কুলদা রায়ের আগান কথা—বাগান কথা

কুলদা রায়

১.
ছেলেবেলা থেকেই রোগা পটকা ছিলাম। ঠাকুরদা এ কারণের খেলার মাঠে যেতে দেননি খুব বেশী। শহরের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরীর সিঁড়িতে বসিয়ে নিজে খেলা দেখতে যেতেন। তখন আমার ক্লাশ টু। আমি নিতান্তই নিরীহ মানুষ। ভেতরে লাইব্রেরীয়ান ময়েন স্যার বসে আছেন। শাদা পা-জামা পাঞ্জাবী পরা। খুব গম্ভীর। আমার ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। 

বারান্দায় একা বসে থাকি। পাশে পুলিশের ট্রেজারী। মাঝে মাঝে ঘণ্টা বাজে। শালগাছের পাতা ঝরে পড়ে। লাইব্রেরীর বাগানে ফুল ফোটে। কটা প্রজাপতি ঘুর ঘুর করে। মাঝে মাঝে শুনতে পাই—খেলার মাঠে কারা কারা চেঁচিয়ে উঠছে-গো-ও-ল।

এর মধ্যে চোখে পড়ে বাগানের শাদা দেওয়ালে লাল কালিতে লেখা আছে—ফুল ছিড়িবেন না। একদিন সাহাপাড়ার সুকেন্দুদা আর বাইদ্যা পট্টির সরফরাজ ভাই ইটের টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে না শব্দটি তুলে ফেলছেন। আমাকে ইশারায় ফিস ফিস করে বললেন, চুপ। কোনো কথা হবে না। আমি চুপ থেকে দেখতে পেলাম আমাদের পাশের পাড়ার এই দুই দাদা না শব্দটি অতি যত্নের সঙ্গে তুলে ফেলে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। বলে গেলেন—খবরদার কাউকে কবি না। 

পড়ে দেখি—ফুল বাগানের দেওয়ালে লেখা আছে বাগানে ফুল ছিড়িবেন। পুরো অর্থ গেছে পালটে। আগে না শব্দটি থাকায় বাগান থেকে ফুল তোলা যেত না। এখন না শব্দটি না থাকায় ফুল তোলা কাজটি করা যাবে। কেউ না করতে পারবে না।

পরদিন সুকেন্দুদারা আবার এলেন। সোজা ফুল বাগানে ঢুকে ফুল ছিড়তে লাগলেন। ময়েন স্যার দেখে খুব রেগে গেলেন। সুকেন্দুদা বললেন, রাগেন ক্যান। আপনিই লিখে রেখেছেন—বাগানের ফুল ছিড়িবেন। আমরা তাই ছিড়ে নিচ্ছি। যখন ফুল ছিঁড়িবেন না লেখা ছিল তখন তো আমরা ফুল ছিড়ে নেইনি। সোজা কথা।

ময়েন স্যার অত্যান্ত নীতিবাগীশ লোক। তিনি লেখাটি দেখলেন। দেখলেন যেখানে ফুল ছিড়িবেন না লেখা ছিল সেখানে না শব্দটি নেই। এখন বাগানের ফুল ছিড়িবার কথাই লেখা আছে। ফলে তিনি আর তাদের সঙ্গে টু শব্দটি করলেন না। 

ময়েন স্যার এক খণ্ড কয়লা এনে আমার হাতে দিলেন। বললেন, যাও বৎস,--ওখানে একটা না শব্দ লিখে দিয়া আইস।

আমি আমার ক্লাশ টুর অক্ষর বিদ্যা দিয়ে একটা না শব্দ বসিয়ে দিলাম। তখন আবার বাগানের ফুল ছিড়িবেনের বদলে বাগানের ফুল ছিড়িবেন না হয়ে গেল। ফুল ছেড়া কাজটির মধ্যে একটা নিষেধাজ্ঞা বসে গেল। স্যার এবার শান্ত শমিত গলায় বলবেন, তোমরা এবার বাগানের বাইরে চলে যাও। না গেলে পুলিশ ডাকব।

সুকেন্দুদারা লেখাটি দেখলেন। তারা দেখলেন--না শব্দটি তুলে ফেলার কারণে তারা যে শক্তিটি অর্জন করেছিলেন—না শব্দটি বসে যাওয়ার ফলে সেই শক্তিটি লুপ্ত হয়েছে। বাগানে ঢোকার সাহসও তারা হারিয়ে ফেললেন। তারা আর দাঁড়ালেন না। মাথা নিচু করে চলে গেলেন। আর কখনো ফুল ছিড়তে আসেননি।

সেই ক্লাশ টুর সময়েই টের পেয়েছিলাম—শব্দের ক্ষমতা অসীম। এই ক্ষমতা মানুষের মধ্যে চলে এলে মানুষ অমিত শক্তি, ক্ষমতা আর সাহসের অধিকারী হয়ে ওঠে। তাকে ঠেকানো যায় না। যে কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে যাদু বিদ্যার মত। শব্দের ক্ষমতা অসীম। পরমাণু বোমার মত। যে কোনো সময় তাজ মহল বানানো যায়। আবার বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়। শব্দবিদ্যা জানলে ঈশ্বর হওয়া যায়। এ কারণে বাইবেলে লেখা আছে আদিতে শব্দ ছিল। উপনিষদে লেখা আছে শব্দই ব্রহ্ম।

ছেলেবেলা থেকেই আমি শব্দের এই যাদুবিদ্যায় মুগ্ধ। সেই মুগ্ধতা টের পেয়ে ময়েন স্যার আমার সেই নিতান্ত শিশু বয়েসে লাইব্রেরীর দরজা খুলে দিয়ে বললেন, এসো। বললেন, ঘুরে ঘুরে দেখো কিছুদিন। কিছু ধরবে না। শুধু দেখবে।
আমি এরপর প্রতিদিন বিকেলে আসি। আর বারান্দায় বসে থাকা নয়---সোজা লাইব্রেরীর মধ্যে ঢুকে যাই। ঘুরে ঘুরে আলমারীগুলো দেখি। দরজায় তালা ঝুলছে। চাবি ছাড়া খোলা যায় না। চাবিটি ময়েন স্যারের কাছে। তিনি নিজে না ডাকলে তার কাছে যাওয়ার সাহস হয় না।
ফলে আমি ঘুরে ঘুরে বইয়ের আলমারীগুলি দেখি। ভেতরে আটকে থাকা বইগুলি দেখি। মলাটগুলি দেখি। বানান করে করে নামগুলো মুখস্ত করি। এইভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পরে ময়েন স্যার আলমারীর দরোজা খুলে দিলেন। বললেন—এবার শুধু বইগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবে। ভুলেও খুলবে না।

আমি স্যারের অনুমতি পেয়ে ছুঁয়ে দেখার আগে বইগুলো নয়ন মেলে দেখি। তারপর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। ঘ্রাণ নেই। কান পাতি। শুনতে পাই কারা যেন ফিস ফিস করছে। কথা বলছে। বোঝা যায় না। আর্তনাদের মত। আনন্দের মত। বেদনার মত। ভালোবাসার মত। নেশা ধরে যায়।


এই নেশার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই লুকিয়ে লুকিয়ে বইগুলো পড়তে শুরু করি। বুঝতে পারি বইয়ের মধ্য কিছু মানুষ থাকে। নিজেকে লিখে রাখে। চিরকাল থেকে যায়। বয়স বাড়ে না। বুড়ো হয় না। তার মৃত্যু হয় না। হারিয়ে যায় না।

সে সময় আমার নিজের কোনো বই ছিল না। কিছু বইয়ের শখ জেগেছিল। কেনার সামর্থ্য ছিল না। সেই ক্লাশ টুর বয়সে এ সমস্যার সহজ সমাধান করে ফেলেছিলাম। বাবার পুরনো ক্যাশবুকে আমার পড়া গল্পগুলো নিজের মত করে লেখা শুরু করি। তাই দেখে ময়েন স্যার এবার আমাকে বই পড়ার অনুমতি দেন। আমি পড়ি আর ক্যাশবুকে লিখে রাখি। কখনো ছবিও এঁকে রাখি। লিখি বইয়ের নাম। লেখকের নাম। গল্পটি। গল্পটির সার সংক্ষেপ। অথবা গল্পের একটি অংশ। কয়েকটি প্যারা। কয়েকটি বাক্য। অথবা কিছু শব্দ। লেখা হলে বুঝতে পারি—এই লেখাগুলি জ্যান্ত। কই মাছের মত লাফালাফি করতে পারে। চোখ মেলে চায়। সামনে এগোয়। লাগলে ধারালো কানসে ফুটিয়ে দিতে পারে।

বাবা এই লেখা দেখে খুব খুশীই হয়েছিল। ক্লাশ থ্রি থেকে বাবা আমাকে লেখালেখির কাজে পুরো লাগিয়ে দিল। সারাদিনের দোকানদারী সেরে রাতে ফিরে তার হিসেব পাতি নিয়ে বসত। বাবা মুখে মুখে বলে যেত—আর আমি লিখতাম—শ্রী শ্রী গণেশায় নমঃ। মোকাম খাটরা। ডানদিকে লিখতাম-- শ্রীকানাই লাল দাস। মালামাল ক্রয় বাবদ দেনা—২০০ টাকা। ফেরত ১৯০ টাকা। জের ১০ টাকা। বাম দিকে লিখতাম গফুর মণ্ডল। কেরোসিন তেল—১ সের। বাকি-৩ টাকা। ইত্যাদি। 

বাবার ক্যাশবুক লিখতে লিখতে এক সময় দেখলাম—বাবা শ্রীকানাই লাল দাসের দেনা শোধ করতে পারছে না। দেনার অঙ্ক বেড়ে যাচ্ছে। বাবা খুবই নিরীহ প্রকৃতির লোক। পড়েছে মাত্র ক্লাশ টেন। দেনা শোধ করতে পারছে না দেখে বাবা শ্রীকানাই লাল দাসের গদিতে যাওয়া ছেড়েই দিল। দোকানে মালামাল কমে গেল। বিক্রিবাটাও নেই। সংসার চলে না। বাবার ঘুম আসে না। বিড় বিড় করে কি যেন বলে। কারো সঙ্গে কথা নেই। কথার মধ্যে বারবার শুধু আমাকে ডেকে বলে—পড়তো খোকা, কতটাকা দেনা হইছে। আমি পড়ি ৫৫০ টাকা।

বাবার দেখা না পেয়ে শ্রীকানাই লাল দাশ দোকানে একবার ঘুরেও গেলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর বাবাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি কালকে? 

তিনি ক্যাশবুকটা বের করে দেখলেন। পকেট থেকে একটা পাইলট পেন বের করে ৫৫০ এর শুন্যটা কেটে দিলেন। বললেন—যত্তসব। 

যেতে যেতে বললেন, ছেলেপেলের বাপ হইছে—এখনো মানুষ হইল না। যাওয়ার আগে আমাকে দুটো লজেঞ্জ দিলেন। আর সেদিন তার গদি থেকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে গেল বাজার। দুটো ইলিশ মাছ। তাজা লাউ। মসুর ডাল। আলু পটল। মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে সর্ষে ইলিশ রান্না করল। বাবাকে খেতে ডাকলেও এলো না। নারিকেল বাগানের মধ্যে বসে রইল। অনেক ডাকাডাকির পরে বলল, খোকা—ক্যাশবুকটা আবার পইড়া শোনা তো।

আমি এবার পড়লাম—শ্রীকানাই লাল দাস। দেনা ৫৫ টাকা। শুনে বাবার মনে হল ভুল শুনেছে। বলল—আবার পড়। ঠিক কইরা পড়।

আমি এবার গলা ফাটিয়ে পড়লাম—মাত্র ৫৫ টাকা। বাবা তার চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে বলল, আজ সকালে যে পড়লি—৫৫০ টাকা। অখন ৫৫ টাকা হয় কি কইরা?
ক্যাশ বইটা খুলে বাবার দিকে এগিয়ে দিলাম। বাবা দেখল শুন্যটি কাটা। সেখানে ৫৫ টাকাই লেখা। দেনা মাত্র ৫৫টাকা।
জিগেস করল, কে কাটছে? তুই কাটছিস?
বললাম, না আমি কাটিনি। 
বাবা এবার একটা চড় কষিয়ে বলল, আমার ছেলে মিথ্যে কথা বলবে এইটা আমি বাঁইচা থাকে সহ্য করব না।
আমি মুখে হাত চেপে ধরে বললাম— কাটছেন শ্রীকানাই লাল দাস। তিনি কইছেন--তোর বাবা ভুল লেখছে। ওটা ৫৫ টাকাই হইবে। 

পরদিন বাবার আবার দোকানে মালামাল তুলল। আমাদের নিয়মিত বাজার হতে লাগল। বাবার মুখে হাসি ফুটল। ধীরে ধীরে বাবা ৫৫টাকা নয়—পুরো ৫৫০ টাকাই শোধ করে দিয়েছিল। পরে শ্রীকানাই লাল দাসের গদিঘরের ক্যাশখাতাও লিখেছি। শুন্যের কী ক্ষমতা সেদিন শ্রীকানাই লাল দাসের কাছে শিখেছি। তিনি প্রাতঃস্মরণীয়।


এর পরে একটু একটু করে বড় হয়েছি। দাদাজান নূরুল হক বিএ-এর চিঠিপত্র লেখার কাজ পেয়েছি। দাদাজানের বয়স তখন ৯০ টপকে যাচ্ছে। খুব ঝুঁকে ঝুঁকে তিনি মসজিদে যান সুবেহ সাদিকে। আর ফেরেন নদীর পাড় ঘুরে। পথে পথে ইটের টুকরো টাকরা কুড়ান। কুড়িয়ে কাঁধের ব্যাগে রাখেন। এইভাবে তিনি তাঁর ভেতর বাড়ি থেকে পাকা রাস্তা অব্দি রাস্তা বানিয়েছেন। তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে ছেলেদের কাছে চিঠি দিতেন—পোস্ট কার্ডে। কদাপি খামে নয়। তাঁর ১২ জন ছেলেমেয়ে। ৮ জন থাকে বিদেশ বিঁভুই। 

দাদাজান চিঠির কথাগুলো বলতেন খাটে শুয়ে। চোখ বুজে। আর আমি পোস্ট কার্ডে লিখে যেতাম। কোথাও ফাঁকা থাকত না। তিনি বলতেন—মুহাম্মদ গোলাপ মিয়া, দোয়াপর বাবা গোলাপ মিয়া, আশা করি পরম দয়ালু আল্লার রহমতে সহি সালামতে রহিয়াছ। তিনি সর্ব শক্তিমান। তাহার সহস্র সহস্র চক্ষু আছে। তিনি সবই দেখিতে পাইতেছেন। তাহার সহস্র সহস্র কর্ণ আছে। সকলই শুনিতে পাইতেছেন। তাহার অগোচর কিছুই নাই। গুপ্ত বলিয়া তাহার কাছে কিছুই নাই। তাহার না-পছন্দ কিছুই করিবে না। তাহার নির্দেশিত পথে চলিলে জান্নাত পাইবে—আমিও পাইব। এই বয়সে পহুছিয়া জান্নাত ভিন্ন আমার আর কোনো বাসনা নাই। পুত্র হিসেবে আমার এই আখেরি বাসনা পূর্ণ করিবার দায়িত্ব তোমাদিগের। সদা সর্বদা আল্লার নাম স্মরণ করিবা। মাথায় টুপি পরিধানপূর্বক জামাতে নামাজ পড়িবা। জীবনে ইসলাম হইবা। ইসলাম হওয়া ছাড়া এ জীবনে আর কোনো উদ্দেশ্য নাই। আল্লাহ তোমাদের সহায় হউক। আমেন।

এ-ই আমার দাদাজান আব্দুল হক বিএ-এর চিঠির বয়ান। এই বয়ানের একটি শব্দও তিনি তাঁর জীবনে পাল্টাননি। নতুন শব্দও জুড়ে দেননি। না-কোনো ব্যক্তিগত সংবাদ। না-কোন পারিবারিক খবর। না-কোনো বিষয় সম্পত্তির কুশল। দাদাজানের জীবনে এসব বালাই ছিল না। দুএকটি চিঠি লেখার পরে আমার এই বয়ানটি মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। ফলে দাদাজান কি বললেন আর না বললেন এটা নিয়ে আমার ভাবনা ছিল না। আমি কিছুদিন পরে নিজের মত করে লিখতাম। লিখতাম—বাড়ির দক্ষিণ পাশে একটি সজিনা গাছ লাগানো হইয়াছে। তাহার ফুল দেখিতে সুন্দর। সজিনার ডালের বড়া দিয়ে খাইতে বড় স্বাদ। এবার নলেন গুড়ের বাজার দর চড়া নয়। সুন্দর বন হইতে দুই বোতল মধু আসিয়াছে। এ পাড়ার বটতলায় এবার সর্প আসে নাই। এই জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষাশেষি ঘরে পিপড়া ঢুকিতেছে। এইবার বন্যা হইবার আশঙ্কা পরিলক্ষিত হইতেছে। এই সব লিখলেও দাদাজানকে পড়ে শোনানোর সময় কিন্তু তাঁর বয়ানটিই মুখস্ত বলতাম। তিনি চোখে দেখতেন না। দেখার দরকারও ছিল না। আমার কথাই সহি মনে করতেন। তাঁর ৮ ছেলে এই চিঠি পেয়ে খুশিই হতেন। সজিনা ডাঁটা, নলেন গুড় এবং সুন্দর বনের মধু খেতে দেশে আসতেন।

এর মধ্যে গোলাপ কাকা বেশ হাসি খুশি লোক। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। একবার দাদাজানের চিঠিতে লিখে দিলাম—দোয়াপর বাবা মুহাম্মদ গোলাপ মিয়া, পাড়ার ছেলেদের স্নেহ করাও তোমা দিগের দ্বায়িত্ব। তাহারা এইবার শীতকালে যাহাতে ক্রিকেট খেলিতে পারে—তাহার সত্বর ব্যবস্থা করিবে। ইহার অন্যথা যেন না হয়। ইহা আমার আরেকটি আখেরি হাউস।

এই চিঠি পেয়ে গোলাপ কাকা দেশে আসার পর আমাদের ক্রিকেট সেট কিনে দিলেন। নিজেও আমাদেরকে ক্রিকেট খেললেন। দাদার চিঠিতে নিজের কথাটি লিখতে পেরেছিলাম বলেই আমরা ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। লেখার ক্ষমতাই আলাদা।

৩.

সেভেন থেকে যখন এইটে উঠেছি তখন তিনজন পাগলের সঙ্গে আমার দোস্তী হয়েছিল। দিনের বেলায় এরা কেউ-ই আমাকে চিনত না। রাতের বেলায় দেখা করে যেত। রাস্তার পাশের একটা ঘরে হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে তখন আমি একা একা পড়তাম। এদের মধ্যে রমজান ছ্যাঁকা নামের পাগলটি আমাকে অঙ্ক শেখাতেন। সেবার ক্লাশ এইটে আমি অঙ্কে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বৃত্তি পেয়েছিলাম। আরেকজন—নাম তারা-পাগল, এই তারা-পাগল আমাকে আকাশের তারা গোনা শিখিয়েছিলেন। জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে আমার ধারণা প্রখর হয়েছিল। তারা-পাগল একটি কথা আমাকে পই পই করে শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন—তারা আকাশে থাকে। মানুষের হাতে নয়। জ্যোতিশাস্ত্র নামে যে বিদ্যেটি এ দেশের পথেঘাটে দেখা যায় –তা আসলে এক প্রকার ভূয়া বিদ্যে। কোনো ভূয়া জিনিসে বিশ্বাস করবি না। আমি এই তারা-পাগলের কথা জান পরান দিয়ে আজ অব্দি বিশ্বাস করে এসেছি। কখনো ভূয়া দর্শনকে আমলে নেইনি।

তিন নম্বর পাগলের নাম অমুল্য পাগল। এই পাগল আসত গভীর রাতে। তখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসবে আসবে করছে। মূল্য পাগল এসে আমার জানার জানালায় টোকা দিত। জানালা গলিয়ে দিত মুরগীর ডিম। কখনো পেয়ারা। কখনো দুটো দয়া কলা। মাঝে সফেদা কি পাকা একটা পেঁপেও। তার জন্য আমার পয়লা কাজ ছিল সারা দিনে টোকানো পঁয়সা কড়ি গোনাগুনতি করে দেওয়া। দুসরা কাজ ছিল—তার মনের কিছু গুহ্য কথা লেখা। এর একটা কঠিন শর্ত ছিল। শর্তটা হল-- গুহ্য কথা কাগজে লেখা যাবে না। কলমেও না। লিখতে হবে হাওয়ার উপরে। তর্জনী নামের আঙ্গুল দিয়ে। এই ভাবে লিখলে কোনো মানুষজন জানতেই পারবে না এই গুহ্যকথা গুলো। আবার লেখা কাজটিও থেকে যাবে পৃথিবীর পাঠশালায়। পাগলের কথা বলে হারিয়েও যাবে না।

সে লেখাগুলি হত পূর্বপুরুষের জন্য যারা ইতিমধ্যে মরে গিয়েছে। আর পরবর্তী পুরুষের জন্য—যারা এখনো জন্মায়নি। ঈশ্বরের আখড়ায় জন্ম গ্রহণের অপেক্ষমান লিস্টে আছে। এই দুই পুরুষের জন্য অমূল্য পাগলের হাওয়াই লেখাগুলো হত। 
অমূল্য পাগলের কাছে ঈশ্বর কথাটি কথা শুনে আমি প্রথমবার চমকে যাই। পূনর্বার চমকাবার কোনো প্রকার সুযোগ না দিয়ে অমূল্য লাগল খুব শান্ত ভঙ্গীতে আমাকে জানিয়েছে—ঈশ্বর তার ব্যক্তিগত সখা। দুজনে একপাতে ভাত খান। এক সঙ্গে ঘুরে বেড়ান। মশা-মাছি তাড়ান। ভুলু কুকুরের জন্য ফাই ফরমাস খাটেন। বলেন—এই হল সেই কুকুরের বংশা ধারা যারা হেঁটে যুধিষ্ঠির নামে এক লোকের সঙ্গে মহাভারতের স্বর্গে গিয়েছিল। ঈশ্বর আর অমূল্য পাগল আর ভুলু কুকুর কাউকে থোড়াই কেয়ার করেন। 

হাওয়ার উপরে অমূল্য পাগলের অতি গুহ্যকথাগুলি লিখতে লিখতে আমিও ঈশ্বরের লোক হয়ে উঠি। যখন তখন তার দেখা মেলে। ডাকাডাকির কোনো ব্যাপার থাকে না। মাঝে মধ্যে ঈশ্বর আমার জামাটি গায়ে দিয়ে অমূল্য পাগলের খোঁজে যায়। আমার শীত লাগলে আমিও ঈশ্বরের জামাটি গায়ে দিয়ে রাস্তার মোড় অব্দি ঘুরে আসি। বুঝতে পারি ঈশ্বরের জামাটি একটু ঢিলে ঢালা হলেও তাতে ঘামের গন্ধ নেই—বেলফুলের ঘ্রাণ আছে। প্রাণ সৌম্য হয়ে যায়। কোনো ঝামেলা থাকে না।

ফলে আমি অমূল্য পাগলের মারফতে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি—ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য কোনো ধর্মের প্রয়োজন নেই। খুব বেশি হলে একজন অমূল্য পাগল কিসিমের লোক পেলেও চলে। অমূল্য পাগলের হাওয়াই গুহ্যকথা লেখার নেট লাভ হল-- আমার ঈশ্বর লাভ। তিনি আছেন—আমি আছি। আমি আছি—তিনি আছেন। তিনি নাই—আমি নাই। আমি নাই—তিনি নাই। সহজ কথা। এই সহজ কথাগুলোও এক ধরনের অতি গুহ্যকথা। সব মানুষ জেনে গেলে কিছু ঝামেলা হয়। নাস্তিক বলে মাথার দাম ঘোষণা করে। আমি তাই এ ধরনের কথা হাওয়ায় লিখি—কাগজে নয়। কলমে নয়। বিশ্বাসে নয়—হৃদয় লিখি—প্রাণে লিখি। আমি হাওয়ার লেখক। পূর্বপুরুষের কিছু কথা—পরবর্তী কামিং পুরুষের কথা আর তার সঙ্গে বর্তমানের এই আমার নিজের কিছু কথা মিশেল দিয়ে লিখি। তবে বলে রাখি-- পুরুষ শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে ধরলে ভুল হবে—ধরতে হবে ক্রিয়ার্থবিধিতে। সেজন্য শব্দের ভেতরে পঞ্চেন্দ্রীয় দিয়ে উঁকি দিতে হবে। সার্থকভাবে উঁকি দিতে পারলেই বোঝা যাবে এই পুরুষ শব্দটির মধ্যে শুধু পুরুষ নয়--একজন নারীও আছে। দুজনে আধাআধি করে। দুজনে হলেই পূর্ণ—পূর্ণ মানুষ। পূর্ণতা ছাড়া এ জীবন অর্থহীন। এ ব্যাপারে আমার শিক্ষক কলিম খান। সাং কলিকাতা বন্দরের নিকটস্থ এক গ্রাম। তাঁকে বিনতি করি। 

--------------------------------------
লেখক পরিচিতি
কুলদা রায়
গল্পকার।
ব্লগার। 

---------------------------------------
. পোর্ট্রেট শিল্পী তাজুল ইসলাম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অপূর্ব। শব্দের ক্ষমতা আসলেই অসীম, নয়তো আমি ক করে এক নিমিষে এই লেখাটা পড়ে শেষ করলাম। আমি খুবই নগন্য পাঠক, সমালোচক নই। তাই সুন্দর কোন বিশেষণ দিতে পারছি না কিংবা তীব্র সমালোচনা করতেও পারছি না। আমি মুগ্ধপাঠক, এক কথায় বলি- সুখপাঠ্য।
    আপনার সোনার দোয়াতকলম হোক।

    উত্তরমুছুন
  2. কেমন লাগলো? পড়ে আপ্লুত। শব্দের ক্ষমতা নিয়ে আমার একটা গোপন বিস্তারিত নোট রয়েছে, তা আজ নিজেই আবার পড়লাম। কর্কট শব্দকে কেন্দ্র করে লেখা। মথিত হলাম।আর শুন্য নিয়ে অনেক আগে একটা লেখা দৈনিক আজকের কাগজে ছাপা হয়েছিল। আমার ভাবনার সাথে রায়ের ভাবনায় এটুকুই বহিরঙ্গের মিল। এজন্যই আমাকে বেশি তাড়িত করছে। তাছাড়া, রায় মহাশয়ের বাক্য চয়ণ খুবই শক্তিশালী ও আবেগ জাগানিয়া। লেখাটি আগেই পড়েছি ।কিন্তু আজকের মতন অনুভব করিনি।
    আরো অগান বাগান চাই। পাঠক অপেক্ষায়।

    উত্তরমুছুন