বইপাঠ : সুদেষ্ণা মজুমদার--শামীম আজাদের গল্পগ্রন্থ প্রিয়ংবদা

প্রিয়ংবদা, কল্পনা ও আমি


দেশ।
অদ্ভুত একটা শব্দ।
দেশের নিয়মে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি ভোর ৪টা।
আর দেশের ঘড়িতে তখন কয়টা?
বলতে পারব না।

নারকেলের পাতার ঝিরিঝিরি আলো আমার চোখে বাতাস বুলিয়ে যায়।
সেই ছায়া দিয়ে আমি ভাত মাখতে বসি।
দাওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে শুকনো পাতার ঝড়। সেই ঝড় সরিয়ে আমার সপ্তডিঙা ভাসাই।
বিলেতের ঘাটায় রশি বাঁধি। তিরতির করে কাঁপতে থাকে আমার ডিঙা।


কলকাতার আলপথের হাত ধরে হাঁটতে থাকি প্রিয়ংবদার সঙ্গে। চুপচাপ কিছুক্ষণ হাঁটার পরও কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। আমার চুপ থাকা বোধহয় প্রিয়ংবদার সহ্য হল না। সে আমাকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কোনো কথা বলছ না যে? অনেকটা পথ তো হাঁটা হল।’ আমি হাঁটা থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি ডেরেককে বাঁচতে দিলে না কেন?’ হাসল প্রিয়ংবদা। বলল, ‘আমি কে? ডেরেক বাঁচতে চায়নি... ওর তো বাঁচার কথাও ছিল না।’ আমাকে ছাড়িয়ে দু পা এগিয়ে গেল সে। আমি এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত ছুঁইয়ে ডাক দিয়ে বলি, ‘আর কেনই বা তাকে ছুঁতে দিলে না?’ ‘কী ছুঁতে দিলাম না?’

আমি গুনগুন করে পড়তে থাকি ৭৯ নম্বর পৃষ্ঠায়, ‘একা একটি গোলাপ’ থেকে—

‘...বাড়ির কাছের আলদি নামের দোকান থেকে কিনে নিই একটি লাল গোলাপ। এ দেশে এমন একটি গোলাপ ভ্যালেন্টাইন ডে ছাড়া অন্যদিন দিলেও একই অর্থ বহন করে। হালকা রাস্ট কালারের শিফন শাড়ি হাতে ভ্যালেন্স রোডের আড়ং এর রূপোর বালা। ওপরে বেবি ব্লু হাঁটু সমান লম্বা ওভারকোট। পেছনে ছাড়া লম্বা সেই বিদেশী রেশম মার্কা চুল। যে চুলে কবিতা হয়েছিল বাংলায়। যে চুলের দিকে মুগ্ধভাবে চেয়ে ডেরেক অনুমতি চেয়েছিল ছোঁয়ার।

‘সেদিনই যেদিন শপিং মলের বুকশপে কফি খেয়ে দুজনের দাম দিতে উঠে গিয়েছিল কাউন্টারে। ফিরে সে কখন আমার পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জানি না। আমি তখন টেবিলে নতজানু হয়ে আমার হাতের বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি আর ওর ফেরার অপেক্ষা করছি। মনে হলো ঘাড়ের পাশে কালচে লাল একটা রঙ স্থির হয়ে আছে। ঘাড় ফেরাতেই বলে, ‘এমেইজিং! ইয়োর হেয়ার। ক্যান আই টাচ এ লিটল?’

‘আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে হেসেই বাঁচি না। হাসতে হাসতে বলি, ‘নো নেভার।’ ও গুটিয়ে ফেলে ওর বাহু। সেই সরলপনা চোখে ব্যথার ভাব জাগে।...’

আমার কষ্ট দেখে প্রিয়ংবদা মনে মনে বোধহয় বলল, ‘এটাই তো জীবন। এটাই তো সত্য। কারোর জীবনে কোনো ফুলবিক্রেতা স্থায়ী হয় না। ঠিক যেভাবে সে একদিন ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছিল লন্ডনের রাস্তায়, একজন বেআইনি পোলিশ অভিবাসী, ঠিক সেভাবেই তোমার জীবন থেকে ভাসতে ভাসতে চলে গেছে। অন্য এক দেশের আইনি ঠিকানায়।’ উত্তর দিলাম—প্রিয়ংবদা, ফুল ছড়িয়ে মৃত্যুকেও সুন্দর করে তুললে।

স্বপ্নচারী এক মানুষের নাম প্রিয়ংবদা শামীম আজাদ। শব্দের নেশায় মেতে থাকা এক আজীবন যুবতী নারী। প্রতিবার, বারংবার সঙ্গমে যে যুবতী মনে করেন এই তো প্রথম! অ্যাত বিস্ময় সেই নারীর মনে, অ্যাত আপ্লুত হন তিনি সৌন্দর্যে, অ্যাত আনন্দ তাঁর সৃষ্টিতে। আর ভাঙতে চেয়ে যিনি বুঝিয়ে দেন, ভাঙাতেও কত শিল্প লুকিয়ে থাকে। ফিরতে চেয়ে না ফেরার দামালপনায়, অতীতচারণায়, গন্ধমাখা কলমিফুল ফুটিয়েই চলেছেন। সেই কলমিই যে কখন ল্যাভেন্ডার হয়ে আপনার মনের আঙিনায় শোভিত হবে তা বুঝে ওঠার আগেই দেখবেন গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে পড়েছেন। একদম তাই! অতীত-বর্তমান এক করে খেলেই চলেছে সাপ-লুডো। সেই খেলায় সওয়ার হয়ে এক সময় আবিষ্কার করবেন, আপনি, পাঠক, খড় ছোঁয়া দেউড়ি থেকে কখন যেন চলে গেছেন বিলেতের কোনো পাহাড় ছোঁয়া রাস্তায়—জানা-বোঝা-চেনার আগেই দেখবেন ভ্রমণের নেশাটা একেবার মস্তিষ্কে চারিয়ে গেছে। বুঝে যাবেন ঘর বাঁধতে গেলে আগে ঘর ছাড়তে হয়। এখানে সব চরিত্রই পরিযায়ী, সব ভাবনাই পরিযায়ী। পাঠককেও হতে হবে পরিযায়ী। ডানা টানটান রোদ্দুরে ধুয়ে, শুকিয়ে, পরিষ্কার করে নিতে হবে মস্ত উড়ালের জন্য। পায়ে জড়িয়ে নিন নিক্কণ। পারাপারের জন্য প্রস্তুত হন। পনেরো হাজার মাইল কই তার অনেক অনেক বেশি ভ্রমণ করতে হবে আপনাকে। অতীত-বর্তমান-স্বপ্ন-বাস্তব—এ এক বিস্তৃত বিস্তার।


ভ্রমণকে এবার একটু থামাই। একটা কবিতা পড়া যাক? কবিতাটার নাম ‘অধিকোষ’।


ছায়া মরু
তৃষিত তৃষ্ণা উড়ে যায়
তুমি থাকো মাটির কইতর...

এইসব কংক্রিট ক্রিসমাস
আর বরফ পাখিদের রেখে
বারবার ফিরে আসি
কাঁচা মাংস আর টার্কির সাথে
রোদে শুইয়ে দিই স্মৃতির কবর
পাহাড়ও গচ্ছিত থাকে
অনাদায় ওঠে নয়া কোনো রাত্রির রোগ
অন্ধমতি নারী আমি
এখনি খুলে দিতে চাই
জানু ও জংঘা সহ সোনার শেমিজ।


ছায়া মরু
চৌকশ চাক উড়ে যাক
দীর্ঘজীবী হও মাটির কইতর...


কইতর। কবুতর। কইতর। কতবার যে আপনার আকাশে, আপনার ছাদের আলসেতে উড়ে উড়ে এসে বসবে, আপনাকে ওম দেবে... আপনি অবাক হয়ে যাবেন। সে তো চিঠিও দেয়! চিঠিও আনে। কার চিঠি? তোমার চিঠি, আমার চিঠি, আপনার চিঠি... কাকে আমি চিঠি লিখি? আপনি? তুমি? এর উত্তর আমাদের সবার জানা! এই যে বিচ্ছেদ, এই বিচ্ছেদের মধ্যে যে সূক্ষ্ম সংযোগ, সেই রেখাটির কাজ করে এই পাখি। আর সংরাগ? তার খবরও তো এ পঙ্খিপ্রিয়াই দেয়। আর এই সংরাগের আরেক পিঠে আরেক কবুতরকে দেখি, আসুন... ‘রুঝটের ঝোল’ থেকে—

‘কেউ কেউ আছে ক্ষয়ের আগে উজ্জ্বল কবুতর হয়ে ওঠে। আমি সেই কবুতর। তবে বেপরোয়া। আমার নখরের আঁচড়ে তোমার গাল দিয়ে স্মৃতির রক্ত না গড়িয়ে পড়া পর্যন্ত আমি আর থামতে পারলাম না। এক সময় তুমি রক্তহীন হলে, আমি পরের প্রহরের জন্য তৈরী হলাম। মনে হল তোমার শ্রীমুখ আমার একদম ভালো লাগে না—ভালো লাগে তোমার রক্তহীনতা, দীনতা, ম্লানতা, খর্বকায়তা, শক্তিহীনতা এবং দুর্বলতা।... তোমার গলা বসে এলে তবে তুমি আসো, চিত্রা একটু যষ্টি মধু হবে, চিত্রা একটু রুঝট পাতার ঝোল হবে, তোমার একটু ওম হবে! এসব করতোয়া কাতরতা বইয়ে নয়া দেয়া পর্যন্ত আমি স্থির থাকি। ভাবি, কোনদিন একবারো কি ভেবেছিলে, যে সুতানলী সাপ লক্ষীন্দরের বাসরে তার রতিক্লান্ত দেহ কেটেছিল তার অন্তরে তখন কী ঘটেছিল?’

‘রুঝট পাতার ঝোল’ আমাকে মনে পড়িয়ে দেয় আরো একটি চরিত্রকে—দিওয়ানে মৌলভী সাহাব। যোগীন্দর পাল-এর ‘স্লিপওয়াকার্স’। একজন মোহাজিরের গল্প। দেশ ভাগের পর যিনি লখনৌ ছেড়ে করাচি চলে যান। যান আরো আরো অনেক মানুষ। এঁরা হৃদয়ে শুধু দেশের স্মৃতি নিয়ে যাননি, নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়িঘর, রাস্তা, চৌরাস্তার মোড়, মায় প্রিয় মালিহাবাদী আম। সবটাই স্মৃতিতে। এবং এঁরা কী করলেন? করাচিতে গিয়ে স্থাপন করলেন আর একটি লখনৌ শহর। এই মৌলভী সাহাব ছাড়া বাকিরা কিন্তু দিনে-দুপুরে, কাজে-কর্মে মানিয়ে নিয়েছিলেন নতুন বাসভূমি। আর দিওয়ানে সাহাব? তিনি শুধু স্বপ্নে বা স্মৃতিতে নয়, জাগ্রত অবস্থায়, প্রতিটা মুহূর্তে সেই লখনৌ শহরেই থাকতেন। দেশ ছাড়ার বেদনা থেকে বেরোবার ওই একটিই উপায় ছিল তাঁর হাতে। মাতৃভূমির স্মৃতি বহনে এতটাই কাতর ছিলেন তিনি, পাগল ছিলেন, লোকের মুখে মুখে হয়ে গিয়েছিলেন ‘দিওয়ানে’।


কবুতর, রুঝট, লক্ষীন্দর, সুতানলী, ওক, ল্যাভেন্ডার, ড্যাফোডিল, কলমি—একটা যায় তো আরেকটা আসে। আমাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে। দিশা হারাই। আঁকড়ে ধরি ‘জিয়ল জখম’।

‘বড় মামার আর মার মাতম থামলে ইয়াস দাঁড়ায়।

বুকের কাছে কবিতার বইখানা নিয়ে গলুইর কাছে গিয়ে রুকুতে দেহ স্থাপন করে।

তারপর হাঙরের মুখের কাছে তার চেয়ে বড় হয়ে তাকা।।

তারপর জলফেনার ফোলানো সেসব ভয়াল চোয়ালগুলো এক এক পাতা করে গুঁজে দিতে থাকে। আর ঢেউয়ের লক্‌লকে লোকমা তা নাই করে ফেলতে থাকে মুহূর্তেই। পুরো বই আত্মসাতের পর শুম্‌শাম নদী লেপ্টে যায় অতীত অবধি। গাঙের ঢাল বেয়ে মাকে ধরে নানা বাড়ীর ইস্কুল ঘরের সামনে দাঁড়ালে মা ফিস ফিস করে বলেন, ‘ইকিতা করলেরে বাফ, তুই না আমার কেচমা কবি!’ ইয়াস মায়ের বালাহীন দু’খানা হাত মুখের কাছে আনে,

‘মেঘর কারণে মাগো ময়ূর যে লাল অই যায়

এ জিয়ল জখম তুমি কি ইবার তুমি ছইয়া দেখবায়...’

গদ্যকারের কলমে এক আজন্ম কাব্যমন খুঁজে পাই, একজন কবির চেতনার ছোঁয়া পাই। সেই কবির ভাবনার ছোঁয়া পেতে আসুন একটু পড়ে নিই—

‘...একদা জলিষ্ণু জামালপুরে শুকনো কুড়ি নদীর নিদ্রাকক্ষে অবাধ সন্তরণরত আমার কিশোরী শরীর অতিরেকে এক কম্পনের উদ্রেক হয়েছিল। তার নিমিত্তেই আমার প্রথম পদ্যপাত। পাঁজি-পুঁথি মেলাবার মতোই জেগে উঠে শিশু সীম আর পরাগায়ণ প্রচেষ্টারত নীলচক্ষু অপরাজিতায় ছাওয়া বাড়ির নিচে আমই দাঁড়িয়ে থাকি দীর্ঘ। পরদিন বৃষ্টি যতক্ষণ ঝরেছিল আমি আর সঞ্চয়িতা এক ছাদের নিচে—ততক্ষণ।

তারপর সেই ঢেউটিনের ছাদের নিচে প্রতি দুপুরেই গরমে আর ঘামে নিজের না-বাঁধা পিঙ্গল কেশরাশি থেকে পেতে থাকি সৌররশ্মির মাদক। বাড়ির সামনের খড়িকাঠের দোকান পেরিয় যেতে গেলে দেখি দাঁড়িপাল্লাজ দড়াদড়ি ছিটকে খয়েরি মাটিতে ড্রেনের কাছে পড়ে আছে কাটাবৃক্ষের ক্রন্দন। আর মৃদুল পায়ে সুগন্ধি বকুল-খসা ধাতব সড়ক মাড়িয়ে গেলে মনে হতো আমি আজ ফুলের আহার।

সে ছিল আমার অন্ধত্ব মোচনের আদি সংকেত যা কিনা এখনো প্রতিরাতে অলৌকিক ফোটে এই অসামান্য জাগতিক দূরত্বে অথবা নিবিড়তম নৈকট্যে।

গভীর রাতে ঘুম ভাঙলেই চাঁন্দের রূহানী ঝলকায়। আমি তার হৃৎপিণ্ডের ওম পাই।’


শব্দ-বাক্য-ভাবনার মায়াজালেরও একটা ওম আছে। সেই ওমে সেঁকতে সেঁকতে আবিষ্কার করি আমাদের এই প্রিয়ংবদা শিল্পী তাঁর লেখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই চলেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তাই তাঁর রচনা বদ্ধ জলাশয়ের শ্বাসরুদ্ধতা নয়, স্রোতস্বিনীর ছলছলিয়ে চলা দিয়ে যায়। এই সাঁতারে তাঁর লেখনি অভিজ্ঞ হয়েছে, কিন্তু অভিজ্ঞতার ভারে কখনো ন্যুব্জ হয়নি লেখকের ডিঙিনৌকো। তাঁর কলম। তরতর করে তা এগিয়ে চলে স্বচ্ছতোয়ার নাভি চিরে। উপল খণ্ডে ধাক্কা খায় চলার ঢেউ। মাঝি দাঁড় ছেড়ে বেভুল তাকিয়ে থাকেন পেছনে ফেলে আসা কোঁকরানো চুলের মতো ঢেউয়ের দিকে। অযাচিত ধাক্কা লাগে কোনো এক সুপ্ততায়। ঝরঝর হেসে ফেলে জলের মধ্যে উলটে পড়েন তিনি। ব্যথা লাগে হয়তো। তবু, বারবার হেসে ফেলেন। তাঁর এই বেয়ে চলা আর ছোটো ছোটো ধাক্কা খাওয়া অনবরত, লাগাতার। অনুদ্দেশের উদ্দেশ্যে। তবু ‘শ্রান্তি’ আসে—


সড়কের নিশানা না-জানা—
কোথায় যে যাব জানি না
কিন্তু কোথাও তো এ নূপুর খুলে
কাচের নিক্কণ সমেত
তুলে রেখে যেতে চাই।
মাটির ফণায় বসা
তোমাদের সেই ঘন ঘোর গ্রাম
কুটুমের সর-পড়া নিথর বাড়ি
সেইখানে রাখা যাবে কি?


এই যে দ্রাবিড় বাতাস
অনার্য সাঁতার
সবকিছু পাড় হয়ে
তোমাদের করমচা বাগানে
পতঙ্গের পাখা-পোড়া দেহ আর
জল শুষে নেয়া হতভাগ্য আকাশিয়া মাটি
তাহাতে কামাক্ষ্যার এ দীর্ঘ ছায়া
একফোঁটা বিশ্রাম রেখে যেতে চাই
রাখা যাবে কি?


প্রিয়ংবদা অনেকক্ষণ চুপ। আমি পাতা ওলটাই। চোখ আটকে যায় ‘পান্না পরিসংখ্যান’-এ। নাকি ঘোর আটকে যায়? স্বপ্ন-বাস্তব-ফ্যান্টাসি... আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে থাকে। বুঝে উঠতে পারি না, এ গল্পের শুরু আর শেষ। সব জলের নাচে তোলপাড় হয়ে যায়। জল নিয়ে লেখক তাঁর ভাবনার কলম দিয়ে এত খেলা করেছেন যে জলকেলি শব্দটার মানে এতদিনে জলের মতো পরিষ্কার! তবু নাকানি-চোবানি খেতে তো আপত্তি নেই। জল এবং রুনি, রুনি এবং জল... এক টুকরো জলজ লেখা—

‘মেডিসিন বাথে এসে দেখে জল ভর্তি এখন কেবল সাদা মানুষ। তার মাঝে চিনে বাদামের খোসার মত ক’জন বাদামী মানুষ ভাসছে। তাদের মধ্যে পরমার বাবাও। প্রথম দল জিকুযি সেরে চলে গেছে বীচে। ঘন নীল জল। নিচ থেকে নানান গতিতে বিচিত্র সব তরঙ্গ উঠছে। ফেনায় ফেনায় কিছু দেখা যায় না, কথা শোনা যায় না। জলের জেলিতে মানুষ নয় মারমেডরা এত কাছাকাছি যে গায়ে ঘষা লাগছে। নায়াগ্রার বিশাল প্রপাতের মতন শব্দে আর স্রোতে সবাই মাখামাখি।

পা দিতেই তার দেহ ঘিরে অসংখ্য বুদবুদ বেয়ে উঠতে লাগলো। আর তার সারা গায়ে জলের জামা গজিয়ে গেল। স্তনের ডগা ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি তার আঙিনা আর ঘর একাকার হয়ে শুরু হল একি প্রাক ক্রিয়া! স্তনের ডগায় এখন নাচছে শংখ সাগর, সহস্র জলশিশ্ন আর উষ্ণ জলসঙ্গমে রুনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। উৎক্ষিপ্ত জল তার জানু জাগাচ্ছে, জংঘা ভাঙছে। সে জলঝড়ে কোন মতে বাঁ হাত নাভীতে ধরে আছে সবুজ চোখ। এমন সময় মাছের ঘেরে ডিম ফুটলো আর গরম গরম জলে গা জ্বলে গেল।’

লেখকের এই যে তুলনা, এর কোনো তুলনা হয় না। সত্যি তাই। ভিশ্যুয়ালাইজ করা যায়—চিনে বাদামের খোসার মতো কজন বাদামি মানুষ কেমন করে জলে ভাসে। জল এক নারীর যৌনতাকে কী পরিমাণ জাগাতে পারে, উদগ্র কামনায় জলের কাছে সে কেমন করে আত্ম-সমর্পণ করে তা এই অংশটিতে পরিষ্কার।

এই গল্পেই পান্নাচোখে ভাবনা আটকে যায়। একদম শেষে পাই রুনির পুত্রলাভ।–
...কাছে যেতেই তার দিকে বাচ্চাটা এগিয়ে ধরে হৈ চৈ করে কেঁদে ওঠে রুনি।
- মা, মাগো তোমার নাতির এক চোখ নেই। আমি কি করবো মা?
পাশেই দাঁড়ানো সেলিম। সে নুয়ে পড়ে, বাচ্চা দেখে। তার কোন বিকার নেই।
- কী সাংঘাতিক সবুজ ওর চোখের রং আম্মা। একদম প্রেসাস স্টোন। কোন অসুবিধা
নাই আম্মা, খাঁটি এ্যামার্‌ল্‌ড কিনে আমি ওর অন্য চোখে লাগাবো।’

আমি প্রিয়ংবদার হাত চেপে ধরে বলি, ‘এটা কী হল? সব গুলিয়ে দিলে কেন? একটা মেয়ে এবং তার সন্তানস্পৃহা—এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তার জন্য এই ফ্যান্টাসি! কিছুর সঙ্গে কিছুকে মেলাতে পারছি না।’

প্রিয়ংবদা একটি চলন্ত বাসকে মনে মনে টাটা করে বলল, ‘মেলাতে কে বলেছে?’ বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তারপর?’ বললাম, ‘তার আর পর কী? ‘মিম্বরের কাঁটা’।’

প্রিয়ংবদা, এই একটা গল্পে এসে আমার যা কিছু বোধ-বুদ্ধির প্রাচীর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। পড়া শেষে আমি আক্ষরিক অর্থে চিৎপাত হয়ে পড়ি। এ কী রক্তপাত, এ কী যন্ত্রণা, এ কী বেদনা! লেখক, আপনার হাতের অদৃশ্য চাবুকটা এভাবে আছড়ে পড়ে চুরমার করে দিলো--! গল্পের শুরুতে যা সরস ও শ্লেষাত্মক ছিল, শেষে এসে তা মারাত্মক হয়ে গেল। সাইফুদ্দিন এবং সাইফুদ্দিনকে ঘিরে যে ঘন রসিকতা ও রসের আবহ আপনি তৈরি করেছিলেন, কোনোভাবেই বোঝা যায়নি সেই রসের গভীরে চোরাঘূর্ণি ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। এবার যখন সেই ঘূর্ণি উপরিভাগে এল, বাঁচার কোনো উপায়ই রাখলেন না! এক ধাক্কায় ক্লাইম্যাক্স! চোখের ওপর ঝপ করে কালো একটা পর্দা পড়ে গেল। সব বাজনা, সব অভিনেতা কোথায় হাপিশ হয়ে গেল! মাই গুডনেস! টুপিটা খুললাম শামীম আজাদ! একটি ছোটো গল্পের কী পরিণতি হতে পারে ‘মিম্বরের কাঁটা’ না পড়লে জানতে পারতাম না।
..

সব গল্পগুলো নিয়ে আলাদা আলাদা করে বলা হয়ে উঠল না। মোট ১০টি গল্প আছে এই বইটিতে। ফেরার ইচ্ছে নিয়ে, না ফেরার বেদনা নিয়ে, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিকড় খোঁজার মাধ্যমে নিজেকে খোঁজা—এইভাবে আমাদের নিয়ে ভেসে চলেছে লেখকের ডিঙিনৌকো। আধুনিকের সঙ্গে পুরাতন, বর্তমানের সঙ্গে অতীত, নিজবাসের সঙ্গে পরবাস, দেশের সঙ্গে বিদেশ মিলেমিশে গেছে। ঘোর ডায়াস্পোরার ঘূর্ণাবর্তে পাঠককে ঘুরতে হবে। আর ভালোবাসার বেদনায় বেদনার্ত হতে হবে।

শেষ করবে আর একটি কবিতা দিয়ে। নাম ‘আঁশফল’। একটিই কবিতা তিনটি ভাগে একই বছরে, তিনটি বিভিন্ন তারিখে, তিনটি স্থানে বসে কবি লিখেছেন। আপনারা সবটাই পড়তে পাবেন। আর মিলিয়ে নিতে পারবেন বইটির মূল চলনের সঙ্গে। আসুন—

ক.

তাই আমি গ্রহণের পর ঊঠি
গাঁদার ঐশ্বর্যে আর জলের ঝালরে
হে আমার
ছায়াবান গাছ আর প্রশ্নবান নদী
আমি একা জাগি
যে তুমি ছেনেছ আমার সকল সবুজ
পদাঘাতে ভেঙেছ আমার মাছের মন্দির
আমি তারে দেখি আর নতুন নির্মাণ করি।

জলের ঝালর ঠোঁটে বিদ্যুৎ জাগায়
বিষয় তাবিজ বান্ধি তোমার বৈঠায়
পাতায় বসতি করি পথে পাই ঘর
দ্বিধাসুখে মত্ত থাকি গ্রহণের পর।।

৮.৯.০৬

জামালপুর

খ.

গাঁদার ঐশ্বর্যে দেখি চান্দেরো রূহানি
ছায়াবান বৃক্ষ জাগে
নদীতে নড়িয়া ওঠে কংক্রিটের মীন
বিস্মিত হইয়া দেখি সময়ের ঋণ।


উৎফুল্ল বিষয় লাটিম বিদ্যুতে গুটায়
বরইর তাবিজ ঝোলে আমার কণ্ঠায়
পাতায় বসতি বলে পথে পাই ঘর
দ্বিধাসুখে মত্ত থাকি আঁশফল অম্বর।।


১০.১০.০৬

ধানমণ্ডি, ঢাকা


গ.

তাই আমি গ্রহণের পর উঠি
গাঁদার ঐশ্বর্যে আর জলের তবকে
ডিমভরা মাছের মন্দির বেয়ে
ঐ মেঘদল দেখি।
হে আমার ছায়াবান গাছ
আর প্রশ্নবান নদী
রংধনু সুধ আর খেয়ার খোয়াবে
আমি পক্ষকাল জাগি।


জলের ঝালর গায়ে আলস্য জাগায়
কলিমা তাবিজ ভাসাই বৈঠার ডগায়
পাতায় বসতি রচে পুনঃ পাই ঘর
দ্বিধাসুখে মত্ত থাকি গ্রহণের পর।।


১২.১২.০৬

লন্ডন


এখানে যে তিনটি কবিতা—অধিকোষ, শ্রান্তি এবং আঁশফল ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলি শামীম আজাদের ‘ওম’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।


প্রিয়ংবদা / শামীম আজাদ / 

জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা / 
প্রচ্ছদ (সুন্দর এবং যথোপযোগী) অভিজিৎ চৌধুরী / 
দাম ১৩৫ টাকা।

পরিচিতি
শামীম আজাদ
বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখেন। কবিতা,অনুবাদ সংকলন, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও নাটক সহ গ্রন্থ সংখ্যা ত্রিশের ওপর। তৃতীয় বাংলা বলে খ্যাত বিলেতে তিনি বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে পরিচিত।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা-বাংলাদেশ, ইয়ার অব দা আর্টিস্ট-লন্ডন আর্টস কাউন্সিল, সংহতি সাহিত্য, সংযোজন পুরষ্কার, সিভিক এওর্য়াড, চ্যানেল এস এবং হুস হু এওর্য়াড-লন্ডন পুরুষ্কার লাভ করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ