মাহবুব লীলেন--আমি লিখি মাউথেবল শব্দমালা দিয়ে

মাহবুব লীলেন কবি, গল্পকার এবং নাট্যকার ও ব্লগার। তার প্রকাশিত গ্রন্থ--উপন্যাসঃ  তৃণগুচ্ছ উনকল্প, নিম নাখারা, বেবাট। নম্র বচন, সাকিন সুন্দরবন, ট্যারাটক, উকুন বাছা দিন, বাজারিবাটু, খেরোখাতা,  কবিতার বই--কবন্ধ জিরাফ, মাংস পুতুল। 
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
গল্পপাঠ ১. গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?

মাহবুব লীলেন : সম্ভবত উদ্ভট ঘটনা গেঁথে রাখার জন্য। লেখা শুরু করেছিলাম ছড়া দিয়ে। রাজনৈতিক ছড়া।
তারপর ধরলাম কবিতা। তারপর দেখি কিছু উদ্ভট ঘটনা আশেপাশে ঘটে; মনে হয় গেঁথে রাখি কিন্তু ছড়া-কবিতায় তা গাঁথা যায় না। একবার একটা ছেলেকে দেখলাম। দারুণ জম্পেশ ছেলে কিন্তু একেবারে হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা। প্রেম করে। কিন্তু হঠাৎ নিজের প্রেমিকার জন্য নিজেই বিয়ের পাত্র ঠিক করে খাটাখাটনি করে বিয়ের অনুষ্ঠান পর্যন্ত সামাল দিয়ে দিলো। কারণ তার প্রেমিকা তার ঘর থেকে অন্যের ঘরে বেশি ভালো থাকবে। বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাবার পর সে মহাখাপ্পা হয়ে উঠল সব ধরনের প্রেম করা মানুষের উপর। ...মনে হলো ঘটনাটা ঘটনার মতো করেই লিখে রাখি। লিখলাম। তারপর একটা লোকের কথা শুনলাম যার মানুষের গলা টিপে ধরতে ভাল্লাগে।
তার আত্মীয় স্বজনের কয়েকটা শিশু মারা গেছে। শিশুদের গলায় আঙুলের দাগও পাওয়া গেছে। ভূতের কাজ বলে বহু তান্ত্রিক বহু টাকা পয়সা নিয়ে গেছে বাড়ি ঝাড়ফুঁক করে। তারপর গ্রামের মাঠেও দুয়েকটা রাখাল ছেলের গলায় দাগওয়ালা লাশ পাওয়া গেছে। তারপর সেই লোকটা বিয়ে করেছে। বিয়ের রাতে চিৎকার দিয়ে তার বৌ বের হয়ে এসেছে বাসরঘর থেকে; স্বামী তার গলা টিপে ধরেছে। ...বৌটা চলে গেছে তার বাপ-ভাইকে সংবাদ দিয়ে। তারপর থেকে লোকটা উধাও... মনে হলো এইটাও লিখে রাখি। লিখলাম। তারপর দেখি আরো কত উদ্ভট ঘটনা এখানে সেখানে আমাদের অন্দরে-বাহিরে। লিখতে থাকলাম...

উদ্ভট কিন্তু আমরা সকলেই। আমরা সকলেই কিন্তু সুযোগের অভাবে চরিত্রবান; শক্তির অভাবে শান্তিপ্রিয় আর সাহসের অভাবে ভদ্রলোক। না হলে কিন্তু আমরাই মনে মনে কত মন্ত্রীরে কিল দিয়া গু বার করে দেই। মনে মনে শত শত মেয়েরে টান দিয়া বিছানায় ফালাই। কিংবা প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্বজাতির অভিনব উপকার করে ফেলি। এগুলো সকলের ভেতরেই আছে কিন্তু বেকুব ছাড়া কেউ তেমন প্রকাশ করে না। কিংবা ধরেন স্বপ্ন। কত আজগুবি ঘটনা দেখি। বাপের লগে বইনের বিয়ে হতে দেখি কিন্তু পরেই দেখি বাসরঘরে সে আমারে ধইরা কয়- কাম অন জান... ধীরে ধীরে মনে হলো এগুলাও লেখার মধ্যে আটকাই। শুরু করলাম। বানিয়ে কুড়িয়ে কিংবা নিজের ভেতর থেকে খোঁড়াখুঁড়ি করে চালাতে থাকলাম। এখনো চালাচ্ছি। কারণ দুনিয়ায় উদ্ভট ঘটনা বড়ো বেশুমার...

গল্পপাঠ ২. শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?

মাহবুব লীলেন : শুরুর দিকে গল্পগুলো স্রেফ ঘটনা বর্ণনাই ছিল। কাব্যিকতাও ছিল বেশ প্রকট। বুঝতে পারতাম না গল্প আসোলে কীভাবে লেখা দরকার। পড়তাম। বহুত পড়তাম। কিন্তু কোনোটাকেই ঠিক জুতসই মনে হতো না ফলো করার জন্য। ঘটনা বর্ণনায় খুব দ্রুত উপসংহারের দিকে চলে যেতে চাইতাম। আমি আড্ডারু মানুষ হলেও কৌতুক বলায় আমি নিদারুণ ফ্লপ। আমার কাছে শোনা কৌতুক নিয়ে আমারই বন্ধুরা মানুষের পেটে খিল ধরিয়ে দেয়। কিন্তু আমি বললে লোকজন বুদ্ধিজীবীর মতো তাকায়... আমি গালি জানি কিন্তু গালির এক্সপ্রেশন ঠিক হয় না। মানুষ রাগার বদলে হাসে... কিন্তু একদিন ছড়াকার রেজুয়ান মারুফ আমাকে একটা জিনিস ধরিয়ে দিলো। আমি কথা বলতে বলতে দারুণ পাঞ্চ লাইন বসিয়ে দিতে পারি। পড়া বইগুলোর বিষয় কিংবা ঘটনা গল্পে কিংবা আড্ডায় খুব জুতসই করে বসিয়ে দিতে পারি। এবং এক্ষেত্রে মারুফের পড়া বইয়ের ঘটনা তার মুখ থেকে শুনে তারই সামনে আড্ডায় আমি বহুবার মেরে দিয়েছি... মারুফ তাজ্জব বনে তাকিয়ে থেকেছে। ভালো জিস্ট আর সিনথেসিস করতে পারি আমি। খাপও খাওয়াতে পারি... সম্ভবত এইটাই প্রথম কেউ আমার একটা দক্ষতা ধরিয়ে দিলো। তারপর গল্পে আমি সেরকম ঘটনাই ঘটাতে চাইতাম বারবার। কিন্তু এতেও একটা সংকট তৈরি হয়ে গেলো। লেখাগুলো পাঞ্চ লাইনে ভরে উঠতে লাগল। নিজের কাছেও ঠিক গল্প মনে হতো না...

গল্পপাঠ ৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?

মাহবুব লীলেন : গল্প লিখি। লেখার ক্ষেত্রে ছোটগল্প আমার পছন্দের একটা জিনিস। কিন্তু কেন যেন পড়ার ক্ষেত্রে ছোটগল্প জিনিসটা আমার পছন্দের তালিকায় নাই। গল্পের বইটই ঘেঁটে এর সাবুদ-দিশা তেমন একটা পাইনি আমি। হঠাৎ খেয়াল করলাম পুরো বাঙালি জাতিই আসলে ছোটগল্পকার। সকলে গল্প না লিখলেও সকলেই গল্প বানায় আর বলে। এবং সেটা আড্ডায়। আর আড্ডার প্রধান দুই উপাদান চাপা আর পরচর্চা দুইটাই মূলত বানানো গল্প। পরিস্থিতি বুঝে কিছুটা ঘটনার সাথে কল্পনার দারুণ মিশেল দিয়ে উপস্থাপনটাই হলো চাপা আর পরচর্চার মূল কৌশল। দুটোই দারুণ ক্রিয়েটিভ জিনিস। চাপাবাজি যেমন অডিয়েন্স নির্ভর তেমনি পরচর্চাও তাই। চাপাবাজ কিংবা চুগলখোররা কিন্তু সব চাপা কিংবা সব পরনিন্দা সবখানে করে না। অবস্থা বুঝে করে; অবস্থা বুঝে ভাষাও বদলায়। গল্পের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে চাপাবাজিতে থাকে দর্শকের অপরিচিত উপাদানের পরিমাণ বেশি আর পরচর্চায় থাকে দর্শকের পরিচিত উপাদান বেশি....। প্রথমটা উদাত্ত আর দ্বিতীয়টা মিনমিনে। ...মনে হলো লোকায়ত এই দুইটা জিনিস হতে পারে গল্প লেখার কৌশল। ঘটনার সাথে কল্পনার মিশ্রণ আর অডিয়েন্স বুঝে পাঞ্চ লাইন দিয়ে দর্শকের কানে ধরে ঘটনায় ঢোকানো... আর বর্ণনার কৌশল তো আছেই...

লোকায়ত আরো কিছু গল্প কৌশল আছে; যেমন স্বপ্ন বর্ণনা। স্বপ্নগুলো ইউনিক স্টাইলের এক ধরনের অসম্পূর্ণ গল্প; যা সকলেই কমবেশি বর্ণনা করে। বর্ণনার শেষে বক্তা শ্রোতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে কী দেখল তা শোনার জন্য; বা তারই কথার ব্যাখ্যা শোনার জন্য। মানে গল্পকর যা বলছে তার বাইরেও ঘটনা আছে কিন্তু সেই ঘটনা গল্পকার নিজে জানে না বরং গল্পকার সেই পেছনের ঘটনা জানার জন্য পাঠক কিংবা শ্রোতার মতামতের উপরই নির্ভর করে। গল্পটা গল্পকারের কাছে কনফিউজড হবার পরেও সে নিশ্চিত থাকে যে গল্পটা কাউকে বলা যায়। সে বলে। ভয়ে আতঙ্কে আনন্দে সেইরকম চেহারা সুরত আর শব্দ চয়ন করে সে বলে। বলার সময় স্বপ্নের খাপছাড়া অংশগুলো যেমন সে জোড়া দেয় না; তেমনি কোনো উদ্ভটতাকেই সে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে না। স্বপ্ন এবং তার বর্ণনা স্টাইল কিন্তু দারুণ এক গল্পের ভাণ্ডার আর কৌশল...। আমি প্রথমে আমার স্বপ্নগুলো লেখা শুরু করলাম। তারপর অন্যের কাছে শোনা স্বপ্ন। তারপর স্বপ্নের মতো গল্প...

লোকায়ত শ্লোক আর কেচ্ছাও কিন্তু গল্পের আরেকটা বড়ো ফর্ম। আমি বড়ো হয়েছি পুরা শ্লোকের মধ্য দিয়ে। আমার মা রেগে গেলেই সমানে শ্লোক ঝাড়েন। প্রতিটা শ্লোকের পেছনেই একটা করে গল্প আছে। কোনোটা শ্লোকের বাক্যেই সম্পূর্ণ প্রকাশিত আর কোনোটার জন্য শানেনুজুল বলতে হয়। যেগুলা বাক্যে প্রকাশিত সেগুলো দক্ষ শ্রোতার জন্য। ’ইসে নাই চাম/হরে কেষ্ট নাম’ এই শ্লোকটা সবার জন্য না। শুধুই সমঝদারের জন্য। এইটার পেছনে গল্প বলার সুযোগ নাই; বললে সেটা শ্লোককে ছাপিয়ে উঠে। তাই যারা কেষ্ট ঠাকুর চেনে তাদেরকেই এই শ্লোকটা শোনাতে হয়। কিন্তু ঠাকুর ঘরে কে রে/ আমি কলা খাই না’ এইটা তুলনামূলক আনাড়ি শ্রোতার উপযুক্ত। এর সাথে ছোট একটা গল্প আছে; সেটা বলতে হয় আনাড়িকে শ্লোকের অর্থ বুঝতে দেবার জন্য। কিন্তু শ্লোকের গল্পগুলো বলা হয় পরে; আগে মূল কথা পরে ব্যাখ্যা। এটা একটা ভালো ফর্ম। ....তারপর গ্রামীণ কেচ্ছা তো আছেই তার ইউনিক ফর্ম নিয়ে। তো আমি এগুলোকেই ফলো করতে থাকলাম নিজের ফর্ম হিসাবে। এখনো করছি....

গল্পপাঠ ৪. আপনার গল্প লেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?

মাহবুব লীলেন : আমি গল্প লিখি না। গল্প বলি। শ্রোতার সামনা সামনি বসে গল্প করি। মানুষ যেমন চাপা কিংবা পরচর্চা কিংবা স্বপ্ন বর্ণনা কিংবা কেচ্ছা বলে আমি সেরকম বলি। গল্প বলার সময় শ্রোতাকে মশা মারা কিংবা বিড়ি ধরানো কিংবা ঢোক গেলা কিংবা মুচকি হাসার সুযোগ যেমন দেই তেমনি মাঝে মাঝে কথার পিঠে কথা গেঁথে তারে আটকে রাখার চেষ্টা করি অন্য উটকো শব্দমালা থেকে। গল্প মাথায় আসলেই আমার চোখের সামনে সেই গল্পের একজন বা একদল শ্রোতা ভেসে উঠে। আমি তখন সেই শ্রোতার সাথে আড্ডা দিতে থাকি। আড্ডা দিতে দিতে গল্পটা বলতে থাকি। এতে একটা সুবিধা প্ওায়া যায়; গল্পের শব্দ কিংবা বাক্যবিন্যাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। পিওর আড্ডার মতো ওটা আপনা আপনিই শ্রোতার উপযোগী হয়ে বের হয়ে আসে। কোন কথার ব্যাখ্যা দিতে হবে আর কোনটা সংক্ষেপে সেরে ফেলতে হবে তাও ঠিক হয়ে যায় শ্রোতা নির্বাচনের সাথে সাথেই.... এর বাইরে একটা জিনিস আমি ব্যবহার করি; তা হলো লোক প্রবাদ কিংবা লোক প্রবাদের ঢংয়ে বাক্য বিন্যাস। এই ফর্মটা দুর্ধর্ষ একটা কার্যকর বাক্য কৌশল। মেদহীন। শার্প। কিন্তু তার অর্থ বহুমাত্রিক... যা পরেও ভাবায় ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্নভাবে...। আমি কিন্তু গল্প মুখে মুখেই লিখি। বলে বলে লিখি। কিংবা কিছুদূর লিখে বিড়ি টানতে টানতে বাকিটা মনে মনে বলি তারপর এসে দ্রুত টাইপ করি। কিংবা রাস্তায় যাতায়াতের সময় ঝিমাতে ঝিমাতে গল্পটা বলি; তারপর সুযোগ পেলেই তা টাইপ করে রাখি...। লোকায়ত কোনো গল্পের বৈশিষ্ট্যেই কিন্তু অতি বর্ণনার সুযোগ নেই। বিশাল বড়ো বাড়ি বলে গল্পকার শ্রোতার উপরই ছেড়ে দেন সেই বাড়ির বিশালত্ব কল্পনা করার দায়। এতে শ্রোতারা নিজের মতো করে সেই বাড়ির বিশালত্ব তৈরি করে নেয় নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে। সৌন্দর্য বর্ণনায় ‘খুব সুন্দর’ এর চেয়ে বেশি কিছু বলেন না গল্পকার। আমিও কিন্তু এইভাবেই বলি। পাতা ঝিরঝির মিরমির বাতাস কিংবা সুচালো নাক আর হরিণ চোখের কোনো বর্ণনা আমার গল্পে নেই। আমি বড়োজোর বলি- মেয়েটার সৌন্দর্য তাব্দা খাওয়ার মতো... এইবার কে কোন সৌন্দর্যে তাব্দা খায় সেটা যার যার অভিজ্ঞতা নির্ভর....।

আমি একটা গল্প বারবার লিখি। বহুবার এডিট করি। প্রথমে নোট নেই। তারপর ড্রাফট করি। ড্রাফট করে বেশ কিছুদিন ফেলে রেখে দিয়ে লেখাটার সাথে নিজের কিছু দূরত্ব তৈরি করি। তারপর আবার লিখি। একটা পর্যায়ে লেখা হয়ে গেলে শুরু করি এডিট করা। মানে ছোট করা। কমপক্ষে চারবার এডিট করি প্রতিটা লেখা। আমার প্রতিটা গল্পই প্রথম ড্রাফটে বিশাল বড়ো হয়। এডিট করতে করতে ছোট করে নিয়ে আসি কখনো কখনো দশভাগের একভাগে। তারপর প্রকাশ করি ব্লগে। পাঠকদের কমেন্ট ধরে ধরে আবার এডিট করি; কখনো কখনো নতুন করে লিখি। আমার লিখতে প্রচুর সময় লাগে। এটা কৌশল না লেখার অক্ষমতা ঠিক বুঝতে পারি না। আর ভাষার ক্ষেত্রে আমার সোজা মানদণ্ড হলো বলতে গেলে যে শব্দ মুখে আটকায় সেটা আমি বদলে ফেলি। আমি লিখি মাউথেবল শব্দমালা দিয়ে...

গল্পপাঠ ৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?

মাহবুব লীলেন : পুরাপুরি নিশ্চিত না। আগেই বলেছি ছোটগল্প জিনিসটাকেই আমার বেশ উদ্ভট জিনিস মনে হয়। কিন্তু গল্পের প্লটে মানুষের অবচেতন কল্পনার বিস্তার; সেইটাকে বাস্তবের ঘটনায় এনে গিট্টুদেয়া কিংবা কথ্যগল্পের ঢং এবং লোক উপাদান এবং গতিশীল গদ্য; এইগুলা বিবেচনা করলে নিজেকে আমার বেশ আগানোই মনে হয়। অন্তত পাঠকের মগজে ধাক্কা বসাতে পারি। তার সাথে আমার আরো দুটো দক্ষতা আছে; আমি যেকোনো কঠিন বিষয়কেও যেমন একেবারে তরল বানিয়ে বলতে পারি তেমনি জুতসই উদাহরণও টানতে পারি। ...আমার বিবেচনায় এগুলো আমার গল্পের শক্ত দিক। ...আমার গল্পে দুর্বলতাও আছে। মাঝে মাঝেই কাব্যিকতা প্রকট হয়ে উঠে। মাঝে মাঝেই কিছু আরোপিত বক্তব্য বা সিদ্ধান্ত গল্পের বারোটা বাজিয়ে দেয়। মাঝে মাঝেই গল্প থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারি না; এগুলো আমার অবজারভেশন। অন্যদের মতামত সংকলন করে বলতে পারি গল্পের মধ্যে বীভৎসতা কিংবা গা-গুলানো উপাদানের পরিমাণ বেশিই হয়; যা অনেকের জন্যই অস্বস্তিকর। ভাষার ক্ষেত্রে গুরুচণ্ডালির লিমিট মানি না; অনেকেই এর জন্য গালাগাল করেন। বর্ণনায় পাতার ঝিরিঝিরি মিরিমিরি কিংবা পাখির পিউকাহা না থাকায় অনেকেই অভিযোগ করেন পাঠককে শ্বাস ফেলার ফুরসৎ দেই না... যা অনেকের মতে মূলত লেখার দুর্বলতা। এর বেশি কিছু এখন পর্যন্ত জানি না। বাকিটা সময়ের হাতে...

গল্পপাঠ ৬. আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?

মাহবুব লীলেন : কোনো গল্পকারই আমার আদর্শ না। অনেকের অনেক গল্পই আমার ভালো লাগে। কিন্তু কারো পথকেই আমার নিজের পথ মনে হয় না। বরং যারা গল্প লেখেন না; আড্ডার চাপাবাজ; কিংবা চুগলখোর কিংবা যারা আমাকে ছোটবেলা কেচ্ছা শোনাতেন আমি গল্প লেখার সময় তাদের কাউকে না কাউকে সেই গল্পের কথক ধরে নিয়ে তার বয়ানে গল্পটা লিখি। আমি নিজেও বেশ ভালো চাপা ঝাড়তে পারি। মাঝে মাঝে নিজেই হাজির হই গল্পের কথকে। আর আমার বাক্য গঠনগুলা সম্ভবত ছোটবেলায় চা বাগানের এক নাইটগার্ড; নায়েব আলীর কাছ থেকে পাওয়া। পেট পর্যন্ত তারের মতো ছড়ানো দাড়ি- মাথা জুড়ে টাক; মাত্র সাড়ে চার ফুট উচ্চতার শক্ত পিটানো শরীরের বৃদ্ধ নায়েব আলী। বাবার চাকরিসূত্রে চা বাগানে আমাদের বাসার নাইট গার্ড ছিল। শীতের রাতে উঠানের এক কোনায় আগুন পোহাতে পোহাতে আমাদের সে কেচ্ছা শোনাতো। বাঘ ভালুক রাক্ষস খোক্কস আর বাগানে কুলিগিরি করে তার বড়ো ছেলেকে ভার্সিটি পড়ানোর গল্প। তখন পর্যন্ত নায়েব আলী আমাকে শুধুই মজা দিতো। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে তার অভিনয়গুলাও ছিল দুর্দান্ত। ছেলের বর্ণনা দিতে দিতে ঝকমক করে উঠত তার মুখ। তখন পর্যন্ত সে শুধুই এক কেচ্ছাকার। কিন্তু একবার সে তার ছেলেকে দেখতে ঢাকায় গেলো। ছেলে ঢাকা ভার্সিটির হলে থাকে। কুমিল্লার মানুষ নায়েব আলী; নিরক্ষর; চা শ্রমিক। নিজে না খেয়ে; অন্য ছেলেমেয়েদেরকে দিয়ে বাগানে কুলিগিরি করিয়ে- পুরো পরিবার বড়ো ছেলের পড়াশোনার খরচ চালায়। বড়ো ভাই দাঁড়াতে পারলে বাকিদের দেখবে... তো সে নায়েব আলী তার বৌয়ের বানানো পিঠাপুলি নিয়ে গিয়ে হাজির হয় ঢাকা ভার্সিটির হলে। ...ছেলেকে দেখে ফিরে আসে। ফিরে এসে হাজির হয় আমাদের বাসায়। আমার মাকে নায়েব আলী ডাকত নানি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে- আইচ্ছা নানি; সার্ভেন মানে কী? আমার মা হাতড়ান- সার্ভেন? সার্ভেন না সার্ভেন্ট? ... নায়েব আলী মাথা নাড়ে- ওইটাই মনে হয়। মানে কী? ...সার্ভেন্ট মানে তো চাকর.....

বারান্দার একটা খুঁটির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল নায়েব আলী। হা করে আমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে- নানি গো নানি...। বাঁশের খুঁটি ধরে মাটিতে বসে পড়ে নায়েব আলী। হাউ মাউ করে কান্দে। তার বুক ছড়ানো দাড়ি ভেসে যায় চোখের পানিতে- নানি গো নানি। আমারে দেইখা পোলায় তার বন্ধুগো কয়-- মায় পিঠা দিয়া সার্ভেন পাঠাইছে ঢাকায়...

সেদিনের পর থেকে নায়েব আলীর গল্পের ধরন বদলে যায়। সে বেশিরভাগ সময়ই ঢাকার গল্প বলত- কোন দালান কতো বড়ো। রাত্তিরে কেমন রাস্তায় বাতি জ্বলে। ট্রেনটা কতগজ লম্বা। ভার্সিটি জিনিসটা কোন ধরনের স্কুল...। কিন্তু গল্প বলতে বলতেই নায়েব আলী মাঝে মাঝে থেমে যেত... টাক মাথায় হাত বোলাতো। হাত দিয়ে দাড়ি খিলাল করত। কিংবা একটা দুইটা দীর্ঘশ্বাস লুকাত....। গল্প বলতে বলতে তার চেহারা বদলে যেত। তারপর আবার বলত। বলা শেষ হলে কিছু গল্প রেখে দিতে অসম্পূর্ণ... আমি বাগানের লেবার; কী আর হবে ঢাকার গল্প দিয়া....

আমার অনেক লেখাতেই অসংখ্য ডট ডট...। একটা বাক্য শেষ হয় কি না হয়। কথক কিছু সময় নেয় দীর্ঘশ্বাস চাপার জন্য কিংবা টাক মাথায় হাত বোলানোর জন্য। তারপর আবার কতক্ষণ ধুমধাম কতটা বাক্য; কখনো একটার লেজ ধরে আরেকটা বাক্য। আবার থামে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে... আবার গল্প বলতে বলতে শেষে নিজের একটা ব্যক্তিগত উপসংহার দিয়ে গল্পটা অসম্পূর্ণ রেখে বন্ধ করে দেয়। ...আমার গল্পের আদর্শ বোধহয় এরাই...

গল্পপাঠ ৭. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?

মাহবুব লীলেন : প্রথমতো নিজেকে হালকা করার জন্যই লিখি। লেখার বিষয়গুলো পায়খানার মতো পেটে জমে উঠে। এগুলো খালাস না করলে পেট ফাঁপে; কামড়ায়; টক টক ঢেকুর আসে। ওই যে চাপা কিংবা পরচর্চা; এর সবই কিন্তু নিজের পেটের গল্পগুলোকে খালাস করার কৌশল। সুতরাং প্রথম ধাপে পায়খানা করার মতো নিজের তাগাদা ছাড়া আর কিছু নাই। দ্বিতীয় ধাপে আমি ঠিক করে নেই গল্পটা কার সাথে বলব। মানে আমার এই গল্পের শ্রোতা কে বা কারা হবে। প্রতিটা গল্পের ক্ষেত্রে আমি দুয়েকজন শ্রোতা ঠিক করে নেই। একজন কিংবা দুজন ঠিক করলে কিন্তু অটোমেটিক্যালি একটা গোষ্ঠী নির্বাচন করা হয়ে যায়...। এদিক থেকে হয়ত কিছু গল্প কিছু পাঠকের জন্য হয়। কিন্তু কনটেক্সটের কারণে মূলত কোনো গল্পই সবার জন্য হয় না। সম্ভবত হবার প্রয়োজনও নাই...

গল্পপাঠ ৮. এখন কি লিখছেন?

মাহবুব লীলেন : এখন লিখছি মহাভারতের গল্প। মূলত কুন্তীকে নিয়ে একটা মঞ্চ নাটক লিখতে গিয়ে বারবার শতশত বই ঘাটতে হচ্ছিল বলে ঠিক করেছিলাম ঘটনাগুলোকে প্রথমতো গল্পের মতো সাজিয়ে নেবো। পরে লিখব নাটক। গল্প গাঁথুনিটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। গল্প বিন্যাসটা শেষ হয়ে গেলে নাটকটা শেষ করব। ... বগোডুলের কিচ্ছা আমার একটা কিচ্ছা সিরিজ। বগোডুল সিলেটি কিচ্ছা সাহিত্যের এক চরিত্র। বগোডুল মানে চূড়ান্ত বোকা। কিচ্ছাগুলো শুরু হয় একটা ফর্ম দিয়ে- বগোডুলের তিনকুলে কেউ নাই; সে চেয়ে চিন্তে খায়... তারপর সে বহুকিসিম বগোডুলগিরি করে আর পরে দেখা যায় সেগুলো মূলত চূড়ান্ত বুদ্ধিমানের কাজ। বেশ কয়েকটা ড্রাফট করেছি বগোডুলের.... বিবর্তনবাদ নিয়ে আরেকটা মঞ্চ নাটকের জন্য নোট তৈরি করছি। শিগ্গির নাটকটাও লিখে ফেলব.....

গল্পপাঠ ৯. আগামী কি লিখবেন?

মাহবুব লীলেন : তালিকা বহুত বড়ো। পাঁচ বছর কবিতা লিখি না। কবিতা লিখব আবার। একটা ষাঁড়ের বিচি নিয়ে একটা গল্প বহুদিন থেকে নাড়াচাড়া করছি; গল্পটা শেষ করব। রাজনীতিবিদ কেনাবেচার একটা গল্প আছে। সেটাও শেষ করব। কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে নিয়ে একটা মঞ্চ নাটক লিখব; মাতৃ লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিতে মহাভারত রচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। কৃষ্ণকে নিয়ে লিখব পুরা একটা বই; নির্জলা রাজনৈতিক কৃষ্ণ। শিশুদের জন্য আমার গল্প নেই। একটা দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিজের মেয়ের বয়স এখন ছয় মাস। তার সাথে প্রচুর বক বক করতে হয় আমার। বই পড়ার সময় এখন শব্দ করে পড়ি; তাতে তার সাথেও বকবক করা হয় আবার আমার পড়াও হয়। চিন্তা করছি তার দেড় বছর বয়স থেকে তাকে গল্প বলা শুরু করব। তার উপযোগী গল্প বানাব... হয়ত সেটা একটা সংকলন হলেও হয়ে যেতে পারে... অর্ধ সমাপ্ত অনেকগুলো লেখা আছে; সেগুলো শেষ করতে হবে... সুন্দরবনের পচাব্দী গাজির পরিবার নিয়ে একটা উপন্যাস কিছুদূর ড্রাফট করা; সেটা শেষ করব। মধুপুর বনের মানুষদের নিয়ে একটা উপন্যাসের কিছু নোট নেয়া; সেটাও শেষ করতে চাই। আমাকে জন্ম দিয়েছে আমার থিয়েটার চর্চার বন্ধুরা। থিয়েটার নিয়ে কথাকলি সিলেট নামে একটা সিরিজ শেষ করার কথা। শেষ করব ওটা। আর দূর ভবিষ্যতে যদি পারি; নব্বই থেকে দু হাজার তেরো কিংবা পনেরো পর্যন্ত আমাদের রাজনীতি কিংবা গণতন্ত্র নিয়ে একটা উপন্যাস। ...তার পরের তালিকাটা তার পরেই করব না হয়...

........ মাহবুব লীলেন ১ জানুয়ারি ২০১৪

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. মাহবুব লীলেনের মহাভারতের তিন রাজনৈতিক নারীর গদ্যশৈলী আমার খুবই ভাল লেগেছে। আর এ সাক্ষাৎকারে তার কথা অনেকের জন্য ট্রিপস এর কাজ করবে।

    উত্তরমুছুন
  2. শিল্পের শ্রমিক এক্কেরে। পরিশ্রমের কথাই বললেন লীলেন। মেধার মহড়া দেন নাই।

    উত্তরমুছুন