এ’টা কোনও মন্তব্য না যে লোকেরা ফিসফিসিয়ে কানে কানে অথবা মন্ত্রপাঠের মতো বিড়বিড়িয়ে অথবা জনসভায় বক্তৃতা পাঠের মতো চিল্লিয়ে বলত বলেই ঘটনাটা ঘটে। তারা বলত, ছেরির মেলা বাড় বাড়ছে। ফাক গজাইছে। হে আগুনে পুড়বোই। তবু তারা সেই পাঠের অপরাধবোধে অনুশোচনায় ভোগে। যদিও ঘটনার পর থেকে ৫৭ দিন পর্যন্ত তারা স্বস্থির নিঃশ্বাসে বুক উঁচিয়ে গর্বভরে ভাবে, এমন যে ঘটবে তা তাদের জানাই ছিল।
এইসব লোকের ভিড়ে আমিও গোয়েন্দা অথবা বিজ্ঞ অথবা একেবারেই সাধারণ হয়ে ঢুকে পড়ি। তখন ভাবি, মেয়েটি যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল তাতে গ্রামে অথবা মফস্বলে একটা অঘটন ঘটতই। এবং তখন স্মৃতিতাড়িত হই যখন লোকেরা তাকে স্মরণ করে। আর তারা এই প্রেক্ষাপটে স্মরণ করে, যখন তারা স্কুল অথবা কলেজগামী কোনও কালো রঙের মেয়েকে অটোরিক্সায় অথবা পায়ে হেঁটে যেতে দেখে। তখন তারা বলে, ছেরিডা রেখার মতোন কাইল্যা। আর যখন বিশাল দেহী কোনও মেয়ের দেখা পায় তখন বলে, ছেড়িডা রেখার মতোন আত্তি (হাতি)। কিন্তু যেহেতু আমাদের শহরকে মফস্বল বলা হয়, তার ওপর যেহেতু আমরা মফস্বলের একেবারে লেজের দিকে বাস করি, তাই জিন্স প্যান্ট আর গেঞ্জি পরিহিত কোনও মেয়েকে সচরাচর দেখি না। আর দেখি না বৃহৎ স্তনযোগলযোগে ওড়নাবিহীন কোনও মেয়ে যে কি-না মাংসল নিতম্বে ঝংকার তুলে হাঁটে। তবে রইছুদ্দী-আহেদালী-মজনু-হানিফ প্রমুখের চা-এর দোকানে সিডিতে যখন বাংলা সিনেমার নায়িকাদের নৃত্য চলে তখন লোকেরা রেখার কথা পুনরায় মনে করে। আর আমি স্মরণ করি লোকেরা যা বলে, তারা বলে সকালে যখন সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে, আর বলে যখন বিকেলে সূর্যের তেজ কমতে থাকে আর যখন রাতে সূর্যের আলো থাকে না এবং লোকেরা ঘরে ফিরতে থাকে, যাতে ঘরে পৌঁছা অবধি শরীরে রেখার স্মৃতি উত্তেজনায় মেখে থাকে। তারা খিলপাড়া বাজারে হাইওয়ের দু’পাশে রইছুদ্দী-আহেদালী-মজনু-হানিফ প্রমুখের চা-এর দোকানে এইসব কথা অথবা স্মৃতি আওড়াতে থাকে।
রইছুদ্দী’র দোকানেই আলোচনা-সমালোচনার ফিরিস্তি ওঠে বেশি। কেননা তার দোকানেই অধিক লোকারণ্য। যদিও তার মেজাজ-মর্জি দারুণ খিটখিটে। কথা বলে চিল্লিয়ে আর রাখঢাক না রেখে। আর তার চোখ দুটো সন্ধ্যায় গর্তে পড়ে যাওয়া লাল মার্বেলের মতো। ক্ষণে-ক্ষণে তার কাঁচা-পাকা দাড়িতে চার আঙুল ডুবিয়ে হনুমানের মতো মুখ ভেঙচিয়ে ওঠে। তবু লোকে বলে চা-এ তার হাত ভালো। গরম পানিতে এক চামচ চিনির সাথে চা-পাতি মিশিয়ে ঘোঁট দিলেই সকলের স্বাদে ঝরঝরে হয়ে ওঠে। তখন লক্ষ্মী খদ্দেরের মনে পেঁচা মালিকের অশালীনতার কোনও অভিযোগ থাকে না। তারা সিডি দেখায় মনোযোগ দেয়। সেখানে বাংলাদেশি নায়িকাদের স্থুল কোমড়ের দোল দেখে খিস্তি আওড়ে ওঠে, ইস্ রে, রেখার ফুটকিডার মতো রে!
ঘটনার তিনদিন পর সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে অথবা কমতে থাকে অথবা থাকে না আর লোকজন বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে থাকে। রইছুদ্দী তার হনুমান মুখ ভেঙিয়ে ওঠে। দ্বাদশী ছেলে এনামুলের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, এনামুইল্যা বান্দির পুত গ্যাছোস কই? তারপর এনামুল চুইংগাম চিবুতে চিবুতে ফিরে এলে রইছুদ্দী হাত উঁচিয়ে তেড়ে আসে কিন্তু গায়ে হাত তুলে না। বরং পুনরায় মুখ ভেঙিয়ে বলে, তোর বাপেরা রে চা দিবো ক্যালা?
লোকেরা পিতা-পুত্রের কীর্তিকলাপকে সিডিতে ভাদাইম্যার কৌতুক দেখার মতো গোপনে উপভোগ করে আর ঠোঁট টিপে হাসে। তারপর চা-এ শব্দ করে চুমুক দিতে দিতে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক সূত্র ধরে রেখার স্মৃতিপাত করে। বলে, ছেরিডা তার ছিড়া আছিন না। সব ছিল হের ভঙ। আমি হেরে নগুয়ার এক বাসা থাইক্যা বাইর হইতে দেখছি। অন্য কেউ বলে, আমি হেরে রাইতের বেলা আনসার ক্যাম্প থাইক্যা বাইর হইতে দেখছি। তহন পেছনে এক আনসাররে দেখছি হাসতে হাসতে হেরে আগাইয়া দিতে। আবার অন্য একজন ময়লা লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে তুলে তার বাম হাত আরেকটু গভীরে ঢুকিয়ে চুলকাতে চুলকাতে বলে, আমি হেরে হাইঞ্জার পরে আড়ো ঘাটের পুলের ওপর তিনডা চ্যাংড়া ছেরার সাথে দাঁত বাইর কইরা আলাপ করতে দেখছি।
এইসব আলাপ-প্রলাপের মাঝে রইছুদ্দী তার হনুমান মুখ ঢুকিয়ে বলে, তোমরার মুখে এই বালের আলাপ ছাড়া আর কোনো কথা নাই?
লোকেরা চুপ মারে। তারা টিনচাল থেকে ভরা বালতিতে বৃষ্টির পানি পড়ার মতো শব্দ তুলে চা-এ চুমুক লাগায়। কিন্তু আহেদালী-মজনু-হানিফ প্রমুখ অতোটা কঠিন না হওয়ায় তাদের দোকানে এইরূপ আলোচনা চলতেই থাকে। অর্থাৎ তারা যেন রেখাকে ভাসমান পতিতা হিসেবে প্রমাণ করার দালালি নেয়। কিন্তু অতোটা নাও হতে পারে। যেহেতু তারা ইত্যাকার প্রলাপের পরে রঙচটা-রঙধরা-কালো চিটচিটে দাঁত খেলিয়ে হেসে ওঠে। তখন মনে হতে পারে লোকেরা এই প্রেক্ষাপট থেকে মজা লওয়ার চেষ্টায় নিগূঢ় থাকে।
কালক্রমে আমিও তাদের আলোচনায় ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করি। তারপর লক্ষ করি কী এক ভুলের ভেতর আমি ডুবে গেছি। হঠাৎ একদিন বুঝতে পারি রেখা আমার ওপর চেপে বসেছে। আমি এই ভূত নামাতে পারি না অথবা কী এক মোহে তা চাই না। প্রথম চুমুকের পর চা-এর দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমি ক্রমাগত আমার ভুলের মাশুল দিতে থাকি। কেননা তখন কিছুদিন রেখা নানাভাবে আমার দৃষ্টিসীমায় হানা দেয়। আমি বিব্রত হই, বিহ্বল হই, চোখ ঘষি, মাথায় পানি ঢালি, কিন্তু রেখা আমার দৃষ্টি ছাড়ে না। তখন আমার দীর্ঘদিন তেলহীন বাইসাইকেলে গরু গাড়ির শব্দ তুলে একরামপুর যাওয়ার সময় রেখাকে নগুয়ার একটা বাসা থেকে বের হতে দেখি। ওই পথে পুনরায় সাইকেলে প্যাডেল মারার কালে তখন রেখাকে আনসার ক্যাম্পে এক জওয়ান আনসারের সাথে খুনসুটি করতে দেখি। আবার যখন সন্ধ্যাবেলা নদীপাড় ঘেঁষে হাঁটি তখন তাকে তিনটা চ্যাংড়া ছেলের সাথে দাঁত বের করে হাসতে দেখি।
শুধু কি তাই? রথখোলা যাওয়ার পথে যখন তাদের কালো-মোটা একগাদা পোলাপান ভর্তি বাড়িতে অগোচরে চোখ পড়ে তখন নদীমুখো একচালা ঘরের খিড়কিমুখে তাকে তার কালো চোখে কালো কাজল মাখতে দেখি। সে আয়না আর খিড়কির ফাঁক গলে একগাল হাসে আর তৎক্ষণাৎ চোখ মারে। এমনকি সে কিছুদিন আমার স্বপ্নসীমায়ও হানা দেয়। সেখানে ঈশ্বরগঞ্জ থেকে চিরকাল মেয়েলোলুপ শ্যামল আসে। গালকাটা ফর্সা শ্যামল। কাটাদাগ বাদ দিলে সে রমণীমোহন পুরুষ। নতুন জেলখানা মোড়ে সে বাস থেকে নামে। তারপর ৫০ গজ পশ্চিমে আমার দোকানে এসে টুল টেনে বসে। তখন অলস বিকেলে রৌদ্রতাপ কমে আসে। কিন্তু তেজদীপ্ত পায়ে আর বৃহৎ নিতম্বে লোলুপ ঝংকার তুলে রেখা বাজারে ঢোকে। তাকে দেখে বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণ না দেখার ভাণ করে নিজ কাজে অধিক মনোযোগী হয়। তবু রেখা ক্ষণে ক্ষণে বাচ্চা বয়সীদের দু’বাহুতে তার সুঠাম হাত রেখে মাথা অবধি তুলে আবার নিচে নামিয়ে রাখে। এবং বাচ্চারা পালাতে গিয়েও তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এবং বুড়োরা একটু দূরে দূরে সরে থাকার ব্যর্থ চেষ্টায় মশগুল হয়। কেননা রেখা ক্রমাগত তাদের জড়িয়ে ধরে। কিন্তু বাড়ন্ত কিশোর কিংবা যুবক বয়সীদের দ্বার ঘেঁষে না। সিদ্দিক মিয়ার রিকশাওয়ালা ছেলে রফিক তাকে ছুঁ’তে গেলে সে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে আর খিস্তি আওড়াতে থাকে, ঘুষকির পুত তোর মা রে গিয়া ধরতে পারস না?
শ্যামল মদখোরের মতো ঝিম ধরে এইসব আকণ্ঠ পান করে। তারপর তার দ্বারা যা সম্ভব তা উচ্চারণ করে। বলে, মাগির রেইট কতো রে?
আমি স্বপ্নের ভেতর অযাচিত চমকে উঠি। তারপর মনে পড়ে সে যে মানসিকতা বহন করে তাতে এমন বলতেই পারে। তখন খুব সহজ কণ্ঠে বলি, আরে নাহ্। তার ছিড়া মেয়ে।
শ্যামলের চোখে মুখে কুটিল হাসি ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে অভিজ্ঞতার অহংবোধ স্পষ্ট। আমি বুঝে যাই সে কী বলবে এবং আমার প্রায় জানা কথাটাই সে পুনরাবৃত্তি করে। বলে, পাছা ঘোরানো দেখে বুঝস না? মাইর না পড়লে ছেইরান এমুন করে হাঁটে না। আমি ময়মনসিংহ অনেক দেখছি। এইসব আমার ভালা রহম চেনা।
এইসব ব্যাপার যে তার ভালো চেনা তা আমি জানি। কিন্তু সে আমার জানাকে উপেক্ষা করে আমার স্বপ্নের পরিধি বেয়ে রেখার দিকে এগুতে থাকে। আমি তাকে ধরতে গিয়ে হোচট খাই। তারপর স্বপ্ন থেকে বাস্তবে নেমে শরীর টান করে চোখ কচলাই। আর নাকে মুখে কাঁথা চেপে ধরে পুনরায় স্বপ্নের ভেতর তলিয়ে যেতে থাকি।
তারপর এইভাবে ক্রমাগত দিন-রাত অতিক্রমের পর একদিন রেখাকে আর কোথাও দেখি না। তখন শরীর-মন বেশ সাবলীল আর ঝরঝরে লাগে। কিন্তু ততোদিনে খিলপাড়া বাজারের লোকেরা রেখার অভাববোধে বিমর্ষ হতে থাকে। কারণ তারা যেহেতু কারোর শীতল স্পর্শ পায় না অথবা নির্বিঘেœ কাজ-কর্ম করতে পারে তাই সকলে এখন একঘেঁয়ে রোগে ভোগে। তারা তখন চা-এর দোকান ছাড়াও কাজলের মুদির দোকান, কুদ্দুছের মুদির দোকান, ওয়াসিমের ইলেকট্রিক দোকান, হরিপদের সেলুন, হুমায়ুনের ফার্মেসি এমনকি আমার স্টুডিওতে তাদের শূন্যতার ব্যাখ্যা করে। তারা বলে, দুইন্যার মধ্যে ভালা খারাপ সবকিছুর দরকার আছে। রেখা নাই বাজারটা কেমুন মরা খলার মতো লাগে।
তারপর একদিন শুনতে পাই হুমায়ুনের ওপর রেখা তার ছায়া ফেলে। রাত্রিবেলায় যখন সে ফার্মেসি বন্ধ করার প্রস্তুতি নিতে থাকে তখন হাইওয়ের ওপাশের জঙ্গল থেকে কেবল সালোয়ার আর বৃহৎ বুকে ব্রা পরিহিত রেখা এসে তার সম্মুখে দাঁড়ায়। ঝাঁকুনি দিয়ে শরীরে নানা প্রকার ঢেউ তুলে ডেস্কে চাপড় দিয়ে ওঠে। ভয়ার্ত হুমায়ুন চোখ তুললে রেখা নিচের ঠোঁটে কামড় চেপে চোখ টিপে। তারপর সে জঙ্গলের ভেতর হাওয়া হয়ে যায়। এই কথা শুনে বাজার কমিটির সভাপতি, পাকা দাঁড়িওয়ালা কুদ্দুছ পানচিটচিটে দাঁত খেলিয়ে হেসে ওঠে। কিন্তু পরদিন কুদ্দুছের কথায় আমরা রেখার সংশ্লিষ্টতা পাই। অর্থাৎ দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার পথে শাহাবুদ্দীনের পোল্ট্রি ফার্মের সামনে রেখা তাকে জড়িয়ে ধরতে শুনি। এই কথা শুনে প্রত্যেকে তাদের অভিব্যক্তি নিজেদের ভেতর অনিচ্ছাকৃত চেপে রাখে। কিন্তু তার ফলে তারা কেউ রেখার কালো ছায়ার সীমানা অতিক্রম করে থাকতে পারে না। ক্রমে সে প্রত্যেকের মন-মনন-শরীরে হানা দিতে থাকে। তবে রিকশাওয়ালা রফিক ও তার টমটমওয়ালা বন্ধুরা তাদের বিছানা, নির্মাণরত জেলখানার নির্জনে অথবা ঝাটাশিরা মাদ্রাসার ভেতর সুনসান জায়গায় রেখার উপস্থিতি কামনা করেও তার দেখা পায় না। আমি কৌতুহলবশত ঈশ্বরগঞ্জে শ্যামলের কাছে ফোন করে জানতে পারি, একটা স্বাস্থ্যবতী কালো মেয়ে তাকে কামোদ্দীপক তাড়া করে কিন্তু ধরা দেয় না। আমি তখন লাইন কেটে দিয়ে নিজের অনুভূতিকে চেপে রাখি। কিন্তু বাজারের লোকজন রেখার ক্রমাগত ছায়াপাতে অতিষ্ঠ আর বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তারপর কুদ্দুছের সভাপতিত্বে বাজার কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে একটা অভিশাপ বাজারে নেমে এসেছে। একমাত্র কোনও বুজুর্গ ব্যক্তিই এই অভিশম্পাত থেকে বাজারবাসীদের রক্ষা করতে পারে। তারপর তারা দল বেধে আউলিয়াপাড়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হেলাল উদ্দিনের শরণাপন্ন হয়। সমস্ত ফিরিস্তি শুনে তিনি বাম বাহুতে বাধার জন্য তাবিজ প্রতি ১০০ টাকার বিনিময়ে ২৩টি তাবিজ আর বাজারের চার কোণায় মাটিতে পুতে রাখার জন্য তাবিজ প্রতি ২০০ টাকার বিনিময়ে চারটি তাবিজ মোট ৩১০০ টাকার বিনিময়ে ২৭টি তাবিজ বাজার কমিটির কাছে হস্তান্তর করেন। তারপর বিনা পয়সায় এক মগ পড়া পানি দিয়ে বলেন যেন বেশি পানির সাথে মিশিয়ে সারা বাজারে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তারা যখন তাবিজ আর পড়া পানি নিয়ে ফিরে আসতে উদ্যোগী হয় তখন মাওলানা সকলকে পাঞ্জেগানা কায়েম করার পরামর্শ দেন। এই কথা শুনে হরিপদ বিমর্ষ ও বিহ্বল হয়। কুদ্দুছ তখন বলে, হুজুর হে বাজারে নাপিতের কাম করে। নাম হরিপদ। হিন্দু বেডা পাঞ্জেগানা কায়েম করবো ক্যামনে?
হুজুর তখন মুখভর্তি দাড়িতে বুরো ক্ষেতে নিড়ানি দেয়ার মতো আঙুল খেলিয়ে বলেন, ইচ্ছা থাকলে পাঞ্জেগানা হ¹লেই কায়েম করতে পারে। না পারলে হরিপদ নিজ ধর্মে কর্মে মনোযোগ দিতে পারে।
তারপর ফিরে এসে সকলে কালো তাগা দিয়ে বাম বাহুতে তাবিজ বেধে নেয়। কেবল আমারটা শ্যামলের জন্য ড্রয়ারে ফেলে রেখে স্টুডিওর কাজে মনোনিবেশ করি। তখন বাজারে উৎসবমুখর পরিবেশের উদয় হয়। লক্ষ করা যায় স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী আর বাজারবাসীদের ভেতর একটা নীল রঙের বড় ড্রাম বাচ্চাদের বিয়ারিং গাড়ির শব্দ তুলে এগিয়ে যায়। জাহাঙ্গীরের কাছে জানা যায়, হুজুরের পড়া পানির মগ ড্রামের আকার ধারণ করেছে। চৌরাস্তার মোড় থেকে শুরু করে তখন প্রত্যেক দোকানে এক মগ পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তারপর উত্তরে ঝাটাশিরা মাদ্রাসার সামনে, দক্ষিণে মেহের মাস্টারের বাড়ির সামনে, পূর্বে চৌরাস্তার মোড় আর পশ্চিমে আলতাফ মেম্বরের ভাঙারি দোকানের পেছনে চারটি তাবিজ মাটিতে পুতে দেয়া হয়। তখন থেকে লক্ষ করা যায়, বাজার মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হয় না। তাই ঝাটাশিরা প্রবেশ পথে কেউ কেউ গামছা অথবা চট বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর সন্ধ্যার পর থেকে কিছুদিন হরিপদকে তার সেলুনে দেখা যায় না। শোনা যায় মেথরপট্টির পেছনে আর সুবোধ বাবুর বাসার সামনে লোকনাথ মন্দিরে সে সাধন ভজনে নিমগ্ন হয়।
রেখার দৃষ্টিসীমার ভেতর এইসব ধর্মকর্মের দিন অতিবাহিত হতে থাকে। অর্থাৎ রাত্রিবেলা হোসেনপুর হাইওয়েতে, পাঠানকান্দি ঢোকার মুখে, খিলপাড়ার ভেতরে ঢুকতে আর বিলপাড়ের রাস্তার মুখে সে অর্ধনগ্ন হয়ে বাজারবাসীর চক্ষুগোচর হয়। অর্থাৎ তাদের ৩১০০ টাকার তাবিজ আর বাধ্যগতদের মতো কড়জোরে প্রার্থনা বিফলে যায়। ফলে তখন খিলপাড়া বাজারের দোকানগুলোতে বহিরাগতদের সমাগম কমে এলে বাজার কমিটি পুনরায় নড়েচড়ে উঠে। বাজারের ইমেজ রক্ষা আর নিজেদের অস্বস্তির ব্যাপারে তারা অধিক সচেতন হয়। কিন্ত পুন পুনঃ মিটিং ডেকেও বাজার কমিটি কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে সকলে বিমর্ষ আর শঙ্কিত হয়ে বাড়ি ফেরে। এবং যেন নিয়তির ক্রমধারায় তারা পুনরায় আক্রান্ত হয়।
এরূপকালে আমি শ্যামলের কাছে ফোন করলে তার কুণ্ঠিত কণ্ঠ শুনতে পাই। সে বলে যে তার জুয়েলারি শপ সন্ধ্যা হতেই তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপর ঈশ্বরগঞ্জ কালিবাড়িতে সে রাত ন’টা অবধি ঠাকুরসেবায় নিয়োজিত হয়। কিন্তু রাত ১০টার দিকে সে যখন বাড়ির সম্মুখে আসে তখন স্বাস্থ্যবতী এক কালোছায়া তার পথরোধ করে। প্রথম প্রথম স্পর্শলাভের প্রত্যাশা করে ব্যর্থ হলে এখন ভয়ে ঘর্মাক্ত হয়। কী এক সূত্র ধরে এই ঘটনা জানাজানি হলে সে লজ্জাস্কর পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়ে। কেননা লোকেরা তাকে ইঙ্গিত করে তখন তামাশায় মশগুল হয়। কিন্তু ক্রমাগত এই তামাশা মহামারি আকারে শঙ্কায় পরিণত হতে থাকে। কেননা তারা, মানে লোকেরা যারা হাসি-ঠাট্টায় নিজেদের মাঝে বিনোদন তৈরি করেছিল তারা ক্রমে ক্রমে স্বাস্থ্যবতী কালো ছায়া দ্বারা দৃশ্যতঃ আক্রান্ত হতে থাকে। তখন তারা দলে দলে কালীবাড়ি আর মসজিদে পুণ্যার্থীদের দল ভারি করতে থাকে। কিন্তু এইসব প্রার্থনা তাদের কাছে নিরর্থক মনে হতে থাকে যখন ফের এক-ই দৃশ্যের ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি ঘটে।
তখন খিলপাড়া বাজার কমিটি পুনরায় মাওলানা হেলাল উদ্দিনের শরণাগত হয়। তার কেরামতি তাবিজ আর পড়া পানি বিফলে যাওয়ার কথা শুনে তিনি অপরাধ আর লজ্জাবোধ করেন। তারপর পূর্বের ৩১০০ টাকার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে বিনা পয়সায় একটা পরামর্শ দেন। কিন্তু পাঞ্জেগানা কায়েমের কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। তখন বাজার কমিটি ফিরে এসে হুজুরের পরামর্শানুসারে বাজারের ঠিক মাঝখানে আক্কাছ আলীর কাঁচামালের দোকান আপাতত তুলে নেয়। তারপর সেখানে আটটি খুঁটি পুতে তার উপর একটা বড় সামিয়ানা টাঙিয়ে নিচে ছালার চট রেখে তাতে বিছানার চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়। এবং হুজুরের পরামর্শমত ঝাটাশিরা হাফিজিয়া মাদ্রাসার পুরাতন আর নতুন ছাত্রদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন তারা ১০ জন করে পাঁচ ভাগে গোলাকারে বিভক্ত হয়। এবং প্রত্যেকে হাঁটু গেড়ে বসে বাতাসে সুপারি বৃক্ষের মতো দোল খেতে খেতে জালালি খতম পাঠ করে। খতম শেষে সেই নীল রঙের বড় ড্রামে একে একে পঞ্চাশ জনের প্রত্যেকে ফুঁ দিয়ে মসজিদের কলের পানিকে পড়া পানির রূপ দেয়। তারপর বাচ্চাদের বিয়ারিং গাড়ির উপর তুলে দড়ি দিয়ে গরুর মতো টেনে নিয়ে যাওয়া হয় আলতাফ মেম্বরের দোকানের পেছনে। সেখান থেকে চৌরাস্তার মোড় অবধি প্রত্যেক দোকানে এক মগ করে পড়া পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এবং পরিত্যক্ত খড় দিয়ে একটা মূর্তি বানিয়ে তাতে ছাই মেখে কালো করা হয়। সূর্যের তেজ কমে আসার সময় যখন পশ্চিমাকাশে রইছউদ্দী’র চোখের মতো লাল রঙ ধারণ করতে শুরু করে তখন বাজার জুড়ে ব্যাপক লোকের সমাগম ঘটে। তাদের সকলের সামনে কুদ্দুছ দেশলাই দিয়ে মূর্তিটির পায়ে আগুন ধরিয়ে দিলে খুব দ্রুত সেই আগুন মাথা অবধি পৌঁছে মূর্তিটি ছাই হয়ে যায়। তারপর অবশিষ্ট পড়া পানি দিয়ে ছাইচাপা জায়গাটুকু ধুয়ে তার ওপর হোসেনপুর ঘেঁষা ব্রক্ষপুত্র থেকে আসা বালি ছিটিয়ে দেয়া হয়। সেদিন লোকেরা সন্ধ্যার কিছু পরেই ভারমুক্ত শরীর-মন নিয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু লোকেরা ফের বিমর্ষ হয় যখন তারা দেখে যে তাদের সকল আয়োজন বিফলে যায়। অর্থাৎ তারা রেখা কর্তৃক পুনরায় আক্রান্ত হতে থাকে। কিন্তু তারপর এক অযাচিত ঘটনা ঘটে। আহেদালী তার চা’র দোকান বন্ধ করে যখন বাড়ির পথ ধরে এবং সে যখন তাদের পুকুরপাড়ের শেওড়া গাছের তলায় আসে তখন নিয়তির ফেরে অর্ধনগ্ন রেখার মুখোমুখি হয়। আর সে তখন সারা শরীরে বৃষ্টিভেজা শেওড়া গাছের মতো স্যাঁতসেঁতে আর কবুতরের বাচ্চার মতো কম্পন অনুভব করে। সে দারুণ অসহায় হয়ে পড়ে এবং তখন কী মনে করে রেখার পা বরাবর সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। এবং তার সম্পর্কে কুটিল মন্তব্য পুষনের অপরাধের দায় স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চায়।
পরবর্তী সাতদিন রেখামুক্ত হয়ে আহেদালী ফুরফুরে মনে তার দোকানকার্য চালিয়ে যায়। তারপর সে যখন তার মুক্তির কাহিনি প্রকাশ করে তখন তা বাতাসের মতো দ্রুত সকলের শরীরে আছড়ে পড়ে। এবং সকলে আহেদালী’র মুক্তির ফর্মুলা নিয়ে রেখা কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সময় এক-ই কায়দায় সেজদায় লুটিয়ে পড়ে আর ক্ষমা ভিক্ষা চায়। এবং মোবাইল মারফত শ্যামল ও শ্যামল কর্তৃক তার সতীর্থ আর প্রতিবেশিরা এই ফর্মুলা গ্রহণ করে এবং তার ফলে তারা সকলে মুক্তি লাভ করে।
বাজারের লোকেরা তখন তাদের বিগত দিনের ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে, কিন্তু তখন তার জন্য তারা কোনও আফসোস করে না। তবে তারা এই কথা স্মরণ করে যে, রেখার পরিণতির কথা তাদের জানাই ছিল।
অর্থাৎ এক মাস সাতাশ দিন তথা ৫৭ দিন আগে এক মেঘার্দ্র সকালে বাজারে অধিক লোকের সমাগম ঘটে। তারা প্রত্যেকে নিজেদের মুখের দিকে তাকিয়ে পরস্পর প্রশ্ন করে যে, রেখার কি হইছে? জমায়েত সকলেই প্রশ্নকর্তা হলেও ততোক্ষণে উত্তর দেয়ার জন্য একজনকে পাওয়া যায়। তিনি রেখার মধ্যবয়সী পিতা ছমেদ আলী। তার থুতুনিতে ছাগলের মতো একমুঠো মেহেদীরাঙা দাড়ি তখন চোখের পানিতে জবজবে হয়ে আছে। তিনি বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে বলেন, সব আমার কফাল। নাইলে এমুন আত্তির মতো ছেরি রাইতবিরাতে ফথে ঘাটে ঘুরে?
তিনি যা বলেন তাতে আমরা বুঝতে পারি যে, গতরাত দশটা’র দিকে রেখা আনসার ক্যাম্পের সামনে ধীরে চলমান এক টমটমে লাফ দিয়ে চড়ে বসে। ছমেদ আলীর মতে হয়তো ইচ্ছে করেই অথবা সে খেয়াল করেনি যে সেই টমটমে গুটি কয়েক রিকশাওয়ালা অথবা এই জাতীয় কিছু যুবক ছিল। তারপর ছমেদ আলী বলে না, কিন্তু আমরা আন্দাজ করি হয়তো বনিবনা হয়নি বলে যুবকেরা অথবা রেখা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এবং যখন চৌরাস্তার মোড়ে টমটম না থামিয়ে বরং আরও দ্রুত গতিতে খিলপাড়া বাজার অতিক্রম করে রইছুদ্দী’র বাড়ির সামনে অবধি চলে যায় তখন হয়তো উত্তেজিত যুবকেরা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় অথবা উত্তেজিত রেখা প্রশমিত হয়ে ভয় পেয়ে নিজেই লাফিয়ে পড়ে। তারপর রইছুদ্দী ভোর বেলা তার দুধেলা গাভিকে শিশির ভেজা ঘাস খাওয়ানোর নিমিত্তে হাইওয়ের পাশে নিয়ে এলে কংক্রিটের ওপর শুকিয়ে থাকা রেখার রক্তাভ মুখ দেখতে পায়। প্রথমে বিশেষ ঠাহর করতে না পারলেও সে যখন হাতে থাকা লাঠি দিয়ে গুতো দেয় এবং যখন রেখার কোনও নড়াচড়া টের পায় না তখন সে ষাঁড়ের মতো চিৎকার দিয়ে ওঠে। আর লোকেরা এসে রেখার অন্তিম পরিণতি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ লাভ করে।
তখন নতুন একদল মানুষ বাজারে এসে ভিড় করে আর এটা ওটা প্রশ্ন করার কালে বেগুনী রঙের পুলিশের গাড়ি গিয়ে থামে মুখথুবড়ে পড়ে থাকা রেখার লাশের পাশে। আর তখন পিঁপড়ের মতো সারিবদ্ধ উৎসুক মানুষ এসে সেখানে জড়ো হয়। হোসেনপুর থেকে আসা গাড়িগুলো তখন প্যাড়াভাঙ্গা পর্যন্ত এসে থেমে যেতে যেতে চরপুমদি পর্যন্ত জ্যাম বাধিয়ে ফেলে। কিন্তু ছমেদ আলীর পিতৃত্বের হাহাকারের সাথে রেখার লাশ পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে গেলে মানুষগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আর জ্যাম ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তবে লোকেরা যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, এমুন যে অইবো এইডা আমরার জানাই আছিন।
এই ঘটনার ৫৭ দিন পর পর্যন্ত লোকেরা রেখা কর্তৃক নানারূপে আক্রান্ত হয়ে অতঃপর মুক্তি লাভ করে। আর ৫৯ দিন পর আজ আর কেউ এইসব কথা মনে করতে চায় না। কে আর অভিশম্পাতে ফিরে যেতে চায়? তখন লোকেরা রেখা নামের কেউ কখনও ছিল না জেনে রেখে শ্মশানের মতো হা করে থাকা সুনসান আমাদের দোকানগুলোর সামনে নিত্য জড়ো হতে থাকে। তখন আমরা কর্মদিবস শেষে আমাদের সংসার আর সন্তানদের নিকট সানন্দে ফিরে যাই।
কিন্তু দু’বছর পর ঠিক এক-ই জায়গায় অনুরূপ একটা মেয়েকে ভোর বেলায় লোকেরা অনুরূপ মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে, আর পুনরায় তারা নতুন কোনও অভিশম্পাতের শঙ্কায় শঙ্কিত হতে থাকে।
২০১৩
এইসব লোকের ভিড়ে আমিও গোয়েন্দা অথবা বিজ্ঞ অথবা একেবারেই সাধারণ হয়ে ঢুকে পড়ি। তখন ভাবি, মেয়েটি যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল তাতে গ্রামে অথবা মফস্বলে একটা অঘটন ঘটতই। এবং তখন স্মৃতিতাড়িত হই যখন লোকেরা তাকে স্মরণ করে। আর তারা এই প্রেক্ষাপটে স্মরণ করে, যখন তারা স্কুল অথবা কলেজগামী কোনও কালো রঙের মেয়েকে অটোরিক্সায় অথবা পায়ে হেঁটে যেতে দেখে। তখন তারা বলে, ছেরিডা রেখার মতোন কাইল্যা। আর যখন বিশাল দেহী কোনও মেয়ের দেখা পায় তখন বলে, ছেড়িডা রেখার মতোন আত্তি (হাতি)। কিন্তু যেহেতু আমাদের শহরকে মফস্বল বলা হয়, তার ওপর যেহেতু আমরা মফস্বলের একেবারে লেজের দিকে বাস করি, তাই জিন্স প্যান্ট আর গেঞ্জি পরিহিত কোনও মেয়েকে সচরাচর দেখি না। আর দেখি না বৃহৎ স্তনযোগলযোগে ওড়নাবিহীন কোনও মেয়ে যে কি-না মাংসল নিতম্বে ঝংকার তুলে হাঁটে। তবে রইছুদ্দী-আহেদালী-মজনু-হানিফ প্রমুখের চা-এর দোকানে সিডিতে যখন বাংলা সিনেমার নায়িকাদের নৃত্য চলে তখন লোকেরা রেখার কথা পুনরায় মনে করে। আর আমি স্মরণ করি লোকেরা যা বলে, তারা বলে সকালে যখন সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে, আর বলে যখন বিকেলে সূর্যের তেজ কমতে থাকে আর যখন রাতে সূর্যের আলো থাকে না এবং লোকেরা ঘরে ফিরতে থাকে, যাতে ঘরে পৌঁছা অবধি শরীরে রেখার স্মৃতি উত্তেজনায় মেখে থাকে। তারা খিলপাড়া বাজারে হাইওয়ের দু’পাশে রইছুদ্দী-আহেদালী-মজনু-হানিফ প্রমুখের চা-এর দোকানে এইসব কথা অথবা স্মৃতি আওড়াতে থাকে।
রইছুদ্দী’র দোকানেই আলোচনা-সমালোচনার ফিরিস্তি ওঠে বেশি। কেননা তার দোকানেই অধিক লোকারণ্য। যদিও তার মেজাজ-মর্জি দারুণ খিটখিটে। কথা বলে চিল্লিয়ে আর রাখঢাক না রেখে। আর তার চোখ দুটো সন্ধ্যায় গর্তে পড়ে যাওয়া লাল মার্বেলের মতো। ক্ষণে-ক্ষণে তার কাঁচা-পাকা দাড়িতে চার আঙুল ডুবিয়ে হনুমানের মতো মুখ ভেঙচিয়ে ওঠে। তবু লোকে বলে চা-এ তার হাত ভালো। গরম পানিতে এক চামচ চিনির সাথে চা-পাতি মিশিয়ে ঘোঁট দিলেই সকলের স্বাদে ঝরঝরে হয়ে ওঠে। তখন লক্ষ্মী খদ্দেরের মনে পেঁচা মালিকের অশালীনতার কোনও অভিযোগ থাকে না। তারা সিডি দেখায় মনোযোগ দেয়। সেখানে বাংলাদেশি নায়িকাদের স্থুল কোমড়ের দোল দেখে খিস্তি আওড়ে ওঠে, ইস্ রে, রেখার ফুটকিডার মতো রে!
ঘটনার তিনদিন পর সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে অথবা কমতে থাকে অথবা থাকে না আর লোকজন বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে থাকে। রইছুদ্দী তার হনুমান মুখ ভেঙিয়ে ওঠে। দ্বাদশী ছেলে এনামুলের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, এনামুইল্যা বান্দির পুত গ্যাছোস কই? তারপর এনামুল চুইংগাম চিবুতে চিবুতে ফিরে এলে রইছুদ্দী হাত উঁচিয়ে তেড়ে আসে কিন্তু গায়ে হাত তুলে না। বরং পুনরায় মুখ ভেঙিয়ে বলে, তোর বাপেরা রে চা দিবো ক্যালা?
লোকেরা পিতা-পুত্রের কীর্তিকলাপকে সিডিতে ভাদাইম্যার কৌতুক দেখার মতো গোপনে উপভোগ করে আর ঠোঁট টিপে হাসে। তারপর চা-এ শব্দ করে চুমুক দিতে দিতে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক সূত্র ধরে রেখার স্মৃতিপাত করে। বলে, ছেরিডা তার ছিড়া আছিন না। সব ছিল হের ভঙ। আমি হেরে নগুয়ার এক বাসা থাইক্যা বাইর হইতে দেখছি। অন্য কেউ বলে, আমি হেরে রাইতের বেলা আনসার ক্যাম্প থাইক্যা বাইর হইতে দেখছি। তহন পেছনে এক আনসাররে দেখছি হাসতে হাসতে হেরে আগাইয়া দিতে। আবার অন্য একজন ময়লা লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে তুলে তার বাম হাত আরেকটু গভীরে ঢুকিয়ে চুলকাতে চুলকাতে বলে, আমি হেরে হাইঞ্জার পরে আড়ো ঘাটের পুলের ওপর তিনডা চ্যাংড়া ছেরার সাথে দাঁত বাইর কইরা আলাপ করতে দেখছি।
এইসব আলাপ-প্রলাপের মাঝে রইছুদ্দী তার হনুমান মুখ ঢুকিয়ে বলে, তোমরার মুখে এই বালের আলাপ ছাড়া আর কোনো কথা নাই?
লোকেরা চুপ মারে। তারা টিনচাল থেকে ভরা বালতিতে বৃষ্টির পানি পড়ার মতো শব্দ তুলে চা-এ চুমুক লাগায়। কিন্তু আহেদালী-মজনু-হানিফ প্রমুখ অতোটা কঠিন না হওয়ায় তাদের দোকানে এইরূপ আলোচনা চলতেই থাকে। অর্থাৎ তারা যেন রেখাকে ভাসমান পতিতা হিসেবে প্রমাণ করার দালালি নেয়। কিন্তু অতোটা নাও হতে পারে। যেহেতু তারা ইত্যাকার প্রলাপের পরে রঙচটা-রঙধরা-কালো চিটচিটে দাঁত খেলিয়ে হেসে ওঠে। তখন মনে হতে পারে লোকেরা এই প্রেক্ষাপট থেকে মজা লওয়ার চেষ্টায় নিগূঢ় থাকে।
কালক্রমে আমিও তাদের আলোচনায় ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করি। তারপর লক্ষ করি কী এক ভুলের ভেতর আমি ডুবে গেছি। হঠাৎ একদিন বুঝতে পারি রেখা আমার ওপর চেপে বসেছে। আমি এই ভূত নামাতে পারি না অথবা কী এক মোহে তা চাই না। প্রথম চুমুকের পর চা-এর দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমি ক্রমাগত আমার ভুলের মাশুল দিতে থাকি। কেননা তখন কিছুদিন রেখা নানাভাবে আমার দৃষ্টিসীমায় হানা দেয়। আমি বিব্রত হই, বিহ্বল হই, চোখ ঘষি, মাথায় পানি ঢালি, কিন্তু রেখা আমার দৃষ্টি ছাড়ে না। তখন আমার দীর্ঘদিন তেলহীন বাইসাইকেলে গরু গাড়ির শব্দ তুলে একরামপুর যাওয়ার সময় রেখাকে নগুয়ার একটা বাসা থেকে বের হতে দেখি। ওই পথে পুনরায় সাইকেলে প্যাডেল মারার কালে তখন রেখাকে আনসার ক্যাম্পে এক জওয়ান আনসারের সাথে খুনসুটি করতে দেখি। আবার যখন সন্ধ্যাবেলা নদীপাড় ঘেঁষে হাঁটি তখন তাকে তিনটা চ্যাংড়া ছেলের সাথে দাঁত বের করে হাসতে দেখি।
শুধু কি তাই? রথখোলা যাওয়ার পথে যখন তাদের কালো-মোটা একগাদা পোলাপান ভর্তি বাড়িতে অগোচরে চোখ পড়ে তখন নদীমুখো একচালা ঘরের খিড়কিমুখে তাকে তার কালো চোখে কালো কাজল মাখতে দেখি। সে আয়না আর খিড়কির ফাঁক গলে একগাল হাসে আর তৎক্ষণাৎ চোখ মারে। এমনকি সে কিছুদিন আমার স্বপ্নসীমায়ও হানা দেয়। সেখানে ঈশ্বরগঞ্জ থেকে চিরকাল মেয়েলোলুপ শ্যামল আসে। গালকাটা ফর্সা শ্যামল। কাটাদাগ বাদ দিলে সে রমণীমোহন পুরুষ। নতুন জেলখানা মোড়ে সে বাস থেকে নামে। তারপর ৫০ গজ পশ্চিমে আমার দোকানে এসে টুল টেনে বসে। তখন অলস বিকেলে রৌদ্রতাপ কমে আসে। কিন্তু তেজদীপ্ত পায়ে আর বৃহৎ নিতম্বে লোলুপ ঝংকার তুলে রেখা বাজারে ঢোকে। তাকে দেখে বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণ না দেখার ভাণ করে নিজ কাজে অধিক মনোযোগী হয়। তবু রেখা ক্ষণে ক্ষণে বাচ্চা বয়সীদের দু’বাহুতে তার সুঠাম হাত রেখে মাথা অবধি তুলে আবার নিচে নামিয়ে রাখে। এবং বাচ্চারা পালাতে গিয়েও তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এবং বুড়োরা একটু দূরে দূরে সরে থাকার ব্যর্থ চেষ্টায় মশগুল হয়। কেননা রেখা ক্রমাগত তাদের জড়িয়ে ধরে। কিন্তু বাড়ন্ত কিশোর কিংবা যুবক বয়সীদের দ্বার ঘেঁষে না। সিদ্দিক মিয়ার রিকশাওয়ালা ছেলে রফিক তাকে ছুঁ’তে গেলে সে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে আর খিস্তি আওড়াতে থাকে, ঘুষকির পুত তোর মা রে গিয়া ধরতে পারস না?
শ্যামল মদখোরের মতো ঝিম ধরে এইসব আকণ্ঠ পান করে। তারপর তার দ্বারা যা সম্ভব তা উচ্চারণ করে। বলে, মাগির রেইট কতো রে?
আমি স্বপ্নের ভেতর অযাচিত চমকে উঠি। তারপর মনে পড়ে সে যে মানসিকতা বহন করে তাতে এমন বলতেই পারে। তখন খুব সহজ কণ্ঠে বলি, আরে নাহ্। তার ছিড়া মেয়ে।
শ্যামলের চোখে মুখে কুটিল হাসি ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে অভিজ্ঞতার অহংবোধ স্পষ্ট। আমি বুঝে যাই সে কী বলবে এবং আমার প্রায় জানা কথাটাই সে পুনরাবৃত্তি করে। বলে, পাছা ঘোরানো দেখে বুঝস না? মাইর না পড়লে ছেইরান এমুন করে হাঁটে না। আমি ময়মনসিংহ অনেক দেখছি। এইসব আমার ভালা রহম চেনা।
এইসব ব্যাপার যে তার ভালো চেনা তা আমি জানি। কিন্তু সে আমার জানাকে উপেক্ষা করে আমার স্বপ্নের পরিধি বেয়ে রেখার দিকে এগুতে থাকে। আমি তাকে ধরতে গিয়ে হোচট খাই। তারপর স্বপ্ন থেকে বাস্তবে নেমে শরীর টান করে চোখ কচলাই। আর নাকে মুখে কাঁথা চেপে ধরে পুনরায় স্বপ্নের ভেতর তলিয়ে যেতে থাকি।
তারপর এইভাবে ক্রমাগত দিন-রাত অতিক্রমের পর একদিন রেখাকে আর কোথাও দেখি না। তখন শরীর-মন বেশ সাবলীল আর ঝরঝরে লাগে। কিন্তু ততোদিনে খিলপাড়া বাজারের লোকেরা রেখার অভাববোধে বিমর্ষ হতে থাকে। কারণ তারা যেহেতু কারোর শীতল স্পর্শ পায় না অথবা নির্বিঘেœ কাজ-কর্ম করতে পারে তাই সকলে এখন একঘেঁয়ে রোগে ভোগে। তারা তখন চা-এর দোকান ছাড়াও কাজলের মুদির দোকান, কুদ্দুছের মুদির দোকান, ওয়াসিমের ইলেকট্রিক দোকান, হরিপদের সেলুন, হুমায়ুনের ফার্মেসি এমনকি আমার স্টুডিওতে তাদের শূন্যতার ব্যাখ্যা করে। তারা বলে, দুইন্যার মধ্যে ভালা খারাপ সবকিছুর দরকার আছে। রেখা নাই বাজারটা কেমুন মরা খলার মতো লাগে।
তারপর একদিন শুনতে পাই হুমায়ুনের ওপর রেখা তার ছায়া ফেলে। রাত্রিবেলায় যখন সে ফার্মেসি বন্ধ করার প্রস্তুতি নিতে থাকে তখন হাইওয়ের ওপাশের জঙ্গল থেকে কেবল সালোয়ার আর বৃহৎ বুকে ব্রা পরিহিত রেখা এসে তার সম্মুখে দাঁড়ায়। ঝাঁকুনি দিয়ে শরীরে নানা প্রকার ঢেউ তুলে ডেস্কে চাপড় দিয়ে ওঠে। ভয়ার্ত হুমায়ুন চোখ তুললে রেখা নিচের ঠোঁটে কামড় চেপে চোখ টিপে। তারপর সে জঙ্গলের ভেতর হাওয়া হয়ে যায়। এই কথা শুনে বাজার কমিটির সভাপতি, পাকা দাঁড়িওয়ালা কুদ্দুছ পানচিটচিটে দাঁত খেলিয়ে হেসে ওঠে। কিন্তু পরদিন কুদ্দুছের কথায় আমরা রেখার সংশ্লিষ্টতা পাই। অর্থাৎ দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার পথে শাহাবুদ্দীনের পোল্ট্রি ফার্মের সামনে রেখা তাকে জড়িয়ে ধরতে শুনি। এই কথা শুনে প্রত্যেকে তাদের অভিব্যক্তি নিজেদের ভেতর অনিচ্ছাকৃত চেপে রাখে। কিন্তু তার ফলে তারা কেউ রেখার কালো ছায়ার সীমানা অতিক্রম করে থাকতে পারে না। ক্রমে সে প্রত্যেকের মন-মনন-শরীরে হানা দিতে থাকে। তবে রিকশাওয়ালা রফিক ও তার টমটমওয়ালা বন্ধুরা তাদের বিছানা, নির্মাণরত জেলখানার নির্জনে অথবা ঝাটাশিরা মাদ্রাসার ভেতর সুনসান জায়গায় রেখার উপস্থিতি কামনা করেও তার দেখা পায় না। আমি কৌতুহলবশত ঈশ্বরগঞ্জে শ্যামলের কাছে ফোন করে জানতে পারি, একটা স্বাস্থ্যবতী কালো মেয়ে তাকে কামোদ্দীপক তাড়া করে কিন্তু ধরা দেয় না। আমি তখন লাইন কেটে দিয়ে নিজের অনুভূতিকে চেপে রাখি। কিন্তু বাজারের লোকজন রেখার ক্রমাগত ছায়াপাতে অতিষ্ঠ আর বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তারপর কুদ্দুছের সভাপতিত্বে বাজার কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে একটা অভিশাপ বাজারে নেমে এসেছে। একমাত্র কোনও বুজুর্গ ব্যক্তিই এই অভিশম্পাত থেকে বাজারবাসীদের রক্ষা করতে পারে। তারপর তারা দল বেধে আউলিয়াপাড়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হেলাল উদ্দিনের শরণাপন্ন হয়। সমস্ত ফিরিস্তি শুনে তিনি বাম বাহুতে বাধার জন্য তাবিজ প্রতি ১০০ টাকার বিনিময়ে ২৩টি তাবিজ আর বাজারের চার কোণায় মাটিতে পুতে রাখার জন্য তাবিজ প্রতি ২০০ টাকার বিনিময়ে চারটি তাবিজ মোট ৩১০০ টাকার বিনিময়ে ২৭টি তাবিজ বাজার কমিটির কাছে হস্তান্তর করেন। তারপর বিনা পয়সায় এক মগ পড়া পানি দিয়ে বলেন যেন বেশি পানির সাথে মিশিয়ে সারা বাজারে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তারা যখন তাবিজ আর পড়া পানি নিয়ে ফিরে আসতে উদ্যোগী হয় তখন মাওলানা সকলকে পাঞ্জেগানা কায়েম করার পরামর্শ দেন। এই কথা শুনে হরিপদ বিমর্ষ ও বিহ্বল হয়। কুদ্দুছ তখন বলে, হুজুর হে বাজারে নাপিতের কাম করে। নাম হরিপদ। হিন্দু বেডা পাঞ্জেগানা কায়েম করবো ক্যামনে?
হুজুর তখন মুখভর্তি দাড়িতে বুরো ক্ষেতে নিড়ানি দেয়ার মতো আঙুল খেলিয়ে বলেন, ইচ্ছা থাকলে পাঞ্জেগানা হ¹লেই কায়েম করতে পারে। না পারলে হরিপদ নিজ ধর্মে কর্মে মনোযোগ দিতে পারে।
তারপর ফিরে এসে সকলে কালো তাগা দিয়ে বাম বাহুতে তাবিজ বেধে নেয়। কেবল আমারটা শ্যামলের জন্য ড্রয়ারে ফেলে রেখে স্টুডিওর কাজে মনোনিবেশ করি। তখন বাজারে উৎসবমুখর পরিবেশের উদয় হয়। লক্ষ করা যায় স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী আর বাজারবাসীদের ভেতর একটা নীল রঙের বড় ড্রাম বাচ্চাদের বিয়ারিং গাড়ির শব্দ তুলে এগিয়ে যায়। জাহাঙ্গীরের কাছে জানা যায়, হুজুরের পড়া পানির মগ ড্রামের আকার ধারণ করেছে। চৌরাস্তার মোড় থেকে শুরু করে তখন প্রত্যেক দোকানে এক মগ পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তারপর উত্তরে ঝাটাশিরা মাদ্রাসার সামনে, দক্ষিণে মেহের মাস্টারের বাড়ির সামনে, পূর্বে চৌরাস্তার মোড় আর পশ্চিমে আলতাফ মেম্বরের ভাঙারি দোকানের পেছনে চারটি তাবিজ মাটিতে পুতে দেয়া হয়। তখন থেকে লক্ষ করা যায়, বাজার মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হয় না। তাই ঝাটাশিরা প্রবেশ পথে কেউ কেউ গামছা অথবা চট বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর সন্ধ্যার পর থেকে কিছুদিন হরিপদকে তার সেলুনে দেখা যায় না। শোনা যায় মেথরপট্টির পেছনে আর সুবোধ বাবুর বাসার সামনে লোকনাথ মন্দিরে সে সাধন ভজনে নিমগ্ন হয়।
রেখার দৃষ্টিসীমার ভেতর এইসব ধর্মকর্মের দিন অতিবাহিত হতে থাকে। অর্থাৎ রাত্রিবেলা হোসেনপুর হাইওয়েতে, পাঠানকান্দি ঢোকার মুখে, খিলপাড়ার ভেতরে ঢুকতে আর বিলপাড়ের রাস্তার মুখে সে অর্ধনগ্ন হয়ে বাজারবাসীর চক্ষুগোচর হয়। অর্থাৎ তাদের ৩১০০ টাকার তাবিজ আর বাধ্যগতদের মতো কড়জোরে প্রার্থনা বিফলে যায়। ফলে তখন খিলপাড়া বাজারের দোকানগুলোতে বহিরাগতদের সমাগম কমে এলে বাজার কমিটি পুনরায় নড়েচড়ে উঠে। বাজারের ইমেজ রক্ষা আর নিজেদের অস্বস্তির ব্যাপারে তারা অধিক সচেতন হয়। কিন্ত পুন পুনঃ মিটিং ডেকেও বাজার কমিটি কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে সকলে বিমর্ষ আর শঙ্কিত হয়ে বাড়ি ফেরে। এবং যেন নিয়তির ক্রমধারায় তারা পুনরায় আক্রান্ত হয়।
এরূপকালে আমি শ্যামলের কাছে ফোন করলে তার কুণ্ঠিত কণ্ঠ শুনতে পাই। সে বলে যে তার জুয়েলারি শপ সন্ধ্যা হতেই তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপর ঈশ্বরগঞ্জ কালিবাড়িতে সে রাত ন’টা অবধি ঠাকুরসেবায় নিয়োজিত হয়। কিন্তু রাত ১০টার দিকে সে যখন বাড়ির সম্মুখে আসে তখন স্বাস্থ্যবতী এক কালোছায়া তার পথরোধ করে। প্রথম প্রথম স্পর্শলাভের প্রত্যাশা করে ব্যর্থ হলে এখন ভয়ে ঘর্মাক্ত হয়। কী এক সূত্র ধরে এই ঘটনা জানাজানি হলে সে লজ্জাস্কর পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়ে। কেননা লোকেরা তাকে ইঙ্গিত করে তখন তামাশায় মশগুল হয়। কিন্তু ক্রমাগত এই তামাশা মহামারি আকারে শঙ্কায় পরিণত হতে থাকে। কেননা তারা, মানে লোকেরা যারা হাসি-ঠাট্টায় নিজেদের মাঝে বিনোদন তৈরি করেছিল তারা ক্রমে ক্রমে স্বাস্থ্যবতী কালো ছায়া দ্বারা দৃশ্যতঃ আক্রান্ত হতে থাকে। তখন তারা দলে দলে কালীবাড়ি আর মসজিদে পুণ্যার্থীদের দল ভারি করতে থাকে। কিন্তু এইসব প্রার্থনা তাদের কাছে নিরর্থক মনে হতে থাকে যখন ফের এক-ই দৃশ্যের ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি ঘটে।
তখন খিলপাড়া বাজার কমিটি পুনরায় মাওলানা হেলাল উদ্দিনের শরণাগত হয়। তার কেরামতি তাবিজ আর পড়া পানি বিফলে যাওয়ার কথা শুনে তিনি অপরাধ আর লজ্জাবোধ করেন। তারপর পূর্বের ৩১০০ টাকার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে বিনা পয়সায় একটা পরামর্শ দেন। কিন্তু পাঞ্জেগানা কায়েমের কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। তখন বাজার কমিটি ফিরে এসে হুজুরের পরামর্শানুসারে বাজারের ঠিক মাঝখানে আক্কাছ আলীর কাঁচামালের দোকান আপাতত তুলে নেয়। তারপর সেখানে আটটি খুঁটি পুতে তার উপর একটা বড় সামিয়ানা টাঙিয়ে নিচে ছালার চট রেখে তাতে বিছানার চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়। এবং হুজুরের পরামর্শমত ঝাটাশিরা হাফিজিয়া মাদ্রাসার পুরাতন আর নতুন ছাত্রদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন তারা ১০ জন করে পাঁচ ভাগে গোলাকারে বিভক্ত হয়। এবং প্রত্যেকে হাঁটু গেড়ে বসে বাতাসে সুপারি বৃক্ষের মতো দোল খেতে খেতে জালালি খতম পাঠ করে। খতম শেষে সেই নীল রঙের বড় ড্রামে একে একে পঞ্চাশ জনের প্রত্যেকে ফুঁ দিয়ে মসজিদের কলের পানিকে পড়া পানির রূপ দেয়। তারপর বাচ্চাদের বিয়ারিং গাড়ির উপর তুলে দড়ি দিয়ে গরুর মতো টেনে নিয়ে যাওয়া হয় আলতাফ মেম্বরের দোকানের পেছনে। সেখান থেকে চৌরাস্তার মোড় অবধি প্রত্যেক দোকানে এক মগ করে পড়া পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এবং পরিত্যক্ত খড় দিয়ে একটা মূর্তি বানিয়ে তাতে ছাই মেখে কালো করা হয়। সূর্যের তেজ কমে আসার সময় যখন পশ্চিমাকাশে রইছউদ্দী’র চোখের মতো লাল রঙ ধারণ করতে শুরু করে তখন বাজার জুড়ে ব্যাপক লোকের সমাগম ঘটে। তাদের সকলের সামনে কুদ্দুছ দেশলাই দিয়ে মূর্তিটির পায়ে আগুন ধরিয়ে দিলে খুব দ্রুত সেই আগুন মাথা অবধি পৌঁছে মূর্তিটি ছাই হয়ে যায়। তারপর অবশিষ্ট পড়া পানি দিয়ে ছাইচাপা জায়গাটুকু ধুয়ে তার ওপর হোসেনপুর ঘেঁষা ব্রক্ষপুত্র থেকে আসা বালি ছিটিয়ে দেয়া হয়। সেদিন লোকেরা সন্ধ্যার কিছু পরেই ভারমুক্ত শরীর-মন নিয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু লোকেরা ফের বিমর্ষ হয় যখন তারা দেখে যে তাদের সকল আয়োজন বিফলে যায়। অর্থাৎ তারা রেখা কর্তৃক পুনরায় আক্রান্ত হতে থাকে। কিন্তু তারপর এক অযাচিত ঘটনা ঘটে। আহেদালী তার চা’র দোকান বন্ধ করে যখন বাড়ির পথ ধরে এবং সে যখন তাদের পুকুরপাড়ের শেওড়া গাছের তলায় আসে তখন নিয়তির ফেরে অর্ধনগ্ন রেখার মুখোমুখি হয়। আর সে তখন সারা শরীরে বৃষ্টিভেজা শেওড়া গাছের মতো স্যাঁতসেঁতে আর কবুতরের বাচ্চার মতো কম্পন অনুভব করে। সে দারুণ অসহায় হয়ে পড়ে এবং তখন কী মনে করে রেখার পা বরাবর সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। এবং তার সম্পর্কে কুটিল মন্তব্য পুষনের অপরাধের দায় স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চায়।
পরবর্তী সাতদিন রেখামুক্ত হয়ে আহেদালী ফুরফুরে মনে তার দোকানকার্য চালিয়ে যায়। তারপর সে যখন তার মুক্তির কাহিনি প্রকাশ করে তখন তা বাতাসের মতো দ্রুত সকলের শরীরে আছড়ে পড়ে। এবং সকলে আহেদালী’র মুক্তির ফর্মুলা নিয়ে রেখা কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সময় এক-ই কায়দায় সেজদায় লুটিয়ে পড়ে আর ক্ষমা ভিক্ষা চায়। এবং মোবাইল মারফত শ্যামল ও শ্যামল কর্তৃক তার সতীর্থ আর প্রতিবেশিরা এই ফর্মুলা গ্রহণ করে এবং তার ফলে তারা সকলে মুক্তি লাভ করে।
বাজারের লোকেরা তখন তাদের বিগত দিনের ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে, কিন্তু তখন তার জন্য তারা কোনও আফসোস করে না। তবে তারা এই কথা স্মরণ করে যে, রেখার পরিণতির কথা তাদের জানাই ছিল।
অর্থাৎ এক মাস সাতাশ দিন তথা ৫৭ দিন আগে এক মেঘার্দ্র সকালে বাজারে অধিক লোকের সমাগম ঘটে। তারা প্রত্যেকে নিজেদের মুখের দিকে তাকিয়ে পরস্পর প্রশ্ন করে যে, রেখার কি হইছে? জমায়েত সকলেই প্রশ্নকর্তা হলেও ততোক্ষণে উত্তর দেয়ার জন্য একজনকে পাওয়া যায়। তিনি রেখার মধ্যবয়সী পিতা ছমেদ আলী। তার থুতুনিতে ছাগলের মতো একমুঠো মেহেদীরাঙা দাড়ি তখন চোখের পানিতে জবজবে হয়ে আছে। তিনি বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে বলেন, সব আমার কফাল। নাইলে এমুন আত্তির মতো ছেরি রাইতবিরাতে ফথে ঘাটে ঘুরে?
তিনি যা বলেন তাতে আমরা বুঝতে পারি যে, গতরাত দশটা’র দিকে রেখা আনসার ক্যাম্পের সামনে ধীরে চলমান এক টমটমে লাফ দিয়ে চড়ে বসে। ছমেদ আলীর মতে হয়তো ইচ্ছে করেই অথবা সে খেয়াল করেনি যে সেই টমটমে গুটি কয়েক রিকশাওয়ালা অথবা এই জাতীয় কিছু যুবক ছিল। তারপর ছমেদ আলী বলে না, কিন্তু আমরা আন্দাজ করি হয়তো বনিবনা হয়নি বলে যুবকেরা অথবা রেখা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এবং যখন চৌরাস্তার মোড়ে টমটম না থামিয়ে বরং আরও দ্রুত গতিতে খিলপাড়া বাজার অতিক্রম করে রইছুদ্দী’র বাড়ির সামনে অবধি চলে যায় তখন হয়তো উত্তেজিত যুবকেরা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় অথবা উত্তেজিত রেখা প্রশমিত হয়ে ভয় পেয়ে নিজেই লাফিয়ে পড়ে। তারপর রইছুদ্দী ভোর বেলা তার দুধেলা গাভিকে শিশির ভেজা ঘাস খাওয়ানোর নিমিত্তে হাইওয়ের পাশে নিয়ে এলে কংক্রিটের ওপর শুকিয়ে থাকা রেখার রক্তাভ মুখ দেখতে পায়। প্রথমে বিশেষ ঠাহর করতে না পারলেও সে যখন হাতে থাকা লাঠি দিয়ে গুতো দেয় এবং যখন রেখার কোনও নড়াচড়া টের পায় না তখন সে ষাঁড়ের মতো চিৎকার দিয়ে ওঠে। আর লোকেরা এসে রেখার অন্তিম পরিণতি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ লাভ করে।
তখন নতুন একদল মানুষ বাজারে এসে ভিড় করে আর এটা ওটা প্রশ্ন করার কালে বেগুনী রঙের পুলিশের গাড়ি গিয়ে থামে মুখথুবড়ে পড়ে থাকা রেখার লাশের পাশে। আর তখন পিঁপড়ের মতো সারিবদ্ধ উৎসুক মানুষ এসে সেখানে জড়ো হয়। হোসেনপুর থেকে আসা গাড়িগুলো তখন প্যাড়াভাঙ্গা পর্যন্ত এসে থেমে যেতে যেতে চরপুমদি পর্যন্ত জ্যাম বাধিয়ে ফেলে। কিন্তু ছমেদ আলীর পিতৃত্বের হাহাকারের সাথে রেখার লাশ পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে গেলে মানুষগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আর জ্যাম ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তবে লোকেরা যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, এমুন যে অইবো এইডা আমরার জানাই আছিন।
এই ঘটনার ৫৭ দিন পর পর্যন্ত লোকেরা রেখা কর্তৃক নানারূপে আক্রান্ত হয়ে অতঃপর মুক্তি লাভ করে। আর ৫৯ দিন পর আজ আর কেউ এইসব কথা মনে করতে চায় না। কে আর অভিশম্পাতে ফিরে যেতে চায়? তখন লোকেরা রেখা নামের কেউ কখনও ছিল না জেনে রেখে শ্মশানের মতো হা করে থাকা সুনসান আমাদের দোকানগুলোর সামনে নিত্য জড়ো হতে থাকে। তখন আমরা কর্মদিবস শেষে আমাদের সংসার আর সন্তানদের নিকট সানন্দে ফিরে যাই।
কিন্তু দু’বছর পর ঠিক এক-ই জায়গায় অনুরূপ একটা মেয়েকে ভোর বেলায় লোকেরা অনুরূপ মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে, আর পুনরায় তারা নতুন কোনও অভিশম্পাতের শঙ্কায় শঙ্কিত হতে থাকে।
২০১৩
1 মন্তব্যসমূহ
বেশ ভাল লাগল। গতি আছে। ভাষা আরও পরিকল্পিত এবং মার্জিত হলে ভাল হত। তবে 'চিল্লিয়ে' শব্দটা কানে লাগল। গল্প বলার ধরন মন কাড়া না হলেও ভাল।
উত্তরমুছুন