বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জার্নাল : উলুবেড়িয়া



 সকাল হয়েছে উলুবেড়িয়ার তলিবপুরে। পিকনিকে এসেছি আমি আর আমার এক বন্ধু। ওর এক দিদির শ্বশুরবাড়ি। গ্রামের বাড়ির ঘরোয়া পিকনিক। ওরা ফিস্ট বলে।http://blogs.eisamay.indiatimes.com/theme/EISAMAY/images/spacer.gif

প্রতি বছরই পিকনিকটা হয়। আমি গেলাম এই প্রথমবার। দিদির বাড়িতে মানুষ বলতে তিনজন। দিদি, দিদির শ্বাশুড়ি আর দিদির বর দেবব্রত দা। প্রাইমারি স্কুলে পড়ায় দিদি। কুলগাছিয়াতে। বাগনানের পরের স্টপেজ। স্কুলের পাশে বড় গোলাপ বাগান। স্কুলে বাথরুম এবং বিদ্যুত্‍‌‌ , কোনোটাই নেই। দেবব্রত দার আগে টালির ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসায় অনেক লস হয়ে যাওয়ার পর শুরু হল দুধের ব্যবসা। সেটাও বছর পাঁচেক চলার পর বন্ধ হল।
তারপর কিছুদিন চলেছিল পোলট্রি। সেটা উঠে যাওয়ার পর এখন একটাই কাজ। চাষ আবাদ। বাড়ির মধ্যেই করেন। যতটা সম্ভব, একটু একটু করে। শশা, লঙ্কা, পেঁয়াজ, আলু, ফুলকপি, কড়াইশুটি, লাউ, টমেটো, ঢ্যাঁড়শ, পালং, কলমী....আরও বেশ কিছু। উনি বিক্রি করেন না। নিজেরাই খান। মাঝে মাঝে দেওয়া থোওয়া করেন। আর একটা ব্যাপারেও গত চার বছর ধরে জড়িয়ে পড়েছেন বছর পঁয়তাল্লিশের এই ভদ্রলোক। মহাভারত এবং তার আনুষঙ্গিক শিকর বাকর। রোজ বিকেলে আধ ঘন্টা করে কালীপ্রসন্ন সিংহ পরেন উনি। বিড়বিড় করে। বিরাট পর্ব থেকে উদ্যোগ পর্ব হয়ে ভীষ্ম পর্বে মিশে যাচ্ছেন। একটা হেঁচকিও নেই। গ্যারগ্যার শব্দে কীচক দ্রৌপদীকে টেনে নিচ্ছে। আশপাশের কেউ জানতেও পারছে না। খানিকক্ষণ ওদিকে চেয়ে থাকলে মনে হতে পারে নেশার ঘোরে আওয়াজ জড়িয়ে গেছে ওঁর। এবার মুখ দিয়ে পাঁচ টাকার আইসক্রিম রঙের গ্যাঁজা বেরোবে। টু থাউজেন্ড নাইনে একটা অ্যাক্সিডেন্টে এই মানুষটার ডান পায়ের মালাইচাকি উড়ে গেছিল। এখন ভেতরে সেঁটে আছে ফাইবারের জিনিস। বাড়ির একপাশ জুড়ে বড়ো পুকুর। আটমাস আগে ছেড়ে দেওয়া আড়াই ইঞ্চি চারাগুলো ঠিকঠাক খাবার পেয়ে এখন কানকো ফুলকো লেজ এর বাহারি বডি হয়ে ফ্যামিলি নিয়ে রেগুলার সেই পুকুরের এদিক থেকে ওদিকে পাস করছে। মাঝে মাঝে মাথাটাকে অল্প ঝটকায় ঘাই মেরে জলের ওপরে তুলে দেখে নিচ্ছে ওদের দেবু কাকা পাড়ে ঠিকভাবে বসে আছে কি না।

দুধের মতো একটা পাতলা আলো মাটিতে পড়ে ছানা হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে থেবড়ে বসে দেবুদা মাছ ধরছিলেন ছিপ দিয়ে। সঙ্গে আর একটা লোক। নাম- মিলখা মন্ডল। মাথার উকুন বাছার মতো করে ঠোঙা থেকে পিঁপড়ের ডিম আর কেঁচো আলাদা আলাদা করে তুলে রাখছে। ওই সময়টাতেই পরপর দুটো বড় লরি পাশের রাস্তা দিয়ে চলে গেল। তার আওয়াজেই হবে, পুকুরের জল ছ্যাঁত করে উঠে আড়মোড়া ভেঙে আচমকা চলাফেরা করতে আরম্ভ করল। ক্লাস এইটের ভৌতবিজ্ঞান বই এই ধরনের চলাফেরা-কে তরঙ্গবলে ডাকে।

ওই মাছগুলো সব পিকনিকের জন্য। অন্যান্য দিন উনি মাছ ধরেন আবার ছেড়ে দেন। আজ দিনটা আলাদা। যে গুলো ধরা পড়বে সে গুলো ভাজা বা ঝোল হয়ে যাবে। এই পিকনিকের নিয়মই এই। পুকুরের মাছ আর জমির সব্জি। অঢেল। কত খাবে! আমাদের ধরে সব মিলিয়ে লোক জনা কুড়ি। তার মধ্যে আন্টির ইস্কুলের দশজন বাচ্চাও আছে। প্রায় বছর দশেক হল এই পিকনিকের বয়স। মিলখা এলাকার লোক। রিক্সা চালায়। ওর ওপর রান্নার ভার। বরাবরই করে আসছে। দিদি রান্নায় ঝাল কম দিতে বলছিল। বছর খানেক আগের এক বর্ষায় মিলখার নয় বছরের মেয়ে এই পুকুরেই ডুবে মরে যায়। শাপলার ভ্যাট খেতে গিয়ে। ভ্যাট ফুলের ডগাটা ভেঙে জিভে ফেলে দিলেই পয়সা। মিষ্টি আতা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের বাচ্চাদের চকোলেট। কচি কোড়ের শাপলায় ভরে ছিল পুকুর। দুপুর বেলায় সেই জিনিস আনতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরদিন বেলাবেলি ছাব্বিশ কেজি ওজনের মেয়ে বড় আলুর বস্তা হয়ে ভেসে উঠল। রান্না করতে করতে এসব বলে যাচ্ছিল মিলখা। ফুলকপির তরকারি তখন গরম ধোঁয়া হয়ে উঠে গিয়ে সামনের জাম গাছের মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। ধোঁয়ার মধ্যে মাঝে মেঝে ফেটে যাচ্ছিল দিদির ছবি-টা। স্নান-টান করে এসে দাঁড়িয়েছে। ফুল ছাপ দেওয়া টাটকা নীল শাড়ি। অন্যদিন এই সময় স্কুলের ছেলেদের জন্য মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করে। কে তরকারি কম পেল। খিচুড়িতে নুনটা বেশি হয়ে গেছে কি না। তারপর শুরু হয় পনেরো ঘরের নামতা কিংবা পানিপথের যুদ্ধ।খেতে বসে একের পর এক মাছ পরছিল পাতে। খলসে, ট্যাংরা, ফ্যাসা, মাগুর, সরপুঁটি, মৌরলা, কালবোস....ভাজা, টক, ঝাল। তার আগে কচুর লতি দিয়েই অনেকটা ভাত উঠে গেল। ওটা দিদির বানানো। বাকি সব মিলখা। বাকি সব করে রব মিলখার তরে। সবাই মিলে মাটিতে বসা। কলাপাতা। সামনের মাটির হাঁড়ির ধোঁয়া তখন শুকনো হয়ে তেজপাতার মতো গন্ধ দিচ্ছে।

খাওয়া-দাওয়ার পর বাচ্চাগুলো চলে গেল। উত্তরদিকের তেঁতুল গাছের উপরের আকাশ থেকে দুপুরটা খসে পড়ল। কাঁঠালগাছে বাঁধা দড়ির দোলনায় বসে নিঃসন্তান দিদি ওদের চলে যাওয়া দেখছিল। আমাদের বলল, তোরা থেকে যা না! হুট করে কেমন ফাঁকা হয়ে গেল বাড়িটা দেখ! কেমন ভরে ছিল....

থাকা সম্ভব ছিল না। প্রত্যেকেই ব্যস্ত!
সারাদিনের কাজ শেষ করে মিলখা নেমেছে পুকুরে। স্নান হবে। এত ঠান্ডাতেও বড়ো পুকুরটায় অন্তত চারবার এ পাশ ও পাশ করবে। কয়েক বছর আগে এই পুকুরেই ভেসে উঠেছিল ওর মেয়ের ফুলো ফুলো বডি। মেয়ের নাম সরস্বতী। ক্লাস টুয়ের হাফ ইয়ার্লিতে অঙ্কে একাশি পেয়েছিল। দোলনা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে দিদি। উল্টো দিকে বসে ততক্ষণে একমনে মহাভারত নামিয়ে আনা শুরু করে দিয়েছে দেবুদা।
আমরা যখন বেরিয়ে এলাম, অভিমন্যু তখন চক্রব্যুহে ঢুকছিল।



লেখক পরিচিতি
বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য

হ্যাঁচ্চো, মিনিবাস, মোমবাতি, মাঝরাস্তা, লেড়ো-খাস্তা... অল্প অল্প করে রয়েছেন সবেতেই। পাশ ফিরে ঘুম আর বিফ কাবাবে প্রচুর সময় দেওয়ার জন্য মাঝমাঝেই ডেডলাইন মিস করেন। প্রিয় বাক্য-- " ঠিয়াছে... কোনও অ্যাপার না...!"


গল্পকার। প্রবন্ধকার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ