রেজা ঘটকের গল্প চন্দ্রমণি

এক.
জলের পাশেই জেলের বাড়িএই জল খাল-বিল-নদীর নয়, স্বয়ং সমুদ্রের উতালপাথাল মাতালজলবর্ষার আগমনীতে সেই জলে ওঠে যৌবনের নাচনসেই নাচতরঙ্গের সাথে যুদ্ধ করে জেলে সারা বছর সমুদ্রে জাল মারেনবর্ষায় সমুদ্রে যত হয় তুফান ভারী, জেলের জালে মাছের ততই ঘোরাঘুরিজেলের জালে অধিক মাছের সেই ঘোরাঘুরিতে জেলেনির চোখেমুখে তখন কষ্টের বাউলি বাতাসে নতুন স্বপ্নেরা উঁকি দেয়আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন- এই চার মাস সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে জেলেনির ঘোর কাটেবছরের বাকি সময় ধরে আবারো শুরু হয় একঘেয়ে জীবনযুদ্ধের ঘানি টানার অফুরন্ত দিনযাপনসে এক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাজীবন বাজি রেখে সেই যুদ্ধে নিত্য ওঠাবসা যাদের, তারাই কৈবর্তঅনেকে বলেন, জলদাসজলের দাস

সমুদ্রের এপিঠ-ওপিঠ খুব ভালো করেই চেনেন চন্দ্রমণি কৈবর্তমাত্র বারো বছর বয়সে বাবার কাছেই সমুদ্রে মাছ ধরায় হাতেখড়ি চন্দ্রমণিরতার পর থেকেই সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তার নিত্য ওঠাবসাবয়স কুড়ি না পেরোতেই চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গার সমুদ্রঘেঁষা জেলেপল্লির জরাজীর্ণ শীর্ণ কুটিরে শ্রীমতি শৈলীরানী তার ঘরে বধূ হয়ে এলশৈলীরানীর বয়স তখন কত? বড়জোর বারো কি তেরোশৈলীরানীর বাবাও একজন কৈবর্তবাড়ি চট্টগ্রামের কৈবল্যধামেসেখান থেকেও সমুদ্র ভারি নিকটে
সাধারণত কৈবর্তসমাজে বিয়ে হয় দুইভাবেবরের বাড়িতে বিয়ে আর কনের বাড়িতে বিয়েনামন্ত পদ্ধতি আর চলন্ত পদ্ধতিবিয়ের এক দিন বা দুই দিন আগে বরপক্ষ কনের বাড়িতে যায়সঙ্গে থাকে সাধ্যমতো বাদকদলবাজনার তালে তালে চলে কৈবর্ত নৃত্যতখন নিত্য করতে করতে কনে নিয়ে বরপক্ষের বাড়িতে এসে শাস্ত্রমতে লগ্ন সময়ে যে বিয়ে হয়, তা হলো নামন্ত পদ্ধতিতে কৈবর্ত বিয়েআর কৈবর্ত বর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শাস্ত্র অনুযায়ী লগ্ন সময়ে যে বিয়ে করে, তা হলো চলন্ত পদ্ধতিতে কৈবর্ত বিয়েসাধারণত কোন পদ্ধতিতে বিয়ে হবে- তা উভয় পক্ষ আলাপ-আলোচনা করে আগেই ঠিক করেতার আগে উভয় পক্ষ দাভানিয়ে বেশ প্যাঁচাল পারেদাভা হলো কৈবর্ত বিয়ের যৌতুকপ্রাচীনকালে কৈবর্ত কনেপক্ষ বরপক্ষ থেকে টাকা নিতএখন আর কৈবর্ত সমাজে সেই নিয়ম ততটা নেইএখন উল্টো কৈবর্ত বরপক্ষকে কনেপক্ষের দাভা মেটাতে হয়সে এক ভারি গুরুচণ্ডালি নিয়ম
তো, চন্দ্রমণির বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্ত ঘোষণা দিলেন, একমাত্র ছেলের বিয়ে নামন্ত পদ্ধতিতেই হবেপ্রয়োজনে দাভায় কিছুটা ছাড় দিতে রাজি তিনিএর আগে পাঁচ কন্যার বিয়েতে চন্দ্রমণির বাবাও দাভা প্রদান করেছেনএকমাত্র ছেলের বিয়েতে সেটা উসুল করার সুযোগ যেহেতু নেই, তাই নামন্ত পদ্ধতিতে বিয়ে দিয়ে কৈবর্তসমাজে নিজের অবস্থান ঘোষণা করতে চান চন্দ্রমণির বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্র্তশৈলীরানীর বাবা হরিপদ কৈবর্ত বা কম কিসে? বন্ধুর ছেলের সঙ্গে আদরের ছোট মেয়েকে বিয়ে দেবেন, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? তাই শখ করে নিজেই ঘোষণা দিলেন, শৈলীরানীর জন্য এগারো কুড়ি নগদ নারায়ণ তার দাভা হিসেবে জমা আছেকৃষ্ণ বৈরাগীর পঞ্চবাদক দলের বাজনা দিয়ে চন্দ্রমণির বরযাত্রা শুরু হলোদুই দিন পর যুধিষ্ঠির কৈবর্তর বাড়িতে শ্রাবণ মাসের বাইশ তারিখে মা গঙ্গাকে স্মরণ করে চন্দ্রমণি আর শৈলীরানীর বিয়ে হলো

দুই.
আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস কৈবর্তসমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসে হয় কৈবর্তদের প্রধান দুই পূজামা-গঙ্গা পূজা ও মা-মনসা পূজামা-গঙ্গা হলো কৈবর্তদের অন্নদাত্রীআর মা-মনসা হলো কৈবর্তদের রক্ষাকর্ত্রীকৈবর্তসমাজের বিশ্বাস, মা-গঙ্গা মস্যের দেবীমা-গঙ্গার ইচ্ছায় জলের মস্যরা চলাফেরা করেআর এই মস্য হলো কৈবর্তদের প্রধান জলশস্যতাই মা-গঙ্গাকে কৈবর্তরা খুব ভক্তি করেআর মা-মনসা সর্পের দেবীসর্প হলো জলের হিংস্র প্রাণীকৈবর্তরা জলচর, তাই সর্পের সাথে তাদের কোনো বিরোধ নেইমা-মনসা তাই কৈবর্তদের রক্ষাদাত্রীসাধারণত কৈবর্তসমাজে আষাঢ় মাসে হয় মা-গঙ্গা পূজা, আর শ্রাবণ মাসে হয় মা-মনসা পূজা
চট্টগ্রামের কৈবর্তরা প্রধানত দুই ধরনেরসমুদ্রনির্ভর জেলে আর নদীনির্ভর জেলেযুধিষ্ঠির কৈবর্তদের পূর্বপুরুষরা বহু প্রাচীনকাল আগে থেকেই চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে মিরসরাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের উপকূলজুড়ে বসবাস করছেপূজা-পার্বণ আর চৈত্রসংক্রান্তি হলো কৈবর্তদের সবচেয়ে বড় উসবআষাঢ় মাসের প্রথম দিন মা-গঙ্গাপূজা উপলক্ষে শৈলীরানীর বাবা হরিপদ কৈবর্ত চন্দ্রমণিদের উত্তর পতেঙ্গার জেলেপল্লির মেয়ের বাড়িতে এসেছেনউদ্দেশ্য মেয়ের বাড়ি মা-গঙ্গাপূজা শেষ হলে মেয়ে-জামাইকে সাথে করে কৈবল্যধামে নিজের বাড়িতে যাবেন
সাধারণত আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে কৈবর্তসমাজে চলে মা-গঙ্গাপূজাএকমাত্র পুত্রবধূর বাবা বেড়াতে আসায় তাই চন্দ্রমণির বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্ত বেজায় খুশিএবার তাই যুধিষ্ঠির কৈবর্তের মনে মনে ইচ্ছেও মা-গঙ্গাপূজায় একটু বেশি খরচ করারঅশোক বাবুর কাছ থেকে নৌকা আর জালের জন্য যে দাদন নিয়েছিলেন, সেই দাদনের টাকা আরেকটু বাড়ানোর জন্য তাই সন্ধ্যার পর যুধিষ্ঠির কৈবর্ত অশোক বাবুর দ্বারস্থ হলেনপ্রতি হাজারে ২০০ টাকা দাদন গুনতে হয় যুধিষ্ঠির কৈবর্তকেজাল-নৌকার জন্য এ বছর তিন হাজার টাকা আগেই ধার করা হয়েছিলঅতিরিক্ত পাঁচশো টাকা নিলে দাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৭০০ টাকাকিন্তু অশোক বাবু বেঁকে বসলেনহাজারে না নিলে পাঁচশোতে দাদন পড়বে ১২০ টাকাউপায় নেই গোলাম হোসেনযুধিষ্ঠির কৈবর্ত তবু দোমনা দোমনা করে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেনসেই সুযোগে অশোক বাবু আবদার করলেন, আর মাছের হিসাবনিকাশের কী হবে?
এই এক নতুন মুশকিল এখন কৈবর্ত সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছেএমনিতে হাজারে ২০০ টাকা দাদনএ ছাড়া আবার মাছ যা ধরা পড়ে তার ওপর সব সময়ই একটা খবরদারি করেন দাদনদাররাজেলের ধরা মাছের দাম হাঁকাবেন দাদনদারদাদনদারদের হাঁকানো সেই দামে ঘাটে বসেই দাদনদারদের ভাড়াটে লোকদের কাছে মাছ বিক্রি করতে হয় কৈবর্ত জেলেদেরএমনিতে সমুদ্রে যেখানে কৈবর্তরা জাল ফেলে মাছ ধরে, তার আয়তন দিন দিন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছেকৈবর্ত ছাড়াও দাদনদাররা এখন মুসলমানদের মাছ ধরায় নানাভাবে উসাহিত করছেনএখন কৈবর্তদের চেয়ে মুসলমানরা দাদনদারদের কাছে সুলভে দাদন পায়সেই দাদনের টাকায় তারা কৈবর্তদের পাতার সামনে জাল ফেলেপাতা হলো কৈবর্তরা সমুদ্রে যেখানে জাল ফেলে সেই ঘেরের নামতো জোয়ারের সময় সমুদ্রের মাছ যখন দৌড়ঝাঁপ করে, সেই মাছেরা কৈবর্তদের জালে ধরা পড়ার আগেই এখন মুসলমানদের সামনে পাতা জালে ধরা পড়ছেফলে কৈবর্তরা তীরে ফিরছে কম মাছ নিয়ে, নতুবা কখনো কখনো একেবারে খালি হাতেতবু দাদনের টাকা ছাড়া জলে নামার জো নেই যুধিষ্ঠিরদের
কাজরী বামন ঠাকুর পঞ্জিকা খুলে তিথি-নক্ষত্র দেখে মা-গঙ্গাপূজার দিনক্ষণ ঠিক করলেনসকাল থেকে তাই কাজরী বামন ঠাকুর পূজার আয়োজন নিয়ে মহাব্যস্তচন্দ্রমণি, চন্দ্রমণির বন্ধু নিখিল, দুই পিসির তিন ছেলে অমল, বিমল আর সুবল কাজরী বামন ঠাকুরকে যথাসাধ্য সহায়তা করছেজেলেপল্লির প্রায় সকল চৌদ্দ-পনেরো বছরের বালকও চন্দ্রমণিদের এটা-ওটা ফাই-ফরমায়েশ খাটছেযুধিষ্ঠির কৈবর্তদের উত্তর পতেঙ্গার জেলেপল্লির একেবারে বঙ্গোপসাগরের তীরের পাশেই চলছে এই পূজার আয়োজনউত্তরমুখী করে তৈরি করা হয়েছে উঁচু মাটির একটি বেদিসেই বেদির ওপর বসানো হয়েছে জলভর্তি মাটির একটি ঘটঘটের ওপর বসানো হয়েছে ডাঁটাসহ গোটা একটি নারকেলআর নারকেলের চারপাশে আমের পাতা মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছেবেদির ঠিক পেছনে একটি কচি কলাগাছ লাগানো হয়েছেআর ঘটের সামনে নৈবেদ্য দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে বেদিকাজরী বামন ঠাকুরের পরামর্শে ঢাকের বাজনা শুরু হলোসেই সঙ্গে জ্বালানো হলো ধূপ আর মোমবাতি
মা-গঙ্গার পূজার বেদি থেকে অল্প দূরে সারি সারি করে বাঁধা হয়েছে নৌকানৌকার গায়ে নতুন করে আলকাতরা মারার মসৃণ চিহ্ননৌকাগুলোর আগা ও গোড়ায় আঁকা হয়েছে নানা রঙের পাতা আর ফলের ছবিনৌকাগুলোর আগার একেবারে বাইরের অংশে আঁকা হয়েছে দুটো করে মানুষের চোখজনশ্রুতি হলো, গভীর সমুদ্রে রাতের আঁধারে নিজ মালিকদের জাল খুঁজতে নৌকার এই চোখজোড়াই কৈবর্তদের সব সময় সাহায্য করে থাকেকাজরী বামন ঠাকুরের ইশারায় পূজা শুরু হলো
গোটা এলাকায় তখন কৈবর্ত জেলেপল্লির প্রায় সবাই উপস্থিতকৃষ্ণ বৈরাগীর পঞ্চবাদক দল ধুমছে বাজনা শুরু করলকৈবর্ত নারীরা সমস্বরে উলুধ্বনি দিলএভাবে তিনবার পূজা করার পর কৈবর্ত নারীরা কুলায় পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে সারি সারি বাঁধা নৌকাগুলোর কাছে গেলেনউলুধ্বনি দিতে দিতে তারা সিঁদুরের কৌটা থেকে ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে সিঁদুর তুলে নৌকাগুলোর আগায় আগায় সিঁদুরের টিপ লাগাতে লাগলেনআর মনে মনে কৈবর্ত নারীরা মা-গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘তুমিই আমাদের দেবীআমাদের জীবন-মরণ সব তোমারই হাতেতুমি আমার স্বামী-পুত্রদের বেশি বেশি মাছ দিয়োনইলে স্বামী-সন্তান নিয়ে আমরা উপোস থাকবতুমি দয়া করো মাআর আশীর্বাদ করো যেন আগামী বছর আবার তোমায় এভাবেই পূজা দিতে পারি
চন্দ্রমণির বড় পিসি সরলাদেবীর একমাত্র ছেলে সুবল আগের রাতে উপোস ছিলকারণ, যুধিষ্ঠির কৈবর্ত মামার কেনা পাঁঠা এ বছর বলি দেবে সুবলবলির আগের রাতে বলিদানকারীর শুদ্ধচারী থাকার নিয়মতাই সুবল শাস্ত্রের সেই নিয়ম পালন করছে উপবাস থেকেপাঁঠা বলির সময়ে আবারো কৈবর্ত নারীরা সমস্বরে উলুধ্বনি দিলেনগোটা জেলেপল্লি আজ যেন নতুন সাজে সেজেছেসবাই নতুন জামাকাপড় পরেছেসবার মনে আজ ভারি আনন্দশত্রুতা ভুলে আজ সবাই একসঙ্গে কৃষ্ণ বৈরাগীর পঞ্চবাদকের ঢোলকের তালে তালে নৃত্য করছেসে এক দেখার মতো দৃশ্য বটেঢাক আর কাঁসার বাদ্যের তালে তালে গোটা বঙ্গোপসাগরেও যেন আজ মাতম করা ঢেউয়ের নাচনপূজা শেষে কাজরী বামন ঠাকুর পঞ্জিকা দেখে ঘোষণা করলেন- ৩রা আষাঢ় রাত্রি ৩টা ১৯ মিনিটে সমুদ্রযাত্রা শুভযুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এবার সমুদ্রে মাছ ধরতে গেল বড় বোন সরলাদেবীর একমাত্র ছেলে সুবলআর পরদিন সকালে হরিপদ কৈবর্তের সঙ্গে কৈবল্যধামে রওনা হলো চন্দ্রমণি আর তার প্রিয়াতমা নববধূ শৈলীরানী

তিন.
হরিপদ কৈবর্ত মেয়ে শৈলীরানী আর মেয়েজামাই চন্দ্রমণিকে কৈবর্তসমাজের অতীত ইতিহাস শোনাচ্ছিলেনবিলাস রাজবংশীর নৌকায় তারা উত্তর পতেঙ্গা থেকে কৈবল্যধাম যাচ্ছিলেনহরিপদ বলছিলেন, বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কৈবর্তরা সমাজে প্রান্তিকগোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচিতবৈদিক সাহিত্য, রামায়ণ, এমনকি মহাভারতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়ব্রাত্যমানে যারা ব্রত থেকে চ্যুত বা ভ্রষ্টবর্তমান আধুনিক সমাজেও এদের নিম্নবর্গ, হরিজন, দলিত, ছোটলোক ইত্যাদি বলে গালি পাড়ে অনেক শিক্ষিত সমাজের গোমূর্খের দলপ্রাচীন সাহিত্যে ব্রাত্য বা অন্তজ শ্রেণী হিসেবে রজক, চর্মকার, নট, বরুড়, মেদ, ভিল্ল আর কৈবর্ত নামে মোট সাত শ্রেণীর ব্রাত্য বা অন্তজের সন্ধান মেলেসময় এবং অঞ্চলভেদে কৈবর্ত শ্রেণীর আবার অনেক নাম পাওয়া যায়যেমন- মস্যঘাতী, স্যজীবী, মাছধরা, জেলে, পাতর, ধীবর, রাজবংশী, কেওট, কৈবর্ত, দাস, মালো, মল্লবর্মণ, গাবর, মেছো, মাউছ্যা, জাইল্যা, জলদাস ইত্যাদি ইত্যাদিএ পর্যায়ে চন্দ্রমণি শ্বশুর মহাশয়কে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বাবা, আমাদের এই কোণঠাসা অবস্থার জন্য আসলে কারা দায়ী?
মেয়েজামাই চন্দ্রমণির প্রশ্নের জবাবে শ্বশুর মহাশয় হরিপদ কৈবর্ত বললেন, ‘মনুসংহিতার বিধান মতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্রের মধ্যে শূদ্ররা হলো সবচেয়ে নিম্নগোষ্ঠীঋষি মনু একদা বলেছেন, ‘শূদ্র অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে নাউচ্চবর্ণের পথ দিয়ে শূদ্র তাদের শবদেহ বহন করতে পারবে নাব্রাহ্মণের নিন্দা করলে শূদ্রের জিহবা কেটে নেওয়া যাবেব্রাহ্মণের সঙ্গে একসাথে বসলে শূদ্রের পাছায় লোহার ছেঁকা দিয়ে তাকে নির্বাসন করা যাবেএমন অনেক কঠিন কঠিন বিধান উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আগে পালন করতমূলত, ক্ষমতা আর শাসনকাজ নির্বিঘ্নে করতেই এভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সমাজকে চার শ্রেণীতে ভাগ করলব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়ের ছত্রচ্ছায়ায় যজ্ঞাযজ্ঞে আর ধর্মকর্মে পৌরহিত্য করতে লাগলশাসনকার্যের দায়িত্ব নিল ক্ষত্রিয়রাশিল্পবাণিজ্য আর কৃষিকাজের দায়িত্ব পেল বৈশ্যরাআর সব ধরনের কায়িক পরিশ্রমের ভার অর্পণ করল শূদ্রদের ওপরসেই হিসেবে ধর্মের দোহাই দিয়ে উচ্চবর্ণ হিন্দুরাই আমাদের কোণঠাসার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী
আর এই চিত্র বালুখালি, উত্তর পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলি, খেজুরতলা, সলিমপুর, কুমিরা, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই- যেখানেই যাও, এখনো বর্তমানএমনকি, কর্ণফুলী, মাতামুহুরী, হালদা, সাংগু, এসব নদীর এপার-ওপারে যেসব জেলেরা এখনো বসবাস করছে, সেখানেও একই অবস্থাআমার ধারণা, শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতবর্ষে এখনো কৈবর্তরা উচ্চবর্ণ হিন্দুদের কাছে আজও অচ্ছু
এতক্ষণ শৈলীরানী চুপচাপ বাবা আর স্বামীর কথোপকথন শুনছিলএসব বড়দের কথা শৈলীরানী একদম বুঝতে পারে নাসে বরং তার চেয়ে বয়সে একটু বড় নৌকার মাঝি বিলাসের সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্বের খাতিরটা আরেকটু ঝালাই করে নিলআচ্ছা বিলাস দা, তুমি বিয়া করবা কবে? বিলাস রাজবংশীর বাড়ি হরিপদর বাড়ির খালের ঠিক উল্টো পারেহরিপদ কৈবর্ত মেয়ে-জামাইকে আনতে বিলাসকে সঙ্গে নিয়েছিলেনবিলাস শৈলীরানীর কথায় না হেসে পারল নাআঁই তো গড়ার চাইমা-বাবা রাজি নবছর দুই যাউকতারপর গড়ির... হে হে হে...
আষাঢ়ের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এই আছে তো এই নেইনৌকার খোলে অবশ্য একটা ভাঙা ছাতা আছেকিন্তু তা বের করার উপায়ও নেইদক্ষিণা বাতাসে বিলাসের নৌকা ঠিক রাখা তখন আরো কঠিন হয়ে যাবেযে কারণে আষাঢ়ের হঠা আসা এই দমকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিকে ওরা তেমন পাত্তাও দেয় নাবেলা দ্বিপ্রহর নাগাদ বিলাস হরিপদ কৈবর্তের ঘাটে নৌকা ভেড়াতে সক্ষম হলোশৈলীরানী সবার আগেই এক লাফে চিরচেনা সেই ঘাটে এমন লম্ফ দিল যে, আরেকটু হলেই চন্দ্রমণি নৌকা থেকে ছিটকে যাচ্ছিলভাগ্যিস শ্বশুর মহাশয় হরিপদ কৈবর্ত চন্দ্রমণিকে ধরে রাখলেন

চার.
যুধিষ্ঠির কৈবর্তের তিন বছরের ছোট সরলা দেবীআর সরলা দেবীর আড়াই বছরের ছোট সুলেখা দেবীকিন্তু সুলেখার বিয়ে হয়েছিল সরলার চেয়ে তিন বছর আগেসুলেখার দুই ছেলে অমল আর বিমলআর সরলার একমাত্র ছেলে সুবলবড় মাসি সরলার বিয়ের সময় অমলের বয়স ছিল দেড় বছরআর সুলেখা দেবী তখন ছিল নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বাসরলার বিয়ের ঠিক কুড়ি দিন পর জন্ম হয় বিমলেরআর দুই বছর ঘুরে সরলার ছেলে সুবলের জন্মপরপর এই নিয়ে তিন বছর দুই বোন সুলেখা আর সরলার ছেলেরা একমাত্র মামা যুধিষ্ঠির কৈবর্তের কাছে সমুদ্রে মাছ ধরায় হাতেখড়ি নিলএর মধ্যে অমল আর বিমলের যখন হাতেখড়ি হয়, তখন ঘটা করে আলাদা আলাদা দুটি পাঁঠা বলি দেওয়া হয়েছিলকারণ, সুলেখার অবস্থা অনেকটা ভালোএ বছর সুবলের হাতেখড়িতে আলাদা করে কোনো পাঁঠা বলি হলো নাকারণ, সরলার সেই অবস্থা নেই
যুধিষ্ঠির কৈবর্ত সুবলকে একটু চুপচাপ দেখে বললেন, মা-মনসাপূজায় তোর নামে একটা পাঁঠা বলি দেবসমুদ্রে জাল ফেলার সময় মনে মনে মা-গঙ্গার নাম জপ করবিআর জাল তোলার সময় মা-মনসার নাম জপ করবিদেখবি বেশি মাছ উঠবে জালেসুবল তার পর থেকে অনেকটা স্বাভাবিককিন্তু আষাঢ়ের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে সমুদ্র আজ ভারি রুদ্রতাই সুবলকে আরো শক্ত করে বসার জন্য ফরমায়েশ করেন যুধিষ্ঠির কৈবর্তজাল ফেলা শেষ করে সুবলের হাতে বইঠা দিয়ে আয়েশ করে তামুক খেলেন যুধিষ্ঠিরআষাঢ়ের এমন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর উল্লাসী সমুদ্রনাচনে ইলিশের ঝাঁক ধরার অভিজ্ঞতা তারমা-গঙ্গার কৃপা হলে আজ অনেক ইলিশ ধরা পড়বেমনে মনে একটু খুশি হয় যুধিষ্ঠির
যদি বাতাস দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঘুঁটি পাকায় আর ভারী জোয়ার হয়, তাহলে আজ ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশিসমুদ্রের এই নানা রঙের ঢঙের সঙ্গে যুধিষ্ঠির খুব পরিচিতপশ্চিম আকাশে শুকতারা দেখা গেলেই জাল তোলা শুরু করবেন বলে মনে মনে স্থির করেন যুধিষ্ঠিরসুবলকে একটা জুতসই ছবক দেওয়া শুরু করলেন যুধিষ্ঠির কৈবর্তসবকিছুই চব্বিশ ঘণ্টার হিসাব, বুঝলি সুবল? চব্বিশ ঘণ্টায় এক দিনএই এক দিনে মোট দুবার জোয়ার হয় আর দুবার ভাটা
এই জোয়ার-ভাটা নির্ভর করে চাঁদের ওপরপুবাকাশে যখন চাঁদ উঠবে, তখন সমুদ্রে জোয়ার শুরু হবেচাঁদ যখন ঠিক মাথার ওপর থাকবে, তখন হবে পূর্ণ জোয়ারআবার চাঁদ যখন পশ্চিমাকাশে হেলতে থাকবে, তখন ধীরে ধীরে ভাটা শুরু হবেআর চাঁদ যখন আর পশ্চিম আকাশে দেখা যাবে না, তখন হয় পূর্ণ ভাটাএরপর আবার জোয়ার শুরু হবেপূর্ণ জোয়ারের যতক্ষণ পর পূর্ণ ভাটা হলো, ঠিক ততক্ষণ পর আবার পূর্ণ জোয়ার হবেতারপর আবার ভাটা শুরু হবেসেই ভাটা থেকে যখন আবার পূর্ণ ভাটা হয়ে জোয়ার শুরু হবে, তখনই আবার পুবাকাশে চাঁদ উঠবেএই হিসাবটা সব সময় মনে রাখবিএ ছাড়া চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণের সময় সবচেয়ে বড় জোয়ার হয়কারণ, তখন চাঁদ, সূর্য আর পৃথিবী এক লাইনে থাকেযাকে আমরা বলি ভরা কাটালএ ছাড়া চাঁদ, সূর্য আর পৃথিবী পরস্পর তিন কোণে বা সমকোণে অবস্থান করলে তখন সমুদ্রের জল একদম কমে যায়এটাকে আমরা বলি মরা কাটালমরা কাটালের সময় সমুদ্রে নামা একেবারে বারণ
এ ছাড়া অমাবস্যা আর পূর্ণিমার সময় বড় জোয়ার হয়তখন মাছ ধরা পড়ে বেশিবড় জোয়ারের সময় মাথা ঠান্ডা রাখা খুব জরুরিনইলে দিক ভুল হলে বহিঃসমুদ্রে ভেসে যাবার ভয় থাকেআমি অবশ্য বাবার সঙ্গে অনেকবারই বহিঃসমুদ্রে মাছ ধরতে গেছিবহিঃসমুদ্রে না গেলে জীবনেও সমুদ্রের ধারণা বুঝবি নাপৃথিবীর তিনভাগ যে জল, তা কেবল বোঝা যায় বহিঃসমুদ্রে মাছ ধরার সময়কিন্তু বহিঃসমুদ্রে যাবার একটা দোষ আছেবহিঃসমুদ্রে একবার মাছ ধরে যারা মজা পায়, তাদের আর এই কাছের সমুদ্রে মাছ ধরতে ইচ্ছে করে না
কিন্তু বিপদ হয় যখন ঝড় ওঠেতখন বহিঃসমুদ্র থেকে দ্রুত আর ফেরা যায় নাএ জন্য চন্দ্র, সূর্য আর আকাশ যদি ভালো করে বুঝতে না পারিস, তাহলে সমুদ্রে মাছ ধরা ভারি কঠিন কাজআর বহিঃসমুদ্রে তো তা আরো কঠিন
চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে কত সময় নেয় রে, সুবল? এতক্ষণ সুবল চুপচাপ মামার কথা শুনছিলএবার মামার অমন সহজ প্রশ্নে ফিক করে হাসি দিয়ে বলল, ত্রিশ দিনযুধিষ্ঠির কৈবর্ত ভাগ্নের কথা শুনে মিটমিট করে হাসলেনতোর জন্য খুব সহজ প্রশ্ন, তাই না? শোন, চাঁদের এই হিসাবটা তোদের বইপত্রে যেভাবে আছে, আমরা সেভাবে বুঝি নাআমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যা বুঝি, তা-ই শোনসাত দিনে হলো সপ্তাহদুই সপ্তাহে হলো এক পক্ষএই এক পক্ষ মানে হলো চাঁদের পক্ষচাঁদের পক্ষ কয়টি? জবাবে সুবল বলল, দুইটি
- কী কী?
- কৃষ্ণপক্ষ আর শুকপক্ষ
- হ্যাঁ, কৃষ্ণপক্ষ আর শুকপক্ষতাহলে দুই পক্ষ মিলে কয় সপ্তাহ হয়?
- চার সপ্তাহ
- বুঝলাম, চার সপ্তাহতাহলে মোট কয় দিন হয়?
- ২৮ দিন
- তাহলে চাঁদের হিসাবে আমরা পেলাম ২৮ দিনআর তুই বইয়ের হিসাবে বললি, চাঁদের ৩০ দিন লাগে পৃথিবী ঘুরতে! আসলে প্রকৃত হিসাবে চাঁদের পৃথিবী ঘুরতে পুরো ২৮ দিনও লাগে নালাগে ২৭ দিন ৮ ঘণ্টার মতোমানে পৃথিবী একবার প্রদক্ষিণ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৮ দিনের চেয়ে অন্তত ১৬ ঘণ্টা কমচাঁদের এই পৃথিবী প্রদক্ষিণের কাঁটায় কাঁটায় হিসাবটা তোর ঠাকুরদা খুব ভালো জানত, বুঝলিআর অমাবস্যার ঠিক কত সময় পর চাঁদ উঠবে, তা উনি প্রায় নির্ভুল বলে দিতে পারতেনআগে পতেঙ্গার সবাই তোর ঠাকুরদার কথার ওপর ভর করেই সমুদ্রে নামতএখন তো কেউ সময়জ্ঞান মানে নাকলিযুগে আরো কত কিছু দেখব, ভগবান!
পশ্চিম আকাশে শুকতারা উঠেছেযুধিষ্ঠিররা তখন জাল তোলা শুরু করলসুবল তখন আরো কিছু নিয়মকানুন শিখে নিল মামার কাছ থেকেকীভাবে মাছ জাল থেকে আবার নৌকার সঙ্গে বাঁধা টুকরো জালে রাখতে হয়কীভাবে জাল থেকে জালে মাছ হাঁটাতে হয়, সেটা একটা জুতসই টেকনিক বটেসুবল প্রথম চেষ্টায় একটি ইলিশকে টুকরো জালে আটকাতে পারেনিদ্বিতীয় চেষ্টায় অবশ্য পেরেছেকিন্তু টেকনিকটা এখনো ঠিক ধরতে পারছে নাযুধিষ্ঠির সেই কৌশলটা সুবলকে বারবার ইলিশ ধরে দেখাতে লাগলেনগুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থাকায় আজ ভালোই ইলিশ ধরা পড়ছে সবার জালে

পাঁচ.
পাঁচ বছর পরের ঘটনাশৈলীরানী ছেলেসন্তানের মা হয়েছেচন্দ্রমণির বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্ত নাতির নাম রেখেছেন অর্জুনঅর্জুন মণি কৈবর্তনাতি অর্জুনের সঙ্গে বেশ ভালোই সময় কাটে যুধিষ্ঠির কৈবর্তেরআর অর্জুনের বাবা চন্দ্রমণি কৈবর্ত এখন সমুদ্রে ফুলটাইম মাছ ধরেমাছ ধরার নেশায় পেয়েছে চন্দ্রমণিকেমাছ ধরতে ধরতে দুঃসাহসী চন্দ্রমণি ইদানীং বহিঃসমুদ্রেও চলে যায়চন্দ্রমণি স্বপ্ন দেখে, যে করেই হোক ছেলে অর্জুনকে আর সমুদ্রমুখী করবে নাকৈবর্তসমাজের বদনাম ঘুচানোর জন্য যত কষ্টই হোক অর্জুনকে স্কুলে দেবেঅর্জুন পড়াশোনা করবেঅর্জুন কৈবর্তসমাজের অন্ধকার আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করার জন্য একদিন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে বড় হবেকৈবর্তসমাজকে শিক্ষামুখী করার জন্য অর্জুন হবে নতুন আলোর দিশারি
অর্জনের মা শৈলীরানীও চন্দ্রমণির সেই স্বপ্নে কষ্ট স্বীকার করতে রাজিএমনিতে কৈবর্ত স্বামীরা সমুদ্র থেকে খালি হাতে ফিরে কারণে-অকারণে স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলেনশৈলীরানীও চন্দ্রমণির হাতের সেই নির্মম আক্রোশের তাণ্ডবের শিকার হয়েছেতবু অভাবের সংসারে সবকিছু মেনে নিয়ে যে করেই হোক, অন্যদের মতো অর্জনকে আর জাল নিয়ে জলে নামতে দেবে না শৈলীরানীবই হাতে অর্জুন স্কুলে যাবেঅর্জুনের দেখাদেখি কৈবর্ত জেলেপল্লির অনেক ছেলেমেয়েও নিশ্চয়ই একদিন স্কুলে যাবেশুধু জল আর জালের ওপর জীবন বাজি রেখে জীবনের দুঃখ যে তাড়ানো যায় না, সেই কথাটি কৈবর্তসমাজে সবার অন্তরে ঢুকিয়ে দেবার জন্য অর্জুন হবে স্কুলমুখী প্রথম ছাত্রবড় হয়ে অর্জুন কৈবর্তসমাজকে আলোর কান্ডারি হয়ে পথ দেখাবেসে কথার সঙ্গে অর্জুনের নানাঠাকুর হরিপদ কৈবর্ত আর দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির কৈবর্তও সুর মেলান
এ কথা সত্য যে, কোনো একটা জায়গা থেকেই শুরুটা করতে হবেআর সেই শুরুটা যদি অর্জুনকে দিয়ে হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগাকোনো একটি পরিবার থেকেই সেই শুরুটা হওয়া চাইযুধিষ্ঠির কৈবর্তের অনেক ইচ্ছে ছিল চন্দ্রমণিকে স্কুলে দেবারকিন্তু সাধ আর সাধ্যের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারেননিসেই সুপ্ত বাসনা যদি চন্দ্রমণির ছেলেকে দিয়ে পূরণ হয়, তাহলে তৃপ্তি নিয়ে পরকালের কথা ভাবতে পারব, এমনটি মনে করেন যুধিষ্ঠির কৈবর্তঅর্জুনের দাদাঠাকুর, যিনি দেড় বছর ধরে আর সমুদ্রে যান নাশরীরে আর আগের মতো তাগদ নেইচোখেও কম দেখেনঅবসর সময়ে অর্জুনের সাথে কুস্তিগিরি আর অনেক খোশগল্প করে সময় কাটানমাঝেমধ্যে অর্জুনের নানাঠাকুর হরিপদ কৈবর্ত বেড়াতে এলে দুই বন্ধু মিলে জমিয়ে ভারি আড্ডা দেনগল্পে গল্পে তারা ফিরে যান যৌবনের সেই নির্ভীক দিনগুলোতে
মাঝেমধ্যে চন্দ্রমণিকে বহিঃসমুদ্রে যেতে বারণ করেন বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্তজলবায়ু এখন আর আগের মতো নেইঠিক সময়ে কারো বোঝার সাধ্য থাকে না, কখন ঝড় হবে আর কখন ঘূর্ণিঝড় পাকাবেপূর্বঘোষণা ছাড়াই বাতাস হঠা দিক পাল্টায়ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার চন্দ্রমণি বড় বড় ঝড়ের কবলে পড়েছেশরীরে শক্তি আছে আর ভগবানের কৃপায় সেসব ঝড় থেকে চন্দ্রমণি নিজেকে বাঁচাতে পেরেছেতবু চন্দ্রমণি ঝুঁকি নিয়ে বহিঃসমুদ্রে যায়না গিয়ে উপায় থাকে নামাছ না পেয়ে খালি হাতে ফেরার দুঃখের চেয়ে বরং জীবন বাজি রেখে নাও ভরা মাছ নিয়ে ফেরার মধ্যেই যে কৈবর্তের সুখ, রক্তে মিশে থাকা সেই আজন্ম জিনের পরম চরিত্র তবু চন্দ্রমণিকে সেই অদৃশ্য নেশা থেকে ফেরাতে পারে নামাছ ধরতে গেলেই কখন যে কিসের নেশায় কিসের টানে কার ইশারায় মনের ভুলেই সেই দূর বহিঃসমুদ্রে চলে যায়, তা হয়তো চন্দ্রমণি নিজেও বুঝতে পারে না
ওদিকে আকাশের রং বদল দেখে বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্ত আর স্ত্রী শৈলীরানী বারবার ভগবানের নাম নেনভগবান রক্ষা করোতোমার বাছাকে তুমি রক্ষা করোমা আর দাদাঠাকুরের সেই অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে ছোড়া রহস্যময় আহাজারি শুনে ছোট্ট অর্জুন তখন ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে থাকেকখনো কিছু না বুঝেই বাব-বাব-বাব বলে আপন মনে কথা বলেআকাশের রং বদলের সঙ্গে কৈবর্তসমাজের এই নিত্য আহাজারি আর আতঙ্কের উচ্চ-ধ্বনি, বৈরী বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে মিলেমিশে শুধু যুধিষ্ঠির কৈবর্ত আর শৈলীরানীর কণ্ঠে নয়, গোটা পতেঙ্গা, কৈবল্যধাম, হালিশহর, কাট্টলি, খেজুরতলা, সলিমপুর, কুমিরা, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই সমুদ্র উপকূলের কৈবর্ত ঘরে ঘরে আকাশ-বাতাস ভারী করে এক অদ্ভুত অজানা শঙ্কার বিমূঢ় ঘোর তৈরি করেযা দেশের অন্য কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর কাছে কেবল দুর্বোধ্য হলেও একটা গভীর আতঙ্কের মধ্যে কৈবর্তসমাজ এভাবেই দিন কাটায়আর এই জানা আতঙ্কের হাজারো শঙ্কা মাথায় নিয়ে আবারো জীবন হাতে করেই চন্দ্রমণি কৈবর্তরা আবারো সমুদ্রে যায়আর স্বপ্ন দেখে অর্জুনরা একদিন জাল ফেলে বই হাতে নিয়ে স্কুলে যাবে
অভাব আর কৈবর্তরা যেন-বা সমার্থক কোনো মাসতুতো ভাইজীবনের দস্তখত দিয়েই তারা সেই অভাব দূর করার নেশায় সারা জীবন সমুদ্রে গতর খাটেনশরীরের শক্তি ফুরিয়ে গেলে ধুঁকে ধুঁকে রোগ আর দুঃখের সঙ্গে সহবাস করেই শোকের মাধ্যমে যার অবসান ঘটেশরীরের শক্তি নিঃশেষ করে ছেলে চন্দ্রমণিকে নিয়ে অকারণে দুশ্চিন্তা করে করে যুধিষ্ঠির কৈবর্ত যেন ধীরে ধীরে আরো কাবু হতে শুরু করলেননাকি বয়স বাড়ার সঙ্গে রোগের একটা মধুর সম্পর্ক রয়েছে যা এখন অর্জুনের দাদাঠাকুর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেনতবু সমুদ্রের হু হু লাগা বাতাসের নির্বেদ ভাষায় সেই দুঃখের কতটুকু আর চিকিসা করা যায়?
এভাবে মাস যায়, বছর যায়কৈবর্তসমাজের সেই চিরায়ত জীবনসংগ্রামের কোনো বদল হয় নাতবু আশার কথা, অর্জুন স্কুলে যায়স্কুলের শিক্ষকেরা অর্জুনকে খুব ভালোবাসেঅর্জুনও শিক্ষকদের মন জয় করে মন দিয়ে লেখাপড়া করছেঅবসরে বাবা চন্দ্রমণিকে জাল আর নৌকার নানান ফরমায়েশে সহায়তা করেমা শৈলীরানীর বাজার করে দেয়দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির কৈবর্তের ওষুধ কিনে আনেআর এভাবে সত্যি সত্যিই একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে অর্জুন এসএসসি পাস করেঅর্জুন কলেজে ভর্তি হয়চোখের সামনেই অর্জুন সবার উসাহ আর সহযোগিতায় একদিন এইচএসসি পাস করেতারপর অর্জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়সবার আশীর্বাদে তেইশ বছর বয়সে অর্জুন এমএ পাস করে
তত দিনে অর্জুনের দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির কৈবর্ত বয়সের ভারে বিছানায় ধরাশায়ীহাঁটাচলা করতে পারে নাআর অর্জুনের নানাঠাকুর হরিপদ কৈবর্ত পরপারে পাড়ি দিয়েছেনমা শৈলীরানী অর্জুনের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেছেনবাবা চন্দ্রমণি জল আর জাল নিয়ে তখনো সমুদ্রে এক অনিঃশেষ জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেনতার মধ্যেই অর্জুন বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে একটি সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করার গৌরব অর্জন করেকক্সবাজার সরকারি কলেজে অর্জুনের নতুন জীবন শুরু হয়
ওদিকে মা শৈলীরানী তত দিনে আরো তিন কন্যাসন্তানের মাপ্রভা, শোভা আর লোপাও স্কুলে যায়ছেলে অর্জুনের কাছে মা শৈলীরানী শোভাকে দিয়ে চিঠি লিখে খবর পাঠান যে, কৈবল্যধামে তার এক দূরসম্পর্কের পিসির ননদের মেয়ের ঘরের মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছেমেয়ের নাম দিপালীদিপালী এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবেছুটি পেলে একবার যেন মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে অর্জুন দেখে যায়মায়ের চিঠিতে অর্জুনের ছুটি মেলেনিকিন্তু কলেজের শীতকালীন ছুটিতে অর্জুন যখন পতেঙ্গার জেলেপাড়ার পিতৃমাটিতে একজন আদর্শ কৈবর্ত হিসেবে প্রত্যাবর্তন করল, তার তিন দিনের মাথায় দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির কৈবর্ত ওপরের ডাক পেলেন
যুধিষ্ঠির কৈবর্তের শ্রাদ্ধে কৈবল্যধাম থেকে অনেক মানুষ এসেছিলসেই দলে শৈলীরানীর সেই পিসির ননদের মেয়ের ঘরের মেয়ে দিপালীও ছিলদিপালীকে অর্জুনেরও ভালো লেগে গেলতারপর সবার আলোচনায় ঠিক হলো যে, আগামী বছর ৩০ চৈত্র অর্জুন আর দিপালীর বিয়ে হবেএ বছর শাস্ত্রমতে বিয়ে হবার সুযোগ নেইকারণ, অর্জুনের দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির কৈবর্ত এ বছর মারা গেছেনচন্দ্রমণির মনে মনে ইচ্ছে, ছেলে অর্জুনের বিয়েতে দাভার প্রচলনটি আর মানবেন নাতাই কনেপক্ষের কাছে চন্দ্রমণি কৈবর্ত কোনো দাভার শর্তও দিলেন নাঅর্জুন মণি কৈবর্তের হাত ধরেই হয়তো কৈবর্তসমাজ নতুন এক সংস্কারের দিকে রওনা হলোএমনটি মনে করেই চন্দ্রমণি কৈবর্ত ভারি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা দিলেন, আজ আমি এক গর্বিত কৈবর্ত পিতাআর শৈলীরানীকে বললেন, তুমি একজন গর্বিত কৈবর্ত মাঅর্জুন আমাদের কৈবর্তসমাজেরই এক গৌরবওরে কে আছিস, পঞ্চবাদক দল খবর দেআজ আমরা সবাই মিলে নাচবসেই খবরে কৃষ্ণ বৈরাগীর ছেলে পঞ্চানন বৈরাগীর পঞ্চবাদক দল এসে চন্দ্রমণির উঠানে বাদ্য বাজাতে শুরু করলএকটু পরই বর অর্জুন মণি কৈবর্ত বরযাত্রী নিয়ে কৈবল্যধামে কনের বাড়িতে রওনা হবে

১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩
বারিধারা, ঢাকা
লেখক পরিচিত
রেজা ঘটক
জন্ম: ২১ এপ্রিল ১৯৭০ (৮ বৈশাখ ১৩৭৭), উত্তর বানিয়ারী, নাজিরপুর, পিরোজপুর, বাংলাদেশ।
পড়াশুনা: অর্থনীতি শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও মাস্টার্স।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
ছোটগল্প: বুনো বলেশ্বরী, ছোটগল্প সংকলন, ২০০৮। সোনার কঙ্কাল, ছোটগল্প সংকলন, ২০১০। সাধুসংঘ, ছোটগল্প সংকলন, ২০১১ । ভূমিপুত্র, ছোটগল্প সংকলন, ২০১৩
উপন্যাসমা, ২০১২। 
সমালোচনাশূন্য দশমিক শূন্য, ২০১১।
কিশোর গল্প: বয়োঃসন্ধিকাল, ২০০৫।
শিশুতোষময়নার বয়স তেরো, ২০০৩। গপ্পো টপ্পো না সত্যি, ২০১১


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ