প্রভাস চন্দ্র মজুমদার
আমার জন্ম ১৯৩৪ সালে অবিভক্ত বাংলার মৈমনসিংহ জেলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে। দেশে তখন ইংরেজ শাসন চলছে। সুতরাং জন্মসূত্রে আমি বৃটিশ ভারতীয়। ইংরেজ শাসন-মুক্ত হয়ে দেশের স্বাধীনতা লাভ ঘটে ১৯৪৭ সালে। তখন আমার বয়স তেরো বছর। তবে স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে দেশভাগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা জড়িয়ে থাকায় আনন্দের চেয়ে বেদনা-বোধ বেশী হয়েছিল। ইংরেজ ভারত ছেড়ে যাবার সময়ে শাসন ক্ষমতা ভাগ করে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তানের দাবীর স্বীকৃতি দিয়ে যায়। সুতরাং বৃটিশ ভারত দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয় – ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানও আবার দুই অংশে – পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিভক্ত হয়ে থাকে। অবশ্য পূর্ব-পাকিস্থান শেষ পর্যন্ত পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘বাংলাদেশ’ নামে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। সেটা ১৯৭০-৭১ সালের ঘটনা।
দেশভাগের ফলে যে সব জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল, তাদের মধ্যে সর্বপ্রধান উদ্বাস্তু সমস্যা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক লক্ষ লোক প্রাণ হারায় আর প্রায় দু’কোটি মানুষ বাসভূমি থেকে উৎখাত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এই উদ্বাস্তু-স্রোত বহুদিন অব্যাহত ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তান থেকেই অ-মুসলমানরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে চলে আসে। আবার কিছু মুসলমানও ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যায়। তবে সংখ্যার বিচারে ভারতে আগত উদ্বাস্তুরা ছিল অনেক বেশী।
উদ্বাস্তু হিসাবে দেশত্যাগের পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেক কারণ ছিল। প্রথম ও প্রধান কারণ ধন-প্রাণের নিরাপত্তার অভাব। অ-মুসলমানরা পাকিস্তানে নিরাপদে বসবাস করতে পারবে না – এই ধারণা ক্রমশ ব্যাপক হয়ে উঠছিল। পর পর কয়েকটি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রবল আতঙ্কের সৃষ্টি করে। যে সব অঞ্চলে হিংসাত্মক কার্য্যকলাপ প্রবল হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকেই বেশী সংখ্যায় উদ্বাস্তুরা দেশত্যাগ করে। যারা অনেক দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করেও থেকে যাবে বলে ভেবেছিল, তারা শেষে নিরুপায় হয়ে ভিটে মাটি ছাড়া হল।
উদ্বাস্তুদের মধ্যে আর্থ-সামাজিক(socio-economic) পার্থক্যজনিত কারণে শ্রেণী-বিভাগ ছিল। শিক্ষিত ও সঙ্গতিপন্নরা সরকারী সাহায্য ছাড়াই নিজেদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে নেয়। এদের সংখ্যা ছিল অল্প। যারা হিংসা, হানাহানি, অত্যাচার ও উৎপীড়নে ধন, প্রাণ হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল, তারাই ছিল সংখ্যায় বেশী। এরা রিফিউজি ক্যাম্প(Refugee Camp) ও জবরদখল কলোনীতে(Squatter’s Colony) অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে কোনোমতে টিঁকে ছিল। সরকারী সাহায্য ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তার থেকেও অনেকটাই দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও রাজনৈতিক দাদারা লুটে-পুটে খেয়েছে। অনাহার, অপুষ্টি ও নানা ব্যাধিতে ভুগে মারা গিয়েছে বহুসংখ্যক।
নানারকম সরকারী নিয়মকানুনের মারপ্যাঁচে অনেকের পক্ষেই উদ্বাস্তু হিসাবে পুনর্বাসনের সাহায্য পাওয়া সহজ ছিল না। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের প্রতি ভারত সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণেরও অভিযোগ আছে। উদ্বাস্তু আগমন বন্ধ করা সম্ভব না হলেও যথেষ্ট হ্রাস করার জন্য নেহরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে দুই দেশেরই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, জীবন ও জীবিকার গ্যারান্টী-সহ অনেক ভালো কথা বলা হয়। কিন্তু কাজের বেলায় বিশেষ কিছু হয়নি। তার পরেও পূর্ব-পাকিস্তানে অনেক বার দাঙ্গা হয়েছে। বিপন্ন সংখ্যালঘুরা দলে দলে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে।
কলকাতা অবিভক্ত বাংলা এবং একসময় বৃটিশ ভারতের রাজধানী ছিল বলে কর্মসূত্রে ও নানা প্রয়োজনে পূর্ব বাংলার বেশ কিছু লোক দেশভাগের আগে থেকেই এদিকে বসবাস করছিলেন। তাঁদের আত্মীয় ও বন্ধুবর্গ দেশত্যাগে মনস্থির করে তাঁদের সাহায্যের আশায় এদিকে চলে আসেন। তাঁরা সাহায্য তেমন কিছু পান নি। তবু মনে কিছু বল-ভরসা পেয়েছেন। দেশভাগের সময়ে যে সব পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ পশ্চিমবঙ্গে কিংবা ভারতের অন্যত্র বসবাস করত না, তারা দলবদ্ধভাবে একসঙ্গে এদিকে আসেনি। যার যখন যেমন প্রয়োজন বা সুবিধা হয়েছে সে সেইভাবেই এসে বহু উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে কম-বেশী থিতু হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের পরিবারের অবস্থাটা ছিল একটু ভিন্ন রকম। শৈশবে আমার পিতৃ বিয়োগ হয়। জীবনযাত্রা ছিল কৃষিভিত্তিক। কিছু জোতজমির উৎপন্ন ফসলেই কায়ক্লেশে সংসার চলত। আমার বড় দাদা ছিলেন পরিবারের অভিভাবক। পোষ্য সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। পাঁচ ভাই, বিধবা মা, এক ভ্রাতৃ-বধু, চারটি ভাইপো-ভাইঝি। সব মিলিয়ে এগারো জন। আমার দুই দিদি ছিলেন। আমার অত্যন্ত শৈশবেই তাঁদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমাদের জীবিকার উৎস পূর্ব-পাকিস্তানের চাষজমি। ভারতে কোনো আয়ের পথ ছিল না। সুতরাং দেশত্যাগের কথা প্রথমে ভাবিনি।
আমার বড়দাদার লেখাপড়া ইংরেজ আমলের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পাশ করার পর বহুকাল কোনো চাকরী পান নি। সামান্য পৈতৃক বিষয় সম্পত্তি দেখা শোনার কাজ করে কাটিয়েছেন। আমার এবং অন্য ভাইদের স্কুলের লেখাপড়া পূর্ব-পাকিস্তানে। আমার ছোটভাই ১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় খুবই ভাল ফল করে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসে। মেধা ও কর্মশক্তির সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস থেকে Migration Certificate নিয়ে এসেছিল বলে পড়াশোনা করার সময় Refugee Stipend পেয়েছিল। আমি জেলা শহরে দিদির বাড়ীতে থেকে পড়াশোনা করেছি। ওঁরা দেশ ছেড়ে চলে আসার কথা ভাবছিলেন না বলে আমিও আরো কয়েক বছর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষাটাও পাশ করে এসেছিলাম। আমি প্রায় নয় বছর পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাস করে ১৯৫৬ সালে স্থায়ীভাবে সে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসি। ততদিনে আমাদের পরিবারের বেশ কয়েকজন ভারতে এসে বসবাস শুরু করেছে, যদিও তাদের প্রায় সবাই আর্থিক দূরবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল। আমার বড়দাদাও চব্বিশ পরগনার একটি স্কুলে শিক্ষকতা কাজ পেয়ে এদেশে সপরিবারে চলে আসেন। তার পর অল্পদিনের মধ্যেই পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একরকম চুকে যায়। ঘনিষ্ঠ আপনজন ঐ দেশে আর কেউ থাকল না।
আমি পূর্ব-পাকিস্তানে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছি। দুটো স্কুলে শিক্ষকতাও করেছি। কখনও উপদ্রব বা উৎপীড়ন সহ্য করতে হয় নি। ‘কাফের’ বলে কেউ কখনও কটুক্তি করেনি। সাধারণভাবে সকলের কাছে ভদ্র ব্যবহারই পেয়েছি। এ সব সত্ত্বেও জন্মভূমি ছেড়ে চলে এলাম ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে অ-মুসলমানরা সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারবে না এবং সুবিচার পাবে না – এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকায় দেশ ত্যাগী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হল। কম বয়সের ভাগ্যান্বেষণের প্রবল আকাঙ্খাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
Migration Certificate নিয়ে আসার কথাই প্রথমে ভেবেছিলাম, কিন্তু বহু চেষ্টা করেও সংগ্রহ করা গেল না বলে অগত্যা পাকিস্তানী পাসপোর্ট ও ভারতীয় ভিসা নিয়েই এ দেশে আসি। এর ফলে আমি Refugee Status পাইনি এবং Rehabilitation benefits অধরাই থেকে যায়। নিজের শক্তি সামর্থ্যর ওপর ভরসা করেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছিল। পাসপোর্ট সারেন্ডার করে রেজিস্ট্রেশানের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করি। তাতে বছর দুই সময় লেগেছিল।
পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বি.এ. পাশ করে এসেছিলাম বলে কলকাতায় এম.এ. পড়ব বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। University College of Arts and Commerce-এ ইংরেজী ও ইকনমিক্সে এম.এ. পড়ার জন্য দরখাস্ত করি। ইকনমিক্সে পড়ার চান্স পাইনি, ইংরেজীতে পেয়েছিলাম। আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা হল যাদবপুর বিজয়গড়ের রিফিউজি কলোনীতে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ীতে। সেখানে রিফিউজি কলোনীর জীবন যাত্রার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল। জায়গাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারি ক্যাম্প ছিল। দলে দলে উদ্বাস্তু এসে জায়গাটা দখল করে নেয়। তাড়াতাড়ি একটা সংগঠন তৈরী করে সরকারের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা শুরু হয়। পল্লীর সদস্যারা প্রত্যেকেই দেড়-দু’কাঠা জমির প্লট পায় আর তার ওপর বাঁশ, বাঁশের চাটাই ও টালি দিয়ে ঘর তৈরী হয়। বেশীর ভাগেরই কাঁচা ভিত। অল্পসংখ্যক, যাদের কিছু পুঁজি ছিল, তারা মেঝেটা পাকা করে নেয়। ঘিঞ্জি বসতি হওয়ায় আর নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষাকালে জল জমে দুর্দশার অন্ত ছিল না। এক কথায় ওখানকার জীবন যাত্রা ছিল প্রায় আদিম। জলের উৎস ছিল ব্যক্তিগতভাবে করা টিউবওয়েল ও পাতকুয়ো। কোনো পৌরসভা জল-সরবরাহ ও আবর্জনা পরিস্কারের দায়িত্ব নেয় নি। জমির ওপর আইনি অধিকার না থাকায় কেউই নিজের অর্থ ব্যয় করে উন্নয়নের চেষ্টা করেনি। অধিবাসীদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ যথেষ্ট না হলেও সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অভাব ছিল না। পরস্পরের বিপদে-আপদে সাহায্য করার লোকাভাব হয়নি। ক্রমে নানা রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ায় উদ্বাস্তুদের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা ও হানাহানি শুরু হয়। এতে সামাজিক পরিবেশ খারাপ হয়ে ওঠে। সামগ্রিকভাবে উদ্বাস্তুদের ওপর বাম-রাজনীতির প্রভাব ছিল বিশেষ প্রবল। CPI(M) বহুকাল উদ্বাস্তুদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসাবে কাজে লাগিয়েছে।
আমি বিজয়গড়ে যাঁর বাড়ীতে এসে উঠেছিলাম তাঁর সঙ্গে অনেকটা পেয়িং গেস্টের মত বন্দোবস্ত ছিল। বাড়ীর উঠোনে একটা ফাঁকা টালির ঘর ছিল, সেটাতে থাকতাম, আর খাবার জন্য মাসে চল্লিশ টাকা করে দিতাম। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসার সময় কিছু সঞ্চিত টাকা-পয়সা এনেছিলাম। তাতে কয়েক মাস চলেছিল। কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম বলে যাতায়াত ও টিফিনের খরচ ছিল। তার পর খাতা-পত্র, টুকিটাকি নানা জিনিসের পেছনেও খরচ ছিল। সব শুদ্ধ আরো গোটা পঞ্চাশেক টাকা প্রতি মাসে লাগত।
তখন ভারতীয় টাকার বিনিময় মূল্য পাকিস্তানী টাকার চেয়ে বেশী ছিল বলে। একটু কম বেশী হাজার খানেক ভারতীয় টাকা ওখান থেকে যা এনেছিলাম তার বিনিময়ে পেয়েছিলাম। হিসাব করে দেখলাম, এই টাকাতে আমার আট-ন’মাস চলতে পারে। ইংরেজী নিয়ে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পড়ছিলাম বলে ভাল ট্যুইশান পাব আশা করেছিলাম। তাহলে দু-একশো টাকা মাসে অনায়াসেই রোজগার করা যাবে। কিন্তু যেমন আশা করেছিলা তেমন হল না। খুব কম মাইনের দু-একটার বেশী ট্যুইশান পাইনি। এতে বড় রকম আর্থিক সঙ্কটে পড়ে গেলাম। বিজয়গড়ে যাঁর ওখানে থাকতাম তাঁর খুব টানাটানির সংসার ছিল। এই কারণে প্রতি মাসের গোড়াতেই আমার দেয় টাকাটা তাঁকে দিয়ে দিতাম। যখন পুঁজি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছিল তখন একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে হল। পল্লী অঞ্চলে অনেক নতুন স্কুল খোলার দরুণ স্কুল শিক্ষকের চাহিদা খুবই বেড়ে যায়। গ্র্যাজুয়েট হলে সেই কারণে সহজেই গ্রামের স্কুলে শিক্ষকের চাকরী পাওয়া যেত। আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে অগত্যা হুগলি জেলার এক গ্রামে শিক্ষকের চাকরী নিয়ে চলে গেলাম। University College of Arts and Commerce-এর সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িকভাবে ছিন্ন হয়ে গেল। স্কুলে মাসিক বেতন পেতাম একশো কুড়ি টাকা। স্কুল হস্টেলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। তার জন্য মাসে পঁচিশ-ত্রিশ টাকার বেশী খরচা হত না। মাসে সত্তর-আশি টাকা সঞ্চয় হত। সাত মাস স্কুলে চাকতি করেছিলাম। শ’-পাঁচেক টাকা পুঁজি নিয়ে স্কুলের চাকরী ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলাম কলকাতায়। আবার লেখাপড়া শুরু করলাম। এর মধ্যে আমার ছোট জামাইবাবু ভারত সরকারের চাকরীতে বদলী হয়ে কলকাতায় চলে এলেন ও উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়ায় বাসা নিলেন। বিজয়গড়ে আর ফিরে গেলাম না। দিদির ওখানে ফ্রী থাকা-খাওয়ার সুবিধা পেয়ে গেলাম বলে আর্থিক দায় অনেকটা কমে গেল। সাত আট মাস মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে এম.এ. পরীক্ষাটা দিলাম এবং ভাগ্যগুণে একটা সেকেন্ড-ক্লাস ডিগ্রী পেয়ে গেলাম।
এই ডিগ্রীটাই আমার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার মূলধন ছিল। আমি এম.এ. পাশ করেছি ১৯৫৮-এ। এই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলের তিনটি ক্লাস ছিল – ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড ক্লাস। ৪৫%-এর কম নম্বর পেলে থার্ড ক্লাস দেওয়া হত। সব থেকে বেশী সংখ্যক পরীক্ষার্থীর কপালে ঐ থার্ড ক্লাসই জুটত। এই জন্য একে বলা হত ‘জনতা ক্লাস’। আর থার্ড ক্লাস পেয়ে পাশ করলে কলেজে পড়ানোর অযোগ্য বিবেচিত হত। নিয়মিত পড়াশোনায় ছেদ পড়া সত্ত্বেও আমার পক্ষে এম.এ.-তে সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া ছিল পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। ফলটা বেরুনোর পর মনে হয়েছিল – “Too good to be true!”
পরীক্ষার ফলটা বেরুনোর পর আমার আর কর্মসংস্থান নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা রইল না। প্রথমে ছ’-সাত মাস আমার বড়দাদার কর্মস্থল গোবরডাঙ্গা খাঁটুরা স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলাম। সেখান থেকে টেলিগ্রাফিকালি Appointment Letter পেয়ে চলে গেলাম আসামের কামরূপ জেলার নলবাড়ী কলেজে। ওখানে বছর খানেক অধ্যাপনা করে ফিরে এলাম পশ্চিমবঙ্গে। এসে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিলাম বীরভূমের রামপুরহাট কলেজে। এখানে কাজে যোগ দিই ১৯৬০ সালে। পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করে ১৯৯৫-এ কর্মজীবন থেকে অবসর নিই। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পেনশান পাচ্ছি আর তা দিয়েই খাওয়া-পরা চলছে।
এই হল সংক্ষেপে আমার কর্মপঞ্জী, Curriculum Vitae।
জীবনে প্রতিষ্ঠিত নিজের চেষ্টাতেই হয়েছি। কোনো সরকারী সাহায্য পাইনি।
___________________________________________________
প্রভাস চন্দ্র মজুমদার রামপুরহাট কলেজ (পশ্চিমবঙ্গ) থেকে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
প্রভাস চন্দ্র মজুমদার রামপুরহাট কলেজ (পশ্চিমবঙ্গ) থেকে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
0 মন্তব্যসমূহ