল গাজির হাত ধরে ওর দুসরা বিবি পালকি থেকে নামছে। সেই যে রাজিয়ার মাথা বিগড়লো, তা আর সিধে হল না কখনও। ওর বিয়ে হয়েছে ভালো ঘরে, পয়সাওলা বর, দু-দুটো উপযুক্ত ছেলে, তাদের বউ, নাতিপুতি। নিজের এখন বয়েস হয়েছে। চুলে পাক ধরেছে। কিন্তু প্রথম প্রেমের সেই না পাওয়ার শোক আজও ভুলতে পারেনি সে। হাটে-মাঠে-ঘাটে যেখানে সুযোগ পেয়েছে, গাজির চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করেছে। চিৎকার করে বলেছে, গাজি একটা মানুষ নাকি! একটা খারাপ চরিত্রের লোক। মেয়েচাটা। পরঘরের মেয়া বিবি দেখলে ওর জিভ দে লালা ঝরে ইত্যাদি। এসব রসাল কথায় কান টানে, মন টানে, কিন্তু বিশ্বাস! কেউ করে, কেউ করে না। গাজি শুনেছিলেন সবই। তিনি রাগেননি। হেসেছিলেন মুখ টিপে। তখন যদি বুঝতেন রাজিয়ার অবদমিত প্রেম ভবিষ্যতে আবুরাজ নামে এক চরম প্রতিপক্ষ খাড়া করে দেবে, তবে কী করতেন বলা মুশকিল।

যাই হোক, আবুরাজ ওই বয়স থেকে গাজির বিরুদ্ধাচারণ করে গেছে। সহায় রাজিয়া। রাজিয়াই ওর হাতে আধলা ইট তুলে দিয়ে কানে বিষমন্তর দেয়, মরদ হোস তো গাজির মাতা ফেটকে দে আয়। ওর খুন লে আয়। আমার দিল জুড়োক। আবুর‌্যা, আমার দিলে বড়ো জ্বালা। এ জ্বালা তুই জুড়োতি পারিস।

শুনতে শুনতে আবুরাজের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। শ্বাস পড়ে ঘন ঘন। আধলা ইট হাতে ছুটে বেরিয়ে যায়। বাপ হামিদ জানতে পেরে ওর পিছু পিছু ছোটে। ধমক দিয়ে, মেরেধরে, কখনও বাবা-বাছা করে আবুরাজকে থামিয়ে রাখে। তবু কি আবুরাজ থামে! কিন্তু গাজিকে ঠিকমতো বাগে পায়নি বলে হাতের ইট হাতেই থেকে গেছে।

ব্যাপারটা যদি এখানেই থেমে যেত, তবে এই কাহিনি লেখার কোনও প্রয়োজন হত না। আসলে এ কাহিনিতে আছে আবুরাজের দীর্ঘ পরাজয়ের ইতিবৃত্ত। গাজি সাহেব জয়ী-- এ কথা একবার নয়, দু-বার নয়, বারবারই ঘটেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, আবুরাজ প্রতিটি পরাজয়ের পরেও দমে যায়নি, বরং নতুন উদ্যমে আবার শুরু করেছে। ও হয়তো জেনে গেছে খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড়বাজির গল্পের শেষটা। একদিন না একদিন, কোনও-না-কোনওভাবে গাজিকে ও হারাবেই-- এই বিশ্বাস ওর বুকে দৃঢ় হয়েছে প্রতিটি পরাজয়ের পর। কেন না, তখনই ওর মাথায় রাজিয়া ফুফুর ছেড়ে দেওয়া বিষপোকাটা নড়েচড়ে বসেছে, আর কানে বেজেছে ফুফুর সেই আর্ত বাণী, আবু র‌্যা, আমার দিলে বড়ো জ্বালা--!

গাজি সাহেবের যতই প্রভাব-প্রতিপত্তি থাক, লোকে যতই ভয় খাক-- মানুষটা কিন্তু মজার কিসিমের। সব সময় হাসিখুশি মুখ, কথা বলেন নরম সুরে। ছোটোবড়ো সবাইকে ‘বাবা-বাছা’ ছাড়া সম্বোধন করেন না। চরিত্র নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলে বটে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ প্রমাণ দিতে পারেনি। এটা তো ঠিক, গাজি কারও ঘরে ঢুকেছেন বা কোনও মহিলার হাত ধরে টেনেছেন-- এমন অপবাদ ওঁর শত্রুও দিতে পারবে না। আর ধন-সম্পত্তি! সেটা অন্যায় কীসের! বাপ-দাদার জমি, জমানো টাকা ওঁর হাতে এসেছে। সেগুলো তিনি উড়িয়ে দেননি, বিলিয়েও দেননি। আরও বাড়িয়েছেন। এ তাঁর বিষয়বুদ্ধি, ব্যাবসাবুদ্ধি। কোনও অন্যায় অসততার ধারপাশ দিয়েও যাননি। মানে দরকার হয়নি। অসাগর মাটির সা¤্রাজ্য ওঁকে দাপট দিয়েছে। তার টানে অনেক কঠিন বিষয়ও জলের মতো তরল করতে পেরেছেন। করায়ত্ত হয়েছে অনেক জটিল, প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এটাই তো স্বাভাবিক। ক্ষমতার চাকা একবার গড়াতে শুরু করলে চলতেই থাকবে। থামবে না।

গাজি সাহেব যৌবনে ফুটবল খেলতেন। মহকুমা জুড়ে নামডাক ছিল। বসিরহাটের লিগ ফুটবলে দু-দুবার টপ স্কোরার হন। কলকাতা থেকে ডাক এসেছিল। যেতে পারেননি অকালে বাপ মারা যাওয়ায়। তবে খেলার রোখটা রয়ে গেছে ওঁর রক্তে। আজও খেলাধুলোর ব্যাপারে সমান উৎসাহী তিনি। কুমারডাঙা, জয়গ্রাম, মিনাখাঁর ফুটবল টুর্নামেন্টে গোল্ড কাপ তাঁর দেওয়া। খবরের কাগজ এলে খেলার পৃষ্ঠা ছাড়া আর কিছুতে উৎসাহ দেখান না। ফুটবলের ব্যাপারে তিনি ঘোরতর মোহনবাগান ও ব্রাজিল সমর্থক।

এ কথা ঠিক, গাজি সাহেব যা করেন, তার পিছনে থাকে প্রবল যুক্তি। আবুরাজের ব্যাপারে একটা অন্যায় হয়েছিল বটে, তবে সেখানে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন না। ওঁর লোকেরা যে কাজটা ঠিক করেনি, সে কথা তিনি বহুবার প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। কিন্তু আবুরাজ মানেনি। মুখ বেঁকিয়ে বলেছে, উসব বড়োনোকি চাল। জুতো মেরকে গরু দান।

আসলে ঘটনাটা এমনই নিদারুণ যে, আবুরাজের গোটা জীবনধারা পালটে যায়। সেই এগারো বছর বয়সে বুকের ভিতর যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা আর নেভেনি। এই মাটির দুনিয়ায় তারপর অনেক ওলোট পালোট হয়েছে, বাংলার মসনদে রং বদল হয়েছে, রাজা প্রজার হিসেব নিকেশ পালটে গেছে। যে গাজি সাহেবরা শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন, তাঁরা আস্তে আস্তে বন্ধু হতে শুরু করেছেন। তারপর হল পরিবর্তন। সেইসঙ্গে তাঁর অবস্থানও পালটে গেল। যে যখন ক্ষমতায়, গাজিও তখন সেই দিকে। এ হল গাজি শ্রেণীর অমোঘ নিয়ম। এতৎ সত্ত্বেও আবুরাজের কোনও পরিবর্তন হয়নি। গাজি যেদিকে, তার উল্টোদিকে তার অবস্থান। তার ধ্যান-জ্ঞান-লক্ষ্য একটাই-- ওই গাজি সাহেব। যত দিন গেছে, গাজির বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে ঘৃণার বাতাবরণ। প্রতিটি ঘটনায় তার বহির্প্রকাশ ঘটেছে। দু-একটি ঘটনা বললে বোঝা যাবে। যেমন--

আবুরাজের বাপ হামিদ তখনও বেঁচে। সে লোক চাষিবাসি মানুষ। খাটিয়ে লোক। কিন্তু আয়পয় বলার মতো নয়। নুন আনতে আমানি ফুরনো সংসার। কষ্টেসৃষ্টে হয়তো চলে যায়, কিন্তু নিজের দুই মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে মহা ফ্যাসাদ। জমানো সব তো গেলই, ভিটের লাগোয়া কাঠা তিনেক জমিও গচ্ছিত রাখতে হল গাজি সাহেবের কাছে।

আবুরাজ তখন সবে জোয়ান। গায়ে গত্তি লেগেছে। আর রোখ খুব। সেইসময় একদিন, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ গাজির দলবল আবুরাজের ভিটের লাগোয়া জমিতে পাঁচিল তুলে দেয়। গোটা ব্যাপারটার তদারক করছিলেন গাজি সাহেব স্বয়ং। এ খবর পেয়েই ছুটে আসে আবুরাজ। ব্যাপার দেখে রাগে ফুলতে শুরু করে। চোখের সামনে গাজি ওদের জমি গাপ করবে আর ও উপযুক্ত ছেলে হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে! গাজির এতবড়ো সাহস! আবুরাজ খামার থেকে ধান মলন দেওয়া পাকা বাঁশের লাঠি নিয়ে তেড়ে এল। চিৎকার করে বলল, অ্যাই শালো, বেড়া বন্ধ কর--।

সেদিন ন-আনির প্রায় চল্লিশ ঘর বাসিন্দা ভিড় জমিয়েছিল আবুরাজের উঠোনে। সকলের চোখেমুখে কী হয় কী হয় ভাব। একরাশ উৎকণ্ঠা ঝরে ঝরে পড়ছিল।

গাজি সাহেব কিন্তু রাগলেন না। কোনও রকম উত্তেজনাও প্রকাশ করলেন না। মিটি মিটি হেসে বললেন, দ্যাখো বাপ, আমারে তুমি যা খুশি বলতি পারো, কিন্তু জানবা আমিও আল্লার বান্দা। আমি নেক কামের লোক। আমারও ইমান আছে। সজ্ঞানে কুনো অন্যায় কাজ করিনি।

আবুরাজ পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, রাকো তুমার ইমান। ও কতা শুনলি আল্লাও হাসবে। তুমি কাম থামাবা কিনা বলো--!

গাজি সাহেব বললেন, ঠিকাচে তুমার আব্বারে ডাকো, তারে শুধোও--!

আবুরাজ তা শুনবে না। রেগেমেগে তেড়ে আসতে চায় গাজির দিকে। গাজি তবু স্থির। শান্ত। কোনও হেলদোল নেই তাঁর। মুখে সেই মিটিমিটি হাসি বুলিয়ে বললেন, শোনো বাপ, মাতা ঠান্ডা করো। তুমার আব্বা হামিদ ওই জমি আমার কাছে বাঁধা দে ট্যাকা নিছিল তুমার বুনের শাদির সোমায়। কতদিন বলিচি, হামিদ, আমি সুদ খাইনে, তুই আসল ট্যাকা দে, জমি ফিরকে লে। তুমার আব্বা সেটা করেনি। উল্টে আমার নেগে ট্যাকা নে জমিডাই বেচে দেছে। বিশ্বাস না হয় শুধোও তুমার আব্বারে।

আবুরাজ মাথা নেড়ে বলেছিল, তুমি শালো জমিচাটা লোগ, তুমারে বিশ্বাস!

ঠিকাচে, আমারে বিশ্বাস করতি হবে না। তুমি তো হামিদের উপযুক্ত ব্যাটা। তুমি আসল ট্যাকা দ্যাও, জমি ফিরকে ল্যাও।

এ কথার উত্তর আবুরাজ মুখে দেয়নি। সোজা লাঠি তুলেছিল গাজির মাথা লক্ষ্য করে। গাজি অবশ্য একা ছিল না। তার অর্থবল যেমন ছিল, লোকবলও যথেষ্ট। তারাও রে-রে করে লাঠি তোলে। খুনোখুনি হয় আর কী! কিন্তু আশ্চর্য শান্ত ছিলেন গাজি সাহেব। তিনি হাত তুলে থামিয়ে দিলেন ওঁর লোকদের। তারপর হেসে আবুরাজকে বললেন, লাঠি যখন দেখালি বাপ, ত্যাখন আমার এই করিমের নেগে লাঠিবাজি কর। যদি জিতিস, আমি এই সক্কলার সামনে কথা দিচ্ছি তুদের জমি এখুনি ফিরকে দোবো।

আবুরাজের রোখ ছিল, শরীরে তাগদ ছিল আর বুকে ছিল প্রতিশোধের আগুন। তবে এসব মূলধন লাঠিবাজিতে অচল। ওখানে কায়দা কানুন, রীত কৌশল হল আসল। আবুরাজ সেখানে অচল, আনাড়ি নম্বর ওয়ান। সে তো লাঠি ধরেনি কখনও, চালাবে কী! দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল করিম মিয়া হাসতে হাসতে জিতে গেল। খিকখিকিয়ে বলল, ওর শালো, লাঠিবাজি করতি এইচিস, লাঠি ধরতি শেখ আগে--।

আবুরাজ হেরে গেল কিন্তু দমে গেল না। ও যেন জেনে গেছে, গাজির মতো প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে হঠকারিতা চলে না। ধৈর্য ধরতে হবে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সে সুযোগের অপেক্ষা করে। গাজির লোকেরা কার জমির ধান কাটল, কার জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে মেছোঘেরির আয়তন বাড়িয়ে নিল, ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য কাপ দিল কিংবা সরকারি রাস্তার জন্য জমি দান করল-- এসব ঘটনা আবুরাজ মন দিয়ে লক্ষ করে। ও চেষ্ট করে বুঝতে যে গাজি যে কাজই করুক, সে ভালো কিংবা মন্দ, এটা ভালো করে দেখা দরকার। জমি কাড়া, মেছোঘেরি বাড়ানো-- এসব ক্ষেত্রে দেখেছে গাজির পক্ষে আছে প্রবল যুক্তি। কেউ হয়তো আছে আগাম টাকা নিয়েছে, ধান দিয়ে শোধ দেবে বলে দেয়নি। কেউ হয়তো জমি বাঁধা রেখেছে, চেষ্টা করেও আর ছাড়িয়ে নিতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে গাজির কী করার আছে! প্রতিটি ব্যাপারে তিনি খুব পরিষ্কার বলে দিতেন, দ্যাখো বাপসকল, আমি তুমাদের কুনো ক্ষেতি হোক চাইনে। তুমরা তো জানো আমি সুদ খাইনে। সুদ আমার কাছে হারাম। যে ট্যাকা নেছ, সে ট্যাকা দ্যাও, যার যা মাল ফিরকে লাও।

কিন্তু টাকা এমনই মহার্ঘ বস্তু, মানুষের হাতে বাঁধা পড়তে চায় না কিছুতেই। মনে মনে গাজির উপর রাগ হয়, কিন্তু কিছু করার নেই। একমাত্র হা-হুতাশ আর অসহায় রাগ দেখানো ছাড়া।

আবুরাজ দেখতে দেখতে একসময় নিজের মনে বলেও ফেলে, সুদ খাওয়া হারাম, গরিবের জমি কাড়া হারাম নয়! এই কথাটা সে জনে জনে বোঝাবার চেষ্টা করে দেখেছে, কেউ বুঝতে চায় না। পাত্তাই দেয় না ওকে। আবুরাজ কিন্তু হাল ছাড়ে না, বরং জোর দিয়ে, চিৎকার করে বলে, আজ আমার কতা বুইতি লারছিস, একদিন ঠিক বুঝকে যাবি।

আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, গাজি সাহেব ঠিকই বুঝে যায় আবুরাজ নামে চালচুলোহীন হাড় হাভাতে এক তাগদবর যুবক ভবিষ্যতে ওঁর জীবনের পশ্চিম আকাশে উড়ো মেঘ হয়ে দেখা দিতে পারে। আজ ব্যাপারটা খুব হালকা মনে হলেও আগামী দিনে এর পরিণতি খুব ভালো হবে না। তাই তিনি চান, আবুরাজ একবার অন্তত জেতার স্বাদ পাক। ও জিতুক। তিনিও সুযোগের অপেক্ষা করেন।

সেই সুযোগ এল হঠাৎই। গাঁয়ে পালাগানের আসর বসেছে। রূপবান পালা। আশেপাশের গাঁ-ঘরের মানুষ উপচে পড়েছে। এইসব আসরে মালাডাকের একটা চমক দমক থাকে। নিলাম হয় মালা। এই নিলাম যেমন একদিকে পয়সা তোলার ফিকির, অন্যদিকে কারও কারও কাছে ধন-গৌরব, পদমর্যাদা ও অহংকারের প্রতিযোগিতা বা প্রদর্শনী।

পালাগানের মাঝপথে রূপবান-এর গলার মালার ডাক শুরু হল। ন-আনির মোড়ল বলো, মাথা বলো-- ওই গাজি। অতএব পদমর্যাদায় তিনিই প্রথম মালা ডাকের অধিকারী। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আবুরাজ এ নিয়ম মানল না। গাজির বিরুদ্ধাচরণ করতে হবে বলেই সে হঠাৎ উঠে হেঁকে বলল, দশ ট্যাকা ডাক দেলাম।

আসরে স্তব্ধতা নেমে এল মুহূর্তেই। আসরে শুধু আবুরাজের মতো মানুষেররা নেই, আছেন গাজি সাহেব স্বয়ং, তারপর কুমারডাঙার নগেন সাধুখাঁ, অতুল সরকার, মেদেরঘেরির জয়নাল মন্ডল, জয়গ্রামের শিবনাথ দাস, মিনাখাঁর গোবিন্দ দাস। আছে তাঁদের পরিবার পরিজন। সব মানী মানুষ। আর আবুরাজ কিনা সকলের সামনে মানী মানুষের অপমান করল! ওর এতবড়ো আস্পর্দা! অতুল সরকার তো খিঁচিয়ে উঠলেন, অ্যাই আবুরাজ, তুই ভেবিচিস কী আঁ! ধরাকে সরা জ্ঞান করতি নেগিচিস নাকি!

সবচেয়ে অপমানিত গাজির দুই ছেলে, শহিদুল আর মুরশিদুল। চোখের সামনে বাপের অপমান তারা ছেলে হয়ে সহ্য করে কী করে!

শহিদুল উঠে দাঁড়ায়। আবুরাজের দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে বলে, অ্যাই শালো, কী ভেবিচিস কী আঁ! দাঁড়া, আজ তোর বাড়ানি ঘোচাচ্ছি।

আবুরাজও পালটা রুখে দাঁড়ায়, কী করবি, আঁ!

মুরশিদুল করিম মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, অ্যই শালো, হাঁ কর‍্যেদেঁড়কে আচিস ক্যানো, ও শালোর ঘেঁটি ধর‍্যে বার করতি পারচিস নে!

আবুরাজও ছাড়নেবালা নয়। দু-পা এগিয়ে এসে বুক চিতিয়ে বলে, আয়, কে আসপি আয়! এ আসর কি কারও বাপের জমিদারি নাকি যে, এহানে একজন ছাড়া আর কেউ মালা ডাকতি পারবে না! তুদের পয়সা আচে বল্যে কি সব চেটিপুটি খাবি নাই! সে দিন আর নেইকো।

ব্যাপারটা ক্রমে ঘোরালো হয়ে উঠছিল। আবুরাজের সমর্থনে কেউ কেউ উঠে দাঁড়ায়। ওরা সব ইদানীং কালের ছোকরা। ওদের ভাবসাব, কথাবার্তা অন্যরকম। গরিব হয়েছে বলে কি চিরকাল পায়ের তলায় থাকতে হবে-- তাই হয় নাকি! এইসব বলাবলি করছিল ওরা।

আসরে হইচই শুরু হয়ে যায়। সবাই ভাবছে, এই বুঝি লাগল। পালাগানের আসর বুঝি ভাঙল! কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্বয়ং গাজি সাহেব হাত তুলে দাঁড়ালেন। মুখে মিটিমিটি হাসি। নরম গলায় বললেন, বোসো বাবারা। শান্ত হয়ে বোসো। পালাগানের আসরে গোলমাল ভালো না।

গাজির কথা শুনে সবাই বসল যে যার জায়গায়। শুধু আবুরাজ গোঁয়ারের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। গাজি হেসে বললেন, পালাগানের আসরে মজাটাই হল আসল। না বাবা, আমার মান যায়নি। আমি তো দিব্যি আছি। মান ব্যাপারটা কী? পয়সা থাকলিই কি মানী হয়? না বাবা, যে য্যামন কাম করবে, তার মান ত্যামন। আমি তো ভেবি পাইনে, আসরে আমাকেই ক্যানো পেরথমে মালা ডাকতি হবে! আমার পয়সা আচে বল্যে! না বাবা ভুল। আমার কিচু নাই, শুধু সাত হাত মাটি আচে। বাকি সব ফক্কিকারী। উসব আমার নয়। আবুরাজ ঠিকই করেচে। মালাডাকের এই নিয়মডা আমারও পছন্দ নয়।

এই বলে গাজি সাহেব মালার দাম হাঁকলেন, পনেরো ট্যাকা।

গাজির এই ভূমিকায় উপস্থিত মান্যগণ্য মানুষেরা অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ হলেও কেউ কিছু বললেন না। প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলেও শুরু হল এক নতুন উত্তেজনা। ন-আনি, ছ-আনি, কুমারডাঙা, জয়গ্রাম, মেদেরঘেরি, মিনাখাঁ-- এসব গ্রামের মানুষজন অবাক বিস্ময়ে দেখল, আবুরাজ যত উত্তেজিত হয়ে মালার দাম হাঁকছে, গাজি সাহেব ততই মিটিমিটি হাসিমুখে, শান্ত স্বরে পাঁচ টাকা করে বাড়িয়ে চলেছেন। নিলাম যখন একশো টাকার কাছাকাছি, গাজি সাহেব ভাবলেন, ছেড়ে দিই, ছেলেটা একবার জেতার সুখ মিটিয়ে নিক।

হ্যাঁ, সেদিনও যদি আবুরাজ জিতত, তবে ওর জীবনধারা নিশ্চয়ই পালটে যেত। এ কাহিনির গতি অন্যখাতে বইত নিশ্চিত। কিন্তু তা হল না।

গাজি সাহেব যখন ছেড়ে দেবেন ভাবছেন, তখনই চোখ গেল নগেন সাধুখাঁর দিকে। নগেন ওঁর ছেলেবেলার বন্ধু। একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, খেলাধুলো। দুজনের তুই-তোকারি সম্পর্ক।

নগেনের ইশারা ধরতে অসুবিধা হল না গাজির। জয়নাল মন্ডল আর শিবনাথ দাসকে দেখিয়ে নগেন বলতে চাইছে, ডাক ছাড়িস নে, তাইলে ওরা আসরে নেমে পড়বে। সে আরও অপমানের ব্যাপার।

গাজি সাহেবও অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছিলেন ব্যাপারটা। মালাডাকের আসরে এসব প্যাঁচ-পয়জার আছে। জয়নাল আর শিবনাথকে এর মধ্যে ঢুকতে দেওয়া মানে গাজির প্রভাব-প্রতিপত্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো। ওরা সবে বড়োলোক। ইটভাটা আর মেছোঘেরি করে পয়সার গরম দেখাচ্ছে। ওরাও তো চায় প্রভাব-প্রতিপত্তি। গাজির মতো বনেদি ধনীকে একবার কাত করতে পারলে ন-আনিকে খাটো করা যাবে, তা ছাড়া চারপাশের গ্রামগুলোতে জানান দেওয়া যাবে জয়নাল আর শিবনাথও কম ফেলনা নয়। গাজি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি বুঝলেন মালা ওঁকে ডেকে যেতেই হবে। শুধু আবুরাজের জন্য নয়, ওই জয়নাল শিবনাথের জন্য। তা ছাড়া শহিদুল, মুরশিদুলও ভালোভাবে নিচ্ছে না। গাজি ছাড়লেও ওরা ছাড়বে না। এটা গ্রামের মান-সম্মানের ব্যাপার।

গাজি হেঁকে বসলেন, দুশো টাকাণ্ড-।

মালা ডাক ওখানেই শেষ। আবুরাজ রণে ভঙ্গ দেয়। জয়নাল শিবনাথও ততক্ষণে মেজাজ বুঝে গেছে। ওরা মালা ডাকতে পারত, কিন্তু তা করলে সরাসরি গাজির সঙ্গে সংঘাতে নামতে হয়। সেটা বোকামি হবে। বরং ওরা চাইছিল আবুরাজ লড়ে যাক। ওরা মদত দেবে। কিন্তু আবুরাজ কোনও দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে আসর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

জিতলেন গাজি। কিন্তু এ জেতায় কোনও মজা নেই। মুখটা ব্যাজার হয়ে গেল। তিনি আন্তরিকভাবে চাইছিলেন আবুরাজ জিতুক। ভষ্যিতের জন্য সেটা ভালো হবে। কিন্তু কেউ সেটা বুঝতেই চাইল না। গাজি সাহেব মাথা নাড়লেন আফশোসে।

অতএব আবুরাজের আবারও পরাজয়, আবারও গুমরে গুমরে থাকা। এই অসম লড়াইতে ওর কী-ই করার আছে! ওর বাপ বোঝায়, আবুর‌্যা, তুই পাগলামি ছাড়। গাজির নেগে টক্কর নেওয়া কি তোর কাজ! রাজিয়া তোর মাতায় কী বিষ ঢুক্যে গেল তুই তাতেই নাচলি। তুই বাপ ছাড়, কাজকাম কর।

আবুরাজ মাথা নিচু করে থাকে। বাপ বলে কাজকাম কর। কাজটা কোথায়! বললেই কাজ হয় নাকি! মাঠের কাজকাম ক্রমে কমে আসছে। জমিই নেই তো জমির কাজ! সব দেখতে দেখতে দখল হয়ে যাচ্ছে। বেড়া, ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘিরছে কলকাতা থেকে আসা লোকজন। ওসব জায়গায় নাকি কলকারখানা হবে, বড়ো বড়ো বাড়ি হবে, কী সব সিটিমিটি হবে। তার জন্য চাষবাস তুলে দিয়ে এখন থেকেই জমি বাঁধা পড়ে যাচ্ছে পয়সাওলা লোকেদের হাতে। সবাই বলাবলি করে, এসব জায়গা নাকি এখন সোনা। ওই তো মিনাখাঁ থেকে বাসে ওঠো, চল্লিশ মিনিটেই পৌঁছে যাবে সায়েন্স সিটি। কলকাতা এখন হাতের মুঠোয়। এইসব অজ পাড়া গাঁ একদিন শহর হয়ে যাবে। হাটখোলায় নগেন সাধুখাঁর দোকানে এসব আলোচনা হয়। অনেক কিছুই মাথায় ঢোকে না ওর। নগেন সাধুখাঁর মানদার সতীশ সর্দারের সঙ্গে গল্প করে। সতীশ বলে, যা হবার তাই হবে। তুই আমি কিছুই না। বলে হো হো হাসে সতীশ।

সতীশ হল নগেন সাধুখাঁর মানদার। মানদারির সঙ্গে ঘোড়া দেখভালের কাজও জানে ভালো। এইসব রোগা পটকা দিশি ঘোড়াগুলোকে খাইয়ে দাইয়ে দলাইমলাই করে তাগড়াই বানিয়ে দেয়। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে এসব অঞ্চলে যে ঘোড়াদৌড় হয়, সেখানে সতীশের মতো সহিস না থাকলে দৌড় জমে না।

সেই ছোটোবেলা থেকে উত্তরের মাঠে ঘোড়াদৌড় দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছে সে। ওই খোলা মাঠে গতির বাতাসে ডানা মেলে যখন ঘোড়াগুলো দৌড়ে আসে, আবুরাজের লোমগুলো তখন রোমাঞ্চে খাড়া হয়ে যায়। রক্তে তখন তুফান তোলে ঘোড়ার খুরের একটানা খট খটা খট আওয়াজ। ঘোড়া আর ঘোড়াদৌড়ের ব্যাপারটা সেই থেকে ওর মাথার সেঁধিয়ে গেছে। অনেক সময় ঘুমের মধ্যেও শুনতে পায় ওর স্বপ্নের ঘোড়া আকাশে ডানা ভাসিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে, বহু দূরে। উধাও মাঠ-প্রান্তর ছাড়িয়ে। সেই থেকে ঘোড়ার সঙ্গে ওর সখ্যতা। আর সেই কারণেই সতীশের পিছু ঘুর ঘুর করে আবুরাজ। সতীশ অবশ্য ঘোড়া দেখভালের কাজে নেয় ওকে। শেখায় কীভাবে ঘোড়া বশ মানাতে হয়, কী কায়দায় ছোটাতে হয়।-- বুইলি, ওর ঘাড়ে হাত বুল্যে একবার ওর কানে কানে শুধু বলবি-- ধর শালাকে মার শালাকে, দেখবি ঘোড়া পঙ্খীরাজের পারা ছুটকে যায়! ঘোড়ার ব্যাপারে সতীশই ওর গুরু। এজন্য কম গালাগাল খেতে হয়নি বাপ মায়ের কাছে। বাপ দিনরাত খক খক কাশে আর থেকে থেকে গাল পাড়ে, মুশকো জোয়ান ব্যাটা, কাজকামের নাম নি, ঘরে‌্য বস্যে ভাত মারতেছে আর গাজির নেগে পয়জারি করতেছে! আবুরাজের মা-ও এককাঠি সরেস। তিন মেয়ের পর ওই আবুরাজ। একটু আদরে বাঁদরে মানুষ। সেই মা-ও রেহাই দেয় না। তার মুখেও শাপমন্যির কথা, ওর‌্যা, তুর দুখে যে শ্যাল কুকুরও কানবে না, বাঁচতি চাস তো--!

কাঁহাতক এসব সহ্য হয়! ‘ধুত্তোর’ বলে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। এক গ্রাম পরে মেদেরঘেরি, রাজিয়া ফুফুর বাড়ি। ঠেলে ওঠে সেখানে। এই ফুফুই ওর সমস্ত আশা ভরসার জায়গা। একমাত্র নির্ভরস্থল। যখনই বাড়ি থেকে ঠেলা খায় বা মনে বিরক্তি আসে, তখন ফুফুর বাড়িই ওর একমাত্র ঠিকানা। আর ফুফুর তো আছে ওর প্রতি অপত্য স্নেহ। ওখানে ফুফা বা ফুফাতো ভাইদেরও প্রবেশাধিকার নেই। আবুরাজ যেন রাজিয়ার নিজস্ব সম্পত্তি। এইজন্য আবুরাজের বাপ হামিদ প্রায়ই বলে, ওই রাজিয়া জিনের পাল্লায় পড়্যে ছেলেটা আমার হাল্লাক হয়্যে গ্যলো গ--!

আবুরাজকে দেখলেই রাজিয়ার বুকের ভিতর সেই পুরনো ক্ষতটা চিনচিন করে ওঠে। প্রতিশোধের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকে। তখন একটাই লব্জ ওর মুখে, আবুর‌্যা, বড়ো জ্বালা দিলে--। আবুরাজ এখন আর ছোটো নেই যে, ফুফুর কথার মর্ম বুঝবে না। ফুফুর জ্বালা যেন ওর ভিতরেও চারিয়ে যায়। গাজি সাহেবের মাথাটা তখন একটা পাকা আমের মতো ঝুলতে থাকে ওর সামনে। হাতদুটো নিসপিশ করে ওঠে। আহ্, গাজির মাথাটা যদি ওই পাকা আমের মতো বোঁটা থেকে খসিয়ে এনে রাজিয়া ফুফুর হাতে দিতে পারতাম--! মনে মনে আফশোস করে আবুরাজ। রাগ হয় নিজের উপর। ফুফুর সামনে মাথা নিচু করে বলে, পারলাম না ফুফু তুমার জ্বালা মেটাতি।

রাজিয়া হেসে ওঠে। আবুরাজের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, ওরে ড্যাকরা, অ্যাত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়কে দিলি! আমি তো সেই কবের থে এই দিলে চোট ন্যে বসকে আচি। কই, আমি তো হাল ছেড়কে দিইনি!

রাজিয়ার কথাগুলো যেন কথা নয়, চাবুকের এক-একটা সপাং সপাং মার। রাজিয়ার হাত যেন হাত নয়, কালসাপ যেন চলেফিরে বেড়াচ্ছে। রাজিয়া যত কথা বলে আর হাত বোলায়, আবুরাজ ততই সোজা হতে থাকে। লোমগুলো যেন খাড়া হয়ে যায়। মাথার ভিতরের বিষপোকাটা হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তুরতুর করে চলতেই থাকে। আর আবুরাজ ততই সোজা হয়ে যায়। গরম হয়ে যায় শরীর। গলার স্বরে ওঠে আসে গাম্ভীর্য। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুমি চিন্তা কোরো না ফুফু, উ শালোর গাজির উঁচু মাতা যদি নিচু না করতি পারি, তবে আমার নাম আবুরাজ নয়।

রাজিয়া হি হি করে হেসে ওঠে, এই তো চাই ব্যাটা।

এবারও যথারীতি আবুরাজ ফুফুর বাড়ি ঠেলে ওঠে। ফুফুও যথারীতি কথার টনিকে চাঙ্গা করে দেয়। সবকিছু পরেও আবুরাজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। রাজিয়া অবাক হয়ে বলে, কী হল?

আবুরাজ মাথা চুলকে বলে, আব্বু আর মা তো ঝ্যাঁটাচ্ছে।

ক্যানো?

কাজকামের নেগে। ঘরেবাড়ে ঢুকতিই দেচ্ছে না।

তা কাজকাম তো করতিই হবে বাবা। চেরকাল তো বাপের ঘাড়ে বস্যে খাওয়া চলে না।

কুতকে করব বলোদিনি! এ দিগরে তো মাঠঘাটের কাজ ত্যামন নেই, এক মালঞ্চের ইটভাটা আছে, নয়তো যেতি হবে বানতলা নালি ধাপা। সেখানে কাজ আচে।

তাতে অসুবিধে কী!

তাতে গাঁ ছাড়া হয়ি থাকতি হবে। আর গাজি শালো ছড়ি ঘুরকেই যাবে।

হুঁ--। রাজিয়াকে এই প্রথম চিন্তিত দেখাল। কিছু সময় নীরবে কেটে যায়। তারপর হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে বলে, তুই ভ্যান চালাতি পারবি?

ভ্যান! আবুরাজ অবাক হয়ে বলে।

রাজিয়া যেন পথ পেয়ে গেছে এইভাবে বলে ওঠে, হ্যাঁ রে, মিনেখাঁর থে দেউলি এহন পাকা সড়ক হইছে, ভ্যান চালালি ভালো আয়পয় হবে।

ধুস, ওহানে তো অটো চলে।

সে আর কটা। তা ছাড়া ভ্যানও তো চলে। তা ছাড়া শুধু মানুষ টানবি ক্যানো, মালও টানবি। তোর ফুফার চালানি মাল তো ভ্যানে আসে, তুইও আনবি।

ফুফা দেবে আমারে কাজ!

রাজিয়া এবার হো হো করে হেসে ওঠে, আমি বললি দেবে না, বলিস কী!

এর দু-দিন পর আবুরাজ নতুন ন-আনি ঢুকল একেবারে নবাব পুত্তুরের মতো। সঙ্গে নতুন ভ্যান। তাকে ফুল লতাপাতা দিয়ে সাজানো। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে বাড়ি ঢুকে বাপের সামনে দাঁড়াল সে। ভাবখানা এমন, এবার কী বলবে বলো!

হামিদ কথা বলবে কী, তার চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে হু হু ধারায়। মা উঠোনে দাঁড়িয়ে দু-হাত আকাশে তুলে মোনাজাত শুরু করে আল্লার উদ্দেশে। ছুটে আসে ন-আনি গ্রামের প্রায় চল্লিশ ঘর বাসিন্দা। সবাইকে শুনিয়ে আবুরাজ বলে, এবার বলবা ফুফু খারাপ লোক! আমারে বেপথে চালাচ্ছে! বলবা! বলো বলো--।

হামিদের মাথা নিচু হয়ে যায়। কথা বলবে কী, কান্নায় ওর গলার স্বর বুজে আসছে। মা বরং চিৎকার করে ফুফুর উদ্দেশে বলে, রাজিয়ারে কুকথা, ছিঃ!

হামিদ পরে বলেছে, রাজিয়া ওর মাথা চিবোক যাই করুক, এত্তবড়ো কামডা তো করল!

সেই ভ্যান নিয়ে আবুরাজ এখন নবাব-বাদশার মতো চলে। ভ্যান তো চালায় না, যেন উড়ে যায়। উড়ে উড়ে একবার মিনাখাঁ, একবার দেউলি-- এই করছে। ফুফার চালানি মাল তো আনছেই, সঙ্গে নগেন সাধুখাঁ ওকে বাবুর হাট থেকে মাল চালানির কাজ দিয়েছে। তা ছাড়া প্যাসেঞ্জার ভাড়া তো আছেই। মিনাখাঁর পাকা সড়ক বেয়ে সে যেন উড়ে উড়ে চলে।

তখন কি জানত এই ভ্যান নিয়েই গাজির সঙ্গে একদিন ওর টক্কর বাঁধবে! হ্যাঁ, একদিন ঈশাণ কোণে মেঘের মতো দেখা দিল সর্বনাশের ইঙ্গিত। ঘটনাটা এইরকম :

মিনাখাঁ-দেউলি পাকা সড়কে এতদিন ভ্যানই চলত। বিকেল তিনটের পর চারটে অটো চলত। এই নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল মিনাখাঁ পঞ্চায়েত সমিতি থেকে। যাতে ভ্যানচালকদের ভাত না মারা যায়। এতদিন এই নিয়ম বজায় ছিল। হঠাৎ রাজ্য জুড়ে পরিবর্তন হয়ে গেল। আর তারই সুযোগ নিয়ে গাজি সাহেবের ছোটো ছেলে শহিদুল কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে ওই রুটে বাস চালিয়ে দিল। আগেও সে এই চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি। তখন সবাই একজোট হয়ে বাধা দিয়েছিল। এবার আর সে সুযোগ নেই। অতএব বাস চলতে শুরু করল। আর ভাত মারা গেল ভ্যানচালকদের। গতির যুগে বাস থাকতে কে আর ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে যাবে! এমনকী মাল চালানিও দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। নগেন সাধুখাঁ তো বলেই বসল, দ্যাখ আবু, তোর সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। কিন্তু আমার দিকটা তো বুঝবি। সময়মতো কাজ হলে কত সুবিধে বলদিনি।

আবুরাজের মাথা গরম হয়ে গেল। শালার গাজি এখানেও হাত বাড়িয়েছে! ও জানে এসবের পিছনে গাজিই আছে। ওর দুই ছেলে পালা করে পঞ্চায়েতে দাঁড়ায়। একজন হারলে অন্যজন নিশ্চিত জিতে যায়। এ গ্রামের ভোট সব গাজির বাড়ি বাঁধা। তা সে যে দলই আসুক। শহিদুল আর মুরশিদুল একবার এ দল একবার ও দল করে বেড়াচ্ছে। কোনও অসুবিধে নেই। আবুরাজ একবার বলেও ছিল, বাহ্ রে শালো, এ তো ভারি মজা। আঙগা গাঁ-ঘরের সবাই দল দল করে মারামারি কর‍্যেমরি, আর গাজি শালো দিব্যি আচে! ওর কুনো হেলদোল নেই! বাহ্ রে শালো!

অতএব পঞ্চায়েত দিয়ে কিছু হবে না জানে আবুরাজ। অন্যান্য ভ্যানচালকরা চিৎকার, গালাগাল, বিডিও অফিসে ডেপুটেশন-- সবই করছিল, কিন্তু আবুরাজ জানে এসবে কিছু হবে না। ঘা দিতে হবে। জোর ঘা।

সেই ঘা দেওয়ার লক্ষ্যেই আবুরাজ দলবল সমেত শহিদুলের বাসকে ঘিরে ধরে। বাসের ড্রাইভার, কনডাকটরকে টেনে নামায়। মারামারি বেধে যায় আর কী! কেউ তো ছাড়বে না। এটা পেটের লড়াই। দুই দিকেই। আবুরাজ রাগ সামলাতে না পেরে ইট লাঠি দিয়ে বাস ভাঙচুর করে। শহিদুল জানত এমন একটা কিছু ঘটবে। তাই সে একেবারে পুলিশ নিয়ে এসে হাজির। এ ক্ষেত্রে পুলিশের যা কাজ, বেশি ঝামেলায় না গিয়ে আবুরাজকে বেঁধে ফেলে। কিন্তু প্রতিবার দেখা গেছে আবুরাজ যখনই লড়াই করেছে, সে একা হয়ে গেছে। এবারই ব্যতিক্রম। ওকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মুখে ন-আনি, ছ-আনি, কুমারডাঙা গ্রামের লোকজন ঘিরে ধরে। সবাই মিলে চিৎকার করে বলল, আবুরাজরে ধর‍্যে নে যাওয়া চলবে না, ও কুনো অন্যায় করেনি। পুলিশ লাঠি তুলল, বন্দুক উঁচিয়ে ধরল। কেউ কেউ সরে দাঁড়াল, কিন্তু চলে গেল না। পুলিশ মানে প্রশাসন। পরিবর্তনের রাজ্যে তাদের চোখের লালিমা কেটে এখন সবুজাভ হয়েছে। ওইসব হাড়হাভাতে মানুষজন এতদিন খুব দাপট দেখিয়েছে, আর নয়। ওরা হেঁকে ওঠে, এইও, সর, সরে যা বলছি--!

গোলমাল যখন একটা বিশ্রী আকার নিতে চলেছে, তখনই ঘোড়ার পিঠে চেপে স্বয়ং গাজি সাহেব এসে হাজির। হাঁফাতে হাঁফাতে তিনি দারোগাকে বললেন, এসব কী! আমার গাঁয়ের ছেলেরে ধরকে নে যাবেন, আমি থাকতি তা হবে না।

পুলিশ যত বোঝায়, আবুরাজের দোষ কী সাংঘাতিক! ওকে অ্যারেস্ট না করে উপায় নেই। গাজি ততই মাথা নাড়েন। মিষ্টি হেসে বললেন, দ্যাখো বাবা, বাস তো ভেঙেছে আমার, আমি তো কুনো অভিযোগ করছি না। আপনি উয়ারে ছেড়কে দ্যান।

গাজির পিছনে চার-পাঁচ গাঁয়ের মানুষ। সকলের চোখে মুখে একই আবেদন, একই প্রার্থনা। দারোগা বুঝলেন, এই অবস্থায় আবুরাজকে ধরে নিয়ে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা। অগত্যা ব্যাজার মুখে আবুরাজের বাঁধন খুলে দিয়ে ফিরে গেলেন।

আবুরাজ মুক্ত। কিন্তু মুক্তি ওকে স্বস্তি দিল না। মুখটা রাগে গনগন করছে। শহিদুল বাস চালিয়ে যত না অন্যায় করেছে তার থেকে বেশি অন্যায় করল যেন গাজি। এভাবে মুক্ত হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না আবুরাজ। গাজি শালো যেন দয়া দেখাল। এটা যে কতবড়ো অপমান, সেটা গাঁ-ঘরের লোকজন কী বুঝবে! ওরা তো গাজির নামে জয়ধ্বনি দিতে লেগেছে। ওরা যত হইহই করে, আবুরাজের শরীর ততই রাগে ফুলতে থাকে। আর এতে যেন নুনের ছিটে দিতে এলেন স্বয়ং গাজি সাহেব। তিনি আবুরাজের কাছে এসে বললেন, যাও বাবা, ঘরকে যাও। আঙগা গাঁ-ঘরের বিবাদ এহানেই বস্যে মিটকে নিতি হবে। থানা-পুলিশ কর‍্যেলাভ আচে নাই!

আবুরাজ রাগে ফেটে পড়ে, রাকো রাকো, তুমার শয়তানি আমি বুঝি না ভেবিছ! আগে ব্যাটারে দে আঙগা ভাত মারলে, এ্যাহন এয়োচ কাটা ঘায়ে নুন ছিটোতি!

দ্যাখো বাবা, এট্টা সাফ কতা জিগাই-- আমি বাস তুলকে নিলিই কি বাস চলা বন্ধ হবে? এ রাস্তা আমার নয়। আর বাসও আমার একার নেই। চারপাশের গাঁ-ঘরের লোকদের জিগাও তারা কী চায়! গতির যুগে কেউ বাবা গরুর গাড়িতে যেতে চাইবে!

আবুরাজ তবু গোঁ ধরে বলে, উসব আনসান প্যাঁচ আমি শুনতি চাইনে, তুমি বাস তোলবা কিনা বলো!

তুই তবে গতি চাস না?

কী গতি গতি করতোছো! গতি কি তুমি একাই জানো, আমরা জানিনে! তুমার গায়ে গত্তি আচে তাই গতির গপ্প মারো, অমন সুযোগ আমরা পেলি গতি তুমার পোঁদে ঢুক্যে যেত। ত্যাখন এই ঘোড়াও গাধা হয়ি যেত।

তুই এত্তবড়ো কতা বললি!

হ্যাঁ, বললাম। তুমি বাস তোলবা কিনা জানতি চাই!

ঠিকাচে, বাস আমি তুলকে নোবো, তবে এট্টা শর্ত আচে।

কী শর্ত?

তুই ঘোড়াদৌড়ে আমার এই ঘোড়া ইসমাইলরে যদি হারাতি পারিস, তবে এই সকলার সামনে কতা দিচ্চি, এই সড়কে আমার বাস কেন কারও বাস চলবে না। আমি দোবো না চালাতি। রাজি?

আবুরাজ বুক চিতিয়ে বলল, ঠিকাচে।

চারপাশের মানুষজন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল দুই অসম বয়সি মানুষের দিকে। ভাবল, এরা পাগল নাকি মাতাল! গাজির না হয় বয়েস হয়েছে, কিন্তু আবুরাজ! ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! গাজিকে হারাতে হবে, ঠিক আছে। তাই বলে কি পাগলামি করতে হবে! আবুরাজের নিশ্চয়ই মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে। বন্ধুরা আবুকে বোঝাতে যায়, তুই ঘোড়াদৌড়ে নামতি চাচ্ছিস, তোর ঘোড়া কুতকে?

আবুরাজ রোখের বশে কথা দিয়েছে। এখন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে ব্যাপারটা কত কঠিন। কিন্তু যাই ঘটুক এখন পিছিয়ে আসা যাবে না। সে জবাব দেয়, ঘোড়া আমার আচে, ও নিয়ে ভাবিস না। গাজিরে এবার হাগিয়ে ছাড়ব।

ওই আনন্দে নাচ। বন্ধুরা বলে।

যা যা--। আবুরাজ ওদের সঙ্গে ছেড়ে চলে যায় সতীশ সর্দারের কাছে। ও জানে সতীশই হচ্ছে ওর একমাত্র উদ্ধারকর্তা। ও নিশ্চয়ই ঘোড়া দেবে। তা ছাড়া এতদিন সতীশের সঙ্গে থেকে ঘোড়ার সঙ্গে ওর একটা সখ্যতা তৈরি হয়ে গেছে।

কিন্তু সতীশ ওকে দেখে ব্যাজার মুখে বলল, তোর কি খেয়ে বসে কাজ নেই, ঘোড়া নে গাজির নেগে টক্কর নিতি গেচিস!

আবুরাজ প্রায় কাতর আবেদনের ভঙ্গিতে বলে, দ্যাখো সর্দারের পো, এটা আমার মরণ বাঁচন লড়াই। এহন তুমিও যদি মুখ ফিরোয়ে নাও, তালি আমার আর মুখ দেখানোর জাগা থাকবে না।

সতীশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওর পিঠে হাত রেখে বলে, দ্যাখ ঘোড়া আমি তুরে দোবো, কিন্তু জিততি তুই পারবি নে।

মানে!

আচ্ছা, এ দিগরে য্যাত ঘোড়াদৌড় হয়, জেতে কে?

আবুরাজ গম্ভীর হয়ে বলে, গাজির ঘোড়া ইসমাইল।

তালে!

তালে আবার কী, বারবার জেতে বল্যে কি এবার জেতবে নাই! কী যে বলো!

এটাই দস্তুর রে। ঘোড়া য্যাতখুশি দৌড়ক কিন্তু জেতবে গাজির ঘোড়া।

তাই হয় নাকি!

মালাডাকে কী হল দেখলি তো! তুই কেন এই পাগলামি করতি গেলি! তা ছাড়া তুই এহনও পাকা সহিস হোসনি, পারবি?

পারি আর না পারি লড়তি তো দোষ নেই। দ্যাখো সর্দার, আমি জানি যে, আমি জিতলিও বাস চলবে, না জিতলি তো চলবেই। ও আমি আটকাতি পারব না, কিন্তু গাজির গুমোর তো ভাঙতি পারব।

দ্যাখ পারিস কিনা। আমিও তো চাই তুই ওদের থোঁতামুখ ভোঁতা কর‍্যেদে।

তুমি আমার হয়ে দোয়া কোরো।

করি রে করি, সবসময় করি। এই বলে সতীশ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

সেদিন উত্তরের মাঠে লোক ভেঙে পড়েছিল। আশেপাশের দশ-বিশ গাঁয়ের লোক সবাই এসে হাজির ঘোড়ার বাজি দেখতে। সতীশের ঘোড়া নিয়ে হাজির আবুরাজ। পিছনে পিছনে সতীশও। নিচু স্বরে বলে, দ্যাখ যাত্রাকালে কু-কতা বলতি নেই, তবু বলতিছি এ ঘোড়া কিন্তু ইসমাইলের নেগে কিচু না।

আবুরাজ হেসে বলে, আমার কতা শুনবে তো?

তা শুনবে। এ আমার পঙ্খীরাজ ঘোড়া। বলে সতীশ ওর ঘোড়ার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে কী সব বলতে লাগল। আবুরাজ অবাক হয়ে দেখল ঘোড়াটার রোগা পলকা শরীরটা যেন ফুলতে শুরু করেছে, শ্বাস ফেলছে ঘন ঘন। আবুরাজ বুঝতে পারল সতীশের ওষুধ ধরেছে। ও নিজেও গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। সকালেই মেদেরঘেরি থেকে রাজিয়া ফুফু খবর পাঠিয়েছে, আবুর‌্যা, আমি আল্লার দরবারে দোয়া মাঙছি, বাবু পিরের দরগায় মানত করিচি, তুই আজ জিতবি, আমার দিল শান্ত হবে।

সকালের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে। উত্তরের মাঠের ঘাস এখনও ভিজে। আকাশে রোদ নেই। মাঠের পুব দিকে যে বাঁক, সেখানে দাঁড়াল আবুরাজ। পাঁচ হাত তফাতে গাজির ঘোড়া ইসমাইল। ওর পিঠে সওয়ার মিজান নামে গাজির এক মানদার। বয়েসে আবুরাজের থেকে ছোটো। সে ওর তাকিয়ে পিচিক করে থুতু ফেলে খিক খিক করে হাসতে লাগল। দেখে রাগে জ্বলে গেল আবুরাজ। ইচ্ছে হল সাঁটিয়ে একটা চড় মারে ওর গালে। সতীশ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওর পিঠে হাত রেখে বলল, ফাঁদে পা দিসনে বাপ। ওরা তো প্যাঁচ-পয়জারি কর‍্যেজিততি চাইবে, তুই শেষ নিশানের দিকি লক্ষ্য রাখ। ওইটাই তুর জাগা। আর সব ভুল্যে যা।

দৌড় শুরুর আগে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল উত্তরের মাঠের চারপাশ। সেখানে কে নেই! মিনাখাঁর পঞ্চায়েত প্রধান, মেদেরঘেরির জয়নাল মন্ডল, জয়গ্রামের শিবনাথ দাস, মিনাখাঁর গোবিন্দ দাস-- এমন আরও কত মুখ। সবাই মানী মানুষ। গাজি সবাইকে শুনিয়ে বললেন, দ্যাখো বাপসকল, আমি সবার সামনে কতা দিচি, এ দৌড়ে আবুরাজ জিতলি ওই মিনাখাঁ সড়কে বাস চলবে না। এ কতা থাকবে। এহন আবুরাজ চাইলে দৌড় দু-বার হতি পারে।

আবুরাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তার দরকার নেই। শুধু তুমারে কতা দিতি হবে কুনো জোচ্চুরি করবা না।

আমি এহানে কেউ না, এরা সবাই আচে, এরা দ্যাখবে।

এদের বিশ্বাস! সব তুমার দলে।

ঠিকাচে, তুমি যেভাবে বলবা সেভাবে দৌড় হবে। তুমিই বলবা কে জিতেছে। রাজি?

হ্যাঁ।

এই কথার পর কথা চলে না। অতএব দৌড় শুরু হয়। প্রথমে একসঙ্গে চলছিল ইসমাইল আর পঙ্খীরাজ। কিন্তু একটা বাঁক ঘুরতেই আবুরাজ টের পেল ইসমাইলের গতি বেড়ে যাচ্ছে। গাজির বাড়ি দানাপানি খাওয়া ঘোড়া। ওর চেহারা চেকনাই আলাদা। যেমন তাগড়াই, তেমন তার পায়ের গতি। মাইলটাক গিয়ে আবুরাজ টের পেল ওর ঘোড়া ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। হেরে যাচ্ছে সে। আবুরাজ পঙ্খীরাজের ঘাড়ে হাত রেখে চিৎকার করে বলতে থাকে, চল পঙ্খীরাজ, তুই আমার দিলের জান, আমার মান সম্মান। উড়কে চল ভাই, উড়কে চল। এইও ধর শালাকে মার শালাকে-।

আবুরাজ যত পঙ্খীরাজকে এ কথা বলে, ওর চোখে পড়ে ইসমাইল ততই যেন উড়ে যাচ্ছে। এক সময় ওকে আর দেখা গেল না। যেন শূন্যে ডানা ভাসিয়ে দিল। অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে।

হেরে ভূত হয়ে গেল আবুরাজ। মাথা ওর আবার নিচু হয়ে গেল। গাজি তবু সবাইকে শুনিয়ে বললেন, দ্যাখো বাবা, আমি গাঁ-ঘরের লোকের নেগে বিবাদ চাইনে। আমি চাই সকলা খেয়েপরে বাঁচুক। ওই রাস্তায় বাস চলবে তবে তিনটের বেশি ট্রিপ দেবে না। তালি ভ্যানেরও সুবিধা হবে।

গাজির এই ব্যবস্থায় সকলে ধন্য ধন্য করে। শুধু আবুরাজ ব্যাজার মুখে পঙ্খীরাজের ঘোড়ার দড়ি ধরে ফিরে যায়। ওর বুকের ভিতরে যেন দাবানল জ্বলতে থাকে। আর কেউ না বুঝুক সতীশ বুঝেছিল আবুরাজের অবস্থাটা। সে ওর পিঠে হাত রেখে বলে, শান্ত হ আবু--।

আবুরাজ হঠাৎ হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে, সর্দার আমি আবার হেরকে গেলাম গো।

না আবু তুই হেরিচিস কে বলল! সবাই তো দেখল গাজির নেগে টক্কর নিতি পারে এই একজনা। এ লড়াই তো শেষ হয়ে যায়নি। আবারও হবে অন্য জাগায়। তুই তো বাবা হাল ছেড়কে দেওয়ার ছেলে না।

আমি কি আর পারব! ও শালার গাজির থোঁতা মুখ ভোঁতা করতি পারব!

পারবি নে মানে! পারতি হবে। ওরে দুনিয়া কারও বশ না। একদিন তোরও দিন আসবে। সে দিনের নেগে তৈরি থাক।

আবুরাজ মাথা নিচু করে বসে থাকে। ক্রমে টের পায় ওর বুকের ভিতর থেকে ঢেউ উঠছে। ওকে ঠেলে দিচ্ছে যেন এক মহা সমুদ্রের দিকে। তখন সবে সন্ধে।





##



এ কাহিনি এখানেই শেষ হতে পারত। হলে অসুবিধে কী! এ তো সত্যি, চিরকাল গাজির মতো লোকেরা জিতে যাবে তাই হয়! সেটা সাজিয়ে দেখানোর খুব দরকার আছে নাকি! আমার মনে হয় নেই। তবে এই কাহিনিতে একটা মোচড় আছে। এবার সেটা বলা দরকার।

সেদিন সতীশ আর আবুরাজ মনের দুঃখে খুব তাড়ি খেয়েছিল। সতীশের মুখে একটাই কথা, হাল ছাড়লি হবে না আবুরাজ। লড়তি তুরে হবেই। একবার জিততি পারলি দেখবি আজ যারা গাজির নেগে হাত তোলে, ধন্য ধন্য করে, সেদিন তুরেও করবে। তবে সেদিন য্যানো ভুলকে যাসনে তুই কে ছিলিস, ক্যামন ছিলিস!

আবুরাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে, ভুলব না সর্দার, ভুলব না--।

এই একটা কথা ওর নেশাতুর মাথার মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। ভুলব না ভুলব না বলতে বলতে সে বাড়ির পথ ধরে। ঘন অন্ধকার। আকাশে বেশ মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে বোধহয়। আবুরাজ টলমল পায়ে হাঁটতে থাকে। আজ বাড়ির সামনে দিয়ে ঢোকার উপায় নেই। বাপ হামিদ বসে আছে। দেখলেই খিস্তি শুরু করবে। আবুরাজ বাড়ির পাশ ঘুরে পগারের ধার ঘেঁসে যাচ্ছিল। পগারে জল ভর্তি। ও পারে গাজি সাহেবের বাগান। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে তারস্বরে। তার মধ্যে থেকে একটা ক্ষীণস্বরে ডাক ভেসে আসে, ও আবু, বাপ ফিরলি!

আবুরাজ এতক্ষণ ভুলব না ভুলব না বলতে বলতে হাঁটছিল, থমকে দাঁড়াল সে। প্রথমে মনে হল মনের ভুল। ও আবার পা বাড়িয়েছে, তখনই আবার শুনল, ও আবু, ফিরলি বাপ!

আবুরাজ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কে?

পগারের ও পারে ঘোর অন্ধকার। তার ভিতর থেকে উত্তর এল, আমি--।

আমি কেডা?

ওরে আমি রে আমি। আমারে চিনতি পারচিস নে?

অন্ধকার অনেকখানি চোখ সহা। আবুরাজ নেশাজড়িত চোখে ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করে। কিছুই বুঝতে পারে না। আবছা দেখতে পায়, পগারের পারে সাদা কুর্তা পায়জামা, হাতে একটা লাঠি, সাদা চুলদাড়িও নজরে পড়ে। আবুরাজ মাথা ঝাঁকায়। যে ছবিটা চোখে ফুটে উঠছে, তার কথা ভাবতেই মন চাইছে না। কিন্তু সেটাই যেন বুক ঠেলে উঠে আসছে বার বার। মুখে বলেও ফেলে, শালোর গাজি, তুমি!

হ্যাঁরে বাপ, আমি।

এহানে কীয়ের নেগে, আমারে মারবা নাই! তা তুমি মারতি পারো। তুমি শালো ট্যাকা চাটা লোক, তুমার হাতেই দুনিয়া বশ। তুমি ট্যাকা ছিটোলিই য্যাত কাকের দল এস্যে আমার শির লে তুমারে নজরানা দেবে। তা মারো। আমি তো দেঁড়কে আচি।

ওদিক থেকে উত্তর আসে, কী যে বলিস। তুরে মারব ক্যানো! আমি একাই এইচি। দেঁড়কে আচি তুর নেগে।

ক্যানো?

এট্টা কতা বলার নেগে।

কী কতা?

ওরে আমি জিততি চাইনি। বারবার চেইচি তুই জেত।

আবুরাজ এবার মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে, ঢং মারার আর জাগা পাচ্ছ না। আমারে সবদিক থে হেরকে দে, এহন এয়াচ ঢং মারতি!

নারে বাপ, আমার বিশ্বাস যা। আমি জিততি চাইনে। বরং তুই জেত এটাই চেইচি।

দ্যাখো, এই রাতকালে তুমার ঢং মারা কতাবার্তা আমার ভালো লাগতেচ না। আমি চললাম।

বলে সত্যিই পা বাড়ায় আবুরাজ। ও দিক সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, বাপ শোন শোন। আমি সত্যি চাইনে জিততে। তবু আমারে জিততি হয়।

মানে!

এই মানেটাই তো মজার রে আবুরাজ। আমি পিতিবার চেইচি আমি হেরকে যাই, তুই জিতে যা। কিন্তু তা হয় না। আমারেই জিততি হয়। ভালো না লাগলিও জিততি হয়। এটাই নিয়ম রে বাপ।

ও নিয়মের মুকি আমি পিসাব করি। তুমারে একদিন না একদিন হারাব তবে আমার নাম আবুরাজ বল্যে রাখলাম।

আমিও তাই চাইরে বাপ। তুই আমারে হারা। আমার আর জিততি ভালো লাগে না। আমি কখনও হারার জ্বালা বুঝিনি, সেটা বুঝতি চাই। এই যে পগারের দু-পারে আমরা আমার দেঁড়কে আচি, আমি চাই তুই আর আমি জাগা অদল বদল করি। তুই এ পারে আয়, আমি ও পারে যাই। তুই য্যামন এ পারের স্বাদ পাসনি, আমিও ত্যামন পাইনি ও পারের স্বাদ। তুই আয়, এস্যে দ্যাখ এ পারের জ্বালা ক্যামন। আমি কখনও তুদের পারের জ্বালা বুঝিনি, আমারে সেটা বুঝতি দে।

আবুরাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, শালো, নেশা করলাম আমি আর মাতাল হলে তুমি! খেয়েবসে আর জাগা পাচ্ছ না, এ পার ও পার করতোচো!

না রে বাপ, আমি সত্যিই এটা চাই, আল্লার কসম।

দ্যাখো তুমার মুকি আল্লার নাম মানায় না। ও তুমি বলবা না। আর য্যাতই ঢং করো, আমি লড়াই ছাড়ব না। এহানে তুমারে হেরকে দে তবে আমার শান্তি-- এই শেষ কথা বলকে রাখলাম।

ও পার থেকে যেন দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল, ও বাপ, এ লড়াই কি শেষ হবে না?

আবুরাজ চিৎকার করে বলে, না, শেষ হবে না। হতি পারে না। আমি ভুলব না, ভুলতি পারব না। বলতে বলতে আবুরাজের চোখদুটো হঠাৎ ধাঁধিয়ে গেল। প্রচ- জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। সেইসঙ্গে কড়কড় করে মেঘের গর্জন। আর তারপরই শুরু হয়ে গেল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আবুরাজের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। ও পারে গাজির শরীরটা আর দেখা যাচ্ছে না।

আবুরাজ মাথা নাড়ায়। চোখদুটো কচলে নেয় বারবার। ও কি এতক্ষণ নেশার ঘোরে ভুল দেখছিল! কে জানে! যাক গে মরুক গে। 


 

লেখক পরিচিতি
অনিল ঘোষ

জন্ম উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট শহরেনদীর তীরে।  সেখানেই বসবাসপড়াশোনা। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ। বাঁধাধরা চাকরির পথ ছেড়ে প্রায় বাউণ্ডুলে জীবনযাপন। কখনও টিউশানিকখনও সাংবাদিকতা। বর্তমানে কলকাতার প্রকাশনা জগতের সঙ্গে যুক্ত। 
পরিচয় পত্রিকার দপ্তর সম্পাদক। সম্পাদিত পত্রিকা ইছামতী বিদ্যাধরী। 

লেখালেখির সূত্রপাত স্কুল থেকে। এ পর্যন্ত গল্প-উপন্যাস-নাটক ও অন্যান্য রচনা মিলিয়ে তেরোটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থÑÑ রণক্ষেত্রচারাগাছ ও অন্যান্য গল্পনিউ জার্সির ফোন,মহাযুদ্ধের পটভূমি (গল্প সংকলন)প্রান্তরের গান (উপন্যাস)নির্বচিত নাটক (নাটক)অকিঞ্চন কথামালা (কবিতা)শ্রেষ্ঠ শিখাবিষয় বসিরহাট (সম্পাদনা) প্রভৃতি।

২০০৭ সালে ছোটোগল্পের জন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রদত্ত ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ