মাহমুদুল হকের কালো বরফ : রক্ত ঝরা বেদনার জমাট অশ্রু

শামিমা নাসরিন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬০-১৯৪০) চেতনার রঙে পান্না হয়ে ওঠে সবুজ, চুনি রাঙা, আর মাহমুদুল হকের (১৯৪০-২০০৮) অভিজ্ঞতার ছাপে বরফ হয়েছে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। স্মৃতি জমে জমে হিম হয়েছে মস্তিষ্কের যে কোনে স্থানে সেখানে আলো পড়ে না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা স্মৃতির সে জমাট কালো বরফ মাঝে মাঝেই এলোমেলো করে দেয় আবদুল খালেক ওরফে পোকাকে। খেই হারিয়ে ফেলে সে। খুঁজতে থাকে শান বাধানো পুকুরঘাট, যেখানে বসে হাড়িবাসন মাজতে মাজতে পুঁটি কথা বলতো মাছেদের সঙ্গে। খুঁজে বেড়ায় ‘বারান্দার চকচকে সিড়িতে বসে’ দেখা ডালপুরি বুড়োকে, যার পা জোড়া ছিল ‘ঠিক একজোড়া ধনুক’, চেহারা মুখস্ত হয়ে যাওয়া শনপাপড়িওয়ালাকে, ‘চোখে দেখবার মতো ছিল তার সাজগোজের বহর। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো সিল্কের জামা, কোমড়ে আর গলায় রূপোর জরির নকশা খেলানো।
একটা কানে আবার মাকড়ি।’ কুলপিমালাইওয়ালাকে, চিনেবাদামওলা আর লালমিঠাইওয়ালাকে। মণিদা, রাণিবুবু ছবিদি’কে, ঝুমি পাঁচু, পানু’কে। তার জীবনের তল চুইয়ে অতল গহ্বরের অসীম কালযাত্রায় মিশে গেছে নানা মানুষ, নানা ঘটনা। ‘ইচ্ছে করলেও এখন আর সব মনে পড়েনা’ পোকার। ‘কতো কথা, কতো চার ভাঁজ করা ছবি, তেশিরা কাঁচ, লালকুঁচ, কতো সকাল-দুপুর-বিকেল বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছে পোকা! ...জিনজার এখন গানের মতো বাজে, হিনজার এখন বুকের ভেতরে নিরবচ্ছিন্ন শব্দ তোলে। হু হু বাতাসের গায়ে নকশা-তোলা ফুলের মতো অবিরল আকুলতা, পোকার বুকের ভেতরের ফাঁকা দালানাকোঠা গুম গুম করে বাজে! ... পোকা পোকা হয়ে যায়।’ দেশভাগ যে কত কঠিন ও করুণ, কত মর্মন্তুদ কালো বরফ (১৯৯২) পাঠ করলে সহজেই আঁচ করা যায়। এ উপন্যাসে ‘দেশবিভাগের মতো বড় ভাঙনের একটা বিশাল ক্রন্দনকে সংক্রমিত’ করে দেন লেখক।

১৯৭৭ সালের ২১ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট মোট দশ দিনে মাহমুদুল হক লেখেন কালো বরফ উপন্যাস। দশ দিনে লিখলেও এ উপন্যাসের যে-আখ্যান তার পাঠ নেন তিনি শৈশবেই এবং বয়ে বেড়ান আমৃত্যু। ১৯৪৭ সালে ধর্মের মুকুট মাথায় পরে জন্ম নেয় ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্র। দেশভাগের তরঙ্গাঘাত ছিন্নভিন্ন করে দেয় মানুষের জীবন। দুর্দশায় পড়ে মাহমুদুল হকের পরিবার। দেশত্যাগ বাধ্য হয়। ১৯৫১ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে পুরো পরিবার চলে আসে ঢাকায়। এরপর ছিন্নমূল এ পরিবারটি একের পর এক বিড়ম্বনায় পরে। নিজের ছিন্ন অতীত, শূন্যে ঝুলে থাকার যন্ত্রণা, বেগ-আবেগ সঞ্চয় করে মাহমুদুল হক লেখেন কালো বরফ উপন্যাস।

কাউকে গালাগালি দেওয়া নয়; সামষ্টিক জীবনের ক্ষয়ক্ষতি নয় বরং এর বিপরীতে দেশভাগের আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়া ব্যক্তিমুখ, ব্যক্তিস্বপ্ন গুঁড়িয়ে যাওয়ার বেদনাবাহিত ইতিহাসই কালো বরফ উপন্যাস। দেশভাগ নিয়ে নানামাত্রিকতায়, নানা দৃষ্টিকোণ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত হয়েছে প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, কবিতা। প্রধানত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মানদণ্ড সামষ্টিক জীবনের ক্ষয়ক্ষতিই বিশ্লেষিত হয়েছে এসব রচনায়। মাহমুদুল হকের আগ্রহ ছিল না সে-সবে। বরং সামষ্টিক জীবনের চাপে দলে মুচড়ে যাওয়া ব্যক্তির অন্তর্চৈতন্যই তার শিল্পীমানসকে উদ্দীপিত করে। অনন্য মনগড়নে তাঁর উপন্যাসের চরিত্ররা তাই আলাদা প্রকৃতির। নিজস্ব বৃত্তে ঘুরে ঘুরে নিজেকে খুঁড়ে রক্তাক্ত করাই এদের নিয়তি। অনুর পাঠশালা’র (১৯৭৩) অনু, জীবন আমার বোনে’র (১৯৭৬) জাহেদুল কবির খোকার মতোই নিঃসীম একাকী আবদুল খালেক। কালো বরফ উপন্যাসের প্রধান এ চরিত্র মাহমুদুল হকের নিজস্ব শিল্পসৃষ্টি। বাস্তব আর কল্পনার মিশেল। সে আলব্যেয়ার কামুর আউট সাইডার নয়, কিংবা শেকসপীয়রের হ্যামলেটও নয়। পৃথিবীর তাবৎ দর্শন, আদর্শ, রীতিনীতি আর মানবতার প্রতি তাদের মতো অবিশ্বাসীও নন। আবদুল খালেক পোকা পাক খেতে খেতে এগিয়ে চলে জীবনের পথরেখা বেয়েই।

পোকার স্মৃতিময় চৈতন্যর ব্যাপ্তি ও বিস্তার এক অর্থময় ব্যঞ্জনায় সমস্ত উপন্যাসের গভীর তলে ঝর্ণাধারার মতো নিয়ত প্রবাহমান। পোকার আবদুল খালেক হয়ে ওঠা এবং কলেজে পড়ানো ছাড়া সবকিছুতেই অনাগ্রহ সমাজ-অভ্যন্তরে তাকে করেছে নিঃসঙ্গ দ্বীপের বাসিন্দা। ‘চিরজীবন শূন্য খোঁজা’ মানুষ আবদুল খালেক। দিন দিন সে নিজের কাছ থেকেও দূরে সরে যেতে থাকে। অর্থহীন হয়ে পড়ে জীবনের বন্ধন। ‘আজ এই ভরদুপুরে, গরিব বৌনাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে, এক অস্থির আবদুল খালেক, রেখা যাকে তার স্বামী বলে জানে, টুকু যাকে তার আব্বা বলে চেনে। হুহু করে কেঁদে ওঠে তার মন।’ ‘কালো বরফে এই স্মৃতিকাতর মানুষের আরোগ্যাতীত দুঃখবেদনার সান্ত¡নাহীন ছবি তিনি হৃদয়ের গভীরতম তল থেকে তুলে এনে কথামালায় জীবন্ত করে তুলেছেন। আহমাদ মোস্তফা কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের সেরা লেখা কোনটি প্রশ্ন করায় জানান, ‘নিজের কোন লেখাকে সেরা বলা যায় নাকি?’ এটা তো দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা, কিন্তু নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন, ‘প্রিয় লেখার কথা বলতে গেলে কালো বরফে’র কথাই বলবো।’ প্রিয় হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন এর গঠনশৈলী ও ভাষার কথা। আরেকটি কারণও বোধ হয় তার অবচেতন মনে কাজ করেছে- এ উপন্যাসটিকে ‘প্রিয় লেখা’ হিসেবে উল্লেখ করতে, তাহলো তাঁর আত্মজৈবনিক উপাদানের ছোঁয়া। কালো বরফ উপন্যাসের আবদুল খালেক পোকার মতোই তার ‘শৈশব খুব দ্বন্দ্বসঙ্কুল, দেশভাগের যন্ত্রণায় ভরা, বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ার বেদনায় ভরা।’ ভারতভাগের পর একের পর এক মনুমেন্টের মতো মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে বিভেদ, অবিশ্বাস। ছোট্ট পোকা দেশভাগের কোনো মর্ম বুঝেনি, কিন্তু বুঝেছে সবকিছু বদলে গেছে ‘এরপর হুট করে একদিন পাকিস্তান হয়ে গেল। কি হলো না হলো অতো বুঝতাম না, কেবল মনে আছে আমাদের বাড়িতে একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো সেদিন। ...দু’একদিনের মধ্যেই বুঝলাম এমন একটা কিছু ঘটে গেছে যাতে আমরা কেউই ভালো নেই, আমাদের আর ভালো থাকা সম্ভব নয়, আমাদের পরিবারের সুখ শান্তি চুরি হয়ে গেছে, আব্বাকে সব সময় দেখতাম থমথমে। মাঝে মাঝে মা’র সঙ্গে তর্ক হতো। আরো অনেকের সঙ্গেই তর্ক হতো। শেষে সকলের অমতে আব্বা পাকিস্তান চলে এলেন।’ কিছুদিন পর পুরো পরিবারটিই পাকিস্তানে (পূর্ববঙ্গ) চলে আসে। ছায়াময়, রৌদ্রকরোজ্জ্বল মেদুর, শৈশবের ভৌগলিক সীমানা পেরিয়ে দুঃসহ বেদনা ও স্মৃতি সম্বল করে পোকা, পোকার মণি ভাইজান, টিপুভাইজান, রাণিবুবু, মা চলে আসতে বাধ্য হয়। ‘সেই বোধ হয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেল সবকিছুর, সে তার আর কখনো জোড়া লাগলো না। আর কখনো জোড়া লাগবে না।’ কিন্তু পিছনে ধাওয়া করে চলে অতীত। সে খাঁড়া বেয়েই পোকার মণিভাইজান ডুবে যায় উদ্ধারহীন অতল গহ্বরে। ছবির সাথে মণির যে কৈশোরিক প্রেম, সে প্রীতিমধুর সম্পর্ক, যে দুষ্টুমি আর শৈশবযাপন তা ছিন্ন হয়ে যায়। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মণি ছবির কাছ থেকে চেয়ে নেয় তার চুল বাধার ফিতে, কাটা, ক্লিপ এবং কথা দেয় ‘আমি আসবো, যে করেই হোক আমি আসবো, ছবি তুমি থেকো।’ কিন্তু বাস্তবে ছবির কাছে ফিরে আসতে পারেনি মণি। ‘এইভাবে সবকিছু একদিন গল্প হয়ে যায়। জীবনের সেই প্রথম, এক গভীর রাতে তার কানে বেজে উঠেছিল লৌহজং লৌহজং। পাশে দাঁড়িয়ে মণিভাইজান, মণিভাইজানের জামার পকেটে একটা ফিতে, ফিতেয় চুলের গন্ধ, যে গন্ধে অনেক দুঃখ, যে দুঃখে অনেক ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় অনেক ছেলেবেলা...’ মণি ছিড়ে যাওয়া তার জোড়া লাগাতে না পারার বেদনা নিয়ে একদিন মা’র সামান্য বকুনিতে একগাদা ঘুমের বড়ি খেয়ে পাড়ি জমায় মৃত্যুর দেশে।

দেশভাগের মতো ছিন্ন হয়েছে আবদুল খালেকের সত্তাও। একদিকে পোকা। যে মায়ের আদর-বকুনি, মণিভাইজানের স্নেহমমতা, ঠ্যাঙ্গানি, করুণা দিদিমণি, গিরিবালা, অদ্ভুত দৃষ্টিওয়ালা অন্ধভিখিরি, রাণিবুবুর বিড়াল কুন্তি’র প্রসঙ্গের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে ব্যাকুল। আরেক দিকে ছিন্নমূল, উদ্যমহীন কলেজ শিক্ষক আবদুল খালেক। ‘আবদুল খালেকের খোলসের মধ্যে গুমরে কাঁদে পোকা ও তার শৈশব। ...এভাবেই আলোছায়ার নকশা বোনে কালো বরফ উপন্যাস।

পোকার শৈশবের ধূসর স্মৃতিমালায় উজ্জ্বল নক্ষত্র মাধু, মাধুরী। মার খেতে খেতেও মহাকালের প্রবহমানতায় জীবন অপরাজেয়। মানুষ মানবিক চৈতন্যে এক অনিঃশেষ স্বপ্নচারিতার পথে অতন্দ্র অভিযাত্রী। কালো বরফ উপন্যাসের এই মাধু চরিত্রে মাহমুদুল হক এঁকে দিয়েছেন সকল লাঞ্চনা-বাঞ্চনা-ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে মানুষের অমৃত প্রেমতৃষ্ণার তিলক। নগেন স্যাকরার প্রতি মাধুর গভীর প্রেম, তার অসুখে অসহায় মাধুর ‘ডুকরে কেঁদে উঠা’র তরঙ্গাঘাত আবদুল খালেক পোকার অচঞ্চল জীবনেও বইয়ে দেয় ঝড়। স্মৃতিচারণে জানায় ‘অমন কান্না আর কাউকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। মাধুর ভালো নাম ছিল মাধুরী। মাধুর ভেতর থেকে বোধ হয় মাধুরীই কেঁদে উঠেছিল সেদিন অমন করে।’ নিজের জীবনে ফাঁক পূরণ করার এক ব্যাকুল আবেগে আবদুল খালেক স্ত্রী রেখাকে ডাকে মাধু, মাধুরী, মাধুরাণী বলে।

মাহমুদুল হকের জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা তার মা। অকপেটে জানান ‘...হাঁ, কালো বরফে’র মায়ের সঙ্গে আমার মায়ের বেশ খানিকটা মিল আছে বটে।’ এ উপন্যাসে মায়ের প্রসঙ্গটি তিনি গভীর মমতায় অঙ্কন করেছেন। কালো বরফ উপন্যাস পাঠ করে একজন চিঠি লিখে লেখককে জানান এর মাধ্যমে তার ‘মাতৃদর্শন’ ঘটেছে। চিঠি পড়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন এবং কেঁদেছিলেনও। তিনি মনে করেন, ‘আমার লেখক জীবনের যা কিছু বড় প্রাপ্তি তার মধ্যে এই চিঠি একটি।’ ‘কিছুতেই পাকিস্তানে যাবেন না’ সিদ্ধান্ত নিলেও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে চলে আসেন পাকিস্তানে। মায়ের এই পরাজয়, যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ বার বছরের কিশোর মাহমুদুল হক সেই সময়ে যতটা বুঝেছিলেন, পরিণত বয়সে তার সে বোধের ব্যাপক ব্যাপ্তি ঘটে। আর এ-ও বুঝেছিলেন নানা ঘটন-অঘটনে বিপর্যস্ত এ পরিবারকে গভীর মমতায়, গভীর ভালোবাসায় অন্তিম শুশ্রƒষা তিনিই দিয়েছিলেন। মায়ের এ ভূমিকাই চালান করেছেন লেখক কালো বরফ উপন্যাসের মা চরিত্রে। মায়ের কথিত ‘ও আমার কোলে এলো’ বাক্যটি তাই আবদুল খালেকের কাছে একটি গানের কলি, সকল যন্ত্রণার অবসান ‘...এতোদিন পর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, ঝিরঝির বিপর্যয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, গানের ওই কলিতে ভরদুপুরেও আকাশে চাঁদ ওঠে, সব রোগের নিরাময় ঘটে, সব পাপ ধুয়ে যায়, জগৎ সংসার ভেসে যায়, কেবলই মনে হয় কৈ, কোথাও তো কোনো দাগ লেগে নেই!

শুদ্ধতম জীবনতৃষ্ণার প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল মাহমুদুল হকের। তার প্রতিটি উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের মস্তিষ্ক গড়নে অনিবার্যভাবে মিশে থাকে এ শুদ্ধতম জীবনতৃষ্ণা। একগুয়েমি সত্ত্বেও জীবন আমার বোন (১৯৭৬) উপন্যাসের খোকার মধ্যে, অনুর পাঠশালা’র (১৯৭৩) অনুর মধ্যে, নিরাপদ তন্ত্রা’র (১৯৭৪) হিরণের মধ্যে ও কালো বরফে’র আবদুল খালেকের মধ্যে- এ তৃষ্ণা প্রবল। আর্থিক সংকট সত্ত্বেও তাই কলেজের পুকুর লিজ নেওয়ার ব্যাপারে তার অনাগ্রহ। পরিপার্শ্বের চাপে চ্যাপ্টা হয়েও সে বয়ে চলে শুদ্ধতম জীবনতৃষ্ণার আলোকপথ।

নন্দন শিল্পের উচ্চতম চূড়া স্পর্শের প্রবল আকাক্সক্ষা ছিল মাহমুদুল হকের। অবিরাম পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এগিয়েছেন। নির্মোহ নিলিপ্ত চকচকে একজোড়া চোখে তাকাতেন জীবনের দিকে। সাঁতার কাটতেন জীবন নদীতে আর তার গভীর থেকে শিকার করে আনতেন কাক্সিক্ষত শব্দমালা, ধ্বনিপুঞ্জ। ঝলমলে উজ্জ্বল, বাছাইকৃত সে শব্দকেই সাজাতেন একের পর এক। গড়ে তুলতেন কাক্সিক্ষত শিল্পসৌধ। ঠিক যেমনটি তিনি চান। তার গদ্য একেবারেই ঋজু, তরতরে ধারালো ও গতিময়। জীবন নিংড়ানো শব্দেই তিনি মেখে দেন গভীর অনুভবের রঙ যা জীবনকেই আরো গাঢ়ভাবে প্রস্ফূটিত করে। পুঁটির অবিরাম কল্পগাঁথা বর্ণনার যে দ্যুতিময় দ্যোতনা তা পাঠককে আলোড়িত করে ‘রাখ, তোর হ্যাংলামি আমি একদিন বার করবো, কি ছোঁচারে বাবা-’ মাছের সঙ্গে এইভাবে কথা শুরু করে দিত পুঁটি, এতো নোলা কেন? রোজ জ্বালাতন। রোজ জ্বালাতন ...ঐ যে বুড়বুড়ি তোলে, ঐসবই তো ওর কথা। কি বলে জানিস? বলে, ও পুঁটি, তুমি খুব ভালে মেয়ে, তোমার মুকুটপরা রাজপুত্তুরের মতো টুকটুকে বর হবে, তুমি সোনার পালঙ্কে শুয়ে ঘুমুবে, হাজার দাসী-বাদী তোমার পা টিপবে, এখন তুমি আমাকে একটু সরের চাঁছি খেতে দাও’ আলোকময়, নির্ভার এসব শব্দ জুড়ে জুড়েই তিনি তৈরি করেছেন ছবি এবং সে ছবিতে ধরা আছে ব্যক্তি হৃদয়ের আবেগ-উত্তাপ, সুর-সৌরভ।

প্রকাশের ক্ষেত্রে মাহমুদুল হকের সংযম ও পরিমিতি বোধ অসামান্য এবং শৈল্পিক বিচারে ক্রমোত্তরনশীল। মন মতো না হওয়াতে মাটিরজাহাজে’র মূল পাণ্ডুলিপি থেকে অনায়াসে বাদ দেন তেত্রিশ পৃষ্ঠা, বাতিল করেন প্রকাশ অপেক্ষায় থাকা ব্যাধ ও নীলদুপুর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি, আলোর মুখ দেখেনা রূপছায়া পত্রিকায় কয়েক ফর্মা ছাপা হওয়া দ্রেীপদীর আকাশে পাখি উপন্যাসটিও।

নিজেকে সবসময় ছাড়িয়ে যাবার একটা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল মাহমুদুল হকের। প্রত্যেকটি লেখা ভিন্ন ভিন্ন গদ্যে সাজিয়েছেন প্রেক্ষিত অনুসারে। লেখা ছেড়ে দেওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি ছিল লিখে সন্তুষ্ট হতে না পারা। প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মাহমুদুল হক তৃপ্তি পেয়েছিল কালো বরফ লিখে। তার ‘মনে হয়েছিল বাহুল্যহীন, মেদহীন ঝরঝরে একটা উপন্যাস লিখতে পারলাম। মানে এই একটি উপন্যাসই আমার কাছে বেশ কমপ্যাক্ট মনে হয়।’ কমপ্যাক্ট এ রচনাতে মাহমুদুল হক দেশভাগের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে গজিয়ে ওঠা ভেদবুদ্ধির জটিল বিষয়টিকে ঠ্যাঙভাঙ্গা শালিক পাখির জবানীতে সাড়ে তিন লাইনে শেষ করেন, যা পুঁটি অনুবাদ করে এভাবে ‘দেখেছ, দেখেছ কি বজ্জাত! আমাকে নচ্ছার বলে গাল দিল। পাকিস্তান চায় বলে হিন্দু পাখিরা নাকি ওর ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে, শোন কথা! তা আমার কি দোষ বলো? ঐ শোন আবার কি বললে! বলছে তোমার জাতভেয়েরা তো করেছে’ দেশভাগের গভীর ক্ষত, অব্যক্ত যন্ত্রণাকে লেখক তুলে ধরেছেন চিত্রের মাধ্যমে ‘...গুলি খেয়ে একটা শকুন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, এক খাবলা মাংস উড়ে গিয়েছিল বুকের এক পাশের। এমন জখমের পরও সপ্তাহখানেক বেঁচে ছিল’। মাহমুদুল হক পাঠক হৃদয়ে এমনভাবে স্বরসঞ্চার করেন যা তার একান্ত আরাধ্য কথন। তিনি ‘যা বলেছেন, যতটুকু বলেছেন, তা সারবান। সৌন্দর্যের আঁধার। স্বপ্নের আয়োজন।’

মাহমুদুল হক অনন্য মনোগড়নে অসমসাহসী। শক্তিমান কথাশিল্পী। লিখেছেন যে শক্তিতে, যে শিল্প প্রেরণায় লেখা ছেড়েছেনও সেই শক্তি আর সাহসে ভর করেই। জীবন ও জগতের সঙ্গে নির্দ্বিধ বোঝাপড়ায় তিনি পৌঁছাতে পেরেছিলেন শিল্পসৃষ্টির ন্যায়সূত্রেই। পঁচিশ বছরের নিশ্চুপ জীবনে অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে ভোগ করেছেন সে জীবনেরই মধুরিমা। ফাঁকির কোনো জায়গা নেই তাঁর রচনায়। রঙ শেষ হয়ে গেলে আর কোনো আঁচড় কাটতে চাননি, ছবি আঁকার বাহুল্য কষ্টও করেননি। মাহমুদুল হক মৃত্যু আর বিস্মরণে তলিয়ে যাবেন না। আমার তো তাই মনে হয়। বাংলা ভাষায় রচিত সাতটি উপন্যাস ও চৌদ্দটি গল্প (গ্রন্থগারে প্রকাশিত) এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য রচনায় জীবনকে তিনি করে তুলেছেন কবিতা, সংক্ষোভে-ক্ষুব্ধতায়, প্রেমে-অপ্রেমে, পূর্ণতায়-অপূর্ণতায়। তাঁর সাহিত্য প্রাণের লাবণ্যে ভরপুর। স্নিগ্ধ আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বল। সাহিত্যিক সততা, অনন্যতা, নিজস্ব প্রকরণ ভঙ্গি নিয়ে মাহমুদুল হকের স্বাতন্ত্র্য ঈর্ষণীয়।


সহায়ক গ্রন্থ ও সাময়িকী :
মাহমুদুল হক, কালো বরফ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ২০০০।
সরকার আবদুল মান্নান,বাংলা কথাসাহিত্য : আধুনিকতার কুশীলব, প্রথম প্রকাশ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০০৭।
‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, সম্পাদক : সন্জিদা খাতুন, ১ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, ঢাকা ২০০৮।
‘কালি ও কলম’, সম্পাদক : আবুল হাসনাত, ৫ম বর্ষ অষ্টম ও একাদশ সংখ্যা, ঢাকা ২০০৮।
‘লোক’, সম্পাদক : অনিকেত শামীম,ঢাকা ২০০৭।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সরকারি এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, পাবনা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ