গনজালেস ডি কস্তা
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জনজীবনের বহুকৌনিক বাস্তবতার অনন্য রূপকার আবুবকর সিদ্দিক। তিনি মূলত কবি। কিন্তু তাঁর কবিসত্তা অত্যন্ত সচেতনভাবে কথাশিল্পীসত্তার ওপর প্রভাব আরোপ করা থেকে বিরত থাকতে পেরেছে; যেটা অধিকাংশ কবি-কথাশিল্পীর ক্ষেত্রে প্রায় অসাধ্য। তার বড় প্রমাণ জীবনানন্দ দাশের কথাসাহিত্য। আবুবকর সিদ্দিকের গল্পগ্রন্থের সংখ্যা দশ। ভূমিহীন দেশ (১৯৮৫), চরবিনাশকাল, মরে বাঁচার স্বাধীনতা, কুয়ো থেকে বেরিয়ে, ছায়াপ্রধান অঘ্রান, কান্নাদাসী, বামাবর্ত, মুক্তিলাল অভ্যুদয়, কালোকুম্ভীর, হংসভাসীর তীওে (২০০৮)। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে 'শ্রেষ্ঠ গল্প' ও 'গল্পসমগ্র'। লেখকের উপন্যাসসমূহ হলো : জলরাক্ষস (১৯৮৫), খরাদাহ, একাত্তরের হৃদয়ভস্ম, বারুদপোড়া প্রহর (১৯৯৬)।
এসব গল্প ও উপন্যাসে বিষয়ের বহুমাত্রিক বিন্যাস কথাশিল্পীকে সমকালীন অন্যান্য কথাসাহিত্যিক থেকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে। তবে তাঁর কবিতার জগৎ বিষয়বৈচিত্র্যে ও ক্রম রূপান্তরে ঋদ্ধ। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে থেকে শুরু করে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু পর্যন্ত অনেক কবির ব্যক্তিগত সানি্নধ্যে এসেছেন তিনি। তবে কারও দ্বারা প্রভাবান্বিত হননি। তাঁর কবিতার ভাষা, উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীকের রয়েছে স্বতন্ত্র মেজাজ। দেশকালের অন্তঃসার উন্মোচনে তাঁর কবিতা মননশীল ব্যঞ্জনায় বিকশিত হয়েছে। কবিতার চিরচর্চিত বিষয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ''ধবল দুধের স্বরগ্রাম''(১৯৬৯) থেকে ক্রমাগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমপ্রতি প্রকাশিত ''রাভী''তে(২০০৮) নতুন বাণীভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহ হচ্ছে : ধবল দুধের স্বরগ্রাম, বিনিদ্র কালের ভেলা, হে লোকসভ্যতা, মানুষ তোমার বিক্ষত দিন, হেমন্তের সোনালতা, নিজস্ব এই মাতৃভাষায়, কালো কালো মেহনতী পাখি, কংকালে অলংকার দিয়ো, শ্যামল যাযাবর, মানবহাড়ের হিম ও বিদ্যুৎ, মনীষাকে ডেকে ডেকে, আমার যত রক্তফোঁটা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, কবিতা কোব্রামালা, বৃষ্টির কথা বলি বীজের কথা বলি, এইসব ভ্রূণশস্য, নদীহারা মানুষের কথা, রাভী। কথাসাহিত্য ও কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তাঁর 'রচনাসংগ্রহ ১' প্রকাশিত হয়েছে। একমাত্র ছড়াগ্রন্থ : হট্টমেলা। নিজের লেখা প্রায় ২৫০টিরও বেশি গণসঙ্গীতের সঙ্কলন : 'রুদ্রপদাবলী : গণমানুষের গান' একটি অনন্য গ্রন্থ। মননশীল রচনায় তিনি অগ্রগণ্য। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ হলো : রমেশচন্দ্র সেন, সাহিত্যের সঙ্গপ্রসঙ্গ, কালের কলস্বর। স্মৃতিকথা : 'সাতদিনের সুলতান'। তিনি বাংলা একাডেমীসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।
৭৯ বছর বয়স্ক এই লেখকের সাহিত্যচর্চার ব্যাপ্তিকাল ৬২ বছরের বেশি। তাঁর দেশবিভাগপূর্ব জীবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে, দেশবিভাগ পরবর্তী পূর্ববাংলায়। শৈশব কৈশোর যৌবন থেকে এই পরিণত বয়স পর্যন্ত তাঁর দেখার পুঁজি ও লেখার প্রেরণা বিপুল। তাঁর গল্প উপন্যাস এই বিশাল অভিজ্ঞতার পুঁজির সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি। আর এটাই কথাশিল্পী হিসেবে আবুবকর সিদ্দিকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাঁর নিজের কথায় :
''পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনৈতিক বন্ধুদের সানি্নধ্যে এসে চিন্তাচেতনা খুব দ্রুত প্রভাবিত হতে থাকে। রাজনৈতিক মুক্তিতৃষ্ণায় উদ্বেল হয়ে গণসঙ্গীত রচনাায় ঝুঁকে পড়ি। ব্রাত্য মানুষের সংগ্রামী জীবন নিয়ে গল্প উপন্যাস লেখার জন্যে ভিতরতাগিদ বোধ করি। অভিজ্ঞতার পটভূমি দক্ষিণবঙ্গের বাগেরহাট_ মোরেলগঞ্জ_ দাকোপ_ শরণখোলা_ মংলা_ বাগেরহাট_ সুন্দরবন থেকে ছড়িয়ে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী_ নবাবগঞ্জ_ শিবগঞ্জ_ কানসাট_ ভোলারহাট_ রহনপুর পর্যন্ত ব্যাপ্ত। এ সবটাই আমার গল্প উপন্যাসের পশ্চাৎভূমি। তবে কবিতা এমন একটা শিল্পক্রিয়া, যা আশিরনখ ব্যক্তিগত হৃদয়রুধিরের প্রতিলিপি। তার প্রজননকলাকে কোনো প্রচলিত ছকে বেঁধে দিতে চাওয়া স্যুইসাইড্যাল হতে পারে বলে আশঙ্কা করি। কী বলবো! কবিতাই আমার গোটা সাহিত্যজীবনের ধ্রুবপদ।
১৯৪৬ থেকে ২০০৮; ৬২ বছরের এই লিখনকাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, লীগ-কংগ্রেসের দ্বৈরথ, নেতাজীর আজাদহিন্দ ফৌজ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, সামপ্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, একুশে ফেব্রুয়ারি, কাগমারী সম্মেলন, একুশ দফা, যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ভাসানীমুজিব _ নেতৃত্ব, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, নকশাল আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন... ... ..., এ এক ধারাবাহিক আভ্যুদয়িক ঘটনাপ্রবাহ। আমি চক্ষুষ্মান ভূশক্তির কাক। সক্রিয় শরীক এক কলমনবীশ। দিনে দিনে হলুদ হয় গাছের পাতারা। পীতাভ হয়ে আসে লেখার পাতারা। কালের কামড় উজিয়ে কী টিকবে-কী টিকবে না, জানিনে, চাইও না জানতে। শুধু বিশ্বাস করি, লেখাই আমার জীবনের করণীয় কাজ। এ আমার ধর্মপালনীয় ব্রত।''(রচনাসংগ্রহ ১, পরিপ্রেক্ষিত প্রসঙ্গে)
আবুবকর সিদ্দিকের কথাসাহিত্যিক সত্তার কয়েকটি প্রবণতা :
ক. আবুবকর সিদ্দিক কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে কট্টর বস্তুবাদী, সমাজনিষ্ঠ শিল্পী। আর বামপন্থী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে জীবনকে সমীক্ষা করার একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়। জীবনের একটা প্রধান সময় তাঁর অতিবাহিত হয়েছে বাম চিন্তাদর্শের ঘনিষ্ঠ সানি্নধ্যে। সেখান থেকে যে গভীর অভিজ্ঞতা ও প্রেরণার শাঁস তুলে এনেছেন তা যেমন বাস্তববাদী, তেমনি অকৃত্রিম। মনে হয় এই কারণেই সুলভ প্রচারের ফাঁদে পা দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের যে ক'জন মুষ্টিমেয় তালিকাভুক্ত কথাসাহিত্যিক আছেন তাঁদের অন্যতম তিনি। সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় এই যে, তত্ত্ব এবং আদর্শ কখনো তাঁর শিল্পমেধার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেনি।
খ. আবুবকর সিদ্দিকের গল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের উপস্থিতি বিস্ময়করভাবে কম। বরং সমাজের নীচুতলার ব্রাত্য তথা লোকায়ত চরিত্রই তাঁকে টানে বেশি। বিশাল বাংলার ব্যাপ্ত গ্রামজীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা যেমন অত্যন্ত প্রত্যন্ত, তেমনি পটভূমির নিসর্গ ও গণমানুষ নিয়ে লেখার আগ্রহও বেশি তাঁর মধ্যে। যেন এখানেই তাঁর প্রতিভা স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পায়।
গ. উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ, বাংলাদেশের এই দুই প্রত্যন্ত এলাকার মৃত্তিকা ও মানুষ সম্বন্ধে বিপুল অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই লেখক। যার ফলে খুব সাবলীল লেখনিতে তিনি দুই প্রান্তের জীবনাচরণের তৃণমূলে চলে যেতে পারেন। একদিকে উপন্যাস 'জলরাক্ষস' ও গল্প 'নোনা মাংসের গন্ধে; 'খালখসা লাল কংকাল', অন্যদিকে উপন্যাস 'খরাদাহ' ও গল্প 'চরবিনাশকাল', 'খরার দুপুর', 'বাইচ', 'দোররা'-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঘ. আবুবকর সিদ্দিকের কবিতায় রোমান্টিক প্রেমানুভূতি একটি বড় বিষয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, এ বিষয়ের উপরে একটি দুটি ব্যতিক্রম বাদে তাঁর প্রায় সমস্ত গল্প নীরব।
ঙ. সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব সমস্যার প্রতি পূর্ণমাত্রায় অনুগত থেকেই শিল্পের দাবি ষোলআনা মিটিয়ে দেন আবুবকর সিদ্দিক। এমনকি রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে বিচিত্রসব নিরীক্ষাধর্মী গদ্যরীতির প্রবর্তন ঘটিয়ে যান তিনি। ফলে রস ব্যত্যয় নয়, বরং ভিন্নমাত্রার শিল্পসাফল্যে উত্তীর্ণ হয় উপন্যাস ও গল্পগুলো।
চ. আবুবকর সিদ্দিকের একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় খুরধার ঝধঃরৎব ব্যবহারের দিকে। বিশেষ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভ-ামীগুলোকে তুলোধুনো করার অস্ত্র হিসেবে তিনি এই ঝধঃরৎব-এর সফল ব্যবহার করেছেন।
ছোটগল্প লেখার মধ্য দিয়ে আবুবকর সিদ্দিকের কথাসাহিত্যের সূচনা হলেও প্রথম উপন্যাস 'জলরাক্ষস' তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে স্থান দিয়েছে। উপন্যাসটি সম্পর্কে শওকত ওসমান বলেছেন : 'তীক্ষ্ন সমাজসচেতন লেখক ক্ষমাহীন চাবুক হেনেছেন অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে।' 'খরাদাহ' সম্পর্কে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ঔপন্যাসিক আবুবকর সিদ্দিককে বলেন, একজন লেখক সোনার দোয়াত কলম কামনা করে। আমি কামনা করবো আপনার লোহার দোয়াত কলম হোক।' তাঁর 'একাত্তরের হৃদয়ভস্ম' এবং 'বারুদপোড়া প্রহর' উপন্যাসের বিষয়স্বাতন্ত্র্য ও শিল্পমূল্য অসামান্য।
'খরাদাহ' উপন্যাসের বিষয় দুর্ভিক্ষ ও পটভূমি খরাপোড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের জনজীবন। অন্যদিকে দক্ষিণ বাংলার বিশেষ করে খুলনা বাগেরহাটের নিম্নভূমির মানুষ ও পরিবেশ অবলম্বনে গড়ে উঠেছে 'জলরাক্ষস'- এর কাহিনী। প্রকৃতি ও জীবন বড় ক্যানভাসে শিল্পায়িত হয়েছে। বিরুদ্ধ শক্তির মোকাবেলায় প্রতিবাদী মানুষের যে চিরকালীন অনমনীয় সংগ্রাম, বাঁচার লড়াই_ এই লড়াইকেই ঔপন্যাসিক তাঁর অভিজ্ঞতার বয়ানে, প্রতীকী নিরীক্ষার ব্যবহারে ও জীবনবোধের রূপায়ণে অসামান্য করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
'চরবিনাশকাল' গল্পগ্রন্থের 'ভোগবৈরাগ্য' একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। এ গল্পের প্রধান চরিত্র অনাদি 'সময়প্রবাহ'। যে সময় আদিহীন অন্তহীন এক নিরাসক্ত গতির প্রতীক, সত্যিকার অর্থে যার নেই কোনো মোহগন্ধ ও পিছুটান। অথচ মূঢ় মানুষ তার বিধ্বংসী কোলের মধ্যে বাস করে। সংসার পাতে, গেরস্থালি সাজায় আর যা কিছু তৈজস ও দলিলপত্র তাকে জীবনসর্বস্ব জ্ঞান করে চিরকালের জন্য অাঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। মুহূর্তজীবী মায়া-মমতার শিকড় থেকে উচ্ছিন্ন হতে হতে আবার নতুন শিকড়ের সঙ্গে নিজেকে গ্রথিত করার আকর্ষণে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চলে পথ ধরে। বুঝেও বুঝতে চায় না, এপথ চিরকালই সেই অমোঘ যাত্রাপথ, যা সাংসারিক মানুষকে ফুসলিয়ে নিয়ে যায় ঘরের বাইরে। নিয়ে যায় সেই মহাপরিণামের দিকে; যেখানে সময়ের গাড়ি ও নিরাকার মৃত্যু একাকার হয়ে আছে।
মূলত গোটা গল্পটি দাঁড়িয়ে আছে একটা কূটদর্শনের ওপর। কিন্তু এর রূপকটি বর্ণনার গুণে এতো প্রত্যয়ময় হয়ে উঠেছে যে, ঘর-পথ-জটিবুড়ি-শীত-পথযাত্রার ছবি, মনে হয় নিতান্ত বাস্তব। অবশ্য লেখক এই মায়াচিত্র নিজেই নস্যাৎ করে দেন যখন এক সাদা চাদর ঢাকা রহস্য পুরুষ জটিবুড়ির সামনে এসে উদয় হয় এবং এই নষ্ট মোহের তথ্য অন্যদি সময়ের বৃত্ত সর্বব্যাপী প্রধান হয়ে ওঠে একেবারে শেষের দিকে।
নামগল্প 'চরবিনাশকাল' 'ভোগবৈরাগ্যে'র মতই বিষয় এবং ভাষায় দু'দিক থেকেই বাংলা কথাসাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বলা চলে আবুবকর সিদ্দিকের নিজস্ব ঘরানার নিরীক্ষা। একদিকে সর্বধ্বংসী সময়ের জ্যোতিহীন প্রবাহ, অন্যদিকে তারই কোলে বসে বেভুল মানুষের সংসার খেলা। বিশাল সময়ের প্রবাহের মধ্যে বসে আয়ুর মাপ। সময় বৃত্তে বাঁধা জীবনকে প্রেমের প্রসাধন কলায় ভুলিয়ে শাশ্বত করে তোলার মূঢ়তা; যার অমোঘ পরিণাম আর কিছু নয়; বৈনাশিক সময়ের বিশ্বস্ত দূত মৃত্যুর আগ্রাসনে চূড়ান্ত বিলয়। এ গল্পে চাঁদবিবি ও তার নাগর পুরুষটি মিলে ভালোবাসার খেলাঘর পাতাবার আয়োজনে উদ্যমী। কিন্তু তারা টের পায় না; মৃত্যুই করাল মাড়ির মধ্যে বসে সেই ঘর বাঁধার আয়োজন। পরিণামে দু'জনেই চিরযাত্রী হয়, চরবিনাশকাল নামক সেই সর্বগ্রাসী মৃত্যু দ্বীপের অভিমুখে। সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে লেখক মৃত্যুর রূপকধর্মী অনুসর্গগুলোকে ঢেনে এনেছেন।
উত্তরবঙ্গের সেই ঝুপসি অন্ধকার মাখা আমবাগান, রাতের নদী মহানন্দা, এপারে প্রাচীন আমলের পোড়াবাড়ি ও তার পেছনে আদি শ্যাওলা বারুণী মেলার ভেসে আসা স্বরধ্বনি; এপারে লাঠিতে ভর দেওয়া মান্ধাতা আমলের প্রাচীন বুড়ি, ভাঙা দেয়ালের খোড়ল থেকে ছিটকে আসা তক্ষক সাপের ডাকের ভৌতিক আওয়াজ, কৃতান্তের মত সর্বনাশা হ্যাঁ মেলে প্রেমিক নাগরকে কবরগুলোর আহ্বান এবং সবশেষে চরবিনাশকাল অভিমুখী নৌকার মাঝির অতিপ্রাকৃতিক চেহারা এবং হিমশীতল অট্টহাসি, তার নৌকায় শোয়ানো কাফন মোড়া সারি সারি লাশ, যাদের বেরিয়ে আসা পায়ের সেই তরল আলতা দাগানো যে আলতার শিশি চাঁদবিবিকে উপহার দেবার জন্য বারুণীর মেলা থেকে রসিক নাগর কিনে এনেছিল সন্ধ্যে রাতে, কালান্তর মৃত্যুর একটি মাত্র ফুৎকারে শূন্যে মিলিয়ে যায় প্রেমিক-প্রেমিকার বাসরঘর সাজানোর বালখিল্য অভিলাষ। বস্তুত আগ্রাসী মৃত্যুর চোয়ালে বসে ভালোবাসার ঘর বাঁধার শখ এমনি মূঢ়তায় নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য।
'কুয়ো থেকে বেরিয়ে' গল্পগ্রন্থের একটি অন্যতম গল্প 'খরার দুপুর'। গল্পটি আয়তনে ছোট, চরিত্র ও পটচিত্র যৎসামান্য। কিন্তু তারই মধ্যে মৃত্যুর আশ্চর্য প্রতিভাস। একটিই সিকোয়েন্স। বন্ধুর পালায় পড়ে যৌবন উত্তীর্ণ কমরেডের উত্তরবঙ্গের এক গ-গ্রামে আগমন। উদ্দেশ্য বন্ধুর বোন শালীমাকে বিয়ে করে বন্ধুকে অব্যাহতি দেওয়া। কিন্তু এটুকু পরিসরে লেখক সূত্রপাত লেকে গল্পের মূল অভিমুখ মৃত্যুর আবহ নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছেন; অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ সূক্ষ্ম সব রূপকের ব্যবহার ঘটিয়ে বারান্দায় বসে আছে হবু বর। তার সামনে জাজ্বল্যমান উত্তরবঙ্গের দুপুরের খরাপোড়া দাবদাহ। সত্যি বলতে গেলে, এই খরাচিত্র আসলে মৃত্যুর পরিণামের ধুয়ো হিসেবে কাজ করেছে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। অথচ উৎসবের কোনো লক্ষণ নেই। এমনকি যে বন্ধুটি কমরেডকে বর বানিয়ে এখানে এনে তুলেছে সেও লাপাত্তা। আর তার বোন শালীমা অর্থাৎ নববধূর তো সাড়াশব্দের প্রশ্নই ওঠে না। ঝাঁ ঝাঁ মৃত্যুর প্রতিনিধি আসা-যাওয়া করতে থাকে তার চোখের সামনে দিয়ে। গ্রামজুড়ে কলেরার মচ্ছব চলছে। একের পর এক কাফন মোড়া লাশবাহী টুপিধারীর শোভাযাত্রা চলছে সামনের রাস্তা দিয়ে এবং কিছু পরে আরো দূরে প্রধান সড়ক কাঁপিয়ে ধুলো উড়িয়ে শহরে ফেরার শেষ বাসটি দৌড়ে চলে যায়।
লেখক এভাবে চূড়ান্ত পরিণাম ঘনিয়ে তোলার প্রাক আয়োজন সম্পন্ন করেন। এরপর ক্লাইমেক্স এবং সেই চিত্রটিও রচিত হয় একটি আপাত জৈবিক প্রলোভনের হাতছানি দিয়ে।
বস্তুত আবুবকর সিদ্দিক 'ভোগবৈরাগ্য' ও 'চরবিনাশকাল' গল্পের মতই 'খরার দুপুর'-এ অতিপ্রাকৃত ক্যানভাসে মৃত্যুর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন অসামান্য শিল্পকৃতিতে।
মূলত আবুবকর সিদ্দিকের উপন্যাস ও অনেক গল্পে অতিপ্রাকৃত আবহ ব্যবহার হতে দেখা যায়। কখনো চিত্রকল্পে আবার কখনো বা পট সংগ্রন্থনে অতিপ্রাকৃত অনিবার্য ভূমিকা পালন করেছে। যেমন- 'সারমেয় সংঘ' (চরবিনাশকাল) গল্পটিতে অতিপ্রাকৃত অনুষঙ্গ এসেছে একটি প্রেম-কাহিনীর পূর্ণতার প্রয়োজনে। আবার 'করমচাঁদ কামার'-এ ধরনের রূপক ব্যবহৃত হয়েছে স্বৈরাচারি সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের অভ্যুত্থান দেখানোর জন্য। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে যখন নিরেট সামাজিক প্রসঙ্গেও অতিপ্রাকৃত উপাদানে যোজনা করে অনায়াসে লেখক তাঁর অভীষ্ট সাফল্যে পেঁৗছে যান। যেমনটা ঘটেছে- 'বেলুনওয়ালা', 'জালযোদ্ধা' গল্পে এবং অনেকটা 'খাদ্যমন্ত্রণালয় কতো দূরে' গল্পের শেষ ভোটারের লাশ থেকে উগরানো পঁচা বোটকা গন্ধে সে বমি করে দেয়। এরাই তার 'পিপল'।
প্রকৃতপক্ষে আবুবকর সিদ্দিকের প্রথম গল্পগ্রন্থ 'ভূমিহীন দেশ'-এ সাতটি গল্পের অন্তত পাঁচটির বিষয় বাংলাদেশের প্রচলিত ভোটপর্ব নিয়ে। ভোটাভুটির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি নির্বাচনের যে ধারাটি এদেশে চালু রয়েছে, তা যে কত অর্থহীনভাবে হাস্যকর এবং জনগণের স্বার্থ লেশবর্জিত; সেই অন্তঃসারশূন্যতা এই গল্পগুলোতে ক্ষমাহীন শেষ ও সূক্ষ্ম রূপকের মধ্যদিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমরা একটু পূর্বে অতিপ্রাকৃতের ব্যবহার নিয়ে কথা বলছিলাম। এই পর্বে 'খাদ্যমন্ত্রণালয় কতো দূর' ও 'ভূতপ্যাঁদানী' গল্প দুটিতেও অতিপ্রাকৃত চিত্র বড় হয়ে উঠেছে। নির্বাচন ও ভোট ব্যবস্থা নিয়ে এতগুলো গল্প একসঙ্গে মনে হয় আর কোনো লেখক এদেশে এখনো রচনা করেননি। 'খালখসা লাল কংকাল' গল্পের রূপক ও সূক্ষ্মভাবে শিল্পের মাত্রা মেনেই ঝধঃরৎব- কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আসলে ভোট ভিখারি নির্বাচন প্রার্থী শ্রেণীশত্রুরা জনগণ নামক অধীন নিরীহ নিম্নবর্গের ভোটারদের শরীর থেকে রক্ত-মাংস-চামড়া নিয়ে কংকাল বানিয়ে ছেড়ে দেয়।
'ছায়াপ্রধান অঘ্রাণ' গল্পগ্রন্থের 'নোনা মাংসের গন্ধে'-এ দক্ষিণবঙ্গের বস্তুনিষ্ঠ রূপায়ণ আবুবকর সিদ্দিককে বাংলা কথাসাহিত্যে বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এ গল্পে সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দরবনের পটভূমি অনুসৃত হয়েছে। গল্পটির কাহিনীর খোসা ভেঙে রূপকটি বেরিয়ে এসেছে একেবারে গল্পের শেষ প্রান্তে পেঁৗছিয়ে। গল্পটি আগাগোড়া গড়িয়ে চলেছে সুন্দরবনের পটভূমিতে একটি মদ ও হরিণের মাংসজীবী অপরাধী পুরুষের আদিম নোনা স্বৈরিণী মেয়ে মানুষের পালায় পড়া কর্মচারী ওবেদুরের মুক্তিপথ খুঁজে মরার তাড়নার দিকে। বাদাবনের রহস্যময় জটিলতায় বিভ্রান্ত ওবেদুর শেষের দিকে সম্পূর্ণ নাচার হয়ে পড়ে তীক্ষ্নধার গুলের আঘাতে মেয়েটির খুন হয়ে যাওয়াতে। বস্তুত এই দুর্ঘটনার নিয়ামক ওবেদুরের অদৃষ্ট থেকে বাস্তবজগতের যা কিছু জীবন লক্ষণ সব নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অতঃপর জীবনের খোলসে যা কিছু এগিয়ে আসে তার প্রত্যক্ষ নজরে, সবই আসলে সেই নিরাকার মৃত্যুর আকারময় রূপাবয়ব। এখানে সে আবির্ভূত হয়েছে বাদাবনের সম্রাট বাঘের রূপকে। কিন্তু অচিরেই আমরা জেনে যাই, তার মহিমাময় জ্যোতির ছটা; দিগন্তচরাচর ঢাকা মহান অবয়ব আর পৃথিবী-বিদারক রাজকীয় গর্জনধ্বনি। আর তার পশ্চাৎ ভূমিতে সাগর ও আকাশের ক্লাসিক পটভূমি এবং সবকিছুকে আচ্ছন্ন করা জ্যোতিময় সূর্য; এই অসাধারণ চিত্রকল্প যা বাংলা কথাসাহিত্যে সম্পূর্ণ একক, এত আলাদা আর কিছু নয়।
বিশাল মৃত্যুর পটভূমিতে বন্দি সামান্য মানুষের নিয়তিচিত্র এবং অসহায় মানুষ তার এই অবধারিত মহাপরিণামের পূর্বাভাস তার জীবনের সূচনালগ্নেই আভাসে অবচেতনে প্রত্যক্ষ করে, তার ইঙ্গিত ছেলেবেলা থেকে ওবেদুরের ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্নে কালো বেড়ালের উপর্যুপরি হানার মধ্যদিয়ে ব্যক্ত হয়েছে। প্রতিবারের স্বপ্নে সেই একই ভয়াবহ প্রতীক; শিয়রে বসে সেই কালো বেড়াল ওবেদুরের মাথা চিবিয়ে খায় এবং সেই চিবানোর কচরমচর আওয়াজ তার কানের মধ্যে এসে আঘাত করে। বাস্তবিক 'নোনা মাংসের গন্ধে'র বিষয় ও ভাষাভঙ্গি বাংলা কলাসাহিত্যে অদ্যাবধি দ্বিতীয় রহিত।
নিরীক্ষাধর্মী গদ্যরীতি
আবুবকর সিদ্দিক রাজনীতিক বা সামাজিক বিষয় নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী গদ্যরীতি প্রবর্তন করেছেন। তাঁর ভাষায় : এক-একজনের লেখায় এক-এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য কাজ করে। সেটাই শৈলী। স্বাতন্ত্র্য তো মানুষের স্বভাবধর্ম। চলনেবলনে পোশাকেআশাকে পেশায়নেশায় ভিন্ন রক্ষচির্হি লোকাঃ। বিশেষত 'ছায়াপ্রধান অঘ্রাণ'-এর নাম গল্প 'ছায়াপ্রধান অঘ্রাণ', দোর্রা ও 'বাইচ' নিরীক্ষাধর্মী গদ্যের অনন্য দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধ বনাম নকশালপন্থী বাম রাজনীতির টানাপড়েন অঘ্রাণের চিত্রকল্পে তুলে ধরা হয়েছে নামগল্পে। চারু মজুমদারের ডাকে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আন্দোলনে তাদের শেষ পরিণতি ছিল হতাশার, ব্যর্থতার, মর্মান্তিক বেদনার। আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নভঙ্গের সেই কাহিনীকে ছায়াময় অঘ্রাণের প্রতীকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্যে আবুবকর সিদ্দিক স্বতন্ত্র চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর উপন্যাস ও গল্পের বিষয়, ভাষাভঙ্গি ও অন্তর্বুনন বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য নিদর্শন। বিষয়ের গভীরতার সঙ্গে বর্ণনার ভাষায় প্রতীক, চিত্রকল্পের দক্ষ ব্যবহার তাঁর গল্পে আরো একটি শিল্পকুশলতার উদাহরণ। বস্তুত মানবজীবনের নিম্নবর্গের নানান সঙ্কট, ক্ষয়, পতন, প্রেম, অস্তিত্বের সারাৎসার ও উত্তরণের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন আবুবকর সিদ্দিক তাঁর গল্পসমূহে।
বস্তুত তৃণমূল সংলগ্ন বলেই গ্রামীণ জীবন প্রাধান্য পেয়েছে আবুবকর সিদ্দিকের কথাসাহিত্যে। রাজনীতি, প্রগতি আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর সাহিত্যসৃজনকে করেছে অনিবার্যভাবে প্রাণিত। এসব ক্ষেত্রে শৌখিন দৃষ্টি নয় মানুষ ও মানুষের শ্রেণীগত অবস্থান নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। হয়েছেন বাস্তব ও প্রতীকআশ্রয়ী। গদ্যশৈলীতে এনেছেন বৈচিত্র্য। অত্যাধুনিক নিরীক্ষাধর্মী গদ্যশৈলী তাঁর। রূপক-প্রতীকের ব্যবহার কারুকার্যম-িত। গ্রামজীবনের মূল দ্বন্দ্বগুলোকে তিনি শনাক্ত করেছেন।
কখনও একই ধরনের একঘেয়ে কাঠামোর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। বারবার বিষয় ও পটভূমি পরিবর্তন করেছেন। উপকণ্ঠ ও প্রান্তিক জীবনযাপনকারী মানুষ তাঁর কথাসাহিত্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন ও উত্তরবঙ্গের সীমান্তভূমি এই বিশাল পশ্চাৎভূমিতে তাঁর বিচরণ। বাংলাদেশের খুব কম কথাসাহিত্যিক এ ধরনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জন করে সেই অভিজ্ঞতাকে শিল্প সার্থক করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এই কম সংখ্যকের একজন হলেন আবুবকর সিদ্দিক। কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিককে অভিহিত করা যায় 'লেখকের লেখক' হিসেবে।- See more at: http://jjdin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=18-08-2012&feature=yes&type=single&pub_no=217&cat_id=3&menu_id=75&news_type_id=1&index=4#sthash.FLCuB5cD.dpuf
এসব গল্প ও উপন্যাসে বিষয়ের বহুমাত্রিক বিন্যাস কথাশিল্পীকে সমকালীন অন্যান্য কথাসাহিত্যিক থেকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে। তবে তাঁর কবিতার জগৎ বিষয়বৈচিত্র্যে ও ক্রম রূপান্তরে ঋদ্ধ। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে থেকে শুরু করে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু পর্যন্ত অনেক কবির ব্যক্তিগত সানি্নধ্যে এসেছেন তিনি। তবে কারও দ্বারা প্রভাবান্বিত হননি। তাঁর কবিতার ভাষা, উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীকের রয়েছে স্বতন্ত্র মেজাজ। দেশকালের অন্তঃসার উন্মোচনে তাঁর কবিতা মননশীল ব্যঞ্জনায় বিকশিত হয়েছে। কবিতার চিরচর্চিত বিষয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ''ধবল দুধের স্বরগ্রাম''(১৯৬৯) থেকে ক্রমাগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমপ্রতি প্রকাশিত ''রাভী''তে(২০০৮) নতুন বাণীভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহ হচ্ছে : ধবল দুধের স্বরগ্রাম, বিনিদ্র কালের ভেলা, হে লোকসভ্যতা, মানুষ তোমার বিক্ষত দিন, হেমন্তের সোনালতা, নিজস্ব এই মাতৃভাষায়, কালো কালো মেহনতী পাখি, কংকালে অলংকার দিয়ো, শ্যামল যাযাবর, মানবহাড়ের হিম ও বিদ্যুৎ, মনীষাকে ডেকে ডেকে, আমার যত রক্তফোঁটা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, কবিতা কোব্রামালা, বৃষ্টির কথা বলি বীজের কথা বলি, এইসব ভ্রূণশস্য, নদীহারা মানুষের কথা, রাভী। কথাসাহিত্য ও কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তাঁর 'রচনাসংগ্রহ ১' প্রকাশিত হয়েছে। একমাত্র ছড়াগ্রন্থ : হট্টমেলা। নিজের লেখা প্রায় ২৫০টিরও বেশি গণসঙ্গীতের সঙ্কলন : 'রুদ্রপদাবলী : গণমানুষের গান' একটি অনন্য গ্রন্থ। মননশীল রচনায় তিনি অগ্রগণ্য। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ হলো : রমেশচন্দ্র সেন, সাহিত্যের সঙ্গপ্রসঙ্গ, কালের কলস্বর। স্মৃতিকথা : 'সাতদিনের সুলতান'। তিনি বাংলা একাডেমীসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।
৭৯ বছর বয়স্ক এই লেখকের সাহিত্যচর্চার ব্যাপ্তিকাল ৬২ বছরের বেশি। তাঁর দেশবিভাগপূর্ব জীবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে, দেশবিভাগ পরবর্তী পূর্ববাংলায়। শৈশব কৈশোর যৌবন থেকে এই পরিণত বয়স পর্যন্ত তাঁর দেখার পুঁজি ও লেখার প্রেরণা বিপুল। তাঁর গল্প উপন্যাস এই বিশাল অভিজ্ঞতার পুঁজির সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি। আর এটাই কথাশিল্পী হিসেবে আবুবকর সিদ্দিকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাঁর নিজের কথায় :
''পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনৈতিক বন্ধুদের সানি্নধ্যে এসে চিন্তাচেতনা খুব দ্রুত প্রভাবিত হতে থাকে। রাজনৈতিক মুক্তিতৃষ্ণায় উদ্বেল হয়ে গণসঙ্গীত রচনাায় ঝুঁকে পড়ি। ব্রাত্য মানুষের সংগ্রামী জীবন নিয়ে গল্প উপন্যাস লেখার জন্যে ভিতরতাগিদ বোধ করি। অভিজ্ঞতার পটভূমি দক্ষিণবঙ্গের বাগেরহাট_ মোরেলগঞ্জ_ দাকোপ_ শরণখোলা_ মংলা_ বাগেরহাট_ সুন্দরবন থেকে ছড়িয়ে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী_ নবাবগঞ্জ_ শিবগঞ্জ_ কানসাট_ ভোলারহাট_ রহনপুর পর্যন্ত ব্যাপ্ত। এ সবটাই আমার গল্প উপন্যাসের পশ্চাৎভূমি। তবে কবিতা এমন একটা শিল্পক্রিয়া, যা আশিরনখ ব্যক্তিগত হৃদয়রুধিরের প্রতিলিপি। তার প্রজননকলাকে কোনো প্রচলিত ছকে বেঁধে দিতে চাওয়া স্যুইসাইড্যাল হতে পারে বলে আশঙ্কা করি। কী বলবো! কবিতাই আমার গোটা সাহিত্যজীবনের ধ্রুবপদ।
১৯৪৬ থেকে ২০০৮; ৬২ বছরের এই লিখনকাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, লীগ-কংগ্রেসের দ্বৈরথ, নেতাজীর আজাদহিন্দ ফৌজ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, সামপ্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, একুশে ফেব্রুয়ারি, কাগমারী সম্মেলন, একুশ দফা, যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ভাসানীমুজিব _ নেতৃত্ব, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, নকশাল আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন... ... ..., এ এক ধারাবাহিক আভ্যুদয়িক ঘটনাপ্রবাহ। আমি চক্ষুষ্মান ভূশক্তির কাক। সক্রিয় শরীক এক কলমনবীশ। দিনে দিনে হলুদ হয় গাছের পাতারা। পীতাভ হয়ে আসে লেখার পাতারা। কালের কামড় উজিয়ে কী টিকবে-কী টিকবে না, জানিনে, চাইও না জানতে। শুধু বিশ্বাস করি, লেখাই আমার জীবনের করণীয় কাজ। এ আমার ধর্মপালনীয় ব্রত।''(রচনাসংগ্রহ ১, পরিপ্রেক্ষিত প্রসঙ্গে)
আবুবকর সিদ্দিকের কথাসাহিত্যিক সত্তার কয়েকটি প্রবণতা :
ক. আবুবকর সিদ্দিক কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে কট্টর বস্তুবাদী, সমাজনিষ্ঠ শিল্পী। আর বামপন্থী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে জীবনকে সমীক্ষা করার একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়। জীবনের একটা প্রধান সময় তাঁর অতিবাহিত হয়েছে বাম চিন্তাদর্শের ঘনিষ্ঠ সানি্নধ্যে। সেখান থেকে যে গভীর অভিজ্ঞতা ও প্রেরণার শাঁস তুলে এনেছেন তা যেমন বাস্তববাদী, তেমনি অকৃত্রিম। মনে হয় এই কারণেই সুলভ প্রচারের ফাঁদে পা দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের যে ক'জন মুষ্টিমেয় তালিকাভুক্ত কথাসাহিত্যিক আছেন তাঁদের অন্যতম তিনি। সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় এই যে, তত্ত্ব এবং আদর্শ কখনো তাঁর শিল্পমেধার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেনি।
খ. আবুবকর সিদ্দিকের গল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের উপস্থিতি বিস্ময়করভাবে কম। বরং সমাজের নীচুতলার ব্রাত্য তথা লোকায়ত চরিত্রই তাঁকে টানে বেশি। বিশাল বাংলার ব্যাপ্ত গ্রামজীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা যেমন অত্যন্ত প্রত্যন্ত, তেমনি পটভূমির নিসর্গ ও গণমানুষ নিয়ে লেখার আগ্রহও বেশি তাঁর মধ্যে। যেন এখানেই তাঁর প্রতিভা স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পায়।
গ. উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ, বাংলাদেশের এই দুই প্রত্যন্ত এলাকার মৃত্তিকা ও মানুষ সম্বন্ধে বিপুল অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই লেখক। যার ফলে খুব সাবলীল লেখনিতে তিনি দুই প্রান্তের জীবনাচরণের তৃণমূলে চলে যেতে পারেন। একদিকে উপন্যাস 'জলরাক্ষস' ও গল্প 'নোনা মাংসের গন্ধে; 'খালখসা লাল কংকাল', অন্যদিকে উপন্যাস 'খরাদাহ' ও গল্প 'চরবিনাশকাল', 'খরার দুপুর', 'বাইচ', 'দোররা'-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঘ. আবুবকর সিদ্দিকের কবিতায় রোমান্টিক প্রেমানুভূতি একটি বড় বিষয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, এ বিষয়ের উপরে একটি দুটি ব্যতিক্রম বাদে তাঁর প্রায় সমস্ত গল্প নীরব।
ঙ. সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব সমস্যার প্রতি পূর্ণমাত্রায় অনুগত থেকেই শিল্পের দাবি ষোলআনা মিটিয়ে দেন আবুবকর সিদ্দিক। এমনকি রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে বিচিত্রসব নিরীক্ষাধর্মী গদ্যরীতির প্রবর্তন ঘটিয়ে যান তিনি। ফলে রস ব্যত্যয় নয়, বরং ভিন্নমাত্রার শিল্পসাফল্যে উত্তীর্ণ হয় উপন্যাস ও গল্পগুলো।
চ. আবুবকর সিদ্দিকের একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় খুরধার ঝধঃরৎব ব্যবহারের দিকে। বিশেষ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভ-ামীগুলোকে তুলোধুনো করার অস্ত্র হিসেবে তিনি এই ঝধঃরৎব-এর সফল ব্যবহার করেছেন।
ছোটগল্প লেখার মধ্য দিয়ে আবুবকর সিদ্দিকের কথাসাহিত্যের সূচনা হলেও প্রথম উপন্যাস 'জলরাক্ষস' তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে স্থান দিয়েছে। উপন্যাসটি সম্পর্কে শওকত ওসমান বলেছেন : 'তীক্ষ্ন সমাজসচেতন লেখক ক্ষমাহীন চাবুক হেনেছেন অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে।' 'খরাদাহ' সম্পর্কে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ঔপন্যাসিক আবুবকর সিদ্দিককে বলেন, একজন লেখক সোনার দোয়াত কলম কামনা করে। আমি কামনা করবো আপনার লোহার দোয়াত কলম হোক।' তাঁর 'একাত্তরের হৃদয়ভস্ম' এবং 'বারুদপোড়া প্রহর' উপন্যাসের বিষয়স্বাতন্ত্র্য ও শিল্পমূল্য অসামান্য।
'খরাদাহ' উপন্যাসের বিষয় দুর্ভিক্ষ ও পটভূমি খরাপোড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের জনজীবন। অন্যদিকে দক্ষিণ বাংলার বিশেষ করে খুলনা বাগেরহাটের নিম্নভূমির মানুষ ও পরিবেশ অবলম্বনে গড়ে উঠেছে 'জলরাক্ষস'- এর কাহিনী। প্রকৃতি ও জীবন বড় ক্যানভাসে শিল্পায়িত হয়েছে। বিরুদ্ধ শক্তির মোকাবেলায় প্রতিবাদী মানুষের যে চিরকালীন অনমনীয় সংগ্রাম, বাঁচার লড়াই_ এই লড়াইকেই ঔপন্যাসিক তাঁর অভিজ্ঞতার বয়ানে, প্রতীকী নিরীক্ষার ব্যবহারে ও জীবনবোধের রূপায়ণে অসামান্য করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
'চরবিনাশকাল' গল্পগ্রন্থের 'ভোগবৈরাগ্য' একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। এ গল্পের প্রধান চরিত্র অনাদি 'সময়প্রবাহ'। যে সময় আদিহীন অন্তহীন এক নিরাসক্ত গতির প্রতীক, সত্যিকার অর্থে যার নেই কোনো মোহগন্ধ ও পিছুটান। অথচ মূঢ় মানুষ তার বিধ্বংসী কোলের মধ্যে বাস করে। সংসার পাতে, গেরস্থালি সাজায় আর যা কিছু তৈজস ও দলিলপত্র তাকে জীবনসর্বস্ব জ্ঞান করে চিরকালের জন্য অাঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। মুহূর্তজীবী মায়া-মমতার শিকড় থেকে উচ্ছিন্ন হতে হতে আবার নতুন শিকড়ের সঙ্গে নিজেকে গ্রথিত করার আকর্ষণে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চলে পথ ধরে। বুঝেও বুঝতে চায় না, এপথ চিরকালই সেই অমোঘ যাত্রাপথ, যা সাংসারিক মানুষকে ফুসলিয়ে নিয়ে যায় ঘরের বাইরে। নিয়ে যায় সেই মহাপরিণামের দিকে; যেখানে সময়ের গাড়ি ও নিরাকার মৃত্যু একাকার হয়ে আছে।
মূলত গোটা গল্পটি দাঁড়িয়ে আছে একটা কূটদর্শনের ওপর। কিন্তু এর রূপকটি বর্ণনার গুণে এতো প্রত্যয়ময় হয়ে উঠেছে যে, ঘর-পথ-জটিবুড়ি-শীত-পথযাত্রার ছবি, মনে হয় নিতান্ত বাস্তব। অবশ্য লেখক এই মায়াচিত্র নিজেই নস্যাৎ করে দেন যখন এক সাদা চাদর ঢাকা রহস্য পুরুষ জটিবুড়ির সামনে এসে উদয় হয় এবং এই নষ্ট মোহের তথ্য অন্যদি সময়ের বৃত্ত সর্বব্যাপী প্রধান হয়ে ওঠে একেবারে শেষের দিকে।
নামগল্প 'চরবিনাশকাল' 'ভোগবৈরাগ্যে'র মতই বিষয় এবং ভাষায় দু'দিক থেকেই বাংলা কথাসাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বলা চলে আবুবকর সিদ্দিকের নিজস্ব ঘরানার নিরীক্ষা। একদিকে সর্বধ্বংসী সময়ের জ্যোতিহীন প্রবাহ, অন্যদিকে তারই কোলে বসে বেভুল মানুষের সংসার খেলা। বিশাল সময়ের প্রবাহের মধ্যে বসে আয়ুর মাপ। সময় বৃত্তে বাঁধা জীবনকে প্রেমের প্রসাধন কলায় ভুলিয়ে শাশ্বত করে তোলার মূঢ়তা; যার অমোঘ পরিণাম আর কিছু নয়; বৈনাশিক সময়ের বিশ্বস্ত দূত মৃত্যুর আগ্রাসনে চূড়ান্ত বিলয়। এ গল্পে চাঁদবিবি ও তার নাগর পুরুষটি মিলে ভালোবাসার খেলাঘর পাতাবার আয়োজনে উদ্যমী। কিন্তু তারা টের পায় না; মৃত্যুই করাল মাড়ির মধ্যে বসে সেই ঘর বাঁধার আয়োজন। পরিণামে দু'জনেই চিরযাত্রী হয়, চরবিনাশকাল নামক সেই সর্বগ্রাসী মৃত্যু দ্বীপের অভিমুখে। সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে লেখক মৃত্যুর রূপকধর্মী অনুসর্গগুলোকে ঢেনে এনেছেন।
উত্তরবঙ্গের সেই ঝুপসি অন্ধকার মাখা আমবাগান, রাতের নদী মহানন্দা, এপারে প্রাচীন আমলের পোড়াবাড়ি ও তার পেছনে আদি শ্যাওলা বারুণী মেলার ভেসে আসা স্বরধ্বনি; এপারে লাঠিতে ভর দেওয়া মান্ধাতা আমলের প্রাচীন বুড়ি, ভাঙা দেয়ালের খোড়ল থেকে ছিটকে আসা তক্ষক সাপের ডাকের ভৌতিক আওয়াজ, কৃতান্তের মত সর্বনাশা হ্যাঁ মেলে প্রেমিক নাগরকে কবরগুলোর আহ্বান এবং সবশেষে চরবিনাশকাল অভিমুখী নৌকার মাঝির অতিপ্রাকৃতিক চেহারা এবং হিমশীতল অট্টহাসি, তার নৌকায় শোয়ানো কাফন মোড়া সারি সারি লাশ, যাদের বেরিয়ে আসা পায়ের সেই তরল আলতা দাগানো যে আলতার শিশি চাঁদবিবিকে উপহার দেবার জন্য বারুণীর মেলা থেকে রসিক নাগর কিনে এনেছিল সন্ধ্যে রাতে, কালান্তর মৃত্যুর একটি মাত্র ফুৎকারে শূন্যে মিলিয়ে যায় প্রেমিক-প্রেমিকার বাসরঘর সাজানোর বালখিল্য অভিলাষ। বস্তুত আগ্রাসী মৃত্যুর চোয়ালে বসে ভালোবাসার ঘর বাঁধার শখ এমনি মূঢ়তায় নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য।
'কুয়ো থেকে বেরিয়ে' গল্পগ্রন্থের একটি অন্যতম গল্প 'খরার দুপুর'। গল্পটি আয়তনে ছোট, চরিত্র ও পটচিত্র যৎসামান্য। কিন্তু তারই মধ্যে মৃত্যুর আশ্চর্য প্রতিভাস। একটিই সিকোয়েন্স। বন্ধুর পালায় পড়ে যৌবন উত্তীর্ণ কমরেডের উত্তরবঙ্গের এক গ-গ্রামে আগমন। উদ্দেশ্য বন্ধুর বোন শালীমাকে বিয়ে করে বন্ধুকে অব্যাহতি দেওয়া। কিন্তু এটুকু পরিসরে লেখক সূত্রপাত লেকে গল্পের মূল অভিমুখ মৃত্যুর আবহ নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছেন; অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ সূক্ষ্ম সব রূপকের ব্যবহার ঘটিয়ে বারান্দায় বসে আছে হবু বর। তার সামনে জাজ্বল্যমান উত্তরবঙ্গের দুপুরের খরাপোড়া দাবদাহ। সত্যি বলতে গেলে, এই খরাচিত্র আসলে মৃত্যুর পরিণামের ধুয়ো হিসেবে কাজ করেছে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। অথচ উৎসবের কোনো লক্ষণ নেই। এমনকি যে বন্ধুটি কমরেডকে বর বানিয়ে এখানে এনে তুলেছে সেও লাপাত্তা। আর তার বোন শালীমা অর্থাৎ নববধূর তো সাড়াশব্দের প্রশ্নই ওঠে না। ঝাঁ ঝাঁ মৃত্যুর প্রতিনিধি আসা-যাওয়া করতে থাকে তার চোখের সামনে দিয়ে। গ্রামজুড়ে কলেরার মচ্ছব চলছে। একের পর এক কাফন মোড়া লাশবাহী টুপিধারীর শোভাযাত্রা চলছে সামনের রাস্তা দিয়ে এবং কিছু পরে আরো দূরে প্রধান সড়ক কাঁপিয়ে ধুলো উড়িয়ে শহরে ফেরার শেষ বাসটি দৌড়ে চলে যায়।
লেখক এভাবে চূড়ান্ত পরিণাম ঘনিয়ে তোলার প্রাক আয়োজন সম্পন্ন করেন। এরপর ক্লাইমেক্স এবং সেই চিত্রটিও রচিত হয় একটি আপাত জৈবিক প্রলোভনের হাতছানি দিয়ে।
বস্তুত আবুবকর সিদ্দিক 'ভোগবৈরাগ্য' ও 'চরবিনাশকাল' গল্পের মতই 'খরার দুপুর'-এ অতিপ্রাকৃত ক্যানভাসে মৃত্যুর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন অসামান্য শিল্পকৃতিতে।
মূলত আবুবকর সিদ্দিকের উপন্যাস ও অনেক গল্পে অতিপ্রাকৃত আবহ ব্যবহার হতে দেখা যায়। কখনো চিত্রকল্পে আবার কখনো বা পট সংগ্রন্থনে অতিপ্রাকৃত অনিবার্য ভূমিকা পালন করেছে। যেমন- 'সারমেয় সংঘ' (চরবিনাশকাল) গল্পটিতে অতিপ্রাকৃত অনুষঙ্গ এসেছে একটি প্রেম-কাহিনীর পূর্ণতার প্রয়োজনে। আবার 'করমচাঁদ কামার'-এ ধরনের রূপক ব্যবহৃত হয়েছে স্বৈরাচারি সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের অভ্যুত্থান দেখানোর জন্য। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে যখন নিরেট সামাজিক প্রসঙ্গেও অতিপ্রাকৃত উপাদানে যোজনা করে অনায়াসে লেখক তাঁর অভীষ্ট সাফল্যে পেঁৗছে যান। যেমনটা ঘটেছে- 'বেলুনওয়ালা', 'জালযোদ্ধা' গল্পে এবং অনেকটা 'খাদ্যমন্ত্রণালয় কতো দূরে' গল্পের শেষ ভোটারের লাশ থেকে উগরানো পঁচা বোটকা গন্ধে সে বমি করে দেয়। এরাই তার 'পিপল'।
প্রকৃতপক্ষে আবুবকর সিদ্দিকের প্রথম গল্পগ্রন্থ 'ভূমিহীন দেশ'-এ সাতটি গল্পের অন্তত পাঁচটির বিষয় বাংলাদেশের প্রচলিত ভোটপর্ব নিয়ে। ভোটাভুটির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি নির্বাচনের যে ধারাটি এদেশে চালু রয়েছে, তা যে কত অর্থহীনভাবে হাস্যকর এবং জনগণের স্বার্থ লেশবর্জিত; সেই অন্তঃসারশূন্যতা এই গল্পগুলোতে ক্ষমাহীন শেষ ও সূক্ষ্ম রূপকের মধ্যদিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমরা একটু পূর্বে অতিপ্রাকৃতের ব্যবহার নিয়ে কথা বলছিলাম। এই পর্বে 'খাদ্যমন্ত্রণালয় কতো দূর' ও 'ভূতপ্যাঁদানী' গল্প দুটিতেও অতিপ্রাকৃত চিত্র বড় হয়ে উঠেছে। নির্বাচন ও ভোট ব্যবস্থা নিয়ে এতগুলো গল্প একসঙ্গে মনে হয় আর কোনো লেখক এদেশে এখনো রচনা করেননি। 'খালখসা লাল কংকাল' গল্পের রূপক ও সূক্ষ্মভাবে শিল্পের মাত্রা মেনেই ঝধঃরৎব- কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আসলে ভোট ভিখারি নির্বাচন প্রার্থী শ্রেণীশত্রুরা জনগণ নামক অধীন নিরীহ নিম্নবর্গের ভোটারদের শরীর থেকে রক্ত-মাংস-চামড়া নিয়ে কংকাল বানিয়ে ছেড়ে দেয়।
'ছায়াপ্রধান অঘ্রাণ' গল্পগ্রন্থের 'নোনা মাংসের গন্ধে'-এ দক্ষিণবঙ্গের বস্তুনিষ্ঠ রূপায়ণ আবুবকর সিদ্দিককে বাংলা কথাসাহিত্যে বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এ গল্পে সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দরবনের পটভূমি অনুসৃত হয়েছে। গল্পটির কাহিনীর খোসা ভেঙে রূপকটি বেরিয়ে এসেছে একেবারে গল্পের শেষ প্রান্তে পেঁৗছিয়ে। গল্পটি আগাগোড়া গড়িয়ে চলেছে সুন্দরবনের পটভূমিতে একটি মদ ও হরিণের মাংসজীবী অপরাধী পুরুষের আদিম নোনা স্বৈরিণী মেয়ে মানুষের পালায় পড়া কর্মচারী ওবেদুরের মুক্তিপথ খুঁজে মরার তাড়নার দিকে। বাদাবনের রহস্যময় জটিলতায় বিভ্রান্ত ওবেদুর শেষের দিকে সম্পূর্ণ নাচার হয়ে পড়ে তীক্ষ্নধার গুলের আঘাতে মেয়েটির খুন হয়ে যাওয়াতে। বস্তুত এই দুর্ঘটনার নিয়ামক ওবেদুরের অদৃষ্ট থেকে বাস্তবজগতের যা কিছু জীবন লক্ষণ সব নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অতঃপর জীবনের খোলসে যা কিছু এগিয়ে আসে তার প্রত্যক্ষ নজরে, সবই আসলে সেই নিরাকার মৃত্যুর আকারময় রূপাবয়ব। এখানে সে আবির্ভূত হয়েছে বাদাবনের সম্রাট বাঘের রূপকে। কিন্তু অচিরেই আমরা জেনে যাই, তার মহিমাময় জ্যোতির ছটা; দিগন্তচরাচর ঢাকা মহান অবয়ব আর পৃথিবী-বিদারক রাজকীয় গর্জনধ্বনি। আর তার পশ্চাৎ ভূমিতে সাগর ও আকাশের ক্লাসিক পটভূমি এবং সবকিছুকে আচ্ছন্ন করা জ্যোতিময় সূর্য; এই অসাধারণ চিত্রকল্প যা বাংলা কথাসাহিত্যে সম্পূর্ণ একক, এত আলাদা আর কিছু নয়।
বিশাল মৃত্যুর পটভূমিতে বন্দি সামান্য মানুষের নিয়তিচিত্র এবং অসহায় মানুষ তার এই অবধারিত মহাপরিণামের পূর্বাভাস তার জীবনের সূচনালগ্নেই আভাসে অবচেতনে প্রত্যক্ষ করে, তার ইঙ্গিত ছেলেবেলা থেকে ওবেদুরের ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্নে কালো বেড়ালের উপর্যুপরি হানার মধ্যদিয়ে ব্যক্ত হয়েছে। প্রতিবারের স্বপ্নে সেই একই ভয়াবহ প্রতীক; শিয়রে বসে সেই কালো বেড়াল ওবেদুরের মাথা চিবিয়ে খায় এবং সেই চিবানোর কচরমচর আওয়াজ তার কানের মধ্যে এসে আঘাত করে। বাস্তবিক 'নোনা মাংসের গন্ধে'র বিষয় ও ভাষাভঙ্গি বাংলা কলাসাহিত্যে অদ্যাবধি দ্বিতীয় রহিত।
নিরীক্ষাধর্মী গদ্যরীতি
আবুবকর সিদ্দিক রাজনীতিক বা সামাজিক বিষয় নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী গদ্যরীতি প্রবর্তন করেছেন। তাঁর ভাষায় : এক-একজনের লেখায় এক-এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য কাজ করে। সেটাই শৈলী। স্বাতন্ত্র্য তো মানুষের স্বভাবধর্ম। চলনেবলনে পোশাকেআশাকে পেশায়নেশায় ভিন্ন রক্ষচির্হি লোকাঃ। বিশেষত 'ছায়াপ্রধান অঘ্রাণ'-এর নাম গল্প 'ছায়াপ্রধান অঘ্রাণ', দোর্রা ও 'বাইচ' নিরীক্ষাধর্মী গদ্যের অনন্য দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধ বনাম নকশালপন্থী বাম রাজনীতির টানাপড়েন অঘ্রাণের চিত্রকল্পে তুলে ধরা হয়েছে নামগল্পে। চারু মজুমদারের ডাকে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আন্দোলনে তাদের শেষ পরিণতি ছিল হতাশার, ব্যর্থতার, মর্মান্তিক বেদনার। আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নভঙ্গের সেই কাহিনীকে ছায়াময় অঘ্রাণের প্রতীকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্যে আবুবকর সিদ্দিক স্বতন্ত্র চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর উপন্যাস ও গল্পের বিষয়, ভাষাভঙ্গি ও অন্তর্বুনন বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য নিদর্শন। বিষয়ের গভীরতার সঙ্গে বর্ণনার ভাষায় প্রতীক, চিত্রকল্পের দক্ষ ব্যবহার তাঁর গল্পে আরো একটি শিল্পকুশলতার উদাহরণ। বস্তুত মানবজীবনের নিম্নবর্গের নানান সঙ্কট, ক্ষয়, পতন, প্রেম, অস্তিত্বের সারাৎসার ও উত্তরণের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন আবুবকর সিদ্দিক তাঁর গল্পসমূহে।
বস্তুত তৃণমূল সংলগ্ন বলেই গ্রামীণ জীবন প্রাধান্য পেয়েছে আবুবকর সিদ্দিকের কথাসাহিত্যে। রাজনীতি, প্রগতি আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর সাহিত্যসৃজনকে করেছে অনিবার্যভাবে প্রাণিত। এসব ক্ষেত্রে শৌখিন দৃষ্টি নয় মানুষ ও মানুষের শ্রেণীগত অবস্থান নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। হয়েছেন বাস্তব ও প্রতীকআশ্রয়ী। গদ্যশৈলীতে এনেছেন বৈচিত্র্য। অত্যাধুনিক নিরীক্ষাধর্মী গদ্যশৈলী তাঁর। রূপক-প্রতীকের ব্যবহার কারুকার্যম-িত। গ্রামজীবনের মূল দ্বন্দ্বগুলোকে তিনি শনাক্ত করেছেন।
কখনও একই ধরনের একঘেয়ে কাঠামোর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। বারবার বিষয় ও পটভূমি পরিবর্তন করেছেন। উপকণ্ঠ ও প্রান্তিক জীবনযাপনকারী মানুষ তাঁর কথাসাহিত্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন ও উত্তরবঙ্গের সীমান্তভূমি এই বিশাল পশ্চাৎভূমিতে তাঁর বিচরণ। বাংলাদেশের খুব কম কথাসাহিত্যিক এ ধরনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জন করে সেই অভিজ্ঞতাকে শিল্প সার্থক করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এই কম সংখ্যকের একজন হলেন আবুবকর সিদ্দিক। কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিককে অভিহিত করা যায় 'লেখকের লেখক' হিসেবে।- See more at: http://jjdin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=18-08-2012&feature=yes&type=single&pub_no=217&cat_id=3&menu_id=75&news_type_id=1&index=4#sthash.FLCuB5cD.dpuf
0 মন্তব্যসমূহ