মোমিনুল আজমের গল্প : জীন


সন্ধ্যার ঠিক পরে, সূর্য পৃথিবীর অপর পৃষ্টে চলে যাবার কারনে তার তেজি রস্মি যখন অন্ধকারের কাছে সম্পূণর্ পরাজিত হলো, আবার চাদের স্নিগ্ধ রুপালি আলো আংশিক পরাজিত করে অন্ধকারকে যখন ম্লান করে তার দ্যুতি ছড়াচ্ছিল, ঠিক সে সময়টাতে জটাধারি হরিহর ফকির কুল গাছের একগোছা কাটাসমেত ডাল, এক নোটা বিলের স্বচ্ছ জল, জ্যান্ত দুটো মোরগ নিয়ে বাড়ির উঠোনের ঠিক মাঝখানটায় বসে জীন ছাড়ানোর লক্ষ্যে এক নাগাড়ে উচ্চস্বরে মন্ত্র পড়া শুরু করলো।
জীনের আছর লাগা মর্জিনা হাত পা বাধা অবস্থায় হরিহর ফকিরের সামনে দু হাটুর মাঝে মাথা লুকিয়ে থর থর করে কাপছে। পাড়ার ছেলে, বুড়ো, মধ্যবয়সি সবাই জিনের শাস্তি দেখার জন্য ফকির এবং মর্জিনাকে কেন্দ্রে রেখে মহা উৎসাহে দাড়িয়ে আছে। এই আয়োজনে মেয়েদের আসা নিষেধ কারন জীন যখন মর্জিনাকে ছেড়ে যাবে তখন বিরহ জ্বালায় সে অন্য কোন মেয়ের উপর আছর করতে পারে। কিন্তু অতি উৎসাহের কারনে আসে পাশের দু গ্রামের নানা বয়সি মেয়েরা বিকেল থেকে মন্ডল বাড়ির সবগুলো রুম দখল করে নিয়েছে। জীন চলে যাবার মূহুর্তটি তারা বেড়া, দরজা, জানালার ফাঁক গলে অবলোকন করতে চায়।

মর্জিনা কাজের মেয়ে। কাজ করতে করতে তার বেড়ে ওঠা। ছয় বছর বয়স থেকে এ বাড়িতে থাকার কারনে সে মন্ডল বাড়ির পারিবারিক সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে মন্ডলের বদান্যতায়। তবে বাড়ির যাবতীয় কাজের ভার তাকে নিতে হয়েছে। মন্ডলের বউ কোমড়ের ব্যাথার কারনে দুপা হেটে বাথরুমে যাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ করতে পারে না।

কাক ডাকা ভোর থেকে নিশুতি রাত পর্যন্ত কাজের চাপে শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই সতেরটি বছর পার হওয়ার পর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যতটা লাবন্য থাকার কথা তা নেই, লম্বা চুলের যত্ন না নেয়ায় তা মাঝে মাঝে জটায় পরিনত হয়েছে। অপুষ্ট শরীরে মাথা ঘোরা ব্যামোর কথা সে অনেকবার বলেছে মন্ডলের বউকে। ওটা কিছুনা বলে মন্ডলের বউ মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ কবোজের ব্্যবস্থা করেছে। একবার মাথা ঘুরে সিড়ি থেকে পড়ে গেলে মন্ডল উঠোন ঘরের ভৃত্য ময়েজকে পাঠিয়ে কবিরাজের কাছ থেকে এক কৌটা সালসার ব্যবস্থা করেছিল। পোড়া মবিলের মতো সে সালসা খেয়ে তার হয়ে যায় জন্ডিস। সে জন্ডিস সারতে সারতে মর্জিনার উপর ভর করে জীন। একা একা কথা বলা, মাঝ রাতে হঠাৎ গান গেয়ে ওঠা, হিহি করে হেসে ঢলে পড়া কিংবা কারন ছাড়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়া এসবই মর্জিনার উপর জীনের কায়কারবার। তার এ অস্বাভাবিক আচরন নিয়ে কথা বললে সে হাসে, মাঝে মাঝে জীনের সাথে তার বসবাসের কথাও স্বীকার করে।

মর্জিনার সেই জিন তাড়ানোর আয়োজনের আগে মন্ডল বাড়ি বন্ধ করা হয়েছে, এজন্য বাড়ির চার কোনায় চারটি লম্বা বাসের ডগায় চারটি মাটির হাড়ি স্থাপন করা হয়েছে, প্রতিটি ঘরের কোনায় চাল কুমড়ার খোল এবং দরজায় নীচে আল্লার কালাম লেখা তাবিজ পুতে দেয়া হয়েছে। দুটি জ্যান্ত পাঠা মোরগ ধরে রাখা হয়েছে সেই সকাল থেকে। হরিহর ফকির জীন তাড়ানোর জন্য দুধে গোসল করে পূত পবিত্র হয়ে আসবেন সে কারনে দুপুরের আগেই আধামন দুধ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তার বাড়িতে।

আগর বাতি, কর্পুরের গন্ধ আর ধোঁয়া, হরিহর ফকিরের উচ্চস্বরের মন্ত্র, অগনিত দর্শকের পিনপতন নিঃস্তব্দতায় মন্ডল বাড়ির উঠোনে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে । ভিন গ্রহের এক আত্নার সাথে কথা হবে মন্ডল বাড়ির আঙ্গিনায় এটি যেমন অবিশ্বাস্য তেমনি তা ভয়েরও। মনে ভয় থাকলেও এ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে চায় সবাই।

জীনের সাথে হরিহর ফকিরের জেরা শুরু হয় এভাবে;

তোর নাম কি?
-মর্জিনা।
সত্যি করে বল তোর নাম কি?
-মর্জিনা।
তুই কতদিন ধরে এ বাড়িতে?
-ছয় বছর বয়স থেকে।
তোরা কয়জন থাকিস?
-আমি একা।
তোর বাড়ি কই?
-এটাই মোর বাড়ি।
মর্জিনার সাথে তোর সম্পকর্ কী?

এ প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকে মর্জিনা; কী জবাব দেবে তার কোন কুলকিনারা পায় না। জবাব ভুল হলে হরিহর ফকির কী তাকে মারবে? তার পাশে রাখা বড়োইয়ের ডালগুলোর দিকে তাকিয়ে তার হাত পা কাপতে থাকে।

হরিহর ফকির উচ্চ স্বরে মন্ত্র যপতে যপতে চিৎকার করে বলে-

শয়তান তুই তোর নাম পরিচয় সহজে বলবি না। এই বলে কুল গাছের দুটো ডাল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে দুর্বল মর্জিনার উপর। সপাং সপাং করে মারতে থাকে হাত পা বাধা মর্জিনার পিঠে। সে মারে মর্জিনার পিঠের জামা ছিড়ে প্রথমে দেখা যায় সাদা চামড়া , পরে তা রক্ত বর্ন ধারন করে। জ্ঞান হারানোর আগে সে ক্ষীন কন্ঠে বলে-

-মুই জীন, খারাপ জীন।

মর্জিনার মুখে এ স্বীকারোক্তি শোনার পর হরিহর ফকিরের ঘামে ভেজা মুখ চাঁদের স্বল্প আলোয় চকচক করে ওঠে। নোটায় ভরা বিলের স্বচ্ছ জলের খানিকটা মর্জিনার মুখের উপর ছিটিয়ে দিয়ে রাম নাম জপতে থাকে। উপস্থিত লোকজনের মাঝেও গুঞ্জন শুরু হয়। লাইনে দাড়িয়ে থাকা শিশুরা তাদের বাপ ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে গায়ের সাথে সেটে থাকে। জীনের আচর লাগা মর্জিনা জ্ঞান হারিয়ে মাটির উপর নিথর পড়ে থাকে।

সামান্য দম নিয়ে হরিহর ফকির নতুন উদ্যোমে মন্ত্র জপতে শুরু করে। সে বলতে থাকে-

-তোকে এক্ষুনি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। যাওয়ার আগে প্রমান দিয়ে যেতে হবে।

মর্জিনার পক্ষ থেকে কোন জবাব আসে না। দুতিনবার একই প্রশ্ন করার পর জবাব না পেয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলে-

- অনেক ধুরন্ধর জীন, একে শক্ত হাতে বিদায় করতে হবে;

এই বলে আবার ঝাপিয়ে পড়ে মর্জিনার উপর। কাটা সমেত কাঠি দিয়ে চার পাঁচ ঘা দেয়ার পরও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে হরিহর ফকির নতুন পন্থা বের করে। ব্যাগ থেকে বের করে শুকনো মরিচ। লাইটারের আগুন দিয়ে সে মরিচ জ্বালিয়ে তা ধরে মর্জিনার নাকের কাছে।

খক খক করে কাশি দিয়ে অনেক কষ্টে উঠে বসে মর্জিনা। ফোলা এবং ঘোলাটে চোখে হরিহর ফকিরের দিকে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বলেঃ

-আমাকে আর মেরোনা বাবা, আমি মরে যাব।

হরিহর ফকির গলার স্বর গম্ভীর করে বলে;

তোকে আর মারবো না, তবে তোকে এক্ষুনি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে এবং আর কোনদিন আসবি না। যাওয়ার সময় প্রমান দিয়ে যেতে হবে। এ বাড়ির কোন গাছের ডাল ভেঙ্গে অথবা টিনের চালে ঢিল ছুড়ে একেবারে চিরদিনের জন্য বিদায় হয়ে যা।

আমি এখুনি চলে যাচ্ছি; আর কোনদিন এ বাড়িতে আসবো না।

এ কথা শোনার পর সবার মাঝে গুঞ্জন শুরু হয়; সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে প্রমানের। ঘটনা কী হলো, জীন কী বললো তা অন্দর মহলে প্রমোট করার দায়িত্ব নিয়েছে মোল্লা বাড়ির একটি ছেলে সেলিম। সেলিমকে   প্রায়ই দেখা যায় স্কুলে যাওয়ার সময় মাঠের কোনায় দাড়িয়ে থাকতে। মন্ডল বাড়ির স্কুলে পড়া মেয়েটা তা আবার ঘরের সবাইকে জানিয়ে দেয়। এভাবে কেটে যায় অনেকটা সময়। হরিহর ফকির উচ্চস্বরে মন্ত্র পড়ে আর বলে;

-এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি কিনা বল?

জীন কিংবা মর্জিনা কারো কাছ থেকে কোন উত্তর আসেনা। বিরক্তির রেখা ফুটে ওঠে হরিহর ফকিরের কপালে । একগোছা কুল এর কাটা নিয়ে আবার ঝাপিয়ে পড়ে মর্জিনার উপর। প্রথম দিকে মর্জিনার উ আহ শব্দ শোনা গেলেও পরে আর কোন শব্দ পাওয়া যায়না। হরিহর ফকির ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে টুলের ওপর। তার চোখে মুখে ভর কর দুঃশ্চিন্তা। জ্যোৎস্নার মৃদু আলোতেও তার কপালের ভাজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কিছুক্ষন পর বড় এক ঢিল এসে পড়ে মন্ডল বাড়ির টিনের চালে। উপস্থিত সবার মাঝে ভয় মিশ্রিত গুঞ্জন শুরু হয়। তারপর আরও একটি। এইভাবে গোটা পাঁচেক ঢিল পড়লে সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাদের ভয় কেটে গেছে। এতোক্ষন নেপথ্যে থাকা মন্ডল দৌড়ে এসে হরিহর ফকিরের হাত জড়িয় ধরে বলে;

-বাবা আপনি আমাকে বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা করলেন!

মন্ডলের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সবার আগে গেটের দিকে পা বাড়ায় হরিহর ফকির। কাজ শেষে পাঠা মোরগ দুটো তার নেয়ার কথা ছিল, তা না নিয়েই হন্ত দন্ত হয়ে ছোটে সে। দু তিন গ্রামের লোক একে একে বের হতে থাকে মন্ডল বাড়ির ছোট গেট দিয়ে।
মর্জিনা নিথর হয়ে শুয়ে আছে। তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল সামান্য কাঁপে। অস্ফুট গলায় বলে ওঠে--পানি। পানি।

মন্ডলের স্কুলে পড়া মেয়েটি পানি আনতে পাতকুয়ায় যায়।  সেখানে সেলিম মাথা নিচু করে হাত ধুচ্ছে। তার ডান হাতের একটি আঙুল সামান্য কেটেছে। তখনো একটু একটু রক্ত বের হচ্ছে। মেয়েটি আঁতকে ওঠে। বলে, ও খোদা! কাটলো কেমনে!

সেলিম তার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসে। বলে, তোমাগো মাটির ঢেলার মইদ্যে ভাঙ্গা শামুক  ছিল। খেয়াল কইরা দেখি নাই। ঢিল ছুড়তে গিয়া কাইটা গেছে।
মেয়েটি কোনো কথা বলে না।  কয়েকটি যশুরে লতার পাতা ডলে ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে দেয়। এদিক ওদিক দেখে। নিশ্চিত হয়-- কেউ তাদের দেখতে পায়নি। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, চাইপা ধরুন। রক্ত পড়া থাইমা যাবে।


লেখক পরিচিতি
মোমিনুল আজম

জন্মেছেন - ১৯৬৫ সালে, গাইবান্ধায়
পড়াশুনা করেছেন- শের ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে
কাজ করেন- বাংলাদেশ ডাক বিভাগে
বর্তমানে- কানাডায় থাকেন
ফিলাটেলি- ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ নামে একটি প্রকাশনা আছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ