তপন
বাগচী: শুরুতে বলতে যদি ক্লাসের বইয়ের বাইরের প্রথম পড়ার কথা বলি তবে রূপকথার গল্প
এবং ছড়ার বই পড়েছি। সে তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘটনা। সুকুমার রায়ের ছড়ার বই পড়েছি।
আরে হ্যাঁ, তখন
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প পড়েছি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠানদিদির থলে’ পড়েছি। উচ্চবিদ্যালয়ে এসে একটু কাঠিন্য
দিয়ে শুরু। ষষ্ঠ শ্রেণিতেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘কৃষ্ণকান্ডের উইল’ পড়েছি। বুঝিনি তেমন কিছু।
অর্থ
খোঁজার জন্য অভিধান হাতড়াতে হয়েছে। আমার দাদু, মানে মায়ের বাবা রসিকলাল শাঁখারী
সাহিত্যের বই পড়তেন খুব। তাঁর সংগ্রহে ছিল বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের উপন্যাস। ফাল্গুনী
মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন
গুপ্তও ছিল। দাদুর কাছে থাকা বই পড়েই আমার সাহিত্য পাঠের শুরু। তাঁর সংগ্রহে শ’খানেক যাত্রাপালাও ছিল। তার বেশ কিছুও
পড়েছি ওই বয়সেই। মায়ের ট্রাংকে পেয়েছি মীর মশাররফের ‘বিষাদসিন্ধু, প্রভাবতীদেবী সরস্বতীর ‘বউ কথা কও’, কৃষ্ণগোপাল বসাকের ‘রিক্তের বেদন’। বুঝি-বা না-বুঝি গল্প জানার আগ্রহে
এগুলো পড়ে ফেলেছি।
গল্পপাঠ : এর
মধ্যে গল্প কখন পড়া শুরু করলেন?
তপন
বাগচী: উপন্যাসের সঙ্গেও গল্পও পড়েছি। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ ছিল বাড়িতে। আর শরৎচন্দ্রের গল্প। তার
কিছু উপন্যাসও ‘বড়গল্প’
নামে গ্রন্থিত
হয়েছে। গল্প আর উপন্যাসের ফারাক তখন বুঝতাম না। আকারে ছোট হলে গল্প, আর আকারে বড় হলে উপন্যাস। এই জ্ঞান নিয়েই
গল্প পড়েছি তখন।
গল্পপাঠ :গল্প
কেনো পড়েন?
তপন বাগচী:
পাল্টা প্রশ্ন করতে পারি-- গল্প পড়ব না কেন? আসলে আমার পাঠ্যতালিকায় সবই ছিল। গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণকাহিনি-- সব। যা হাতের কাছে পাই, তাই পড়ি। আমাকে নির্দিষ্টভাবে গল্পের পাঠক
বলা যাবে না। যদি বেশি কী পড়েছি হিসাব করি, তবে বোধহয় কবিতার কথাই মনে আসবে। কিন্তু
গল্পের প্রতি আমার কোনো অনীহা নেই। কবিতাই আমার বেশি প্রিয়। আর কবিতার চেয়ে একটু
বেশি বিস্তার পাই গল্পে, তাই পাঠের কাতারে কবিতার পরে গল্পও আমার প্রিয় হয়ে ওঠে।
গল্পপাঠ : জীবনে প্রথম কোন গল্পটি আপনাকে বেশি স্পর্শ করেছিল? কেন করেছিল?
তপন
বাগচী: শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’। পশুর প্রতি মানুষের ভালবাসা যে কত তীব্র
হতে পারে গফুর আর মহেশের কথা পড়েই তা অনুভব করতে পারি। প্রাণীর প্রতি প্রেম জাগিয়ে
দিয়েছিল ওই গল্পটি। অজস্রবার পড়া হয়েছে গল্পটি। গত মাসেও পড়েছি গল্পটি। এটি কখনো
পুরোনো হবে না। যতবার সামনে পাব, গল্পটি আমি প্রতিবারই পাঠ করবো। কী এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে ওই গল্পটির
মধ্যে, তা আমি জানি না,
তবে আমাকে ভেতর থেকে
টানে। কোনো মুসলিম চরিত্রের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় আমার গফুরের সঙ্গে। আর পশুও যে
হতে পারে, গল্পের
কেন্দ্রীয় চরিত্র, তার
অনুভবও হতে পারে ওই গল্পের প্রতি আবার আকর্ষণের কারণ। তাছাড়া ক্ষুধা দারিদ্র,
শোষণ, নির্যাতনে, বাৎসল্য-- সবই আছে ওই ছোট আকারের ছোটগল্পের মধ্যে।
গল্পপাঠ :গল্প
পড়তেন কিভাবে? কোন কোন
সময়ে? কোন কোন পরিবেশে?
পরিবারের কেউ বা
বন্ধু বা শিক্ষক কি কেউ গল্প পড়তে উৎসাহিত করেছেন? একটি গল্প কিভাবে পড়তে হয়--সেটা কি কেউ
কখনো আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছেন?
তপন
বাগচী: খুবই কঠিন প্রশ্ন। কবিতা পড়া, গল্প পড়া, উপন্যাস পড়ার জন্য আলাদা সময় আছে কিনা জানি না। ডায়াবেটিক রোগির জন্য যেমন বলে দেয়া হয়ে সকালে রুটি, দুপুরে ভাত, রাতে রুটি কেতে হবে। দুই ঘন্টা অন্তর কিছু খেতে হবে। সাহিত্যের পাঠতেকর ক্ষেত্রে তেমন কিছু আছে কিনা আামর জানা নেই। পড়ার ক্ষেত্রে আমার বাছবিচার নেই। একসঙ্গে ৪/৫টা বই পড়ার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। পরীক্ষার আগে রাতেও মূলবইয়ের নিচে লুকিয়ে রোমেনা আফাজের ‘সাগরতলে দস্যু বনহুর’ পড়েছি, তা এখনো মনে আছে।
উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বন্ধু অজিতকুমার সরকারের সঙ্গে পাল্পা দিয়ে পড়তাম। কে আগে পড়ে শেষ করতে পারে তারই প্রতিযোগিতা। হোস্টেলের সবাই ক্লাসের পড়া পড়ছে। আর আমরা দুই বন্ধু ক্লাসের পড়া তাড়াতাড়ি শেষ করে গল্পের বই নিয়ে বসতাম। উপন্যাস পড়লে বেশি সময় লাগে। তাই গল্প নিয়ে বসতাম। কত গল্প যে পড়েছি, এখন মনেও করতে পারছি না। গল্পের নাম ভুলেছি, গল্পকারের নামও মনে করতে পারছি না, কিন্তু সেই আনন্দময় স্মৃতিটুকু মনে পড়ছে! আমার বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক অনিলকৃষ্ণ দত্ত আমাকে পড়তে উৎসাহ দিতেন। আরে লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা শিক্ষক কালিপদ বিশ্বাসও খুঁজে দিতেন বই। প্রধান শিক্ষক সুধাংশ শেখর গোলদার আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে সত্যজিৎ রায়ের ‘ফটিকচাঁদ’ নামের কিশোর-উপন্যাস। তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। এরপর খুঁজে পেতে পড়ে ফেলি সত্যজিৎ রায়ের কিছু গোয়েন্দা গল্প।
আর কদমবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের লাইব্রেরিতে ছিল ‘ভারতীয় জনগণের শুভেচ্ছাসহ’ সিল-মারা বেশ কিছু বই। আলমারির নিচের একটি পাটাতন ফাঁক করে হাত ঢুকিয়ে আমি আর অজিত অনেক বই এনেছি লুকিয়ে। চুরির অপবাদটি নিতে চাই না এই জন্যে যে, আমরা আবার যথাস্থানে রেখে নতুন বই আনতাম। আমার মামা ননীগোপাল বর ছিলেন চেয়ারম্যান আর অজিতের বাবা চন্দ্রকান্ত সরকার ছিলেন সচিব। ধরা পড়ে গেলে কেলেঙ্কারির একশেষ হতো! তাই সচেতন থাকতাম। বইগুলো যথাস্থানে রাখার ব্যাপারের সজাগ থাকতাম। সেই সময়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কিছু গল্প পড়ার সুযোগ ঘটে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের গল্পও পেয়ে যাই হাতে। অচিন্ত্য-প্রেমেন্দ্র এরকম কয়েকবন্ধুর লেখা ‘বাঁকা লেখা’ নামের একটি বারোয়ারি উপন্যাস পড়ে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমরা তো আর বই দেখে বেছে নিতে পারতাম না। হাতে যে বই উঠত, সে বইই নিয়ে আসতাম।
গল্প কীভাবে পড়তে হয়, তা আবার কে কীভাবে শেখাবে? পড়তে পড়তেই শিখে গেছি গো! কবিতা পড়তে যেমন ছন্দ-তাল বুঝলে ভালো হয়, কিংবা বারবার পড়লেই ছন্দটা টের পাওয়া যায়, গল্প তো আর তেমন কোনো শ্রুতিগ্রাহ্য প্রকরণ নেই। আর একটা কথা, বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই মুক্তধারা-র ক্যাটালগ আসত প্রধান শিক্ষকের ঠিকানায়। ওখানে থাকতো ভিপি-যোগে বই ক্রয়ের নিয়মাবলি। আমি কখনই ভিপি-যোগে কিনেছি সুকুমার বড়–য়ার ‘ভিজে বেড়াল’, মনোমোহন বর্মণের ‘সোনালি ভোরের রোদে’ প্রভৃতি ছড়ার বই। আর ‘সচিত্র বাংলাদেশ’ পত্রিকার গ্রাহক ছিলাম। তাতে অনেক গল্প থাকত। গল্পগুলোর নাম মনে না থাকলেও গল্পকারদের নাম মনে পড়ছে, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, জুবাইদা গুলশান আরা, শহীদ আখন্দ প্রমুখ।
উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বন্ধু অজিতকুমার সরকারের সঙ্গে পাল্পা দিয়ে পড়তাম। কে আগে পড়ে শেষ করতে পারে তারই প্রতিযোগিতা। হোস্টেলের সবাই ক্লাসের পড়া পড়ছে। আর আমরা দুই বন্ধু ক্লাসের পড়া তাড়াতাড়ি শেষ করে গল্পের বই নিয়ে বসতাম। উপন্যাস পড়লে বেশি সময় লাগে। তাই গল্প নিয়ে বসতাম। কত গল্প যে পড়েছি, এখন মনেও করতে পারছি না। গল্পের নাম ভুলেছি, গল্পকারের নামও মনে করতে পারছি না, কিন্তু সেই আনন্দময় স্মৃতিটুকু মনে পড়ছে! আমার বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক অনিলকৃষ্ণ দত্ত আমাকে পড়তে উৎসাহ দিতেন। আরে লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা শিক্ষক কালিপদ বিশ্বাসও খুঁজে দিতেন বই। প্রধান শিক্ষক সুধাংশ শেখর গোলদার আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে সত্যজিৎ রায়ের ‘ফটিকচাঁদ’ নামের কিশোর-উপন্যাস। তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। এরপর খুঁজে পেতে পড়ে ফেলি সত্যজিৎ রায়ের কিছু গোয়েন্দা গল্প।
আর কদমবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের লাইব্রেরিতে ছিল ‘ভারতীয় জনগণের শুভেচ্ছাসহ’ সিল-মারা বেশ কিছু বই। আলমারির নিচের একটি পাটাতন ফাঁক করে হাত ঢুকিয়ে আমি আর অজিত অনেক বই এনেছি লুকিয়ে। চুরির অপবাদটি নিতে চাই না এই জন্যে যে, আমরা আবার যথাস্থানে রেখে নতুন বই আনতাম। আমার মামা ননীগোপাল বর ছিলেন চেয়ারম্যান আর অজিতের বাবা চন্দ্রকান্ত সরকার ছিলেন সচিব। ধরা পড়ে গেলে কেলেঙ্কারির একশেষ হতো! তাই সচেতন থাকতাম। বইগুলো যথাস্থানে রাখার ব্যাপারের সজাগ থাকতাম। সেই সময়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কিছু গল্প পড়ার সুযোগ ঘটে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের গল্পও পেয়ে যাই হাতে। অচিন্ত্য-প্রেমেন্দ্র এরকম কয়েকবন্ধুর লেখা ‘বাঁকা লেখা’ নামের একটি বারোয়ারি উপন্যাস পড়ে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমরা তো আর বই দেখে বেছে নিতে পারতাম না। হাতে যে বই উঠত, সে বইই নিয়ে আসতাম।
গল্প কীভাবে পড়তে হয়, তা আবার কে কীভাবে শেখাবে? পড়তে পড়তেই শিখে গেছি গো! কবিতা পড়তে যেমন ছন্দ-তাল বুঝলে ভালো হয়, কিংবা বারবার পড়লেই ছন্দটা টের পাওয়া যায়, গল্প তো আর তেমন কোনো শ্রুতিগ্রাহ্য প্রকরণ নেই। আর একটা কথা, বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই মুক্তধারা-র ক্যাটালগ আসত প্রধান শিক্ষকের ঠিকানায়। ওখানে থাকতো ভিপি-যোগে বই ক্রয়ের নিয়মাবলি। আমি কখনই ভিপি-যোগে কিনেছি সুকুমার বড়–য়ার ‘ভিজে বেড়াল’, মনোমোহন বর্মণের ‘সোনালি ভোরের রোদে’ প্রভৃতি ছড়ার বই। আর ‘সচিত্র বাংলাদেশ’ পত্রিকার গ্রাহক ছিলাম। তাতে অনেক গল্প থাকত। গল্পগুলোর নাম মনে না থাকলেও গল্পকারদের নাম মনে পড়ছে, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, জুবাইদা গুলশান আরা, শহীদ আখন্দ প্রমুখ।
গল্পপাঠ : পড়ে
কোনো গল্প ভালো লাগলে কি রকম অনুভূতি হয়? আপনার কি কখনো মনে হয়েছে গল্পের কোনো
চরিত্র আপনার নিজের মত। বা চরিত্রটি আপনার মধ্যে চলে এসেছে। কিছুদিন তার মত করে
চলাফেরা করতে শুরু করেছেন?
তপন
বাগচী: গল্পের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যেই নিজের ছায়া দেখতাম। কিছু চরিত্র মিলে যেত।
আর কিছু চরিত্র পড়ে মনে হতো, আহা আমি যদি এমন হতে পারতাম। তারমতো চলাফেরা করার মতো অনুশীলন করেনি।
তবে মনে মনে ভেবেছি। কতদিন যে নিজেকে ইন্দ্রনাথ ভেবেছি, কিন্তু তার মতো দুঃসাহসী হতে পারি নি।
মামাবাড়ি থাকতাম।
রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পটি ভালো লাগলেও নিজের সঙ্গে মেলাতে পারি
নি। ‘হৈমন্তী’কে পেলে নিজের ধন্য জীবন কামনা করেছি মনে
মনে। আর গল্পে তো একটা চরিত্র পুরোপুরি দাঁড়িয়ে যায় না। কিছু ইঙ্গিতেই ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’। উপন্যসের চরিত্র বরং মনে দাগ কাটে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র অপু তো মনে আমি নিজেই। শরৎচন্দ্রের চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’-এর জন্য কত যে কেঁদেছি! বুক ভেঙে যেত!
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘চিতা বহ্নিমান’-এর তপনকে নিজের থেকে আলাদা ভাবি নি। একজন ‘তপতী’কে মনে মনে খুঁজতাম। শৈলজারঞ্জন
মজুমদারের ‘স্টেশন
মাস্টার’ মনে হতো
নিজেকেই।
গল্পপাঠ :একটি
গল্পের কি কি বিষয় আপনাকে টানে? অর্থাৎ একটি ভালো গল্প হয়ে উঠতে হলে গল্পের মধ্যে কি কি বিষয় থাকা
দরকার বলে মনে করেন?
তপন
বাগচী: গল্পে তো গল্প থাকতেই হবে। কিন্তু এই সময়ে অনেক গল্পে আমি গল্প দেখতে পাই
না। অনেকে বলবেন গল্পের ধরন এখন বদলে গেছে। গল্পের ভেতর গল্প থাকতেই হবে, এমন কোনো কথাই নেই। আচ্ছা বাপু মানলাম।
তবে সেগুলো আর গল্প নামে ডেকেই বা কী লাভ। অন্য কেনো নাম দিয়ে ফেলুন। পাকিস্তানকে
যখন স্বাধীন করেছি, তখণ তো
বাংলাদেশ বলে নতুন নাম নিয়ে নিয়েছি। গল্প ছাড়া যারা গল্প লিখতে চান, তারা আসলে গল্পের খোলসে অন্য কিছু লিখতে
চান। আমি গল্প না পেলে, চরিত্র না পেলে, দ্বন্দ্ব না পেলে, সেই গল্প শেষ করি না। পড়ে শেষ কতে পারিনি, এমন অনেক গল্প আছে। কিন্তু কবিতা কিংবা
উপন্যাস কিংবা নাটক আমার হাতে পড়েনি, যা পড়ে শেষ করার সুযোগ গ্রহণ করিনি।
গল্পপাঠ :সে
রকম গল্প কোন কোন গল্পকারের মধ্যে পেয়েছেন? কিছু গল্পের নাম বলুন।
তপন
বাগচী: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের ‘একরাত্রি’,
‘সমাপ্তি’, সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহ’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’, শওকত ওসমানের ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘স্পর্শের দোষ’, আবু ইসহাকের ‘জোঁক’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘সত্যের মতো বদমাশ’, বিপ্লব দাশের ‘পঞ্চুহরির শেষ বিবাহ’, আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’, ‘অবতরণিকা’ (যা থেকে নির্মিত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের
মহানগর চলচ্চিত্র), নরেশচন্দ্র
সেনগুপ্তের ‘রূপের
অভিশাপ’, শাহেদ
আলীর ‘জিব্রাইলের ডানা’,
মিরজা আবদুল হাইয়ের ‘মেহেরজানের মা’, সুচরিত চৌধুরীর ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘আরো দুটি মৃত্যু’, সরদার জয়েনউদ্দিনে ‘নয়নঢুলি’, শহীদুর রহমানের ‘বিড়াল’, সোমেন চন্দের ‘ইঁদুর’, হরিপদ দত্তের ‘কালো ভ্যানের জানালা’ প্রভৃতি গল্পের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।
গল্পপাঠ : কীকী
কারণে কোনো গল্প মন্দ হয়ে ওঠে? এ রকম কি ঘটনা ঘটেছে যে এক সময় মনে হয়েছিল গল্পটি ভালো--পরে তা মন্দ
লেগেছে?
তপন
বাগচী: গল্পে থাকে টান। সেই টান নষ্ট হতে পারে যে কোনো সামান্য অনুষঙ্গের কারণে।
ধরুন, বাংলা ভাষাটাই জানে,
তিনি যদি গল্প লিখতে
যান, বটে বড়ই বিপদ! ভাষা
ভালো করে না জেনেও অনেকের কবিতার মতো কিছু রচনা করে কবিখ্যাতি লাভ করতে পারেন
গায়ের জোরেও। কিন্তু গল্পে সেটি খাটে না। ভাষাটা না জানলে তার জারিজুরি ফাঁস হয়ে
যায়। এখন অনেকে গল্প লিখছেন কিন্তু ভাষাটাও জানেন না। সেটি মনে রেখেই এই কথাটি বলে
ফেললাম। আর গল্পে যদি গল্প না পাই, আগেই বলে রেখেছি, তাকে আমি ভাল গল্প বলতে চাই না। মিডিয়ায়
তার যত প্রতিপত্তিই থাকুক, আমার মনের কথা বলতে আর ভয় কারে? একসময় ভালো লাগা গল্পকে আর পরে খারাপ
লেগেছে, এমনটি
হয়নি আমার পাঠের ক্ষেত্রে। কারণ, যেটি ভালো সেটি সব সময়েই ভালো। আগে ভালো, পরেও ভালো। আর যেটি আগে খারাপ, সেটি পরেও খারাপ। একজন গল্পকার একসময়ে
খারাপ গল্প লিখলেও পরে আবার তিনি ভাল গল্প লিখতে পারেন। কিন্তু আগের খারাপ গল্পটির
দায় তাঁকে বহন করতেই হয়!
গল্পপাঠ :এ
সময়ের কোন কোন গল্পকারের গল্প আপনি পড়েছেন বা পড়েন? সেগুলো কেমন লাগে? ভালো লাগলে কেনো ভালো লাগে? মন্দ লাগলে কেনো মন্দ লাগে? কারণগুলো বিস্তারিত লিখুন।
তপন
বাগচী: যেহেতু পত্রিকা পড়ি, তাই সাময়িকীপৃষ্ঠা প্রকাশিত গল্প চোখে পড়ে। চোখ বুলাই। মনে ধরলে পড়ি,
না ধরলে এড়িয়ে যাই।
সংসারে পড়ার অনেক কিছুই আছে। এই সময়ের গল্পকারদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, পূরবী বসু, বুলবুল চৌধুরী, আবিদ আনোয়ার, হরিশংকর জলদাস, রফিকুর রশীদ, পারভেজ হোসেন, মনিরা কায়েস, মামুন হুসাইন, ওয়াসি আহমেদ, হুমায়ুন মালিক, জাকির তালুকদার, আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা প্রমুখের গল্প আমার ভালো
লাগে। এদের গল্প ভালো লাগার কারণ ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না। এর বাইরের যাঁরা
গল্পকার আছেন, তাঁদের
গল্প ভালো লাগে না, এমনটি
নয়। তাঁদের কোনো কোনো গল্প হয়তো ভালোও লেগেছে। আবার সবার নাম একসাথে উঠেও আসে না।
কিংবা আমার স্বাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। হয়তো আমার ভালো লাগেনি, কিন্তু অন্য কোনো পাঠকের বিবেচনায় হয়তো
আরো ভালো গল্প রয়ে গেছে। সব লেখা তো একদিনে নজরেও আসে না। মন্দ লাগার গল্পও আছে।
কিন্তু পাঠক হিসেবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করার মতো সময় নষ্ট না করে নতুন কোনো
গল্পের দিকে মুখ ডোবাতে চাই।
লেখক পরিচিতি
তপন বাগচী।
উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
কবি। প্রবন্ধকার। গবেষক।
0 মন্তব্যসমূহ