মণিকা চক্রবর্তী : আমার গল্পগ্রন্থটি, বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরি , ২০১৩-এ বাংলা একাডেমী বইমেলায় ‘শুদ্ধস্বর’
থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গল্পগ্রন্থে মোট
বারোটি গল্প রয়েছে। সব কটি গল্পই এর আগে কালেরকন্ঠ, সংবাদ, ইদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। বারোটি গল্পের মধ্যে
‘স্বপ্নে মেঘের নূপুর’
গল্পটি আমার কাছে সেরা
বলে মনে হয়। যদিও অনেকে ‘ব্লু মুন’ ‘ কন্টাক্ট লেন্স’ও ‘গান্ধারীর তৃতীয় চু’কে ভালো গল্প বলে মনে
করেন।
গল্পপাঠ :২.গল্পটির বীজ কিভাবে পেয়েছিলেন?
মণিকা চক্রবর্তী : ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে জগৎ ও জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী সমান্তরাল একটি সম্পর্ক যা কেবল টানাপোড়েন
তৈরি করে। সত্তা নিজেকে জানার জন্য অপর সত্তার দর্পণে নিজেকে দেখতে চায় এবং নিজের বিভাজিত
সত্তাকেও অবশেষে উপলব্ধি করে। ব্যক্তিমানুষের মধ্যে
রয়েছে আলো-অন্ধকার মিশ্রিত মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা । এই আলো-অন্ধকারের পারস্পরিক
বিরোধিতা সমান্তরালভাবে চলতে থাকে এবং সমাধানহীন
সমাধান খোঁজে। গল্পের বীজ হিসেবে এই বিষয়টি পেয়েছিলাম। হয়তো নিজের হৃদয় খুঁড়েই
পেয়েছিলাম এর বীজ।
গল্পপাঠ :৩.গল্পের বীজটির বিস্তার কীভাবে ঘটল? শুরুতে কি থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছেন?
না কাহিনি,
কাঠামো বা প্লট নিয়ে
ভেবেছেন?
মণিকা চক্রবর্তী : ‘স্বপ্নে মেঘের নূপুর’ গল্পের বিস্তারে অনেক গভীরে ছায়া বিস্তার করেছে জীবনের নানা
ভাবনা। প্রথমে বিস্তৃত হয়েছে নারীচেতনা এবং প্রেমিকসত্তার তীব্র স্বপ্নভাঙার বেদনা। কাঙ্খিত নারীর কাছ থেকে প্রেমিকসত্তাটি
প্রতারিত হয়েও তার হৃদয়ে প্রেমের স্নিগ্ধতাকে সে হারিয়ে যেতে দিতে চায়নি। নিজ হৃদয়ে প্রেম,
শান্তি আর স্থিরতাকে
নিবিড়ভাবে লালন করতে চেয়েছে। ঘৃণা ও বিদ্বেষের পথকে সে পরিহার করেছে হৃদয়ে অবস্থিত এক শুভবোধের
টানে। যে বিষয়টি প্রথমে এসেছে তা হল, কাঙ্খিত মানুষের কাছ থেকে তীব্র প্রত্যাখান, এরপর প্রেমিকসত্তাটি
কতটা জটিলতায় আক্রান্ত হয়? পরবর্তীকালে সৌন্দর্য ও স্থিতির আশ্রয় হিসেবে সে হৃদয়ে প্রেমকে
ধারণ করতে পারে কি না? এই গল্পটির ক্ষেত্রে প্রথমেই বিষয়বস্তু এসেছে। পরে একে কাহিনিতে রূপান্তরিত
করেছি। আমার বেশিরভাগ গল্পেই প্রথমে থিম নিয়ে ভেবেছি। পরে সেটি কাহিনি হিসেবে
প্রসারিত হয়েছে।
গল্পপাঠ :৪.গল্পটির চরিত্রগুলো কীভাবে এসেছে? শুরুতে কতটি চরিত্র এসেছিল? তারা কি শেষ পর্যন্ত
থেকেছে? আপনি কি বিশেষ কোনো চরিত্রকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন? তাদের মধ্যে কি আপনার
নিজের চেনাজানা কোনো চরিত্র এসেছে? অথবা নিজে কি কোনো চরিত্রের মধ্যে চলে এসেছেন?
মণিকা চক্রবর্তী : এ গল্পের কাহিনিতে আছে একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যুবক যার নাম সিকান্দর। শহুরে জীবনের প্রতিনিয়ত
লোডশেডিংয়ের আক্রমণে অসহনীয় গরমে রাতের বিছানা ছেড়ে গভীর ঘুম ভেঙে হঠাৎ জেগে ওঠা এক যুবক। স্বাভাবিক ঘুম হয়নি
বলে তার চারপাশে থেমে থাকা অদ্ভুত ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে নিজের ভেতরের প্রেম
আর স্বপ্নগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। তার পুরানো প্রেমের স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকে কোহিনূর নামের এক নারী,
যার প্রত্যাখ্যান তাকে
বিপন্ন করে। তবু সময়ের সাথে জড়িয়ে থাকা এসব অপমান, প্রতারণা আর দীর্ঘশ্বাসের মাঝে খেই হারিয়ে ফেলা যুবকটি একসময়
নিজেকে গুছিয়ে নেয়, নিজেরই বুকের ভেতর। গল্পটির প্রথম অংশে প্রত্যাখ্যাত যুবকটি
ঘৃণা ও বিদ্বেষের পথ পরিহার করে জীবনের চলমানতার পথে থাকে। এবং নিজের অন্তর্নিহিত
চেতনার ভেতর প্রেমের সৌরভকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রথম অংশে আমি দেখাতে চেয়েছি একটি প্রেমহীন
জীবন ঘৃণার মধ্যে বসবাস করতে পারে না। প্রেমহীনতা মহাজাগতিক ব্যালান্সকে নষ্ট করে।
গল্পের দ্বিতীয় অংশে যুবকটি অন্ধকারের ভেতর আরও অন্ধকারকে উপলব্ধি করে। নিজের ভেতরে এক আত্মদ্বন্দ্বের
অসহায়তায় আক্রান্ত হয়। আলো-অন্ধকার মিশ্রিত মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়। সে মধ্যরাতে জানালার
ভেতর দিয়ে সামনের ফ্যাটের এক অসাধারণ সুন্দর নারীশরীরকে আবিষ্কার করে। প্রতিরাতে সেই নারীটিকে
নিবিড়ভাবে দেখতে দেখতে সেই দৃশ্য তার মগজে স্থায়ীভাবে বোনা হয়ে যায়। প্রতিরাতে এই দৃশ্যটির
জন্য সে অপো করে আর দেখার পর নিজেকে নির্লজ্জ, নষ্ট মানুষ মনে হয়। একদিকে পুরানো প্রেম,
প্রেমের স্মৃতি আর
অন্যদিকে এই নষ্টামী তার ভেতর নিঃসীম নিঃসহায়তা তৈরি করে। ভালো-খারাপের সীমার
অস্পষ্টতা নিয়ে সে নিজের ভেতর ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে।
গল্পটির শেষ অংশে যুবকটি একদিন সেই সুন্দরী মেয়েটিকে জানালা দিয়ে আত্মহত্যা করতে
দ্যাখে। কিন্তু তার কিছু করার থাকে না। আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানুষ অনেকটাই মানবিকভাবে অসহায় ।
ফ্লাটকেন্দ্রিক শহুরে শৃঙ্খলিত জীবনে নিয়মের আনুগত্যের কারণে প্রত্যেকের চারপাশে এক
অদ্ভুত দেয়াল। ইচ্ছে করলেই এ দেয়াল ভাঙা যায়না। এ গল্পে ব্যক্তি মানুষটি
তার অবচেতনের আলো-অন্ধকার দ্বারা যেমন আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি আক্রান্ত হয়েছে মানবিক তাড়না দ্বারা। এখানে সিকান্দর চরিত্রটিই
প্রধান চরিত্র, যেখানে স্বাভাবিক জীবনের ভেতর অস্বাভাবিক জীবনের রহস্যময়তা ভর করে। সিকান্দর তার চারপাশের
জগৎকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চাইলেও সে ব্যর্থ হয়। এই চরিত্র প্রতিটি
মানুষের মধ্যেই আছে বলে আমার মনে হয়।
গল্পপাঠ :৫.এই গল্পগুলোর দ্বন্দ্ব সংঘাত কিভাবে নির্মাণ করেছেন?
মণিকা চক্রবর্তী : নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি, এবং শেষের দৃশ্যটি অতি বাস্তবতা। শেষের দৃশ্যটির অনুরূপ
অভিজ্ঞতা পাশাপাশি অ্যাপার্টম্যান্টগুলোতে নিয়মিত চোখ রাখলেই দেখা যায়। একবার এক কিশোর ছেলেকে
বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া করে বড় সনি টিভি আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলতে দেখেছি। তারপর ভীষণ রকমের হাতাহাতির
দৃশ্য। আমার মনে হচ্ছিল ছেলেটি তখনই মারা যাবে। চিৎকার শুনছি, দেখছি, কিন্তু কিছুই করার নেই।
গল্পপাঠ :৬.গল্পের পরিণতি নিয়ে কি আগেই ভেবে রেখেছিলেন?
মণিকা চক্রবর্তী : এ গল্পটিতে প্রেম, জীবন, অবচেতন, মৃত্যু সবকিছুকেই জীবনের প্রবহমানতায় আনা হয়েছে। মানুষ দংশিত হচ্ছে
ভালো-মন্দের ক্রমিক দ্বন্দ্ব দ্বারা। মানুষ ভালোবাসার নীড়ে পৌঁছার চেষ্টা করছে বারবার আর রহস্যঘন
আক্রমণে ব্যর্থ হচ্ছে। পরিণতিটি বোধহয় আগেই ভেবে রেখেছিলাম।
গল্পপাঠ :৭.গল্পটি কদিন ধরে লিখেছেন? এবং এর ভাষাভঙ্গিতে কি ধরনের শৈলী ব্যবহার
করেছেন?
মণিকা চক্রবর্তী : গল্পটি লিখতে একমাস সময় লেগেছে। আমি খুব অল্প লিখি, তবে নিয়মিত লেখার টেবিলে বসার চেষ্টা করি। আমার সব গল্পই আয়তনে
ছোট। অল্প কথার মধ্যে দিয়ে অনেক বেশি বিষয়কে ধরার চেষ্টা করেছি। খুব ঝরঝরে সোজা সাপটা
গদ্য আমার আসে না। লেখাগুলোতে চিত্রকল্প এসে যায়, এবং তাতে প্রকৃত অনুভবটি তুলে ধরার চেষ্টা
করি।
গল্পপাঠ :৮.গল্পটিতে কি কিছু বলতে চেয়েছেন?
মণিকা চক্রবর্তী : অবশ্যই গল্পটিতে কিছু বক্তব্য আছে। শুধু এই গল্পটিই নয়, আমার সব গল্প ও উপন্যাসের
ভেতরেই সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে। মানুষের জীবন দুঃখময়, তবু মানুষ নিজেকে ভালোবাসায় বাঁচিয়ে রাখতে
চায়, প্রাত্যহিক জীবনকে
সাজিয়ে-গুছিয়ে তুলতে চায়। মৃত্যুর ভয়াবহতা চলমানতার ছন্দে বাধা দেয়। এই দোলাচলের ভেতরেই
মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকে।
গল্পপাঠ : ৯ .গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন? আপনি কি মনে করেন আপনি
যা লিখতে চেয়েছিলেন, তা লিখতে পেরেছিলেন এই গল্পটিতে?
মণিকা চক্রবর্তী : গল্পটি লেখার পর আমার কিছুটা ভালো লেগেছে। তবে এ-ও মনে হয়েছে,
গল্পটি বোধহয় আরও ভালো
হতে পারত। নারীচেতনা, অবচেতনের আর্তি, মৃত্যুর ভয়াবহতা, আধুনিক সমাজের অস্থিরতা, সবকিছুই ব্যক্ত হয়েছে অল্পমাত্রায়। এর সম্মিলিত মর্মার্থ
পাঠকের কাছে কতটা পৌঁছেছে সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।
গল্পপাঠ :১০. এ গল্পটি পাঠক কেন পছন্দ করে বলে আপনার মনে হয়?
মণিকা চক্রবর্তী : আমার লেখা এই গল্পটি আমপাঠক তেমনভাবে পছন্দ করেনি। বরং দুজন লেখক আমার
এই গল্পটিকে একটি ভালো গল্প বলে চিহ্নিত করেছে।
লেখক পরিচিতি
মণিকা চক্রবর্তীর জন্ম কুমিল্লায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
স্নাতকোত্তর। লেখালেখি করছেন দীর্ঘকাল
ধরে। মূলত
গল্প ও উপন্যাস লিখে থাকেন।
প্রথম উপন্যাস অতঃপর নিজের কাছে প্রকাশিত হয় ২০১০
সালে, একুশে বইমেলায়। দ্বিতীয় উপন্যাসটি,
দিগন্ত ঢেউয়ের ওপারে, ২০১১ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। গল্পগ্রন্থ
বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে।
লেখালেখির বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে সংগীতচর্চা তাঁর
অন্যতম সংরাগ।
0 মন্তব্যসমূহ