গল্প নয় সত্যি : কেউ খোঁজ রাখে না সেই তাসলিমার


রফিকুল ইসলাম রতন
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল, ২০১৪
দৈনিক যুগান্তর

গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে নোবেল পুরস্কার গ্রহীতা শিবগঞ্জের তাসলিমা বেগমের খোঁজ এখন আর কেউ রাখেন না।
নিভৃত গ্রাম পীরগাছির ছোট্ট এক চিলতে ঘরে রোগার্ত তাসলিমা কাতরালেও তাকে দেখার কেউ নেই। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসসহ কেউই এ পর্যন্ত তার কোনো খবর নেননি। নিজের যৎ সামান্য সামর্থ্য দিয়েই চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন তাসলিমা।
তাসলিমা বেগমের দুঃখ এতবড় একটি সম্মান তার হাতে উঠলেও, গ্রামীণ ব্যাংক ও দেশের কোনো মানুষ তাকে মনে রাখেনি। ২০০৬ সালের ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের রাজধানী অসলোর সিটি হলে জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাসলিমা বেগমও গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে গ্রহণ করেছিলেন নোবেল পুরস্কার। কিন্তু তার মর্যাদা এতটুকুও বদলায়নি। নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণের পর থেকে ড. ইউনূস অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সারা দুনিয়া চষে বেড়ালেও সবাই ভুলে গেছেন তাসলিমাকে। যাদের শ্রম আর ঘামে গড়ে উঠেছে এই ব্যাংকটি, যাদের বলা হয় ব্যাংকের প্রকৃত মালিক এবং যে তাসলিমা ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের এক নম্বর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, তারই কিনা আজ এ অবস্থা!
ক্ষোভ, কষ্ট ও দুঃখের সঙ্গে তাসলিমা বেগম জানান, ‘নোবেল পুরস্কার নেয়ার জন্য স্যারের (ড. ইউনূস) সঙ্গে নরওয়ে ও সুইডেন গিয়ে এত যে সম্মান পেলাম, তার পর থেকে আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে ঢাকায় ডাকেনি। কেউ কোনো সাহায্যও করেনি, খোঁজখবরও নেয়নি। ওই আগের মতোই গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যান্য ঋণগ্রহীতার সঙ্গে ধাইনগর শাখা থেকে সমিতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। লাভের মধ্যে এতটুকুই যে, ওই সময় পত্রপত্রিকায় স্যারের পাশে আমার ছবিও ছাপা হয়েছিল। তার সঙ্গে টেলিভিশনে আমাকেও দেখানো হয়েছিল। অনেক মানুষ সম্মান জানিয়েছিলেন। সে সময় ভেবেছিলাম, এই নোবেল পুরস্কার গ্রহণের উছিলায় হয়তো আমার ভাগ্য বদলে যাবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ওগুলো সবই ছিল স্বপ্ন আর দুরাশা।’
এসব কথা বলতে বলতে তার চোখ ভিজে যায়, ঠোট কেঁপে ওঠে, আবেগাপ্লুত হয়ে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘ওই নোবেল পুরস্কারের কয়েকটি ছবি বাড়িতে বাঁধিয়েও রেখেছি। যা দেখে আপসোস হয়। লাভের মধ্যে এই ছবির স্মৃতিটাই, আর কিছু হয়নি। কষ্ট লাগে যে, গ্রামীণ ব্যাংকও আমাকে আলাদা করে কোনো মূল্যায়ন করল না।’
চল্লিশোর্ধ্ব তাসলিমা বেগম সম্প্রতি তার আধাপাকা বাড়িতে একটি ছোট্ট বিছানায় শুয়ে যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন পাশে ছিলেন স্বামী আবু হানিফ। স্ত্রীর দুঃখ ও কষ্টে নিজেও বারবার কেঁদে ফেলেন তিনি। আবু হানিফ যুগান্তরকে বলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি যে, এতবড় সম্মান আর পুরস্কার গ্রহণের পর তাসলিমাকে সবাই ভুলে যাবে। আমরা গরিব মানুষ, বেশি কিছু চাই না, শুধু একটু সম্মান চাই।’
সাত বছরের বেশি সময় আগে অসলো নগরীতে জাঁকজমকপূর্ণ নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান শেষে এই প্রতিবেদককে তাসলিমা বেগম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি জীবনে কোনো দিন এরকম একটি দেশে আসতে পারব।’ তিনি বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি আমার মতো একজন গাঁও-গেরামের অল্প লেখাপড়া জানা অতি সাধারণ একজন মহিলা যে গ্রহণ করবে, তা ভেবেও গর্ববোধ হচ্ছে। জীবনেও ভাবিনি আল্লাহ আমায় এত সম্মান দেবেন। দোয়া করবেন, আমি যেন গ্রামীণ ব্যাংকের সব মহিলা সদস্যের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মান বজায় রাখতে পারি।’
তাসলিমা বেগম নোবেল পুরস্কার গ্রহণের পর ড. ইউনূসের সঙ্গে সুইডেন, নরওয়ে, লন্ডন ও ঢাকায় ব্যাপক সংবর্ধনা ও সম্মান পেলেও, তার জীবনে পরিবর্তনের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। তাসলিমা বেগমের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার সময় স্থানীয় বর্ষীয়ান এক ব্যক্তি তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় শুধু একজনেরই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ও তাসলিমাদের দিকে ফিরেও তাকাননি।’
যুগান্তরের শিবগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি মোঃ জোবদুল হক জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ধাইনগর ইউনিয়নের পীরগাছি গ্রামের তাসলিমা বেগম গ্রামীণ ব্যাংকের ধাইনগর শাখার ২নং কেন্দ্রের সদস্য ও ২নং গ্র“পের চেয়ারম্যান। সম্প্রতি পীরগাছি গ্রামে তাসলিমার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, তিনি অসুস্থ। শুয়ে শুয়েই কথা বলেন তিনি। তিনি জানান, ১৯৯১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ধাইনগর শাখা চালু হলে তার শ্বশুর প্রথম সেখানে এক সভায় যান। তাদের বক্তব্য শুনে পারিবারিক অস্বচ্ছলতা দূর করার লক্ষ্যে তাসলিমা বেগম গ্রামীণ ব্যাংক থেকে মৌসুমি ঋণ হিসেবে প্রথমে ৫শ’ টাকা ও সাধারণ ঋণ হিসেবে দেড় হাজার টাকা ঋণ নেন। ওই টাকা দিয়ে তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় শাকসবজি চাষ ও ছাগল পালন শুরু করেন। গত ৮ বছরে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের টাকায় ব্যবসা করে তিনি কোনো রকমে তার সংসার চালাচ্ছেন। ৪ শতক জমি বাড়িয়ে বর্তমানে ৩৩ শতকে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন। নির্মাণ করেছেন ৪ রুমের একটি পাকা ঘরও। তাসলিমা-হানিফ দম্পতির দুই ছেলে। বড় ছেলে আশরাফুল হক বর্তমানে পুলিশের সিপাহি পদে চাকরি নিয়ে চারঘাটে কর্মরত। ছোট ছেলে আবুল আওয়াল সিয়াম চাঁপাইনবাবগঞ্জের এশিয়ান প্রি-ক্যাডেট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।
তাসলিমা বেগম জানান, বর্তমানে ধাইনগর শাখা থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা তার নামে ঋণ নিয়ে তারা পাওয়ার টিলার কিনে ভাড়া দিচ্ছেন। আমের মৌসুমে তারা আমবাগান কিনে আমও বিক্রি করেন।
তাসলিমা বেগম নোবেল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য কীভাবে নির্বাচিত হলেন রোগাক্রান্ত কণ্ঠে সে কাহিনীও শোনালেন। তিনি জানান, ২০০৫ সালে ধাইনগর গ্রামীণ ব্যাংক শাখার অধীনে ৪৮টি কেন্দ্রের ভোটে তিনি বিজয়ী হন। পরে উপজেলা এরিয়ায় ৯টি শাখার ভোটেও তিনি জয়লাভ করেন। এর পরে রাজশাহী জোনে ১৩ জোনের প্রতিনিধিদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের এক নম্বর সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৬ সালের ৭ নভেম্বর গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন জোন থেকে ঢাকায় আসা প্রতিনিধিদের ভোটেও নরওয়েগামী ৯ সদস্যের মধ্যে নেতৃত্ব পান তিনি। তাসলিমা বেগম আরও জানান, নরওয়ে থেকে আসার পর তিনি ধাইনগর শাখার ২নং কেন্দ্রের সদস্য হিসেবে ও ২নং গ্র“পের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে ওই এলাকার বিভিন্ন গরিব পরিবারের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ড. ইউনূস বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কেউ তার কোনো খোঁজ নেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ