আমি সামান্য কিছুকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলাম। এক সেমেস্টার মাত্র। তখন আমার এক বন্ধু ছিল। শেখ সাব্বির হোসেন। আমি প্রায় সারাদিন তার সাথে গল্প করতাম। সাব্বির ছিল উর্দুভাষী মুসলমান। ফেজ টুপি পরত না, কিন্তু তার দাড়ি ছিল, গোঁফ কামানো। কলকাতার পার্কসার্কাস অঞ্চলে ছিল তাদের বাড়ি। সাব্বির পড়াশুনোয় বেশ ভালো ছিল। কিন্তু একদিন ডারউইন প্রসঙ্গে সে আমাকে বলেছিল, ম্যায় উয়ো সব মানতা নেহি। ইনসান, বান্দর সে নেহি আ সকতা।
ঈদের পর সে আমার জন্য এক টিফিন কেরিয়ার ভর্তি মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। ছোলার ডাল দিয়ে তৈরী মিষ্টি, ঘিয়ে পাকানো। সেই মিষ্টি আমার নেহাত ভেতো বাঙালী পেটের জন্য একটু বেশীই গুরুপাক। খানিক খেয়েই আমার গা জড়াতে শুরু করল। একে আমি মিষ্টি পছন্দ করি না। তার উপর ঘি! আমি যখন খাচ্ছি, তখন সাব্বির আমার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। আমি খানিক খেয়ে বললাম আর পারছি না। সাব্বিরের মুখ একট ঘন হল। চোখ একটু ছোট। আমার মনে হল আমি না খেলে সাব্বির ঠিক ভাববে আমি হিন্দু হয়ে মুসলমানের তৈরী খাবার খেতে চাইছি না। প্রাণপনে খাবারটা গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করতে করতে সেই প্রথম আমি সাম্প্রদায়িকতা কাকে বলে বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম আমি সংখ্যাগুরু আর সাব্বির সংখ্যালঘু। আরেকটা অসহায়তাও টের পেয়েছিলাম, কোনোদিন ধর্ম নিয়ে তেমন মাথা না ঘামানো আমার পরিচয়েও কোথাও হিন্দু লেখা আছে। শুধু মাত্র আমার নাম পদবীর কারণে।
শাহাদ্দুজামান বাংলাদেশের লেখক। ‘ঠাকুরের সঙ্গে’ তাঁর লেখা ছোট গল্প। গল্পটা খুব চেনা। কিছুকাল আগে গুগ্ল-এর একটা অডিও ভিসুয়াল বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। নাম ছিল রিইউনিয়ন। দুই বৃদ্ধের গল্প। একজন ভারতে, আরেকজন পাকিস্তানে। একজন লাহোর ছেড়ে চলে এসেছিলেন দেশভাগের সময়। আরেকজন লাহোরেরই বাসিন্দা। দুই বাল্যবন্ধু একে অপরকে খুঁজে পাচ্ছেন বহুকাল পরে, আন্তর্জালে গুগ্ল সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যে। শাহাদ্দুজামানের ‘ঠাকুরের সঙ্গে’ লেখাটাও অনেকটা একই ধরণের। এক বৃদ্ধের বাংলাদেশে ফেলে আসা বাস্তুভিটে খুঁজতে যাওয়া গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
‘ঠাকুর’ এই শব্দটা আসলে বাঙালীর কাছে হিন্দু দেবদেবীর ঈঙ্গিতবাহী। আরেকজন ঠাকুরও বাঙালীর খুব প্রিয়। তবে তাঁকেও বাঙালী প্রায় দেবত্বে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছে। শাহাদ্দুজামান আসলে “ঠাকুরের সঙ্গে” নামটার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কেই ইঙ্গিত করলেন। ঠাকুরের ‘সঙ্গে’, এই ‘সঙ্গে’ শব্দটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটা “অপর”-এর সংজ্ঞা। অপর অর্থে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু ধর্মীয় সম্প্রদায়, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। শাহাদ্দুজামান বাংলাদেশের লেখক, তিনি নিজে ধর্মীয় পরিচয়ে বা পারিবারিকভাবে বাঙালী মুসলমান পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন; বসবাস করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাই তাঁর গল্পের আঙ্গিকে কথক হলেন বাংলাদেশে বসবাস করা আম নাগরিক, একজন মুসলমান। এইখানে একটা সুপ্ত সম্প্রদায়গত ভাবনা আছে। তবে সেটাকে আমি ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে একটা বিশেষ তকমা দিতে চাই না। শাহাদ্দুজামান চাইলেই লেখাটাকে পিনাকী ঠাকুর বা তাঁর জ্যাঠা ক্ষেত্ররঞ্জন ঠাকুরের বয়ানে, বা তাঁদের অনুসরণ করে লিখতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা চাননি। তাঁর দেশের পাঠকের বেশীর ভাগ অংশ সাধারণ মুসলমান। যাঁরা নিজেরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করতে যান না। আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যা আসলে তাঁদের কাছে কখনই প্রত্যক্ষ নয়। একভাবে পরোক্ষ। এক ধরণের “অপর”-এর ধারণার নির্মাণ যার মধ্যে সুপ্ত আছে।
পিনাকী ঠাকুর ডাক্তার। সে মেডিক্যাল কলেজে পাশ। সরকারী কর্মী। অথচ ইলেকশনের পর একজন সাধারণ অচেনা মানুষ তাঁকে দেখে বলে “এই শালা মালাউনগুলি যায় না ক্যান এই দেশ থাইকা? ” খুব সাধারণভাবে শাহাদ্দুজামান জানিয়ে দেন একটা বাস্তব। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপন্নতা। তাঁদের দেশের একটা অংশের মানুষ তাঁদের সেই দেশের নাগরিকত্ব মেনে নেন না। তাঁদের চোখে বাংলাদেশ মালাউনদের দেশ নয়। ঠিক যেমন ভাবে হিটলারের সময় জার্মানীর অনেক মানুষ মনে করতেন যে ইহুদীরা জার্মানীর নাগরিক নন।
এই ঘটনার ভয় বা বিপন্নতা থেকে পিনাকী ফিরে যেতেন চান ঢাকার কাছাকাছি। হয়ত অন্য মানুষ বা রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুর কাছে থাকার নিরাপত্তাবোধ তাঁর মধ্যে তখনও ছিল। তাই তিনি দেখা করেন তাঁর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। যদি বদলি পাওয়া যায়। এই উর্ধতন কর্তৃপক্ষ খুব স্বাভাবিক ভাবে তাঁকে জানিয়ে দেন – “শুন পিনাকী এই দ্যাশে বইসা ডাক্তার হইছো, সেইটাই হাজার শোকর কর, বদলী টদলীর এত আশা কইরো না।” এর শোকর পিনাকী কার কাছে করবেন? সেই রাষ্ট্রের কাছে, যেখানে তিনি জন্মেছেন, তিনি জন্মসূত্রে যার নাগরিক? নাকি সেই রাষ্ট্রে বসবাস করা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কাছে, যাদের একটা অংশের মতে তিনি তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ে সেই দেশে বসবাস করার উপযুক্ত নন, বা সেইটাই একটা ঔচিত্যবোধ বিবর্জিত কাজ। লেখক আমাদের জানিয়ে দেন যে এটা একটা বাস্তব তাঁর দেশে, কারণ কবি নির্মলেন্দু গুণ এঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়েও ভাইভায় বাদ চলে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র তার দাদা ভারতে থাকেন বলে। আর কোন প্রশ্ন তাকে করা হয়নি। লেখক এটাও জানাতে ভোলেন না যে আসলে এই এঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে যারা সরকারী চাকুরে, তাদের বড় অংশই ঘুষখোর। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয় তাদের রাষ্ট্রের সাথে একাত্ব করেছে এমন কোন মহৎ ভাবনার তেমন জায়গা নেই।
কিংবা ক্ষেত্রমোহনের ধুতি পরা। ধুতি আজকাল কলকাতাতে বিরল একটা পোষাক। কিন্তু আদ্যন্ত বাঙালীর দেশ বাংলাদেশেও ধুতি বিরল। শাহাদ্দুজামান ক্ষেত্রমোহনের ধুতি পরা, এবং সেই কারণে পিনাকীর অস্বস্তি, বা প্রথমেই ধুতি পরার কারণে কথকের অবাক হওয়ার মধ্যে দিয়ে “ধুতি” যে আসলে একটা হিন্দুত্ববোধক চিহ্নে পর্যবসিত হয়েছে সেই কথা জানিয়ে দেন। ধুতি পরা একটা লোক আসলে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থানে বড়ই বেমানান। অথচ কথক প্রথমেই জানান যে তাঁর দাদা মৌলভী মফিজুদ্দিন তরফদারের একটা ধুতি পরা ছবি আছে। এবং তিনি বেশ সৌখিন ধরনের ধুতি পরতেন। অর্থাৎ মৌলভি মোমিন মুসলমানের কাছেও একসময় ধুতি “অপর”-এর পোষাক ছিল না। বরং বাঙালীয়ানার পরিচয় ছিল। কিন্তু ক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশে ধুতি একটা এলিয়েন সিম্বল। যা মানুষের কৌতুহল জাগায়। এবং একই সাথে পরিহিতের সঙ্গীর বিপন্নতার বোধ বাড়িয়ে তোলে। একটা সামান্য পোষাককে এমন একটা প্রতীকি অর্থে ব্যবহার করা অসাধারণ।
গুগ্লের বিজ্ঞাপনের মতই, এই গল্পের পরিণতিতেও লেখক চলে যান দুই বৃদ্ধের শৈশবকালীন বন্ধুত্বের ফ্যান্টাসির অবস্থানে। দুই দেশ, দুই সম্প্রদায়, বিরোধ হানাহানি, পারস্পরিক অবস্থানের বিপরীতে বা দ্বন্দের নির্মানে আসলে লেখকের আর বিশেষ কোন উপায়ও ছিল না। তিনি হয় একটা ভীষণ রিয়ালিটিতে শেষ করতে পারতেন – যেখানে ক্ষেত্রমোহন তাঁর বাড়িও খুঁজে পান না। তাঁর গ্রাম চিনতে পারেন না। বরং ধুতি পরা একজন মানুষ তাঁর পুরানো আবাস খুঁজতে চাইছেন এবং তার ফলে তৈরী হচ্ছে একটা ভীতি, সন্দেহের বাস্তব বাতাবরণ।
শাহাদ্দুজামান তা করেন না। তিনি বরং একটা পাল্টা ফ্যান্টাসি তৈরী করেন। দুই বৃদ্ধের বাল্যবন্ধুত্বের উষ্ণতার। আসলে শৈশব এমন এক সময় যখন ধর্মের কাঁটাতারগুলোর খোঁচা খোঁচা কাঁটাগুলো গজাতে পারেনি। আর এই দুই বৃদ্ধের শৈশব এমন এক সময়ে যখন হিন্দু আর মুসলমান বাঙালীর সৌভ্রাতৃত্ব খুব অস্বাভাবিক ছিল না। বিষয়টাকে আরো মোলায়েম করতে লেখক দেখান যে বাড়িটা জবরদখল হয়নি, বা দাঙ্গার রাতে পালিয়ে আসেননি ক্ষেত্রমোহনের পরিবার। বরং বসতভিটে বিক্রি করেছেন আরেক পরিবারকে। আর সেই দুই পরিবারের দুই শিশু লুটোপুটি করেছে বাগানে। বেজী ধরতে গেছে।
আমার সাম্প্রদায়িক মনে একটা প্রশ্ন জাগে। যদি ক্ষেত্রমোহন ফিরে না আসতে চেয়ে তাঁর সেই গ্রামেই থেকে যেতে চাইতেন? তাহলে গল্পের পরিণতি কেমন হত? সেইটাও একটা ফ্যান্টাসির অবস্থান হত। যেমন মান্টোর টোবাটেকসিং-এ।
লেখক তাঁর চিন্তা নিয়ে তাঁর দেশের মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। নির্মাণ করতে চেয়েছেন একটা সুন্দর অপরবাস্তব। যেখানে দুটো সম্প্রদায়ের শিশুরা বন্ধুত্বে বেড়ে ওঠে। এবং বন্ধুত্বেই ধর্মের বেড়া টপকে যায় আজীবন। লেখক তাঁর কাম্য বাস্তবের ছবি পাঠককে দিতে চেয়েছেন। আমি তাঁকে কুর্নিশ করি।
গল্পকার।
প্রবন্ধকার।
ঈদের পর সে আমার জন্য এক টিফিন কেরিয়ার ভর্তি মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। ছোলার ডাল দিয়ে তৈরী মিষ্টি, ঘিয়ে পাকানো। সেই মিষ্টি আমার নেহাত ভেতো বাঙালী পেটের জন্য একটু বেশীই গুরুপাক। খানিক খেয়েই আমার গা জড়াতে শুরু করল। একে আমি মিষ্টি পছন্দ করি না। তার উপর ঘি! আমি যখন খাচ্ছি, তখন সাব্বির আমার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। আমি খানিক খেয়ে বললাম আর পারছি না। সাব্বিরের মুখ একট ঘন হল। চোখ একটু ছোট। আমার মনে হল আমি না খেলে সাব্বির ঠিক ভাববে আমি হিন্দু হয়ে মুসলমানের তৈরী খাবার খেতে চাইছি না। প্রাণপনে খাবারটা গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করতে করতে সেই প্রথম আমি সাম্প্রদায়িকতা কাকে বলে বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম আমি সংখ্যাগুরু আর সাব্বির সংখ্যালঘু। আরেকটা অসহায়তাও টের পেয়েছিলাম, কোনোদিন ধর্ম নিয়ে তেমন মাথা না ঘামানো আমার পরিচয়েও কোথাও হিন্দু লেখা আছে। শুধু মাত্র আমার নাম পদবীর কারণে।
শাহাদ্দুজামান বাংলাদেশের লেখক। ‘ঠাকুরের সঙ্গে’ তাঁর লেখা ছোট গল্প। গল্পটা খুব চেনা। কিছুকাল আগে গুগ্ল-এর একটা অডিও ভিসুয়াল বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। নাম ছিল রিইউনিয়ন। দুই বৃদ্ধের গল্প। একজন ভারতে, আরেকজন পাকিস্তানে। একজন লাহোর ছেড়ে চলে এসেছিলেন দেশভাগের সময়। আরেকজন লাহোরেরই বাসিন্দা। দুই বাল্যবন্ধু একে অপরকে খুঁজে পাচ্ছেন বহুকাল পরে, আন্তর্জালে গুগ্ল সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যে। শাহাদ্দুজামানের ‘ঠাকুরের সঙ্গে’ লেখাটাও অনেকটা একই ধরণের। এক বৃদ্ধের বাংলাদেশে ফেলে আসা বাস্তুভিটে খুঁজতে যাওয়া গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
‘ঠাকুর’ এই শব্দটা আসলে বাঙালীর কাছে হিন্দু দেবদেবীর ঈঙ্গিতবাহী। আরেকজন ঠাকুরও বাঙালীর খুব প্রিয়। তবে তাঁকেও বাঙালী প্রায় দেবত্বে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছে। শাহাদ্দুজামান আসলে “ঠাকুরের সঙ্গে” নামটার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কেই ইঙ্গিত করলেন। ঠাকুরের ‘সঙ্গে’, এই ‘সঙ্গে’ শব্দটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটা “অপর”-এর সংজ্ঞা। অপর অর্থে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু ধর্মীয় সম্প্রদায়, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। শাহাদ্দুজামান বাংলাদেশের লেখক, তিনি নিজে ধর্মীয় পরিচয়ে বা পারিবারিকভাবে বাঙালী মুসলমান পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন; বসবাস করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাই তাঁর গল্পের আঙ্গিকে কথক হলেন বাংলাদেশে বসবাস করা আম নাগরিক, একজন মুসলমান। এইখানে একটা সুপ্ত সম্প্রদায়গত ভাবনা আছে। তবে সেটাকে আমি ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে একটা বিশেষ তকমা দিতে চাই না। শাহাদ্দুজামান চাইলেই লেখাটাকে পিনাকী ঠাকুর বা তাঁর জ্যাঠা ক্ষেত্ররঞ্জন ঠাকুরের বয়ানে, বা তাঁদের অনুসরণ করে লিখতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা চাননি। তাঁর দেশের পাঠকের বেশীর ভাগ অংশ সাধারণ মুসলমান। যাঁরা নিজেরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করতে যান না। আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যা আসলে তাঁদের কাছে কখনই প্রত্যক্ষ নয়। একভাবে পরোক্ষ। এক ধরণের “অপর”-এর ধারণার নির্মাণ যার মধ্যে সুপ্ত আছে।
পিনাকী ঠাকুর ডাক্তার। সে মেডিক্যাল কলেজে পাশ। সরকারী কর্মী। অথচ ইলেকশনের পর একজন সাধারণ অচেনা মানুষ তাঁকে দেখে বলে “এই শালা মালাউনগুলি যায় না ক্যান এই দেশ থাইকা? ” খুব সাধারণভাবে শাহাদ্দুজামান জানিয়ে দেন একটা বাস্তব। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপন্নতা। তাঁদের দেশের একটা অংশের মানুষ তাঁদের সেই দেশের নাগরিকত্ব মেনে নেন না। তাঁদের চোখে বাংলাদেশ মালাউনদের দেশ নয়। ঠিক যেমন ভাবে হিটলারের সময় জার্মানীর অনেক মানুষ মনে করতেন যে ইহুদীরা জার্মানীর নাগরিক নন।
এই ঘটনার ভয় বা বিপন্নতা থেকে পিনাকী ফিরে যেতেন চান ঢাকার কাছাকাছি। হয়ত অন্য মানুষ বা রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুর কাছে থাকার নিরাপত্তাবোধ তাঁর মধ্যে তখনও ছিল। তাই তিনি দেখা করেন তাঁর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। যদি বদলি পাওয়া যায়। এই উর্ধতন কর্তৃপক্ষ খুব স্বাভাবিক ভাবে তাঁকে জানিয়ে দেন – “শুন পিনাকী এই দ্যাশে বইসা ডাক্তার হইছো, সেইটাই হাজার শোকর কর, বদলী টদলীর এত আশা কইরো না।” এর শোকর পিনাকী কার কাছে করবেন? সেই রাষ্ট্রের কাছে, যেখানে তিনি জন্মেছেন, তিনি জন্মসূত্রে যার নাগরিক? নাকি সেই রাষ্ট্রে বসবাস করা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কাছে, যাদের একটা অংশের মতে তিনি তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ে সেই দেশে বসবাস করার উপযুক্ত নন, বা সেইটাই একটা ঔচিত্যবোধ বিবর্জিত কাজ। লেখক আমাদের জানিয়ে দেন যে এটা একটা বাস্তব তাঁর দেশে, কারণ কবি নির্মলেন্দু গুণ এঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়েও ভাইভায় বাদ চলে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র তার দাদা ভারতে থাকেন বলে। আর কোন প্রশ্ন তাকে করা হয়নি। লেখক এটাও জানাতে ভোলেন না যে আসলে এই এঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে যারা সরকারী চাকুরে, তাদের বড় অংশই ঘুষখোর। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয় তাদের রাষ্ট্রের সাথে একাত্ব করেছে এমন কোন মহৎ ভাবনার তেমন জায়গা নেই।
কিংবা ক্ষেত্রমোহনের ধুতি পরা। ধুতি আজকাল কলকাতাতে বিরল একটা পোষাক। কিন্তু আদ্যন্ত বাঙালীর দেশ বাংলাদেশেও ধুতি বিরল। শাহাদ্দুজামান ক্ষেত্রমোহনের ধুতি পরা, এবং সেই কারণে পিনাকীর অস্বস্তি, বা প্রথমেই ধুতি পরার কারণে কথকের অবাক হওয়ার মধ্যে দিয়ে “ধুতি” যে আসলে একটা হিন্দুত্ববোধক চিহ্নে পর্যবসিত হয়েছে সেই কথা জানিয়ে দেন। ধুতি পরা একটা লোক আসলে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থানে বড়ই বেমানান। অথচ কথক প্রথমেই জানান যে তাঁর দাদা মৌলভী মফিজুদ্দিন তরফদারের একটা ধুতি পরা ছবি আছে। এবং তিনি বেশ সৌখিন ধরনের ধুতি পরতেন। অর্থাৎ মৌলভি মোমিন মুসলমানের কাছেও একসময় ধুতি “অপর”-এর পোষাক ছিল না। বরং বাঙালীয়ানার পরিচয় ছিল। কিন্তু ক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশে ধুতি একটা এলিয়েন সিম্বল। যা মানুষের কৌতুহল জাগায়। এবং একই সাথে পরিহিতের সঙ্গীর বিপন্নতার বোধ বাড়িয়ে তোলে। একটা সামান্য পোষাককে এমন একটা প্রতীকি অর্থে ব্যবহার করা অসাধারণ।
গুগ্লের বিজ্ঞাপনের মতই, এই গল্পের পরিণতিতেও লেখক চলে যান দুই বৃদ্ধের শৈশবকালীন বন্ধুত্বের ফ্যান্টাসির অবস্থানে। দুই দেশ, দুই সম্প্রদায়, বিরোধ হানাহানি, পারস্পরিক অবস্থানের বিপরীতে বা দ্বন্দের নির্মানে আসলে লেখকের আর বিশেষ কোন উপায়ও ছিল না। তিনি হয় একটা ভীষণ রিয়ালিটিতে শেষ করতে পারতেন – যেখানে ক্ষেত্রমোহন তাঁর বাড়িও খুঁজে পান না। তাঁর গ্রাম চিনতে পারেন না। বরং ধুতি পরা একজন মানুষ তাঁর পুরানো আবাস খুঁজতে চাইছেন এবং তার ফলে তৈরী হচ্ছে একটা ভীতি, সন্দেহের বাস্তব বাতাবরণ।
শাহাদ্দুজামান তা করেন না। তিনি বরং একটা পাল্টা ফ্যান্টাসি তৈরী করেন। দুই বৃদ্ধের বাল্যবন্ধুত্বের উষ্ণতার। আসলে শৈশব এমন এক সময় যখন ধর্মের কাঁটাতারগুলোর খোঁচা খোঁচা কাঁটাগুলো গজাতে পারেনি। আর এই দুই বৃদ্ধের শৈশব এমন এক সময়ে যখন হিন্দু আর মুসলমান বাঙালীর সৌভ্রাতৃত্ব খুব অস্বাভাবিক ছিল না। বিষয়টাকে আরো মোলায়েম করতে লেখক দেখান যে বাড়িটা জবরদখল হয়নি, বা দাঙ্গার রাতে পালিয়ে আসেননি ক্ষেত্রমোহনের পরিবার। বরং বসতভিটে বিক্রি করেছেন আরেক পরিবারকে। আর সেই দুই পরিবারের দুই শিশু লুটোপুটি করেছে বাগানে। বেজী ধরতে গেছে।
আমার সাম্প্রদায়িক মনে একটা প্রশ্ন জাগে। যদি ক্ষেত্রমোহন ফিরে না আসতে চেয়ে তাঁর সেই গ্রামেই থেকে যেতে চাইতেন? তাহলে গল্পের পরিণতি কেমন হত? সেইটাও একটা ফ্যান্টাসির অবস্থান হত। যেমন মান্টোর টোবাটেকসিং-এ।
লেখক তাঁর চিন্তা নিয়ে তাঁর দেশের মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। নির্মাণ করতে চেয়েছেন একটা সুন্দর অপরবাস্তব। যেখানে দুটো সম্প্রদায়ের শিশুরা বন্ধুত্বে বেড়ে ওঠে। এবং বন্ধুত্বেই ধর্মের বেড়া টপকে যায় আজীবন। লেখক তাঁর কাম্য বাস্তবের ছবি পাঠককে দিতে চেয়েছেন। আমি তাঁকে কুর্নিশ করি।
লেখক পরিচিতি
শমীক ঘোষ
গল্পকার।
প্রবন্ধকার।
পড়াশুনা ঃ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
বোম্বে থাকেন। চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
0 মন্তব্যসমূহ