মায়ের লাশ চুরির মাধ্যমেই চুরি বিদ্যায় তার হাতেখড়ি। আর বয়স-ইবা
তার কতো তখন? বড়জোর নয় কি দশ। অথবা বারো কি তেরো বছর।
অথচ ওই বয়সে যে বালকের মা-মাসী, পিসি-খুড়া, জ্যাঠা-মামা, দাদা-দাদী, নানা-নানীর নিঃশর্ত স্নেহ-ভালোবাসায় বেড়ে ওঠার কথা। অন্য দশটি শিশুর মতো
তারও তখন স্কুলে যাবার কথা। সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। মাঠে গিয়ে খেলনা
হারিয়ে মন খারাপ করে বাড়ি ফেরার কথা। অথবা স্রেফ বাড়ির উঠোনে জ্যাঠীমার একগাদা মুড়ির
ধানের মধ্যে পেঁপের নল দিয়ে পাওয়ার পাম্প বানিয়ে জল ঢেলে ঢেলে সারা উঠোনে একটা লংকাকাণ্ড
ঘটানোর কথা। সেই বালক কিনা ওসব কিছু ছাড়িয়ে সবার অজান্তে আদিবাসী কমিউনিটির বাইরে আদীম
এক পাহাড়ের গুহায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বসতি স্থাপন করেছে। যার খাদ্যই হল শুধু মরা মানুষের
মাংস। আদিবাসী কমিউনিটিতে কেউ মারা গেলে গোরস্থানে রাখা সেইসব লাশ চুরি করা আর তা খাদ্য
হিসাবে ব্যবহার করার পর লাশের কংকালটি গুহার মধ্যেই একটা নির্দিষ্ট কর্নারে সংরক্ষণ
করাই হল বালকের একমাত্র কাজ। কারণ, বালকের ধারণা, তার দরবেশ বাবার উপদেশ যদি সত্যি হয়, তাহলে লাশগুলি
সব আসলে সোনার কংকাল। আদিনাথ পাহাড়ে তখন আজকের এই বালকই আগামীর এক অবিসংবাদিত সম্রাট।
আর তার সেই যজ্ঞের শুরুটা অবশ্যই মায়ের লাশ চুরির মাধ্যমে। আর খাদ্যাভ্যাস তার লাশের
মাংস।
প্রকৃত জনশ্র“তি হল-- আদিনাথ পাহাড়ের সমুদ্রের ওপারে যে আরো
জনবসতি থাকতে পারে, সেই বিষয়টি আদিবাসী কমিউনিটিতে ওই বালকের
বাবা ছাড়া আর কেউ তেমন একটা জানতো না। যদিও ওই বালকের যিনি ঠাকুরদা, তিনি আইজলের খ্রিস্ট্রিয় চার্জ থেকে শিক্ষা পাওয়া ওই আদিবাসী কমিউনিটির
প্রথম খ্রিশ্চিয়ান। পরবর্তীতে যিনি ওই কমিউনিটিতে অনেককেই খ্রিস্টধর্মে উৎসাহিত করে
খ্রিশ্চিয়ান বানিয়েছেন। এমনকি নিজেদের পাহাড়ি উঠোনে ইট সুরকি পাথর দিয়ে কেমন এক অট্টালিকা
মার্কা প্যালেস বানিয়ে ওটার সুউচ্চ চূড়ায় একটা বিশাল ঘণ্টা ঝুলিয়ে কতো কাণ্ডকারখানা
করে ওটার ফটকে লিখলেন-- খ্রিষ্টীয় চার্জ। আর তখন থেকে ধীরে
ধীরে আদিবাসী কমিউনিটির প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ ঘণ্টা বাজার পর সকাল সন্ধ্যায় সেই প্যালেসে
গিয়ে কেমন নিরব প্রার্থণা করায় অভ্যস্থ হয়ে গেল। প্রভু সর্বজনাব যীশু-ই তখন থেকে তাদের
একমাত্র ত্রাণকর্তা। এভাবে আদিনাথ পাহারের আদিবাসী কমিউনিটির একটা অংশে ধীরে ধীরে একটা
কমোন বৈশিষ্ট হয়ে ওঠল-- সকাল সন্ধ্যায়, বিপদে আপদে, জন্ম মৃত্যু বিবাহে, ঝড় ঝাপটায়, এমন কি মাছ ধরা বা নতুন কোনো প্রাণী
শিকার বা উৎসব পার্বণেও প্রভু যীশুর নাম নেওয়া। প্রভু যীশুই ঈশ্বর। তিনিই তাদের সবাইকে
রক্ষা করবেন। অথচ তখনো আদিনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় বিশাল এক তাম্রমুর্তিতে স্বয়ং
ভগবান বৌদ্ধই ধ্যানমগ্ন। নতুন পুরাতন আদিবাসী কমিউনিটির প্রায় সবাই আগে সেখানে গিয়ে
প্রার্থণা করতো। আর এখন সেখানে যীশুরও উপস্থিতি। আদিবাসী কমিউনিটি দুভাগে বিভক্ত হতে
থাকল। আদিনাথ পাহাড়ের আদিবাসী কমিউনিটিতে তখন একদিকে খ্রিস্টধর্মের প্রসার আর অন্যদিকে
বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে শুরু হল একটা শীতল যুদ্ধ। সেই নিরব ধর্মযুদ্ধের
মধ্যে ওইটুকু বালক অমোন একটা কাণ্ড ঘটাতে লাগল বরং কমিউনিটির প্রায় সবারই অজান্তে।
আদিনাথ পাহাড়ের খ্রিস্টিয় কমিউনিটিতে তখন এমন একটা গুজব ছড়িয়ে
পড়ল যে, প্রায়াত বিদ্যাপ্রতীম জগৎময় মোহান্তি রডরিক, যাঁর হাতে ওই কমিউনিটিতে খ্রিস্টান ধর্মের শুরু, তাঁর একমাত্র ছেলে শরৎময় মোহান্তি রডরিক নাকি পার্শ¦বর্তী ভগবান টিলার কোনো অজ্ঞাত বুদ্ধ মেয়ের সাথে কঠিন প্রণয়ে লিপ্ত। আট
দশ কান হয়ে সেই খবরটি যখন শরৎ পতœী জয়ারাম রডরিক শুনলেন,
তখন অনিবার্যভাবে স্বামীস্ত্রী কলহ শুরু হল। আর সেই কলহের শেষ পরিনতী
ছিল খুবই ভয়ংকর। রাতের আঁধারে শরৎময় মোহান্তি রডরিক নিজের বউকে শিশুপুত্র অনির্বাণের
সামনেই খুন করল। আর খুনের পর অসুস্থ শয্যাশায়ী বৃদ্ধা মা আর ওইটুকু শিশুপুত্র অনির্বাণকে
ফেলে শরৎময় মোহান্তি রডরিকের সেই রাতেই কমিউনিটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ কোথাও পলায়ন।
ছোট্ট অনির্বাণ তখন কার কাছে বড় হবে? একদিকে ঘরে অসুস্থ শয্যাশায়ী ঠাকুরমা। যার সেবা শুশ্র“ষার জন্যই যেখানে কমিউনিটির কারো
না কারো প্রত্যক্ষ সহযোগিতা লাগে, সেখানে ওইটুকু অনাথ বালক
অনির্বাণের কে খোঁজ রাখে? বালক অনির্বাণ তখন মায়ের কবরের
পাশে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে, খেয়ে না খেয়ে পরে থাকে। হঠাৎ করে অমোন
প্রলয়ধ্বংসের মুখোমুখি একটা পরিবারের ওইটুকু বালকের মধ্যেও তখন রহস্যময় অজ্ঞাত এক ঘোর
লাগা শুরু হয়। অনির্বাণ খাইলো নাকি ঘুমাইলো, অনির্বাণ ঘরে
নাকি বাহিরে, অনির্বাণ তখন কোথায় কীভাবে পরে থাকলো,
সেই খবর নেওয়ার মতো ওই কমিউনিটিতে কে আছে বালকের? কিছুদিন অমোন ঘোরের মধ্যেই কাটল বালক অনির্বাণের। এভাবে হয়তো একদিন বালক
অনির্বাণের একমাত্র শয্যাশায়ী ঠাকুরমাও ঘুমের মধ্যে মারা গেল। হয়তো বালক অনির্বাণের
ঠাকুরমাকেও পুরানা গোরস্থানে কবর দেওয়া হল। কিন্তু বালক অনির্বাণের কী হল সেই খবর কি
কমিউনিটির কেউ আর রেখেছে? আদিনাথের আদিবাসী কমিউনিটিতে বালক
অনির্বাণের বসবাসের আর কোনো সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না।
হয়তো ওদিকে ততোদিনে অনির্বাণ তার ঠাকুরমার লাশটাও চুরি করেছে।
আর তা সযতেœ সেই অন্ধকার গুহার কোনো প্রান্তে লুকিয়ে
রেখেছে। মায়ের লাশের মাংস খাওয়া শেষ হলে ঠাকুরমার লাশের মাংস খাবে। কারণ হয়তো ইতোমধ্যে
বালক অনির্বাণ লাশের মাংস দিয়ে উদর পূরণে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। প্রথম প্রথম আদিনাথ পাহাড়ের
কমিউনিটিতে সবাই ধারণা করেছিল-- হয়তো অনির্বাণের বাবা কোনো
এক রাতে এসে বালক অনির্বাণকে চুরি করে নিয়ে গেছে। অথবা বালকটা স্রেফ কোথাও হারিয়ে গেছে।
নতুবা পাহাড়ের কোনো খাদে পড়ে মরে শুকোচ্ছে। অথবা শেয়াল শকুনের পেটে হয়তো ঠাঁই নিয়েছে
বালক অনির্বাণ। নইলে ওইটুকু বালক আর কোথায় যাবে? এভাবে শরৎময়
মোহান্তি রডরিকের মতো তার শিশুপুত্র অনির্বাণ মোহান্তি রডরিকও আদিনাথ পাহাড়ের কমিউনিটি
থেকে একদিন হারিয়ে গেল। কমিউনিটির কেউ আর বালক অনির্বাণকে আদিনাথ পাহাড়ের কোথাও দেখতে
পেল না। ধীরে ধীরে আদিনাথ পাহাড়ের খ্রিস্টিয় কমিউনিটিতে বালক অনির্বাণও একদিন নির্বাসিত
হল।
ওদিকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত বালক অনির্বাণ অজ্ঞাত পাহাড়ের
অন্ধকার গুহায় লাশের মাংস খেয়ে লাশ আর কংকালের সাম্রাজ্যে বড় হতে থাকল। আদিবাসী কমিউনিটির
গোরস্থান থেকে লাশ চুরি করা, সেই লাশের মাংস ভক্ষণ করা
আর কংকালগুলো সারি সারি করে গুহার মধ্যেই সাজিয়ে রাখাই অনির্বাণের তখন একমাত্র কাজ।
শুধুমাত্র অন্ধকারেই অনির্বাণের চলাফেরা। অন্ধকারেই অনির্বাণের বসবাস। অন্ধকারই অনির্বাণের
অনিবার্য কর্মকাল। আদিনাথ পাহাড়ে কেউ আর বালক অনির্বাণের কথা মনে রাখল না। অথচ সবার
অজান্তেই অজ্ঞাত পাহাড়ের গভীর গুহায় অনির্বাণ এক কংকালের সাম্রাজ্য স্থাপন করে চলল।
যেন আদিনাথ পাহাড়ের চলতি সভ্যতার উল্টোপাশে বালক অনির্বাণ আরেক সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছে।
ধর্ম নিয়ে সৃষ্ট কলহের উর্ধ্বে নতুন এক সভ্যতার শ্রষ্ঠা অনির্বাণ অন্ধকারেই আরেক বিপরীত
রাজ্য স্থাপন করেছে। যেখানে মরা মানুষের মাংসই হল একমাত্র খাদ্য। অনির্বাণ লাশের মাংস
খেয়েই বড় হচ্ছে। লাশ চুরি যার পেশা। দরবেশ বাবা যার ধ্যানগুরু।
এক সময় আদিনাথ পাহাড়ে একটা খবর বেশ চাউর হল। কে বা কাহারা
যেন মৃত ব্যক্তির লাশ চুরি করে নিয়ে যায়। কেন লাশ চুরি করে? কারা লাশ চুরি করে? কীসের জন্য লাশ চুরি করে?
এমন সব প্রশ্ন কমিউনিটির কারো কারো মাথায় আসলেও কয়েকদিন যেতে না যেতেই
লাশ চুরির ঘটনা আলোচনা থেকে অটোমেটিক উধাও হয়ে যেত। তবে এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ রইল
না যে, লাশ শুধুমাত্র আদিনাথ পাহাড়ের গোরস্থান থেকেই চুরি
হয় না। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের কমিউনিটি থেকে বা পশ্চিমের ভগবান টিলায়ও নাকি লাশ চুরির
ঘটনা তখন ঘটছে। ধীরে ধীরে লাশ চুরির এই ঘটনা নিয়ে আদিনাথ পাহাড়ের খ্রিস্টান কমিউনিটি
এবং কেয়াং প্রধান বৌদ্ধ কমিউনিটির মধ্যে পারস্পারিক সন্দেহ আর কলহ দানা বাঁধতে লাগল।
লাশ চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে আদিনাথ পাহাড়ের খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ কমিউনিটির আদিবাসীরা
তখন মুখোমুখি। কলহে উত্তপ্ত পাহাড়ি জনপদ। কমিউনিটিতে কারো লাশ চুরি হলেই তখন উভয় পক্ষে
অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়। ফলাফল পাহাড়ি আদিবাসী জনপদে গুপ্ত হত্যার সংখ্যাও যেমন বাড়ল,
লাশ চুরির ঘটনাও বাড়তে লাগল। কিন্তু লাশ চোর ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিছুতেই
লাশ চোর সনাক্ত করাও যাচ্ছে না। লাশ চোরকে ধরাও যাচ্ছে না। হয়তো কেউ মারা গেল। দুচারদিন
গোরস্থানে এক ধরণের পাহারা বসানো হলো। সেই পাহারা আর কতোদিন-ইবা বসানো সম্ভব?
মরা মানুষের লাশ কতোদিন আর পাহারা দিয়ে রাখা যায়? যেভাবে হোক গোরস্থানে পাহারা বন্ধ হওয়ামাত্র সেই লাশও চুরি হয়ে যায়। কিন্তু
লাশ চোর ধরা ছোঁয়ার উর্ধ্বে। আদিনাথ কমিউনিটিতে কেউ আর লাশ চোরকে ধরতে পারে না। অনির্বাণ
দুঃসাহসি রাজার মতোই একা একাই তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলে।
অশান্ত পাহাড়। অশান্ত পাহাড়ি আদিবাসী জনপদ। অশান্ত ধর্মের
দোহাই দিয়ে টিকে থাকা পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলো। কলহ, বিপদ,
ভয়, গুম, হত্যা,
আর লাশ চুরি। অবশেষে পাহাড়ি জনপদে চরম অসন্তোস বিরাজ করলে সরকার সেখানে
রাষ্ট্রীয় সেনা মোতায়েনে বাধ্য হল। নইলে নাকি আদিবাসীদের গোপন কিলিং মিশন বন্ধ হবে
না। বরাবরের মতো কলহ বন্ধের জন্য সরকার নিরপেক্ষ না থেকে কোনো এক পক্ষকে সমর্থণের যে
কৌশল ব্যবহারে অভ্যস্থ, সেই সুযোগে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সেনাদের
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ আর সহযোগিতায় পাহাড়ে চিরায়ত দা-বর্ষা ঢালের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয়
আগ্নেয়াস্রের ব্যবহার ও আগমন বাড়তে থাকল। এভাবে ধীরে ধীরে আদিনাথের পাহাড়ে শত্র“ দমনের সেই অমিমাংসিত খেলায়
শত্র“-মিত্র খেলাটি বেশ জমে ওঠল। আর এক সময় অশান্ত পাহাড়ি গোষ্ঠীগুলো সরকারি নিরাপত্তা
সেনাদের বিরুদ্ধেই স্বার্থ আর দ্বন্দ্বের শ্রেষ্ঠত্বে লিপ্ত হল। তখন কে কাকে হত্যা
করে, কি কারণে হত্যা করে, হত্যায়
কার লাভ ওতো সব হিসাব নিকাশ না করেই পাহাড়ি শান্ত জনপদ চিরস্থায়ী অশান্ত যুদ্ধক্ষেত্রে
পরিনত হল। পাহাড়ে তখন মৃত্যু মানে পাল্টা মৃত্যু। গুম মানে পাল্টা গুম। হত্যা মানে
পাল্টা হত্যা। ধীরে ধীরে পুরো আদিনাথ পাহাড় এক নরবলীর পাহাড়ি জনপদ হয়ে ওঠল।
এতে অনির্বাণের কোনই অসুবিধা হল না। বরং দরবেশ বাবার খাঁটি
আর্শিবাদে অনির্বাণ তখন অন্ধকার গুহা সোনার কংকালে ভরপুর করতে থাকে। দরবেশ বাবা অনির্বাণকে
এক অতি আশ্চার্য আর্শিবাদ দান করেছেন। বস্তুটি দেখতে অনেকটা আয়নার মতো হলেও ওটি আকার
আর গঠনে আসলে একটা চাকু। খোলা আকাশের নিচে অনির্বাণ যদি দরবেশ বাবার দেখা পেতে চায়, তাহলেই কেবল ওই চাকুটি ব্যবহার করে অনির্বাণ। চাকুর সূচালো ফলাটি আকাশ বরাবর
ধরার পর রশ্মির মতো তীব্র উজ্জ্বল এক আলোর সরলরেখা আকাশপথে অনির্বাণের সাথে তখন সাক্ষাৎ
দেয়। এই আলোর রেখার মধ্যেই দরবেশ বাবাকে স্পষ্ট দেখতে পায় অনির্বাণ। দরবেশ বাবা অনির্বাণকে
যেসব উপদেশ দেন বা অনির্বাণ যা জানতে চায় তার বিনিময় হয়। আর দরবেশ বাবার সাক্ষাৎ পাবার
জন্য অনির্বাণকে এর আগে তিনটি কাজ করতে হয়। তিনবার লাশের মাংস খেতে হয়। মনে মনে তিনবার
দরবেশ বাবাকে স্মরণ করতে হয়। আর তিনবার মুখে একটা মন্ত্রটা আস্তে আস্তে উচ্চারণ করতে
হয়। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। অমনি আকাশ পথে আলোক রশ্মির মতো নেমে আসেন জীবন্ত
দরবেশ বাবা। পা তাঁর ভূবনে আর মাথা ওই সর্বোচ্চ আকাশে। এক আশ্চার্য আলোক রশ্মি তখন
অনির্বাণের সাথে ভাব বিনিময় করে। অনির্বাণকে নির্দেশ দেয় অথবা উপদেশ দেয়। অনির্বাণ
ছাড়া দরবেশ বাবাকে আর কেউ দেখতে পায় না।
দরবেশ বাবার সাথে অনির্বাণের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাও বেশ রহস্যজনক।
অনির্বাণের মা তার বাবার হাতে খুন হবার পরদিন ঠিক মধ্যান্থের সময়। বালক অনির্বাণ তখন
তার মার কবর ঘেঁষে মন খারাপ করে বসেছিল। নাকি মার কাছে যাবার জন্য অনেক চেষ্টা করে
ব্যর্থ হবার পর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই ঘুমের মধ্যেই বালক অনির্বাণ শুনতে
পেল-- আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে একটা ঝাঁঝাল শব্দ। দাদ্রিং মাদ্রিং
রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। ঘুমন্ত অনির্বাণ
চোখ খুলে কি ভয় পেল? নাকি কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমুঢ়
বালক! ভয় পেয়ে অনির্বাণের কি কোথাও পালানোর মতো জায়গা আছে? ভীত সন্ত্রস্থ বালক অনির্বাণ তখন ভয়ের পরিবর্তে হয়তো বিস্ময় চোখে দরবেশ
বাবাকে দেখতে লাগল। দরবেশ বাবা আবারো উচ্চারণ করলেন-- দাদ্রিং
মাদ্রিং রোদ্রিং রা। অনির্বাণ কি ভয় পেল?
নাকি সে অভয় পেল? অনির্বাণ কি সাহস হারাল?
নাকি সে দুঃসাহসি হল? অনির্বাণ কি উৎসাহী
হল? নাকি সে উৎকণ্ঠায় আবারো ঘুমিয়ে পড়ল। অনির্বাণ কি জ্ঞান
হারাল? নাকি সে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল? অনির্বাণ কি আবারো স্বপ্ন দেখল? অনির্বাণ ঘোরের
মধ্যে আসলে কি কি দেখল? অনির্বাণ কি ঘুমের মধ্যে আবারো দেখল--
দরবেশ বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। আর জোড়ালো কণ্ঠে বলছেন-- দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং
রোদ্রিং রা। আধো ঘুমন্ত আধো জাগা বালক অনির্বাণ তখন সুতীক্ষè এক আলোক রশ্মির মুখোমুখি। বালক অনির্বাণ জানতে চায়-- কে তুমি?
পাহাড়ি মধ্যান্থের দাপদগ্ধ হাওয়া উলম্ফভাবে অনির্বাণের কান
ঘেঁষে শা-শা শব্দে কথা বলে ওঠে-- আমি কেউ না খোকা।
অনির্বাণ আবারো জানতে জায়-- কি
চাও তুমি?
উত্তপ্ত নরম গরম হাওয়া প্রলম্বিত হতে হতে জবাব দেয়-- কিছুই না। কিছুই নারে, খোকা।
অনির্বাণ তখন পাক্কা সেয়ানার মতো উচ্চারণ করে-- দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং
রোদ্রিং রা। অনির্বাণ তখন পুরোপুরি চেতনে। অনির্বাণ তখন সুস্থির চিন্তা করার চেষ্টা
করে। স্থির দেখতে পায় আলোক রশ্মির ভিতরে আকাশ পাতাল সাদা ধবধবে এক দরবেশ বাবা দাঁড়িয়ে
আছেন তার সামনে। অনির্বাণ আবারো সুস্পষ্ট উচ্চারণ করে-- দাদ্রিং
মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। এবার
দরবেশ বাবা অনির্বাণের সামনে আরো সুস্পষ্ট হল। অনির্বাণ যেন ঠিক পাহাড়ি জনপদেরই পরিচিত
কোন আপন মানুষের সাথেই কথা বলছে। দীর্ঘদিন যার সাথে অনির্বাণের জানাশোনা। দরবেশ বাবা
যেন বা অনির্বাণের কতো পুরনো চেনা কেউ। দরবেশ বাবাকে দেখতে দেখতে অনির্বাণ বুঝতে পারে
সে বুঝি খুব শক্তি অনুভব করছে শরীরে। ওই যে মায়ের কবর, ওই
যে ওদিকে তাদের বাড়ি, ওই যে দূরের গাছপালা, বাড়িঘর, পাহাড় সবকিছু ঠিকই আছে। তবু তার মনে হতে
থাকে-- সে বুঝি মুহূর্তে সবকিছু তছনছ করে গুড়িয়ে দিতে পারার
মতো শক্তি পাচ্ছে শরীরে। কীসের শক্তি টের পাচ্ছে অনির্বাণ? অনির্বাণ কেন এতো শক্তি পাচ্ছে শরীরে? অনির্বাণের
কি কিছু হল? কে এই দরবেশ বাবা? অনির্বাণের
কাছে সে কি চায়?
সেই থেকে অনির্বাণ যথেষ্ট শক্তি পায় শরীরে। তবে কি এই শক্তির
উৎস দরবেশ বাবা। আর এই শক্তির মন্ত্র-- দাদ্রিং মাদ্রিং
রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। কোথায় কি কিভাবে
বদলে যাচ্ছে-- অনির্বাণ বুঝতে চেষ্টা করে। অনির্বাণ কিছুই
বুঝতে পারে না। অনির্বাণ চোখ কচলায়। অনির্বাণ বুঝতে পারে না কি করতে হবে। ঠিক তখন স্বয়ং
দরবেশ বাবাই অনির্বাণকে নির্দেশ দেয়-- পালিয়ে যা। এখান থেকে
পালিয়ে যা বলছি। কবরের ওই লাশ নিয়ে পালিয়ে যা। যাহ...।
অনির্বাণ বুঝতে চেষ্টা করে দরবেশ বাবা কি বলছেন। অনির্বাণ
চারদিকে তাকায়। অনির্বাণ বুঝতে পারে না কি করতে হবে। দরবেশ বাবা তখন আবারো কথা বলেন-- লাশ নিয়ে পালিয়ে যা। সোনার কংকাল পাবি। যা পালিয়ে যা বলছি। যাহ...।
অনির্বাণ কি তখন ওঠে? মায়ের কবরকে
খুব ভালো করে একবার দ্যাখে। খুব ভালো করে চারদিকটায় তাকায়। না কোথাও কেউ নেই। অনির্বাণ
নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। মায়ের লাশ নিয়ে অনির্বাণ পালানোর ফন্দি করে। অনির্বাণ ঘরে
ফিরে আসে। অনির্বাণ ঘরের বাইরে আসে। অনির্বাণ অসুস্থ ঠাকুরমার ঘরে উঁকি দেয়। অনির্বাণ
আবার ঘরের বাইরে আসে। অনির্বাণ যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে। মধ্যান্থের অনির্বাণের সাথে ঘটে
যাওয়া কোন ঘটনার কথা আদিনাথ পাহাড়ের কেউ কিছুই জানল না। অনির্বাণ অস্থির হয়ে ঘর বাহির
করতে থাকে। মনে মনে অনির্বাণ বলতে থাকে-- দাদ্রিং মাদ্রিং
রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা। দাদ্রিং মাদ্রিং রোদ্রিং রা।
আদিনাথ পাহাড় থেকে দক্ষিণে তাকালে অথৈ সাগর। বাকি তিনদিকে
পাহাড় আর পাহাড়। পশ্চিমে তাজিংডং, কেওক্রাডাং, ভগবান টিলা, অযোধ্যা, মাটিরাঙ্গা, সুভলং, চিম্বুক।
আরো পশ্চিমে সীতা, কুণ্ডি, কৈবল্যধাম।
আর উত্তরে মিজু, ত্রিদিব, চণ্ডি,
বাল্মিকী, ত্রিফলা। আরো উত্তরে ব্রক্ষ্মা,
অগ্নি, শৈল, ত্রিপুঠ।
আর পূর্বে কালী, মেঘাই, চৈতাল,
পঞ্চবটি। আরো পূর্বে ঋতু, নমঃ, পুনঃ, শ্যামঃ। আদিনাথ সবার দক্ষিণে। হাজার বছর
আগে হিমালয় কন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে প্রেম বিরহের বিদ্রোহী এক যোদ্ধা এই আদিনাথ। সমুদ্র
দর্শন তার চাই। প্রয়োজনে প্রিয়তমা কাঞ্চনকেও ত্যাগ করতে রাজী আদিনাথ। সৌন্দর্য সম্রাজ্ঞী
হিমালয় কন্যা কাঞ্চন আদিনাথের কথায় শুধু মুখ টিপে হাসল। আদিনাথ অভিমান আরো বাড়িয়ে দিল।
কাঞ্চন সাথে যেতে না চাইলেও সমুদ্র দর্শন তার চাইই চাই। ফলাফল আদিনাথ আর কাঞ্চনের স্থায়ী
বিচ্ছেদ। আদিনাথ পাহাড়ে এখন যারা বসবাস করেন তাদের কমিউনিটিতে এমনটি ধারণা করা হয়।
কাঞ্চনের বিদ্রোহী প্রেমিক আদিনাথকে তাই কমিউনিটির সবাই দেবতা মানেন। আদিনাথকে তারা
সবাই পূজা দেয়। কাঞ্চনকে আদিনাথের সবাই হিংসে করেন। একমাত্র আদিনাথই তাদের দেবতা।
সেই আদিনাথকে সরিয়ে সেখানে এখন অন্য অনেকের আগমন ঘটেছে। সবার
আগে এসেছেন বুদ্ধদেব। তারপর এসেছেন শ্রী শ্রী চৈতন্য। তারপর শ্রী শ্রী মঙ্গলাদেব। তারপর
শ্রী যিশুখ্রিস্ট। শ্রী মোহাম্মদ খবরটি পেলেন সবার পরে। কারণ উনি তখন কাবুল দখল নিয়ে
মহাব্যস্ত। অথবা রেঙ্গুনের দিকে নজর দেবার সময় তাঁর আরো পরে। এক সময় দেখা গেল আদিনাথের
আদিবাসীরা ছোট ছোট নানান সম্প্রদায়ে বা দেবতাকে ঘীরে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শে কমিউনিটি
বৃদ্ধি করে চলছে। দর্শন বুঝিবা পৃথিবীময় নিজে নিজেই এভাবে ছড়ায়। গৌতমেরটা যেভাবে ছড়ায়, যিশুরটাও একইভাবে ছড়ায়। শ্রীকৃষ্ণেরটাও একই নিয়মে টিকে থাকে। মোহাম্মদেরটাও
একই উপায়ে ছড়ায়। দর্শন জনমতের কাছে পৌঁছাবেই। এটাই হয়তো দর্শনের নিজস্ব ক্ষমতা। যে
কারণে কার্ল মার্ক্স টিকে থাকবে। যে কারণে পুঁজিবাদও টিকে থাকবে। যে কারণে ধর্মযুদ্ধও
টিকে থাকবে। যে কারণে যুগ যুগের ইতিহাস হলো ক্রুসেড। রক্ত, হত্যা, বলি, নরবলি। আর
এসবের যৌথ নাম হল মতাদর্শ। আর সেই মতাদর্শের লিখিতরূপের ক্ষমতা সবার চেয়ে বেশি। যে
কারণে ত্রিপাঠক, বেদ, বাইবেল,
কোরআন দীর্ঘদিন টিকে থাকবে। যে কারণে কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস, ডারউইন, নিউটন,
আইনস্টাইন, বোস, পিথাগোরাসের কথা মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবে। অথবা হিটলার, নেপোলিয়ন, তৈমুর লং, সাদ্দামের
কথা মানুষ দীর্ঘদিন ভুলবে না। আবার অনেকের কথা পৃথিবীর কোন কোন কমিউনিটি হাজার হাজার
বছরেও জানতে পারবে না। যেমন পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা কতো, তা
কেবল আমরা অনুমান করতে পারি। পৃথিবীতে পাখির সংখ্যা-ইবা কতো, যা আমরা কেবল অনুমান করেই বলতে পারি। পাখির সংখ্যা, ভাষার সংখ্যা সবই অনুমান নির্ভর। ঠিক তেমনি পৃথিবীতে ধর্মের সংখ্যাও অনুমান
নির্ভর। পাখি, ভাষা, ধর্ম সবই আসলে
অনুমান নির্ভর। শুধু যোগসূত্রের ঘাটতি। আশ্চার্য জগদীশ চন্দ্র বসু যেমন হঠাৎ ঘোষণা
দিলেন-- গাছেরও প্রাণ আছে। অমনি জগৎসুদ্দু লোকজন একটু নড়ে
চড়ে বসলেন। কেউ কেউ বিপক্ষে গিয়ে দেখলেন বিরোধীতা করে এই দলটিকে বেশি দিন টেকানো যাবে
না। অতএব জগদীশের কথা মেনে নাও। সিদ্ধান্ত হল-- হ্যা,
গাছেরও প্রাণ আছে-- এক্কেবারে খাঁটি কথা।
আদিনাথের মতো পাহাড়ে জগদীশের নাম না পৌঁছালেও সেখানকার মানুষজন
নিজেদের অজান্তেই হয়তো গাছেরও প্রাণ আছে কথাটি মানে। কারণ তারা প্রকৃতির প্রকৃতি বিচারে
তাদেরকে দেবতা মানে। গাছকেও। পাহাড়কেও। তাই তারা আসলে আদিনাথকেও দেবতা মানে। সেখানে
আরো কতো দেবতা আছেন তা হয়তো যাছাই করা সম্ভব কমিউনিটিগুলোর সামাজিক উৎসব আর পার্বণগুলোর
উৎস অনুসন্ধান করা গেলে। কিন্তু অতো জটিল ভাবনা আজকাল আর কেউ ভাবেন না। অনেকে আবার
ডগায় ডগায় নেচে নেচে পণ্ডিৎ হতে চান। গভীর উপলব্ধিতে মনের গভীরে যা ধরা দেয়, সেই শৃৃংঙ্খলিত ভাবনাই আসল সত্য। ইতিহাস তাকে অগ্রসর করে মাত্র। যীশু যা
ভাবতেন বা মোহাম্মদ যা করতেন, তা সময়কে প্রতিনিধিত্ব করছে
নিজ নিজ ভাবনার শক্তি ও সামর্থের জোড়ে। তাই আদিনাথ ভাগ হচ্ছে। হিমালয় ভাগ হচ্ছে। আটলান্টিক
ভাগ হচ্ছে। ভাগ হচ্ছে সভ্যতা, উন্নয়ন ও চিন্তা। মানুষের দ্বন্দ্ব
আরো দিন দিন বহুমখী হচ্ছে। কারো সাথে কারো দুইশো ভাগ দ্বন্দ্ব। কারো সাথে কারো চারশো
ভাগ দ্বন্দ্ব। সবকিছুই স্বার্থজনিত দ্বন্দ্ব। আর বালক অনির্বানও হয়তো নিজের স্বার্থের
জন্য অমন কষ্টকর এক গুহাবাসী জীবন বেছে নিল। যেখানে লাশের মাংস হল একমাত্র ক্ষুধা নিবারনের
উপায়। বেঁচে থাকার জন্য যেখানে আর কোন সভ্যতা লাগে না। অন্ধকার গুহার মধ্যে লাশের মাংস
খেয়েই লাশের কংকালের সাথে বেঁচে থাকা সম্ভব। অনির্বান সেই সভ্যতার শ্রষ্ঠা। অনির্বানও
বেঁচে থাকল। বুনো মানুষের মতো গুহাবাসী নতুন এক মানুষ খেকো মানুষ হিসেবে অনির্বান বাঁচতে
লাগল।
এরপরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সেনাদের
হাতে গভীর রাতে গোরস্থান থেকে লাশ চুরি করার সময় অনির্বাণ হাতে নাতে ধরা পরে। কারণ, সর্বশেষ যে লাশটি অনির্বাণ চুরি করতে গিয়ে সেনাদের হাতে ধরা পরল--
ওটা ছিল মুংখিল রৈথালা নামে এক আদিবাসী নেতার লাশ। ধারণা করা হয়,
কোন গোপন নিষিদ্ধ সশস্র দলের হাতে খুন হয়েছে রৈথালা। পাল্টা হতাহতের
সম্ভাবনায় তখন থমথমে পাহাড়। অশান্ত পাহাড়ি জনপদ। কিন্তু নিরাপত্তা সেনাদের দায়িত্ব
পাহাড় শান্ত রাখা। কিন্তু কিভাবে?
মেজর জুলমতের নের্তৃত্বে সাত সদস্যের একটা চৌকশ সেনাদলের
গোপনে জোড়ালো নজরদারি ছিল মুংখিলা রৈথালার কবরে। যদি কোন পক্ষ মুংখিলার লাশ গায়েব করার
চেষ্টা করে তাহলে ওই গোপন মিশনের কাছে তারা ধরা পরবে। গভীর রাতে যথারীতি অনির্বাণও
ধরা পরল জুলমতদের হাতে। অনির্বাণ বুঝতে পারে না তার কি অপরাধ। সে তো এই সভ্যতার বাইরে
অন্য এক সভ্য জগতের মানুষ। যেখানে কেবল মানুষের মৌলিক মানুষ থাকার সুযোগ আছে। অনির্বাণও
একজন মৌলিক মানুষ। সভ্য জগতের আচার আচরণ শিষ্টাচার অনির্বাণ জানে না। অনির্বাণ কিছুতেই
সেনাদের বোঝাতে পারল না যে-- এই লাশের মৃত্যুর সাথে সে কোনভাবেই জড়িত
নয়। সে এটার সংগ্রাহক আর ভক্ষক মাত্র। আবার এই জগতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার কিছুই জানে
না অনির্বাণ। কেবল লাশের সন্ধানে আসা নিশাচর এক লাশখেকো মানুষ সে। অন্ধকারেই যার কেবল
চলাফেরা। অন্ধকারেই যার বসবাস। অনির্বাণ সেনাদের হাতে আটক হল।
কোন ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য বের করার জন্য আমাদের প্রশিক্ষিত
বাহিনীর সদস্যরা কেমন আচরণ করে-- আমরা হয়তো জানি না। আমরা
শুধু অনুমান করতে পারি কেমন প্রচেষ্টা তারা জংলী যুবকের ওপরেও চালাতে পারে। অনির্বাণ
নতুন জগতের এইসব নতুন মানুষদের কাণ্ডকারখানার সাথে মোটেও পরিচিত নয়। তাদের এই অদ্ভুত
আচরণের কোন অর্থও তার জানা নেই। সবচেয়ে দুরুহ যে ব্যাপারটি সেটা হল অনির্বাণের ভাষা।
কোনপক্ষই কারো ভাষা বোঝে না। অনির্বাণ আহতবস্থায়ই সেনাদের সেই জিজ্ঞাসা সেলে পরে থাকল।
অনির্বাণের কি আর জ্ঞান ফিরবে? জিজ্ঞাসা সেলের কৌশলগুলো বুঝি
সব অমোন-- খানিক জ্ঞান হারাবে -- খানিক জ্ঞান ফিরবে। ক্ষণে ক্ষণে নতুন নতুন ব্যাপার স্যাপার।
মাঝরাতে কি অনির্বাণ জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল? নাকি অনির্বাণের তার দরবেশ বাবার কথা মনে পড়েছিল? অথবা অনির্বাণ স্রেফ সুইসাইড করার আগে ক্ষত বিক্ষত দেহের রক্ত দিয়ে দেয়ালে
দেয়ালে যা লিখল বা আঁকল, তার সবকিছু কেন উদ্ধার করা যাচ্ছে
না? এমন অদ্ভুত ভাষা আর অভিব্যক্তি, এমন সুগাঢ় আর আকৃষ্ট করার মতো নিখাদ সেই আহবান-- এসব দিয়ে অনির্বাণ আসলে কি বোঝাতে চেয়েছে? অনির্বাণ
নিজের রক্ত দিয়ে দেয়ালে আসলে কি প্রকাশ করেছে? সে কি নিজের
পরিচয়টা নিজের রক্তে প্রকাশ করেছে? সে যে নিজের মায়ের লাশ
চুরি করেছে, সে যে লাশের মাংস খেয়ে বেঁচে থেকেছে, সে যে এক দরবেশ বাবার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে,-- এসবই কি সে নিজের রক্তে দেয়ালে খোদাই করেছে? কোথাও
শুধু নির্বাক কিছু অভিব্যক্তি। কোথাও শুধু অনির্বাণের রক্ত মাখা হাতের ছাপ। কোথাও শুধু
অনির্বাণের একটুখানি আকুতি। কোথাও হয়তো অনির্বাণের সত্য প্রকাশের আহাজারি। কোথাও হয়তো
শুধু অনির্বাণের রক্তমাখা হাতের শেষ নড়াচড়া। ছাপগুলো কেমন ধীরে ধীরে নিথর হয়ে গেছে।
অথবা এসবই আমরা কেবল অনুমান করছি মাত্র। অনির্বাণ যা কিছু প্রকাশ করেছে আমরা হয়তো তার
কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে অনির্বাণ সর্বশেষ যে ঘরে ছিল শুধু সেই ঘরের সাদা দেয়াল,
মেঝে আর গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে অনির্বাণের শেষ সময়টুকুর কিছু কর্মকাণ্ডের
ছাপ পাওয়া গেল।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল সকাল বেলায়। এক দায়িত্বরত সেনা
যখন অনির্বাণ যে ঘরটায় বন্দি ওটার বাইরে থেকে তালা খুলে দরজা সরাল তখন। সেকি? ঘরের কোথাও অনির্বাণ নেই। জানালা দরজা সব খুলে দেখা গেল-- দেয়ালে দেয়ালে অসংখ্য আঁকিবুকি। লেখা বা অভিব্যক্তির চিন্থ। ছোপ ছোপ জমাট
রক্ত। অনির্বাণ কোথাও নেই। শুধু মেঝেতে পরে আছে একটা সোনার কংকাল।
১০ অক্টোবর ২০০৪
কাঁঠালবাগান
রেজা ঘটক
জন্ম: ২১ এপ্রিল ১৯৭০ (৮ বৈশাখ ১৩৭৭), উত্তর বানিয়ারী, নাজিরপুর, পিরোজপুর, বাংলাদেশ।
পড়াশুনা: অর্থনীতি শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও মাস্টার্স।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
ছোটগল্প: বুনো বলেশ্বরী, ছোটগল্প সংকলন, ২০০৮। সোনার কঙ্কাল, ছোটগল্প সংকলন, ২০১০। সাধুসংঘ, ছোটগল্প সংকলন, ২০১১ । ভূমিপুত্র, ছোটগল্প সংকলন, ২০১৩
উপন্যাস: মা, ২০১২।
সমালোচনা: শূন্য দশমিক শূন্য, ২০১১।
কিশোর গল্প: বয়োঃসন্ধিকাল, ২০০৫।
শিশুতোষ: ময়নার বয়স তেরো, ২০০৩। গপ্পো টপ্পো না সত্যি, ২০১১।
0 মন্তব্যসমূহ