
শিবু ঃ আমি শুরুটা এভাবে করতে চাই যে, আপনি প্রবন্ধ লিখছেন, অনুবাদ করছেন, গল্প লিখছেন, উপন্যাস লিখছেন, পত্রিকার কলামও লিখছেন, এসমস্ত লেখালেখির পেছনে নিশ্চয়ই প্রবল একটা প্রেরণাকাজ করছে। তো জানতে চাচ্ছি এই প্রেরণার উৎসটা কোথায়?
শাহাদুজ্জামান: আসলে ভেতর থেকে একটা চাপ বোধ করি লেখার। এই চাপটাকে তুমি প্রেরনা বলতে পারো। প্রেরনার উৎস খুঁজতে গেলে বলবো ভেতরের নানা রকম জিজ্ঞাসা। জীবন যাপন করতে গিয়ে অবিরাম নানারকম প্রশ্ন তাড়িত হই। নানা রকম ভাবনা, অনুভুতি, বোধ এগুলো মনের ভেতর জমা হয়। মাল বোঝাই ট্রাকের মত সেইসব প্রশ্ন, অনুভুতি, বোধগুলোকে বহন করতে থাকি। একটা ভার বোধ হয় তারপর মনে হয় এগুলো আনলোড করা দরকার। আনলোড করার জায়গা খুঁজি। সবজায়গায় তো সবকিছু আনলোড করা যায় না। কিছু ভাবনা, অনুভুতি, প্রশ্নকে আনলোড করতে পারি গল্পের ভেতর ,কিছু প্রবন্ধে, কিছু, কলামে, অনুবাদে, কোনটা বা উপন্যাসে। তো এইভাবে একেক স্পেসে একেক ভাবনা খালাস করি। লেখাটা লিখবার পর হালকা লাগে, ভারমুক্ত বোধ করি। আবার ট্রাক চলতে থাকে আর মাল বোঝাই হয়। আবারো আনলোড করার তাগাদা তৈরী হয়। তো এভাইে চলছে।
শিবু: ‘কথা‘ পত্রিকায় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাৎকারে আপনি জানিয়েছেন যে মেডিকেলে পড়বার সময়ই আপনি মার্ক্সীষ্ট এসথেটিকসের অনুবাদ দিয়ে লেখা শুরু করেছেন। এর আগে কি কিছুই লেখেননি, ছোটবেলায় শিশুসাহিত্য ধরনের?
শাহাদুজ্জামান: হ্যাঁ, মেডিকেলে বাম রাজনীতির সংষ্পর্শে এসে আমি প্রথম লিখতে শুরু করি। সেই প্রেক্ষাপটা জাহাঙ্গীরের সাথে আলাপে আছে। এটা একটু স্ট্রেঞ্জ যে একেবারে খুব সিরিয়াস মার্ক্সিস্ট এসথেটিক্সের একটা অনুবাদ হচ্ছে আমার প্রথম লিখিত কাজ। আমি কখনও কবিতা লিখি নাই। আমার ঐ বয়সে বন্ধু বান্ধব অনেকেই কবিতা লিখতো। আমি তেমন কিছু লিখিনি। এমনকি আমি স্কুল ম্যাগাজিনে, কলেজে ম্যাগাজিনে কখনো কিছু লিখিনি। পত্রিকার ছোটদের পাতায় অনেকে লেখে, ছড়া টড়া তেমন কোন শিশু সাহিত্যও আমি করি নাই।
শিবু: কেন লেখেননি বলে মনে হয়।
শাহদুজ্জামান: না লিখলেও আমি সেই স্কুল জীবন থেকেই অনেক পড়ছি। মনে আছে যে কিছু লেখার কথা ভাবতে গেলেই আমি যে লেখাগুলো পড়েছি তার সঙ্গে একটা কমপারিজন চলে আসতো। মনে হতো যে আমি কিছুতেই ঐ মানের লেখা লিখতে পারবো না সুতরাং ফালতু লিখে লাভ কি? পড়ার কারনে মনে মনে লেখার একটা স্টান্ডার্ড সেট হয়ে গিয়েছিলো যেটা আমাকে লেখা থেকে বিরত রাখতো। সে কারনে সম্ভবত লেখার ইচ্ছা যখন জাগলো তখন নিজে না লিখে অন্যের উপর ভর করলাম। অনুবাদ করলাম। নিজের মৌলিক লেখার কনফিডেন্সটা আসতে আমার অনেক সময় লেগেছে। আমার প্রথম বই কয়েকটি বিহবল গল্পের প্রথম রিভিউ করেছিলো চিটাগাংএর আলম খোরশেদ সংবাদে। সেখানে সে ঐ কথাটা লিখেছিলো যে ‘শাহাদুজ্জামানকে তো আমরা মার্ক্সিষ্ট এসথেটেসিয়ান হিসেবে জানতাম সে হঠাৎ এমন গল্প লিখতে শুরু করেছে দেখে আমরা অবাক হয়েছি‘ ইত্যাদি।
শিবু: আপনি তো তখন চিটাগাং এ আরো সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন?
শাহাদুজ্জামান: হ্যা আমি তখন চিটাগাং ফিল্ম সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারী। নাটকের দলেও কাজ করছি।
শিবু: আপনি কি অভিনয়ও করতেন?
শাহাদুজ্জমান: হ্যা, অভিনয়ও করেছি। মিলন চৌধুরীর অঙ্গন থিয়েটার ইউনিটে যুক্ত ছিলাম। তার নাটকে অভিনয় করেছিলাম। অঙ্গন থিয়েটারের প্রতিনিধি হয়ে ব্রেখটের উপর ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছিলাম। জার্মানীর আলেকজান্ডার ষ্টিলমার্ক ওয়ার্কশপ কন্ডাক্ট করেছিলেন। আমি তখন চিটাগাং বেতারে গানও করতাম। গান আমার পরিবারের ভেতরই ছিলো। আমার বাবা মা দুজনই গান করতেন। আমিও কলেজ ফাংশনে নিয়মিত গাইতাম। রেডিওতে রবীন্দ্র সংঙ্গীত করতাম। তো এইরকম নানারকম কিছু করছি। কিন্তু মনে হতো এত কিছু করে তো লাভ নাই। একটা কোথাও স্থির হওয়া দরকার। অভিনয় আমার স্বচ্ছন্দের জায়গা না সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। গানটাকে আরো এগিয়ে নেবার জন্য যে শ্রম, সাধনা দরকার সেটা দিতে পারবো বলে মনে হয়নি। লেখালেখিটাতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছি। লেখালেখিই চালিয়ে যাবো ঠিক করেছিলাম। মাঝে খুব পেয়ে বসেছিলো ফিল্ম। মনে আছে ঋত্বিক ঘটক এসময় আমাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলেন। ঋত্বিকও লেখালেখি করতেন তারপর নাটকে গেছেন, সেখান থেকে গেছেন ফিল্মে। বলেছিলেন ফিল্ম বহু মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে তাই তিনি অন্য মিডিয়া ফেলে ফিল্মে এসেছেন। বহু মানুষকে প্রভাবিত করা ব্যাপারটা এ্যাপিল করেছিলো আমাকে। এটা অনেকটা মার্ক্সিস্ট ওরিয়েন্টেশন থেকে হয়েছিলো। লেনিন বলেছিলেন, ফিল্ম বিপ্লবের হাতিয়ার। তো এসব মিলে একবার ঠিক করেছিলাম ফিল্ম মেকারই হবো। ঢাকাতে ফিল্ম এপ্রেসিয়েশন করা, মস্কোর ফিল্ম ইন্সটিউটে ভর্তির সব ব্যবস্থা করা ইত্যাদি নানা কান্ড করেছি। আমার ঐ ফিল্ম পর্বটির কথা তারেক মাসুদের স্মৃতি নিয়ে একটি লেখাতে বিস্তারিত লিখেছি যেটা ‘দেখা‘ নামে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যাহোক তারপর নানা চড়াই উৎড়াইয়ের পর টের পেয়েছি যে ফিল্ম করাও আমাকে দিয়ে হবে না। তো শেষ পর্যন্ত লেখাটাতেই স্থির হয়েছি।
শিবু: তো গল্প লেখা শুরু করলেন কি করে?
শাহাদুজ্জামান: আমি তখন মূলত অনুবাদ, প্রবন্ধ এসব লিখছি। মাঝে অনেকগুলো সাক্ষাৎকার নিলাম ইলিয়াস ভাই, হাসান ভাই, সুলতান, সেই স্টীলমার্ক যিনি ব্রেখটের ওয়ার্কশপ করিয়েছিলেন এদের। সেসব ইন্টারভিউ বেশ প্রশংসিত হলো। সাক্ষাৎকারগ্রহনকারী হিসেবে আমার একটা পরিচিতি হলো। কিন্তু একসময় মনে হলো এসবের ভেতর দিয়ে আমার নিজের কথাটা তো বলতে পাচ্ছি না। আমাদের পারিবারিক বেশ কিছু বিপর্যয়, সামরিক শাসন, আমার গ্রামে চাকরী করতে যাওয়া এসব মিলিয়ে মনের ভেতর অনেক কথা জমা হয়েছিলো যেগুলো ওসব প্রবন্ধে, অনুবাদে আমি প্রকাশ করতে পারছিলাম না। এসময় প্রচুর চিঠি লিখতাম আমি। আমার বন্ধু মুকুলের কাছে, মিলনদার কাছে, বন্ধু ঢালী আল মামুনের কাছে। আবার বাবা মার কাছে লম্বা লম্বা সব চিঠি লিখতাম। সেইসব চিঠিতে নেহাত ঘর বাড়ি শরীর স্বাস্থ্যের কথা থাকতো না আমি আমার তখনকার সব ভাবনাগুলো চিঠিতে লিখতাম। আমার লেখালেখির পেছনে চিঠির একটা ভুমিকা আছে।
শিবু : আপনার চিঠি বিষয়ক কথাগুলো আমাকে প্রবলভাবে তাড়িত করেছে। আপনি বিসর্গকে দুঃখ বইয়ে লিখেছিলেন, এখন ইমেইল চলে এসেছে, এখন আর দরজার নিচে হলুদ খাম পড়ে থাকবে না। এই যে ইমেজটা। এর ভেতরে এক যুগান্তরের গল্প লুকিয়ে আছে।
শাহাদুজ্জামান: হ্যা আমরা তো চিঠিযুগের মানুষ। আমি কিন্তু বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখতে লিখতেই অনুভব করি যে আমার ভেতরের কথাগুলোকে আমি ভাষায় তুলে আনতে পারছি। মুকুলের কাছে যে চিঠি লিখতাম সেগুলো কিন্তু নেহাত চিঠি ছিলো না। আমি চিঠির ভাষা নিয়ে নানা নীরিক্ষা করতাম, নানা ফর্মে চিঠি লিখতাম। তো চিঠি ছিলো আমার সাহিত্যে হাত মকসো করা একটা ক্ষেত্র। পরে নিজের গল্পে যে নানা নীরিক্ষা করেছি সেটার শুরুটা ছিলো ঐ চিঠিতেই। সেই থেকেই একসময় গল্প লেখা শুরু করি। আমার প্রথম গল্প জোৎস্নালোকের সংবাদ আমার বন্ধু মুকলের একটা চিঠির সুত্রেই লেখা। মুকুল খুব ভালো চিঠি লিখতো। প্রথম কিছু গল্প লিখে আমি বন্ধুদের সাথেই শেয়ার করি। তারা পছন্দ করে। এরপর আমাকে গল্পের ব্যাপারে সত্যিকার কনফিডেন্সটা দেন ইলিয়াস ভাই। আমি গোটা পাঁচেক গল্প লিখে ইলিয়াস ভাইকে পড়তে দিয়েছিলাম। পড়ে তিনিই আমাকে খুব সাহস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন গল্প তোমার লেখা উচিৎ। তিনি আমার ‘হারুনের মঙ্গল হোক‘ গল্পটা তার তৃনমুল পত্রিকায় ছেপেছিলেন।
শিবু: আপনি তো কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সাথে আলাপে বলেছেন যে আপনার লেখা আপনার সেই বন্ধু মুকুলের আনুমোদন নিয়ে তারপর ছাপান।
শাহাদুজ্জামান: বলতো পারো লেখালেখির ব্যাপারে আমার কয়েকজন ব্যাক্তিগত এডিটর আছে। আমার সেই বন্ধু মুকুল, মিলন দা, আমার স্ত্রী পাপাড়িন নাহার। আমার অধিকাংশ লেখা আমি এদের মন্তব্য নিয়ে তারপর ছাপাই। সত্যিকার অর্থে অনেস্ট ক্রিটিক পাওয়া তো দুর্লভ। এদের সাহিত্য বোধ ভালো এবং এরা আমার ক্রিটিকাল ফ্রেন্ড। যেখানে তাদের পছন্দ হয় না সেখানে আমাকে একেবারে ধুয়ে দেয় তারা। লেখালেখি করে আমার এমন কিছু পরিচিত মানুষদের দেখতাম তারা নিজের লেখাটা শুধু তাদেরই পড়তে দেয় যারা তাকে প্রশসংসা করবে। এটা তো মোটামুটি নিজেকে হত্যা করারই ব্যবস্থা করা। আমি সে অর্থে ভাগ্যবান যে আমার কিছু বন্ধু আছে যারা কোনরকম বন্ধুকৃত্য না করে আমাকে একেবারে খোলাচোখে তাদের মতামত জানায়।
শিবু: আপনার একটি লেখার লিখেছেন যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও তার সব লেখা তার বন্ধু জিনু ভাইকে পড়তে দিয়ে তারপর ছাপতেন।
শাহাদুজ্জামান: হ্যা, উনার নাম মাহবুবুল আলম জিনু। জিনু ভাইর মতকে ভীষন গুরত্ব দিতেন ইলিয়াস ভাই। খোয়ারনামা লেখার সময় দেখেছি প্রতিটা চ্যাপ্টার তিনি জিনু ভাইকে পড়তে দিচ্ছেন এবং তার মন্তব্যের ভিত্তিতে ঠিকঠাক করছেন। খোয়াবনামার শেষের একটা পুরো চ্যাপ্টার তিনি বাদ দিয়েছিলেন জিনু ভাইয়ের কথায়।
শিবু: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে আপনার পরিচয়টা কিভাবে।
শাহাদুজ্জামান: ইলিয়াস ভাই আর হাসান ভাই চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন বক্তৃতা দিতে। আমি তখন চিটাগাং মেডিকেলের ছাত্র। ৮৮/৮৯ এর দিকে। হাসান ভাইয়ের সাথে আগেই পরিচয় ছিলো তার সুত্রেই ইলিয়াস ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলো। চিটাগাংএ পুরোটা দিন তার সঙ্গে কাটিয়েছিলাম। দারুন মজাদার, দিলখোলা আবার বিনয়ী একজন চমৎকার মানুষ। ঐ একদিনেই তার সঙ্গে আমার একটা কানেকটিভিটি হয়ে গিয়েছিলো। এরপর তো ঢাকায় নিয়মিত যোগাযোগ হতো তার সঙ্গে। ঢাকা কলেজে, মিউজিক কলেজে, তার বাসায় অগনিত আড্ডা হয়েছে। এরপর তো একরকম তার ঘরের মানুষে পরিনত হয়েছিলাম। ইলিয়াস ভাইয়ের সাথে কাটানো সময়গুলো আমার জীবনে অসাধারন কিছু সময় হয়ে আছে। তাকে নিয়ে আমার কয়েকটি লেখা আছে, আমার ‘লেখালেখি‘ বইটাতে।
শিবু ঃ আপনার গল্প লেখার প্রসঙ্গে আবার আসি। আপনি বলছেন আপনি কখনও কবিতা লিখেন নাই কিন্তু আপনার গদ্যে কবিতার প্রবল প্রভাব লক্ষ করি। আপনার ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ বইটা থেকেই সেটা দেখতে পাই। গদ্যের ভিতরে কাব্যিকতার যে একটা ফরমেট বা ঢং আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটিকে সফল বলি বা অসফল বলি, অনেকে কিন্তু প্রশ্ন তুলছে যে গদ্যের এরকম পয়েটিক ঢংটা দরকার আছে কিনা। আপনার পরবর্তী পর্যায়ের যে গদ্য বা গল্প লিখছেন সে গদ্যের মধ্যে সেই পোয়েটিক জায়গাগুলো অনেকখানিই আপনি অতিক্রম করে যাচ্ছেন, মানে, সেটা ঝেড়ে ফেলারই চেষ্টা আছে বলে আমার মনে হয়। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে এই যে কবিতা লিখছেন না কিন্তু কাব্যিকতা এড়াতে পারছেন না, কাব্যিকতা ঢুকে যাচ্ছে আপনার মধ্যে এটি কি কখনও আপনাকে ভাবিয়েছে?
শাহাদুজ্জামানঃ এটা ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। হ্যাঁ, কবিতা লিখি নাই কখনো কিন্তু কবিতার ভীষণরকম পাঠক ছিলাম। কলেজ জীবনে নিয়মিত আবৃত্তি করতাম। আর জীবনানন্দ তো আমাকে অবসেস করে রেখেছিলো। জীবনানন্দের কবিতা পড়তে গেলেই দেখতাম যে আমি সম্পূর্ন ভিন্ন জগতে চলে যাচ্ছি। কবিতাটা আমাকে রীতিমত একটা অন্য গ্রহে ট্রান্সপোর্ট করছে। তার ভাষার এই শক্তি আমাকে প্রবলভাবে আক্রান্ত করে। জীবনান্দের অনেক কবিতার ভেতরও কিন্তু গল্প আছে। আট বছর আগে একদিন, ক্যাস্পে, হাওয়ার রাত এগুলো তো সব গল্পই, কবিতার ঢঙ্গে লেখা। শব্দকে সাজিয়ে একটা কুহক তৈরী করার যে শক্তি সেটা তো কবিতার মত আর কোন মাধ্যমের নাই। এটা একটা অন্যরকম শক্তি। নাটকের শক্তি, ফিল্মের শক্তি, গল্পের শক্তির চেয়েও পৃথক এ শক্তি। আমি বিভিন্ন মাধ্যমে চলাচল করবার কারনে গল্প যখন লিখতে গেছি তখন অন্যান্য সেই মাধ্যমগুলো অভিজ্ঞতাও কিন্তু আমার ভেতর কাজ করেছে। মনে আছে ‘অগল্প‘ গল্পটাতে গল্প ভাঙ্গার যে ব্যাপরটা আছে সেটা ব্রেখটের নাটকের প্রভাবে হয়েছিলো। আমি ব্রেখটের উপর ওয়ার্কশপটা করে আসার পর পরই গল্পটা লিখেছিলাম। ফিল্মের মন্তাজ ধারনায় সেই যে নানা ইমজের জাকস্টাপজিশন তার প্রভাব আছে ‘চীনা অক্ষর বা লং মার্চ‘ গল্পটায়, ‘কতিপয় ভাবুক‘ গল্পটা রশোমোন ফিল্মটা দিয়ে প্রভাবিত। এভাবে নানা মিডিয়ার অভিজ্ঞতার প্রভাব আমার গল্পে আছে। একইভাবে সাহিত্যের নানা শাখার অভিজ্ঞতাও ঢুকেছে আমার গল্পে। আমি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এসবের দেয়ালগুলো ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করেছি। প্রতিটা সাহিত্য শাখার তো একটা নিজস্ব প্রবনতা আছে, শক্তি আছে, আমি গল্পে নানা শাখার সেই শক্তিগুলোকে মেলাতে চেষ্টা করেছি। যেমন প্রবন্ধের একটা মুল প্রবনতা হচ্ছে একটা আর্গুমেন্ট দাঁড় করানো।
শিবুঃ একটা চিন্তা হাজির করা।
শাহাদুজ্জামানঃ শুধু চিন্তা না, একটা আর্গুমেন্টে। একটা প্রস্তাব।
শিবুঃ একটা তাত্ত্বিক প্লাটফর্ম তৈরী করা
শাহাদুজ্জামানঃ হ্যা। কিন্তু একটা আর্গুমন্টে দাঁড় করানো, তত্ব খাড়া করার দায় গল্পের নাই। গল্পের ভেতর একটা ন্যারেশন, চরিত্র, ঘটনা ইত্যাদির দাবী থাকে। অন্যদিকে কবিতায় কিন্তু শুধুমাত্র শব্দ সাজিয়ে বিশেষ একটা আবহ তৈরী করা হয় মাত্র, একটা এ্যাটমোসফিয়ার।
শিবুঃ এক ধরণের ট্রান্স ।
শাহাদুজ্জামানঃ হ্যাঁ, একটা ট্রান্স। তো আমি কিন্ত গল্পে অনেক সময়ই চেষ্টা করি এই তিনধরনের প্রবণতাগুলোকে একত্রিত করতে। যেমন ধরো আমার ‘কাঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার‘ গল্পটা। এর ভেতর সরাসরি কোন গল্প নাই আবার একটা বেশ প্রমিমেন্ট গল্পও আছে। ঐযে কাঁঠাল পাতার সাথে মাটির ঢেলার বন্ধুত্বের গল্পটা। কিন্তু সেখানে ঐ গল্পটা কিন্তু প্রধান না। ঐ ছোট্ট্ গল্পটাকে বলবার জন্য এর আগে আমি অনেক গুলো কথা বলছি, এই গল্পটা কেন এবং কাদের জন্য এরকম একটা আর্গুমেন্ট তৈরী করেছি। গল্পে একটা প্রবন্ধের প্রবনতা আনা বলতে পারো। আবার পুরো গল্পের ভাষাটাতে একটা কবিতার আমেজ আছে। আমি আসলে একটা কবিতা দিয়ে অনুপ্রানিত হয়েই গল্পটা লিখেছিলাম। কোথায় পড়েছিলাম কবিতাটা, কবির নাম মনে নেই কিন্তু সেই কবিতার কিছু ইমেজ, শব্দ মাথায় ছিলো। তো ঐ গল্পটাতে এমন একটা ভাষা ব্যবহার করেছি যাতে একটা মিষ্ট্রির এ্যাটমোস্ফেয়ার তৈরী হয়েছে যা কবিতার বৈশিষ্ট্য। তো এই গল্পে কিন্তু সেই অর্থে গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা সব শাখারই উপাদান আছে। আমার অধিকাংশ গল্পে কিন্তু এই চেষ্টাটা আছে। তো তুমি কবিতা প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটা করলে সে প্রেক্ষিতে বলবো যে আমার এই লেখাগুলিকে আমি সাহিত্যকর্ম হিসেবে দেখি যেখানে নানা শাখার বৈশিষ্টগুলো এসে মিশেছে। ক্যাটাগরী করার সুবিদার্থে একে গল্প বলা হচ্ছে হয়তো।
শিবুঃ যেমন সিনেমার ক্ষেত্রে এই আর্গুমেন্টটা বা এই ঝামেলাটাও আছে যে কোনটা ডকুমেন্ট্রি আর কোনটা ফিকশন। এ নিয়ে একটা একটা তর্ক আছে । মদ্দা কথা তো এই যে এখানে দুইটাই চলচ্চিত্র কিন্তু সেটাকে আমরা আমাদের প্রয়োজন মনে করে ফিকশন করছি বা ডকুমন্টোরী করছি। দুটাকে মিলিয়েও দিচ্ছি । আপনার ‘বিসর্গতে দুঃখ’সেটাকে আমরা কি কোন নিরীক্ষামুলক উপন্যাস বলবো নাকি বড় গল্প বলবো?
শাহাদুজ্জামানঃ আমার ‘বিসর্গতে দুঃখ‘ গল্প না উপন্যাস না প্রবন্ধ এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। আমি আবারো বলবো আমি একে সাহিত্য কর্ম মনে করি। সুবিধামত বিশেষ একটা তকমা এটাকে পড়ানো যায়। শহীদুল জহির বিসর্গতে দুঃখ বইটাকে বলেছিলেন মেটাফিকশন। বইটা নিয়ে তিনি একটা রিভিউ লিখেছিলেন। ওটাই তার জীবনের একমাত্র বুক রিভিউ।
শিবুঃ আপনার গল্পে আইডিয়াগুলো অসাধারন। আপনার মহাশুন্যে সাইকেল গল্পটাতে এই যে দূরতে¦র আইডিয়াটা, তা চমৎকার। কিম্বা কাঠাল পাতা-মাটির ঢেলা গল্পটা। আমি ঐ গল্পটার কথা আবারো বলছি একারণে যে, এত ছোট একটা গল্প, শুধুমাত্র আইডিয়ার উপরে এবং গল্পটা বেসিক্যালি হচ্ছে ৫/৬ লাইনের , কিন্তু গল্পটা বলার জন্য আপনি একধরণের ভ’মিকা তৈরী করেছেন অনেক বড়, এবং বলতে গেলে ১/২ পৃষ্ঠার ঐটুকু ভুমিকাটাই আসল, তাতেই আপনি গল্পটা বলেছেন। আপনার ‘তারপর যেতে যেতে’ গল্পটার আইডিয়া কিন্তু দারুন। ম্যাজিক রিয়ালিজমের একটা গন্ধটা আছে, তারপরও এটা আসলে আমাদেরই গল্প, এখানকারই গল্প, আমাদের লোকগাঁথাতেও এভাবে অনেক গল্পে উঠে আসে। তো আমি বলছি আইডিয়ার এক ধরণের স্বতঃস্ফুর্ত এবং ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা আছে আপনার গল্পের মধ্যে। আইডিয়ার কারণে সেটা অনেক উজ্জ্বল। কিন্তু আমি জানতে চাই আইডিয়াটা কি কখনও কখনও বোঝা হয়ে যায় কিনা। আইডিয়া কি আপনার গল্পের শিল্পগুন ছাপিয়ে ওঠে কিনা। কোন রকম হাইয়ারার্কি তৈরী হয় কিনা। আইডিয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে শিল্পগুনটাকে কম্প্রোমাইজ করতে হয় কিনা?
শাহাদুজ্জামানঃ খুব ভাল প্রশ্ন করেছো। হ্যাঁ আমার গল্পকে ডিক্টেট করে কিন্তু আইডিয়া বা থিম কোন ঘটনা বা চরিত্র না। কাহিনী আমাকে ডিক্টেট করে না, আইডিয়া ডিক্টেট করে। আমি শুরু করি একটা আইডিয়া থেকে এবং সে আইডিয়াটা একটা কাহিনীর ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করি। তুমি একদম ঠিক বলেছো যে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে আইডিয়া এবং সাহিত্যগুনের একটা সাংঘর্ষিক সম্পর্ক হতে পারে। হাইরার্কি তৈরী হতে পারে। যেটা তুমি বললে যে, আইডিয়া না স্টোরি বা সাহিত্যগুণ বিচার, কোনটা বড় রোল প্লে করে, সেটাই আমার টোটাল গল্প লেখার স্ট্রাগলের জায়গা। আমি ব্যালেন্স করার চেষ্টা করি, সচেতন থাকি। কিন্তু সবসময় সফল হই তা বলবো না।
শিবু ঃ আপনার মহাশূন্যের সাইকেল গল্পে ব্যক্তির যে বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তির যে কন্টে¤েপারারি ক্রাইসিস সেটি চমৎকারভাবে এসেছে। একজন মানুষ তার নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছে, অনেকটা নিজের আদালতে নিজে দাঁড়িয়ে জবাদিহিতা করছে, নিজেকে মোকাবিলা করছে। এই যে গল্পে ব্যক্তিকে এরকম একটা নিঃসঙ্গ জায়গায় দাঁড় করানো সেটা অসাধারণ। এখানে আপনি ব্যাক্তির বিচ্ছিন্নতা, এলিনিয়েশন, পুঁজিবাদী সমাজের ক্রাইসিস ইত্যাদি অনেক আইডিয়াকে উপস্থিত করছেন। এতে আপনার কি মনে হয়েছে যে গল্পটা একটু ভারী হয়ে গেছে, গল্পের স্বতঃস্ফুর্ততা ব্যাহত হয়েছে?
শাহাদুজ্জামানঃ আমি যেহেতু জানি যে গল্পে আমি মোটামুটি ভারি একটা আইডিয়া নিয়ে ডিল করছি সেহেতু আমার চেষ্টা থাকে গল্পটাকে এন্টারটেইনিং করা, মজার করা। যাতে পাঠকের এটেনশনটা থাকে, গল্পটা শেষ পর্যন্ত পড়ে এবং তারপর একটা ভাবনা দ্বারা তাড়িত হয়। রাস্তার পাশে ক্যানভাসাররা যারা অসুধ বেচে দেখবে, অসুধের কথায় আসার আগে ডুগডুগি বাজায়, নানারকম খেলা দেখায়, ম্যাজিক-ট্যাজিক দেখায় লোকসব জড়ো হলে তারপর ঔষধের কখা তোলে। আমিও গল্পে কিন্তু অনেকটা এই ব্যাপারটা করি। মহাশুন্যে সাইকেল গল্পে কিন্তু শুরুতে নানা ফানি সব ব্যাপার আছে। লোকটার স্ত্রী গোল্ড ফিস পোষে, ছেলে স্কুল থেকে এসে ডিম খায়, লোকটা ছেলের সাথে ফোনে নিজেকে চেয়ে মজা করে। তো এসবরে ভেতর দিয়ে পাঠকের কিউরিসিটিটা আমি জারি রাখি। তারপর বিচ্ছিন্নতা, এলিনিয়েশন ইত্যাদি ভারী ব্যাপারগুলো আসে শেষের দিকে। ফান করে টোপ দিয়ে গেথে ফেলে ঔষধটা শেষে বেচা, ওরকম ব্যাপার আর কি। শেষের দিকে পৌঁছে পাঠক কিন্তু একটা অস্তিত্ববাদী প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে যায়। কাঁঠাল পাতা মাটির ঢেলার গল্পেও কিন্তু সে ব্যাপারটা হয়।
শিবুঃ কিন্তু এখানে আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে গল্পের তো একটা নিজস্ব শক্তি আছে, সিনেমাতে আমরা যেমন বলি না যে ইমেজ অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয়। ইমেজ এখানে প্রতিনিধিত্ব করে। তো আমি বলতে চাচ্ছি যে, গল্পে ইটসেলফ তার নিজস্ব স্বতঃস্ফুর্ত প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে সেইটা কি এচিভ করা সম্ভব? আপনার সাহিত্যের যে পাঠক যাদের কে আপনি এই ইনফরমেশনটা দিচ্ছেন, আমি বলব যে আপনি এই গল্পকে বা আপনার সাহিত্যকে আধার করে আপনার যে রাজনৈতিক এজেন্ডা বা সমাজের প্রতি আপনার একধরণের যে কমিটমেন্ট সেগুলাকে সার্ভ করতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে গল্পের সাথে আপনার স¤পর্কটাতো একধরণের এক্সপ্লয়টেশনের জায়গায় চলে যাচেছ। গল্পটাকে আপনি ব্যবহার করছেন আপনার একটা পারপাস সার্ভ করার জন্য।
শাহাদুজ্জামানঃ ইন্টারেস্টিং আর্গুমেন্ট তোমার। এখন আমার সাহিত্য করার ক্ষেত্রে ন্যারো অর্থে কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। বৃহৎ অর্থে হয়তো আছে। তুমি আরেকটা শব্দ ব্যবহার করলে, কমিটমেন্ট। হ্যাঁ আমার সাহিত্য করার পেছনে কমিটমেন্ট আছে। আমার কমিমেন্ট হচ্ছে যে আমার লেখা মানুষকে শুধু উপরিতলে এন্টারটেইন করবে না, গভীর ভাবনাগুলো দিয়ে তাড়িত করবে। এই লেখা জীবনকে যাপনে সাহায্য করবে। সত্যি বলতে প্রত্যেকটা মানুষকে এট দি এ্যান্ড অফ দি ডে এই সমাজকে,পৃথিবীকে, পারিপার্শ্বের মানুষকে একা মোকাবেলা করতে হয়। জীবনের গভীর অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু প্রায়ই আমরা পথ হারাই। সেই কপাল কুন্ডলা যেমন বলেছিলো, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো? আমরা পথ হারাই। এই পথ খুঁজে নেবার জন্য নানা কিছু আমাদের সাহায্য করতে পারে। সাহিত্যও করতে পারো। আমার জীবনকে করেছে। পৃথিবীটা তো শুধু সাদা কালো না, এখানে অনেক ধুসর জায়গা আছে। সাহিত্য সেই ধুসর জায়গায় আলো ফেলে। এই যে আমরা অধিকাংশ মানুষ একটা উপরিতলের জীবন যাপন করে চলেছি, কনজিউম করে চলেছি, এখন আমাদের জীবন তো বেষ্ট পসিবল আইডিয়া দিয়ে গাইডেড না। এই উপরিতলের জীবনের নীচে যে গভীর প্রশ্নগুলো আছে আমরা সেই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে চাই না বা হওয়ার সুুযোগ পাই না। সাহিত্য আমাকে সেইসব গভীর আইডিয়াগুলো, প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি করেছে। জীবন আমার কাছে অনেক সহনীয় হয়েছে, অর্থবহ হয়েছে। সুতরাং আমি নিজে যখন সাহিত্য করতে শুরু করেছি তখন আমিও সেই ধরনের সাহিত্যই করতে চেয়েছি যা শুধু পাঠককে নিছক আনন্দ দেবে না তাকে জীবনের বৃহত্তর আইডিয়াগুলোর মুখোমুখি করবে। লেখালেখি আমার কাছে জীবনের একটা অর্থ খোঁজারই উপায়। এটা আমার একটা জার্নি। আমি চাই আমার পাঠকরাও আমার সেই জার্নির সহযাত্রী হোক। মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি তো তার চিন্তার ক্ষমতায়, আবেগ অনুভুতির তীব্রতায়। কিন্ত আমরা তো ক্রমশ চিন্তাহীন, আবেগহীন এক একটা ভোগী জন্তুতে পরিনত হচ্ছি। তো তুমি বলছিলে গল্পকে আমি এক্সপ্লয়েট করি কিনা, ব্যবহার করি কিনা। তা তো করি। গল্পকে এক্সপ্লোয়েট করি পাঠককে এন্টারটেইন করার জন্য না, আমি গল্পকে ব্যবহার করি মানুষের থটকে প্রভোক করতে। গল্পের মধ্য দিয়ে আমি পাঠককে নিজেদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চাই। প্রশ্ন তাড়িত করতে চাই। সেটাকে যদি রাজনৈতিক এজেন্ডা বলতে চাও, বৃহত্তর অর্থে বলতে পারো।
শিবু ঃ তাছাড়া আপনার একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী তো আছেই। আপনার ক্রাচের কর্নেল উপন্যাসটির ভেতর দিয়ে তার একটা পরিচয় আপনি দিয়েছেন। এটা নিয়ে বিতর্ক আছে যে এটা উপন্যাস হয়েছে কি হয় নাই। আপনি ক্রাচের কর্নেলে আমাদের অফিসিয়াল হিস্ট্রির বাইরের, বিস্মৃত একজন চরিত্রকে তুলে নিয়ে এসেছেন। একটা কাউন্টার হিস্ট্রি হিসেবে আপনি তা তৈরী করেছেন। তো প্রথম উপন্যাসটাই আপনি একটা সামজিক দায়বদ্ধতা থেকে লিখলেন। উপন্যাসটা নিয়ে তো অনেক সাড়াও পেয়েছেন আপনি। ক্রাচের কর্নেল পরবর্তি প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটু বলেন।
শাহাদুজ্জামানাঃ ক্রাচের কর্নেল বিষয়ে তো বিভিন্ন জায়গায় আমি বলেছি, লিখেছি। নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এই বইটা তো আমার বইগুলোর ভেতর সবচেয়ে বেশী পঠিত। এটার চতুর্থ সংস্করন চলছে। তো বইটা অনেকে পড়ছে সেটা বোঝা যায়। আমি অসংখ্য মেইল পেয়েছি যারা বইটি পড়ে উচ্ছসিত হয়ে লিখেছেন। বিশেষ করে তরুন প্রজন্ম। তারা ইতিহাসকে নতুন করে দেখতে পেয়ে ভীষনভাবে আপ্লুত হয়েছে। তিনবছর আগে বইটি প্রকাশিত হয়েছে আমি এখনও ইমেইল পাই। পৃথবীর বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্গালীদের কাছ থেকেও ইমেইল পাই। সেদিন আমেরিকা থেকে এক তরুন লিখেছে সে প্রতিদিন কাজে যাবার সময় টিউব ট্রেনে বসে বইটি পড়তো সে। বইটি যেদিন শেষ হয়েছে, শেষ দৃশ্যে এসে সে ঐ টিউবেই পড়তে পড়তে ডুকরে কেঁেদ উঠেছে এবং বেশ একটা বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তো এরকম নানা প্রতিক্রিয়ার চিঠি আমি পেয়েছি। দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ ক‘জন রাজনীতিবিদ বইটি পড়েছেন আমি খোঁজ পেয়েছি। বইটিতে শেখ মুজিবের অবস্খান নিয়ে ভিন্নমূখী মন্তব্য পেয়েছি। যারা মুজিব বিরোধী তারা আমাকে বলেছেন আমি এ বইয়ে মুজিবকে যথেস্ট ছাড় দিয়েছি আবার মুজিব ভক্তরা বলেছেন আমি মুজিবকে যথাযথ সন্মান দেইনি। কারো কাছে মনে হয়েছে আমি কর্নেল তাহেরকে অনেক বেশী গ্লোরীফাই করেছি, ক্রিটিকালী দেখিনি। আবার কেউ প্রশ্ন তুলেছেন যেটা তুমি বললে যে এটা ঠিক উপন্যাস হয়েছে কিনা। পত্রিকাতে এ নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। এখন একটা বই প্রকাশিত হয়ে গেলে সেটা তো পাঠকের সম্পত্তি। সুতরাং তারা যার যার জায়গা থেকে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। বইটা যে একটা আলোচনার জন্ম দিয়েছে সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন।
শিবু : আপনিতো ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেলেন। ক্রাচের কর্নেলকে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবেই ক্যাটাগোরাইজ করা যেতে পারে। ইলিয়াস এর খোয়াবনামা যে অর্থে ঐতিহাসিক আপনার ক্রাচের কর্নেল সে অর্থে ঐতিহাসিক না। আমি একটা অন্য ইস্যুতে যাচ্ছি হুমায়ুন আহমেদ এর সাম্প্রতিক উপন্যাস দেয়াল নিয়ে যে কন্ট্রোভার্সি তৈরী হয়েছে সে বিষয়ে। এটাও একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই বিতর্ক হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে, এখানে শেখ মুজিবুর রহমান বা ইতিহাস বিকৃত হয়েছে এ রকম প্রশ্ন উঠেছে। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে যে, এই যে রাষ্ট্র কর্তৃক সাহিত্যের উপর ছড়ি ঘুড়ানো, আবার একজন লেখক যখন ঐতিহাসিক কোন চরিত্র ডিল করছেন তখন তার দায়বদ্ধতা ভুলে গিয়ে তিনি তার মতো করে একটা গল্প তৈরী করছেন এই দুইটা বিষয়কে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
শাহাদুজ্জামান: এ ইস্যুটা জটিল। ইতিহাসের দায় আর লেখকের স্বাধীনতা এই দুইটা খুব ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট বিষয় না। হাইকোর্টের ডিক্রির মাধ্যমে একটা উপন্যাসের চরিত্র সৃষ্টি করা তো কোন কাজের কথা না। কিন্তু আমি লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে ইতিহাসের একটা চরিত্রকে আমার নিজের মত করে তৈরী করে বললাম যে এটা ইতিহাস বিকৃতি না এটা বিকল্প ইতিহাস তাহলেই তো হলো না। প্রশ্ন জাগবে কোনটা বিকল্প ইতিহাস আর কোনটা ইতিহাস বিকৃতি সেটা কে নির্ধারন করবে? এটা বিচারের মাপকাঠিটা কি? দুটার ভেতর সীমারেখাটা কোথায়? আবার ইতিহাসের দায়টাই বা কোন পারসপেকটিভ থেকে দেখা হবে? এখন যদি গোলাম আযমকে হিরো করে কেউ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটা উপন্যাস লেখে, লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে সে মুক্তিযুদ্ধের একটা বিকল্প ইতিহাস লেখে যেখানে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধে জয় হয়েছে রাজকারদেও, তখন আমার ষ্টান্ডটা কি হবে? এখানে একটা কথা বলি জামার্নীতে এখনও কোন বা”্চার নাম হিটলার রাখা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ, হিটলারের প্রতি সহানুভুতি জাগে তেমন কোন সাহিত্য রচনাও নিষিদ্ধ। কিন্তু চাইলে তো হিটলারকে বিকল্পভাবে দেখারও অনেক সুযোগ আছে। হিটলার পেইন্টার হতে চেয়েছিলেন, বই লিখেছেন। অসাধারন বক্তা ছিলেন। তিনি প্রচুর লেখাপড়া করতেন। তার কাজের একটা দার্শনিক ভিত্তিও ছিলো। গীতা তার খুব প্রিয় বই। কৃষ্ণ যে অর্জুনকে বলছে, ‘প্রয়োজন হলে তুমি তোমার নীতির প্রশ্নে তোমার বিবেকের বিরুদ্ধে যাবে।‘ এটা কথটা হিটলারের প্রিয় ছিলো জানিয়েছেন। কোটি কোটি ইহুদীকে যে মারা হচ্ছে এটা তার বিবেকের কাছে খারাপ লাগতে পারে কিন্তু তিনি তো জানেন যে ইহুদিদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহৃ করা তার নৈতিক দায়িত্ব। সুতরাং তাদের গ্যাস চেম্বারে পাঠাতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। তো এই হিটলারকে হিরো বানিয়ে বিকল্প ইতিহাস লেখা যাবে না কেন? এখনেই হচ্ছে কথা। লেখকের স্বাধীনতা তো মামার বাড়ির আবদার না। এখানে গ্রেটার হিউমেনিটির প্রতি দায়ের প্রশ্ন আছে, মহাকালের প্রতি দায়ের প্রশ্ন আছে। যে আদর্শের উপর ভিত্তি করেই হোক না কেন হিটলার মানবসভ্যতার উপর যে ভয়াবহ ক্যাটাস্ট্রফ ডেকে এনেছে তার জন্য তো তাকে পে করতে হবে। তা না হলে তো মহাকালের সাথে প্রতারনা করা হবে। তারপর এখন সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭০/৮০ বছর পর এখন হিটলার নিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে। হিটলারের শেষ দিন নিয়ে সেদিন একটা সিনেমা দেখলাম। তার দ্বিধা, দ্বন্দ্বগুলো আনা হয়েছে। এখন এত বছর পর নানা কিছু ক্লোজারের পর জার্মানরা কিছুটা ফ্ল্যাক্সিবল হবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সুতরাং কনেটেক্সট ফ্রি স্বাধীনতা বলে তো কিছু নাই। টাইম কনটেক্টেটের একটা গুরুত্বপুর্ন উপাদান। কখন কি বলা হচ্ছে সেটা দেখা জরুরী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহুকিছু তো এখনও অমীমাংসিত। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ৭১ এর যুদ্ধ ইন্ডিয়া পাকিস্তান ওয়ার হিসেবে পরিচিত, শর্মিলা বোস নামের এক গবেষক তো গবেষনা করে দেখাচ্ছেন যে বাংলাদেশে পাকিস্তানীরা কোন রেপই করেনি। এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও হয়নি। তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো এমনিতেই এক নাজুক অবস্থায় আছে, সেখানে লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে কি ধরনের বিকল্প ইতিহাস রচনা করতে চায় একজন সেটা দেখার ব্যাপার আছে। ইতিহাসকে নতুনভাবে ইন্টারপ্রিট করার সুযোগ নিশ্চয়ই আছে। আমি ক্রাচের কর্নেলে সে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা তো এভিডেন্স বেইজড হতে হবে। মুজিব হত্যার পুরো কনটেকস্টটা আমি আমার বইয়ে ধরবার চেষ্টা করেছি। এখন হুমায়ুন আহমেদ ঐ দেয়াল বইটা পুরোটা লেখার সুযোগ পাননি ফলে পুরোটা না পড়ে ঐ লেখাটা নিয়ে কোন মন্তব্য করা ঠিক না। তবে যতটুকু পড়েছি তাতে তো নানা বিভ্রান্তি আছে। উনি শুরু করছেন মেজর ফারুককে দিয়ে যিনি যুদ্ধের অবসরে জঙ্গলে বসে শরবত খাচ্ছেন, দুর্ধর্ষ কোন পাকিস্তনী সেনাকর্তাকে হত্যা করছেন ইত্যাদি। এখন কথা হচ্ছে ফারুক বাংলাদেশে ঢুকেছেন দেশ স্বাধীন হবার চারদিন আগে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল তখন অলরেডী স্বাধীন। সুতরাং ফারুকের ওমন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কোন সুযোগই নাই। তিনি নয়মাস ধরে মিডল ইষ্টে কি করছিলেন সেগুলো নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। খন্দকার মোশতাককেও তিনি ফানিভাবে উপস্থিত করেছেন। এখন এইসব চরিত্রকে এভাবে প্রেজেন্ট করে তিনি কি বিকল্প ইতিহাস উপস্থাপন করতে চাচ্ছিলেন সেটা তো তার পুরো লেখাটা না পড়ে বলা মুশকিল। ফারুক, মোশতাক এরা তো সয়ম্ভু কোন চরিত্র না যে নিজেরা বসে বসে নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা আভ্যান্তরীন এবং আন্তর্জাতিক নানা পাওয়ার প্লেকে সার্ভ করেছে। হুমায়ুন সেই বিগ পিকচারটা মাথায় রেখেছেন কিনা সেটা তো দেখবার ব্যাপার আছে। হুমায়ুন আহমেদের ব্যাপার হচ্ছে উনি তো প্রায় লেখাতেই একধরনের ক্যাজুয়াল এপ্রোচ নেন, একটা ঠাট্টা তামাশার আবহ তৈরী করেন। তিনি এনটারটেইন করতে চান। তার লেখলেখির ভেতর একটা ম্যাজিসিয়ান এপ্রোচ আছে। তিনি নিজেও তো ম্যাজিক দেখাতেন শুনেছি। ম্যাজিশিয়ানের আলটিমেট পারপাজ হচ্ছে এনটারটেইন করা, চমকে দেয়া। আমরা যতক্ষন ম্যাজিকের কোন পারফরমেন্স দেখি ততক্ষন বেশ মুগ্ধ হয়ে থাকি। দ্যাট ইজ দি এ্যান্ড অফ ইট। ম্যাজিক শেষ, মজা শেষ। এরপর আর এটা নিয়ে ভাবনা চিন্তার কিছু নাই। হুমায়ুন আহমেদের অনেক লেখার ভেতরই এই প্রবনতা আছে। পাঠক পড়তে শুরু করলে একধরনের মজা পায়, এনটারটেইনড হয় কিন্তু বইটা বন্ধ করার পর মাথায় আর কিছু নাই। এরপর পরবর্তী ম্যাজিক শো দেখার অপেক্ষা। এখন অনেক বিষয় নিয়ে লেখতে গেলে এই এপ্রোচ কাজ করলো হয়তো কিন্ত ইতিহাসের এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এই এপ্রোচ কতটা সফল হবে তাতে সন্দেহ আছে। এটা তো ফানি কোন ব্যাপার না।
শিবু: অন্য একটা প্রসঙ্গ। আপনার লেখালেখিতে জীবনানন্দ দাস নানাভাবে এসেছে দেখেছি। আপনার গল্পের শিরোনামের ক্ষেত্রেও আপনি জীবনানন্দ হুবহু ব্যাবহার করেছেন। আপনার বইয়ের নাম ‘পশ্চিম মেঘে সোনার সিংহ‘ বা গল্পের নাম ‘ঘাসের উপর সবুজ বাতাস‘ এগুলো তো সরাসরি তার লাইন। আমি নিজেও কিন্তু আমার অনেক নাটকে আপনার গল্পের নাম হুবহু ব্যাবহার করেছি, ‘হারুনের মঙ্গল হোক‘, ‘মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া‘। আপনি একজায়গায় তারকোভস্কির নষ্টালজিয়া ছবির একটা সংলাপও ব্যাবহার করেছেন, ‘এক ফোঁটা পানি আর একফোটা পানি মিলে দুই ফোটা পানি হয় না হয় বড় এক ফোঁটা পানি।‘ তো এই যে আপনি অন্যের লেখা ব্যবহার করছেন বা আমি আপনার শিরোনাম ব্যবহার করছি এগুলো কি প্লেজারিজম?
শাহাদুজ্জামান: সাহিত্যে প্লাজারিজমের ধারনা তো গবেষনা পত্রে প্লেজারিজমের ধারনার মত না। অন্যের লেখা তো আমার অভিজ্ঞতারই অংশ। এখন কারো ভীষনভাবে ভালো লেগে যাওয়া একটা লাইনকে আমি আমার লেখার ভেতর দিয়ে একটা নতুন জীবন দিয়ে দিতে পারি। সাহিত্যে এ রেওয়াজ তো পুরনো। কিন্তু কারো পুরো একটা আইডিয়াকে, লেখার পুরো একটা অংশকে নিজের বলে চালিয়ে দিলে সেটা তো প্লেজারিজম। কিন্তু ওমন একটা দুইট লাইন তো হরহামেশা ব্যাবহার হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিখ্যাত লোকদের লাইন ব্যবহার করা সেইফ কারন সবাই জানে এটা কার কথা। আলাদা করে রেফারেন্স দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার কিছু নাই। রবীন্দ্রানাথের কবিতার লাইন তো তিরিশ দশকের কবিরা অবিরাম তাদের কবিতার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমি তো লাইন ব্যবহার করেছি কেউ কেউ তো একই নামে আরেকটা বই লিখে ফেলেন। যেমন সন্দীপন চট্ট্রোপাধ্যায় মার্কেজের লাভ ইন দি টাইম অব কলেরা নামটা ব্যবহার করেই তার উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ‘কলেরার দিনগুলিতে প্রেম‘।
শিবু: আমি যতটুকু জানি যে জীবনান্দ দাশ নিয়ে আপনি একটা উপন্যাসের প্লট চিন্তা করছেন। জীবনানন্দ দাশের সাথে আপনার এক ধরনের বোঝাপড়ার চেষ্টা করছেন। জীবনানন্দ কেন গুরুত্বপূর্ণ আপনার সাহিত্যে?
শাহাদুজ্জামান: ঠিকই বলেছ যে আমি জীবনান্দের লাইফের উপর ভিত্তি করে একটা ফিকশন লেখার চেষ্টা করছি। তো তুমি যে প্রশ্নটা করলে জীবনানন্দ কেন আমার কাছে গুরুত্বপুর্ন ঐ বইয়ে সেই প্রশ্নের উত্তরই আমি দেওয়ার চেষ্টা করবো। বলতে পারো জীবনানন্দের সাথে আমার একটা নিজস্ব বোঝাপড়া, যেটা তুমি বললে। বহুদিন ধরেই জীবনানন্দ আমার সঙ্গে আছেন। তার মত করেই বলতে হয় আলো অন্ধকারে যাই আমি তারে পারি না এড়াতে। তো জীবনানন্দ নিয়ে আমার যে ফাসিনেশন আমি সেটাকেই ইনভেস্টিগেট করবো। আমি গল্প লিখলেও জীবনানন্দের কবিতার এপ্রোচ দিয়ে আমি প্রভাবিত। উনি কিন্তু খুব সহজ শব্দ ব্যবহার করে কবিতা লেখেন। সুধীনন্দ্রনাথ দত্তের মত তার কবিতা পড়াবার জন্য ডিকশনারী খুলে বসতে হয় না। খুব চেনা জানা শব্দকে এমনভাবে এরেঞ্জ করেন যে একটা ধান্ধা লাগিয়ে দেন, গভীরতর প্রশ্নের দিকে টেনে নিয়ে যান। এই যে ঘাসের উপর সবুজ পাতা লাইনটা বললে। উনি লিখছেন, ‘ঘাসের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবুজ বাতাস‘, তারপরই কন্ট্রাডিক্ট করে বলছেন ‘অথবা সবুজই বুঝি ঘাস।‘ খুব সোজা কথাবার্তা, কোন কঠিন শব্দ নাই। কিন্তু তিনি ডেলিবারেটলি একটা ঝামেলা তৈরী করেছেন। এখন ঘাস তো সবুজ আমরা জানি। কিন্তু তিনি একটা রহস্য তৈরী করছেন যে ঘাসটা কি আসলে সবুজ? নাকি আসলে বাতাসটা সবুজ বলে ঘাসটা সবুজ হয়ে গেছে। একটা অদ্ভুত ভাবনার ভেতর তিনি ফেলে দিলেন পাঠককে। ফর গ্রান্টেড একটা ব্যাপারকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করলেন, একটা জালে আটকে ফেললেন। আমার নিজের গল্পে কিন্তু সেই চেষ্টা থাকে। সহজ বাক্যে, সহজ ন্যারেটিভ। পাঠককে শুরুতেই আমি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেই না, পাঠককে গল্পের ভেতরে ঢুকবার পথটাকে সহজ করে রাখি।
শিবু:: ক্রিকেটারদের লুজ বল দেওয়ার মতো...
শাহাদুজ্জামান: ভালো বলছো। হ্যা, লুজ বল দেয়ার মতই। দেখতে এপারেন্টলি সিম্পল মনে হলেও ভেতরে বিপদ আছে। জীবনানন্দ শব্দ দিয়ে একটা ম্যাজিক আবহ তৈরী করে জীবনের গভীর গভীরতর সব প্রশ্ন তোলেন। তিনি লিখেছেন না যে আঁধার দেখেছি, আছে আরো বড় অন্ধকার। সেইসব অন্ধকারে আলো ফেলেন তিনি। বয়স যত বাড়ছে দেখছি জীবনের কত আলো আধারি জায়গা, এমবিগুইট, আনসারটেইনিটি। সাহিত্যে এগুলোকে অসাধারনভাবে চর্চা করেছেন জীবনানন্দ। সময়ের সাথে সাথে তিনি বদলেছেন। তার বনলতা সেন থেকে সাতটি তারার তিমির অনেক ভিন্ন। তখন জীবনের আরো জটিল প্রশ্নগুলো দিয়ে তাড়িত তিনি। শুধু কবিতা তো না, কি বিশাল তার কাজের পরিমান। আমি আরেকটা লেখায় লিখেছিলাম কিভাবে সেই টুটেনখামেনের পিরামিড আবিষ্কার হবার মত আবিস্কার হলো জীবনানন্দের লেখা ভর্তি ট্যাঙ্কগুলো। কয়েক শত গল্প, ঢাউস আকারের অনেকগুলো উপন্যাস। আমি তো সেইসব গল্প উপন্যাস পড়ে স্তম্ভিত। তিরিশ চল্লিশ দশকে লেখা সেইসব গল্পের, উপন্যাসের কি অভিনব সব বিষয়, এ্যপ্রোচ। তিনি একটাও ছাপালেন না। ছাপালে জীবনান্দকে কবি না কথাসাহিত্যিক কোন পরিচয়ে চিনবো সেটা এক সংকট হতো। কত অগনিত বিষয়ে যে তিনি লিখেছেন। নির্জন, উইথড্রন মানুষ বলে তার পরিচিতি আছে কিন্তু কনটেমপোরারী সব ব্যাপারে চোখ কান খোলা ছিলো তার। নিউক্লিায়ার পাওয়ার নিয়ে লিখেছেন তিনি, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লিখেছেন। তার বেকারত্ব, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক, বন্ধুহীনতা, অর্থকষ্ট, ট্রামের নীচে পড়া এসব মিলিয়ে তার ব্যাক্তিজীনটাও কৌতুহলোদ্দীপক। তার ডায়রীগুলোর ভেতর পাই আরেক জীবনান্দকে। তো এই মানুষটাকে যত জানছি তত বিস্মিত হচ্ছি। জীবনান্দের যত লেখা বেরিয়েছে সেগুলো পড়ছি, তাকে নিয়ে যত রকম কাজ হয়েছে সেগুলোর উল্লেখযোগ্য সব যোগাড় করেছি, পড়ছি, নোট রাখছি। তারপর লিখতে বসবো। এটা একটা ফিকশনই হবে কোন গবেষনার বই না।
শিবু: এই যে আপনি ব্যাক্তিত্বভিত্তিক কাজ করছেন। তাহেরকে নিয়ে ক্রাচের কর্নেল করছেন। এখন জীবনানন্দকে নিয়ে করতে চাচ্ছেন। এতে কি একটা পৌনপুনিকতার ব্যাপার হয়ে যাবে?
শাহাদুজ্জামান: আমি কিন্তু একেবারে কমপ্লিট ভিন্ন ঘরানার মানুষকে নিয়ে কাজ করেছি। তুমি তাহেরের কথা বললে আমার কিন্তু চ্যাপলিন নিয়েও একটা বই আছে। এখন আমি কাজ করতে চাচ্ছি জীবনানন্দ নিয়ে। তাহের, চ্যাপলিন, জীবনানন্দ এই যে একেবারে ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ নিয়ে কাজ করছি এতে কিন্তু আমি শুধু তাদের কথাই বলছি না, প্রকারন্তরে আমার নিজের কথাও বলছি। এতো মানুষ থাকতে বেছে বেছে এই মানুষগুলো সম্পর্কে কাজ করার মধ্য দিয়ে আমি কিন্তু আমার নিজের ব্যাপারেও একটা স্টেটমেন্ট রাখছি। শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, জীবন নিয়ে আমার নিজের যে প্রশ্ন এইসব মানুষগুলোর ভেতরই আমি তার অনেকটুকু উত্তর পাই। আমি আগেও বলছিলাম যে আমার যাবতীয় লেখার পেছনে একটা অনুসন্ধান থাকে। আমি প্রশ্ন তাড়িত হয়ে লেখাগুলি লিখি। তো এইসব মানুষ কিন্তু র্যানমডলি আমি সিলেক্ট করছি না, তারা সব বিখ্যাত মানুষ বলেও আমি তাদের সিলেক্ট করছি না। তাদের নির্বাচন করছি কারন তাদের ভেতর আমার নিজের কিছু প্রশ্নের উত্তর আছে। এখন জীবনান্দ নিয়ে তো অগনিত লেখা হয়েছে। জীবনানন্দকে একেকজন একেকভাবে এ্যাপ্রোচ করেছেন। কিন্তু আমারো অধিকার আছে আমি নিজে ব্যাক্তিগতভাবে কিভাবে তাকে ফেইস করেছি, বুঝেছি সেটা জানানোর। আমার গল্প উপন্যাস যেমন আমার নিজের ভয়েসটাকে অন্যের কাছে উপস্থিত করার একটা উপায় তেমনি জীবননন্দকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি আামার নিজের ভয়েসটাকে উপস্থিত করতে চাই। আমার অভিজ্ঞতাটা তো আর অন্যের মত হবে না। সুতরাং এখানে রিপিটেশনের সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। আর ক্রাচের কর্নেল লিখতে গিয়ে আমাকে ইতিহাসের দায় নিয়ে অনেক বেশী সতর্ক থাকতে হয়েছে। সাহিত্যের দায় আর ইতিহাসের দায় দুটোকে মেলাতে ভীষন চাপ গেছে। সবসময় সফলও হয়নি। কিন্তু এ লেখায় তেমন কোন চাপ নেই। পুর্নাঙ্গ সাহিত্যিক স্বাধীনতা নিয়েই বইটা লিখতে চাই।
শিবু: আচ্ছা আপনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। ইলিয়াস ভাই বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ তো সবার সঙ্গে আছে। এইটা তো তার সময়ের একটা চিন্তা। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট তো ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ এখন ভারত বাংলাদেশ মৈত্রীতে একটা রাজনৈতিক এজেন্ডা হয়ে দাড়িয়েছে। আবার বিশ্বভারতীর কপিরাইটের আইনটা যখন উঠে গেল তখন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার প্র্যাকটিশ শুরু হয়ে গেলো যে, যা ইচ্ছা তাই করা যেতে পারে। এই সময়ে এসে রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে মোকাবিলা করেন আপনি?
শাহাদুজ্জামান: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা ছোট লেখা লিখেছিলাম কিছুদিন আগে, ‘রবীন্দ্রনাথ: ব্যাক্তিগত কোলাজ‘ নামে। লেখাটা আমার লেখালেখি বইটাতে আছে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার ভাবনার কথা জানিয়েছি। সেখানে লিখেছিলাম যে আমার বাবা তরুন বয়সে গল্প লিখতেন। লেখক হতে চেয়েছিলেন। বাবার তরুন বয়সে লেখা একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটাতে বাবা লিখছেন যে একদিন পুর্নিমার রাতে জানালার পাশে গল্প লিখবেন বলে তিনি বসেছেন তখন হঠাৎ পুর্নিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে সেখানে একটা সাহিত্য সভা হচ্ছে। সেই সভার সভাপতি রবীন্দ্রনাথ এবং সভাসদের মধ্যে আছে বাংলা সাহিত্যে দিকপাল সব, শরৎচন্দ্র, বিভুতি , তারাশংকর এরা সব। বাবা অবাক হয়ে শুনলেন যে সেই সভার বিষয় হচ্ছেন আমার বাবা। তারা আলোচনা করছেন, এই যে অর্বাচিন তরুনটি জানালার পাশে সাহিত্যচর্চার জন্য বসেছে তাকে সেই অনুমতি দেয়া যায় কিনা। আলাপ আলোচনার পর সবাই যখন রবীন্দ্রনাথের রায় শুনবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেস তখনই চাঁদটা মেঘে ঢেকে যায়। তো রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত পাননি বলে আমার বাবা আর সাহিত্য চর্চার সাহসই পাননি। তো আমি লিখেছিলাম যে আমিও জানালার পাশে লিখতে বসি কিন্তু কখনোই পুর্নিমা রাতে বসি না। কে জানে কখন আকাশে দেখা দেবেন নেই বিখ্যাত সভাপতি। আসলে কথা হচ্ছে একজন লেখক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি হয়ে এক ধরনের অসহয়ত্ব জাগে। এত ম্যাসিভ তার কাজ কর্ম, এত বিরাট একটা পার্সোনালিটি যে তার সামনে দাড়িয়ে একটা বিরাট পাহাড়ের নীচে দাঁড়ানো হরিনের মত মনে হবে নিজেকে, এই পাহাড় ডিঙ্গানো অসম্ভব মনে হয়। তখন কারো একধরনের অসহায়ত্ব জাগে আবার কারো কারো ইচ্ছা জাগে ডিঙ্গানো যখন যাচ্ছে না শিং দিয়ে একটু গুতিয়ে দেওয়া যাক। তাকে নিয়ে অতি উচ্ছাস আছে, গুরুবাদিতা আছে। আবার কেউ রবীন্দ্রনাথকে একচোট নিয়ে বেশ তৃপ্তি পান। আমি রবীন্দ্রনাথকে সিলেকটিভলি গ্রহন করি। তার কবিতা আমাকে তেমন টানে না। তার গল্প টানে। তার চিন্তার ব্যাপকতা টানে। তার প্রবন্ধগুলো পড়ি। তার গান খুবই উপভোগ করি। এত ভার্সেটাইল লোক তো পৃথিবীর ইতিহাসেও খুব কম। তিনি যে বাংলা ভাষাতে কাজ করে গেছেন এবং একটা স্টান্ডার্ড সেট করে গেছেন তাতে আমরা যারা পরে সাহিত্য করতে এসেছি তাদের জন্য তো একটা বিরাট পাওনা। তবে যেটা বললে সেটা ঠিক যে রবীন্দ্রানাথ এখন নানা জনের সম্পত্তিতে পরিনত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে কে কিভাবে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে সে চেষ্টা আছে। রবীন্দ্রনাথ তো বহু মানুষের রুটি রুজির ব্যাপার।ফলে তাকে নিয়ে নানা রকম কারবার সব হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তো তার কাজ করে গেছেন সেটাকে এখন আমরা কিভাবে ব্যবহার করবো, কিভাবে আমাদের সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক করে তুলবো সেটা আমাদের দায়িত্ব।
শিবু: কিন্তু রবীন্ত্রনাথের রাজনৈতিক অবস্খান নিয়ে তো অনেক ঝামেলা আছে। বৃটিশদের ব্যাপারে তার প্রাথমিক মুগ্ধতা, বঙ্গ ভঙ্গে তার ভুমিকা পুর্বাঞ্চলের মুসলমানদের অধিকার বিষয়ে তার নীরবতা এসব নিয়ে তো প্রশ্ন তোলা যায়।
শাহাদুজ্জমান: এগুলোকে এত একপেশে ভাবে দেখবার সুযোগ নাই। সেদিন কোথায় একটা লেখা পড়লাম যিনি প্রমান করার চেষ্টা করছেন যে রবীন্দ্রনাথ বৃটিশদের দালাল। তো এসব তো বালখিল্যতা। রবীন্দ্রনাথের দেখার ভেতর, বোঝার ভেতর নিশ্চয়ই সীমাবদ্ধতা ছিলো। তিনি তো আর অতি মানব না। তিনি মুসেলীনির ব্যাপারেও মুগ্ধ হয়েছিলেন একসময়, তার শ্রেনী অন্ধতাও ছিলো অনেক সময়। কিন্তু তার বড় গুন হচ্ছে তিনি তার সীমাবদ্ধতাগুলো সম্পর্কে দ্রুত সজাগ হয়ে যেতে পারতেন। তিনি মুসোলিনী বিষয়ে সতর্ক হয়েছিলেন। বৃটিশসহ, পুরো ইউরোপ নিয়ে তার যে মোহগ্রস্ততা সেটা তো আর থাকে নি একসময়। সভ্যতার সংকটে ষ্পষ্ট তিনি জানিয়েছেন কিভাবে ইউরোপ বিষয়ে তার যাবতীয় মুগ্ধতা ধুলিসাৎ হয়েছে। হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে তার লেখা আছে সেখানে তিনি কিন্তু বলছেন যে ভারতবর্ষ যদি মুসলমানদের কন্ঠস্বর না শোনে তাহলে কত মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রভাবনা, বঙ্গভঙ্গের সময় তার অবস্থান এসব নিয়ে চমৎকার একটা লেখা লিখেছে তৈমুর রেজা, ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয়: চোরাটানের ইতিহাস‘ নামে। লেখাটা সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের অনুষ্টুপ পত্রিকায় ছাপিয়েছে। লেখাটিতে রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু স্বাবরোধীতাকে সুন্দরভাবে বাখ্যা করেছে তৈমুর।
শিবু: অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক একজায়গায় বলেছেন যে, বঙ্কিমের সাহিত্য, শরতের সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য মিলিয়ে যত চরিত্র আছে সবগুলো যদি একত্র করি তাহলে দেখবো ফাইভ পার্সেন্টও মুসলমান চরিত্র নাই। দেশভাগ কেন হলো এ থেকেও তা বোঝা যায়।
শাহাদুজ্জামান: আহমদ ছফাও তার এক লেখায় লিখেছেন যে রবীন্দ্রনাথের সাথে যদি দেখা হতো তাহলে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করতাম এত কাজ আপনার, সারা জীবনে একটা মুসলমান চরিত্রও তৈরী করলেন না? ইন্টারেষ্টিং প্রশ্ন। এটা ঠিক যে এই সাহিত্যিকরা মুসলমান চরিত্র তেমন তৈরী করেননি। এটাও দেখতে হবে যে হিন্দুদের জীবন তারা যতটা জানতেন, মুসলমানের জীবনটা তারা ততটা কাছ থেকে দেখেননি, এ জীবনটা তারা চিনতেন না ভালো করে। সেটাও একটা সীমাবদ্ধতা। রবীন্দ্রনাথ তো স্বীকারই করেছেন যে তার লেখা বিচিত্র পথে গেলেও সর্বত্রগামী হয়নি। দেশভাগের পেছনে তো নানারকম রাজনৈতিক কার্যকারন ছিলো, হিন্দু আধিপত্যও নিঃসন্দেহে একটা বড় ব্যাপার। কিন্তু বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিষ্ঠায় হিন্দু আধিপত্য যে সবসময় অনিবার্য একটা ব্যাপার ছিলো সেটা বলা যাবে না। ইলিয়াস ভাইয়ের ডায়েরী সম্পদনা করেছি আমি। সেখানে এই নিয়ে তার বেশ ইন্টারেষ্টিং কিছু ভাবনার কথা আছে। তিনি লিখছেন দেশভাগের আগেই কিভাবে কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, আব্বাস উদ্দীন, বুলবুল চৌধুরী, জয়নুল আবেদিন এমনকি অনেক আগে মীর মোশাররফ হোসেন প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এই অঞ্চলে। আমার কথা হচ্ছে হিন্দু আধিপত্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা মাথায় রাখতে হবে কিন্তু সেটার কাউন্টার হিসেবে বাঙ্গালী মুসলমানের আইডেন্টিটিতে আমাদের দাঁড়াতে হবে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। আহমেদ ছফা মেধার সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলমাদের পরিচয় সংকটগুলো বুঝবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাঙ্গালী মুসলমানিত্বকে নিজেদের জাতি পরিচয় হিসেবে দাঁড় করাবার কথা তিনি বলেছেন বলে আমার মনে হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশে বেশ একটা রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্রোত আছে যারা এদেশটাকে বাঙ্গালী মুসলমানের দেশ হিসেব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এর ভেতর গভীর সাম্প্রদায়িক মনোভাব আছে।
শিবু: আপনার নিজের কোন ধর্মবিশ্বাস আছে?
শাহাদুজ্জামান: আমি তো মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছি। কিন্তু আমি কোন প্রাকিটিসিং মুসলমান না। আমার এই ধর্মীয় পরিচয়টা আমার কাছে গুরুত্বপুর্ন না। আমার পরিবারের ভেতরও ধর্ম নিয়ে খুবই উদার একটা আবহের মধ্যে বড় হয়েছি। বাড়িতে ধর্মের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে। ধর্মীয় নানা আচারগুলো পালনে আমাদের বাড়িতে কোন বাধ্যবাধকতা ছিলো না। আমরা যখন বরিশালে তখন আরজ আলী মাতুব্বরের লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তো ইসলামের নানা বিশ্বাসের উপর তীব্র আঘাত করেছেন। ঢাকায় তিনি পরিচিত হবার আগে, পাঠক সমাবেশ তার বই প্রকাশের বছর দশেক আগেই তার সঙ্গে যোগযোগ ঘটেছে আামার। আমি তখন মেডিকেলের ছাত্র। তার সঙ্গে চিঠি লেখালেখি হয়েছে। তিনি বরিশালে আমাদের বাড়িতেও এসেছেন। আমার বাবা ‘মার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছেন। আমার বাবা নিজে কোরানের একটা প্রাঞ্জল অনুবাদ করেছেন। খুবই চমৎকার, গল্পের মত। সেটা তিনি ছাপাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু প্রকাশক পাননি। কিন্তু ধর্ম প্রশ্নে খুবই খোলামেলা তিনি। আরজ আলী মাতুব্বরের বই, কথা অত্যন্ত গুরত্বের সাথে পড়েছেন, শুনেছেন। অমুসলিম বহু মানুষ আমাদের পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠজন। আমার একটি লেখা আছে ‘আমার বিধর্মী আত্মীয়কুল‘ এই শিরোনামে। সেখানে আমি লিখেছি আমার সেই অমুসলিম ঘনিষ্ঠজনদের কথা যাদের কাছ থেকে আমি নানাভাবে পুষ্টি পেয়েছি। তো ব্যাক্তিগতভাবে কোন বিশেষ ধর্ম পরিচয়ে পরিচিত হবার কোন ইচ্ছা আমার নাই। কিন্তু এটা আমার ব্যাক্তিগত অবস্থান। আমি এও জানি এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে ধর্ম পরিচয় একটা খুব গুরুত্বপুর্ন ব্যাপার। তাদের এই প্রবনতাকে আমি গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। রাস্ট্রভাবনার জায়গা থেকে যদি দেখি তাহলে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসকে কিভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর মোকাবেলা করা হবে সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখার আছে। কম্যুনিষ্টরা এসব জায়গায় অনেক ভুল হরেছে। ধর্ম হচ্ছে আফিম এরকম সহজ কথায় ব্যাপারটা ফুলষ্টপ দিয়ে দেয়া তো যাবে না।
শিবু: তবে আপনি বিশ্বাস করেন না করেন আপনি মুসলমান জাতির প্রতিনিধিত্ব করছেন। আপনি তো ইউরোপে থাকেন। সেখানে আপনার আইডেন্টিটি তো হবে যে আপনি মুসলমান। নাইন ইলাভেনের পর মুসলমান আইডেন্টিটির তো নানা সমস্যা তৈরী হয়েছে। মুসলমান নামের কারনে একজনকে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। মানুষের ধর্ম পরিচয়টা এখানে বড় হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
শাহাদুজ্জামান: আমি বৃটেনে থাকি। বৃটেনে এই পরিস্থিতিটা আমেরিকা থেকে খানিকটা পৃথক। আমেরিকায় বহুজনকে মুসলমান পরিচয়ের কারনে নাইন ইলেভেনের পর নানাভাবে অপদস্থ হতে হয়েছে। ইউরোপেও এই মুসলিম ভীতি আছে কিন্তু আমেরিকার প্যানিকিটা বেশী । বৃটেনে ব্যাক্তিগতভাবে আমি মুসলমান নাম থাকার কারনে তেমন কোন নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি, তাছাড়া আমি কাজ করি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেখানে পরিবেশটা একটু ভিন্ন। ভেতরে কেউ ভাবতেই পারে কিন্তু একাডেমিক পরিবেশে সেগুলো খুব একটা এক্সপ্রেসড হয় না। তবে একজন অভিবাসী হিসেবে নানা রকম মার্জিনালাইলেজন তো আছেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের পাসপোর্টের কারনে এয়ারপোর্টে প্রায়ই বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ইমেজ তো নানাকারনে নেতিবাচক। তবে কম্যুনিজমনের পতনের পর পাশ্চাত্যের এক নতুন ভীতি হিসেবে দেখা দিয়েছে ইসলাম। কম্যুনিষ্ট ঠেকাতে আফগানে আমেরিকা কিভাবে মুসলিম জঙ্গীবাদকে উসকে দিয়েছিল একসময় সেটা তো আমরা জানি। সেটাই তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন তারাই হয়ে উঠেছে মুসলমানদের প্রতি হোস্টাইল। এরকম পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুসলমানরা আরো নিজেদের মুসলমান পরিচয়কে জাহির করতে উদ্যোমী হচ্ছে। যারা অভিবাসী তারা নিজেদের মুসলমান আইডিন্টিটিকে আরো বেশী আকড়ে ধরতে চাইছে। আমার বেশ কিছু বন্ধু একসময় ধর্মকর্মের সাথে যাদের কোন সম্পর্ক ছিলো না দেখেছি বিদেশে এসে বিরাট ধার্মিক হয়ে গেছে। দাড়ি, টুপি, আলখেল্লা লাগিয়ে ঘুরছে। এখানে যেটা হয় ইমিগ্রেন্টরা তো নানাভাবে কোনঠাসা থাকে, মার্জিনালাইজড থাকে তখন সে যদি তার মুসলিম আইডিন্টিকে বড় করে তুলতে পারে তখন সে নিজেকে বিশ্ব মুসলিম ভাতৃত্বের একটা বড় প্লাটফর্মে স্থাপন করতে পারে। এই বিদেশ বিভুইয়ে এটা তার জন্য একটা বিরাট ব্রিদিং স্পেস। তাছাড়া সারা পৃথিবীতে একটা আদর্শিক ক্রাইসিস আছে। সোসালিষ্ট ব্লকের পতনের পর সারা বিশ্বের বাজার অর্থনীতি আর ভোগবাদের যে প্রবল জোয়ার শুরু হয়েছে তাতে বিশ্বব্যাপী একটা আত্মিক সংকটও আছে। সেই ফাঁক দিয়ে অনেক জায়গায় ধর্ম ঢুকছে। সুতরাং ইসলাম নিয়ে এই যে বিশ্বব্যাপী একটা তোলপাড় এর রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, আত্মিক অনেক মাত্রা রয়েছে। কিন্ত আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করো তো বলবো আমি আমার মুসলমান পরিচয়কে কখনোই বড় করে দেখি না। সেই সাথে আমি এমন একটা পৃথিবীর কথা ভাবি সেখানে মানুষের ধর্ম পরিচয়টার কোন গুরুত্বই থাকবে না। তেমন পৃথিবী আসতে আরো কয়েক শতাব্দীও হয়তো চলে যাবে ।
শিবু : আাপনার লেখায় ভায়োলেন্স তেমন পাওয়া যায় না। এটা কি এড়িয়ে যাওয়া নাকি এটি আপনার বিষয়ের মধ্যেই প্রাসঙ্গিক ভাবে আসেনি। যৌনতাও তেমন আসেনি।
শাহাদুজ্জামান: আমার গল্পে ভায়োলেন্স যে একদম নাই তা কিন্তু না। আমার ‘ক্ষতি যত ক্ষত যত‘ গল্পটা একটা ভায়োলেন্ট রেপের উপর। বাসের মধ্যে একটা মেয়ে রেপড হয়। তারপর ধরো ‘কারা যেন বলছে‘ গল্প কয়েকজন সন্ত্রাসী ছাত্রের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে লেখা যারা পরীক্ষা বদ্ধ করবার জন্য একজনকে খুন করে। ঐ গল্পটায় একটা কমিক এপ্রোচ আছে। এখন ভায়োলেন্সকে আমি উচ্চকিত ভাবে উপস্থিত করছি না, কিন্তু চাপা একটা ভায়োলেন্সের ভয়াবহতা আছে। একজন একটা ছুরি হাতে চোখ লাল কওে, ভয়ংকর মুখভঙ্গী করে তোমাকে বললো ‘তোকে খুন করবো‘ আর একজন ছুরিটা ধরে ঠোঁটের কোনে মুচকি হেসে বললো, ‘তোকে খুন করবো‘ কোনটা বেশী ভায়োলেন্ট? আর আমার হাসপাতাল নিয়ে বইটাতে তো সমাজের নানা ভায়োলেন্ট ঘটনার সারসরি উল্লেখ আছে। আর যৌনতার ব্যাপারটা আমার গল্পে প্রাসঙ্গিক ভাবে তেমন আসেনি। তবে চোরাগোপ্তা আছে নানা গল্পে, ক্যালাইডোস্কোপ গল্পে, বিসর্গতে দুঃখতে। যৌনতার ব্যাপারটা ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে না পারলে একটা ইরোটিক প্লেজারের জায়গায় যেতে পারে এই রিক্স থেকে সাবধানে প্রসঙ্গটা আনি। আমি আমার ক্যাডেট কলেজের কিশোর জীবন নিয়ে যে নভেলাটা লিখছি সেখান কৈশর যৌনতার ব্যাপরগুলো থাকবে।
শিবু: আপনার গল্পগুলো তো ঠিক আখ্যান ধর্মী না, অনেকটা মেটানেরেটিভ। একধরনের বিক্ষিপ্ততা আছে। আপনি যেটাকে এক লেখায় বলেছিলেন রাশান পুতুলগুলোর মত, পুতুলের ভিতরে পুতুল তার ভিতরে পুতুল। আপনার ‘বুকশেলফে বাঘ‘, ‘ভেড়া, সক্রেটিস স্তন’ এইগল্পুলোতে সেই প্রবনতা খুব ষ্পষ্ট। আপনার ‘ভেড়া, সক্রেটিস, স্তন’ গল্পটা আমার খুব পছন্দের। সেখানে এক জায়গায় আছে কেন লিখি। আপনি বলছেন, শেয়ালের মুখে যে মোড়গটা বাধা পড়েছে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে এ মোড়গটা কি ভাবছে সে কথা জানানোর জন্যই লেখেন। আমার মনে হয়েছে শেয়াল যেন আমরা এই মারখাওয়া মানুষ আর শেয়াল হচ্ছে খুব ধূর্ত, সব কিছু মিলে এই পৃথিবী, এই বাস্তবতা আমরা সবাই যার কাছে আটকা পড়েছি, তো আপনি তার কথাই লিখছেন। তাই কি? যদি জানতে চাই কেন লিখছেন?
শাহাদুজ্জামান: তুমি যা বললে একজাক্টলি তাই। আমাকে তো প্রতিদিন মানুষ সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি হতে হয়, যেমন জীবনানন্দ বলেছিলেন। বাস্তবতা একটা বিরাট হা করে আমাকে গিলে ফেলবার জন্য দাড়িয়ে আছে। বাস্তবতা আমার চেয়ে বড়, শক্তিশালী, চালাক। আমি তার শিকার হয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে একটা জীবন যাপন করি। কেন এই জীবন যাপন করি, কিভাবে জীবনটা যাপন করি সে ব্যাপারগুলো বুঝতেই লিখি। লেখা আমার কাছে জীবনের একটা অর্থ খোঁজারই উপায়। লেখালেখির মুহুর্তগুলোতে মনে হয় সেই শেয়ালের মুখ থেকে যেন হঠাৎ কিছুক্ষনের জন্য ছাড়া পেয়েছি। তারপর শেয়াল আমাকে ধরে ফেলে আবার।
শিবু: হাসান আজিজুল হক একবার প্রশ্ন তুললেন সাহিত্য দিয়ে আসলে কি হয়, সাহিত্য দিয়ে আমরা কি করব? একজন বলেছিলেন যে গান কখনও এ্যাটম বোমার চাইতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। এখন যদি প্রশ্ন করি আসলে নতুন কোন বাস্তবতা তৈরির ক্ষেত্রে ক্ষমতার দিক থেকে সামগ্রিক শিল্পকলার কি ভুমিকা?
শাহাদুজ্জামান: কথা হচ্ছে বাস্তবতার পরিবর্তন তো নানা স্তরে ঘটে। একটা নির্দিষ্ট কোন কর্মকান্ড দিয়ে সেটা ঘটে না। ঘটে নানা স্তারের, নানা ধরনের কর্মকান্ড দিয়ে, একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, ধীরে ধীরে। শিল্পসাহিত্যও অনেক কর্মকান্ডের একটা। কোন সমাজের একটা মোড় ফেরার ঘটনা হয়তো একটা বিশেষ মুহুর্তে ঘনীভুত হয়। একটা বিপ্লব, আন্দোলন, যুদ্ধ। কিন্তু এই দৃশ্যমান ঘটনার পেছনে তো একটা আইডিয়া কাজ করতে হবে, একটা আবেগ কাজ করতে হবে। এই আইডিয়া, এই আবেগ কোথা থেকে আসবে? সেটা সাপ্লাই করেন, নার্চার করেন সমাজ চিন্তাবিদরা, শিল্পীসাহিত্যিকরা। শিল্পীসাহিত্যিকরা পরিবর্তনের সেই আকাংখা তৈরীতে ভুমিকা রাখেন। একটা শিল্পকর্ম, একটা সাহিত্যকর্ম মানুষের মনে এ্যাটম বোমার মতই কাজ করতে পারে। কিন্তু সেটা ওমন মুহুর্তে গুড়িয়ে দেয় না সবকিছু। খুব ধীরে, গোপনে মানুষকে জাগিয়ে রাখে। এমনি বহু জেগে থাকা মানুষের কালমিনেটিভ এফেক্টে একটা পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে। পৃথিবীর চেহারাটা তো অবিরাম পাল্টাচ্ছে। এই পাল্টানো তো আর দৈবক্রমে ঘটছে না। অনেক মানবিক কর্মকান্ড এই পাল্টানোতে ভুমিকা রাখছে। শিল্পসাহিত্যও তেমন একটা কর্মকান্ড। কিন্তু শিল্পসাহিত্য কতটুকু ভুমিকা রাখছে সেটা তো নিক্তি দিয়ে মাপা যাবে না। একসময় সমাজ পরিবর্তনের লক্ষে আরোপিতভাবে শিল্পসাহিত্য চর্চা হয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের নামে। সেটাও কৃত্রিম এবং এভাবেও শিল্প সাহিত্য সমাজ পরিবর্তনে ভুমিকা রাখতে পারে না। শিল্পসাহিত্য পরিবর্তনটা ঘটায় চোরা¯্রােতে, মানুষের স্বপ্নের ভেতর। আর শিল্পসাহিত্যকে শুধু পরিবর্তনের ফ্রেমওয়ার্কে দেখবারও তো প্রয়োজন নেই। খাওয়া দাওয়া, প্রজনন ছাপিয়ে মানুষের একটা এসথেটিক আকাংখাও থাকে। মানুষ একটা নন্দনতাত্বিক প্রানী। পেটের ক্ষুধা মেটানোর মত তার নন্দনতাত্বিক ক্ষুধা মেটানো জরুরী। সেই ক্ষুধা মেটায় শিল্পসাহিত্য।
শিবু: শহীদুল জহীরকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর সোশালিস্ট লিটরেচার এর প্রাসঙ্গিকতা থাকবে কিনা? তিনি সুন্দর উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, মানুষ এই জন্যেই পড়বে যে মানুষ তার স্বপ্নের খোঁজ নিতে চায়। মানে সেসময়ের সাহিত্য তো একধরনের ডকুমেন্টেশন যা দেখায় যে মানুষ এক সময় সব মানুষকে নিয়ে ভাল থাকার একটা স্বপ্ন দেখতো। সেই সপ্নেরই ডকুমেন্টেশন সেগুলো যা সে পড়বে বার বার।
শাহাদুজ্জামান: চমৎকার বলেছেন উনি। মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখবার জন্য তার পুরনো স্বপ্নের কাছে ফিরে যেতে হবে বার বার। শিল্পসাহিত্য আমাদের স্বপ্নেরই ডকুমেন্টেশান। আমরা যেমন হাজার বছর আগের মিথ পড়ি। মিথগুলো কিন্তু তখনকার মানুষের স্বপ্নেরই ডকুমেন্টেশান। তেমনি আমরাও কিন্তু শিল্পসাহিত্যের মধ্য দিয়ে মিথ তৈরী করে যাচ্ছি। হাজার বছর পরের মানুষ যখন এখনকার মানুষের শিল্পসাহিত্যকে পড়বে তখন তারা সেগুলোকে মিথ হিসেবেই পড়বে। আমাদের স্বপ্নের ডকুমেন্টেশান হিসেবেই পড়বে। আমাদের জীবনের আকাংখাগুলোকে চিনবার চেষ্টা করবে।
শিবু: রশীদ চৌধুরীকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, মানুষ তো এখন ত্রিমাত্রিকতার দিকে খুব ছুটছে। এই যুগে পেইন্টিং এর মত দ্বিমাত্রিক শিল্পের কি আদৌ কোন ভবিষ্যৎ আছে? তিনি খুব সুন্দর উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সূর্যের আলো তো মানুষ ধরতে পারেনা, কিন্তু সূর্যের আলোকে ধরার যে আকাঙ্খা সেটা পেইন্টিং এ থাকে। এভাবে একটা টুডি সার্ফেসের মধ্যে থ্রীডির আকাঙ্খা মানুষের সবসময় থাকবে, এটা শেষ হয়ে যাবার মত বিষয় না। মানুষ অসম্ভবকে ধরতে চাইবেই। আপনার কোন একটা লেখাতে পড়েছিলাম একটা লোক বাথটাবে ছিপ ফেলে বসে আছে।
শাহাদুজ্জামান: হ্যা ওটা সম্ভবত কাফকার একটা লেখা থেকে আমি উদ্ধৃত করেছিলাম। একটা লোক বাথটাবে ছিপ ফেলে বসে আছে। তো আরেকজন জিজ্ঞাসা করছে, ‘কি মাছ পেলে?‘ তখন প্রথমজন বলছে, ‘তুমি কি জানো না যে বাথটাবে মাছ থাকে না?‘
শিবু: তাহলে কথা কি এই, জানি যে বাথটাবে মাছ নাই তবু ছিপ ফেলে বসে থাকতে হবে?
শাহাদুজ্জামান: কথা তো অনেকটা তাই। মানিক বন্দোপাধ্যয় দিবারাত্রির কাব্য বইটায় একজায়গায় লিখছেন, ‘আমরা পৃথিবীর মূল সত্য কোন দিন জানতে পারবো না তারপরেও আমরা অবিরাম মূল সত্য জানার চেষ্টা করে যাব এটাই হচ্ছে জীবনের মূল সত্য।‘
শিবু: তাহলে এ কথা দিয়েই আজকের আলাপ শেষ করি।
শাহাদুজ্জামান: হ্যা, শেষ করা যাক।

শাহাদুজ্জামান
জন্ম ঢাকায়। ১৯৬০।
গল্পকার। ঔপন্যাসিক। প্রবন্ধকার। অনুবাদক।
গবেষক।
শিক্ষক, নিউ ক্যাসেল ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।
প্রকাশিত বই
উপন্যাস : ক্রাচের কর্নেল, শাহবাগ , দূরগামী কথার ভেতর,
গল্প : কয়েকটি বিহ্বল গল্প, অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প,
প্রবন্ধ : বায়োস্কোপ চলচ্চিত্র প্রভৃতি, লেখালেখি, চ্যাপলিন আজো চমৎকার, ভাবনা ভাষান্তর।
0 মন্তব্যসমূহ