এক.
জলের পাশেই জেলের বাড়ি। এই জল খাল-বিল-নদীর নয়, স্বয়ং সমুদ্রের উতালপাথাল মাতালজল। বর্ষার আগমনীতে সেই
জলে ওঠে যৌবনের নাচন। সেই নাচতরঙ্গের সাথে যুদ্ধ করে জেলে সারা বছর সমুদ্রে জাল মারেন। বর্ষায় সমুদ্রে যত
হয় তুফান ভারী, জেলের জালে মাছের ততই ঘোরাঘুরি। জেলের জালে অধিক মাছের সেই ঘোরাঘুরিতে জেলেনির চোখেমুখে তখন
কষ্টের বাউলি বাতাসে নতুন স্বপ্নেরা উঁকি দেয়। আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন-
এই চার মাস সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে জেলেনির ঘোর কাটে। বছরের বাকি সময় ধরে
আবারো শুরু হয় একঘেয়ে জীবনযুদ্ধের ঘানি টানার অফুরন্ত দিনযাপন। সে এক যুদ্ধ-যুদ্ধ
খেলা। জীবন বাজি রেখে সেই যুদ্ধে নিত্য ওঠাবসা যাদের, তারাই কৈবর্ত। অনেকে বলেন,
জলদাস। জলের দাস।
সমুদ্রের এপিঠ-ওপিঠ খুব ভালো করেই চেনেন চন্দ্রমণি কৈবর্ত। মাত্র বারো বছর বয়সে
বাবার কাছেই সমুদ্রে মাছ ধরায় হাতেখড়ি চন্দ্রমণির। তার পর থেকেই সমুদ্রের
জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তার নিত্য ওঠাবসা। বয়স কুড়ি না পেরোতেই চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গার সমুদ্রঘেঁষা
জেলেপল্লির জরাজীর্ণ শীর্ণ কুটিরে শ্রীমতি শৈলীরানী তার ঘরে বধূ হয়ে এল। শৈলীরানীর বয়স তখন
কত? বড়জোর বারো কি তেরো। শৈলীরানীর বাবাও একজন
কৈবর্ত। বাড়ি চট্টগ্রামের কৈবল্যধামে। সেখান থেকেও সমুদ্র ভারি নিকটে।
সাধারণত কৈবর্তসমাজে বিয়ে হয় দুইভাবে। বরের বাড়িতে বিয়ে আর কনের বাড়িতে বিয়ে। নামন্ত পদ্ধতি আর চলন্ত
পদ্ধতি। বিয়ের এক দিন বা দুই দিন আগে বরপক্ষ কনের বাড়িতে যায়। সঙ্গে থাকে সাধ্যমতো
বাদকদল। বাজনার তালে তালে চলে কৈবর্ত নৃত্য। তখন নিত্য করতে করতে কনে নিয়ে বরপক্ষের বাড়িতে
এসে শাস্ত্রমতে লগ্ন সময়ে যে বিয়ে হয়, তা হলো নামন্ত পদ্ধতিতে কৈবর্ত বিয়ে। আর কৈবর্ত বর শ্বশুরবাড়িতে
গিয়ে শাস্ত্র অনুযায়ী লগ্ন সময়ে যে বিয়ে করে, তা হলো চলন্ত পদ্ধতিতে কৈবর্ত বিয়ে। সাধারণত কোন পদ্ধতিতে
বিয়ে হবে- তা উভয় পক্ষ আলাপ-আলোচনা করে আগেই ঠিক করে। তার আগে উভয় পক্ষ ‘দাভা’ নিয়ে বেশ প্যাঁচাল
পারে। দাভা হলো কৈবর্ত বিয়ের যৌতুক। প্রাচীনকালে কৈবর্ত কনেপক্ষ বরপক্ষ থেকে টাকা নিত। এখন আর কৈবর্ত সমাজে
সেই নিয়ম ততটা নেই। এখন উল্টো কৈবর্ত বরপক্ষকে কনেপক্ষের দাভা মেটাতে হয়। সে এক ভারি গুরুচণ্ডালি
নিয়ম।
তো, চন্দ্রমণির বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্ত ঘোষণা দিলেন, একমাত্র ছেলের বিয়ে নামন্ত পদ্ধতিতেই হবে। প্রয়োজনে দাভায় কিছুটা
ছাড় দিতে রাজি তিনি। এর আগে পাঁচ কন্যার বিয়েতে চন্দ্রমণির বাবাও দাভা প্রদান করেছেন। একমাত্র ছেলের বিয়েতে
সেটা উসুল করার সুযোগ যেহেতু নেই, তাই নামন্ত পদ্ধতিতে বিয়ে দিয়ে কৈবর্তসমাজে নিজের অবস্থান ঘোষণা
করতে চান চন্দ্রমণির বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্র্ত। শৈলীরানীর বাবা হরিপদ
কৈবর্ত বা কম কিসে? বন্ধুর ছেলের সঙ্গে আদরের ছোট মেয়েকে বিয়ে দেবেন, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? তাই শখ করে নিজেই ঘোষণা
দিলেন, শৈলীরানীর জন্য এগারো কুড়ি নগদ নারায়ণ তার দাভা হিসেবে জমা আছে। কৃষ্ণ বৈরাগীর পঞ্চবাদক
দলের বাজনা দিয়ে চন্দ্রমণির বরযাত্রা শুরু হলো। দুই দিন পর যুধিষ্ঠির
কৈবর্তর বাড়িতে শ্রাবণ মাসের বাইশ তারিখে মা গঙ্গাকে স্মরণ করে চন্দ্রমণি আর শৈলীরানীর
বিয়ে হলো।
দুই.
আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস কৈবর্তসমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই
মাসে হয় কৈবর্তদের প্রধান দুই পূজা। মা-গঙ্গা পূজা ও মা-মনসা পূজা। মা-গঙ্গা হলো কৈবর্তদের
অন্নদাত্রী। আর মা-মনসা হলো কৈবর্তদের রক্ষাকর্ত্রী। কৈবর্তসমাজের বিশ্বাস, মা-গঙ্গা মৎস্যের দেবী। মা-গঙ্গার ইচ্ছায় জলের
মৎস্যরা চলাফেরা করে। আর এই মৎস্য হলো কৈবর্তদের
প্রধান জলশস্য। তাই মা-গঙ্গাকে কৈবর্তরা খুব ভক্তি করে। আর মা-মনসা সর্পের
দেবী। সর্প হলো জলের হিংস্র প্রাণী। কৈবর্তরা জলচর, তাই সর্পের সাথে তাদের কোনো বিরোধ নেই। মা-মনসা তাই কৈবর্তদের
রক্ষাদাত্রী। সাধারণত কৈবর্তসমাজে আষাঢ় মাসে হয় মা-গঙ্গা পূজা, আর শ্রাবণ মাসে হয় মা-মনসা পূজা।
চট্টগ্রামের কৈবর্তরা প্রধানত দুই ধরনের। সমুদ্রনির্ভর জেলে
আর নদীনির্ভর জেলে। যুধিষ্ঠির কৈবর্তদের পূর্বপুরুষরা বহু প্রাচীনকাল আগে থেকেই
চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে মিরসরাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের উপকূলজুড়ে বসবাস করছে। পূজা-পার্বণ আর চৈত্রসংক্রান্তি
হলো কৈবর্তদের সবচেয়ে বড় উৎসব। আষাঢ় মাসের প্রথম দিন মা-গঙ্গাপূজা উপলক্ষে শৈলীরানীর বাবা হরিপদ
কৈবর্ত চন্দ্রমণিদের উত্তর পতেঙ্গার জেলেপল্লির মেয়ের বাড়িতে এসেছেন। উদ্দেশ্য মেয়ের বাড়ি
মা-গঙ্গাপূজা শেষ হলে মেয়ে-জামাইকে সাথে করে কৈবল্যধামে নিজের বাড়িতে যাবেন।
সাধারণত আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে কৈবর্তসমাজে চলে মা-গঙ্গাপূজা। একমাত্র পুত্রবধূর
বাবা বেড়াতে আসায় তাই চন্দ্রমণির বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্ত বেজায় খুশি। এবার তাই যুধিষ্ঠির
কৈবর্তের মনে মনে ইচ্ছেও মা-গঙ্গাপূজায় একটু বেশি খরচ করার। অশোক বাবুর কাছ থেকে
নৌকা আর জালের জন্য যে দাদন নিয়েছিলেন, সেই দাদনের টাকা আরেকটু বাড়ানোর জন্য তাই সন্ধ্যার পর যুধিষ্ঠির
কৈবর্ত অশোক বাবুর দ্বারস্থ হলেন। প্রতি হাজারে ২০০ টাকা দাদন গুনতে হয় যুধিষ্ঠির কৈবর্তকে। জাল-নৌকার জন্য এ বছর
তিন হাজার টাকা আগেই ধার করা হয়েছিল। অতিরিক্ত পাঁচশো টাকা নিলে দাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৭০০ টাকা। কিন্তু অশোক বাবু বেঁকে
বসলেন। হাজারে না নিলে পাঁচশোতে দাদন পড়বে ১২০ টাকা। উপায় নেই গোলাম হোসেন। যুধিষ্ঠির কৈবর্ত তবু
দোমনা দোমনা করে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। সেই সুযোগে অশোক বাবু আবদার করলেন,
আর মাছের হিসাবনিকাশের
কী হবে?
এই এক নতুন মুশকিল এখন কৈবর্ত সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। এমনিতে হাজারে ২০০
টাকা দাদন। এ ছাড়া আবার মাছ যা ধরা পড়ে তার ওপর সব সময়ই একটা খবরদারি করেন দাদনদাররা। জেলের ধরা মাছের দাম
হাঁকাবেন দাদনদার। দাদনদারদের হাঁকানো সেই দামে ঘাটে বসেই দাদনদারদের ভাড়াটে লোকদের
কাছে মাছ বিক্রি করতে হয় কৈবর্ত জেলেদের। এমনিতে সমুদ্রে যেখানে কৈবর্তরা জাল ফেলে
মাছ ধরে, তার আয়তন দিন দিন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। কৈবর্ত ছাড়াও দাদনদাররা এখন মুসলমানদের মাছ
ধরায় নানাভাবে উৎসাহিত করছেন। এখন কৈবর্তদের চেয়ে মুসলমানরা দাদনদারদের কাছে সুলভে দাদন পায়। সেই দাদনের টাকায় তারা
কৈবর্তদের ‘পাতা’র সামনে জাল ফেলে। পাতা হলো কৈবর্তরা সমুদ্রে যেখানে জাল ফেলে সেই ঘেরের নাম। তো জোয়ারের সময় সমুদ্রের
মাছ যখন দৌড়ঝাঁপ করে, সেই মাছেরা কৈবর্তদের জালে ধরা পড়ার আগেই এখন মুসলমানদের সামনে পাতা জালে ধরা পড়ছে। ফলে কৈবর্তরা তীরে
ফিরছে কম মাছ নিয়ে, নতুবা কখনো কখনো একেবারে খালি হাতে। তবু দাদনের টাকা ছাড়া জলে নামার জো নেই যুধিষ্ঠিরদের।
কাজরী বামন ঠাকুর পঞ্জিকা খুলে তিথি-নক্ষত্র দেখে মা-গঙ্গাপূজার দিনক্ষণ ঠিক করলেন। সকাল থেকে তাই কাজরী
বামন ঠাকুর পূজার আয়োজন নিয়ে মহাব্যস্ত। চন্দ্রমণি, চন্দ্রমণির বন্ধু নিখিল, দুই পিসির তিন ছেলে
অমল, বিমল আর সুবল কাজরী
বামন ঠাকুরকে যথাসাধ্য সহায়তা করছে। জেলেপল্লির প্রায় সকল চৌদ্দ-পনেরো বছরের বালকও চন্দ্রমণিদের
এটা-ওটা ফাই-ফরমায়েশ খাটছে। যুধিষ্ঠির কৈবর্তদের উত্তর পতেঙ্গার জেলেপল্লির একেবারে বঙ্গোপসাগরের
তীরের পাশেই চলছে এই পূজার আয়োজন। উত্তরমুখী করে তৈরি করা হয়েছে উঁচু মাটির একটি বেদি। সেই বেদির ওপর বসানো
হয়েছে জলভর্তি মাটির একটি ঘট। ঘটের ওপর বসানো হয়েছে ডাঁটাসহ গোটা একটি নারকেল। আর নারকেলের চারপাশে
আমের পাতা মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বেদির ঠিক পেছনে একটি কচি কলাগাছ লাগানো হয়েছে। আর ঘটের সামনে নৈবেদ্য
দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে বেদি। কাজরী বামন ঠাকুরের পরামর্শে ঢাকের বাজনা শুরু হলো। সেই সঙ্গে জ্বালানো
হলো ধূপ আর মোমবাতি।
মা-গঙ্গার পূজার বেদি থেকে অল্প দূরে সারি সারি করে বাঁধা হয়েছে নৌকা। নৌকার গায়ে নতুন করে
আলকাতরা মারার মসৃণ চিহ্ন। নৌকাগুলোর আগা ও গোড়ায় আঁকা হয়েছে নানা রঙের পাতা আর ফলের ছবি। নৌকাগুলোর আগার একেবারে
বাইরের অংশে আঁকা হয়েছে দুটো করে মানুষের চোখ। জনশ্রুতি হলো,
গভীর সমুদ্রে রাতের
আঁধারে নিজ মালিকদের জাল খুঁজতে নৌকার এই চোখজোড়াই কৈবর্তদের সব সময় সাহায্য করে থাকে। কাজরী বামন ঠাকুরের
ইশারায় পূজা শুরু হলো।
গোটা এলাকায় তখন কৈবর্ত জেলেপল্লির প্রায় সবাই উপস্থিত। কৃষ্ণ বৈরাগীর পঞ্চবাদক
দল ধুমছে বাজনা শুরু করল। কৈবর্ত নারীরা সমস্বরে উলুধ্বনি দিল। এভাবে তিনবার পূজা
করার পর কৈবর্ত নারীরা কুলায় পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে সারি সারি বাঁধা নৌকাগুলোর কাছে গেলেন। উলুধ্বনি দিতে দিতে
তারা সিঁদুরের কৌটা থেকে ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে সিঁদুর তুলে নৌকাগুলোর আগায় আগায় সিঁদুরের
টিপ লাগাতে লাগলেন। আর মনে মনে কৈবর্ত নারীরা মা-গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করলেন,
‘তুমিই আমাদের দেবী। আমাদের জীবন-মরণ সব
তোমারই হাতে। তুমি আমার স্বামী-পুত্রদের বেশি বেশি মাছ দিয়ো। নইলে স্বামী-সন্তান
নিয়ে আমরা উপোস থাকব। তুমি দয়া করো মা। আর আশীর্বাদ করো যেন আগামী বছর আবার তোমায়
এভাবেই পূজা দিতে পারি।’
চন্দ্রমণির বড় পিসি সরলাদেবীর একমাত্র ছেলে সুবল আগের রাতে উপোস ছিল। কারণ, যুধিষ্ঠির কৈবর্ত মামার
কেনা পাঁঠা এ বছর বলি দেবে সুবল। বলির আগের রাতে বলিদানকারীর শুদ্ধচারী থাকার নিয়ম। তাই সুবল শাস্ত্রের
সেই নিয়ম পালন করছে উপবাস থেকে। পাঁঠা বলির সময়ে আবারো কৈবর্ত নারীরা সমস্বরে উলুধ্বনি দিলেন। গোটা জেলেপল্লি আজ
যেন নতুন সাজে সেজেছে। সবাই নতুন জামাকাপড় পরেছে। সবার মনে আজ ভারি আনন্দ। শত্রুতা ভুলে আজ সবাই
একসঙ্গে কৃষ্ণ বৈরাগীর পঞ্চবাদকের ঢোলকের তালে তালে নৃত্য করছে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য
বটে। ঢাক আর কাঁসার বাদ্যের তালে তালে গোটা বঙ্গোপসাগরেও যেন আজ মাতম করা ঢেউয়ের নাচন। পূজা শেষে কাজরী বামন
ঠাকুর পঞ্জিকা দেখে ঘোষণা করলেন- ৩রা আষাঢ় রাত্রি ৩টা ১৯ মিনিটে সমুদ্রযাত্রা শুভ। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে
এবার সমুদ্রে মাছ ধরতে গেল বড় বোন সরলাদেবীর একমাত্র ছেলে সুবল। আর পরদিন সকালে হরিপদ
কৈবর্তের সঙ্গে কৈবল্যধামে রওনা হলো চন্দ্রমণি আর তার প্রিয়াতমা নববধূ শৈলীরানী।
তিন.
হরিপদ কৈবর্ত মেয়ে শৈলীরানী আর মেয়েজামাই চন্দ্রমণিকে কৈবর্তসমাজের অতীত ইতিহাস
শোনাচ্ছিলেন। বিলাস রাজবংশীর নৌকায় তারা উত্তর পতেঙ্গা থেকে কৈবল্যধাম যাচ্ছিলেন। হরিপদ বলছিলেন,
বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান
সময় পর্যন্ত কৈবর্তরা সমাজে প্রান্তিকগোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচিত। বৈদিক সাহিত্য,
রামায়ণ, এমনকি মহাভারতে এর
উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘ব্রাত্য’ মানে যারা ব্রত থেকে চ্যুত বা ভ্রষ্ট। বর্তমান আধুনিক সমাজেও
এদের নিম্নবর্গ, হরিজন, দলিত, ছোটলোক ইত্যাদি বলে গালি পাড়ে অনেক শিক্ষিত সমাজের গোমূর্খের দল। প্রাচীন সাহিত্যে ব্রাত্য
বা অন্তজ শ্রেণী হিসেবে রজক, চর্মকার, নট, বরুড়, মেদ, ভিল্ল আর কৈবর্ত নামে মোট সাত শ্রেণীর ব্রাত্য বা অন্তজের সন্ধান
মেলে। সময় এবং অঞ্চলভেদে কৈবর্ত শ্রেণীর আবার অনেক নাম পাওয়া যায়। যেমন- মৎস্যঘাতী, মৎস্যজীবী, মাছধরা, জেলে, পাতর, ধীবর, রাজবংশী, কেওট, কৈবর্ত, দাস, মালো, মল্লবর্মণ,
গাবর, মেছো, মাউছ্যা, জাইল্যা, জলদাস ইত্যাদি ইত্যাদি। এ পর্যায়ে চন্দ্রমণি
শ্বশুর মহাশয়কে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বাবা, আমাদের এই কোণঠাসা অবস্থার জন্য আসলে কারা দায়ী?
মেয়েজামাই চন্দ্রমণির প্রশ্নের জবাবে শ্বশুর মহাশয় হরিপদ কৈবর্ত বললেন,
‘মনুসংহিতা’র বিধান মতে,
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্রের মধ্যে
শূদ্ররা হলো সবচেয়ে নিম্নগোষ্ঠী। ঋষি মনু একদা বলেছেন, ‘শূদ্র অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে না। উচ্চবর্ণের পথ দিয়ে
শূদ্র তাদের শবদেহ বহন করতে পারবে না। ব্রাহ্মণের নিন্দা করলে শূদ্রের জিহবা কেটে
নেওয়া যাবে। ব্রাহ্মণের সঙ্গে একসাথে বসলে শূদ্রের পাছায় লোহার ছেঁকা দিয়ে তাকে নির্বাসন করা
যাবে।’ এমন অনেক কঠিন কঠিন বিধান উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আগে পালন করত। মূলত, ক্ষমতা আর শাসনকাজ
নির্বিঘ্নে করতেই এভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সমাজকে চার শ্রেণীতে ভাগ করল। ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়ের
ছত্রচ্ছায়ায় যজ্ঞাযজ্ঞে আর ধর্মকর্মে পৌরহিত্য করতে লাগল। শাসনকার্যের দায়িত্ব
নিল ক্ষত্রিয়রা। শিল্পবাণিজ্য আর কৃষিকাজের দায়িত্ব পেল বৈশ্যরা। আর সব ধরনের কায়িক
পরিশ্রমের ভার অর্পণ করল শূদ্রদের ওপর। সেই হিসেবে ধর্মের দোহাই দিয়ে উচ্চবর্ণ হিন্দুরাই
আমাদের কোণঠাসার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।
আর এই চিত্র বালুখালি, উত্তর পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলি, খেজুরতলা, সলিমপুর, কুমিরা, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই- যেখানেই যাও, এখনো বর্তমান। এমনকি, কর্ণফুলী, মাতামুহুরী,
হালদা, সাংগু, এসব নদীর এপার-ওপারে
যেসব জেলেরা এখনো বসবাস করছে, সেখানেও একই অবস্থা। আমার ধারণা, শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতবর্ষে এখনো
কৈবর্তরা উচ্চবর্ণ হিন্দুদের কাছে আজও অচ্ছুৎ।
এতক্ষণ শৈলীরানী চুপচাপ বাবা আর স্বামীর কথোপকথন শুনছিল। এসব বড়দের কথা শৈলীরানী
একদম বুঝতে পারে না। সে বরং তার চেয়ে বয়সে একটু বড় নৌকার মাঝি বিলাসের সঙ্গে পুরোনো
বন্ধুত্বের খাতিরটা আরেকটু ঝালাই করে নিল। আচ্ছা বিলাস দা, তুমি বিয়া করবা কবে? বিলাস রাজবংশীর বাড়ি
হরিপদর বাড়ির খালের ঠিক উল্টো পারে। হরিপদ কৈবর্ত মেয়ে-জামাইকে আনতে বিলাসকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। বিলাস শৈলীরানীর কথায়
না হেসে পারল না। আঁই তো গড়ার চাই। মা-বাবা রাজি ন। বছর দুই যাউক। তারপর গড়ির... হে হে
হে...
আষাঢ়ের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এই আছে তো এই নেই। নৌকার খোলে অবশ্য একটা
ভাঙা ছাতা আছে। কিন্তু তা বের করার উপায়ও নেই। দক্ষিণা বাতাসে বিলাসের
নৌকা ঠিক রাখা তখন আরো কঠিন হয়ে যাবে। যে কারণে আষাঢ়ের হঠাৎ আসা এই দমকা গুঁড়ি
গুঁড়ি বৃষ্টিকে ওরা তেমন পাত্তাও দেয় না। বেলা দ্বিপ্রহর নাগাদ বিলাস হরিপদ কৈবর্তের
ঘাটে নৌকা ভেড়াতে সক্ষম হলো। শৈলীরানী সবার আগেই এক লাফে চিরচেনা সেই ঘাটে এমন লম্ফ দিল যে,
আরেকটু হলেই চন্দ্রমণি
নৌকা থেকে ছিটকে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস শ্বশুর মহাশয় হরিপদ কৈবর্ত চন্দ্রমণিকে ধরে রাখলেন।
চার.
যুধিষ্ঠির কৈবর্তের তিন বছরের ছোট সরলা দেবী। আর সরলা দেবীর আড়াই
বছরের ছোট সুলেখা দেবী। কিন্তু সুলেখার বিয়ে হয়েছিল সরলার চেয়ে তিন বছর আগে। সুলেখার দুই ছেলে অমল
আর বিমল। আর সরলার একমাত্র ছেলে সুবল। বড় মাসি সরলার বিয়ের সময় অমলের বয়স ছিল দেড় বছর। আর সুলেখা দেবী তখন
ছিল নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সরলার বিয়ের ঠিক কুড়ি দিন পর জন্ম হয় বিমলের। আর দুই বছর ঘুরে সরলার
ছেলে সুবলের জন্ম। পরপর এই নিয়ে তিন বছর দুই বোন সুলেখা আর সরলার ছেলেরা একমাত্র
মামা যুধিষ্ঠির কৈবর্তের কাছে সমুদ্রে মাছ ধরায় হাতেখড়ি নিল। এর মধ্যে অমল আর বিমলের
যখন হাতেখড়ি হয়, তখন ঘটা করে আলাদা আলাদা দুটি পাঁঠা বলি দেওয়া হয়েছিল। কারণ, সুলেখার অবস্থা অনেকটা
ভালো। এ বছর সুবলের হাতেখড়িতে আলাদা করে কোনো পাঁঠা বলি হলো না। কারণ, সরলার সেই অবস্থা নেই।
যুধিষ্ঠির কৈবর্ত সুবলকে একটু চুপচাপ দেখে বললেন, মা-মনসাপূজায় তোর নামে একটা পাঁঠা বলি দেব। সমুদ্রে জাল ফেলার
সময় মনে মনে মা-গঙ্গার নাম জপ করবি। আর জাল তোলার সময় মা-মনসার নাম জপ করবি। দেখবি বেশি মাছ উঠবে
জালে। সুবল তার পর থেকে অনেকটা স্বাভাবিক। কিন্তু আষাঢ়ের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে
সমুদ্র আজ ভারি রুদ্র। তাই সুবলকে আরো শক্ত করে বসার জন্য ফরমায়েশ করেন যুধিষ্ঠির কৈবর্ত। জাল ফেলা শেষ করে সুবলের
হাতে বইঠা দিয়ে আয়েশ করে তামুক খেলেন যুধিষ্ঠির। আষাঢ়ের এমন গুঁড়ি গুঁড়ি
বৃষ্টি আর উল্লাসী সমুদ্রনাচনে ইলিশের ঝাঁক ধরার অভিজ্ঞতা তার। মা-গঙ্গার কৃপা হলে
আজ অনেক ইলিশ ধরা পড়বে। মনে মনে একটু খুশি হয় যুধিষ্ঠির।
যদি বাতাস দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঘুঁটি পাকায় আর ভারী জোয়ার হয়, তাহলে আজ ইলিশ পাওয়ার
সম্ভাবনা বেশি। সমুদ্রের এই নানা রঙের ঢঙের সঙ্গে যুধিষ্ঠির খুব পরিচিত। পশ্চিম আকাশে শুকতারা
দেখা গেলেই জাল তোলা শুরু করবেন বলে মনে মনে স্থির করেন যুধিষ্ঠির। সুবলকে একটা জুতসই
ছবক দেওয়া শুরু করলেন যুধিষ্ঠির কৈবর্ত। সবকিছুই চব্বিশ ঘণ্টার হিসাব, বুঝলি সুবল?
চব্বিশ ঘণ্টায় এক দিন। এই এক দিনে মোট দুবার
জোয়ার হয় আর দুবার ভাটা।
এই জোয়ার-ভাটা নির্ভর করে চাঁদের ওপর। পুবাকাশে যখন চাঁদ উঠবে, তখন সমুদ্রে জোয়ার
শুরু হবে। চাঁদ যখন ঠিক মাথার ওপর থাকবে, তখন হবে পূর্ণ জোয়ার। আবার চাঁদ যখন পশ্চিমাকাশে হেলতে থাকবে,
তখন ধীরে ধীরে ভাটা
শুরু হবে। আর চাঁদ যখন আর পশ্চিম আকাশে দেখা যাবে না, তখন হয় পূর্ণ ভাটা। এরপর আবার জোয়ার শুরু
হবে। পূর্ণ জোয়ারের যতক্ষণ পর পূর্ণ ভাটা হলো, ঠিক ততক্ষণ পর আবার পূর্ণ জোয়ার হবে। তারপর আবার ভাটা শুরু
হবে। সেই ভাটা থেকে যখন আবার পূর্ণ ভাটা হয়ে জোয়ার শুরু হবে, তখনই আবার পুবাকাশে চাঁদ উঠবে। এই হিসাবটা সব সময়
মনে রাখবি। এ ছাড়া চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণের সময় সবচেয়ে বড় জোয়ার হয়। কারণ, তখন চাঁদ, সূর্য আর পৃথিবী এক
লাইনে থাকে। যাকে আমরা বলি ভরা কাটাল। এ ছাড়া চাঁদ, সূর্য আর পৃথিবী পরস্পর তিন কোণে বা সমকোণে অবস্থান করলে তখন
সমুদ্রের জল একদম কমে যায়। এটাকে আমরা বলি মরা কাটাল। মরা কাটালের সময় সমুদ্রে
নামা একেবারে বারণ।
এ ছাড়া অমাবস্যা আর পূর্ণিমার সময় বড় জোয়ার হয়। তখন মাছ ধরা পড়ে বেশি। বড় জোয়ারের সময় মাথা
ঠান্ডা রাখা খুব জরুরি। নইলে দিক ভুল হলে বহিঃসমুদ্রে ভেসে যাবার ভয় থাকে। আমি অবশ্য বাবার সঙ্গে
অনেকবারই বহিঃসমুদ্রে মাছ ধরতে গেছি। বহিঃসমুদ্রে না গেলে জীবনেও সমুদ্রের ধারণা বুঝবি না। পৃথিবীর তিনভাগ যে
জল, তা কেবল বোঝা যায় বহিঃসমুদ্রে
মাছ ধরার সময়। কিন্তু বহিঃসমুদ্রে যাবার একটা দোষ আছে। বহিঃসমুদ্রে একবার
মাছ ধরে যারা মজা পায়, তাদের আর এই কাছের সমুদ্রে মাছ ধরতে ইচ্ছে করে না।
কিন্তু বিপদ হয় যখন ঝড় ওঠে। তখন বহিঃসমুদ্র থেকে দ্রুত আর ফেরা যায় না। এ জন্য চন্দ্র,
সূর্য আর আকাশ যদি
ভালো করে বুঝতে না পারিস, তাহলে সমুদ্রে মাছ ধরা ভারি কঠিন কাজ। আর বহিঃসমুদ্রে তো
তা আরো কঠিন।
চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে কত সময় নেয় রে, সুবল? এতক্ষণ সুবল চুপচাপ মামার কথা শুনছিল। এবার মামার অমন সহজ
প্রশ্নে ফিক করে হাসি দিয়ে বলল, ত্রিশ দিন। যুধিষ্ঠির কৈবর্ত ভাগ্নের কথা শুনে মিটমিট করে হাসলেন। তোর জন্য খুব সহজ প্রশ্ন,
তাই না? শোন, চাঁদের এই হিসাবটা
তোদের বইপত্রে যেভাবে আছে, আমরা সেভাবে বুঝি না। আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যা বুঝি,
তা-ই শোন। সাত দিনে হলো সপ্তাহ। দুই সপ্তাহে হলো এক
পক্ষ। এই এক পক্ষ মানে হলো চাঁদের পক্ষ। চাঁদের পক্ষ কয়টি? জবাবে সুবল বলল, দুইটি।
- কী কী?
- কৃষ্ণপক্ষ আর শুকপক্ষ।
- হ্যাঁ, কৃষ্ণপক্ষ আর শুকপক্ষ। তাহলে দুই পক্ষ মিলে কয় সপ্তাহ হয়?
- চার সপ্তাহ।
- বুঝলাম, চার সপ্তাহ। তাহলে মোট কয় দিন হয়?
- ২৮ দিন।
- তাহলে চাঁদের হিসাবে আমরা পেলাম ২৮ দিন। আর তুই বইয়ের হিসাবে বললি, চাঁদের ৩০ দিন লাগে
পৃথিবী ঘুরতে! আসলে প্রকৃত হিসাবে চাঁদের পৃথিবী ঘুরতে পুরো ২৮ দিনও লাগে না। লাগে ২৭ দিন ৮ ঘণ্টার
মতো। মানে পৃথিবী একবার প্রদক্ষিণ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৮ দিনের চেয়ে অন্তত ১৬ ঘণ্টা
কম। চাঁদের এই পৃথিবী প্রদক্ষিণের কাঁটায় কাঁটায় হিসাবটা তোর ঠাকুরদা খুব ভালো জানত,
বুঝলি। আর অমাবস্যার ঠিক কত
সময় পর চাঁদ উঠবে, তা উনি প্রায় নির্ভুল বলে দিতে পারতেন। আগে পতেঙ্গার সবাই তোর ঠাকুরদার কথার ওপর
ভর করেই সমুদ্রে নামত। এখন তো কেউ সময়জ্ঞান মানে না। কলিযুগে আরো কত কিছু
দেখব, ভগবান!
পশ্চিম আকাশে শুকতারা উঠেছে। যুধিষ্ঠিররা তখন জাল তোলা শুরু করল। সুবল তখন আরো কিছু
নিয়মকানুন শিখে নিল মামার কাছ থেকে। কীভাবে মাছ জাল থেকে আবার নৌকার সঙ্গে বাঁধা টুকরো জালে রাখতে
হয়। কীভাবে জাল থেকে জালে মাছ হাঁটাতে হয়, সেটা একটা জুতসই টেকনিক বটে। সুবল প্রথম চেষ্টায়
একটি ইলিশকে টুকরো জালে আটকাতে পারেনি। দ্বিতীয় চেষ্টায় অবশ্য পেরেছে। কিন্তু টেকনিকটা এখনো
ঠিক ধরতে পারছে না। যুধিষ্ঠির সেই কৌশলটা সুবলকে বারবার ইলিশ ধরে দেখাতে লাগলেন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
থাকায় আজ ভালোই ইলিশ ধরা পড়ছে সবার জালে।
পাঁচ.
পাঁচ বছর পরের ঘটনা। শৈলীরানী ছেলেসন্তানের মা হয়েছে। চন্দ্রমণির বাবা যুধিষ্ঠির
কৈবর্ত নাতির নাম রেখেছেন অর্জুন। অর্জুন মণি কৈবর্ত। নাতি অর্জুনের সঙ্গে বেশ ভালোই সময় কাটে যুধিষ্ঠির
কৈবর্তের। আর অর্জুনের বাবা চন্দ্রমণি কৈবর্ত এখন সমুদ্রে ফুলটাইম মাছ ধরে। মাছ ধরার নেশায় পেয়েছে
চন্দ্রমণিকে। মাছ ধরতে ধরতে দুঃসাহসী চন্দ্রমণি ইদানীং বহিঃসমুদ্রেও চলে যায়। চন্দ্রমণি স্বপ্ন দেখে,
যে করেই হোক ছেলে অর্জুনকে
আর সমুদ্রমুখী করবে না। কৈবর্তসমাজের বদনাম ঘুচানোর জন্য যত কষ্টই হোক অর্জুনকে স্কুলে
দেবে। অর্জুন পড়াশোনা করবে। অর্জুন কৈবর্তসমাজের অন্ধকার আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম
করার জন্য একদিন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে বড় হবে। কৈবর্তসমাজকে শিক্ষামুখী
করার জন্য অর্জুন হবে নতুন আলোর দিশারি।
অর্জনের মা শৈলীরানীও চন্দ্রমণির সেই স্বপ্নে কষ্ট স্বীকার করতে রাজি। এমনিতে কৈবর্ত স্বামীরা
সমুদ্র থেকে খালি হাতে ফিরে কারণে-অকারণে স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলেন। শৈলীরানীও চন্দ্রমণির
হাতের সেই নির্মম আক্রোশের তাণ্ডবের শিকার হয়েছে। তবু অভাবের সংসারে
সবকিছু মেনে নিয়ে যে করেই হোক, অন্যদের মতো অর্জনকে আর জাল নিয়ে জলে নামতে দেবে না শৈলীরানী। বই হাতে অর্জুন স্কুলে
যাবে। অর্জুনের দেখাদেখি কৈবর্ত জেলেপল্লির অনেক ছেলেমেয়েও নিশ্চয়ই একদিন স্কুলে যাবে। শুধু জল আর জালের ওপর
জীবন বাজি রেখে জীবনের দুঃখ যে তাড়ানো যায় না, সেই কথাটি কৈবর্তসমাজে সবার অন্তরে ঢুকিয়ে
দেবার জন্য অর্জুন হবে স্কুলমুখী প্রথম ছাত্র। বড় হয়ে অর্জুন কৈবর্তসমাজকে
আলোর কান্ডারি হয়ে পথ দেখাবে। সে কথার সঙ্গে অর্জুনের নানাঠাকুর হরিপদ কৈবর্ত আর দাদাঠাকুর
যুধিষ্ঠির কৈবর্তও সুর মেলান।
এ কথা সত্য যে, কোনো একটা জায়গা থেকেই শুরুটা করতে হবে। আর সেই শুরুটা যদি অর্জুনকে দিয়ে হয়,
তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কোনো একটি পরিবার থেকেই
সেই শুরুটা হওয়া চাই। যুধিষ্ঠির কৈবর্তের অনেক ইচ্ছে ছিল চন্দ্রমণিকে স্কুলে দেবার। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের
সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারেননি। সেই সুপ্ত বাসনা যদি চন্দ্রমণির ছেলেকে দিয়ে পূরণ হয়,
তাহলে তৃপ্তি নিয়ে
পরকালের কথা ভাবতে পারব, এমনটি মনে করেন যুধিষ্ঠির কৈবর্ত। অর্জুনের দাদাঠাকুর,
যিনি দেড় বছর ধরে আর
সমুদ্রে যান না। শরীরে আর আগের মতো তাগদ নেই। চোখেও কম দেখেন। অবসর সময়ে অর্জুনের
সাথে কুস্তিগিরি আর অনেক খোশগল্প করে সময় কাটান। মাঝেমধ্যে অর্জুনের
নানাঠাকুর হরিপদ কৈবর্ত বেড়াতে এলে দুই বন্ধু মিলে জমিয়ে ভারি আড্ডা দেন। গল্পে গল্পে তারা ফিরে
যান যৌবনের সেই নির্ভীক দিনগুলোতে।
মাঝেমধ্যে চন্দ্রমণিকে বহিঃসমুদ্রে যেতে বারণ করেন বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্ত। জলবায়ু এখন আর আগের
মতো নেই। ঠিক সময়ে কারো বোঝার সাধ্য থাকে না, কখন ঝড় হবে আর কখন ঘূর্ণিঝড় পাকাবে। পূর্বঘোষণা ছাড়াই বাতাস
হঠাৎ দিক পাল্টায়। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার
চন্দ্রমণি বড় বড় ঝড়ের কবলে পড়েছে। শরীরে শক্তি আছে আর ভগবানের কৃপায় সেসব ঝড় থেকে চন্দ্রমণি নিজেকে
বাঁচাতে পেরেছে। তবু চন্দ্রমণি ঝুঁকি নিয়ে বহিঃসমুদ্রে যায়। না গিয়ে উপায় থাকে
না। মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফেরার দুঃখের চেয়ে বরং জীবন বাজি রেখে নাও ভরা মাছ নিয়ে
ফেরার মধ্যেই যে কৈবর্তের সুখ, রক্তে মিশে থাকা সেই আজন্ম জিনের পরম চরিত্র তবু চন্দ্রমণিকে
সেই অদৃশ্য নেশা থেকে ফেরাতে পারে না। মাছ ধরতে গেলেই কখন যে কিসের নেশায় কিসের
টানে কার ইশারায় মনের ভুলেই সেই দূর বহিঃসমুদ্রে চলে যায়, তা হয়তো চন্দ্রমণি নিজেও বুঝতে পারে না।
ওদিকে আকাশের রং বদল দেখে বাবা যুধিষ্ঠির কৈবর্ত আর স্ত্রী শৈলীরানী বারবার ভগবানের
নাম নেন। ভগবান রক্ষা করো। তোমার বাছাকে তুমি রক্ষা করো। মা আর দাদাঠাকুরের
সেই অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে ছোড়া রহস্যময় আহাজারি শুনে ছোট্ট অর্জুন তখন ফ্যালফ্যাল করে
সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো কিছু না বুঝেই বাব-বাব-বাব বলে আপন মনে কথা বলে। আকাশের রং বদলের সঙ্গে
কৈবর্তসমাজের এই নিত্য আহাজারি আর আতঙ্কের উচ্চ-ধ্বনি, বৈরী বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে মিলেমিশে শুধু
যুধিষ্ঠির কৈবর্ত আর শৈলীরানীর কণ্ঠে নয়, গোটা পতেঙ্গা, কৈবল্যধাম, হালিশহর, কাট্টলি, খেজুরতলা, সলিমপুর, কুমিরা, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই সমুদ্র উপকূলের কৈবর্ত ঘরে ঘরে আকাশ-বাতাস ভারী করে
এক অদ্ভুত অজানা শঙ্কার বিমূঢ় ঘোর তৈরি করে। যা দেশের অন্য কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর
কাছে কেবল দুর্বোধ্য হলেও একটা গভীর আতঙ্কের মধ্যে কৈবর্তসমাজ এভাবেই দিন কাটায়। আর এই জানা আতঙ্কের
হাজারো শঙ্কা মাথায় নিয়ে আবারো জীবন হাতে করেই চন্দ্রমণি কৈবর্তরা আবারো সমুদ্রে যায়। আর স্বপ্ন দেখে অর্জুনরা
একদিন জাল ফেলে বই হাতে নিয়ে স্কুলে যাবে।
অভাব আর কৈবর্তরা যেন-বা সমার্থক কোনো মাসতুতো ভাই। জীবনের দস্তখত দিয়েই
তারা সেই অভাব দূর করার নেশায় সারা জীবন সমুদ্রে গতর খাটেন। শরীরের শক্তি ফুরিয়ে
গেলে ধুঁকে ধুঁকে রোগ আর দুঃখের সঙ্গে সহবাস করেই শোকের মাধ্যমে যার অবসান ঘটে। শরীরের শক্তি নিঃশেষ
করে ছেলে চন্দ্রমণিকে নিয়ে অকারণে দুশ্চিন্তা করে করে যুধিষ্ঠির কৈবর্ত যেন ধীরে ধীরে
আরো কাবু হতে শুরু করলেন। নাকি বয়স বাড়ার সঙ্গে রোগের একটা মধুর সম্পর্ক রয়েছে যা এখন
অর্জুনের দাদাঠাকুর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তবু সমুদ্রের হু হু লাগা বাতাসের নির্বেদ
ভাষায় সেই দুঃখের কতটুকু আর চিকিৎসা করা যায়?
এভাবে মাস যায়, বছর যায়। কৈবর্তসমাজের সেই চিরায়ত জীবনসংগ্রামের কোনো বদল হয় না। তবু আশার কথা,
অর্জুন স্কুলে যায়। স্কুলের শিক্ষকেরা
অর্জুনকে খুব ভালোবাসে। অর্জুনও শিক্ষকদের মন জয় করে মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। অবসরে বাবা চন্দ্রমণিকে
জাল আর নৌকার নানান ফরমায়েশে সহায়তা করে। মা শৈলীরানীর বাজার করে দেয়। দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির
কৈবর্তের ওষুধ কিনে আনে। আর এভাবে সত্যি সত্যিই একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে অর্জুন এসএসসি
পাস করে। অর্জুন কলেজে ভর্তি হয়। চোখের সামনেই অর্জুন সবার উৎসাহ আর সহযোগিতায় একদিন এইচএসসি পাস করে। তারপর অর্জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হয়। সবার আশীর্বাদে তেইশ বছর বয়সে অর্জুন এমএ পাস করে।
তত দিনে অর্জুনের দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির কৈবর্ত বয়সের ভারে বিছানায় ধরাশায়ী। হাঁটাচলা করতে পারে
না। আর অর্জুনের নানাঠাকুর হরিপদ কৈবর্ত পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। মা শৈলীরানী অর্জুনের
বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেছেন। বাবা চন্দ্রমণি জল আর জাল নিয়ে তখনো সমুদ্রে এক অনিঃশেষ জীবনসংগ্রাম
চালিয়ে যাচ্ছেন। তার মধ্যেই অর্জুন বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে একটি সরকারি কলেজে
শিক্ষকতা করার গৌরব অর্জন করে। কক্সবাজার সরকারি কলেজে অর্জুনের নতুন জীবন শুরু হয়।
ওদিকে মা শৈলীরানী তত দিনে আরো তিন কন্যাসন্তানের মা। প্রভা, শোভা আর লোপাও স্কুলে
যায়। ছেলে অর্জুনের কাছে মা শৈলীরানী শোভাকে দিয়ে চিঠি লিখে খবর পাঠান যে, কৈবল্যধামে তার এক
দূরসম্পর্কের পিসির ননদের মেয়ের ঘরের মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়ের নাম দিপালী। দিপালী এবার এসএসসি
পরীক্ষা দেবে। ছুটি পেলে একবার যেন মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে অর্জুন দেখে যায়। মায়ের চিঠিতে অর্জুনের
ছুটি মেলেনি। কিন্তু কলেজের শীতকালীন ছুটিতে অর্জুন যখন পতেঙ্গার জেলেপাড়ার পিতৃমাটিতে একজন
আদর্শ কৈবর্ত হিসেবে প্রত্যাবর্তন করল, তার তিন দিনের মাথায় দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির কৈবর্ত ওপরের ডাক পেলেন।
যুধিষ্ঠির কৈবর্তের শ্রাদ্ধে কৈবল্যধাম থেকে অনেক মানুষ এসেছিল। সেই দলে শৈলীরানীর
সেই পিসির ননদের মেয়ের ঘরের মেয়ে দিপালীও ছিল। দিপালীকে অর্জুনেরও
ভালো লেগে গেল। তারপর সবার আলোচনায় ঠিক হলো যে, আগামী বছর ৩০ চৈত্র অর্জুন আর দিপালীর বিয়ে
হবে। এ বছর শাস্ত্রমতে বিয়ে হবার সুযোগ নেই। কারণ, অর্জুনের দাদাঠাকুর যুধিষ্ঠির কৈবর্ত এ বছর
মারা গেছেন। চন্দ্রমণির মনে মনে ইচ্ছে, ছেলে অর্জুনের বিয়েতে দাভার প্রচলনটি আর মানবেন না। তাই কনেপক্ষের কাছে
চন্দ্রমণি কৈবর্ত কোনো দাভার শর্তও দিলেন না। অর্জুন মণি কৈবর্তের
হাত ধরেই হয়তো কৈবর্তসমাজ নতুন এক সংস্কারের দিকে রওনা হলো। এমনটি মনে করেই চন্দ্রমণি
কৈবর্ত ভারি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা দিলেন, আজ আমি এক গর্বিত কৈবর্ত পিতা। আর শৈলীরানীকে বললেন,
তুমি একজন গর্বিত কৈবর্ত
মা। অর্জুন আমাদের কৈবর্তসমাজেরই এক গৌরব। ওরে কে আছিস, পঞ্চবাদক দল খবর দে। আজ আমরা সবাই মিলে
নাচব। সেই খবরে কৃষ্ণ বৈরাগীর ছেলে পঞ্চানন বৈরাগীর পঞ্চবাদক দল এসে চন্দ্রমণির উঠানে
বাদ্য বাজাতে শুরু করল। একটু পরই বর অর্জুন মণি কৈবর্ত বরযাত্রী নিয়ে কৈবল্যধামে কনের
বাড়িতে রওনা হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩
বারিধারা, ঢাকা
লেখক পরিচিত
রেজা ঘটক
জন্ম: ২১ এপ্রিল ১৯৭০ (৮ বৈশাখ ১৩৭৭), উত্তর বানিয়ারী, নাজিরপুর, পিরোজপুর, বাংলাদেশ।
পড়াশুনা: অর্থনীতি শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও মাস্টার্স।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
ছোটগল্প: বুনো বলেশ্বরী, ছোটগল্প সংকলন, ২০০৮। সোনার কঙ্কাল, ছোটগল্প সংকলন, ২০১০। সাধুসংঘ, ছোটগল্প সংকলন, ২০১১ । ভূমিপুত্র, ছোটগল্প সংকলন, ২০১৩
উপন্যাস: মা, ২০১২।
সমালোচনা: শূন্য দশমিক শূন্য, ২০১১।
কিশোর গল্প: বয়োঃসন্ধিকাল, ২০০৫।
শিশুতোষ: ময়নার বয়স তেরো, ২০০৩। গপ্পো টপ্পো না সত্যি, ২০১১
0 মন্তব্যসমূহ