কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের গল্প : স্বপ্ন-উদ্যান

একদা ক্রমাগত আমরা একে অন্যের স্বপ্নের জগতে ভ্রমণ করতে থাকি এবং সকলে মিলে শেষ পর্যন্ত একটা কাজই করি, তা হচ্ছে, একের স্বপ্নের সাথে অন্যের স্বপ্নকে জোড়াতালি দিয়ে একটা উদ্যান নির্মাণ করে ফেলতে থাকি,-- স্বপ্নের ভিতর দিয়ে আয় করা এ উদ্যান, যাকে আমরা আপাতত স্বপ্ন-উদ্যানই বলতে চাইছি। এ নিয়ে একপর্যায়ে আমরা বেকুবের মতো আচরণও করি,-- কারণ, একে অন্যের স্বপ্নের ভিতর দৌড়াদৌড়ি করতে-করতে আমরা পরস্পরের নামই ভুলে যেতে থাকি, আমাদের আবাসের চিহ্ন মনে করতে পারি না, আমাদের দেহ আমাদেরই ভালোবাসায় স্বপ্নময় হতে থাকে!
সেইটুকু সৌন্দর্য আমরা সৃজন করতে পারি, যেখানে এক-এক জনের নাম বিষযটার কোনো প্রয়োজন নাই। এ নিয়ে মানুষের ঠাট্টা-মশকরাকে আমরা এক পয়সার দাম দিই না; বরং আমরা এমন একটা ঘরের কথা বলি, যা হবে দেয়ালহীন, আমাদের চলাচলের জায়গা হবে হাশরের মাঠের মতোই একান্ত বিস্তৃত। আমরা আগের ভাষা ভুলে যাই (তা তো যাবই,-- দেশভাগ আর শহীদের রক্ত মানুষের চরিত্রে দাগ রাখে নাই?), যে ভাষায় আমরা কথা সৃজন করি, তাতে মাটি-জল-নদীর নিজস্ব গন্ধ থাকে। এ বাতাসের ভিতর হাস্যকোলাহল শুধু থাকে না, বিলাপের মিশ্রণও কখনও-কখনও টের পাই। এইসব মিলে যে গল্পটা তৈরি হয়, আমরা অতঃপর সেই গল্পের পিছনে দৌড়াই। গল্পবিনে আমাদের সময় পার হয় না। তবে সেই গল্পের রিয়েল ক্যারেক্টার পাওয়া মুশকিলই। কারণ আমরা এর কোনো আকার-প্রকার পাই না,-- মনে হয়, তা যেন ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, যা কেবলই স্বপ্নে পাওয়া এক উদ্যানের গল্প। সেই গল্পই আমরা ভুলেও যাচ্ছি! নতুবা আমরা একই গল্প নানা জনে নানাভাবে বার-বার কেন বলি! আমরা তা ভুলেই-বা যাই কেন? তবে একটা সময় পরে আমাদের বন্ধুসকল এই একখান গল্পেই মনোযোগ নিয়ে আছে মনে হলো। আমার বন্ধুদের, এমনকি নিজেকে নিয়েও এই এক মজা, আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের স্বপ্নসৌন্দর্যের ভিতর আনন্দ নিতে জানি। আমরা অবাক হতে জানি, কারণ অবাক হওয়ার মতো সমূহ উপাদান এখানে আছে। তবে একটা বিষয় ক্লিয়ার হয়ে গেছে, উদ্যানটি নিয়ে কথা বলার ভিতর নানা রকমের ধাঁধাও তৈরি হচ্ছে; এবং, এ নিয়ে মানুষ অনেক কথা বলছে, মানে গপসপ করতে চাইছে। এও কম মজা নয়, মানুষের ভিতরকার অনেক বিবেচনা, অনেক কথা, এইভাবে গপসপ আকারে পার হয়ে সমাজের ভিতর তা চলাচল করে। মানুষ এক আজব জীব! এইসব গবেষণা যদি অন্যের ভাবনা বা হিসাবের উপর দিয়ে যায়, তাহলে তাতে তার আরাম নষ্ট হয় না, সেই বান্দা তখন ঘটনা দিয়ে ঘটনাকে প্যাঁচায়। একই কায়দাই হয়ত তারা আমাদের গল্পের তদন্তে নামে। আমার বন্ধুসকল এ গল্প সত্যি কিনা তা জানার বাসনাই সিআইডি পুলিশের মতো আমায় জেরা করে। বন্ধুদের একজন তো এ-কাজকে অনেক বেহুদা কিছু মনে করে, এবং গল্পটি আবারও শেষ করতে হলে যে আলাদা এক নেশার দরকার, তা জানায়।

স্বপ্ন-উদ্যানটি শহরের কোন্ দিকে তা আমরা বলতে পারি না। এর একচুয়েল বর্ণনাও আমি দিতে পারছিলাম না। হয়ত এটি শহরের একেবারে শুরুতেই আছে, শহরের শেষ প্রান্তে থাকার কথাও কেউ কেউ বলে; কেউ বলে, এটি শহরের একেবারে কেন্দ্রেই আছে। নাকি আসলে তা নাইই! স্বপ্নের ভিতরে চলাচল করা জিনিস কত ভাবের ভিতর যে চলে! আমার এ ভাবের কথা নিয়ে বন্ধুরা হাসে, আমি ভ্যাবাচেকা খেলে বন্ধুরা তা নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করে। তাদের হাসিকে ফলো করতে-করতে আমি উদ্যান বিষয়ে দুনিয়াটা চক্কর দিয়ে ফেলি। এটি নেশার ভিতরের একটা কারবার মাত্র, জ্ঞানীমহলে এইসব নিয়ে হয়ত জ্ঞানের কথাই বলছি! আমাদের স্বপ্ন কি জ্ঞানীদের স্বপ্নের ভিতর চালান করে দিয়ে স্বপ্নের বেসাতি করছি?

আমরা অবশেষে একটা শহরের ভিতকার এক সত্যিকার উদ্যানের কথা বলব। আমরা এমনই সৌভাগ্যতাড়িত যে, আমরা যেন কোনো কথা নিজেদের ভিতর চালাচালি না-করে থাকতে পারি না। কথার উপরে সত্য নাই। প্রিয়া, পান্না, মেহবুবা, জুঁই বা মনোরমা কিংবা অন্য নামের অনেকেই এ গল্পে যুক্ত হয়। ওগো প্রিয় রমণী, সহজিয়া জীবনের চিহ্ন, নিজ দেহকে দেহের অধিক সৌন্দর্যে বাঁচতে দাও,-- আমরা হয়ত এইভাবেও ভাবি। এইভাবে তারা কোনো না কোনোভাবে স্মৃতির ভিতর দিয়ে এ-গল্পের সাথে জড়িয়েও গেছে। সৌন্দর্য খরচের সেই উদ্যানই তাদের আলোচনার ভিতর থাকে। আমরা এ-সংক্রান্ত আইনের বিষয়টি স্মরণ করি। আইনের বাইরে তো জগৎ নাই। এ জগৎ আইনময়। এই কথা বলাতে আইনের সাথে জড়িয়ে রাখা মোসাম্মৎ মায়াচান বেগম ক্ষুব্ধ হয়ে কয়, ‘আইন কিছু না, এইডা হইলো গিয়া নিজেরে গুছাইয়া রাখার একখান ফক্করবাজি। নিজের চিন্তা-মিন্তারে হুঁশদিশ রাইখা কাজ করলে আইনেরে নিয়া অত চিন্তা কী-আর করা লাগে?’ তবু আমি বলি, ‘এইটা এমন এক জিনিস যারে মায়ের পেট থাইকা একেবারে বাইন্ধা নিয়া জগতে আইতে হয়। এক সেকেন্ডের জইন্য তারে ভোলার কোনো ব্যবস্থা এই দুনিয়াই নাই। মানুষ আইনকে আইনের মতো সাজাইয়া নিয়া তার সৌন্দর্যের ভিতর নিজেরে রাখতে চায়। পুলিশও কি আর আইনের উর্দ্ধে নাকি!’ তাই শুইনা মইদর মিয়া বকবকাইয়া হাসে, সে কয়, ‘পুলিশের একখান মাইর খাইলে কই যাইবো অত নাগরামি। পুলিশের দেশে পুলিশেরে নিয়া অত কথা। ভাইজান, এইসব গপসপের জইন্যো পুলিশের পারমিশন নিছেন? হিহিহি...’

এই শহরে একজন নগরপিতা আছেন। এখানে আজব কিছু নিয়মও আছে-- পুলিশের লাঠিচার্জ, পোলাপানের হাউকাউ, জিনিসপত্রের দামের কোনো ঠিক-ঠিকানা না-থাকলেও, কাইজা-ফ্যাসাদ আর লোড-শেডিং সময় মেনেই আসে। স্বপ্ন দিয়ে স্বপ্নকে মোকাবেলা করার কায়দা তিনি জানেন। কথাও তিনি অনেক বলেন,-- অত কথার কী থাকতে পারে, তা আমরা অনেক গবেষণা করেও পাই না। যেখানে আনন্দবিহীন কিছুই থাকার কথা না, সেখানে তাকে নিয়ে অত কথা কেন চলে? নগরপিতা কি আনন্দের বাইরের কেউ? এইসব গপসপের ভিতর বিবেচনা না-থাকলে কী আর চলে। আমরা নগরপিতাকে নিয়ে ভাবি,-- আচ্ছা, এইসব আনন্দের সাথে নগরপিতার অত শত্র“তামি কেন? তিনি আমাদেরকে নিষিদ্ধ করার মতো ধমকও দেন, এমনকি দপ্তরবিহীন করার একটা বাসনা হয়ত তার আছে। নতুবা স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন দিয়ে গড়া একটা উদ্যানকে নিয়ে তার অত মাথাব্যথা কেন! এই নগরের ভিতর যত বিপত্তি তার গোড়াপত্তনই নাকি এই স্বপ্ন-উদ্যান থেকে শুরু! তিনি যুক্তি দেখান, বুঝান, আমরা যেইভাবে জীবন ভাগাভাগি করতে আছি, একজন আরেকজনের বিপদে সব দেখা শুরু করছি, সেখানে নাকি আমাদের তরফ থেকেই সব ঝামেলার শুরু? আমাদের কাজের নাকি কোনো সিস্টেম নাই, আদব-কায়দা নাই, এমনকি আমাদের ভিতর কোনো ধরনের মায়া-মহব্বতও নাই। এর বড়ো কারণ হচ্ছে, আমরা যা বুঝি, তা আমরা নিজেরাই বুঝি; অন্যের বুঝের সাথে আমাদের কোনো শলা-পরামর্শ নাই। সেই উদ্যানের যে সিস্টেম, তাই নগরপিতাকে যেন রীতিমতো পর্যুদস্ত করে ফেলে। তিনি তার কথা জানাতে জানাতে উদ্যানের কাছে আসেন; তার দলবল নিয়ে স্বপ্ন-উদ্যানের মেইনগেইট নিয়ে অনেক গবেষণা করেন। কিন্তু তিনি এর ভিতরে ঢুকতে পারেন না! তিনি বলতে থাকেন, আপনারা গেইটে যেই সিস্টেম চালু রেখেছেন তার কী মানে থাকতে পারে! এটা সত্য যে সেই উদ্যানে প্রবেশ করতেই আমরা তিন-তিনটা গেইটের ব্যবস্থা রেখেছি। সেই গেইটগুলির আছে আজগুবি ক্ষমতা,-- নিজের নাম, বংশ পরিচয়, এমনকি জীবনের হিস্টরি জমা রেখে তবে এর ভিতরে ঢুকতে হয়। আমরা আকারে প্রকারে জানাই যে, এই হচ্ছে এই জমানার পিরালি-ভাব! নগরপিতা তার বাপের বাপের, এমনকি তার চৌদ্দ-সিঁড়ি উপরের কোনো মানুষ এমন কথা শুনে নাই। নগরপিতার সাথের লোকগুলি গেইটের পর গেইট ভেঙে-গুড়িয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, কোত্থেকে কী সব গায়েবি বার্তা আসতে থাকে,-- ‘ শুনুন জনাব, আপনি আপনার, নাম, বংশ-পরিচয় আর বাইরের জগতের সমুদয় হিসাব গেইটে জমা দিয়ে ভিতরে আসুন প্লিজ!’ তারা অতঃপর চলে যায়, অথবা কোথাও হয়ত থাকে। তবে এইটুকু জানা যায়, তাদের মনষ্কামনা পূরণ হয় না। নগরপিতার পরই অনেক দূর থেকে একজন আসেন, তিনি পাহাড়ি-হুজুর। তিনিও এইসব দেখে পরান খুলে হাসেন। এইসব বুজরুকির যে কোনো মানে নাই, তাই তিনি অক্ষরে অক্ষরে বোঝাতেও থাকেন।

কত রং, কত আকার, কত শরৎ-বর্ষা এর উপর দিয়ে যায়। আকারে প্রকারে চেহারায় কতভাবে তা বদলায়, পুষ্প তার সৌগন্ধ দিয়ে অষ্টপ্রহর একে ভরিয়ে দিতে থাকে। স্বাধীনতার এতগুলি বছর পর মুক্তির সেই যুদ্ধের তেজে এখনও তা রক্তাক্ত হয়। কিন্তু তা কখনও কখনও নানান মায়াজালে থাকে, একে দেখাও যায় না। তবু তার প্রাণ রাঙিয়ে চলে। হাওয়ার উপর দিয়ে এর অস্তিত্ব বয়ে যায় নাকি? তবু আমাদের বিভ্রান্তি মুছে যায় না! এই উদ্যানের কোনো ঠিকানা আছে কিনা, তাও কেউ বলতে পারে না। এইসব না-থাকার ভিতর আবার কি ঝামেলা শুরু হলো, তা তো বলা মুশকিলই! আমরা তো মানুষের কথার জবাব না দিয়ে পারি না। যেমন, এই উদ্যানের বাউন্ডারি তো আর অষ্টপ্রহর অদৃশ্য রাখলে চলে না। না-দেখার ভিতরও তো একটা জিন্দেগি লাগে। জীবনে দেখার একটা সিস্টেম রাখতে হয়। কেউ এর ভিতরে আসবে, কিভাবে আসবে তা হিসাবের ভিতর রাখতে গেলেও তো মানুষের দরকার হয়। মানব বিনে হিসাব-কিতাব কি করে হবে? তাই তো জান-গতরের শ্রমও লাগে। সেই শ্রমের আবার হিসাব লাগে। মানুষ তো শেষ পর্যন্ত মানুষ হয়েই বাঁচবে, পরি বা দেবতা হয়ে তো বাঁচবে না! তাই তো কোনো এক কর্মজীবীর সাথে এইসব নিয়ে আমি বাতচিত করতেই সে বলে, ভাইজান, শইল্যের উফ্রে সত্য নাই। জগতের যাবতীয় কাম-কাজ শইল্যের উপর দিয়াই চলাচল করে। ব্রেইন যে ব্রেইন, তারেও পজিশনে রাখতে গেলে, বাঁচাইয়া রাখতে গেলে, শইল্যের কাম লাগে। শইল্যের উফ্রে কেরামতি নাই। শইল নাই ত জীবন নাই। এই যে মানুষ একে একে মানুষ হয়ে ওঠে, এমনকি মানুষ যে জন্ম নেয়, তারও তো একটা সিস্টেম আছে। ঘাম জড়ানির একটা ব্যাপার আছে। মানুষের শইল্যে যে আসল ঘাম আছে, মানুষ জন্মানির ঘাম, তারে বাদ দিয়া তো ভাইজান আফ্নে কিছুই করবার পারবেন না। যত কিছু কইন, নাম মুইছা দেইন, চাবি মিশমার করেন, বেতাল ফুর্তি-আমুদ করেন, কিন্তুক ঘাম-জড়ানির জীবনের বাইরে জীবন নাই।

স্বপ্নের বাইরে জীবন নাই,-- কারণ এতে জীবনের কিছু ছায়া, কিছু মায়া আছে, বাস্তব কিছু চলাচল আছে। আমরা তা নিয়েই থাকি কিংবা হতচকিত হই। আমাদের মন স্বপ্ন-উদ্যানকে ঘিরে পড়ে আছে। আমরা ধরে নিই, এটি এই নগরের প্রাণেই আছে। কিন্তু নগরপিতা কোনো একসময় আবারও বলতে থাকেন, ‘পাহাড়-সাগর শুধু নয়, রাজধানী-শহরের সাথে আমাদের কত মধুর মাখামাখি। আর কোত্থেকে কোন্ এক স্বপ্ন-উদ্যানের কথা দিয়ে পোলাপানগুলি কত রংবাজি শুরু করেছে।’ তার হয়ত তো ইচ্ছা করছে, এক ফুঁয়ে এখনই সব উড়িয়ে দিতে। অতঃপর নগরপিতা, এবং নগরের আরও কিছু লোক, কী যেন কী করে, সেই উদ্যানের প্রকৃতির খোঁজে নামে হয়ত। এবং তা পাওয়া সম্ভব হয় কিনা তা আমরা জানতেও পারি না।

২০.০৮.২০১৩



লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর 

গল্পকার। ঔপন্যাসিক। প্রবন্ধকার।
লিটিল ম্যাগাজিন কথা'র সম্পাদক।
পেশায় চিকিৎসক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ