নিজের সেরা লেখা নিয়ে গল্পকার অনিন্দ্য আসিফ : এই গল্পের অধিকাংশ চরিত্র আমার খুব প্রাণের মানুষ

গল্পপাঠ ১. আপনার লেখা কোন গল্পটি সেরা বলে মনে হয়?

অনিন্দ্য আসিফ : এ’টা খুব কঠিন একটা প্রশ্ন। একজন লেখক তার সবগুলো লেখার জননী। জননী কখনও তার সন্তানদের আলাদা করতে জানে না অথবা সে’টা করে না। তবে ইমোশন আর তার রিফ্লেকশনের একটা ব্যাপার থাকে। আমারও আছে। আমি গল্পটিকে এককভাবে সেরা বলছি না। বলছি ভালো লাগার কথা। বলছি আবেগ জড়ানো মুহুর্তগুলোর কথা। গল্পটির নাম- টানাপড়েন।


গল্পপাঠ ২. গল্পটির বীজ কিভাবে পেয়েছিলেন?

অনিন্দ্য আসিফ :  আমিতো কিশোরগঞ্জের ছেলে। জিলা শহর হলেও এ’টা মূলত মফস্বল এলাকা। আমার খুব ভালোবাসার জায়গা এ’টা। এখানকার মাটি, হাওয়া, অর্ধমৃত নরসুন্দা নদী, দ্বিধা-দ্বন্ধের শিল্প-সংস্কৃতি (কখনও কখনও অভিমানে দূরে থাকি, পরক্ষণে আবার ফিরে যাই) ঢাকা আমার কখনও ভালো লাগতো না। এখনও লাগে না। তবু এক ১৩ ডিসেম্বরের রাতে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঢাকার উদ্দেশে একরকম পালিয়ে গিয়েছিলাম। ইচ্ছার বিরুদ্ধে খুব ঠেসে-ঠুসে তিন বছর ঢাকায় ছিলাম। তখনও আমার মনজুড়ে শুধু কিশোরগঞ্জ। যখন গুলিস্তান যেতাম তখন দেখতাম টার্মিনালে সারিবদ্ধ কিশোরগঞ্জগামী বাস দাঁড়িয়ে। মনটা তখন মোচড় দিয়ে উঠতো। তো সেই দুঃসহ সময়ে ফেলে আসা মফস্বল নিয়ে একটা গল্প লেখা শুরু করি। যার নাম- মফস্বলের আড্ডা। পরবর্তীতে নাম পাল্টে হলো- টানাপড়েন।

গল্পপাঠ ৩. গল্পের বীজটির বিস্তার কভাবে ঘটল? শুরুতে কি থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছেন? না, কাহিনীকাঠামো বা প্লট নিয়ে ভেবেছেন

অনিন্দ্য আসিফ :  আসলে ফেলে আসা মফস্বলেও দীর্ঘদিন আমি মানসিক টানাপড়েনে ছিলাম। বীজটা সম্ভবত ওখানেই। তারপর নগরজীবনে সেটাকে কোনোরকমে টেনে নেওয়া আর কি।

গল্পপাঠ ৪. গল্পটির চরিত্রগুলো কিভাবে এসেছে? শুরুতে কতটি চরিত্র এসেছিল? তারা কি শেষ পর্যন্ত থেকেছে? আপনি কি বিশেষ কোনো চরিত্রকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন? তাদের মধ্যে কি আপনার নিজের চেনা জানা কোনো চরিত্র এসেছে? অথবা নিজে কি কোনো চরিত্রের মধ্যে চলে এসেছেন?

অনিন্দ্য আসিফ :  আবেগের জায়গাটা আসলে এখানেই। চরিত্রগুলো আমার খুব চেনা। খুব কাছে থেকে তাদের আমি দেখেছি। আসলে একমাত্র ‘যাত্রা’ গল্পটি ছাড়া কোনও বানানো গল্প আমার নেই। সবগুলো গল্পের অধিকাংশ চরিত্র আমার চেনা-জানা। তন্মধ্যে ‘ঘুণপোকা ও কাঠের গল্প’-এই গল্পটির থিম নিয়েছি গল্পকার-কবি বন্ধু মাজহার মান্নার কাছ থেকে। সে বলেছিল, একটা থিম নিতে পারো, আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু গল্পটি দাড় করাতে পারিনি। তারপর শুরু করলাম আর শেষ করলাম একটা বাড়ন্ত প্রতিবন্ধি কিশোরির অন্তঃসত্তা হয়ে ওঠার বাস্তব ঘটনা নিয়ে গল্প- ঘুণপোকা ও কাঠের গল্প। এমনকি সবশেষ যে গল্পটি লিখেছি (রেখাপাত), এটি আমার একমাত্র যাদুবাস্তবতার ওপরে লেখা গল্প, তার সবগুলো চরিত্র আমার চেনা-জানা। তদ্রুপ আশুদা’র খোঁজে, দৌড়, হলিডে, কুহক অথবা বিভ্রম, টান, টানাপড়েন-২, শাদা অথবা শূন্য সবগুলো গল্পের চরিত্রকে আমি ভালো করেই জানি।

বলছিলাম ‘টানাপড়েন’ গল্পের কথা। এই গল্পের অধিকাংশ চরিত্র আমার খুব প্রাণের মানুষ। কতো কতো দিন-রাত সিগেরেটের মতো ক্ষয় করে ফেলেছি তাদের সাথে। প্রোগ্রাম, ছোটকাগজ বের করার জন্য একসাথে কতো দৌড়ঝাঁপ করেছি তার ইয়ত্তা নেই। সেই ভালোবাসার মানুষগুলো নিজেদের জীবনে বেশ ভালোই আছে। তাদের খুব মিস করি এখন। 

খোকা ভাই (জিয়া আহমেদ), চন্দ্রিমা (আফরোজা সোমা), রায়হান ভাই (জাহাঙ্গীর আলম জাহান), ওমর পারভেজ, মাজহার মান্না আরও অনেকে। গল্পটিতে আরও অদ্ভূত একটা চরিত্র আছে-মিস বাঙ্গালী আঁখি। সে খুব বেশি লেখার চেষ্টা করতো। তখনই বলেছিল যে সতেরো হাজার কবিতা তার লেখা হয়ে গেছে। এই নিয়ে আমরা খুব মজা করতাম। তাকে দিয়েই গল্পের শুরু। গল্পে আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আছে- ইন্দু আর দ্বীপ। গল্পে তারাই আমাকে প্রেম দিয়ে, অবহেলা দিয়ে ক্রমান্বয়ে জৈবিক করে তুলেছে। ব্যক্তিগত জীবনে তারা দু’জনই দু’সন্তানের গর্বিত জননী। শুধু দ্বীপের মাঝে এখনও দারুণ বিষণ্নতা কাজ করে বলে মনে হয়। কারণ সে বেশ ভালোই কবিতা লিখত। প্রভাষক স্বামীর ঘরে থেকেও শিল্পের সাথে তার দূরত্ব বেড়ে গেছে বলে তার এই একাকীত্ব। 

ও হ্যাঁ, আরেকটা চরিত্র আছে- নিশিকানন। তাকে দিয়েই গল্পটা শেষ করেছি। তবে পারভেজকে খুব বেশি মিস করি। তখন সে বেশ ভালো কবিতা লিখত। ওসব ছেড়ে ছুড়ে ও এখন আইটিতে ভালো চাকরি করে। অবশ্য আমি নিজেকেও মিস করি। একসময়তো আমরা কবিতাই লিখতাম। লোকে বলত, আমি নাকি ভালো কবিতা লিখতে জেনে গেছি। হা হা হা

গল্পপাঠ ৫. এই গল্পগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিভাবে নির্মাণ করেছেন?

অনিন্দ্য আসিফ : আসলে দ্বন্ধ-সংঘাত অথবা সাবলীল প্রেম কোনও কিছুই কি পূর্ব থেকেই ঠিক ঠিক মাথায় রেখে লেখা যায়? আমার অন্তত হয় না। ওগুলো লেখার মাঝেই অটোমিটিক্যালি এসে যায়।

গল্পপাঠ ৬. গল্পের পরিণতিটা নিয়ে কি আগেই ভেবে রেখেছিলেন?

অনিন্দ্য আসিফ : না। হুট করেই গল্পটি শুরু করা। তবে যেহেতু শুরু করার পর প্রায় এক বছর এতে আর হাত দিইনি সেহেতু দ্বিতীয়ার্ধের হিসেবে এক অর্থে আগে থেকেই ভেবে রাখা।

গল্পপাঠ ৭. গল্পটি কদিন ধরে লিখেছেন? এক এর ভাষা ভঙ্গিতে কি ধরনের শৈলী ব্যবহার করেছেন

অনিন্দ্য আসিফ : গল্পটি শুরু করার পরতো বেশ কিছুদিন এতে আর হাত দিইনি। তারপর লেখবো লেখবো করে শেষ পর্যন্ত এ’টা শেষ করতে প্রায় তিন বছর লেগে গেলো। ভাষাভঙ্গিতে শৈলি বলতে দারুণ কিছু উপমা ব্যবহারের চেষ্টা করেছি। তবে এখন আমার কাছে যেটা মনে হয়, মফস্বলের হিসেবে বিশেষ করে সংলাপগুলোতে জাত ভাষাটা ব্যবহার করা যেতো।

গল্পপাঠ ৮. গল্পটিতে কি কিছু বলতে চেয়েছিলেন?

অনিন্দ্য আসিফ : শুরুতে ওরকম কিছু ভাবিনি। কিন্তু মাঝে যখন অনেক গ্যাপ পড়ে গেল তখন ভাবলাম, ফেলে আসা সময়কে, সময়ের ভিতরে জীবনের খুঁটিনাটি বাস্তবতাকে, বাস্তবতার মানুষ, মানুষের আবেগ-অনুভ’তির অক্ষরগুলোকে কাগজে সাজিয়ে রাখলে কেমন হয়? এখনকার এই যে আমি, আমার প্রিয়জন, আমার মফস্বল, সমাজ, রাষ্ট্র আর তার বর্তমান ব্যবস্থা পঞ্চাশ বছর পরতো তার কিছুই থাকবে বলে মনে হয় না। যদি বেঁচে থাকি তবে তার জন্য একটা আয়না তৈরি করার ব্যাকুল প্রয়াস তখন আমার মাঝে কাজ করেছিল। যাতে করে অন্তত আমি আমাকে দেখতে পাই।

গল্পপাঠ ৯. গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন? আপনি কি মনে করেন--আপনি যা লিখতে চেয়েছিলেন, তা লিখতে পেরেছেন এই গল্পটিতে?

অনিন্দ্য আসিফ : লেখক কি তার লেখার ব্যাপারে সম্পুর্ণ তুষ্ট হতে পারে? তবু গল্পটি আমার কাছে ভালো লাগে। বলছি না এটিই আমার লেখা শ্রেষ্ঠ গল্প। এই দায়িত্ব তো পাঠকের। হয়তো এতে অনেক বেশি আবেগ জড়িয়ে আছে বলে সময় পেলেই গল্পটা আমি পড়ি। সেই সময়টাকে ধারণ করি তখন। মনে মনে বলি, আহারে কোথায় গেলো সেই সময়!

গল্পপাঠ ১০. এই গল্পটি পাঠক কেনো পছন্দ করে বলে আপনার মনে হয়?

অনিন্দ্য আসিফ : এই গল্পটি আমার জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। কেননা এ’টা প্রকাশিত হবার পর পাঠক গল্পকার হিসেবে আমাকে চিনতে শুরু করেছে। তবে এই গল্পটি পাঠক পছন্দ করে কি-না আমি জানি না। অবশ্য অনেকে আমাকে বলেছে যে তাদের কাছে গল্পটা ভালো লেগেছে। তাদের কেউ কেউ বলেছে যে তারা গল্পটি একটানে শেষ করেছে। আমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভূত লেগেছে। কেননা গল্পটি বেশ বড়। গল্পটি শেষ করার পর কিছুদিন ফেলে রেখেছি। কেননা এ’টা আকারের জন্য কোথায় ছাপতে দেব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। যেহেতু তখন কেবল গল্প লিখতে শুরু করেছি। 

গল্পকার হিসেবে তেমন পরিচিতি আমার নেই। তারপর সাত-পাঁচ ভেবে পাঠালাম কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছে। সম্ভবত ২০০৭ এর দিকে। কিছুদিন পর তিনি ফোন করলেন। বললেন, গল্পটি আমার খুব মজা লেগেছে। তারপর তাঁর সম্পাদিত গল্পের ছোট কাগজ ‘কথা’-র সম্ভবত ৫ম সংখ্যায় ৩৪ পৃষ্টার এই গল্পটি ছাপলেন। এজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি এখনও আমাকে গল্প বিষয়ক নানান ব্যাপারে সহযোগিতা করেন।





লেখক পরিচিতি


অনিন্দ্য আসিফ
জন্ম ১৯৮১।
কিশোরগঞ্জে বেড়ে ওঠা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. আপনার ভেতরের কিছু কথা জানা গেল ।

    উত্তরমুছুন
  2. Akib Shikder bolchi.... Sakkhatkare sotto kotha bolte sahos thaka chai..Sahos apnar ase ASIF vai... Apnae sadhubad janai.... (y)

    উত্তরমুছুন