জন্মদিন, হাসান ও আগুনপাখি ও অন্যকথা

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

হাসান আজিজুল হক বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ প্রতীম কথাশিল্পী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শুধু গল্পই লিখেছেন। উপন্যাস লেখেননি। তিনি তৃতীয় উপন্যাস লিখলেন আগুন পাখি শিরোণামে। উপন্যাসটি ভাষাভঙ্গীর জন্য বিশেষভাবে আলোচিত হয়  বাংলাদেশে।


বাংলাদেশে কিছু তমুদ্দুনপন্থী সাহিত্যিকরা প্রচলিত প্রমিত ভাষাটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাঙালীদেরকে রিপ্রেজেন্ট করে না বলে প্রচার করে থাকেন। তাদের মতে প্রমিত ভাষা  কোলকাতার বাবুদের তৈরি ভাষা। এখন তারা বাবু শব্দটিকে কিঞ্চিত বদলে দাদাদের ভাষা বলে। দাদা অর্থে হিন্দুদের দিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে একটা ভাষা-সাম্প্রদায়িকতা কাজ করে। তাদের প্রকল্প রয়েছে দেশের সংখ্যা-গরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমানদের রিপ্রেজেন্ট করে এমন তমুদ্দিনপন্থী বাংলা ভাষা তৈরি করতে হবে। হাসান আজিজুল হকও তাদের টার্গেটে আছেন।
হাসানের ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আরেকজন গল্পকার-প্রবন্ধকার কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ২ ফেব্রুয়ারী। তিনি আগুনপাখির নির্মাণপর্ব নিয়ে কথা বলেছেন। সেখানে হাসান স্বল্পপরিসরে হলেও ভাষা-সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। তমুদ্দিনপন্থীদের ফাঁদে পা দেননি। তাঁর কাছে মানুষই আগে। এই মানুষ ভাষাহীন হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। পরে নিজের মত করে মা শব্দটি বলে। মা শব্দটি জাতি-ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দ। এই মা শব্দই বড় লেখকের লেখার আকাশ।

সাক্ষাৎকারটির সঙ্গে গল্পপাঠের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। গল্পপাঠের নিজস্ব অবস্থান পরিস্কার করার জন্য ভূমিকাটি সংযুক্ত হয়েছে।
 
 গল্পপাঠ
--------------------------------------------------------------------------------------------------
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : হাসান ভাই, আজ আপনার ৭৫তম জন্মদিন, আপনাকে স্বাগতম, আজ আপনি আছেন কেমন?
হাসান আজিজুল হক : এই তো আছি ভালোই। তোমরা ভালোই তো আছো?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, তা আছি। ৭৫তম জন্মদিন তো একজন লেখকের একটা ল্যান্ডমার্কও। আমি তো আর অত পত্রিকা বা মিডিয়া খেয়াল করতে পারেনি। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
হাসান আজিজুল হক : কোন কোন কাগজে কি কি সব এসেছে শুনলাম। স্থানীয় কাগজেও নিউজ আছে।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আচ্ছা, আমরা আপনার আগুনপাখি নিয়ে কিছু কথা বলি। এ উপন্যাসের মূল প্রণোদনাটা আপনি পেলেন কী করে?
হাসান আজিজুল হক : সাজ্জাদ শরিফ আমায় দেশভাগ নিয়ে কোনো গল্পলেখার বিষয়ে আগ্রহী কিনা জানতে চায়। তো, আমি বললাম, তা তো আছেই। আমি একটা লিখে দেবো। তা গল্প হয় কিনা বলতে পারব না। তো লিখলাম একটি নির্জলা কথা।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : এটা কি গল্পই ছিল?
হাসান আজিজুল হক :  হ্যাঁ,--তো, সনৎকুমার সাহা এটি পড়ে বেশ উদ্দীপ্ত হলেন, এবং তিনি বললেন, এটার ভিতর কিন্তু দারুণ একটা ফোর্স আছে। আপনি এ নিয়ে কাজ করতে পারেন! আমি তখন বললাম, তাহলে দেবো নাকি ডিনাইমাট ফাটিয়ে? তখনই এটিকে একটা উপন্যাসে রূপান্তর করার কথা ভাবলাম। এর ভাষা নিয়ে অনেক ভাবনা শুরু হলো।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আমারও যদ্দূর মনে পড়ছে, ২০০৪ এর দিকে আপনি এই ধরনের উপন্যাসে বর্ধমানের একটা ভাষা ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে আপনি আমার সাথে দীর্ঘ আলাপও করেছিলেন। আমার কাছেও মনে হলো, এই উপন্যাসের জন্য বর্ধমান এলাকার ভাষাটা ব্যবহার তো করলে ভালোই হবে। তবে কথা হচ্ছে হাসান ভাই, আপনি কেবল ক্রিয়াপদ আর কিছু বিশেষ্য, বিশেষণ আর অন্বয়বাদী শব্দেই স্থানীয় শব্দ আনলেন। এতে কি ভাষার আলাদা শক্তিটা আনা গেল?
হাসান আজিজুল হক :  আমি কিন্তু একপর্যায়ে চিন্তা করলাম পুরোটাই যবগ্রামের ভাষা দিই। তবে এখানে পাঠস্বাদুতার বিষয়টাও ভাবতে হলো। তুমি দেখবে, এই ভাষাতে পুরুষ/মহিলা, মহিলা/মহিলা, এমনকি হিন্দু মহিলা আর মুসলিম মহিলার ভিতর পার্থক্য আছে। আমি আমার মায়ের ভাষার স্টাইলটা আনতে চেয়েছি।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : তবু ভাষা তো দেখি অনেকটা প্রমিত আচরণেই ছিল।
হাসান আজিজুল হক :  আমি ভাষাকে উন্মুক্ত আকাশের মতোই একটা বিষয় মনে করি। মানুষ তার স্বাধীন মতে তা ব্যবহার করবে।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আচ্ছা হাসান ভাই, উপন্যাসে কি আপনি যুক্ত বাঙলার বা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক আকাঙ্খার উপর জোর দিয়েছেন? শরৎ বসু বা সুবাস বোস কিংবা আবুল হাশেমদের মিলিত বাংলার কথা বলতে চেয়েছেন?
হাসান আজিজুল হক :   দেখো, যুক্ত বাংলার একটা বিষয় শরৎ বসু-আবুল হাশিমদের রাজনৈতিক ইচ্ছার উপর ছিল। কিন্তু জিন্নাহ, বল্লবভাই প্যাটেল, বা নেহেরুকে সামাল দেবে কে? গান্ধী অবশ্য দেশভাগ নিয়ে তখন বলেছিলেন, আমার বুকের ভিতর শেল মারা হলো! তবে এই উপন্যাসে আমি আমার মায়ের সাফারিংসটাই আনতে চেয়েছি,-- হিন্দু, মুসলিম, যুক্ত বাংলা, সর্বভারতীয় কোনো বিষয় নয়। যতভাবেই বলো জাহাঙ্গীর, পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের যন্ত্রণা তো ছিল আলাদা।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আচ্ছা, আপনি কি এ উপন্যাস লিখে তৃপ্ত, উপন্যাসের একটা আদল মনমতো আনতে পেরেছেন?
হাসান আজিজুল হক :   আমি তো বলেছি। আমার যা বলার ছিল তা বলেছি তো।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : তবু ধরেন, তিস্তাপুরাণ, খোয়াবনামার ভিতর যে আলাদা একটা অদ্ভুত শক্তি বা বিষয় আছে, তা কি অনেকটা পারিবারিক ডায়েরির আকারে আসেনি?
হাসান আজিজুল হক :   আমি তো পারিবারিক একটা বিষয়ই সমস্ত কিছুর সাথে মিলিয়ে ভিন্ন আদলে আনতে চেয়েছি।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : হাসান ভাই, আপনার কি অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম’র কথা মনে আছে?
হাসান আজিজুল হক :   তা থাকবে না কেন, অবশ্যই আছে-- বলো কি বলবে।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : এর ভাষাটা কিন্তু দারুণ, জলমাটির গন্ধ, লোক-গদ্য আছে, আছে অনন্ত নামের এক সর্বজনীন কৃষ্ণ, এবং জীবনের রূপ-রস দারুণ ভাবে আছে সেখানে।
হাসান আজিজুল হক :   অবশ্যই ভালো উপন্যাস, খুবই ভালো। পেঙ্গুইন থেকে করা এর ইংরেজি অনুবাদও ভালো হয়েছে। জীবনকে অনেক কাছে থেকে গভীর স্পর্শে দেখেছেন। তিনি অনেক সিনসিয়ার।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আমি ভাষাটাকে আরও মজার হিসাবে পাই, কারণ তাতে যেন আমার নিজের জীবনের ভাষারূপ আমি দেখি, একেবারে কাবু করে ফেলে আমায়।
হাসান আজিজুল হক :  আরে কী বলছো? উনি তো কুমিল্লার দিকের, তুমি চট্টগ্রামের নও!

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : হাহাহা, না হাসান ভাই, আমার বাড়ির কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে, অদ্বৈত’র বাড়ি তো ব্রাহ্মণবাড়িয়া, তিতাসের তীরে।
হাসান আজিজুল হক :  তাই বলো, যাই হোক, সব মিলিয়ে এটি চমৎকার এক শিল্পকর্ম।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : উপন্যাস ধরে যখন আমরা ভাষার কথা বলছি, তখন আমরা আলালের ঘরের দুলাল’র ভাষাটার কথা বলতে পারি। আপনার কি মনে হয়, এর যদি সত্যিকার বিকাশ হতো, তাহলে বাংলা গদ্যের চেহারা-চরিত্র আলাদা হতো?
হাসান আজিজুল হক :  তুমি কি বঙ্কিম বা তৎকালীন গদ্যের আলোকে বলছো?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ।
হাসান আজিজুল হক :  এই ভাষাটা কিন্তু তখনকার কলকাতা শহরের টিপিক্যাল মধ্যবিত্তের ভাষা। পুরো বঙ্গকে তো তা রিপ্রেজেন্ট করে না। আমার কাছে অত হালকা গদ্য ভালো লাগে না হাহাহা। কোমলমতি চটকদার একটা ভাব আছে তাতে। কেবলই ঠাট্টা-ইয়ার্কির দিকে যায়। তখনকার অদ্ভুত নষ্টভ্রষ্ট কলকাতার বাবুয়ানা জীবন আছে। জমিদাররা তখন সন্ধ্যা হলেই নিজের ঘর-সংসার ফেলে বেশ্যাখানায় যায়। ছোট জমিদারদের খেয়াল-ঠাট্টা করে, রাজনীতির কোনো রূপ নাই। ভাষা ডেভলপ করে নি। তারচেয়ে ভবাণীচরণেল হুতোম প্যাঁচার নকসাটা আমার ভালো লেগেছে। অনেকটা নকসা ধর্মী লেখা তবে সেখানকার স্যাটায়ার বেশ মজার। আর্লি নাইন্টিজের একটা চিত্র সেসবে পাওয়া যায়। তখনই বঙ্কিম, বিদাসাগররা উঠে আসছেন। তাতে সতীদাহ বা সহমরণ শুধু নয়, সমাজের সংস্কৃতির বিভাজনটা আস্তে আস্তে গড়ে ওঠছে। ইউরোপীয়ান কালচার আস্তে আস্তে ঢুকছে। তা ভালো/মন্দ দুইই আছে।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আপনাকে ধন্যবাদ হাসান ভাই
হাসান আজিজুল হক :   তোমরাও ভালো থেকো।

২.২.২০১৪




লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর 

গল্পকার। ঔপন্যাসিক। প্রবন্ধকার।
লিটিল ম্যাগাজিন কথা'র সম্পাদক।
পেশায় চিকিৎসক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ