দেশভাগ আর মাইকেল মধুসূদনের জীবনের প্রেক্ষাপটে উপন্যাস লিখেছেন অমর মিত্র। সরাসরি সে বই প্রকাশিত হতে চলেছে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া থেকে৷ প্রকাশের আগেই সেই উপন্যাস দশমীদিবসে-র পাণ্ডুলিপি পড়ে ফেলল আমার আনন্দবাজার।
দশমীদিবসে
প্রকাশক- ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, লেখক- অমর মিত্র
আশিস পাঠক
দেশভাগে সমস্ত দেশই হয়ে ওঠে বিদায়ঘাট। ছবি- বই থেকে গৃহীত।
‘সুপবন বহিতেছে দেখিয়া, জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও তাহাতে নাম লেখ ‘‘শ্রীমধুসূদন’’। বার বার পড়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই ছোট্ট প্রবন্ধটি, ‘মৃত মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ আরও এক বার পড়তে ইচ্ছে করল অমর মিত্রের এই সাম্প্রতিক উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি পড়ে। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ভাদ্র ১২৮০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল শোকপ্রস্তাবের মতো এই প্রবন্ধটি। তার কিছু আগে, ১৮৭৩-এর ২৯ জুন রবিবার দুপুর দুটোয় জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের। অসুস্থতা, অর্থাভাব, দেনার দায় এবং নিজের মৃত্যুর ঠিক তিন দিন আগে স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর খবরে জীর্ণ, অতি জীর্ণ সেই মৃত্যু। যে বিষাদে মেঘনাদবধ কাব্য-এর শেষ করেছিলেন মধুসূদন, সে বিষাদের ছিটেফোঁটাও কি ছিল তাঁর মৃত্যুতে? ‘সপ্ত দিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে’, বঙ্গদেশ মধুসূদনের মৃত্যুতে ক’দিন কেঁদেছিল তা গবেষণাসাপেক্ষ।
কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র ওই প্রবন্ধ-প্রস্তাবে রোদন করার কথা বলেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘বঙ্গদেশ, বঙ্গকবির জন্য রোদন করিতেছে। বঙ্গ কবিগণ মিলিয়া বঙ্গীয় কবিকুলভূষণের জন্য রোদন করিতেছেন। কবি নহিলে কবির জন্য রোদনে কাহার অধিকার?’ ঠিক এর আগের লাইনেই, ওপরে যা উদ্ধৃত করেছি, বঙ্কিম কী বলছেন? মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মৃত’, এই বার সুপবন বইছে, সেই অবসরে জাতীয় পতাকা-য় তাঁর নাম লেখ। কোন নাম? মাইকেল মধুসূদন দত্ত নয়, শ্রীমধুসূদন।
বঙ্গদেশ, বঙ্গকবি, বঙ্গীয় কবিকুলভূষণ, বঙ্গভূমি... একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, মধুসূদনের কবিআত্মা ও কাব্যশিল্পের কোন মর্মটিকে ধরতে চাইছেন বঙ্কিমচন্দ্র। একান্ত বাঙালি মর্মটিকে। সেই বাংলা, ১৮৭৩-এর বাংলা। বঙ্গজ-জনের কানে সেই জন্মভূমির নদ কপোতাক্ষের গান শোনাতে চেয়েছিলেন প্রবাসে, তাঁর মৃত্যু ঘটল গঙ্গার পূর্বকূলে, ঐতিহাসিক ভাবেই অখণ্ড সেই বাংলার ধারণা তাঁর কাব্যের মর্মে।
বাংলা ভাগ, বঙ্গজ-জনের দুই রাষ্ট্রে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া দেখে যাননি মধুসূদন। কিন্তু জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা অনুভব করেছেন। তার ছিঁড়ে যাওয়ার হাহা-রব বেজেছে তাঁর প্রাণে। সেই মধুসূদন যখন বীরাঙ্গনা দাসীর যাত্রার সঙ্গী হয়ে থাকেন এই ‘দশমীদিবসে’ উপন্যাসে তখন সেই যাত্রাটা একরকম আত্মানুসন্ধানের যাত্রা হয়ে ওঠে। নিজের ‘আমি’-কে কোথাও এনে না ফেলেও ঔপন্যাসিক সেই সন্ধানের অংশী হয়েছেন। ‘আরম্ভের আগে’ এ উপন্যাসের প্রেরণার কথা লিখেছেন অমর মিত্র, ‘এই উপন্যাসের কথা ভেবেছিলাম বহুবছর বাদে ২০০০ সালে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে, যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের কপোতাক্ষকূলে বসে বিদায়ঘাটের কথা শুনে। কবি মধুসূদন, মা জাহ্নবীকে নিয়ে যে বিদায়ঘাটের যে কাহিনি শুনেছিলাম আমি, সেই বিদায়ঘাটই আমাকে প্ররোচিত করে এই উপন্যাস লিখনে। আর মেঘনাদবধকাব্য, মেঘনাদের মৃত্যু, রাবণের হাহাকার, মধুর জীবন। দেশভাগে সমস্ত দেশই হয়ে ওঠে বিদায়ঘাট।’
বিদায়ঘাটের কথাই বলে বেড়ায় উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বীরাঙ্গনা দাসী। মধুসূদনের সন্ততি সে। প্রবাসী মধুসূদনের মতোই, বীরাঙ্গনারও সঙ্গে সঙ্গে যায় কপোতাক্ষ: ‘বীরাঙ্গনা দাসী দিল্লি থেকে ফিরুক বা কলকাতা থেকে দিল্লি যাক, বসিরহাট থেকে কলকাতা আসুক বা কলকাতা থেকে ৭৯ নম্বর বাসে চেপে বসিরহাট ফিরুক, তার মনে কপোতাক্ষই বহে যায় শুধু। সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে। সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’
অমর মিত্র বীরাঙ্গনার জীবনের মধ্য দিয়ে স্মৃতির সেই ছবিটাকে আবার নতুন করে এঁকেছেন। বড় বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, স্বদেশ সম্পর্কে ক্লাসিক ছকে বাঁধা ধারণাটার বিপ্রতীপে সযত্নে এঁকে দিয়েছেন দেশের অতি সাধারণ মানুষের জীবনের জলছবি- সেই সাগরদাঁড়ি, সেই কপোতাক্ষ, সেই অশ্রুনদীর সুদূর পারে বিদায়ঘাট। ‘দশমীদিবসে’ তাই একই সঙ্গে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও শ্রীমধুসূদনের ঔপন্যাসিক জীবনভাষ্য, বীরাঙ্গনার জীবনে যা গোটা একটা জীবন হয়ে জীবন্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশভাগের এমন গভীর প্রতিফলনও সাম্প্রতিক অতীতে বাংলা সাহিত্যে ঘটেনি।
0 মন্তব্যসমূহ