অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে। বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়--ধূলিহর গ্রামে। বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে। গেল বছর অবসর নিয়েছেন। এখন সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে মগ্ন।
১৯৭৪ সালে মেলার দিকে ঘর গল্প নিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আত্মপ্রকাশ। ধীরে ধীরে নিজেকে বিকশিত করেছেন। প্রথম উপন্যাস নদীর মানুষ ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই মাঠ ভাঙে কালপুরুষ ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। ধ্রুবপুত্র লেখা হয়েছিল ৭ বছর ধরে। এই উপন্যাস খরা পীড়িত প্রাচীন উজ্জয়িনী নগরের কথা। এর যা কাহিনি তার সমস্তটাই লেখকের নির্মাণ। কবির নির্বাসনে নগর থেকে নির্বাসনে যায় জ্ঞান। মেঘে তার যাত্রাপথ বদল করে নেয়। প্রকৃতির এই পরিবর্তনে নগরে নেমে আসে বিপর্যয়। দীর্ঘ এই আখ্যান শেষ পর্যন্ত শূদ্র জাতির উত্থান ও কবির প্রত্যাবর্তন এ পৌঁছয়। এই কাহিনি যেন কবি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের বিপরীত এক নির্মাণ। খরা, জলের অভাবে আমার দেশ নিরন্তর দগ্ধ হয়। সেই কাহিনি এখানে এসেছে রূপক হয়ে। মেঘের অভাব জ্ঞানের অভাব। সৃজন কাল বন্ধ্যা হয়ে থাকে। দেশ তার ভিতরে পোড়ে। ক্ষমতা কী ভাবে মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে নিরন্তর, এই উপন্যাস সেই কথাও খুঁজে বের করতে চেয়েছে। ২০০৬ সালে এই উপন্যাস সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে।
১৯৯৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাস অশ্বচরিত তথাগত বুদ্ধের ঘোড়া কন্থক ও তাঁর সারথী ছন্দকের কাহিনি। তারা এই আড়াই হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছে রাজপুত্রের প্রত্যাবর্তনের জন্য। এতদিনে এই পৃথিবী হিংসায় পরিপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরের তীরে দীঘার ছোট এক হোটেলের খরিদ্দার সংগ্রহকারী ভানুদাস নিজেকে নিজেকে বলে ছন্দক। হোটেলওয়ালার টাট্টু ঘোড়ার পালক সেই ভানুদাস ঘোড়াটিকে বলে কন্থক। বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে ঘোড়াটি পালায়। ভানুদাস সেই ঘোড়ার খোঁজে যায় চারদিকের গ্রামে গ্রামে, হাটে হাটে। রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে কোথায় না ? এই উপন্যাস সময় থেকে সময়ান্তরে যাত্রা করেছে বারে বারে। তথাগত বুদ্ধের সময় থেকে হিংসাদীর্ণ এই সময়ে। সেই ঘোড়াটিও পালাতে পালাতে শেষ পর্যন্ত যেন হিরোসিমায় গিয়ে কালো বৃষ্টির ভিতরে গিয়ে পড়ে। লেখক ভারতীয় প্রতিবেশে জাদু বাস্তবতার ব্যবহার করেছেন এই উপন্যাসে। ঘোড়াটি প্রতি আশ্বিনে পালাত। এইবার পালিয়েছে ঘোর বৈশাখে। প্রকৃতি এক দিনেই দুই ঋতু যেন পার হয়ে গিয়েছিল। এই উপন্যাসের কোনো শেষ নেই যেন। চলতেই থাকে। অশ্বচরিত বাংলা উপন্যাসে এক আলাদা রীতির জন্ম দিয়েছে যেন। লেখক হিংসা আর মৃত্যুর বিপক্ষে জীবনের কথা শুনিয়েছেন। পরমাণু অস্ত্রের বিপক্ষে কথা বলেছেন। ২০০১ সালে এই উপন্যাস বঙ্কিম পুরস্কারে ভূষিত হয়।
২০১৪ সালে কলকাতা বইমেলার কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে অমর মিত্রের নতুন উপন্যাস দশমী দিবসে।মাইকেল মধুসূদনের জীবন আর দেশভাগকে উপন্যাসের কাঠামোয় মিলিয়েছেন অমর মিত্র, তাঁর দশমী দিবসে ) উপন্যাসে।
অমর মিত্র এই উপন্যাসটি বিষয়ে লিখেছেন--
আমি এই দশমী দিবসে উপন্যাসটি দীর্ঘদিন ধরে লিখেছি। এই উপন্যাসের কাল দেশভাগের বছর দশের পর থেকে এই সন্ত্রাস কবলিত সময়। কিন্তু এর ভিতরে অনেকটা অংশ জুড়ে আছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রেবেকা, হেনরিয়েটা, মা জাহ্নবী, রাজনারায়ণ দত্ত আর সাগরদাঁড়ি ও কপোতাক্ষ নদ। সময় থেকে সময়ান্তরে যাত্রা করেছে মানুষ। মেঘনাদের মৃত্যু ও রাবনরাজার হাহাকার, মধুসূদনেরই ব্যক্তি জীবনের ছায়ায় ঢাকা যেন। এই উপন্যাসে বীরাঙ্গনা ওপার থেকে নিয়ে এসেছে কবি মধুসূদনকে। মধুর কথা, সাগরদাড়ির কথা নিয়ে আসতে পেরেছে, আর সাত পুরুষের ভিটে গ্রাম মহকুমা জেলা কপোতাক্ষ নদ রেখে এসেছে ওপারে। সে চারণ কবির মতো মধুর কথা বলে বেড়ায়। এই শহরে পার্ক স্ট্রিট কবরখোলায় গিয়ে তার সঙ্গে বুঝি দেখা হয় রেবেকা হতভাগিনীর। হেনরিয়েটার প্রেমে পড়ে তাকে মাদ্রাজে ফেলে এসেছিল নিষ্ঠুর মধু। বুড়ি রেবেকা সেই থেকে কবির কবরের সামনে বসে বুঝি অশ্রুপাত করে। তার গাউনের পকেটে থাকে তাকে নিবেদন করা কৃষ্ণাঙ্গ কবি মধুসূদনের প্রথম কাব্য গ্রন্থ, জীর্ণ হয়ে যাওয়া ক্যাপটিভ লেডি। বীরাঙ্গনার কাছে খোজ নেয় সে, কী হইল সাগরদাড়ির, কী হইল কপোতাক্সোর ? দেশ ভাগ হইল তো কপোতাক্ষ লইয়া আসিতে পারিলে না বীরা? উহাকে ফেলিয়া আসিলে, মধুর রিভার ?
এই উপন্যাস সময় থেকে সময়ান্তরে যাত্রা করে। এখানে নানাযুগ এক যুগে এসে মেশে, এ যেন আমি দেখতে পাই। আমি নিজে যেন দেখেছিলাম সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ তীরে মধু তাঁবু ফেলে বসে আছে মা জাহ্নবীর সঙ্গে দেখা করবে , সে খ্রিস্টান, ত্যজ্য পুত্র। সে যাবে কালাপানির ওপারে। যে ঘাটে অপেক্ষা করেছিল মধু, যে ঘাট দিয়ে চলে গিয়েছিল অনন্ত জীবন সমুদ্রে, সেই ঘাট বিদায় ঘাট। আর আসেনি মধু। দেশভাগের পর সমগ্র দেশটি হয়ে যায় বিদায় ঘাট। আর দেশের সমস্তদিন যেন হয়ে ওঠে দশমী দিবস।
দশমী দিবসে
অমর মিত্র
প্রকাশক : ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট
কোলকাতা।
এছাড়াও সমসাময়িক প্রকাশ করেছে অমর মিত্রের ২০ টি গল্পের সংকলন--
২০১৪ সালের কোলকাতা বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে--কন্যাডিহি উপন্যাস।
প্রকাশক : দে'জ পাব্লিশার্স।
এই উপন্যাসের সিনোপসিস :
জাহ্নবী দেখছিল পদ্মপুকুর চলে গেল। দেখছিল তার বকুলফুল সই ভদ্রা মিলিয়ে গেল। সব মিলিয়ে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। ঠাকুরতলা, বটতলা, অশথতলা, হলদিডাঙা, মধুগুলগুলি আম গাছটি---সব। বাবার মুখও আবছা হয়ে গেল। জাহ্নবী যেন নদীর মতো বয়ে যেতে লাগল। বুঝতে পারছিল যা ফেলে যাচ্ছে তা চিরকালের মতোই ফেলে যাচ্ছে। যা চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে, তা চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে। যেমন যায় নদী। নদী কি পিছনে ফিরতে পারে ? বিকেল বিকেল সে পৌঁছল মহাজনের বাড়ি।
0 মন্তব্যসমূহ