১
যথারীতি সকাল বেলা খাওয়ার টেবিলের উপর দৈনিক পত্রিকা। এটি ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট বাড়ির একটি চিরাচরিত দৃশ্য। সালমা জহির চায়ের কাপ নিয়ে বসেছেন। পত্রিকার শিরোনামে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন। ঘুরেফিরে একটি সংবাদের দিকেই বার বার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে। খবরের শিরোনাম ‘অবশেষে ঘরের ছেলেই চোর‘। নিজের একটি ছেলে আছে। নাম সজল। এই শিরোনামের সাথে সেই ছেলের কোন মিল নেই। তারপরও মায়ের মন। হাজারটা দুশ্চিন্তা সেখানে এসে ভীড় করে। আজকে যদি নিজের স্বামী জহির সাহেব বেঁচে থাকতেন থাকলে এই সমস্যা হতো না। সালমা খবরটা পড়তে শুরু করলেন।
’ছেলে স্বীকার করেছে যে আসলে সে নিজেই ড্রাগের পয়সা যোগার করতে আলমারী থেকে মায়ের সোনার গহনা চুরি করেছে।’
স্বামী ছাড়া সন্তান মানুষ করার যে কি যন্ত্রণা তা যে ভোগে শুধু সেই বুঝে। মায়ের সাথে সন্তানদের সম্পর্কটা নিশঃর্ত ভালবাসার, প্রশয়ের। মায়ের শাসন কি আর ছেলে-মেয়েরা অতো মানে? উল্টো পারলে তো তারা নিজেরাই মাকে শাসন করতে আসে। ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর তো ছেলেমেয়েরা নিজেদেরকে এক একজন বুদ্ধির ঢেঁকি ভাবতে শুরু করেছে। ডিগ্রির থেকেও জীবনের অভিজ্ঞতা যে কতো বড় সম্পদ তা এদেরকে বোঝাবে কে?
মেয়ের থেকে ছেলেকে নিয়ে চিন্তা বেশি। কি ছুতোনাতায় প্রায়ই সজলের ক্লাস বন্ধ থাকে। তার উপর এই ধরনের সংবাদ সেই চিন্তার মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দেয়। অল্পবয়সী ছেলে, চারদিকে এতো প্রলোভন, এসময় বেকার সময় কাটালে শয়তান না জানি মাথার মধ্যে কি ঢুকিয়ে দেয়। সন্ধ্যা হয়ে গেল, এখনও সজল ঘরে ফিরলো না।
সালমা গেট দিয়ে বেরুতে যাবেন ঠিক তখনই মেয়ে মিতু ক্লাস শেষে ঘরে ফিরলো।
'মা তুমি এরকম শাড়ি পরে বাইরে যাচ্ছ কেন?'
'বাইরে যাচ্ছি নাতো। মতলুবদের ওখানে সজল খেলছে। ওকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।'
'তুমি থাক আমি ডেকে নিয়ে আসছি।'
সালমা ছেলের অপেক্ষায় গেটের কাছেই দাড়িয়ে রইলেন। সজল তাকে ভয় না পেলেও বোনকে বেশ মেনে চলে। আর মিতুও ভাইয়ের সাথে সাথে মায়ের উপরও বেশ খবরদারী করে বেড়ায়। মিতু খুব বুদ্ধিমান এতে কোন সন্দেহ নেই। এ নিয়ে সালমার এক ধরনের গর্ব থাকলেও মাঝে মধ্যে মনে হয় মেয়েটা কোন কোন সময় না বুঝে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলে। এখনও জগৎ সংসার কি জিনিষ বুঝে উঠতে পারেনি। অথচ ভাবখানা এই যে সালমার থেকে ঢের জ্ঞান রাখে। সেদিন তো সংসারের খরচ নিয়ে মায়ের সাথে বেশ তর্ক জুড়ে দিল। এই সংসারটা পঁচিশ বছর ধরে এক হাতে চালানোর পর এখন মেয়ের কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে সালমা নাকি অযথা বেশি টাকা খরচ করে।
মিতুদের বাড়ির পেছনের লাগোয়া খালি প্লটটায় পাড়ার ছেলেরা তাদের খেলার জায়গা করে নিয়েছে। তারা শীতকালে খেলে ব্যডমিন্টন, বর্ষার সময় ফুটবল আর বছরের বাদ বাকী সময় ক্রিকেট। ভয় লাগে কখন না জানি বল লেগে ঘরের জানালা ভেংগে যায়। কিন্তু পাড়ার ছেলে। তাও আবার উঠতি বয়সের। এদের শাসন করতে নেই। প্লটের মালিক আমজাদ আলী সিলেটের লোক। বেশ কয়েক বছর ধরেই লন্ডনে। কেয়ারটেকার মতলুব তার জমিটা পাহারা দিয়ে রেখেছে। এককোনে একটা কাঁচা বাড়ি করে পরিবার নিয়ে সে সেখানেই থাকে। পরিবার বলতে বৌ মাজেদা। মাজেদা একটা লক্ষ্মীমন্ত সংসারী মেয়ে। বাসার আশেপাশের খালি জায়গায় মৌসুমী তরিতরকারীর বাগান করে জায়গাটা ভরে ফেলেছে। মিতু সেখানে পৌছে মাজেদাকে গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে।
'কি মাজেদা কেমন আছ? সজল ভেতরে থাকলে একটু ডেকে দাওতো?'
'ভাইজান তো এখনই দেয়াল টপকাইয়্যা আপনাগো বাসার দিকে চইল্যা গেল।'
'ও এই জন্যই পথে দেখা হলো না।'
'আপা আপনি একবার কইছিলেন আমাগো বাসায় একবার আইবেন। আফনার তো সময় হয় না। আইজ একট্যু এই গরীবের বাসায় আইস্যা একটু বইস্যা যান।'
মিতু একবার মাজেদাকে ওর বাসায় যাওয়ার কথা বলেছিল বটে। তখন অবশ্য সে ঢাকা শহরে স্বল্প আয়ের লোকদের জীবনযাত্রা নিয়ে একটা প্রজেক্ট করছিলো। সে কথা মাজেদা বেশ মনে রেখেছে।
'না আজকে না। আরেকদিন আসবো।'
'আমাগো গরীবের বাসায় আপনি আসলে কোনদিনই আইবেন না।'
এ কথা শোনার পর সে আর মাজেদার ঘরে না গিয়ে পারলো না এবং ঘরে ঢুকেই বেশ অবাক হলো।
একেবারে মন জুড়িয়ে যাবার মতো করে মাজেদা সংসারটা সাজিয়েছে। খুব পরিপাটি। বেড়ার দেয়াল। টিনের চাল। একদিকে বিছানা আরেকদিকে তিনটে চেয়ার দিয়ে বসার জায়গা করে রেখেছে। সেখনটায় একটা ছোট মতোন আলমিরা, মিটসেফ বলাই ভাল। দেয়ালের একদিকে লম্বা করে কাঠের তক্তা দিয়ে তাক করে তাতে সংসারের ছোটখাট প্রয়োজনীয় তৈজষপত্র রেখেছে। বিছানার পাশে দেয়াল থেকে একটা ডিম্বাকার আয়না ঝুলছে। তার নীচে আরেকটা ছোট্ট কাঠের তাকে একটা ঝুড়ি রাখা। সেখানটায় কাঁচের চুড়ি, চুলের ফিতা, নারকেল তেল, তিব্বত কৌটা, টেলকম পাউডার, এরোমেটিক লিপস্টিক, চিরুনী এরকম টুকিটাকি সাজসজ্জার সরঞ্জাম। সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে ঘরের ভেতরের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা। কোথায় একবিন্দু ময়লা নেই। রান্না, গোসল আর টয়লেটের ব্যবস্থা ঘরের বাইরে। কত অল্পতেই যে মানুষ খুব সুখী থাকতে পারে, পরিপূর্ণ হতে পারে তা এই নিম্নমধ্যবিত্ত দম্পত্তির কাছ থেকে শেখার আছে। মার কাছে মিতু শুনেছে যে মাজেদা মাঝে মধ্যে অন্য যোগালীদের খাবার সরবরাহ করে থাকে। এতে ওর হাতে একটু পয়সা জমে। সেটা দিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু শখের জিনিষপত্র কিনে। এই সেদিন যেমন আম্মাকে সাথে নিয়ে রুপালী জুয়েলার্স থেকে একটা সোনার চেন কিনে নিয়ে আসলো।
ঘরের বাইরে এসে মিতু মাজেদার বাগান দেখতে লাগলো।
'এবার তো দেখি একেবারে মাচা ভরে লাউএর গাছ বেড়ে উঠেছে। এমন টসটসা লাউপাতা তো কেউ বাজার থেকে কিনতে পারবে না।'
'আপনাগো দোয়ায় এবার ভালই ফলন হইছ্যে। আইজক্যা খালাম্মারে একটা লাউ আর কিছু শাকপাতা দিয়া আইছি।'
'তোমার সংসারটা খুব সুন্দর করে সাজিয়াছো।'
'আপা আমাগো আর সংসার! হেইড্যা কি আর আপনাগো নজরে আসে?'
'বললাম তো খুব সুন্দর। আমার সত্যিই খুব ভাল লাগছে।'
'এই গরীবের সংসারে যে আপনি পা দিছেন এইড্যা তো আমাগো ভাইগ্যো।'
'নিজেকে সব সময় এতো গরীব ভাবো কেন মাজেদা? যার চাহিদার তালিকাটা যত বেশি বড় সে তত বেশি গরীব। যাদেরকে দামী দামী কাপড় পড়ে ঝকঝকে গাড়িতে চড়ে বেড়াতে দেখ, খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে তাদের অনেকের থেকেই তুমি অনেক ভালো আছ। নাকি তোমারও খুব চাহিদা আছে?'
'না আপা আল্লার কাছে শুকরিয়া করি যা দিছে তা কাইড়্যা না নিলেই হইল্যো।'
'সত্যি তোমার কিছু চাওয়ার নেই? তাহলে তো তুমি খুবই বড়লোক।'
কথাটা শুনে মনে হয় মাজেদা খুবই লজ্জা পেল। চোখটা মেঝেতে নামিয়ে একটা আমতা আমতা ভাব। শেষে আস্তে করে বলল, 'আপা একটা ড্রেসিং টেবিলের শখ ছিল।'
২
সজল তাহলে ঘরে ঢুকেছে। ওর ঘরের ডিভিডি প্লেয়ারে জোরে জোরে গান বাজছে। গান না তো চিৎকার। এখন সন্ধ্যে বেলা। মাগরীবের নামাজের সময়। কতোদিন ছেলেকে বলেছেন এ সময়টায় গান বাজাতে নেই। তা কে শোনে তার কথা। এদিকে সজলকে খুঁজতে গিয়ে এখন মিতুর কোন পাত্তা নেই। সালমা নামাজ শেষ করলেন। তবে জায়নামাজ ছেড়ে উঠলেন না। মৃত স্বামীর জন্য দোয়া দরুদ পড়ছিলেন। এখন উনি প্রতিমুহূর্তে বুঝতে পারছেন মানুষটা তার জীবনটা কিভাবে আগলে রেখেছিলেন। এমনকি মরে গিয়েও কোন অর্থনৈতিক অসুবিধায় ফেলে রেখে যাননি। স্বামীর চাকরী শেষ হবার আগেই শহরের উপকণ্ঠে রূপনগরের এই দোতলা বাড়ির কাঠামোটা দাড়িয়ে গিয়েছিল। একতলাটা নিজেদের জন্য রেখে দোতলাটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তার উপর আছে ব্যাংকে রাখা টাকা। এককালীন অবসরভাতার পুরোটাই সেখানে জমা আছে। মূলধণ থেকে প্রতি মাসে মাসে সুদ পাওয়া যায়। তওবা তওবা। সুদ না মুনাফা। টাকাতো ইসলামী ব্যাংকে রাখা। মিতু বলে আসলে ওটা সুদই। নাম বদলে দিলেই হলো নাকি? মেয়েটা খুব বেয়াদব। এতো করে বলা হয় তারপরও ঠিক মতো নামাজ-রোজা করে না। উল্টো এসব কথা বলে মাকে অপরাধী বানাতে চায়। গুণাহ হলে তো ব্যাংকের হবে। ওরাই তো বলছে ইসলামী ব্যাংক সুদের ব্যবসা করে না। বাবা-মাকে সমালোচনা করা সহজ। নিজেদের যখন সময় হবে তখন বুঝবে কতো ধানে কতো চাল। এমনি এমনিই কি দু'ছেলেমেয়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পারছে? স্বামী-স্ত্রী দুজনে কতোই না খেটেছেন জীবনকে এমন সাজানো গোছানো আকার দিতে। সব যখন পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছিলো, তখনই হঠাৎ ছন্দপতন। দুদিনের নোটিশে স্বামী মারা গেলেন। মানুষটার সাথে কতো কারণে অকারনে ঝগড়া করেছিলেন, মনে কষ্ট দিয়েছিলেন এখন সেসব ভাবলে অনুতাপে ভোগেন। দোয়া দরুদ শেষ করলেন। কিন্তু জায়নামাজ থেকে উঠলেন না। আজকাল মাঝেমধ্যেই তিনি বড্ড বেশি নষ্টালজিক হয়ে পড়ছেন।
প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে এই ঢাকা শহরেই দুজনে মিলে সাবলেটের একটা ঘরে জীবন শুরু করেছিলেন। টোনাটুনির টানাটানির সংসার। তারপরতো আজিমপুরের সরকারী কোয়ার্টারে আসা। শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হতো বলে সহজে স্বচ্ছলতার দেখা মিলছিলো না। স্বচ্ছলতা না থাকলেও সাছন্দ্য ছিল। দুজনে মিলে সারা ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে লবনদানী থেকে শুরু করে বিছানা, আলমিরা সংসারের যাবতীয় সব প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র কিনেছিলেন। তাতেই নিজেকে প্রচন্ড সুখী মনে হতো। নিজেদের মধ্যে তেমন কোন মনোমালিন্য হতো না। দাম্পত্য জীবনের প্রথম ঝগড়া ছিল একটি ড্রেসিং টেবিলকে কেন্দ্র করে। চোখ বন্ধ করলে এখনও পুরো ঘটনা পানির মতো পরিস্কার দেখতে পান। যেন তিনি নয়, অন্য কেউ। দূর থেকে দাড়িয়ে লক্ষ্য করছেন সদ্যবিবাহিত স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া। স্ত্রী একটা ড্রেসিং টেবিল পছন্দ করেছে। সেটা কেনার জন্য গোঁ ধরেছে। স্বামীর তা কেনায় অনিচ্ছা। দামটা বাজেটের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের পুরুষত্বের অহংকারে নববিবাহিত স্ত্রীর কাছে তা প্রকাশ করছে না। না কেনার অজুহাতের জন্য খালি সেটার খুঁত বের করছে। শেষ পর্যন্ত আর সেই ড্রেসিং টেবিলটা কেনা হলো না। খালি হাতে বাড়ি ফেরা। এই নিয়ে প্রথমে খুনসুটি পরে মান অভিমান শেষে তো বিশাল ঝগড়া ঝাটি। নিজের ভাইয়ের বিয়ের জন্য সে সময়টাতে আবার সালমাকে বাপের বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু পুরোনো অভিমানের জের ধরে বাপের বাড়ি থেকে সহজে আর তিনি ফিরছিলেন না। একদিন সকালে দেখেন জহির সাহেব উনার বাবার বাড়িতে এসে হাজির। অবশেষে সালমা ফিরে এলেন নিজের সংসারে। আজিমপুরে। স্বামীর সাথে ফিরতে ফিরতেই নিজের সব অভিমানের বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছিল। তবে সবচেয়ে চমক অপেক্ষা করছিলো শোবার ঘরে। নিজের পছন্দ করা ড্রেসিং টেবিলটা বিছানার পাশে। এখনও সে দিনের কথা ভাবলে চোখে জল আসে। কি যে সুখ ছিল জীবনের সে সময়টাতে! আজ সেই মানুষটা নেই। এই বাড়ির প্রতিটা জায়গায় আনাচে কানাচে তার স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাড়ি বদলের সময় অনেক পুরোনো আসবাবপত্র বেচে দিলেও এই ড্রেসিং টেবিলটা কখনও হাত ছাড়া করার কথা ভাবেননি। ওনার এখন আর ড্রেসিং টেবিলের দরকার নেই বলে সেটা এখন মিতুর ঘরে রেখেছেন। অথচ মেয়ে মায়াটা বুঝলো না, বিস্তর অভিযোগ তার এই পুরোনো আসবাবটিকে নিয়ে। ছেলে মেয়েরা এক এক করে চলে যাবে। ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাদের নিজস্ব জীবনে। কিন্তু যতদিন বেঁচে ততদিন নিজের মতো করেই বেঁচে থাকতে চান। যত্ন করে আগলে রাখতে চান জীবনের কিছু স্মৃতিকে।
৩
মিতু খুবই গোছানো মেয়ে। বেশ রুচিশীলও। রূপনগরের বাসায় উঠার পর নিজের ঘরটা প্রায় ছবির মতো সাজিয়ে নিয়েছে। বিছানায় আর জানালায় আড়ং থেকে কেনা একই রকম নকশার চাদর আর পর্দা। বুকসেলফ, পড়ার টেবিল আর কাপড় রাখার ছোট্ট আলমিরার মাথার উপর আজিজ মার্কেটের আইডিয়া থেকে কেনা পোড়া মাটির তৈরী ছোট ছোট নক্সাদার টবে মানিকলতা, অর্কিড আর ক্যাকটাস রাখা। খালি দেয়ালের গায়ে ঝুলছে ফ্রেমে বদ্ধ টেরাকোটায় করা ফুল-পাতা। সব কিছুই সে কিনেছে নিজের হাত খরচ থেকে বাঁচানো পয়সায়। যে কেউ ঘরে ঢুকলেই মিতুর রুচির প্রশংসা না করে পারে না। এতে সে আরো উৎসাহিত হয়ে উঠে ঘরটা সব সময় গুছিয়ে রাখে। তবে ড্রেসিংটেবিলটার কাছে আসলেই মনটা খচখচ করতে থাকে, ইশ যদি এটাকে বদলানো যেত!
সারাবাড়িতে একটাই ড্রেসিং টেবিল। সেটা মিতুর রুমেই রাখা হয়েছে। বাসার আর অন্য সব বাসিন্দা যেমন মা আর ছোট ভাই কারুরই এটার তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। আর এই বয়সটাতেই মিতুর ড্রেসিং টেবিল ছাড়া চলে না। ঘর থেকে বেরুনোর আগে একবার অন্তত কিছুক্ষন এটার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নেয়। অথচ এই প্রয়োজনীয় আসবাবটারই সবচেয়ে জীর্নদশা। এটা নাকি তার বাবা মার সংসার জীবনের প্রথমদিককার সময়ে কেনা। তার মানে এর বয়স প্রায় পঁচিশ হতে চলল। গায়ে কোন ভার্নিসের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। জৌলুস হারানো কাঠের সারা গায়ে আঁচড়ের দাগ। ছোটবেলায় মিতু আর ওর ছোটভাই মিলে নাকি এই শিল্পকর্ম করেছে। প্রায়ই মনে হয় এটা সরিয়ে যদি নতুন একটা কেনা যেত তাহলে ঘরটা পুরোপুরিই ঝাঁ-চকচকে হয়ে উঠতে পারতো। মিতু জানে যে বর্তমান বাস্তবতায় মার কাছে এই আবদার করা চলে না।
সেদিন মাজেদার সাথে কথা বলার পর মনের মধ্যে বার বার একটা চিন্তা উঁকি মারছে। মাজেদাকে এই ড্রেসিং টেবিলটা কিনতে বললে কেমন হয়? তারপর স্কলারশিপের যে টাকাটা জমেছে তা দিয়ে একটা নতুন পছন্দসই একটা কিনে আম্মাকে ভালো চমকে দেওয়া যাবে। বিক্রী হবে না এটা মনে করে তো আম্মা এই জিনিষটা বেচে দেওয়ার ব্যাপারে সবসময়ই গররাজী ছিল।
কাকতলীয়ভাবে ঐ দিনই মাজেদা ওর বাগানের লালশাক দিতে মিতুদের বাসায় আসে।
কিছুটা দ্বিধাদ্বন্ধ নিয়ে মিতু মাজেদাকে জিজ্ঞেস করলো,
'মাজেদা এই ড্রেসিং টেবিলটা তোমার কেমন লাগে? যদি চাও তো এটা কিনতে পার। তোমার থেকে খুব একটা দামও রাখবো না। আসলে আমি নতুন একটা কেনার কথা ভাবছি।'
কথাটা শুনে মাজেদার চোখ মুখ যে এতোটা ঝলমল করে উঠবে সেটা মিতু ভাবতে পারেনি। কিছুটা দামদস্তুর করার পর শেষে দাম ঠিক করা হয় ৫৫০ টাকা। টাকাটা মাজেদা কিস্তিতে শোধ করবে। সেদিনই ১০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে মাজেদা চুক্তিটা পাকা করে রাখে। মনে হচ্ছে সে কোনভাবেই ড্রেসিংটেবিলটা হাত ছাড়া করতে চাচ্ছে না।
একমাস পরেও মাজেদার এই আগ্রহের কোন কমতি দেখা গেল না। সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে এক কাপ চা হাতে মিতু ছাদে ঘোরাঘুরি করছিল। হঠাৎ করেই সেখানে মাজেদা এসে উপস্থিত। রীতিমতো হাপাচ্ছিল।
'আপা এই নেন আরো একশ টাকা। সব মিলাইয়্যা দুইশ হইলো। বাকী তিনশ টাকা যোগাড় কইর্যা দিয়া যামু।'
'ঠিক আছে। তখনই ড্রেসিং টেবিলটা নিয়ে যেও। তা তুমি কেমন আছ?'
'আপা আপনাগো দোয়ায় ভালা আছি। বস্তির কয়ড্যা মাইয়্যার জামা সিলাইয়্যা দিতাছি। কাজ ফেল্যাইয়্যা আইছি। এখন আসি।'
কথাটা বলেই মাজেদা যেমন ভাবে এসেছিল ঠিক তেমনি আকস্মিক ভাবেই বিদায় নিল। তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে মিতু ভাবতে লাগলো তার কাছে যা পরিত্যক্ত আরেকজনের কাছেই তা কত আরাধ্য বিষয়। আসলে মানুষের চাওয়া পাওয়ার সীমারেখার মধ্যে আসলে যোজন যোজন না খুব অল্প দূরত্বই থাকে। শুধু দরকার দৃষ্টিভঙ্গিটাকে একটু নেড়েচেড়ে দেখার।
৪
মাজেদা ভাবছিল কি করে জানি তার সব শখগুলো পূরন হয়ে যায়। তার স্বামী মতলুব তাকে একবার একটি আসবাবপত্রের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল। কমদামের। তারপরও দু'হাজার টাকার নিচে কোন ড্রেসিংটেবিল নেই। গরীবের ঘোড়া রোগ মানায় না। মাজেদা ড্রেসিংটেবিলের স্বপ্ন প্রায় ভুলতে বসেছিল। আর ঠিক তখনই মিতুর কাছ থেকে একটা ড্রেসিংটেবিল কেনার প্রস্তাব পায়। একদম লটারীর টিকিট জিতে যাওয়ার মতো। এটা ঠিক যে ড্রেসিং টেবিলটা একটু পুরনো তবে তার বাড়িও তো আর পাকা দালান না। মাজেদা মানানসই স্বপ্নই দেখে। বুঝেশুনে চলে। ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে না।
জমানো টাকা যা ছিল তা দিয়ে সেই সাথে আরও কিছু ধার দেনা করে কিছুদিন আগেই একটা সোনার চেন কিনেছে। হাতে কোন টাকাই ছিল না। এদিকে দেরী করলে যদি আবার মিতু আপার মন বদলে যায় এই ভয়ে সংসার খরচ থেকেই প্রথম কিস্তির টাকাটা দিয়ে বায়নাটা পাকা করে রেখেছিলো। এখন দিনরাত খেটে পাশের বস্তির মেয়েদের জামা সেলাই করে বাকী টাকাটা যোগারের চেষ্টায় আছে। এই পর্যন্ত সে মিতুকে চারশ টাকা পর্যন্ত দিয়েছে। এখন আর বাকী একশ টাকা শোধ করতে পারলেই ড্রেসিংটেবিলটা বাসায় নিয়ে আসতে পারবে। মাজেদা এখন কল্পনায় তার বিছানার পাশে প্রায়শই ড্রেসিং টেবিলটাকে দেখতে পায়। এই উত্তেজনা নিয়েই এখন প্রতিদিন তার ঘুম ভাঙ্গে। আর মাত্র একশ টাকা, শেষ কিস্তিটা শোধ করতে পারলেই অনেকদিনের লালিত স্বপ্নটা একেবারে হাতের মুঠোয় চলে আসবে!
শিহরিত মন নিয়েই সে শেষ কিস্তির টাকাটা দিতে মিতুদের বাসায় আসে। মিতু তখনও ভার্সিটি থেকে ফেরেনি। আগের সব লেন দেন মিতুর সাথেই হয়েছে। কিন্তু মাজেদার একদমই অপেক্ষা করার ধৈর্য্য রাখতে পারছিলো না। খালাম্মাকে দেখে তার হাতেই টাকাটা দিয়ে দিল।
'খালাম্মা এই যে শেষ কিস্তির একশ টাকা।'
মিতুর আম্মা যেন আকাশ থেকে পরলো,
'কিসের টাকা?'
'ড্রেসিং টেবিল কেননের শেষ কিস্তি।'
'কিসের ড্রেসিং টেবিল? কার ড্রেসিং টেবিল?'
'মিতু আপার ঘরে যেইড্যা আছে হেইড্যার কথা বলতাছি। মিতু আপাই তো আমারে পাঁচশ টাকা দিয়া আমারে হেইড্যা কিইন্যা নিতে বলছে। এর আগে আমি ওনারে চারশ টাকা শোধ করছি।
খালাম্মাকে দেখে মনে হলো মাজেদার কথা উনি যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না।
আসলেও উনি তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেই মুহূর্তে উনি পেপারে পড়ছিলেন কিভাবে একটা বখে যাওয়া ছেলে ঘরের আসবাবপত্র বিক্রী করে নিজের ড্রাগের টাকা যোগার করছিলো তার বিশদ বর্ণনা। এখন উনার একার ঘাড়েই সব ভাবনা বলে সারাক্ষন সন্তানদের নিয়েই চিন্তা ভাবনা করেন। আবার ওদের উপর অগাধ বিশ্বাস রাখেন বলে অতো আণুবীক্ষনিক নজরদারী প্রয়োজন মনে করেন না। দুজনের দুটো ঘর আছে সেখানে তারা কি করছে কি ফন্দি আটছে তা ওনার অতো না জানলেও চলবে। কিন্তু মিতু যে তলে তলে ঘরের আসবাবপত্র বেচে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাও আবার উনাকে না জানিয়ে সেটা একদমই কল্পনার অতীত। মিতুর কি কোন কারণে খুব টাকার প্রয়োজন পরেছে? ও তো ড্রাগ ট্রাগের কাছে ঘেঁষার মেয়ে না। মায়ের মন অনেক শংকাই মনের মধ্যে উঁকি মারছে। তবে সব ছাড়িয়ে নিজের মেয়ের প্রতি এক ধরনের অভিমান বোধ করছেন। নিজের ঘরে না রেখে ড্রেসিং টেবিলটা মিতুর ঘরে রেখেছেন অথচ মেয়ে তার বিনিময়ে এই প্রতিদান দিল? মায়ের কথা না ভাবুক বাবার স্মতি চিহ্নের প্রতিও তো এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। অথচ নিজের পেটের মেয়ে হয়ে মায়ের মনের এই বোধটাকে বুঝতে পারলো না। বোধের একদম মূল ধরে টান দেওয়া।
৫
সেদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে মিতু ঘরের দরজা খোলা দেখতে পেল। ভেতরে মাজেদা আর মায়ের গলা শুনতে পারছে। তার নিজের ঘরের ভেতর থেকেই সেই সব কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। মাকে একটু উত্তেজিত মনে হলো। মাজেদাকে বলতে শুনলো,
-'খালাম্মা আমার কোন দোষ নাইক্যা। মিতু আপা নিজের থ্যাইক্যাই আমারে একড্যা কিনতে কইছে। আপনাগো জামাই তো আমারে বলে, সবুর করো, তোমারে এইক্যেবারে নতুন কিইন্যা দিমু।'
মা আর মাজেদার কথোপকথনের শেষ অংশ শুনে মিতুর বুঝে নিতে বাকী থাকে না প্রথম অংশে কি ছিল। ড্রেসিং টেবিলটা মাজেদার কাছে বেচে দেওয়ার কথাটা আম্মাকে বলা হয়নি। মাজেদা কি আজকে তবে তার শেষ কিস্তির টাকাটা দিতে এসেছিল? মাত্র একশ টাকাতে বিক্রি করছে বলে কি আম্মা রেগে গেছে? আম্মাকে এখন ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। পাঁচশ টাকা কম না। এই জিনিষ ফেলতেও তো কম সে কম একশ টাকা লাগতো। সেখানে খুবই ভালোভাবে ঘর থেকে এটাকে সরাতে পারছে সাথে কিছু বাড়তি পয়সাও পাচ্ছে পুরো বিষয়টা বলতে গেলে একটা ভালো বানিজ্যই।
নিজের ঘরে ঢুকে আম্মার চেহারা দেখে বুঝতে পারলো ঘটনাটা যতটা হাল্কাভাবে নিয়েছিল, বিষয়টা সেরকম নয়। আম্মা এখন মিতুকে না দেখার ভান করছে। খুব রেগে গেলে উনি এমনটা করেন। কিছুটা গম্ভীর স্বরেই মাজেদাকে বলল,
'এখানে একটু অপেক্ষা করো। তোমার চারশ টাকা এখনই মিটিয়ে দিচ্ছি।'
আর কোনদিকে না তাকিয়ে আম্মা সোজা নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। মিতুও পেছন পেছন অনুসরন করে ও ঘরে গেল। আম্মা আলমারী খুলে টাকা বের করছিলেন। মিতু কিছুটা কৈফিয়তের সুরে বলল,
'এতো সহজে পুরোনো একটা ড্রেসিং টেবিল বিক্রি করে দিচ্ছিলাম তাতে অসুবিধা কি ছিল?'
আম্মার নিরুত্তর মুখের কঠিন ভাবরেখা দেখে মিতু এবার একটু নরম স্বরে বলল,
'আমার বান্ধবীদের রুমে সব কি সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের আধুনিক ড্রেসিং টেবিল। আমিও ওরকম একটা চাই।'
এবার আম্মা মিতুর দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত কিন্তু কঠিন স্বরে বলল,
'তোমার নিজের সংসারে যে রকম ইচ্ছা সে রকমভাবে সাজিয়ে নিও। এটা আমার সংসার। এখানে তোমার আব্বার কোন স্মতি ফেলা যাবে না।'
যুদ্ধটাতে শেষ পর্যন্ত সালমাই জিতে গেলেন। কিম্বা মিতু সহজেই হার স্বীকার করে নিল। কেন - সে প্রশ্নের উত্তর না হয় আর নাই বা জানা হলো। আসলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা অতো খারাপ নয়।
মিতুর মনে হলো আম্মার হাত থেকে টাকাটা নেওয়ার সময় মাজেদার চোখে যেন আশাহতের বেদনা ছায়া ফেললো। মেয়েটা কি ড্রেসিং টেবিলটা নিয়ে অনেক বেশি আশা দেখেছিল? হবে হয়তো। আশাহতের বেদনা মিতুর চোখেও কি ছায়া ফেলেনি? হয়তো সবচেয়ে বেশি কষ্টটা বোধহয় আম্মাই পেয়েছেন। কে আর কার হৃদয়ের কতটা খবর রাখে?
তিন জোড়া নারী চোখ একদৃষ্টিতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। কিম্বা আয়না দেখছে তার সামনে তিন জোড়া চোখে ভেসে বেড়াচ্ছে তিন কালের প্রতিচ্ছবি - অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।
লেখক পরিচিতি
ওয়াহিদা নূর আফজা
যথারীতি সকাল বেলা খাওয়ার টেবিলের উপর দৈনিক পত্রিকা। এটি ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট বাড়ির একটি চিরাচরিত দৃশ্য। সালমা জহির চায়ের কাপ নিয়ে বসেছেন। পত্রিকার শিরোনামে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন। ঘুরেফিরে একটি সংবাদের দিকেই বার বার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে। খবরের শিরোনাম ‘অবশেষে ঘরের ছেলেই চোর‘। নিজের একটি ছেলে আছে। নাম সজল। এই শিরোনামের সাথে সেই ছেলের কোন মিল নেই। তারপরও মায়ের মন। হাজারটা দুশ্চিন্তা সেখানে এসে ভীড় করে। আজকে যদি নিজের স্বামী জহির সাহেব বেঁচে থাকতেন থাকলে এই সমস্যা হতো না। সালমা খবরটা পড়তে শুরু করলেন।
’ছেলে স্বীকার করেছে যে আসলে সে নিজেই ড্রাগের পয়সা যোগার করতে আলমারী থেকে মায়ের সোনার গহনা চুরি করেছে।’
স্বামী ছাড়া সন্তান মানুষ করার যে কি যন্ত্রণা তা যে ভোগে শুধু সেই বুঝে। মায়ের সাথে সন্তানদের সম্পর্কটা নিশঃর্ত ভালবাসার, প্রশয়ের। মায়ের শাসন কি আর ছেলে-মেয়েরা অতো মানে? উল্টো পারলে তো তারা নিজেরাই মাকে শাসন করতে আসে। ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর তো ছেলেমেয়েরা নিজেদেরকে এক একজন বুদ্ধির ঢেঁকি ভাবতে শুরু করেছে। ডিগ্রির থেকেও জীবনের অভিজ্ঞতা যে কতো বড় সম্পদ তা এদেরকে বোঝাবে কে?
মেয়ের থেকে ছেলেকে নিয়ে চিন্তা বেশি। কি ছুতোনাতায় প্রায়ই সজলের ক্লাস বন্ধ থাকে। তার উপর এই ধরনের সংবাদ সেই চিন্তার মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দেয়। অল্পবয়সী ছেলে, চারদিকে এতো প্রলোভন, এসময় বেকার সময় কাটালে শয়তান না জানি মাথার মধ্যে কি ঢুকিয়ে দেয়। সন্ধ্যা হয়ে গেল, এখনও সজল ঘরে ফিরলো না।
সালমা গেট দিয়ে বেরুতে যাবেন ঠিক তখনই মেয়ে মিতু ক্লাস শেষে ঘরে ফিরলো।
'মা তুমি এরকম শাড়ি পরে বাইরে যাচ্ছ কেন?'
'বাইরে যাচ্ছি নাতো। মতলুবদের ওখানে সজল খেলছে। ওকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।'
'তুমি থাক আমি ডেকে নিয়ে আসছি।'
সালমা ছেলের অপেক্ষায় গেটের কাছেই দাড়িয়ে রইলেন। সজল তাকে ভয় না পেলেও বোনকে বেশ মেনে চলে। আর মিতুও ভাইয়ের সাথে সাথে মায়ের উপরও বেশ খবরদারী করে বেড়ায়। মিতু খুব বুদ্ধিমান এতে কোন সন্দেহ নেই। এ নিয়ে সালমার এক ধরনের গর্ব থাকলেও মাঝে মধ্যে মনে হয় মেয়েটা কোন কোন সময় না বুঝে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলে। এখনও জগৎ সংসার কি জিনিষ বুঝে উঠতে পারেনি। অথচ ভাবখানা এই যে সালমার থেকে ঢের জ্ঞান রাখে। সেদিন তো সংসারের খরচ নিয়ে মায়ের সাথে বেশ তর্ক জুড়ে দিল। এই সংসারটা পঁচিশ বছর ধরে এক হাতে চালানোর পর এখন মেয়ের কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে সালমা নাকি অযথা বেশি টাকা খরচ করে।
মিতুদের বাড়ির পেছনের লাগোয়া খালি প্লটটায় পাড়ার ছেলেরা তাদের খেলার জায়গা করে নিয়েছে। তারা শীতকালে খেলে ব্যডমিন্টন, বর্ষার সময় ফুটবল আর বছরের বাদ বাকী সময় ক্রিকেট। ভয় লাগে কখন না জানি বল লেগে ঘরের জানালা ভেংগে যায়। কিন্তু পাড়ার ছেলে। তাও আবার উঠতি বয়সের। এদের শাসন করতে নেই। প্লটের মালিক আমজাদ আলী সিলেটের লোক। বেশ কয়েক বছর ধরেই লন্ডনে। কেয়ারটেকার মতলুব তার জমিটা পাহারা দিয়ে রেখেছে। এককোনে একটা কাঁচা বাড়ি করে পরিবার নিয়ে সে সেখানেই থাকে। পরিবার বলতে বৌ মাজেদা। মাজেদা একটা লক্ষ্মীমন্ত সংসারী মেয়ে। বাসার আশেপাশের খালি জায়গায় মৌসুমী তরিতরকারীর বাগান করে জায়গাটা ভরে ফেলেছে। মিতু সেখানে পৌছে মাজেদাকে গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে।
'কি মাজেদা কেমন আছ? সজল ভেতরে থাকলে একটু ডেকে দাওতো?'
'ভাইজান তো এখনই দেয়াল টপকাইয়্যা আপনাগো বাসার দিকে চইল্যা গেল।'
'ও এই জন্যই পথে দেখা হলো না।'
'আপা আপনি একবার কইছিলেন আমাগো বাসায় একবার আইবেন। আফনার তো সময় হয় না। আইজ একট্যু এই গরীবের বাসায় আইস্যা একটু বইস্যা যান।'
মিতু একবার মাজেদাকে ওর বাসায় যাওয়ার কথা বলেছিল বটে। তখন অবশ্য সে ঢাকা শহরে স্বল্প আয়ের লোকদের জীবনযাত্রা নিয়ে একটা প্রজেক্ট করছিলো। সে কথা মাজেদা বেশ মনে রেখেছে।
'না আজকে না। আরেকদিন আসবো।'
'আমাগো গরীবের বাসায় আপনি আসলে কোনদিনই আইবেন না।'
এ কথা শোনার পর সে আর মাজেদার ঘরে না গিয়ে পারলো না এবং ঘরে ঢুকেই বেশ অবাক হলো।
একেবারে মন জুড়িয়ে যাবার মতো করে মাজেদা সংসারটা সাজিয়েছে। খুব পরিপাটি। বেড়ার দেয়াল। টিনের চাল। একদিকে বিছানা আরেকদিকে তিনটে চেয়ার দিয়ে বসার জায়গা করে রেখেছে। সেখনটায় একটা ছোট মতোন আলমিরা, মিটসেফ বলাই ভাল। দেয়ালের একদিকে লম্বা করে কাঠের তক্তা দিয়ে তাক করে তাতে সংসারের ছোটখাট প্রয়োজনীয় তৈজষপত্র রেখেছে। বিছানার পাশে দেয়াল থেকে একটা ডিম্বাকার আয়না ঝুলছে। তার নীচে আরেকটা ছোট্ট কাঠের তাকে একটা ঝুড়ি রাখা। সেখানটায় কাঁচের চুড়ি, চুলের ফিতা, নারকেল তেল, তিব্বত কৌটা, টেলকম পাউডার, এরোমেটিক লিপস্টিক, চিরুনী এরকম টুকিটাকি সাজসজ্জার সরঞ্জাম। সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে ঘরের ভেতরের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা। কোথায় একবিন্দু ময়লা নেই। রান্না, গোসল আর টয়লেটের ব্যবস্থা ঘরের বাইরে। কত অল্পতেই যে মানুষ খুব সুখী থাকতে পারে, পরিপূর্ণ হতে পারে তা এই নিম্নমধ্যবিত্ত দম্পত্তির কাছ থেকে শেখার আছে। মার কাছে মিতু শুনেছে যে মাজেদা মাঝে মধ্যে অন্য যোগালীদের খাবার সরবরাহ করে থাকে। এতে ওর হাতে একটু পয়সা জমে। সেটা দিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু শখের জিনিষপত্র কিনে। এই সেদিন যেমন আম্মাকে সাথে নিয়ে রুপালী জুয়েলার্স থেকে একটা সোনার চেন কিনে নিয়ে আসলো।
ঘরের বাইরে এসে মিতু মাজেদার বাগান দেখতে লাগলো।
'এবার তো দেখি একেবারে মাচা ভরে লাউএর গাছ বেড়ে উঠেছে। এমন টসটসা লাউপাতা তো কেউ বাজার থেকে কিনতে পারবে না।'
'আপনাগো দোয়ায় এবার ভালই ফলন হইছ্যে। আইজক্যা খালাম্মারে একটা লাউ আর কিছু শাকপাতা দিয়া আইছি।'
'তোমার সংসারটা খুব সুন্দর করে সাজিয়াছো।'
'আপা আমাগো আর সংসার! হেইড্যা কি আর আপনাগো নজরে আসে?'
'বললাম তো খুব সুন্দর। আমার সত্যিই খুব ভাল লাগছে।'
'এই গরীবের সংসারে যে আপনি পা দিছেন এইড্যা তো আমাগো ভাইগ্যো।'
'নিজেকে সব সময় এতো গরীব ভাবো কেন মাজেদা? যার চাহিদার তালিকাটা যত বেশি বড় সে তত বেশি গরীব। যাদেরকে দামী দামী কাপড় পড়ে ঝকঝকে গাড়িতে চড়ে বেড়াতে দেখ, খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে তাদের অনেকের থেকেই তুমি অনেক ভালো আছ। নাকি তোমারও খুব চাহিদা আছে?'
'না আপা আল্লার কাছে শুকরিয়া করি যা দিছে তা কাইড়্যা না নিলেই হইল্যো।'
'সত্যি তোমার কিছু চাওয়ার নেই? তাহলে তো তুমি খুবই বড়লোক।'
কথাটা শুনে মনে হয় মাজেদা খুবই লজ্জা পেল। চোখটা মেঝেতে নামিয়ে একটা আমতা আমতা ভাব। শেষে আস্তে করে বলল, 'আপা একটা ড্রেসিং টেবিলের শখ ছিল।'
২
সজল তাহলে ঘরে ঢুকেছে। ওর ঘরের ডিভিডি প্লেয়ারে জোরে জোরে গান বাজছে। গান না তো চিৎকার। এখন সন্ধ্যে বেলা। মাগরীবের নামাজের সময়। কতোদিন ছেলেকে বলেছেন এ সময়টায় গান বাজাতে নেই। তা কে শোনে তার কথা। এদিকে সজলকে খুঁজতে গিয়ে এখন মিতুর কোন পাত্তা নেই। সালমা নামাজ শেষ করলেন। তবে জায়নামাজ ছেড়ে উঠলেন না। মৃত স্বামীর জন্য দোয়া দরুদ পড়ছিলেন। এখন উনি প্রতিমুহূর্তে বুঝতে পারছেন মানুষটা তার জীবনটা কিভাবে আগলে রেখেছিলেন। এমনকি মরে গিয়েও কোন অর্থনৈতিক অসুবিধায় ফেলে রেখে যাননি। স্বামীর চাকরী শেষ হবার আগেই শহরের উপকণ্ঠে রূপনগরের এই দোতলা বাড়ির কাঠামোটা দাড়িয়ে গিয়েছিল। একতলাটা নিজেদের জন্য রেখে দোতলাটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তার উপর আছে ব্যাংকে রাখা টাকা। এককালীন অবসরভাতার পুরোটাই সেখানে জমা আছে। মূলধণ থেকে প্রতি মাসে মাসে সুদ পাওয়া যায়। তওবা তওবা। সুদ না মুনাফা। টাকাতো ইসলামী ব্যাংকে রাখা। মিতু বলে আসলে ওটা সুদই। নাম বদলে দিলেই হলো নাকি? মেয়েটা খুব বেয়াদব। এতো করে বলা হয় তারপরও ঠিক মতো নামাজ-রোজা করে না। উল্টো এসব কথা বলে মাকে অপরাধী বানাতে চায়। গুণাহ হলে তো ব্যাংকের হবে। ওরাই তো বলছে ইসলামী ব্যাংক সুদের ব্যবসা করে না। বাবা-মাকে সমালোচনা করা সহজ। নিজেদের যখন সময় হবে তখন বুঝবে কতো ধানে কতো চাল। এমনি এমনিই কি দু'ছেলেমেয়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পারছে? স্বামী-স্ত্রী দুজনে কতোই না খেটেছেন জীবনকে এমন সাজানো গোছানো আকার দিতে। সব যখন পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছিলো, তখনই হঠাৎ ছন্দপতন। দুদিনের নোটিশে স্বামী মারা গেলেন। মানুষটার সাথে কতো কারণে অকারনে ঝগড়া করেছিলেন, মনে কষ্ট দিয়েছিলেন এখন সেসব ভাবলে অনুতাপে ভোগেন। দোয়া দরুদ শেষ করলেন। কিন্তু জায়নামাজ থেকে উঠলেন না। আজকাল মাঝেমধ্যেই তিনি বড্ড বেশি নষ্টালজিক হয়ে পড়ছেন।
প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে এই ঢাকা শহরেই দুজনে মিলে সাবলেটের একটা ঘরে জীবন শুরু করেছিলেন। টোনাটুনির টানাটানির সংসার। তারপরতো আজিমপুরের সরকারী কোয়ার্টারে আসা। শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হতো বলে সহজে স্বচ্ছলতার দেখা মিলছিলো না। স্বচ্ছলতা না থাকলেও সাছন্দ্য ছিল। দুজনে মিলে সারা ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে লবনদানী থেকে শুরু করে বিছানা, আলমিরা সংসারের যাবতীয় সব প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র কিনেছিলেন। তাতেই নিজেকে প্রচন্ড সুখী মনে হতো। নিজেদের মধ্যে তেমন কোন মনোমালিন্য হতো না। দাম্পত্য জীবনের প্রথম ঝগড়া ছিল একটি ড্রেসিং টেবিলকে কেন্দ্র করে। চোখ বন্ধ করলে এখনও পুরো ঘটনা পানির মতো পরিস্কার দেখতে পান। যেন তিনি নয়, অন্য কেউ। দূর থেকে দাড়িয়ে লক্ষ্য করছেন সদ্যবিবাহিত স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া। স্ত্রী একটা ড্রেসিং টেবিল পছন্দ করেছে। সেটা কেনার জন্য গোঁ ধরেছে। স্বামীর তা কেনায় অনিচ্ছা। দামটা বাজেটের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের পুরুষত্বের অহংকারে নববিবাহিত স্ত্রীর কাছে তা প্রকাশ করছে না। না কেনার অজুহাতের জন্য খালি সেটার খুঁত বের করছে। শেষ পর্যন্ত আর সেই ড্রেসিং টেবিলটা কেনা হলো না। খালি হাতে বাড়ি ফেরা। এই নিয়ে প্রথমে খুনসুটি পরে মান অভিমান শেষে তো বিশাল ঝগড়া ঝাটি। নিজের ভাইয়ের বিয়ের জন্য সে সময়টাতে আবার সালমাকে বাপের বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু পুরোনো অভিমানের জের ধরে বাপের বাড়ি থেকে সহজে আর তিনি ফিরছিলেন না। একদিন সকালে দেখেন জহির সাহেব উনার বাবার বাড়িতে এসে হাজির। অবশেষে সালমা ফিরে এলেন নিজের সংসারে। আজিমপুরে। স্বামীর সাথে ফিরতে ফিরতেই নিজের সব অভিমানের বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছিল। তবে সবচেয়ে চমক অপেক্ষা করছিলো শোবার ঘরে। নিজের পছন্দ করা ড্রেসিং টেবিলটা বিছানার পাশে। এখনও সে দিনের কথা ভাবলে চোখে জল আসে। কি যে সুখ ছিল জীবনের সে সময়টাতে! আজ সেই মানুষটা নেই। এই বাড়ির প্রতিটা জায়গায় আনাচে কানাচে তার স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাড়ি বদলের সময় অনেক পুরোনো আসবাবপত্র বেচে দিলেও এই ড্রেসিং টেবিলটা কখনও হাত ছাড়া করার কথা ভাবেননি। ওনার এখন আর ড্রেসিং টেবিলের দরকার নেই বলে সেটা এখন মিতুর ঘরে রেখেছেন। অথচ মেয়ে মায়াটা বুঝলো না, বিস্তর অভিযোগ তার এই পুরোনো আসবাবটিকে নিয়ে। ছেলে মেয়েরা এক এক করে চলে যাবে। ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাদের নিজস্ব জীবনে। কিন্তু যতদিন বেঁচে ততদিন নিজের মতো করেই বেঁচে থাকতে চান। যত্ন করে আগলে রাখতে চান জীবনের কিছু স্মৃতিকে।
৩
মিতু খুবই গোছানো মেয়ে। বেশ রুচিশীলও। রূপনগরের বাসায় উঠার পর নিজের ঘরটা প্রায় ছবির মতো সাজিয়ে নিয়েছে। বিছানায় আর জানালায় আড়ং থেকে কেনা একই রকম নকশার চাদর আর পর্দা। বুকসেলফ, পড়ার টেবিল আর কাপড় রাখার ছোট্ট আলমিরার মাথার উপর আজিজ মার্কেটের আইডিয়া থেকে কেনা পোড়া মাটির তৈরী ছোট ছোট নক্সাদার টবে মানিকলতা, অর্কিড আর ক্যাকটাস রাখা। খালি দেয়ালের গায়ে ঝুলছে ফ্রেমে বদ্ধ টেরাকোটায় করা ফুল-পাতা। সব কিছুই সে কিনেছে নিজের হাত খরচ থেকে বাঁচানো পয়সায়। যে কেউ ঘরে ঢুকলেই মিতুর রুচির প্রশংসা না করে পারে না। এতে সে আরো উৎসাহিত হয়ে উঠে ঘরটা সব সময় গুছিয়ে রাখে। তবে ড্রেসিংটেবিলটার কাছে আসলেই মনটা খচখচ করতে থাকে, ইশ যদি এটাকে বদলানো যেত!
সারাবাড়িতে একটাই ড্রেসিং টেবিল। সেটা মিতুর রুমেই রাখা হয়েছে। বাসার আর অন্য সব বাসিন্দা যেমন মা আর ছোট ভাই কারুরই এটার তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। আর এই বয়সটাতেই মিতুর ড্রেসিং টেবিল ছাড়া চলে না। ঘর থেকে বেরুনোর আগে একবার অন্তত কিছুক্ষন এটার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নেয়। অথচ এই প্রয়োজনীয় আসবাবটারই সবচেয়ে জীর্নদশা। এটা নাকি তার বাবা মার সংসার জীবনের প্রথমদিককার সময়ে কেনা। তার মানে এর বয়স প্রায় পঁচিশ হতে চলল। গায়ে কোন ভার্নিসের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। জৌলুস হারানো কাঠের সারা গায়ে আঁচড়ের দাগ। ছোটবেলায় মিতু আর ওর ছোটভাই মিলে নাকি এই শিল্পকর্ম করেছে। প্রায়ই মনে হয় এটা সরিয়ে যদি নতুন একটা কেনা যেত তাহলে ঘরটা পুরোপুরিই ঝাঁ-চকচকে হয়ে উঠতে পারতো। মিতু জানে যে বর্তমান বাস্তবতায় মার কাছে এই আবদার করা চলে না।
সেদিন মাজেদার সাথে কথা বলার পর মনের মধ্যে বার বার একটা চিন্তা উঁকি মারছে। মাজেদাকে এই ড্রেসিং টেবিলটা কিনতে বললে কেমন হয়? তারপর স্কলারশিপের যে টাকাটা জমেছে তা দিয়ে একটা নতুন পছন্দসই একটা কিনে আম্মাকে ভালো চমকে দেওয়া যাবে। বিক্রী হবে না এটা মনে করে তো আম্মা এই জিনিষটা বেচে দেওয়ার ব্যাপারে সবসময়ই গররাজী ছিল।
কাকতলীয়ভাবে ঐ দিনই মাজেদা ওর বাগানের লালশাক দিতে মিতুদের বাসায় আসে।
কিছুটা দ্বিধাদ্বন্ধ নিয়ে মিতু মাজেদাকে জিজ্ঞেস করলো,
'মাজেদা এই ড্রেসিং টেবিলটা তোমার কেমন লাগে? যদি চাও তো এটা কিনতে পার। তোমার থেকে খুব একটা দামও রাখবো না। আসলে আমি নতুন একটা কেনার কথা ভাবছি।'
কথাটা শুনে মাজেদার চোখ মুখ যে এতোটা ঝলমল করে উঠবে সেটা মিতু ভাবতে পারেনি। কিছুটা দামদস্তুর করার পর শেষে দাম ঠিক করা হয় ৫৫০ টাকা। টাকাটা মাজেদা কিস্তিতে শোধ করবে। সেদিনই ১০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে মাজেদা চুক্তিটা পাকা করে রাখে। মনে হচ্ছে সে কোনভাবেই ড্রেসিংটেবিলটা হাত ছাড়া করতে চাচ্ছে না।
একমাস পরেও মাজেদার এই আগ্রহের কোন কমতি দেখা গেল না। সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে এক কাপ চা হাতে মিতু ছাদে ঘোরাঘুরি করছিল। হঠাৎ করেই সেখানে মাজেদা এসে উপস্থিত। রীতিমতো হাপাচ্ছিল।
'আপা এই নেন আরো একশ টাকা। সব মিলাইয়্যা দুইশ হইলো। বাকী তিনশ টাকা যোগাড় কইর্যা দিয়া যামু।'
'ঠিক আছে। তখনই ড্রেসিং টেবিলটা নিয়ে যেও। তা তুমি কেমন আছ?'
'আপা আপনাগো দোয়ায় ভালা আছি। বস্তির কয়ড্যা মাইয়্যার জামা সিলাইয়্যা দিতাছি। কাজ ফেল্যাইয়্যা আইছি। এখন আসি।'
কথাটা বলেই মাজেদা যেমন ভাবে এসেছিল ঠিক তেমনি আকস্মিক ভাবেই বিদায় নিল। তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে মিতু ভাবতে লাগলো তার কাছে যা পরিত্যক্ত আরেকজনের কাছেই তা কত আরাধ্য বিষয়। আসলে মানুষের চাওয়া পাওয়ার সীমারেখার মধ্যে আসলে যোজন যোজন না খুব অল্প দূরত্বই থাকে। শুধু দরকার দৃষ্টিভঙ্গিটাকে একটু নেড়েচেড়ে দেখার।
৪
মাজেদা ভাবছিল কি করে জানি তার সব শখগুলো পূরন হয়ে যায়। তার স্বামী মতলুব তাকে একবার একটি আসবাবপত্রের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল। কমদামের। তারপরও দু'হাজার টাকার নিচে কোন ড্রেসিংটেবিল নেই। গরীবের ঘোড়া রোগ মানায় না। মাজেদা ড্রেসিংটেবিলের স্বপ্ন প্রায় ভুলতে বসেছিল। আর ঠিক তখনই মিতুর কাছ থেকে একটা ড্রেসিংটেবিল কেনার প্রস্তাব পায়। একদম লটারীর টিকিট জিতে যাওয়ার মতো। এটা ঠিক যে ড্রেসিং টেবিলটা একটু পুরনো তবে তার বাড়িও তো আর পাকা দালান না। মাজেদা মানানসই স্বপ্নই দেখে। বুঝেশুনে চলে। ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে না।
জমানো টাকা যা ছিল তা দিয়ে সেই সাথে আরও কিছু ধার দেনা করে কিছুদিন আগেই একটা সোনার চেন কিনেছে। হাতে কোন টাকাই ছিল না। এদিকে দেরী করলে যদি আবার মিতু আপার মন বদলে যায় এই ভয়ে সংসার খরচ থেকেই প্রথম কিস্তির টাকাটা দিয়ে বায়নাটা পাকা করে রেখেছিলো। এখন দিনরাত খেটে পাশের বস্তির মেয়েদের জামা সেলাই করে বাকী টাকাটা যোগারের চেষ্টায় আছে। এই পর্যন্ত সে মিতুকে চারশ টাকা পর্যন্ত দিয়েছে। এখন আর বাকী একশ টাকা শোধ করতে পারলেই ড্রেসিংটেবিলটা বাসায় নিয়ে আসতে পারবে। মাজেদা এখন কল্পনায় তার বিছানার পাশে প্রায়শই ড্রেসিং টেবিলটাকে দেখতে পায়। এই উত্তেজনা নিয়েই এখন প্রতিদিন তার ঘুম ভাঙ্গে। আর মাত্র একশ টাকা, শেষ কিস্তিটা শোধ করতে পারলেই অনেকদিনের লালিত স্বপ্নটা একেবারে হাতের মুঠোয় চলে আসবে!
শিহরিত মন নিয়েই সে শেষ কিস্তির টাকাটা দিতে মিতুদের বাসায় আসে। মিতু তখনও ভার্সিটি থেকে ফেরেনি। আগের সব লেন দেন মিতুর সাথেই হয়েছে। কিন্তু মাজেদার একদমই অপেক্ষা করার ধৈর্য্য রাখতে পারছিলো না। খালাম্মাকে দেখে তার হাতেই টাকাটা দিয়ে দিল।
'খালাম্মা এই যে শেষ কিস্তির একশ টাকা।'
মিতুর আম্মা যেন আকাশ থেকে পরলো,
'কিসের টাকা?'
'ড্রেসিং টেবিল কেননের শেষ কিস্তি।'
'কিসের ড্রেসিং টেবিল? কার ড্রেসিং টেবিল?'
'মিতু আপার ঘরে যেইড্যা আছে হেইড্যার কথা বলতাছি। মিতু আপাই তো আমারে পাঁচশ টাকা দিয়া আমারে হেইড্যা কিইন্যা নিতে বলছে। এর আগে আমি ওনারে চারশ টাকা শোধ করছি।
খালাম্মাকে দেখে মনে হলো মাজেদার কথা উনি যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না।
আসলেও উনি তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেই মুহূর্তে উনি পেপারে পড়ছিলেন কিভাবে একটা বখে যাওয়া ছেলে ঘরের আসবাবপত্র বিক্রী করে নিজের ড্রাগের টাকা যোগার করছিলো তার বিশদ বর্ণনা। এখন উনার একার ঘাড়েই সব ভাবনা বলে সারাক্ষন সন্তানদের নিয়েই চিন্তা ভাবনা করেন। আবার ওদের উপর অগাধ বিশ্বাস রাখেন বলে অতো আণুবীক্ষনিক নজরদারী প্রয়োজন মনে করেন না। দুজনের দুটো ঘর আছে সেখানে তারা কি করছে কি ফন্দি আটছে তা ওনার অতো না জানলেও চলবে। কিন্তু মিতু যে তলে তলে ঘরের আসবাবপত্র বেচে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাও আবার উনাকে না জানিয়ে সেটা একদমই কল্পনার অতীত। মিতুর কি কোন কারণে খুব টাকার প্রয়োজন পরেছে? ও তো ড্রাগ ট্রাগের কাছে ঘেঁষার মেয়ে না। মায়ের মন অনেক শংকাই মনের মধ্যে উঁকি মারছে। তবে সব ছাড়িয়ে নিজের মেয়ের প্রতি এক ধরনের অভিমান বোধ করছেন। নিজের ঘরে না রেখে ড্রেসিং টেবিলটা মিতুর ঘরে রেখেছেন অথচ মেয়ে তার বিনিময়ে এই প্রতিদান দিল? মায়ের কথা না ভাবুক বাবার স্মতি চিহ্নের প্রতিও তো এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। অথচ নিজের পেটের মেয়ে হয়ে মায়ের মনের এই বোধটাকে বুঝতে পারলো না। বোধের একদম মূল ধরে টান দেওয়া।
৫
সেদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে মিতু ঘরের দরজা খোলা দেখতে পেল। ভেতরে মাজেদা আর মায়ের গলা শুনতে পারছে। তার নিজের ঘরের ভেতর থেকেই সেই সব কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। মাকে একটু উত্তেজিত মনে হলো। মাজেদাকে বলতে শুনলো,
-'খালাম্মা আমার কোন দোষ নাইক্যা। মিতু আপা নিজের থ্যাইক্যাই আমারে একড্যা কিনতে কইছে। আপনাগো জামাই তো আমারে বলে, সবুর করো, তোমারে এইক্যেবারে নতুন কিইন্যা দিমু।'
মা আর মাজেদার কথোপকথনের শেষ অংশ শুনে মিতুর বুঝে নিতে বাকী থাকে না প্রথম অংশে কি ছিল। ড্রেসিং টেবিলটা মাজেদার কাছে বেচে দেওয়ার কথাটা আম্মাকে বলা হয়নি। মাজেদা কি আজকে তবে তার শেষ কিস্তির টাকাটা দিতে এসেছিল? মাত্র একশ টাকাতে বিক্রি করছে বলে কি আম্মা রেগে গেছে? আম্মাকে এখন ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। পাঁচশ টাকা কম না। এই জিনিষ ফেলতেও তো কম সে কম একশ টাকা লাগতো। সেখানে খুবই ভালোভাবে ঘর থেকে এটাকে সরাতে পারছে সাথে কিছু বাড়তি পয়সাও পাচ্ছে পুরো বিষয়টা বলতে গেলে একটা ভালো বানিজ্যই।
নিজের ঘরে ঢুকে আম্মার চেহারা দেখে বুঝতে পারলো ঘটনাটা যতটা হাল্কাভাবে নিয়েছিল, বিষয়টা সেরকম নয়। আম্মা এখন মিতুকে না দেখার ভান করছে। খুব রেগে গেলে উনি এমনটা করেন। কিছুটা গম্ভীর স্বরেই মাজেদাকে বলল,
'এখানে একটু অপেক্ষা করো। তোমার চারশ টাকা এখনই মিটিয়ে দিচ্ছি।'
আর কোনদিকে না তাকিয়ে আম্মা সোজা নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। মিতুও পেছন পেছন অনুসরন করে ও ঘরে গেল। আম্মা আলমারী খুলে টাকা বের করছিলেন। মিতু কিছুটা কৈফিয়তের সুরে বলল,
'এতো সহজে পুরোনো একটা ড্রেসিং টেবিল বিক্রি করে দিচ্ছিলাম তাতে অসুবিধা কি ছিল?'
আম্মার নিরুত্তর মুখের কঠিন ভাবরেখা দেখে মিতু এবার একটু নরম স্বরে বলল,
'আমার বান্ধবীদের রুমে সব কি সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের আধুনিক ড্রেসিং টেবিল। আমিও ওরকম একটা চাই।'
এবার আম্মা মিতুর দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত কিন্তু কঠিন স্বরে বলল,
'তোমার নিজের সংসারে যে রকম ইচ্ছা সে রকমভাবে সাজিয়ে নিও। এটা আমার সংসার। এখানে তোমার আব্বার কোন স্মতি ফেলা যাবে না।'
যুদ্ধটাতে শেষ পর্যন্ত সালমাই জিতে গেলেন। কিম্বা মিতু সহজেই হার স্বীকার করে নিল। কেন - সে প্রশ্নের উত্তর না হয় আর নাই বা জানা হলো। আসলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা অতো খারাপ নয়।
মিতুর মনে হলো আম্মার হাত থেকে টাকাটা নেওয়ার সময় মাজেদার চোখে যেন আশাহতের বেদনা ছায়া ফেললো। মেয়েটা কি ড্রেসিং টেবিলটা নিয়ে অনেক বেশি আশা দেখেছিল? হবে হয়তো। আশাহতের বেদনা মিতুর চোখেও কি ছায়া ফেলেনি? হয়তো সবচেয়ে বেশি কষ্টটা বোধহয় আম্মাই পেয়েছেন। কে আর কার হৃদয়ের কতটা খবর রাখে?
তিন জোড়া নারী চোখ একদৃষ্টিতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। কিম্বা আয়না দেখছে তার সামনে তিন জোড়া চোখে ভেসে বেড়াচ্ছে তিন কালের প্রতিচ্ছবি - অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।
লেখক পরিচিতি
ওয়াহিদা নূর আফজা
জন্ম সালঃ ৩০শে জানুয়ারি
জন্মস্থানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ
বর্তমান আবাসস্থলঃ ফ্রীমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া.
পেশাঃ তড়িৎ প্রকৌশলী
প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ : কিন্নরকণ্ঠী নদী, বিতংস, ঘরট্ট
প্রাপ্ত পুরস্কার: কথাসাহিত্যে কালি ও কলম পুরষ্কার'২০১৩
http://www.cadetcollegeblog.com/author/noorafza
ইমেইল-ঠিকানা দেবেনঃ wahidaafza@gmail.com
জন্মস্থানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ
বর্তমান আবাসস্থলঃ ফ্রীমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া.
পেশাঃ তড়িৎ প্রকৌশলী
প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ : কিন্নরকণ্ঠী নদী, বিতংস, ঘরট্ট
প্রাপ্ত পুরস্কার: কথাসাহিত্যে কালি ও কলম পুরষ্কার'২০১৩
http://www.cadetcollegeblog.com/author/noorafza
ইমেইল-ঠিকানা দেবেনঃ wahidaafza@gmail.com
2 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ লাগলো আপা। অনেক শুভকামনা আপনার জন্য। নিয়মিত গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
উত্তরমুছুনম্যাম আপনার লেখার ভীষণ ভক্ত। কালি ও কলমে ছোটগল্প সংকলনে প্রথম খোঁজ পাই। নারীদের লেখা খুব বেশি পড়া হয়নি তবে যতটুকু পড়েছি আপনার চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ততা আর কোথাও পাইনি। কালি ও কলমে সেই লেখাটা পড়ে কেঁদেছিলাম মনে পড়ে। শুভকামনা রইল।
উত্তরমুছুন