বইপড়া: মাহবুব লীলেনের তৃণতুচ্ছ উনকল্প

বীরাঙ্গনার গল্প খোঁজার গল্প

কামরুল আহবাব

মাহবুব লীলেনের লেখা প্রায়ই পাঠককে বিভ্রান্ত করে। না বাস্তবতা, না ফিকশন--এরকম একটা দ্বিধার মাঝখানে তাঁর গল্পগুলো এগিয়ে যায়। গল্পের চরিত্রগুলো প্রায়ই বাস্তব জীবনে থাকে, তারা আমাদের আশপাশে, আমাদের পত্রিকার পাতায়, আমাদের আড্ডায় বাস করে। সেই বাস্তব মানুষগুলোকে অনায়াসে গল্পে ঢুকিয়ে দেন মাহবুব লীলেন, আবার কখনো কখনো বের করে আনেন। এই বিভ্রান্তি তাই পাঠকের মনে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খেলা করে যায়।
'তৃণতুচ্ছ উনকল্প' উপন্যাসটিও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানে বাস্তব চরিত্রগুলো আছে, তবে চরিত্রগুলো শেষ পর্যন্ত মূল গল্পের অংশ নয়, গল্প তৈরির জন্যই তাদের আগমন।

তৃণতুচ্ছ উনকল্প--এই বইটির গল্প শুরু হয় সত্যিকারের কাহিনী দিয়ে। লেখক জানান ছোটবেলা তাঁর মায়ের কাছে শোনা একটি অসমাপ্ত গল্পের কথা। তাঁর মা বলেন, '১৯৭২ সালের মাঝামাঝি। তখন তুই পেটে। বিয়ানীবাজারের আশপাশে একটা মেয়ে একা একা দৌড়াত। কেউ কিছু জানত না তার সম্পর্কে। শুধু সবাই দেখত মাঝেমধ্যেই সে মেয়েটা বিলাপ করে চিৎকার দিয়ে ওঠে--ও মাইও মাইও গো।'

মাইয়া লোকরে এত অত্যাচার...প্রতিবারই মা গল্পটা এখানে এসে থামিয়ে দেন। তারপর চাপাচাপি করলে বলেন, দেশ স্বাধীনের পরে রাস্তায় বহু পাগলি দেখা যেত এরকম...

এই কাহিনীর অনেক অনেক বছর পর মাহবুব লীলেন এই গল্পটি তৈরি করতে বসেন। তিনি এই কাজে একদল লেখকবন্ধুর সাহায্য নেন। আন্তর্জাতিক লেখক কমিউনিটি সচলায়তনে এই গল্পের সূচনা তৈরি করেন তিনি। তারপর সহ-লেখকদের আহ্বান জানান গল্পের কংকালে রক্তমাংস যোগ করতে। 'তৃণতুচ্ছ উনকল্প' তাই শেষ বিচারে অনেক লেখকের তৈরি একটা উপন্যাস; যে উপন্যাসের মূল চরিত্র সেই পাগলিকে নিয়ে অন্য লেখকরা তাঁদের ধারণা যোগ করেন, তর্ক করেন, তারপর আবার বদলান। এভাবে বদলাতে বদলাতে গল্পটি এগিয়ে যায়। অবশ্য এগিয়ে যায় কথাটি বলাও পুরো ঠিক হচ্ছে না, গল্প আসলে এগোয় না, বিভিন্ন লেখকের মতামতের মাঝখান দিয়ে গল্পটি এক জায়গায় আটকে থাকে। নানা সম্ভাবনা উঠে আসে, নানা ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়, কিন্তু সেই পাগলির মূল গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো শক্তিশালী হয়নি কোনোটিই। লেখক নিজেই একসময় স্বীকার করেন, 'গতকাল অনেকগুলো গল্প জমা হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো গল্পই নন্দিতা কিংবা পিয়ালিকে নিয়ে যেতে পারেনি বিয়ানীবাজারের রাস্তায়। এরকম কোনো ঘটনা এখনো দাঁড়ায়নি, যে ঘটনা অনিবার্যভাবে নন্দিতার গলা থেকে সেই চিৎকারটা বের করে আনতে পারবে। আমার নিজের ওপর সন্দেহ হয়। আমি কি সবাইকে মিসগাইড করছি? না হলে সবাই তো আসছে গল্পটায় কিছু না কিছু যোগ করার জন্য। তাহলে কেন মূল বিন্দুটাই সবাই মিস করছে?...অনেক অনেক গল্প। কিন্তু আমার গল্প কই?'

বইয়ের পাতায় পাতায় তাই অনেক গল্প বলা হয় এভাবেই, বাংলাদেশ ছাড়িয়ে তা একসময় ভারতের পটভূমিতেও যায়। আসলে পৃথিবীর সব নির্যাতনই তো একই, সেখানে বাংলাদেশের লেখকদের বলা গল্পের সঙ্গে তাই ভারতের লেখকদের বলা গল্পগুলোও একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়। কিন্তু উত্তর মেলে না। পাঠককে যে গল্পটি বলার জন্য মাহবুব লীলেন ডেকে নিয়ে আসেন, সেই গল্পের থই পাওয়া যায় না। একসময় লেখক নিজেই হতাশ হয়ে পড়েন। প্রশ্ন রাখেন, 'এত কিছু করেও যে গল্পটা দাঁড় করানো যায়নি, সেটা কি আদৌ দাঁড়াবে আর?'

এবার লেখক যোগাযোগ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজামুদ্দিন লস্কর ময়নার সঙ্গে। গল্পটি ময়নারই ভালো জানার কথা। কিন্তু ময়না কিছু একটা লুকান, কিছু একটা আড়াল করে যান লেখকের কাছ থেকে।
লেখক এবার তাই ময়নার গল্পটি শোনার চেষ্টা করেন। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ময়নাকে তিনি নতুন একটি প্রশ্ন করেন। 

"ময়না ভাইকে আমি মনে করিয়ে দিই--আপনাদের সময়ের সবচে সুন্দরী মেয়েটা, যাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা পুরো ৯ মাস নিয়ে রেখেছিল নিজেদের ক্যাম্পে। তার বিনিময়ে তারা নিরাপত্তা দিয়েছিল তার পরিবারকে।
আমি তাঁকে সেই হোটেলটার কথা মনে করিয়ে দিই, যে হোটেলে তার বন্ধুরা আড্ডা দিত। ময়না ভাই নিঃশব্দে শোনেন। আমি তাকে তার সময়ের ঘটনা বলতে থাকি--দেশ স্বাধীন হলে সেই মেয়েটা ফিরে আসে নিজের পরিবারে। সবকিছু ভুলে পরিবারটাও গুছিয়ে নিতে থাকে আবার...

ময়না ভাই, ৯ মাস পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে থাকা সেই মেয়েটাকে স্বাধীন দেশে আপনার বন্ধুদের ডাকে আবার সেই হোটেলে যেতে হয়েছিল। থাকতে হয়েছিল বহুদিন...আপনি নিশ্চয়ই জানেন? টেলিফোনের ওপারে ময়না ভাইয়ের চমকে ওঠা আমি টের পাই। আমি টের পাই তাঁর স্মৃতিকথার দ্বিতীয় খণ্ড লিখতে না চাওয়ার কষ্ট। আমি তাঁর কাছে শেষ উত্তরটা জানতে চাই--৯ মাস পাকিস্তানি মিলিটারির সেবা করেছ, এইবার আমাদের সেবা করো কিছুদিন'--ময়না ভাই, আপনি কি বলতে পারেন মেয়েটিকে এই কথাটি হোটেল দখল করে থাকা আপনার পরিচিত ঠিক কোন মানুষটি বলেছিল?' আমি জানতাম ময়না ভাই আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন না।"

মাহবুব লীলেন শেষ সময়ে এসে গল্পের সমাপ্তিটা এভাবেই টানেন। তিনি নির্যাতন আর ধর্ষণের তফাৎ বোঝান। আক্রান্ত জনপদে '৭১ সাল আর তার পরবর্তী সময়ের পার্থক্যটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। যে গল্পটি লেখার জন্য মাহবুব লীলেন বইটি শুরু করেছিলেন, সেই গল্পটি তিনি পাঠকদের শোনাতে পারেননি। কিন্তু নতুন যে গল্পটি শোনান, তার রেশ পাঠকের মনে রয়ে যায় দীর্ঘ সময়...।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ