শ্রাবণী দাশগুপ্তর লেখক ভুবন : লিখতে ভালো লাগে বলে লিখি

গল্পপাঠ ১. গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  : আসলে ঠিক সচেতনভাবে লেখা শুরু হয়নি। কখন যে শুরু করেছি, কেনই বা, ভেবে পাইনি। খুব ছোটবেলা থেকে সাহিত্যের প্রতি অদ্ভুত টান তৈরি হয়েছিল। তার কৃতিত্ব আমার মা এবং আমার ঠাকুর্দার। স্কুলে যাওয়ার অনেক আগে থেকে বাড়িতে যা শিখেছিলাম, তাই ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল হয়তো। মনে পড়ে খবরের কাগজের শিরোনামগুলো পড়ে শোনাতাম ঠাকুর্দাকে। শিখতাম সংস্কৃত শ্লোক। মায়ের কাছে সহজপাঠ প্রথমভাগ।
দ্বিতীয়ভাগও শেষ হয়েছিল স্কুলে যাবার আগেই। “রাম বনে ফুল পাড়ে। গায়ে তার লাল শাল...” অথবা “একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনু...” কোথাও ছবি এঁকে রেখে যেত অজান্তেই। তাছাড়া ছবিতে রামায়ণ, ছবিতে মহাভারত, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ভালো বই। এভাবে বই ভালোবাসতে শুরু করি। বই অর্থে কাহিনী... গল্প, ছড়া, ছন্দোবদ্ধ কবিতা। লেখার মধ্যে বাক্যরচনা কিম্বা ছোটছোট প্রবন্ধ। ভালো লাগত লিখতে। কল্পনা করতেও। আর খানিকটা বড় হলে উপহারেও বই, মা-ও কিনে দিতেন বই। ঠাকুমার কাছে রাখা পঞ্জিকাও পড়তাম আবার মুড়ির খালি ঠোঙা ছিঁড়ে নিয়ে সেটাও। রচনা বইয়ের রচনা পড়তেও বেশ লাগত। কলমের আত্মকথা, পুরোনো বইয়ের আত্মকথা... এরকম রচনা লিখতে ভালো লাগত। স্কুল ম্যাগাজিনে ছড়া বা কবিতা দিয়েছি, পরেও যে চেষ্টা করিনি তা নয়। তবে আমার মনে হয় আমার ক্ষেত্র গল্প ও গদ্য। কবিতা আমার কাছে জন্মায় না।

গল্পপাঠ ২. শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  : ওই যে বললাম, ভেবেচিন্তে কিছু শুরু হয়নি। তখন রূপকথার গল্প পড়তাম... ঠাকুমার ঝুলি ছাড়াও আরো অনেক বই ছিল ছোটোদের। ওইভাবে কখনো লিখতে শুরু করি। খুব লাজুক ছিলাম, কাউকে পড়াতাম না। মা-ই হয়তো দেখতেন, বাড়ির অন্যদের দেখাতেন। কিছু কিছু ছেলেমানুষী কল্পনায় লেখা। ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম তখন। ছবিতে গল্প লেখার একটা নেশা হয়েছিল। বাবা খুব খুশি হয়ে, উতসাহ দিতেন। তবে সে সমস্ত খাতাপত্তর কিছু আর রাখিনি। ভাসাভাসা মনে পড়ে। স্কুলের শেষ পর্‍যায়ে পৌঁছে যেগুলো লিখতাম সেসব মোটামুটি সিনেমার মত রোম্যান্টিক গল্প। ততদিনে শেষের কবিতা বা রাজলক্ষী-শ্রীকান্তের প্লেটনিক প্রেম মাথায় বেশ জমিয়ে বসেছে। নিজের লেখাগুলো ঘনিষ্ঠ দু’একজন বান্ধবী ছাড়া কাউকে পড়াতাম না। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। অনেকাংশে সেই ছায়াও থাকত। আমার একেবারে প্রথমদিকে লিটল ম্যাগাজনে প্রকাশিত লেখাগুলো ওরকমই। আর যেটি খুব আনন্দে লিখতাম, সেটি চিঠি। পরিজনকে চিঠি লেখার প্কারথা তো ছিলই। আর গোপনে কাল্পনিক... এক চরিত্র অন্য চরিত্রের সঙ্গে পত্রাচার করছে। ভীষণ উপভোগ করাতাম এই স্বকল্পিত উত্তর প্রত্যুত্তরের বিস্তার। আমার প্রথম প্রকাশিত গল্প এক চিঠি... এক পাঠিকা লিখছে পরিচিত এক লেখিকাকে। আমি ছিন্নমূল পরিবারের মেয়ে। সমস্ত ফেলে রেখে আসা একটা পরিবারের দিনযাপনের সংঘর্ষ দেখে বেড়ে উঠেছিলাম। শুধু পিতৃস্থানীয়েরা নন, মাতৃস্থানীয়েরাও ছিলেন লড়াইয়ের প্রতি পদক্ষেপে। সেসবও অবচেতনে কখন জমা পড়েছিল বুঝতে পারিনি।

গল্পপাঠ ৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  : সে অর্থে প্রস্তুতি নেওয়া তো দূরের কথা, ভাবিই নি কখনো। ভালো লাগা থেকে লিখেছি। গল্প বা উপন্যাস পড়ে অবাক হয়ে ভাবতাম, কি করে এমন লেখেন! কোথায় পাবো তারে – পড়ে সমরেশ বসুর প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হত। সব নারী চরিত্রগুলোয় নিজেকে বসিয়ে কল্পনা করতাম। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লেখা পাঠিয়েছিলাম আঞ্চলিক স্যুভেনিরে। প্রকাশকেরা নিয়েছিলেন। সেসব সময়ের লেখা এখন মনে হয়... প্রাণটি তেমনই আছে, বাইরের চেহারাটি পুরোনো হয়ে গেছে।

গল্পপাঠ ৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  :  আমার লেখার সংখ্যা এতই কম যে ক্রাফট্‌ বা প্রকৌশল কি, তা নিজেই খুঁজে চলেছি। আমার মনে হয় এই বিষয়টি কিছুটা হলেও পাঠকের ওপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত। পাঠক লেখকের লেখা পড়ে মতামত দিন না... লেখার গঠনপ্রণালী কী বা কেমন! তবে এটুকু বলি যে কোনও সাধারন মুহূর্ত বা অনুভব বা সামান্য কথা থেকে অনেক সময়ে গল্প পেয়ে যাই। এর বেশি আর বলতে পারিনা। আর সচেতনভাবে ইংরেজী ও হিন্দী শব্দের ব্যবহার এড়ানোর চেষ্টা করি। বাংলা শব্দভান্ডারের অনেক শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে, খুব খারাপ লাগে।

গল্পপাঠ ৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  : জানিনা। লিখতে ভালো লাগে বলে লিখি। লিখে আনন্দ পাই। নিজের লেখা সম্বন্ধে এর থেকে বেশি বলার মত সময় এখনো আসেনি।

গল্পপাঠ ৬. আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  : পৃথিবী জুড়ে এত সব অসাধারণ লেখা হয়েছে বা হচ্ছে, তার মধ্যে সেরা গল্পকার বলব কেমন করে? তবে বিমল করের ছোট গল্প আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে খুব। কী একটা আছে ওঁর লেখায়, যেটা ভোলা যায়না। যেমন নভোস্তি... গল্পটিতে কী অসাধারণভাবে দার্শনিকতা ছুঁয়ে গেছে... শুধু চরিত্রগুলির স্বাভাবিক কথোপকথনে... কোথাও উচ্চকিত কিছু নেই... মুগ্ধ করে দেয়। এমন অনেক গল্প আছে ওঁর। তাছাড়া বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়... জড়তাহীন সরল গতিময়তা... ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল। আপাতভাবে অতি সাধারণ, কিন্তু কোথায় যে স্পর্শ করে রাখে! তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ছুটি... চিরন্তন, চিরকালের। চমকে দিয়েছে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গিরিগিটির মত গল্প... এসবই ঘটনাবহুল গল্পকথন নয়... বিন্দু থেকে সিন্ধুতে উত্তরণ অসাধারন দক্ষতায়। আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই। মঁপাসা আমার ভীষণ প্রিয় লেখক। তাঁর গল্পে অন্যরকম ভাবনায় লেখা অন্যদেশের যুগ সন্ধিক্ষনের দলিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা চিনিয়েছে দেশভাগ, দারিদ্র, সংঘাত বা দ্রোহ। দেশভাগের প্রায় সতের বছর পরে আমার জন্ম। তবু পড়তে পড়তে মেলাতে চেষ্টা করেছি পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে, কারন তখনো যৌথ পরিবার এভাবে নিশ্চিহ্নপ্রায় হয়ে যায়নি।

গল্পপাঠ ৭. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  :  আমার পাঠকের সংখ্যা খুব সীমিত। সে অর্থে আমি এখনো লেখক হইনি... একথা শুরুতেই বলে দিয়েছি। তবু বলব, পাঁচজন বিশিষ্ট বিদগ্ধ পাঠক তাঁদের পাঠপ্রতিক্রিয়া জানালে আমার মনে হয় সার্থক হলাম। তাই বিনীতভাবে বলি, এখনও পর্‍যন্ত লিখি নিজেরই জন্যে। যেসমস্ত ভাবনা মনের মধ্যে নড়েচড়ে, তাদেরকে খানিকটা গুরুত্ব দিয়ে খাতায় নামানোর চেষ্টা করি। আমি বেশ খুঁতখুঁতে অবশ্য, লেখার পরে সব সময়েই মনে হয়, সবটা লেখা হলনা যেমনভাবে চেয়েছি। লেখার পরে অনেকবার কাটাকুটি করি। তারপর কোথাও কোথাও পাঠাই। কেউ গ্রহন করলে, প্রশংসা করলে ভারী খুশি হই, উতসাহিতও।

গল্পপাঠ ৮. এখন কি লিখছেন?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  : খামখেয়ালে লিখি। তাই এই মুহূর্তে কিছু লিখছি না। ভাবছি কিছু লেখা যায় কিনা। আসলে আমার লিখতে অনেক সময় লাগে। তাই, নিদির্ষ্ট সময় বা শব্দসংখ্যা থাকলে অসুবিধেয় পড়ে যাই। আসলে আমার লেখাটা পুরোটাই ভালো লাগা থেকে আসে।

গল্পপাঠ ৯. আগামী কি লিখবেন?

শ্রাবণী দাশগুপ্ত  :  আগামীতে কি লিখব, জানিনা। অনেকে বলেছেন, উপন্যাসে হাত দেবার কথা। সাহস পাইনি। ভাবিইনি এখনো।



লেখক পরিচিতি
শ্রাবণী দাশগুপ্ত

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
এখন রাঁচিতে থাকেন।

গল্পকার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. বড় দুখজাগানিয়া মনটানানিয়া তোমার গল্পটা শ্রাবণী। নামকরণও সুন্দর।
    নীতা বিশ্বাস।

    উত্তরমুছুন
  2. Onek onek dhonyobad Neetadi'....

    Srabani.

    উত্তরমুছুন