নিজের সেরা গল্প নিয়ে গল্পকার আহমেদ খান হীরকের কথা : ইনসমনিয়া’

প্রশ্ন এসেছে ‘ইনসমনিয়া’ আমার সেরা গল্প কিনা। তবে সেরা বিষয়টা নিয়ে আমি দ্বন্দ্বকাতর থাকি, তাই আমার লেখা কোন গল্পটি সেরা হয়েছে, নিজের জন্য তা বলা মুস্কিল। তবে, ‘ইনসমনিয়া’ গল্পটি লিখে আমি তৃপ্ত হয়েছিলাম। লেখার পরপরই গল্পটি আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিল, এইটুকু বলতে পারি। ‘ইনসমনিয়া’ এখনো আমার প্রিয় একটা গল্প- আমি চাই গল্পটি অনেকে পড়ুক।

‘ইনসমনিয়া’ লেখার আগের কয়েকটা দিন, বোধহয় সপ্তাহখানেক আমি অন্য কাজে ঠিক মন দিতে পারছিলাম না। অন্য কাজ মানে হয়তো লেখারই কাজ, কিংবা অন্য যেকোনো সাধারণ কাজ। হয়তো বাসে করে ফিরছি বা কোথাও বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি, বেশ চা-সিগারেট চলছে, পরচর্চা চলছে, কিন্তু চা-সিগারেট-পরচর্চায় যে আনন্দ সেটা পাচ্ছি না; এখন শুনতে বেশ উদ্ভট লাগছে হয়তো, বা যারা এরমধ্যে দিয়ে যায় নি তাদের কাছে একেবারেই হাস্যকর শোনাচ্ছে নিশ্চয় যে একটা লেখার আগে মানুষের এরকম হয়।

তা হয় তো নিশ্চয়ই, মানে আমার তো হয়েছে। আমার ভেতর এক ধরনের তাড়না, এবং তাড়নার চেয়েও বেশি, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এক অস্বস্তি, অনুভব করতে থাকি। আমি বুঝতে পারি আমি এক ধরনের দুর্বিপাকে পড়তে যাচ্ছি যে ওই লেখাটা না আসা অবধি এই অস্বস্তি চলতে থাকবে। আমি ক্রমাগত সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হতেই থাকবো। ফলে, এই বিচ্ছিন্নতা থেকে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদেই, আমি লিখতে বসি গল্পটা।

যখন লিখতে বসি তখন আমি জানি শুধু একটা চরিত্রকে। যে শহরে এসেছে গ্রাম থেকে, হয়তো প্রতীষ্ঠা পেয়েছে কিছুটা, কিন্তু গ্রামের সাথে যে-সম্পর্ক তা ঠিক ছিন্ন করতে পারে নি। ব্যস, এতটুকুই আমার জানা ছিল। চরিত্রটা আমার জানা ছিল। গল্পটা একদম না। আমি জানতাম না গল্পটা কী। আমি শুধু ওই চরিত্রটাকে জানছিলাম সপ্তাহখানেক জুড়ে। বা এমন হতে পারে চরিত্রটা আমার মধ্যেই ছিল, ওই এক সপ্তাহে সেটা আমার ভিতরে কোনো কারণে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। আমি শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার ওই চরিত্রটা, বৃষ্টিসৃষ্ট কাদামাটির ঢলে ভেসে যাচ্ছে। এবং ভেসে যেতে তার খুব আনন্দ হচ্ছে এই ভেবে যে এই ঢল তাকে নিয়ে যাবে তার গ্রামে। আমি শুধু এতটুকু জানতাম।

গল্পের কাহিনী কাঠামো প্লট ইত্যাদি বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই অল্প, জানি না বললেই চলে। বালির নিচের জলস্তর যেভাবে বুদ্বুদের সৃষ্টি করে ওপরে, গল্পও ঠিক সেভাবেই বুদ্বুদ তৈরি করে আমার ভেতর। আমি বড় জোর বুদ্বুদটা হস্তান্তর করি- হস্তান্তর করি নিজের ভেতর থেকে প্রথমে নিজের জন্যই, নিজের সামনে; তারপর হয়তো পাঠকের উদ্দেশ্যে। ‘ইনসমনিয়া’ নিয়ে শুধু এতটুকু নিশ্চিত ছিলাম যে গল্পটা আমি ‘তুমি’তে বলব। কেন ভেবেছিলাম এমন? হতে পারে আমার প্রথম লাইনটা ততক্ষণে চলে এসেছিল। আমার ভেতরে তখন শুধু গুঞ্জরিত হচ্ছিল- তাহলে এটাই তোমার নিয়তি ছিল?

ব্যস, গল্পটার নিয়তি ঠিক হয়ে গিয়েছিল- এখন অন্তত তাই মনে হয়। আর তখন মনে হচ্ছিল, এর বাইরে লেখা আমার সম্ভব না। আর খুব চাপ যাচ্ছিল। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলাম। ওই ঘোর ছিল চরিত্রটার সঙ্গে থাকার; কিন্তু আমি তার সাথে বেশিক্ষণ থাকতেও চাচ্ছিলাম না- যেহেতু থাকলে বাস্তবের সাথে খুব সংঘাত বাড়ে। আমি তাই ঘোর থেকে, জীবনের বাস্তব আর গল্পের বাস্তবের মধ্যে যে মিশেল তা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি লিখতে শুরু করি। আমার মনে হয়, একটি সিটিঙেই আমি লেখাটা শেষ করি। তারপর একটা সিগারেট খাই। হাঁফ ছাড়ি। মনে মনে বলি বেঁচে গেলাম। তারপর, তার বেশ কয়েকদিন পর, আবার গল্পটি নিয়ে বসি। বসি এ কারণেই যে নিজেই দেখতে চাই যা ভেবেছিলাম তা লিখেছি কিনা আদতে। এবং দ্বিতীয় সিটিঙে খুব অল্পই কিছু কারেকশন করি। মনে হয় যা লিখতে চেয়েছি তার কিছুটা পেরেছি। ফলে তৃপ্তি তৈরি হয়, আর গল্পটা প্রিয় হয়ে ওঠে। যে-চরিত্র আমি দেখাতে চেয়েছি, যে-কথাটা আমি বলতে চেয়েছি; আমার মনে হয়, পাঠকের নির্লিপ্ত জায়গা থেকেও, তা শোনা যায় বোঝা যায়। ফলে প্রিয় ব্যাপারটা দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে।

চরিত্রের গুরুত্বের বিষয়ে বলতে গেলে, আগেই বলেছি, আমি শুধু একটা চরিত্রকেই জানতাম। তার নাম কী তা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, তবু বোধহয় তার নাম একবার উচ্চারিত হয় গল্পে। তবে আমি আরেকটা চরিত্র ‘দস্তিগার’কে চিনতাম না প্রথমে। কিন্তু যে-ই মাত্র ‘দস্তিগার’ এলো, সাথে সাথেই চরিত্রটি আমার আলাদা নজর পেয়ে গেল। ‘দস্তিগার’কে আমার ভালো লেগে যায়- তার মধ্যে কী যেন একটা বিষয় গাঢ় হয়ে ওঠে। ‘দস্তিগার’ সেই সব চরিত্রগুলোর একটি যে চরিত্রগুলো আমাদের ভেতরেই আছে, কিন্তু আমরা ভান করি চরিত্রগুলো নেই। দিনের পর দিন ‘দস্তিগার’দের আমরা উপেক্ষা করে আসছি। ফলে, দস্তিগার এলেই একটা অদ্ভুত অবস্থা তৈরি হয় গল্পের ভেতর; অন্তত আমার ভেতর। আর দস্তিগারকে ডিল করাও, লেখক হিশেবে, আমার জন্য খুব কঠিন ছিলো- এইটুকুই শুধু বলতে পারি। অন্যান্য যে চরিত্র দুয়েকটা, সেগুলো আমার প্রধান চরিত্রের অবস্থার প্রেক্ষিতেই, গল্পটা জানানোর প্রয়োজনেই এসেছে। তাদের দিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছি বলে মনে হয় না। কেবল দস্তিগারের বউ শেষের দিকে হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন তখন আমি আতঙ্কবোধ করেছিলাম এই ভেবে যে বোধহয় আমি যা বলতে চাচ্ছি এই মেয়েটার কারণে তা আর বলা হবে না।

তবে সুখের বিষয়, তেমন হয় নি। আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তার বেশ খানিকটা বলতে বোধহয় পেরেছিলাম ‘ইনসমনিয়া’য়।

কিন্তু কী বলতে চেয়েছিলাম আমি?

শুধুই কি একটি চরিত্রের কথা বলতে চেয়েছি গল্পটি জুড়ে?

আমার মনে হয় আরো কিছু বলতে পেরেছি আমি, বা আরো কিছু বলার চেষ্টা করেছি। আমি ঠিক সুখপাঠ্য গল্প লিখি নি বোধহয়। কেননা, পড়ার পর, অনেককেই অসন্তুষ্ট হতে দেখেছি। বা অসন্তুষ্ট না হলেও কষ্ট পেতে দেখেছি। তাদের হয়তো ধারণা ছিলো গল্প এমন হতে পারে না। তাদের ধারণা ছিলো গল্প বেশ গল্পের মতো হবে। ‘ইনসমনিয়া’ তাদের ধারণা ভেঙে দিয়েছে বলেই মনে হয়; ফলে, তারা কষ্ট পেয়েছে। তবে কয়েকজন প্রশংসাও করেছে। কী বলে প্রশংসা করেছে সে বিষয়ে না বলাটাই ভালো। প্রশংসা উহ্য থাকুক। বরং পাঠক পড়েই জানাক তাদের কেমন লাগলো। আদতেই গল্পের ভেতর তারা কিছু পেল কিনা!


লেখা শেষ, লিখে পাঠকের কাছে পৌঁছানোও শেষ। আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে, এবার দায়িত্ব পাঠকের।



লেখক পরিচিতি

আহমেদ খান হীরক
জন্মসাল- ১৯৮১
জন্মস্থান- রহনপুর, রাজশাহী, বাংলাদেশ।
বর্তমান আবাসস্থল-ঢাকা, বাংলাদেশ।
পেশা- লেখক, টুন বাংলা এ্যানিমেশন স্টুড...
প্রকাশিত লেখা- উত্তরাধিকার, নতুন ধারা ইত্যাদিসহ বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা।
প্রকাশিত গ্রন্থ- কাব্যগ্রন্থ- আত্মহননের পূর্বপাঠ।
ইমেইল- hirok_khan@yahoo.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ