রতনলালের বয়স হয়েছে, যেমন বয়স
হয়েছিল জংলী, কাশ্মীর কি কলি ব্রহ্মচারীর শাম্মি কাপুরের। অমন জঙ্গলী চেহারা অমন
চুল সব ঝরে গিয়েছিল। শেষে হুইল চেয়ার ছিল সম্বল। যেমন হয়েছে কাশ্মীর কি কলির শরমিলা
, এপ্রিল ফুল সিনেমার সায়রাবানুর। অমন রতনলাল ইদানীং তার মোবাইলে এফ, এম, চ্যানেলে
গান শোনে। জাপান, লাভ ইন টোকিয়ো, লে গয়ে দিল, গুড়িয়া জাপান কি, এই এদিকে এসো, এসো
না, কথাটি শোনো, শোনো না......... তাদের সত্তর বছরের পুরোন ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে
একটা বুড়ো কদম গাছের ছায়ায় দৈনিক খবরের কাগজের ক্রোড়পত্র নিয়ে বসে আছে রতনলাল।
ক্রোড়পত্র ব্যতীত সে কিছু পড়ে না। এই ক্রোড়পত্রে উঠতি, যশপ্রার্থী সিনেমার
নায়িকাদের ছবি থাকে। ছবি মানে বিস্ফোরণ। সকাল বিকেল ভাল যায়, স্বল্পবাসিনীদের
দেখে। ইস, এখন যদি সে জন্মাত, সিনেমার খুকিদের পিছনে ছুটত।
রতনলাল পঁয়ষট্টি। দেখলে মনে
হবে পঁচানব্বই। আর পাঁচ বছর বাকি শতায়ু হতে। অথবা মন্বন্তরের কাল পেরিয়ে এসেছে।
হাড়জিরে, মুখের উপর কালো পোঁচ, পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি রতনলালের শরীর ক্রমশ বাতাসে
যেন মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। কী থেকে কী হয়েছে সে। বাঁশ থেকে কঞ্চি। সেই কঞ্চি
শুকিয়ে চিমটে। তার আছে জুলজুলে দুটি চোখ আর হাপরটানা বুক।
ফ্ল্যাটে উপায় হয় না রাস্তা
আর পথ চলতি মেয়েমানুষ দেখার। তাই সে গোটা শীত সমস্ত দিন ফুটপথের ধারে এই সবুজ রঙের
প্লাস্টিক চেয়ারে বসে কাটিয়েছে। এখন চৈত্র। সকাল আর বিকেল। দিনে দিনে রোদের ঝাঁঝ বাড়ছে। তাই সকালে সাতটা
থেকে দশটা আর বিকেলে রোদ পড়লে এসে বসে। শীতের সময় সকাল থেকে বিকেল পযর্ন্ত থাকে,
মাঝে দুপুরে স্নান-খাওয়া । তখন কদম ছায়ার বাইরে রোদে বসে সে ঝিমোয়। আর চৈত্রে
ছায়ায় থাকে। দুপুরে এই এলাকা ঘুমিয়ে থাকে। আগে কাঁসারি, ফেরিওয়ালার হাকডাক ছিল,
সেই অনেকবছর আগে, শীতে চাই পাটালি গুড়, জয়নগরের মোয়ায়া হেঁকে যেত কারা যেন, গরমের
সন্ধেয় চাই বেল ফুউল, মালাই বরফ...। একবার পাশের বাড়ির পাঁচিলের উপর বসে পশারির
মাথার ঝাঁকা থেকে তিনখানি বড় সাইজের পাটালিগুড় তুলে নিয়েছিল রতন। তারপর তাদের
পাশের ফ্ল্যাটে বেচে দিয়ে গঙ্গার ধারে রিজেন্ট সিনেমা হলে গিয়ে লাভ ইন টোকিয়ো।
জাপান-----জয় মুখারজী আর কে যেন? কী সায়রা বানু কি? সাধনা, নাকি আশা পারেখ কি
শরমিলা। আর একবার ওই পাশের ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ফেবারল্যুবা রিস্ট
ওয়াচ তুলে বেচে দিয়ে অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস, সাগরিকা, আমেরিকা বাই নাইট ও
ফ্রেন্ডস কেবিনে খাওয়া। দেখো দেখো দেখো, অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস। সে এখন কলকাতার
ইভনিং দেখছে। কলেজ থেকে ফিরছে জগতের সেরা মেয়েরা, জিনস আর শালোয়ার কামিজ, ক্বচিৎ
শাড়ি। সব আমূল আর কমপ্ল্যান খেয়ে খেয়ে বড় হয়েছে। পনেরতেই ভরা গাঙ। ভরা গাঙ বলত
বারিদদা। যুব নেতা। তার কাছে এই জীবনের যা কিছু শেখা। ইস্কুল থেকে বাচ্চাদের নিয়ে ফিরছে মা। যুবতী মা
সব। তাদের দেখে কত সুখ। বিকেল অতি মনোরম। উপায় নেই, না হলে সে মিলেনিয়াম পার্কে
গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে থাকত। আজ থেকে বছর ছয় আগে একবার গিয়েছিল সন্ধেয়। শুধু চুমুর
শব্দ পেয়েছিল রতনলাল। তার সঙ্গে ছিল মিনতি। তারই কোর্টে ডি-গ্রুপ। স্বামী তাকে
ছেড়েছে। ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। না হলে তার চাকরি যাবে। রতনলাল কী পারে না? উফ,
মনে করলে শিহরণ। কিন্তু এও টের পেয়েছিল তখনই তার দেহ থেকে দেহ সরতে আরম্ভ করেছে।
পত্রিকায় চোখ দিল সে। ক্রোড়পত্রে আজ এক
নতুনের ইন্টারভিউ। মস্ত বড় বড় ছবি। কেটে বাঁধিয়ে রাখা যায়। চকচক করছে মাখন মাখন
থাই। ভাল ভাষায় ঊরু বলে। বুকের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। একটা ছবিতে খোলা পিঠ। কোমর
থেকে শাড়ি পড়ে যায় যায়। নতুন সিনেমার ছবি। দেখা নয়, পড়া নয় যেন চাটা। আপনি
ক্যামেরার সামনে ন্যুড হতে রাজি?
চিত্রনাট্য ডিম্যান্ড করলে
রাজি।
ফ্রন্টাল ন্যুডিটি?
শিল্পের জন্য সব করা যায়।
পড়তে পড়তে শিহরিত হয় রতনলাল।
শিল্পের জন্য মিনতির বাড়ি যেতে আরম্ভ করেছিল সে। ছেলে তখন টিউশনিতে। দুয়ারে খিল
এঁটে তারা শিল্পের জন্য সব করত। মিনতি বাধ্য হত। কিন্তু তখনই সে অকেজো হতে আরম্ভ
করেছিল। ইস ! মনে পড়লে চোখে জল এসে যায়। মক্কেলের ঘুষের টাকার ভাগে মিনতির নাম
রতনলাল ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছিল। সবই শিল্প। চাষার জমিতে কারখানা। কারখানার জমিতে উঁচু
উঁচু বাড়ি। সেখান থেকে পাগলের বা গৃহ বধূর ঝাঁপিয়ে পড়া।
আপনি কি ইমরানের সঙ্গে লিভ টুগেদার করবেন?
ভাবি নি কিছু, ও আমার খুব ভাল
বন্ধু, উই লাইক ইচ আদার, আই ক্যান শেয়ার উইথ হিম।
কী শেয়ার করেন?
নো পার্সোনাল কোয়েশ্চেন প্লিজ।
পড়তে পড়তে
রতনলাল উত্তেজিত হয়। এক জায়গাই ঘুরেফিরে পড়তে থাকে। নিজের মনে হাসে। মেয়ে ইস্কুলের
সেই দিদিমনি ফিরছে। মাথা নামিয়ে হেঁটে যায়। কী সুন্দর এই বউটি। শ্যামলা বরণ।
শ্যামল বরণী মেয়ে বল কার পথ চেয়ে..., কে গাইতো যেন, অরুণ রক্ষিত। শুয়ারের
বাচ্চাটাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। রতন খবর দিয়েছিল। সে ছিল এই শহরের সেরা
ইনফরমার। খবর দিত কে কী করছে। কে নকশাল, কে কংগ্রেস, কে সিপিএম, কে সোনাগাছি যায়,
কে কার বউকে নিয়ে সিনেমায়---সব। রতনের সামনে এসে দাঁড়াল এখন কে?
কে, কোন বন থেকে এলি রে বনের
পাখি? সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তার সমুখে ক্রোড়পত্রের নায়িকা। সিনেমার খুকিই যেন ধরাধামে
অবতীর্ণ। টাইট জিনস আর সবুজ টিশার্ট। পায়ে স্পোর্টস শ্যু। আজকাল ছেলে মেয়ের পোশাকে
কোনো তফাৎ নেই। সাইড ব্যাগ থেকে বোতল বের করে জল খায় সে। রতনলাল রং জ্বলা হলুদ
পাঞ্জাবি আর কেচে কেচে লালচে শাদা পায়জামা। খ্যাংরা কাঠির উপর আলুর দমের মতো তার
মুন্ড। দেখলে মনে হয় অনেক ওভার পিটানর পর রং খসে যাওয়া ডিউজ বল। আঁশের মতো গুটিকয়
চুল সেখানে। পুরো কালো। হাসিনের সেলুন থেকে ডাই করে আসে মাসে একবার। আর তা করতে
গিয়ে চুল খসিয়ে দিয়েছে অনেক। তবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ে
নেয় রতন। রুমালে মুখ মুছে কায়দা করে বসে। আড় চোখে তাকায়।
মেয়েটি কুড়ি একুশ। মাথাভরা ঘন
চুল, ঘাড়ের দুপাশে লতিয়ে। ময়লা ময়লা রং। লম্বায় পাঁচ পাঁচ। স্বাস্থ্যবতী। কী
পুরুষ্টু ঊরু। নিতম্বে চেপে বসেছে জিনস।
সবুজ টিশার্টের আড়ালে পুরুষ্টু বুক। ভগবান কত আনন্দের জিনিশ পাঠিয়েছেন ধরা ধামে।
এনজয় এনজয়। রতন যা দেখার দেখে নিয়েছে। এই জীবনে এইটাই সম্বল। এইটা দেখতেই সে বসে
থাকে এখানে। বাড়িতে থাকতে ভয় হয়। মনে হয় তার বউ পুষ্পিতার পোষা অ্যালশেসিয়ানটা যে
কোনদিন তাকে ছিঁড়ে খাবে। কী ঘাড়েগদ্দানে চেহারা তার। প্রতিদিন খাসির মাংসের ছাঁট
আর হাড় আসে ওর জন্য। মাসকাবারি ব্যবস্থা। সঙ্গে ভাত। খেয়ে খেয়ে আর পুষ্পিতার আদরে
আদরে সে হয়ে উঠেছে মাস্তান। খুব জ্বালা
ওটাকে নিয়ে। যখন হাড় চিবোয় দাঁতে, কী শব্দ !
রতনের তখন মনে পড়ে হাড় ছাড়া তার আর কিছু নেই। মাঝেমধ্যে কুকুরটা তার গায়ের
গন্ধ শোঁকে। হাড়ের গন্ধ পরখ করে। এই সারমেয় তার পুত্রের দান। একা থাকে বুড়ো বুড়ি। কুকুরটা থাক। বাবা তোমার উপর তো কতজনের খার আছে। দুবলা হয়ে গেছ। বাড়ি
এসে ক্যাংলা হয়ে যাওয়া তোমাকে পিটিয়ে যেতে পারে। কুকুর থাকলে কেউ সাহস করবে না।
কিন্তু শুয়োরের বাচ্চা কুকুর
জানালা ছাড়া নড়বে না। রাস্তার কুক্কুরি দেখে ঘেউ করে। মেয়েমানুষও দ্যাখে। উপায়হীন
রতনলাল রাস্তায়, কদমছায়ায়।
তার ছেলে গৌর আলাদা। প্রচুর
টাকা তার। জ্যোতিষ চর্চা শিখে এসেছে কামরূপ কামাক্ষ্যা থেকে। পাঁচটা সোনার দোকানে
বসে। তা ছাড়া টেলিভিশনে গেরুয়া পরে শনি মঙ্গল দুদিন ভাগ্য গণনা করে। পুষ্পিতা
পুত্র নিয়ে অহঙ্কারী। সে আর তার আলসেশিয়ান নিবিষ্ট হয়ে ওই অনুষ্ঠান দ্যাখে। বউ বলে
তার ছেলে পারে। ভাগ্য বলতে পারে। নাম তার দেবগুরু বৃহস্পতি। রতন ভাবে একদিন ছেলের
সামনে তার ছক ফেলে দেবে, বল আমার কী হবে, শিয়াল শকুন আর কুকুরে খাবে আমাকে ?
দুর্ভিক্ষের দিনে অমনি হত শোনা যায়।
শুনে পুষ্পিতা বলেছিল বলেছিল,
কী হবে, না মরলে শকুণ ছোঁয় না, আমি বেধবা হবো, দেরি নেই।
রতন তার বউকে ঘেন্না করে যত
তার চেয়ে তার বউ বেশি। সে তো বাধ্য করেছিল ওকে বিয়ে করতে। জোর করে। সে ছিল বারিদ
বোসের চেলা। ভুবন সাহার আশীবার্দ ধন্য। বিয়ে না করলে মুখ পুড়িয়ে দেবে অ্যাসিড
দিয়ে। ওর দাদাকে নকশাল বলে ধরিয়ে দেবে। বাবাকে শিলিগুড়ি বদলি করে দেবে বিলয়দাকে
বলে। বিলয় সান্যাল। পশুপালন মন্ত্রীর খাস
পিয়ন। রাজি কি রাজি না বলো পুষ্পি।
পুষ্পিতা তখন কী সুন্দর! কী
দারুন দেখতে! ছিপছিপে গড়ন, মাথাভরা চুল, টানাটানা চোখ, নাক একটু চাপা। সরু কোমর,
চওড়া পাছা। আর অনেকটা করে মাংস দুই বুকে। বারিদদা তার পিঠে হাত দিয়ে বলেছিল, ঢলো
ঢলো কাঁচা, বেশ হয়েছে। পরে বলেছিল, বউকে নিয়ে বড়বাবুদের কাছে যাসনে, কেন তা বুঝে
নে।
বড়বাবু মানে বড় নেতা। ধীরেন
স্যার, জয়নাল স্যার, বেচা মিত্তির স্যার। এক একজন এক এক মন্ত্রীর লোক। যা চাইবে
দিতে হবে। বিনিময়ে তোমাকেও দেবে। আহা কী জীবন গেছে তার ! পুষ্পিতাকে লুকিয়ে
রেখেছিল যেন। তারপর দেড় বছরের ভিতর ছেলে হওয়ার পরই বদলাতে লাগল সে। সে তো ভালবাসত
সুকেশ লালাকে। তারা সাত পুরুষ কোলকাতার। বড়বাজারে রেডিমেড জামাকাপড়ের ব্যবসা ছিল।
এখনো আছে। বুড়ো হয়েও কী চেহারা সুকেশের। ছফিট লম্বা, হাঁটলে মেদিনী কাঁপে। সুকেশই
পুষ্পিতাকে গড়েপিটে তার হাতে দিয়েছিল। সুকেশ জানত পুষ্পিতাকে বিয়ে করা সহজ হবে না।
কেন হবে না ? দহেজ, পণ ছাড়া তার ফ্যামিলিতে বিয়ে কেউ মেনে নেবে না। ব্যবসার শেয়ার
পাবে না। বাড়ির শেয়ার পাবে না। ত্যজ্য হয়ে যাবে। সুতরাং পুষ্পিতাকে তার হাতে
সমর্পণ করে বেঁচেছিল সুকেশ। তাদের বিয়ের বেনারসিও দিয়েছিল সে, আড়াই হাজার নগদ আর
বউ ভাতের খরচও। প্রেমিকা দান করেছিল সে নগদে আর তৈজসে।
ওক্কে স্যার, আপনার মনে কোনো
সন্দেহ হত না, পুষ্পিতা দেবীর সঙ্গে সুকেশ লালার পুরোন রিলেশন একজিস্ট করছিল কিনা।
তা তো ছিলই,
বলে চেয়ারে পা তুলে বসল রতনলাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি এসব জেনে কী করবে?
লিখব স্যার।
‘স্যার’ বলছে সবুজ
টি শার্ট আর টাইট জিনস। খেলারামের দোকান থেকে চেয়ার নিয়ে বসেছে সে তার সমুখে। কিন্তু তার কথা লিখে লাভ কী ? সে কে? তার এখন
আর কোনো শক্তিই নেই যে তার কথা শুনবে লোকে। সে জিজ্ঞেস করল, কী জানতে চাও?
সিনিয়র সিটিজেনের জীবন।
আমাকে নিয়ে লিখবে কেন?
আমাকে এডিটর বলেছেন, তাঁরা কেমন আছেন এই বিষয়ে লিখতে, রাস্তায়
আপনাকে দেখে খুব ইন্টারেস্টিং লাগল, আমাদের পত্রিকার সাপ্লিমেন্ট পড়ছেন, তাই
দাঁড়িয়ে গেছি, বলুন স্যার।
উফ! তাকে কি কেউ স্যার
বলেছে কোনোদিন? তাঁরা কেমন আছেন মানে কারা?
কেন আপনারা স্যার। আপনারা
সিনিয়র সিটিজেন, আপনারা?
না লিখবে না কিছু, এসব কথা লিখলে আমার বিপদ
হবে।
আপনার নাম ব্যবহার করব না,
তাই তো?
ইয়েস, আমাকে তাহলে কুকুর
দিয়ে খাওয়াবে আমার বউ।
আমি তাঁর ও ইন্টারভিউ নেব
স্যার।
হুম। গম্ভীর হয়ে গেল
রতনলাল। পুষ্পিতা কী বলবে? জোর করে বিয়ের কথা? বলুক না। কী যায় আসে ? আসলে সুকেশ
ফেলে দিতে সে নিয়েছিল এটা কে না জানে? সুকেশের হাত ফেরত মেয়ে তো। সেকেন্ড হ্যান্ড
তো। পুষ্পিতা বলেছিল, তুমি তো জেনেশুনে বিয়ে করেছিলে, আই লাভ সুকেশ, কত পয়সা নিয়েছ
আমি জানি নে ভাবছ ?
রতনলাল বলল, বেবি, তুমি বেশ
সুন্দর।
থ্যাঙ্কিউ স্যার, বলুন।
কী বলব?
যা মনে আসে।
তোমার বয় ফ্রেন্ড কই?
নেই স্যার।
কেন নেই?
নেই কেন সেই পাখি, ইয়েস
স্যার সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
তুনি একা?
ইয়েস স্যার, হি ইজ
কেরিয়ারিস্ট, সে ম্যানেজমেন্ট করতে পুনে গেছে, একটা গুজরাতি মেয়ের সঙ্গে এনগেজড।
শুয়োরের বাচ্চাকে আগের দিন
হলে আমি দেখে নিতাম। বলল রতনলাল।
ইটস ওক্কে স্যার, লিভ ইট।
ওক্কে বললেওক্কে হয় নাকি?
রতনলাল বলে।
সে আমাকে ভালবাসত না,
গুজরাতি মেয়েটি, অঙ্কিতা পটেলদের বিরাট ব্যবসা, মিলিওনিয়ার, থাক স্যার।
তোমার চেয়ে ভাল দেখতে?
আমি তো জানি না স্যার।
অলিভিয়া শেঠের মতো?
ক্রোড়পত্র মেলে ধরল রতনলাল, বলল, তুমি কিন্তু এর মতো দেখতে, একেবারে এক।
থ্যাঙ্কিউ স্যার, আগে কেউ বলে নি, আমি একটু পুষ্পিতাদির
কাছে যাব।
হে হে করে হাসে
রতনলাল, সে মেয়েছেলেটা কী বলবে আমি জানি।
আপনি বলুন তো কী
বলবেন উনি?
রতনলাল বলল, আমার হাড়
মাস ওই জোজোকে দিয়ে খাওয়াবে, সুকেশ লালাকে ভালবাসত, আমি ওর জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।
সবুজ টিশার্ট
বলে, সত্যি কি তাই স্যার, লালা ওকে
ভালবাসত ?
রতনলাল বলে, ছেলেটা
কি আমার, মনে হয় না।
আপনি বলছেন স্যার?
আমি কেন, তিনিই বলে,
ছেলে কুকুর দিয়ে গেছে কেন, যাতে আমি কিছু না করতে পারি, ছেলেকে তো ওর মা বলেছে,
আমি কে, কেউ না, আমি শুধু ভাত কাপড় দিয়ে পালন করেছি, আসল বাপ নাকি সুকেশ লালা।
উফ, দারুন স্টোরি,
তারপর স্যার?
ছেলে বলেছে তাকে
কোর্টে নিয়ে যাবে, টেস্ট করে বুঝবে কে তার বাবা।
ডি,এন,এ টেস্ট স্যার।
হুম, আমিও বলেছি কর, যা পারিস খিচে নে, লালার
ব্যবসার ভাগ নে। বলে ঠ্যাঙ দুলোতে লাগল রতনলাল, এইটা আজকাল হয়েছে, একবার যদি লেগে
যায়, গেল সব, লাইফে আর কিছু করতে হবে না।
চৈত্র শেষের বেলা পড়ে
যাচ্ছে। রাস্তায় লোক বাড়ছে। একদল বুড়ো হরিনাম করতে করতে পথ পরিক্রমায় বেরিয়েছে।
ওরা তাকেও ডেকেছিল। ধুর কে যায়। হাঁটবে কে? তার একশো মিটার যাওয়ার সামর্থ্যও নেই।
গা হাত পা থরথর করে কাঁপে। মেসিন বিগড়োন পাম্পের মতো প্রায়। ঘড়ঘড় করে চলে। ওই
হরিনামওয়ালারা পরের জীবনের পাথেয় কুড়োচ্ছে। ওদের ভিতরে পাঁচজন লালবাজার, তিনজন
রাইটার্স, দুজন আলিপুর, দুজন বারাসত, একজন রাণাঘাট,দুজন ব্যাংক। বারাসতের একজন
সাসপেন্ড অবস্থায় রিটায়ার করেছে। কবে তার কেস মিটবে ভগবানও জানে না। সে কর্তাল
বাজায়। তার সামনের সবুজ টিশার্ট দেখছে হরিনামওয়ালাদের। ওদের ভিতরে একজন লেডিস আছে।
প্রচুর পয়সা। ধনী বিধবা। পায়ে স্পোর্টস শ্যু। তিনি প্রায় লিডার। সকলের কপালে
চন্দনের ফোটা। চৈত্রমাস ভর চলবে এই নগর সংকীর্তন।
সবুজ টিশার্ট বলল, নাইস স্যার,
স্যার আপনি কত সময় এখেনে বসে থাকবেন?
খেলারাম দোকান বন্ধ করলে আমাকে
ঘরে তুলে দেবে।
আপনার ছেলে যদি ডি,এন,এ, টেস্ট
করতে যায়, আপনার ভাল লাগবে?
আমিই তো বলেছি যেতে, পঞ্চাশ
লাখে সেটল করুক লালা।
আপনার বদনাম হবে স্যার,
পুষ্পিতাদিরও।
নো, ছেলেটা বুজরুকি দিয়ে কতদিন
চালাবে, পরামর্শ আমার।
আপনি! ইজ ইট ট্রু?
মিথ্যে বলে আমার লাভ? নড়ে বসে
রতনলাল, গৌর এক দাঁওতেই পঞ্চাশ লাখ পেয়ে যাবে, তাতেই ওর জীবন কেটে যাবে।
আপনার স্ত্রী?
সে বলবে, সুকেশের বেটা পেটে
ধরা তার স্বপ্ন।
যদি টেস্টে না মেলে ?
রতনলাল বলল, মেলাতে হবেই,
করাতে হবে, সুকেশের নাতি নাতনি, ফ্যামিলি, লজ্জা লুকোতে ও টাকা দিয়ে সেটল করবেই করবে,
টেস্টে যাবে না।
কিন্তু আপনার পুষ্পিতাদির
সম্মান যাবে না?
মোটেই না, জানবেটা কে?
তবুও।
রতন বলে উঠল, গেলে কি
হয়েছে, আমার মাটির গৌর সোনার হয়ে যাবে।
সবুজ টিশার্ট বলল, আপনি
গৌরকে ভালবাসেন?
আমার গৌর নিয়ে আমি এখনো
আহ্লাদ করি, তোমার সঙ্গে মানাবে।
ওক্কে স্যার, আমি যাই।
আরে রাগ করলে, আমি এমনি
বললাম, গৌরের মেয়েমানুষের অভাব নেই।
অন্ধকার নেমে আসছে।
খেলারামের দোকানে ধুপ জ্বলেছে। তার গন্ধ কদমতলে আসছে। রতনলালের সামনে খবরের কাগজের
মেয়েটি। কী দারুন সাক্ষাৎকার দিয়েছে। এখন তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে সে। রতন জিজ্ঞেস
করল, তোমার সেই বয়ফ্রেন্ড তোমাকে কিস করেছিল কোনোদিন?
ইয়েস স্যার, থাক, ওক্কে
স্যার আমি যাই, আই ওয়ন্ট টু মিট পুষ্পিতাদি।
এখন সিরিয়াল দেখছে, কোলে
কুকুরের মাথা, কথা বলবে না।
তাহলে আপনার স্টোরিই লিখে দেব।
হুম লিখো, আর একটু বসো, সে
কি তোমার সঙ্গে শুয়েছিল ?
বলব না।
রতন বলল, না বললে হবে না।
সবুজ টিশার্ট বলল, কেন হবে
না?
হবে না বেবি, গোপন কথা
শুনতে চায় সবাই, শুনলে সুখ।
নো স্যার, গোপন থাক। বলে সে তার হাতের ভয়েস
রেকর্ডার বন্ধ করে।
অন্ধকার হয়ে যেতে সেই সবুজ
টিশার্ট উঠে দাঁড়ায়, বলল, ভাল থাকবেন স্যার, বাই, আমরা কতবার শুয়েছি, না শুতে
চাইলে সে ছেড়ে চলে যাবে ভয় দেখাত।
চমকে উঠে দাঁড়ায় রতনলাল, বলে, তুমি তাকে খুব
ভালবাসতে?
ইয়েস স্যার, আমি তাকে সব
দিয়েছিলাম, বিকজ আই লাভ হিম, কিন্তু সে বিট্রে করল, ওক্কে, স্টিল আই লাভ হিম লাভ হিম, বলতে বলতে সে
অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায়। মিলিয়ে যায়। তখন খেলারাম এসে তার হাত ধরে, উঠলে বড়
রতনদা?
সে কই?
আমি বলছি তুমি এই কদমতলে
বসবে না আর, শালা এখেনে কিছু আছে, গা ঠান্ডা হয়ে যায়, রোঁয়া কাটে।
রতনলাল বলে, একটা মেয়ে
ছিল না এখেনে ?
খি খি করে হাসে, গাছ
থেকে নেমে এসেছিল মনে হয়।
ছিলরে, এই যে। বলতে বলতে
আলোয় এসে কাগজটা মেলে ধরে রতন। দেখল সবুজ টিশার্ট পরা মেয়েটা হাসছে, বাই স্যার,
কাল আবার দেখা হবে। তার ফ্ল্যাট থেকে অ্যালসেশিয়ান ডেকে ওঠে। গুরু গম্ভীর গর্জন।
শুনলেই তার বুক কেঁপে ওঠে। বউ আর জোজো একঘরে, সে অন্য ঘরে। রাতে ঘরে ঢুকে সে খিল
এঁটে দেয়। তার ঘুমের ঘোরে কুকুরটা যদি গা চাটতে থাকে। তারপর দাঁত। তার ভয় করে খুব। মনে মনে গৌরের নাম
নেয়। খেলারাম তাকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। সে শুধু ফিরল একবার পিছনে, কদমতলে, মনে
মনে বলল, কাল এস আবার, যত সময় ছিলে, কুকুরের ভয়টা ছিল না আমার।
জানালা দিয়ে কুকুর ডাকল,
পুষ্পিতা আসছে তোর ছেলের বাপ।
পুষ্পিতা গলায় ঝাঁজ এনে বলল,
ছেলের বাপ, সে ক্ষমতা ছিল নাকি, সুকেশ দিয়েছিল বলে মা হয়েছি, এস মেয়েপাড়ার
কাত্তিক।
যাবই তো, তুই যা তোর
সুকেশের কাছে মনসা মাগী কাল নাগিনী।
অন্ধকারে গজরাতে গজরাতে এগোয় রতনলাল হালদার।
লেখক পরিচিতি
অমর মিত্রজন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্রউপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।]
প্রকাশিত বই : পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী,ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
পুরস্কার : সাহিত্য একাডেমী।
0 মন্তব্যসমূহ