কিছুক্ষণ আগে কলকাতা থেকে রমানাথ টেলিফোন করে জানাল সে আজ বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছে।...
গত বছর কলকাতায় গিয়েছিলাম । তখন রমানাথের ওপর সাহিত্যপত্র ‘ইসক্রা’ একটা রমানাথ রায় সংখ্যা তৈরি করছে। ওই সাহিত্যপত্রের সম্পাদক প্রগতি মাইতি রমানাথের পুরনো বন্ধু হিসেবে আমাকে কিছু একটা লিখতে বলল। যা লিখেছলাম তার প্রথম অংশের স্মৃতিচারণটা এখানে উপস্থিত করছি:
লেখালিখির জগতে আমার বন্ধু নেই বললেই হয়; হাতে গোণা যে কয়েকজন রয়েছে তার মধ্যে রমানাথ সবচেয়ে পুরনো আর স্থায়ী । আমার অন্য যেসব বন্ধু রয়াছে তাদের সঙ্গে দেখা হলে কেমন আছ, কোথায় আছ, ছেলে কী করছে, এক আধটু রাজনীতি এসবের পর আর প্রায় বলার কথা থাকেনা । রমানাথের সঙ্গে দেখা হলে জীবনের অনেক ঝড়-ঝাপ্টা সত্ত্বেও আজও সাহিত্য, ভাষাব্যবহার আর লিখনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলে আসে । পেছনে ফেলে আসা সুদূর ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে আজ পর্যন্ত এই সম্পর্ক প্রায় অটুট রয়েছে ।
রমানাথের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কফি হাউসে । রমানাথ তখন এম.এ পরীক্ষা দিয়েছে। আমার সঙ্গে তার পরিচয় অবশ্য গল্পকার রমানাথ হিসেবে । তখনও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়নি, রমানাথ গল্প লেখে, অল্প-প্রচারিত ক্ষীণকায় অবাণিজ্যিক কিছু কাগজে তা ছাপা হয় । কফি হাউসের টেবিলে গল্প-কবিতা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলে। কখনো কে কী লিখছে বা লিখেছে তা নিয়ে কথা হয়, কখনো সখনো কেউ একজন নিজের নতুন লেখা পড়ে । কে কোন নতুন বই বা লেখা পড়ছে কি সম্প্রতি পড়েছে তা নিয়েও আলোচনা হয় । এ ছাড়া ক্ষীণকায় অবাণিজ্যিক সাহিত্যপত্রের প্রকাশক-সম্পাদকরাও কফিহাউসে আসে, লেখার দেওয়া-নেওয়া চলে । তারপর, কিছুদিনের মধ্যে আস্তে আস্তে আমাদের (রমা, আমি...) দলটা একটু ছোট, কিছুটা আলাদা হয়ে যায় । সবাই আসে, তবে বেশির ভাগ দুচারটে কথা বলে অন্য কোনো টেবিলে গিয়ে বসে । আসলে কোন পত্রিকায়, কী লিখছি/লিখছ-র বাঁধা গৎ, অমুক-তমুক, অমুকদা-তমুকদা, অমুক পত্রিকা-তমুক পত্রিকার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কী লিখব, কেন লিখব, কেমন করে লিখব এসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা অল্প কয়েকজন মাথা তখন ঘামাতে শুরু করেছি, আর এই ব্যাপারগুলো বেশির ভাগের কাছে অপ্রয়োজনীয় বা অবান্তর বলে মনে হচ্ছিল । তা মৌখিক বা লিখিত যাই হোক না কেন, ভাষা-ব্যবহারের উদ্দেশ্য হল সংজ্ঞাপন । বাস্তব জীবনের সাধারণ সংজ্ঞাপনে ‘কেমন করে’ বলা হয়েছে-র চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হল ‘কী’ বলা হয়েছে । আর এর বিপরীতে সাহিত্যিক সংজ্ঞাপনে অর্থাৎ সৃষ্টিশীল রচনায় ‘কী’ অর্থাৎ বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘কেমন করে’ লেখা অর্থাৎ লিখন ।
রমানাথ গল্প লিখত । বাংলা ভাষার, বাঙালির সাহিত্যের জগতে সাহিত্যকর্মের (গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকের), আলোচনায় যে ধারণাবোধক শব্দবীজগুলি সবসময় সর্বস্তরে উপস্থিত থাকে, বাচনকে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলির কয়েকটা হল: বিষয় বা বিষয়বস্তু, জগত, জীবন, জীবন-ব্যাখ্যা, জীবন-বোধ, বক্তব্য, কবিত্ব ইত্যাদি আর এসবের মাঝখানের কেন্দ্রবিন্দু হল ‘কী?’। এসব ধারণাকে ঘিরে একই ধরনের যে শব্দগুলি বারবার পুনরাবৃত্ত হয় সেগুলি প্রশ্নহীনভাবে আউড়ানোর বদলে মনোযোগ দিয়ে শুনলে বা পড়লেই বোঝা যায় সেগুলি কতটা ফাঁপা : ‘ঔপন্যাসিকের মানসদৃষ্টি, বিস্তৃত জীবনপটে অভিজ্ঞতার বিন্যাস ও উপন্যাসোচিতসমস্যা — একটি উপন্যাসের এই প্রধান ত্রিশর্তের...’, ‘ব্যক্তিস্বরূপের বিশেষ বিন্যাসে...’ (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘আমরা যে কবিতায় একত্রে যত অধিক চিত্তবৃত্তির চরিতার্থতা লাভ করি। তাহাকে ততই উচ্চশ্রেণীর কবিতা বলিয়া সম্মান করি...’ (রবীন্দ্রনাথ), ভাষা, ভাব, ছন্দ, এই তিনের সন্নিপাতে কাব্য গড়ে ওঠে।... কাব্য যখন মহত্ত্বের কোঠায় পৌঁছায়... তখন তার ভিতর পাওয়া যায় বিরাট একটা সহজতা কাব্যের ভাষা যেমন অকৃত্তিমতার কণ্ঠস্বর, কাব্যের ছন্দ তেমনই অকৃত্তিমতার পদধ্বনি। (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত), আধুনিক ‘গীতিকাব্যের মতো ছোটগল্পের রসেরও পাক লেখক-পাঠকের সমরসানুভূতির উষ্ণতায়। (সুকুমার সেন) ‘কিছুদিন কিছু কবির সহজ ভাষার পর ….জীবনানন্দের ….সন্ধ্যাভাষা... (সমর সেন)। প্রশ্ন হল নিম্নরেখ (নিম্নরেখা আমাদের) শব্দগুলির অর্থ কী? এই সব পুরনো শূন্যগর্ভ শব্দের শেকল ভেঙে, অর্থহীন ভান-ভণিতার সীমানা পেরিয়ে, আমরা পথ খুঁজতে লাগলাম । এই সময়ে আমাদের চারদিকে সন্ধানের এলোমেলো কিছু প্রথম পদক্ষেপও শুরু হয়েছে: ছোট গল্প নতুন রীতি, কৃত্তিবাস, হাংরি জেনারেশন । বিমল কর সম্পাদিত ছোট গল্প নতুন রীতি শিরোনামে পাঁচটি পুস্তিকায় যে গল্পগুলি প্রকাশিত হয় তার মধ্যে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জটায়ু’ আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিজনের রক্তমাংস’ আমাদের চোখ এড়াই নি । পঞ্চাশের দশকের শেষে কৃত্তিবাস কবিতা-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কিছু কবি কিছুটা চমক, কিছুটা তথাকথিত বোহেমিয়ান জীবনের প্রদর্শক মিথ আর প্রচারের মাধ্যমে পরিচিত হন । কৃত্তিবাসের কবিরা বলতেন সাহিত্যে, কবিতায় মুখের ভাষা ব্যবহার করতে হবে । কে, কাকে, কী পরিস্থিতিতে, কী বিষয়ে, কেন কথা বলছে সে অনুসারে মুখের ভাষা সব সময় পালটাচ্ছে । এর মধ্যে কোন মুখের ভাষাটা সাহিত্যে ব্যবহার্য ? হাংরি আন্দোলনের চ্যাঁচামিচিতে দাদা-র বিভিন্ন ইস্তাহার আর বিট জেনারেশনের বিভিন্ন উক্তির এলোমেলো প্রতিধ্বনি আর আর্ত চিত্কার শোনা যেত । এর কোনোটাই আমাদের সন্তুষ্ট বা সে অর্থে আকর্ষণ করতে পারেনি । আর শেষ পর্যন্ত লেখা আর লেখার যাবতীয় আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কী নিয়ে লেখা হবে — ভালোবাসা, যৌনতা, প্রকৃতি, ব্যক্তি, সমাজ, বাস্তবতা, বিচ্ছিন্নতা, ইত্যাদি । বস্তুত আজও অবস্থাটা খুব একটা পালটায় নি । আর একদিকে গদ্যে বাস্তবতাবাদ আর অন্যদিকে কবিতায় আমি-কেন্দ্রিক রাবীন্দ্রিক রোমান্টিসিজম পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য আজও খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি । বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকীয় দৃষ্টবাদ-প্রভাবিত সাহিত্যভাবনার নিরঙ্কুশ আধিপত্যে রচয়িতার তুলনায় লিখন-নির্মিত রচনাকে , বাস্তবতাবাদ বর্জন করে রচনার সৃষ্ট বাস্তবকে গুরুত্ব দেওয়ার দৃষ্টান্ত আজও বিরল । রমানাথ এদিক থেকে আমার জানা একমাত্র ব্যতিক্রম ।
আবার ফিরে যাচ্ছি পুরনো দিনের কথায়, আমাদের চিন্তা-ভাবনা আর সন্ধানের কথায় । রচনা, রচয়িতা (রচনায় রচয়িতার স্থান, উপস্থিতি/অনুপস্থিতি), লেখা (√লিখ্ সকর্মক/অকর্মক), লিখন (ভাষা-সংগঠন, শব্দ-নির্বাচন, বাক্য), কাহিনি-কথন (পুরুষ, ক্রিয়ার কাল, দৃষ্টিকোণ বা আলোকায়ন), পঠন-পাঠ (=পুনর্নির্মাণ), পাঠ-লিখন (=আলোচনা-সমালোচনা) — এগুলিই ছিল আমাদের লেখালিখির পেছনের চিন্তা । আমাদের ছোট্ট দলটির কেমন করে লিখব চিন্তার প্রথম প্রকাশ ‘এই দশক’ বুলেটিন (১৯৬২)। রমানাথ ছিল তার হোতা । তারপর আমার দায়িত্বে বেরুল কবিতা পত্রিকা ‘শ্রুতি’ (১৯৬৪) । এর পর গল্পের পত্রিকার আকার নিয়ে ‘এই দশকের’ প্রকাশ ‘শাস্ত্র-বিরোধী গল্পের’ [শাস্ত্র √শাস্- (শাসন করা, উপদেশ বা শিক্ষা দেওয়া) -ষ্ট্রন (শাস্ত্র বিধি-বিধান, তত্ত্ব, ধর্মগ্রন্থ)] আন্দোলন বা বিদ্রোহের সূচনা হয় । ‘গতকাল পর্যন্ত আমরা ছিলাম অন্ধ, ছিলাম শাস্ত্রের হাতে বন্দী।... শিল্প ও সাহিত্যে শাস্ত্রসম্মত পথকে বর্জন করতে হবে ...সাহিত্য দীর্ঘদিনের সংস্কার ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হোক ।’ রমানাথের অধি-রাচনিক বাচনের উদ্ধৃত এই অংশের উপাদান তিনটি বাক্য ।প্রথম বাক্যটি কমা দ্বারা যুক্ত দুটি সরল বাক্যের সমবায়ে গঠিত যৌগিক বাক্য, ইতিহাস-নির্দেশক সরল অতীত কাল ( ছিলাম) । পরের দুটি বাক্য সরল বাক্য ।দ্বিতীয় বাক্যে যৌগিক ক্রিয়ার (- তে+√হ-) ঔচিত্য-করণীয়-নির্দেশক ভবিষ্যৎ কাল আর তৃতীয় বাক্য আকাঙ্ক্ষা-নির্দেশক অনুজ্ঞা ব্যবহৃত । এর মধ্য দিয়ে গল্পে (শিল্প-সাহিত্যে) শাস্ত্র-বিরোধী আন্দোলনের অবস্থান ও অভীষ্ট স্পষ্ট: ইতিহাস / অতীত — করণীয়/ লক্ষ্য — সংস্কার / কুসংস্কার থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ।
মার্ক টোয়েন-এর উপন্যাস Adventures of Huckleberry Finn-র শুরুতে একটা বিজ্ঞপ্তি রয়েছ:
Persons attempting to find a motive in this narrative will be prosecuted;
persons attempting to find a moral in it will be banished ;
persons attempting to find a plot in it will be shot...
যারা এই আখ্যানের মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে;
যারা এর মধ্যে কোনো নীতি-উপদেশ খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের নির্বাসিত করা হবে ;
যারা এর মধ্যে কোনো কাহিনি খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের গুলি করা হবে...
মার্ক টোয়েন-এর উপন্যাসের এই উপরচনার তৃতীয় বাক্যটি শাস্ত্র-বিরোধীদের বিভিন্ন ইস্তেহারে ব্যবহৃত হয় । দশটি প্রস্তাবের ঐ ইস্তেহারের উত্পাদক ছিল রমানাথ, এই বাক্যের মধ্যে যে নাগরিক হাস্যরস রয়েছে তা রমানাথের কিছু কিছু লেখার অন্যতম চরিত্রলক্ষণ হয়ে দাঁড়ায় । এছাড়া এই দশকের প্রথম সংখ্যার ঘোষণায় একটি বাক্য ছিল: অতীতের মহৎ সৃষ্টি অতীতের কাছে মহৎ, আমাদের কাছে নয় । এই বাক্যটি ছিল অঁতোন্যাঁ আর্তো-র (Antonin Artaud) ‘নাটক আর তার প্রতিরূপ’ (Le Théâtre et son double) বইয়ের ‘মহৎ সাহিত্যকর্মের ব্যাপারটার ইতি করা যাক’ (En finir avec les chefs d'œuvres) প্রবন্ধ থেকে নেওয়া একটি বাক্যের ( Les chefs-d'œuvres du passé sont bons pour le passé : ils ne sont pas bons pour nous ) অনুবাদ । মার্ক টোয়েন আর আর্তো-র রচনার ব্যবহার রমানাথের, শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের চিন্তার আন্তঃসাংস্কৃতিকতা আর রচনার আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার স্বাক্ষর।
আসলে আমরা বাংলায় লিখলেও বাংলায় কী লেখা হয়েছে, হচ্ছে তার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কী লেখা হচ্ছে, বিশেষ করে কীভাবে লেখা হচ্ছে তার খবরাখবর রাখতে চেষ্টা করতাম । বলা যায় আজকের যুগের রচনার অন্তঃসাংস্কৃতিক আর আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতা সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম । রমানাথ পয়সা পেলেই কফিহাউসের ওপরে রূপা কোম্পানির, গ্র্যান্ড হোটেলের আর্কেডের বইয়ের দোকান থেকে নতুন বই কিনত । ইতিমধ্যে রমানাথ ফরাসি ‘নতুন উপন্যাস’ (Nouveau Roman) আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল । বোধ হয়, ওই সময়ে বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে একমাত্র রমানাথই ইংরেজি অনুবাদে আল্যাঁ-রব গ্রিয়ে ( The Jealousy/ La Jalousie, The Voyeur/ Le Voyeur) , স্যামুয়েল বেকেট (Molloy , Malone Dies , The Unnamable ), ক্লোদ সিমোঁ (The Passage to Milan/ Passage de Milan, The Modification/ La Modification ), নাতালি সারোত (The Age of Suspicion/ L'Ère du soupçon, The Planetarium/Le Planetarium), ইতালো কালভিনো ( The Nonexistent Knight/ Il cavaliere inesistente, Invisible Cities/ Le città invisibili), পিটার বিকসেল (A Table is a Table/ Ein Tisch ist ein Tisch) ইত্যাদি লেখকের লেখা পড়েছিল । ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘একটা নতুন উপন্যাসের জন্য’ বইয়ের ‘কিছু বাতিল হওয়া ধারণা সম্পর্কে’ (Sur quelques notions périmées, 1957) প্রবন্ধে রব-গ্রিয়ে উপন্যাসে চরিত্র, কাহিনি, প্রকরণ ও বিষয়ের দ্বৈত অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, অন্য দুটি প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘নতুন উপন্যাস একটা তত্ত্ব নয়, একটা অনুসন্ধান’, নতুন উপন্যাসে ‘বাস্তববাদের বদলে রয়েছে বাস্তব’ । রমানাথ এসব পড়ে ভাবত, আলোচনা করত।
প্রসঙ্গত দুটি মজার ঘটনা বলছি । ১৯৬৩ বা ১৯৬৪ সালে বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের কর্তৃপক্ষ মার্কাস স্কোয়ারে সম্মেলনের বার্ষিক প্রদর্শনীতে বিনিপয়সায় আমাদের ছোট একটা স্টল দিয়েছিল । স্টল সাজানোর রেস্ত আমাদের ছিল না, তাই আমরা চারদিকে নানান স্লোগান ঝুলিয়ে দিলাম, তারপর হঠাৎ একটা ঘট পাওয়া গেল । কী করা যায়? আমরা তখনো তথাকথিত মঙ্গলঘটের সংস্কার থেকে বেরুতে পারিনি। আমি রমানাথকে কলেজস্ট্রিট মার্কেট থেকে একটা ডাব নিয়ে আসতে বললাম । কোনো এক অজানা কারণে সেদিন সন্ধ্যের বাজারে ডাব না পেয়ে রমানাথ ডাবের বদলে একটা ছোট কাঁঠাল (এঁচড়) নিয়ে এসেছিল । এঁচড় দিয়ে কী করা যায় ? আর কিছু না ভেবে এঁচড়টাকে ঘটের ওপর বসিয়ে দিলাম। প্রতিক্রিয়া অভাবনীয় ! দলে দলে লোক স্টলে এসে কেউ রাশভারি গলায়, কেউবা চটে লাল হয়ে, কেউবা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করতে লাগল ঘটের ওপর এঁচড়, এর মানেটা কী ? আমরা ‘মানে’ তৈরি করতে থাকলাম। ঘট আর ডাবের রচনা = (শাস্ত্র, সংস্কার অনুসারী ) মঙ্গলঘট, কিন্তু ঘট আর এঁচড়ের রচনা = ? মানে? মানে তো সবসময় পঠনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় । এসব কথায় অনেকে কৌতূহলী হল, অনেকে রেগে গেল, কেউ কেউ ‘এঁচরে পাকা’ মন্তব্য করে চলে গেল। এর পরের দ্বিতীয় ঘটনাটা অন্য ধরনের, তার সংজ্ঞাপিত ‘ব্যঙ্গার্থ’ও ভিন্নতর । শাস্ত্রবিরোধী ‘এই দশক’ আর ‘শ্রুতি’, অন্তত প্রথম দিকে, রমানাথ আর আমার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণে আন্দোলন বা পত্রিকা-প্রকাশ ‘আমাদের’ যৌথ উদ্যোগে পরিণত হয়েছিল । ‘এই দশকর ’ চতুর্থ সংখ্যায় আমি প্রথম তিনটি সংখ্যায় প্রকাশিত গল্পগুলির ওপর আলোচনা করেছিলাম । অন্য দিকে ‘শ্রুতির’ চতুর্থ সংখ্যা ছিল অনূদিত কবিতার সংকলন । তাতে রমানাথ ফরাসি কবি জাক প্রেভের-এর কবিতার অনুবাদ করেছিল । আমাদের টাকা-পয়সার সংস্থানটা ছিল খুবই সীমিত । তাই কিছুটা সস্তায় ছাপানোর জন্য আমরা মির্জাপুর স্ট্রিটের শেষে আমজাদিয়া রেস্টুরেন্টের আগে দীপক প্রিন্টার্স (৪৫ সূর্য সেন স্ট্রিট) বলে একটা ছোট্ট ছাপাখানায় পত্রিকা ছাপাতে শুরু করি । ঐ ছাপাখানার মালিক বঙ্কিমবাবু (বঙ্কিম সাহা) ঢাকার পয়সাওয়ালা লোক । ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত । সম্পত্তি বদল করে বাড়িঘর সবই করেছেন । ঢাকায় ছাপাখানা ছিল, তাই বাড়ির সবার আপত্তি সত্ত্বেও এখানে ছাপাখানা করেছেন । বঙ্কিমবাবু সব সময় সুবেশ, পরনে ধবধবে শাদা ফিনফনে গিলে করা পাঞ্জাবি, ধুতি । বঙ্কিমবাবুর প্রেসে দুপুরে ছাপা হত এক ধরনের ট্যাবলয়ড । একদিন, বড় বড় হরফে শিরোনাম শোলমারির সাধু কে? নেতাজি? আরেকদিন, কুম্ভমেলায় কে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন? কেন এত গোপনে ? বিকেলে প্রেস থেকে দু তিনজন কাগজবিক্রেতা ওই কাগজগুলো নিয়ে নেতাজির নতুন খবর, বা কুম্ভমেলায় কে? কারা? চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে কাছেই শিয়ালদহ স্টেশনে চলে যেত । ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা গরম তেলেভাজার মতো কাগজগুলো কিনে নিত । বঙ্কিমবাবুর প্রেসে আর যা ছাপা হত তা হল কার্ড — বিয়ে, জন্মদিন, পৈতে, মুখে ভাত, শ্রাদ্ধ , হালখাতা, সরস্বতী-পুজো ইত্যাদির কার্ড, মফস্বলের অসংখ্য লোক স্টেশন থেকে নেমে চলে আসত এই কার্ড ছাপাতে । এখানেই আমার কাহিনির শুরু । আমাদের দলের কেউ একটা প্রেসে গেলেই বঙ্কিমবাবু সব সময় বলতেন, আপনাগো কামেই হাত লাগাইছে, কাইল বিকালে অ্যাকবার আহেন, অনেকটা প্রুফ পাইয়া যাইবেন । আপনাগো কামেই হাত লাগাইছে! কিন্তু ভেতরে গেলে দেখা যেত তিনজন কর্মীর দুজন বিয়ের কি শ্রাদ্ধের কার্ড আর তৃতীয় জন খনার বচন বা ছাত্রপাঠ্য ভূগোলের বই কম্পোজ করছে । এখন প্রুফ পেতে হলে হত্যে দিয়ে বসে থাকতে হবে । তাই সেদিনও বললাম, এই বসলাম! অন্তত কিছুটা প্রুফ না নিয়ে আর উঠছি না ।
গত বছর কলকাতায় গিয়েছিলাম । তখন রমানাথের ওপর সাহিত্যপত্র ‘ইসক্রা’ একটা রমানাথ রায় সংখ্যা তৈরি করছে। ওই সাহিত্যপত্রের সম্পাদক প্রগতি মাইতি রমানাথের পুরনো বন্ধু হিসেবে আমাকে কিছু একটা লিখতে বলল। যা লিখেছলাম তার প্রথম অংশের স্মৃতিচারণটা এখানে উপস্থিত করছি:
লেখালিখির জগতে আমার বন্ধু নেই বললেই হয়; হাতে গোণা যে কয়েকজন রয়েছে তার মধ্যে রমানাথ সবচেয়ে পুরনো আর স্থায়ী । আমার অন্য যেসব বন্ধু রয়াছে তাদের সঙ্গে দেখা হলে কেমন আছ, কোথায় আছ, ছেলে কী করছে, এক আধটু রাজনীতি এসবের পর আর প্রায় বলার কথা থাকেনা । রমানাথের সঙ্গে দেখা হলে জীবনের অনেক ঝড়-ঝাপ্টা সত্ত্বেও আজও সাহিত্য, ভাষাব্যবহার আর লিখনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলে আসে । পেছনে ফেলে আসা সুদূর ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে আজ পর্যন্ত এই সম্পর্ক প্রায় অটুট রয়েছে ।
রমানাথের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কফি হাউসে । রমানাথ তখন এম.এ পরীক্ষা দিয়েছে। আমার সঙ্গে তার পরিচয় অবশ্য গল্পকার রমানাথ হিসেবে । তখনও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়নি, রমানাথ গল্প লেখে, অল্প-প্রচারিত ক্ষীণকায় অবাণিজ্যিক কিছু কাগজে তা ছাপা হয় । কফি হাউসের টেবিলে গল্প-কবিতা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলে। কখনো কে কী লিখছে বা লিখেছে তা নিয়ে কথা হয়, কখনো সখনো কেউ একজন নিজের নতুন লেখা পড়ে । কে কোন নতুন বই বা লেখা পড়ছে কি সম্প্রতি পড়েছে তা নিয়েও আলোচনা হয় । এ ছাড়া ক্ষীণকায় অবাণিজ্যিক সাহিত্যপত্রের প্রকাশক-সম্পাদকরাও কফিহাউসে আসে, লেখার দেওয়া-নেওয়া চলে । তারপর, কিছুদিনের মধ্যে আস্তে আস্তে আমাদের (রমা, আমি...) দলটা একটু ছোট, কিছুটা আলাদা হয়ে যায় । সবাই আসে, তবে বেশির ভাগ দুচারটে কথা বলে অন্য কোনো টেবিলে গিয়ে বসে । আসলে কোন পত্রিকায়, কী লিখছি/লিখছ-র বাঁধা গৎ, অমুক-তমুক, অমুকদা-তমুকদা, অমুক পত্রিকা-তমুক পত্রিকার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কী লিখব, কেন লিখব, কেমন করে লিখব এসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা অল্প কয়েকজন মাথা তখন ঘামাতে শুরু করেছি, আর এই ব্যাপারগুলো বেশির ভাগের কাছে অপ্রয়োজনীয় বা অবান্তর বলে মনে হচ্ছিল । তা মৌখিক বা লিখিত যাই হোক না কেন, ভাষা-ব্যবহারের উদ্দেশ্য হল সংজ্ঞাপন । বাস্তব জীবনের সাধারণ সংজ্ঞাপনে ‘কেমন করে’ বলা হয়েছে-র চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হল ‘কী’ বলা হয়েছে । আর এর বিপরীতে সাহিত্যিক সংজ্ঞাপনে অর্থাৎ সৃষ্টিশীল রচনায় ‘কী’ অর্থাৎ বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘কেমন করে’ লেখা অর্থাৎ লিখন ।
রমানাথ গল্প লিখত । বাংলা ভাষার, বাঙালির সাহিত্যের জগতে সাহিত্যকর্মের (গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকের), আলোচনায় যে ধারণাবোধক শব্দবীজগুলি সবসময় সর্বস্তরে উপস্থিত থাকে, বাচনকে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলির কয়েকটা হল: বিষয় বা বিষয়বস্তু, জগত, জীবন, জীবন-ব্যাখ্যা, জীবন-বোধ, বক্তব্য, কবিত্ব ইত্যাদি আর এসবের মাঝখানের কেন্দ্রবিন্দু হল ‘কী?’। এসব ধারণাকে ঘিরে একই ধরনের যে শব্দগুলি বারবার পুনরাবৃত্ত হয় সেগুলি প্রশ্নহীনভাবে আউড়ানোর বদলে মনোযোগ দিয়ে শুনলে বা পড়লেই বোঝা যায় সেগুলি কতটা ফাঁপা : ‘ঔপন্যাসিকের মানসদৃষ্টি, বিস্তৃত জীবনপটে অভিজ্ঞতার বিন্যাস ও উপন্যাসোচিতসমস্যা — একটি উপন্যাসের এই প্রধান ত্রিশর্তের...’, ‘ব্যক্তিস্বরূপের বিশেষ বিন্যাসে...’ (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘আমরা যে কবিতায় একত্রে যত অধিক চিত্তবৃত্তির চরিতার্থতা লাভ করি। তাহাকে ততই উচ্চশ্রেণীর কবিতা বলিয়া সম্মান করি...’ (রবীন্দ্রনাথ), ভাষা, ভাব, ছন্দ, এই তিনের সন্নিপাতে কাব্য গড়ে ওঠে।... কাব্য যখন মহত্ত্বের কোঠায় পৌঁছায়... তখন তার ভিতর পাওয়া যায় বিরাট একটা সহজতা কাব্যের ভাষা যেমন অকৃত্তিমতার কণ্ঠস্বর, কাব্যের ছন্দ তেমনই অকৃত্তিমতার পদধ্বনি। (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত), আধুনিক ‘গীতিকাব্যের মতো ছোটগল্পের রসেরও পাক লেখক-পাঠকের সমরসানুভূতির উষ্ণতায়। (সুকুমার সেন) ‘কিছুদিন কিছু কবির সহজ ভাষার পর ….জীবনানন্দের ….সন্ধ্যাভাষা... (সমর সেন)। প্রশ্ন হল নিম্নরেখ (নিম্নরেখা আমাদের) শব্দগুলির অর্থ কী? এই সব পুরনো শূন্যগর্ভ শব্দের শেকল ভেঙে, অর্থহীন ভান-ভণিতার সীমানা পেরিয়ে, আমরা পথ খুঁজতে লাগলাম । এই সময়ে আমাদের চারদিকে সন্ধানের এলোমেলো কিছু প্রথম পদক্ষেপও শুরু হয়েছে: ছোট গল্প নতুন রীতি, কৃত্তিবাস, হাংরি জেনারেশন । বিমল কর সম্পাদিত ছোট গল্প নতুন রীতি শিরোনামে পাঁচটি পুস্তিকায় যে গল্পগুলি প্রকাশিত হয় তার মধ্যে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জটায়ু’ আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিজনের রক্তমাংস’ আমাদের চোখ এড়াই নি । পঞ্চাশের দশকের শেষে কৃত্তিবাস কবিতা-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কিছু কবি কিছুটা চমক, কিছুটা তথাকথিত বোহেমিয়ান জীবনের প্রদর্শক মিথ আর প্রচারের মাধ্যমে পরিচিত হন । কৃত্তিবাসের কবিরা বলতেন সাহিত্যে, কবিতায় মুখের ভাষা ব্যবহার করতে হবে । কে, কাকে, কী পরিস্থিতিতে, কী বিষয়ে, কেন কথা বলছে সে অনুসারে মুখের ভাষা সব সময় পালটাচ্ছে । এর মধ্যে কোন মুখের ভাষাটা সাহিত্যে ব্যবহার্য ? হাংরি আন্দোলনের চ্যাঁচামিচিতে দাদা-র বিভিন্ন ইস্তাহার আর বিট জেনারেশনের বিভিন্ন উক্তির এলোমেলো প্রতিধ্বনি আর আর্ত চিত্কার শোনা যেত । এর কোনোটাই আমাদের সন্তুষ্ট বা সে অর্থে আকর্ষণ করতে পারেনি । আর শেষ পর্যন্ত লেখা আর লেখার যাবতীয় আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কী নিয়ে লেখা হবে — ভালোবাসা, যৌনতা, প্রকৃতি, ব্যক্তি, সমাজ, বাস্তবতা, বিচ্ছিন্নতা, ইত্যাদি । বস্তুত আজও অবস্থাটা খুব একটা পালটায় নি । আর একদিকে গদ্যে বাস্তবতাবাদ আর অন্যদিকে কবিতায় আমি-কেন্দ্রিক রাবীন্দ্রিক রোমান্টিসিজম পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য আজও খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি । বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকীয় দৃষ্টবাদ-প্রভাবিত সাহিত্যভাবনার নিরঙ্কুশ আধিপত্যে রচয়িতার তুলনায় লিখন-নির্মিত রচনাকে , বাস্তবতাবাদ বর্জন করে রচনার সৃষ্ট বাস্তবকে গুরুত্ব দেওয়ার দৃষ্টান্ত আজও বিরল । রমানাথ এদিক থেকে আমার জানা একমাত্র ব্যতিক্রম ।
আবার ফিরে যাচ্ছি পুরনো দিনের কথায়, আমাদের চিন্তা-ভাবনা আর সন্ধানের কথায় । রচনা, রচয়িতা (রচনায় রচয়িতার স্থান, উপস্থিতি/অনুপস্থিতি), লেখা (√লিখ্ সকর্মক/অকর্মক), লিখন (ভাষা-সংগঠন, শব্দ-নির্বাচন, বাক্য), কাহিনি-কথন (পুরুষ, ক্রিয়ার কাল, দৃষ্টিকোণ বা আলোকায়ন), পঠন-পাঠ (=পুনর্নির্মাণ), পাঠ-লিখন (=আলোচনা-সমালোচনা) — এগুলিই ছিল আমাদের লেখালিখির পেছনের চিন্তা । আমাদের ছোট্ট দলটির কেমন করে লিখব চিন্তার প্রথম প্রকাশ ‘এই দশক’ বুলেটিন (১৯৬২)। রমানাথ ছিল তার হোতা । তারপর আমার দায়িত্বে বেরুল কবিতা পত্রিকা ‘শ্রুতি’ (১৯৬৪) । এর পর গল্পের পত্রিকার আকার নিয়ে ‘এই দশকের’ প্রকাশ ‘শাস্ত্র-বিরোধী গল্পের’ [শাস্ত্র √শাস্- (শাসন করা, উপদেশ বা শিক্ষা দেওয়া) -ষ্ট্রন (শাস্ত্র বিধি-বিধান, তত্ত্ব, ধর্মগ্রন্থ)] আন্দোলন বা বিদ্রোহের সূচনা হয় । ‘গতকাল পর্যন্ত আমরা ছিলাম অন্ধ, ছিলাম শাস্ত্রের হাতে বন্দী।... শিল্প ও সাহিত্যে শাস্ত্রসম্মত পথকে বর্জন করতে হবে ...সাহিত্য দীর্ঘদিনের সংস্কার ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হোক ।’ রমানাথের অধি-রাচনিক বাচনের উদ্ধৃত এই অংশের উপাদান তিনটি বাক্য ।প্রথম বাক্যটি কমা দ্বারা যুক্ত দুটি সরল বাক্যের সমবায়ে গঠিত যৌগিক বাক্য, ইতিহাস-নির্দেশক সরল অতীত কাল ( ছিলাম) । পরের দুটি বাক্য সরল বাক্য ।দ্বিতীয় বাক্যে যৌগিক ক্রিয়ার (- তে+√হ-) ঔচিত্য-করণীয়-নির্দেশক ভবিষ্যৎ কাল আর তৃতীয় বাক্য আকাঙ্ক্ষা-নির্দেশক অনুজ্ঞা ব্যবহৃত । এর মধ্য দিয়ে গল্পে (শিল্প-সাহিত্যে) শাস্ত্র-বিরোধী আন্দোলনের অবস্থান ও অভীষ্ট স্পষ্ট: ইতিহাস / অতীত — করণীয়/ লক্ষ্য — সংস্কার / কুসংস্কার থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ।
মার্ক টোয়েন-এর উপন্যাস Adventures of Huckleberry Finn-র শুরুতে একটা বিজ্ঞপ্তি রয়েছ:
Persons attempting to find a motive in this narrative will be prosecuted;
persons attempting to find a moral in it will be banished ;
persons attempting to find a plot in it will be shot...
যারা এই আখ্যানের মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে;
যারা এর মধ্যে কোনো নীতি-উপদেশ খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের নির্বাসিত করা হবে ;
যারা এর মধ্যে কোনো কাহিনি খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে তাদের গুলি করা হবে...
মার্ক টোয়েন-এর উপন্যাসের এই উপরচনার তৃতীয় বাক্যটি শাস্ত্র-বিরোধীদের বিভিন্ন ইস্তেহারে ব্যবহৃত হয় । দশটি প্রস্তাবের ঐ ইস্তেহারের উত্পাদক ছিল রমানাথ, এই বাক্যের মধ্যে যে নাগরিক হাস্যরস রয়েছে তা রমানাথের কিছু কিছু লেখার অন্যতম চরিত্রলক্ষণ হয়ে দাঁড়ায় । এছাড়া এই দশকের প্রথম সংখ্যার ঘোষণায় একটি বাক্য ছিল: অতীতের মহৎ সৃষ্টি অতীতের কাছে মহৎ, আমাদের কাছে নয় । এই বাক্যটি ছিল অঁতোন্যাঁ আর্তো-র (Antonin Artaud) ‘নাটক আর তার প্রতিরূপ’ (Le Théâtre et son double) বইয়ের ‘মহৎ সাহিত্যকর্মের ব্যাপারটার ইতি করা যাক’ (En finir avec les chefs d'œuvres) প্রবন্ধ থেকে নেওয়া একটি বাক্যের ( Les chefs-d'œuvres du passé sont bons pour le passé : ils ne sont pas bons pour nous ) অনুবাদ । মার্ক টোয়েন আর আর্তো-র রচনার ব্যবহার রমানাথের, শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের চিন্তার আন্তঃসাংস্কৃতিকতা আর রচনার আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতার স্বাক্ষর।
আসলে আমরা বাংলায় লিখলেও বাংলায় কী লেখা হয়েছে, হচ্ছে তার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কী লেখা হচ্ছে, বিশেষ করে কীভাবে লেখা হচ্ছে তার খবরাখবর রাখতে চেষ্টা করতাম । বলা যায় আজকের যুগের রচনার অন্তঃসাংস্কৃতিক আর আন্তঃসাংস্কৃতিক আন্তঃরাচনিকতা সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম । রমানাথ পয়সা পেলেই কফিহাউসের ওপরে রূপা কোম্পানির, গ্র্যান্ড হোটেলের আর্কেডের বইয়ের দোকান থেকে নতুন বই কিনত । ইতিমধ্যে রমানাথ ফরাসি ‘নতুন উপন্যাস’ (Nouveau Roman) আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল । বোধ হয়, ওই সময়ে বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে একমাত্র রমানাথই ইংরেজি অনুবাদে আল্যাঁ-রব গ্রিয়ে ( The Jealousy/ La Jalousie, The Voyeur/ Le Voyeur) , স্যামুয়েল বেকেট (Molloy , Malone Dies , The Unnamable ), ক্লোদ সিমোঁ (The Passage to Milan/ Passage de Milan, The Modification/ La Modification ), নাতালি সারোত (The Age of Suspicion/ L'Ère du soupçon, The Planetarium/Le Planetarium), ইতালো কালভিনো ( The Nonexistent Knight/ Il cavaliere inesistente, Invisible Cities/ Le città invisibili), পিটার বিকসেল (A Table is a Table/ Ein Tisch ist ein Tisch) ইত্যাদি লেখকের লেখা পড়েছিল । ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘একটা নতুন উপন্যাসের জন্য’ বইয়ের ‘কিছু বাতিল হওয়া ধারণা সম্পর্কে’ (Sur quelques notions périmées, 1957) প্রবন্ধে রব-গ্রিয়ে উপন্যাসে চরিত্র, কাহিনি, প্রকরণ ও বিষয়ের দ্বৈত অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, অন্য দুটি প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘নতুন উপন্যাস একটা তত্ত্ব নয়, একটা অনুসন্ধান’, নতুন উপন্যাসে ‘বাস্তববাদের বদলে রয়েছে বাস্তব’ । রমানাথ এসব পড়ে ভাবত, আলোচনা করত।
প্রসঙ্গত দুটি মজার ঘটনা বলছি । ১৯৬৩ বা ১৯৬৪ সালে বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের কর্তৃপক্ষ মার্কাস স্কোয়ারে সম্মেলনের বার্ষিক প্রদর্শনীতে বিনিপয়সায় আমাদের ছোট একটা স্টল দিয়েছিল । স্টল সাজানোর রেস্ত আমাদের ছিল না, তাই আমরা চারদিকে নানান স্লোগান ঝুলিয়ে দিলাম, তারপর হঠাৎ একটা ঘট পাওয়া গেল । কী করা যায়? আমরা তখনো তথাকথিত মঙ্গলঘটের সংস্কার থেকে বেরুতে পারিনি। আমি রমানাথকে কলেজস্ট্রিট মার্কেট থেকে একটা ডাব নিয়ে আসতে বললাম । কোনো এক অজানা কারণে সেদিন সন্ধ্যের বাজারে ডাব না পেয়ে রমানাথ ডাবের বদলে একটা ছোট কাঁঠাল (এঁচড়) নিয়ে এসেছিল । এঁচড় দিয়ে কী করা যায় ? আর কিছু না ভেবে এঁচড়টাকে ঘটের ওপর বসিয়ে দিলাম। প্রতিক্রিয়া অভাবনীয় ! দলে দলে লোক স্টলে এসে কেউ রাশভারি গলায়, কেউবা চটে লাল হয়ে, কেউবা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করতে লাগল ঘটের ওপর এঁচড়, এর মানেটা কী ? আমরা ‘মানে’ তৈরি করতে থাকলাম। ঘট আর ডাবের রচনা = (শাস্ত্র, সংস্কার অনুসারী ) মঙ্গলঘট, কিন্তু ঘট আর এঁচড়ের রচনা = ? মানে? মানে তো সবসময় পঠনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় । এসব কথায় অনেকে কৌতূহলী হল, অনেকে রেগে গেল, কেউ কেউ ‘এঁচরে পাকা’ মন্তব্য করে চলে গেল। এর পরের দ্বিতীয় ঘটনাটা অন্য ধরনের, তার সংজ্ঞাপিত ‘ব্যঙ্গার্থ’ও ভিন্নতর । শাস্ত্রবিরোধী ‘এই দশক’ আর ‘শ্রুতি’, অন্তত প্রথম দিকে, রমানাথ আর আমার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণে আন্দোলন বা পত্রিকা-প্রকাশ ‘আমাদের’ যৌথ উদ্যোগে পরিণত হয়েছিল । ‘এই দশকর ’ চতুর্থ সংখ্যায় আমি প্রথম তিনটি সংখ্যায় প্রকাশিত গল্পগুলির ওপর আলোচনা করেছিলাম । অন্য দিকে ‘শ্রুতির’ চতুর্থ সংখ্যা ছিল অনূদিত কবিতার সংকলন । তাতে রমানাথ ফরাসি কবি জাক প্রেভের-এর কবিতার অনুবাদ করেছিল । আমাদের টাকা-পয়সার সংস্থানটা ছিল খুবই সীমিত । তাই কিছুটা সস্তায় ছাপানোর জন্য আমরা মির্জাপুর স্ট্রিটের শেষে আমজাদিয়া রেস্টুরেন্টের আগে দীপক প্রিন্টার্স (৪৫ সূর্য সেন স্ট্রিট) বলে একটা ছোট্ট ছাপাখানায় পত্রিকা ছাপাতে শুরু করি । ঐ ছাপাখানার মালিক বঙ্কিমবাবু (বঙ্কিম সাহা) ঢাকার পয়সাওয়ালা লোক । ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত । সম্পত্তি বদল করে বাড়িঘর সবই করেছেন । ঢাকায় ছাপাখানা ছিল, তাই বাড়ির সবার আপত্তি সত্ত্বেও এখানে ছাপাখানা করেছেন । বঙ্কিমবাবু সব সময় সুবেশ, পরনে ধবধবে শাদা ফিনফনে গিলে করা পাঞ্জাবি, ধুতি । বঙ্কিমবাবুর প্রেসে দুপুরে ছাপা হত এক ধরনের ট্যাবলয়ড । একদিন, বড় বড় হরফে শিরোনাম শোলমারির সাধু কে? নেতাজি? আরেকদিন, কুম্ভমেলায় কে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন? কেন এত গোপনে ? বিকেলে প্রেস থেকে দু তিনজন কাগজবিক্রেতা ওই কাগজগুলো নিয়ে নেতাজির নতুন খবর, বা কুম্ভমেলায় কে? কারা? চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে কাছেই শিয়ালদহ স্টেশনে চলে যেত । ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা গরম তেলেভাজার মতো কাগজগুলো কিনে নিত । বঙ্কিমবাবুর প্রেসে আর যা ছাপা হত তা হল কার্ড — বিয়ে, জন্মদিন, পৈতে, মুখে ভাত, শ্রাদ্ধ , হালখাতা, সরস্বতী-পুজো ইত্যাদির কার্ড, মফস্বলের অসংখ্য লোক স্টেশন থেকে নেমে চলে আসত এই কার্ড ছাপাতে । এখানেই আমার কাহিনির শুরু । আমাদের দলের কেউ একটা প্রেসে গেলেই বঙ্কিমবাবু সব সময় বলতেন, আপনাগো কামেই হাত লাগাইছে, কাইল বিকালে অ্যাকবার আহেন, অনেকটা প্রুফ পাইয়া যাইবেন । আপনাগো কামেই হাত লাগাইছে! কিন্তু ভেতরে গেলে দেখা যেত তিনজন কর্মীর দুজন বিয়ের কি শ্রাদ্ধের কার্ড আর তৃতীয় জন খনার বচন বা ছাত্রপাঠ্য ভূগোলের বই কম্পোজ করছে । এখন প্রুফ পেতে হলে হত্যে দিয়ে বসে থাকতে হবে । তাই সেদিনও বললাম, এই বসলাম! অন্তত কিছুটা প্রুফ না নিয়ে আর উঠছি না ।
ইতিমধ্যে বেশ লম্বা-চওড়া এক ভ্দ্রলোক প্রচণ্ড রাগে চিত্কার করতে করতে ছাপাখানায় ঢুকলেন । তাঁর হাতে সুন্দর ডিজাইন করা একটা বিয়ের কার্ড । ‘আপনাকে চেয়ারশুদ্দু তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে । দেখুন কী কান্ড করেছেন, দেখুন একবার!‘ নির্লিপ্ত, নিরুদ্বিঘ্ন বঙ্কিমবাবু শান্ত গলায় বললেন, ‘কী হইছে? বানান ভুল?‘ ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বানান ভুল ! দেখুন বদমাইশিটা একবার দেখুন! বিয়ের কার্ডে বাপের নামের জায়গায় ছেলের নাম আর ছেলের নামের জায়গায় বাপের নাম ছাপা হয়েছে ।‘ বঙ্কিমবাবু অবিচলিত শান্ত গলায় তাঁর বিশুদ্ধ পূর্ববঙ্গীয় উপভাষায় লোকটিকে বোঝালেন, পুরো ব্যাপারটার মূলে রয়েছে মেশিনের স্বেচ্ছাচারিতা । মেশিন কম্পোজ করা শব্দ, লাইন, প্যারা, পৃষ্ঠা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়, কিছুই করার নেই, খদ্দেরের কপাল । কথায় বলে, ছাপাখানার ভূত! বঙ্কিমবাবু ভেতরে চলে গেলেন, ফিরলেন হাতে একটা লাল কালির কলম নিয়ে, দেখালেন কীভাবে লাল কালিতে বাপের আর ছেলের নাম ঠিক জায়গায় লিখতে হবে । অদৃষ্টবাদীর মতো নীরবে কলমটা হাতে নিয়ে ভদ্রলোক কীরকম একটা অস্বস্তি নিয়ে টেবিলের ওপর রাখা তিনশ কার্ডের দিকে তাকিয়ে রইলেন । আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না । ভদ্রলোককে বললাম ওভাবে লাল কালিতে শুদ্ধ করলে বিশ্রী দেখাবে, একটা কাজ করুন, নতুন কার্ড কিনে আনুন, বঙ্কিমবাবু কোনো পয়সা না নিয়ে শুদ্ধভাবে আবার একবার ছাপিয়ে দেবেন । বঙ্কিমবাবু না করতে পারলেন না, ভদ্রলোক ঝড়ের বেগে নতুন কার্ড কিনতে বেরিয়ে গেলেন । প্রচণ্ড রেগে বঙ্কিমবাবু আমায় বললেন, উনি ব্যাপারটা প্রায় মিটিয়ে দিয়েছিলেন আমিই আবার গন্ডগোল পাকালাম । তারপর বললেন, ‘আসল কথাটা আমার কওয়ার কথা নয়, তাও কই, আপনার, আপনার বন্ধু রমানাথবাবু আর আপনাগো দলবলের স্বভাবটাই হইল সব কিছুতে প্যাচাল পারা আর ঝুটঝামেলা বাঁধানো । আপনাগো ল্যাখালেখিতেও দ্যাখছি তাই, উলট পালট, প্যাচাল আর ঝুটঝামেলা ।’
এই দ্বিতীয় বৃত্তান্তের তিনটি অংশ, অন্যভাবে বলা যায় এই কাহিনিতে তিনটি আখ্যান রয়েছে । প্রথম দুটি অংশ বাদ দিয়ে আমরা তৃতীয় অংশে গিয়ে দেখছি আখ্যানের চরিত্র বঙ্কিমবাবু বাইরে থেকে আমাদের লিখনকে ওলট-পালট আর ঝুটঝামেলা বা ‘প্যাচাল‘ (গণ্ডগোল, বাজে কথা, তর্ক, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ; পৃ. ১৯৭, দ্বিতীয় খণ্ড। ) ছাড়া আর কিছু বলেই ভাবতে পারছিলেন না । তাতে লৌকিক আধুনিকতার লক্ষণ রগরগে যৌনতা বা আবেগের উচছ্বাস — এর কোনোটাই ছিল না । এমন কী তথাকথিত বামপন্থী বিপ্লবী স্লোগানও নয় । আবার ‘মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে । কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়’ — ইয়োরোপের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আর শিল্প-সাহিত্যর ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তের মিথষ্ক্রিয়ার উত্পাদন ক্ষণস্থায়ী দাদা আন্দোলনের সমাপ্তির বহুকাল পরে জুরিখের ‘কাবারে ভলতের’ থেকে বহু দূরে কলকাতা নামক গাঁয়েঁর চণ্ডীমণ্ডপে দাদা-র সাহেবদের কণ্ঠস্বরের নকল করে এ জাতীয় অর্থহীন ভড়ং বা প্রলাপের চিত্কার করাও আমাদের লেখায় ছিল না । তাহলে এগুলি কী? সাধারণ পাঠকের সাহিত্য, গল্প, কবিতা সম্পর্কে গড়ে ওঠা ধারণার বাইরের, বাংলা ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস তথা পরিগ্রহণ দ্বারা গড়ে ওঠা আর নিয়ন্ত্রিত তার প্রত্যাশার দিগন্তের (Erwartungshorizont ) সীমানা পেরুনো আমাদের এই রচনাগুলিকে পরিগ্রহণ করা বাঙালি পাঠকদের অনেকের পক্ষেই তখনো সম্ভব ছিল না ।
আসলে ক্ষণস্থায়ী ‘শ্রুতি’ বা তার চেয়ে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী পত্রিকা শাস্ত্রবিরোধী ‘এই দশক’ ছিল আমাদের অনুসন্ধানের কাল । আমরা খুঁজছিলাম । খুঁজছিলাম আমাদের প্রত্যেকের, নিজস্ব সৃজনশীলতার পরিচায়ক ‘আমার’ লিখন। ‘শ্রুতি’ আর ‘শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’ ছিল সমবেতভাবে বা /এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সন্ধানের ইতিহাসের একটা অধ্যায় ।
এই দ্বিতীয় বৃত্তান্তের তিনটি অংশ, অন্যভাবে বলা যায় এই কাহিনিতে তিনটি আখ্যান রয়েছে । প্রথম দুটি অংশ বাদ দিয়ে আমরা তৃতীয় অংশে গিয়ে দেখছি আখ্যানের চরিত্র বঙ্কিমবাবু বাইরে থেকে আমাদের লিখনকে ওলট-পালট আর ঝুটঝামেলা বা ‘প্যাচাল‘ (গণ্ডগোল, বাজে কথা, তর্ক, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ; পৃ. ১৯৭, দ্বিতীয় খণ্ড। ) ছাড়া আর কিছু বলেই ভাবতে পারছিলেন না । তাতে লৌকিক আধুনিকতার লক্ষণ রগরগে যৌনতা বা আবেগের উচছ্বাস — এর কোনোটাই ছিল না । এমন কী তথাকথিত বামপন্থী বিপ্লবী স্লোগানও নয় । আবার ‘মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে । কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়’ — ইয়োরোপের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আর শিল্প-সাহিত্যর ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তের মিথষ্ক্রিয়ার উত্পাদন ক্ষণস্থায়ী দাদা আন্দোলনের সমাপ্তির বহুকাল পরে জুরিখের ‘কাবারে ভলতের’ থেকে বহু দূরে কলকাতা নামক গাঁয়েঁর চণ্ডীমণ্ডপে দাদা-র সাহেবদের কণ্ঠস্বরের নকল করে এ জাতীয় অর্থহীন ভড়ং বা প্রলাপের চিত্কার করাও আমাদের লেখায় ছিল না । তাহলে এগুলি কী? সাধারণ পাঠকের সাহিত্য, গল্প, কবিতা সম্পর্কে গড়ে ওঠা ধারণার বাইরের, বাংলা ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস তথা পরিগ্রহণ দ্বারা গড়ে ওঠা আর নিয়ন্ত্রিত তার প্রত্যাশার দিগন্তের (Erwartungshorizont ) সীমানা পেরুনো আমাদের এই রচনাগুলিকে পরিগ্রহণ করা বাঙালি পাঠকদের অনেকের পক্ষেই তখনো সম্ভব ছিল না ।
আসলে ক্ষণস্থায়ী ‘শ্রুতি’ বা তার চেয়ে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী পত্রিকা শাস্ত্রবিরোধী ‘এই দশক’ ছিল আমাদের অনুসন্ধানের কাল । আমরা খুঁজছিলাম । খুঁজছিলাম আমাদের প্রত্যেকের, নিজস্ব সৃজনশীলতার পরিচায়ক ‘আমার’ লিখন। ‘শ্রুতি’ আর ‘শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’ ছিল সমবেতভাবে বা /এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সন্ধানের ইতিহাসের একটা অধ্যায় ।
1 মন্তব্যসমূহ
পুষ্কর দাশগুপ্ত, এই বানানটিই জানতাম। পুস্কর বানান কি পুষ্করদার অনুমোদিত? তাহলে আমি কি ভুল জানি? লেখাটি অত্যন্ত মূল্যবান। সংগ্রহে রাখার মত। আসলে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ বলতেই আমরা সাহিত্যিকদের কলমে বুঝি কিছু অ্যানেকডোট আর অনেক সেন্টিমেন্টার ভ্যাদভ্যাদানি। পুষ্করদা চিরদিন পান্ডিত্যে আর সততায় আমাদের সম্মোহিত করে রেখেছিলেন... বা সম্মোহিত শব্দটিও অন্তঃসারশূন্য ও ভ্যাদভেদে, আসলে বুদ্ধিকে জাগিয়ে দিয়ে পাঠককে চেতন করে তোলেন পুষ্করদা। রমানাথ রায়কে আমার ছোট বেলা থেকে ভাল লাগত, আনন্দবাজারে তাঁর একটি করে গল্প শারদ সংখ্যায়, প্রথমেই মন দিয়ে পড়তাম, বুঝতাম একেবারে অন্য ঘরানার লেখা পড়ছি। আর কাউকে সেভাবে নজর করে পড়তে পারিনি। যেখানে ফরাসি সাহিত্য থেকে শুরু করে কনটিনেন্ট-এর সব সাহিত্যে ফর্ম নিয়ে অসংখ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, সেখানে, এই বাংলায় বুদ্ধ্যহংকারের জমানায় বসেও এই আন্দোলন নিয়ে পড়াশুনো প্রায় শূন্য । আজ এই লেখার সবটা মিলিয়ে আজ যেন শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন, ভাষা ও "কেমনভাবে লেখা হবে"এই আন্দোলন সম্বন্ধে অনেক অনেক আলো পেলাম। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন