টানাপড়েন-২

অনিন্দ্য আসিফ

দু’পর্দার মাঝখানে সে তার দশ আঙুল ডুবিয়ে দিলে পর্দাগুলো প্রথমে ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠে। তারপর অলস চোখের পাতার মতো আস্তে ধীরে খুলে গেলে তরুণীর চোখের মতো স্বচ্ছ কাঁচের জানালা স্পষ্ট হয়। সাত তলার উপর জানালা ঘেঁষে উঁকি, উবু এবং ডানে বামে কাত হয়ে ছোট্ট এই শহরের সবুজ পালকে তার স্বচ্ছ জলের মতো দৃষ্টি উড়িয়ে দেয়। আমারতো তার সবকিছুতেই সাবলীল আগ্রহ। তারই পুনরাবৃত্তিতে এই দৃষ্টিখেলা আকণ্ঠ পান করার এক পর্যায়ে বলি, কী দ্যাখো? ইতোমধ্যে কিছু বিষয় গুছিয়ে রেখেছিলাম। আর সম্ভাব্য কিছু প্রশ্নের উত্তরও জড়ো করেছিলাম দুঠোঁটের খুব কাছাকাছি। যেন মুখস্তবাজ বক্তার মতো চট করে বলে দিতে পারি।
এখন সেগুলো দামাল শিশুদের গোসল করা চৈতের পুকুরের জলের মতো সব ঘোলা হয়ে গেল মনে হয়। টেবিলে রাখা স্কুল বালকের পিঠে চড়া ব্যাগের উপর আমার ডান হাতটা রাখি। আঙুলের মাথায় যেন ঘামে ভেজা কম্পন চিকন ডালে বসা পাখির মতো দুলে উঠে। ব্যাগের ভেতর কী? ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসা রঙিন কাগজে মোড়া প্যাক আর আমার আবেগকে যেন অবজ্ঞা করে তার ভ্রুসহ কপালের বলিরেখা দলামচা হয়ে ওঠে। বলে, প্যাকের ভেতর কী? খুলেই দ্যাখো না। সংসারের নিত্য ব্যবহৃত হলুদ মরিচের প্যাক খোলার মতো সহজ ভঙ্গিতে রঙিন কাগজের ভাঁজ ভেঙে ভেতর থেকে কাঁচ আর আমার পরমানুভূতির আঁখরে বাঁধাই ফ্রেমে তার ফটোগ্রাফ টেবিলের উপর নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তারপর আমি যা কল্পনা করেছিলাম পুরোপুরি তার চিত্রায়ন হয়। টেবিলের উপর ঠেসে ধরা দু’কনুইর উপরে বৃত্তাকার করতলে থুতুনি ডুবিয়ে চোখ দুটো কচ্ছপের মাথার মতো গর্ত থেকে বের করে বিস্ময় প্রকাশ করে। বলে, আমি অ্যাতো সুন্দর? তারপর ফটোগ্রাফের উপর ঝুঁকে থেকেই আমার দিকে কাঠটোকরার ঠোঁটে গড়া গর্তের মতো চোখ তুলে বলে, এই জন্যেই রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলে? বাড়িতেই তো দেয়া যেতো? আমার শরীর থেকে তখন যেন এই প্রথম বালকবেলার কাদামাটি ঝরতে থাকে। ফলে বৃষ্টিস্নাত ঝরঝরে পুরুষ হয়ে উঠি দ্রুত। বলি, আজ ১০ ডিসেম্বর।

এখন বাইরে নষ্ট ডিমের কুসুম রঙা পড়ন্ত বিকেল। নিশিকানন থাকুক না-থাকুক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ফুল ফোটা বসন্তের মতো ক্রমাগত ১০ ডিসেম্বর তিন সাল পর আজ ভারাক্রান্ত হয়ে আমার দিকে ঝুঁকে আছে। আমি ঝুঁকে আছি মুঠোবদ্ধ গ্লাসের ভেতরে স্পষ্ট তরলের উপর। মনে হয় তরলের রঙ রঙিন হলে ভালো হতো। তবে গত ৪ ডিসেম্বরের বেনিআসহকলা-র অক্ষরে লেখা গল্পের সাথে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকতে পারতো। গত ছ’দিন ধরে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই গল্পটা আমি পড়ে যাচ্ছি নিয়মিত। কিন্তু কখনোই শেষ করতে পারি না। তার আগেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বুড়োদের ছানি পড়া চোখের মতো নয়, শিশুদের ছলছল চোখের মতো। তখন গল্পটা বেমালুম ভুলে যেতে চাই। ভাবতে চেষ্টা করি সৌর জগতে ৩৬৪ দিনে এক বছর। এখানে ৪ ডিসেম্বর নেই। তখন পাশার মতো সিগেরেটের খেলা নিয়ে মেতে উঠি। যে খেলাটা শূন্য দশকের মাঝামাঝিতে যখন কবিতায় নব্বই দশকের কবিদের কাজের বৈচিত্র্য নিয়ে নানান আলোচনা, আমরা তখন প্রায় রাতে জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের সম্মুখ বেয়ে কখনও পুলিশ সুপারের বাসা আবার কখনও মহিলা কলেজের সামনে দিয়ে নিশাচর হয়ে ঘুরতাম তার ফাঁকে কখনও চাঁদের কখনও ল্যাম্পপোস্টের আলোয় উপভোগ করতাম। সহজ কথা হলো ৪ ডিসেম্বর নিশিকাননের বিয়ে হয়ে গেছে। শেষমেশ একটা আফসোস থেকেই গেল যে দীর্ঘসময় পাশাপাশি থেকেও তাকে কখনও বলতে পারিনি যে তার জন্য আমার ভেতর কী হয়? অবশ্য ইতোমধ্যে ঠিক করেছি আজ থেকে তার জন্য সবকিছুর কী-কে অতিক্রম অথবা ভুলে যেতে হবে। তাই অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলে পথে নামলেও এই অনুভবে ভালো লাগতে শুরু করে যে চোখের সামনে থেকে নিশিকাননের জরিমাখা মুখটা শাদা মেঘের মতো সরে যেতে থাকে। অর্থাৎ যেন চাপমুক্ত হতে থাকি। অথবা চাপমুক্ত হতেই কিনা বহুদিন পর আমাদের মফস্বলের ছারপোকা আর আঁশটে গন্ধবিশিষ্ট সিনেমা হলে ঢুকি। তারপর মনযোগ দিয়ে সেই সিনেমাটা দেখি যেখানে নায়ক তার বউকে ফুলশয্যায় রেখে জুয়ার টেবিলে বসে। এবং হারতে হারতে শেষ রাতে শেষমেশ অস্পৃষ্ট বউকে বাজিতে ধরে এবং হেরে বসে। সিনেমা হল থেকে বের হয়ে অনুভব করি শরীর জুড়ে খেলা করে পরিচিত সেই আঁশটে গন্ধ। ততোক্ষণে মুঠোফোন পর্দায় রাত পৌনে দশটা। চারপাশে তখন চোখে জ্বালা ধরানো আলো। যদিও সবকিছু দৃশ্যমান, স্পষ্ট। এমনকি দূরে ফলের দোকানে ঝুলে থাকা থোকা থোকা এক একটা আঙ্গুর ফলকে মনে হয় মাইক্রোস্কোপের নিচে ধরা অণুকণার মতো বড়। অর্থাৎ ফেরারির মতো নিজেকে আড়াল রাখার প্রবণতা পুনর্বার চেপে ধরে। তারপর অন্ধগলি বেয়ে রেলপথে নামার কালে টুকটাক হাওয়া বয়। তখন জমে যাওয়া বরফের মতো আমার শরীরের প্রত্যঙ্গগুলোর নিবিড় সংযোগ ঘটে। তবু এখন অনেক কিছু ভাবতে পারি এমনকি ভাবতে ভালো লাগে। যেহেতু এখন সবদিকে নক্ষত্রবিলাপ। উপরে আদিগন্ত, দূরে-অদূরে বৈদ্যুতিক বাল্ব, রেলপথের দু’ধারে বাতাসের সংস্পর্শে জোনাকির দেহে লেগে থাকা লসিফরিনের জ্বলে ওঠা এ-সব কিছুতেই নক্ষত্র দর্শন। আমি যেখানে একটু ক্ষণের জন্য থামি সেখানে একটা বট গাছের মাথায় পাতার খুব ভিড়। এখানে স্থির অন্ধকার থাকলেও জোনাকির প্রভাবে তার পাত্তা নেই। এখান থেকে ৫০০ গজ দক্ষিণে ঝকমকে দিনালো আর মানুষের হৈচৈ। ওটা এই মফস্বলের রেলস্টেশন। আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা শীত সঙ্গে নিয়ে বহুতল ভবনের সিঁড়ি ভাঙার মতো এক পা দু’পা করে এক নম্বর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াই। পরিচিত প্লাটফর্ম। ইতোমধ্যে যশোদলের বুক ভেঙে শরীরে অজগরের মতো প্যাঁচ তুলে ময়মনসিংহগামী ট্রেন দুই নম্বর প্লাটফর্মে এসে থামে। একবার ভাবি মানুষের ভিড় ঠেলে উঠে পড়বো নাকি? কিন্তু ইচ্ছে করে না। গত শতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের মতো ট্রেনের গা ঘেঁষে ঝুলে থাকা সাইকেল, কলার ছড়ি ইত্যাদির সাথে প্রতি গেটে গানের দৃশ্যে নায়কের হাত ধরে বাংলা সিনেমার নায়িকার মতো ঝুলে থাকে মানুষ। তারপর প্রথম দেখা বাচ্চাদের উৎসুক চোখে তাকিয়ে দেখি কুয়াশা কেটে হুড়মুড়িয়ে নামা বৃষ্টির ঢলের মতো শব্দ তুলে ধীরে ধীরে ট্রেনটা কীভাবে চলে গেল। তারপর হুট করেই স্টেশটা কোলাহলমুক্ত হয়। কিন্তু নীরব হয় না। এখানে যারা থেকে যায় তারা শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। থেকে যাওয়াটাকেই তারা তাদের নিয়তি ভাবে। কিন্তু আরও কিছু পরিপাটি মহিলা ও পুরুষ থেকে গেল। ট্রেন মিস করল? হতে পারে। বাকি লোকগুলো যাদের কিছু মহিলা আর গুটিকয়েক জমে যাওয়া শিশু, যাদের খুব পরিশ্রান্ত দেখায় তারা সারিবদ্ধ লাশের মতো অথবা জীবিতাবস্থায় সারে তিন হাত কবরের মতো জায়গা পেতে শুয়ে পড়তে শুরু করে। কিছু মহিলা আর মেয়ে অবশ্য যথাসাধ্য পরিপাটি হওয়ার অভিনয় নিয়ে ঘুরঘুর করে। তারা রাতভর কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে এভাবেই ঘুরঘুর করবে। এই যেমন এখন কালোমত একটা ভাঙাচোরা মেয়ে কাঁধে বড়ো ভ্যানিটি ব্যাগ, ব্রা’র ভেতর অযাচিত টুকরো কাপড় ঢুকিয়ে পিড়ামিডের মতো বুক উঁচিয়ে আর অনবরত চুইংগামের মতো পান চিবিয়ে ঠোঁটজোড়াকে লাল করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে আমাকে পুনর্বার প্রদক্ষিণ করছে। আমি তাকে সৎ মা’র সংসার থেকে বিতাড়িত জরিনা নামে জানি। দীর্ঘক্ষণ পর বিজলীর মতো ফস করে দেশলাই জ্বেলে একটা গোল্ডলিফ ধরাই। তখন জরিনা চুরুটের ধোঁয়ার মতো আমার প্রায় শরীর ঘেঁষে দু’একবার প্রদক্ষিণ করে। আমি চোখের ঈশারায় অসম্মতি দেখাই। জরিনা র্যা ম্প মডেলদের মতো কোমর নাচিয়ে চলে যায়। তারপর এককোণে ছেড়া কাঁথা গায়ে জিলেপির মতো দলা হয়ে বসে থাকা এক বৃদ্ধার কান্না শুনে এগিয়ে যাওয়ার সময় এক নম্বর প্লাটফর্মের দক্ষিণ মাথায় বেশ চেঁচামেচি শুরু হয়। উৎসুক পাবলিকের ফাঁক গলে চোখ মেরে দেখি জরিনা তার মতোই ভাঙাচোরা একটা ছেলের ধুলোমাখা জ্যাকেটের কলার চেপে ধরে বলছে, ট্যাকা দে বান্দির পুত। এই চুতমারানি কিয়ের ট্যাকা? জরিনা তখন উগ্র পাওনাদারের মতো আরো উত্তেজিত হয়ে বলে, কাইলকে টেরেনের চিপায় ফালাইয়া তোর এই মাইরে যে কচলাইছস হেই ট্যাকা। জরিনার এই সত্যভাষণ যেন শান্ত জলের মাঝে একটা ঢিল। তাই তাদের ভিড় করে থাকা পাবলিক ঢিলখাওয়া জলের মতো বৃত্তাকারে সরে যেতে যেতে যেন মিলিয়ে যায়। লক্ষ্য করি দু’জন অপেক্ষারত সম্ভবত চট্টগ্রামগামী মহিলা যাত্রী তাদের জিবে কামড় দিয়ে উঠে। তাদের সঙ্গে থাকা পুরুষ অভিভাবক বিড়বিড়িয়ে বলে, যতোসব কুত্তার বাচ্চা। মাইয়া মানুষ ঘরে থাকবি... আমার মেয়ে হলে গলা টিপে মাইরা ফেলতাম। ছি ছি ছি... আরও ক’জনের অভিব্যক্তিতে মেয়েটার চলমান চরিত্রের সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ উঠে এল। আমি কিছুক্ষণ তাদের চেহারায়’মেয়েটি এই অবস্থায় এখন এখানে কেন, এই দায়ভার কার? এই জিজ্ঞাসা দেখার জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু খুব দ্রুত প্রত্যেকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে তৎপর হয়ে পড়ে।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে কিশোরগঞ্জ ক্লিনিকের তিন তলায় একটি রুমের সামনে দাঁড়ানোর আধ ঘন্টা আগে জেলা রেজিস্ট্রি অফিস অতিক্রম করে যাচ্ছিলাম। এ-সময়ে এই দিকটা কুয়োর তলদেশের মতো নীরব থাকে। টেনিস মাঠের মোড়েই আমি দুটো গোল্ডলিফ ধরাই। তারপর ধূমপানের ক্ষেত্রে দ্বৈত চরিত্রের অভিনয় করি। অর্থাৎ পাশার অনুপস্থিতিটা সযতনে সামলে নিই। তারপর রেজিস্ট্রি অফিস পেরিয়ে যখন গ্রন্থাগারের সামনে এসে দাঁড়াই তখন দুটো সিগেরেট একত্রে পরপর বেশ ক’টা টান দিই। এক মিনিটের মধ্যে আমার চোখে ল্যাম্পপোস্টের শাদা আলো শাদা কুয়াশা হয়ে যায়। অর্থাৎ যেন কিছুই দেখি না। যদিও খুব খারাপ লাগে না যেহেতু আমরা ধোঁয়া ও ধাঁ ধাঁ-র মধ্যেই আছি ব্যক্তি এমনকি জাতীয় জীবনে। অর্থাৎ যখন ওয়ান ইলেভেনের পর আমাদের দেশের আত্মস্বীকৃত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলটাই পূর্বের অনৈতিকতার দরুণ নিজেদের ক্ষমতার উপর ভরসা রাখতে পারেনি এবং অবশেষে একজন প্রকাশ্য স্বৈরাচারের কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় আসে; তারপর কী নির্লজ্জতার সাথেই না-তারা নূর হোসেন দিবস পালন করে। এবং সত্যিকার অর্থেই আমাদের জানামতে, একটি প্রগতিশীল দলের প্রধান ক্ষমতার লোভে তাদের জোটে এসে যোগ দেয় এবং আশানুরূপ পদবী না পাওয়ায় জনগণের হাসির পাত্র হয়ে ওঠে। এবং কী অদ্ভুত যে আমাদের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরাই বিস্ময়ে অথবা আনন্দে মুখে তালা দিয়ে যেন সার্কাস খেলা দেখে যান। এবং শিল্প সাহিত্যের কেউ কেউ এমনকি আমাদের মফস্বলের রায়হান ভাই বলে বেড়াচ্ছেন যে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে তারা নাকি প্রচ- মৌলবাদী। তাদের কেউ কেউ প্রগতিশীলতা আর উদারতার মিশ্রণে কখনও কখনও মূর্খের মতো আচরণ করে। যেমন তারা নামাজ পড়তে দেখলে নাক সিঁটকায় কিন্তু পূজা দেখে খুব আহ্লাদিত হয়। এই ধরনের মানসিক বিকলঙ্গতায় আমরা উদ্বিগ্ন এবং বিচলিত। দরজা নক করলে অলস পায়ের শব্দ তুলে একজন মা’র মতো মহিলা এগিয়ে আসেন। আমি তার মুখের বলিরেখা দেখে বুঝি তিনি দ্বীপের মা। বিকেল থেকে এই পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পর মুখে জিলেপির মতো হাসি পেঁচিয়ে এইমাত্র কথা বলি, আন্টি কেমন আছেন? ভালো বাবা, তুমি কেমন? জ্বী, ভালো। মাথা তুলে দেখি লোহার সিটে প্রবীণ গাছের মতো মোটা পেটে দ্বীপ শুয়ে আছে। দৃপ্ত পায়ের কাছে গিয়ে কিছুটা হকচকিত আর বিহ্বল হই। কারণ বহুদিন পরে দেখা এই দ্বীপের সাথে আমার পরিচিত দ্বীপের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রসালো আঙুরের মতো বের হয়ে থাকা পায়ের আঙুল থেকে গলা অবধি কম্বল দিয়ে মুড়ানো। তার উত্তরে টইটুম্বুর কমলালেবুর মতো গালের জন্য আড়ালে থাকা কালিমাখা দুটো চোখ আর ফালি করা তরমুজের মতো ঠোঁটজোড়াকে বেশ অসহায় লাগে। আমাকে দেখে অসহায় ঠোঁটে শক্তি যোগ করে বলে, কেমন আছেন? আমি উত্তর এড়িয়ে বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করি, কী হয়েছে তোমার? আপনি জানেন না? নাতো ! আমি কেবল তোমার অসুস্থতার খবর শুনে এসেছি। এতো রাতে? রাত কোথায়? মাত্রতো সাড়ে এগারো। তা তোমার কী হয়েছে বললে না ! দ্বীপ বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো লজ্জা পেয়ে ওপাশে মুখ ঘোরায়। দ্বীপের মা বলে, দ্বীপ মা হবে। এবার উল্টো লজ্জা পেয়ে আমি কুঁচকে যাই। কী অদ্ভূত! এতোক্ষণেও এই সাধারণ বিষয় আত্মস্ত করতে পারিনি! দ্বীপ বইয়ের পাতার মতো এপাশ ঘোরে। তার চোখ, ঠোঁট, চিবুক সবকিছু থেকে একযোগে মা হওয়ার গর্ব আর দীপ্তি ঠিকরে বেরুতে থাকে। আমিও সাপের মতো গত কিছুদিনের ক্লান্তি আর অবসাদের খোলস ছেড়ে নতুন আর সজীব হয়ে বেরুতে থাকি। এটা এই জন্য না যে দ্বীপ মা হচ্ছে, বরং দ্বীপ তার প্রভাষক স্বামী আর খুঁটিনাটি সংসারের ঝোঁপে সুগন্ধি ফুল হয়ে সুখে আছে এই ভেবে ভালো বোধ করি। বাচ্চার নাম কী ঠিক করলে? এখনো ভাবিনি। কী নাম রাখা যায় বলেন তো। এক মিনিট ভেবে একটা নাম বলার আগ মুহুর্তে থেমে যাই। ভাবি কী দরকার আজীবন একটা স্মৃতি বয়ে বেড়ানো। ওর বাচ্চা ওর নাম নিয়েই বেঁচে থাক। বারোটার দিকে তিনতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে ভাবি মানুষ কী চমৎকারভাবে সংসারী হয়ে ওঠে। তারপর বাইরে বেরুতে বেরুতে একটা অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ্য করি। আমার মগজ থেকে চুল বেয়ে পিতৃত্বের মতো একটা গন্ধ সারা শরীরময় ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর একা একা লজ্জানবত হয়ে একটা গোল্ডলিফ ধরাই। মা হচ্ছে দ্বীপ আর আমার শরীরে পিতৃত্বের গন্ধ। হা হা হা

ইংলিশ রাজ পরিবারের বিয়ের খবরে অতিষ্ঠ হয়ে গত এক মাস যাবত কোনও পত্রিকা হাতে নিইনি। অদ্ভূত আর হাস্যকর ব্যাপার। ক্ষুধার্ত পৃথিবী জুড়ে এতোসব খবর ফেলে সমস্ত প্রিন্ট মিডিয়াতে বিদেশি পাতার রোজকার রসালো খবর হলো কেটের শপিং, চুলের স্টাইল, পছন্দ অপছন্দের ফর্দ ইত্যাদি। আজ যখন একদা পত্রমিতার চিঠির ঘ্রাণ শুঁকে সম্মোহিত হয়ে ভাঁজ খোলার মতো পত্রিকার পাতা ভাঙি তখন মনেতে দারুণ ঝক্কি লাগে। হাজার হাজার কোটি টাকার শেয়ার কেলেঙ্কারির পাতা উল্টিয়ে ভেতরের পাতায় চোখ পেতে দেখি বাঘমারার রাইসমিলের এক নারী শ্রমিক মাত্র একশ’ টাকার বিনিময়ে তার সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছে। হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির পাশে একশ’ টাকায় ক্ষুধার্ত মা’র জীবনের স্বপ্ন বিক্রি। গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার এইরূপ বিচরণে আমরা ক্রমাগত অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ বাকশক্তিযোগে চোখ, কান, নাক তথা শরীরের সমস্ত অঙ্গাদি নিয়েও আমরা মানুষ কি-না তা প্রমাণ করে দেখানোর সময় এসেছে।

দু’বছর পর যখন পৃথিবীময় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল, বিশেষত আরব বসন্তের জ্বরে যখন আমরাও কাঁপছি তারও পরে আমাদের মফস্বলের সাহিত্যাঙ্গনে একটা দুঃখ আর মুখরোচক ব্যাপার সত্যি হয়ে উঠল। পূর্বের অনৈতিকতার অভিযোগ এনে ছড়া পরিচালনা পর্ষদ থেকে রায়হান ভাইকে বের করে দেয়া হল। মনে হলো ছড়া পরিচালনা পর্ষদ কাদা পানিতে জবুথবু ইঁদুর খেলা দেখতে চাইল। কিন্তু রায়হান ভাই সেখানে পটু একটি বাইম মাছ হয়ে উঠলেন। এবং এ কাজে তাকে সঙ্গ দিল এবং ভালোভাবেই সঙ্গ দিল পাশা, জানি, মান্নাসহ আরো ক’জন। আর তারা প্রায় কুয়োতল থেকে রায়হান ভাইকে ডাঙায় তুলে আনল। এবং অল্প দিনের মধ্যেই আঞ্চলিক ছড়া সম্মেলন নামে একটি জাতীয়মত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। আর সেখানে হয়তো বেহায়া নয়তো একেবারেই পবিত্র লোকের মতো রায়হান ভাইয়ের সজীব হয়ে উঠার চিত্র দেখে আমার দারুণ লাগে। ভাই কেমন আছেন? পঞ্চাশোর্ধ রায়হান ভাই যার কিনা হার্টে প্রবলেম চশমার ফাঁক গলিয়ে আঙ্গুর ফলের মতো চোখ বের করে বললেন, হ্যাঁ আইছো নাকি। খুব ভালো। এইটুকু নিয়ম রক্ষার উপকথা বলে রায়হান ভাই একপ্রকার পালানোর মতো করে মানুষের ঝোঁপের মধ্যে হারিয়ে যান। তাতে করে তার সাথে আমার শীতল সম্পর্কের ব্যাপারটা যেটা কি-না ভুলতে বসেছিলাম সেটা শীতঘুম শেষে ব্যাঙের মতো গর্ত থেকে মাথা তুলে। যদিও খানিকক্ষণ এই মাথাকে রায়হান ভাইয়ের সমর্থক এমনকি সমার্থক মনে হয় তবু তা ভুলে যেতে চাই সংসারের ক্ষুদ্র ত্রুটি ভেবে। কেননা চার শতাধিক কবি-ছড়াকারের মিলনমেলা থেকে একটা প্রিয় মুখ আমাকে খুঁজে নিতে হবে। আমি জানি সে আসবেই। যদিও মূলত অসম্ভব তবু সেই শিশুর তুলতুলে হাতে আমস্তক ডুবে যাওয়ার ক্ষণকে ফিরে পেতে মনটা আনচান করে উঠে। তারপর তাকে আচমকা আমার সামনেই ভাস্কর্যের মতো সটান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুলকিত আর শঙ্কিত হই। একটা অপরাধবোধ যা কি-না মূলত অপাঙতেয় তবু তাতেই আমি আচ্ছন্ন হই। কেননা দ্বীপের শুদ্ধ সংসারী হয়ে ওঠা অথবা তাতে নিপুণ অভিনেত্রী হয়ে ওঠা না ওঠার ব্যাপারে আমার সমালোচক হওয়া সাজে না। কেননা আমিতো তাদের চারজনের সংসারে অনবদ্য কিংবা অন্যায্য কোনও আসবাব নই। চারজন এইজন্য যে শুনেছি দ্বীপ আবার মা হয়েছে। কিন্তু অসুখী সংসারে দ্বীপ ক্রমাগত মা হয়ে যাচ্ছে কীভাবে তাও আমার বোধগম্য হয় না। এটা আমার কাছে একটা সমাধানহীন ধাঁ ধাঁ। আমি গোপনে আমার শরীর শুষে গন্ধ টানি। লক্ষ্য করি এখানে পিতৃত্বের কোনও ঘ্রাণ নেই কেবল পিঁপড়ের মতো সারি সারি ঘামের গন্ধ। কেমন আছেন? প্রশ্নটা মুখ থেকে নয় মনে হয় দ্বীপের বুকের কুয়োতল থেকে একদলা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে আসে। আমি বলি, কতোদিন পর। তারপর তোমার কী খবর? আপনার নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছি। একদলা মাংসল মুখম-লের গহ্বরে ঢুকে যাওয়া কয়লা কালো চোখ, ত্রিভূজের বাহুর মতো হেলে থাকা ঠোঁট আর অনেকটা নিচে কাঁঠালের মতো ঝুলে থাকা স্তন, একঝলক দেখে নেওয়া ইত্যাদি প্রত্যঙ্গাদি থেকে বুঝে নিলাম দ্বীপ আরও কতো কিছু হারিয়েছে। দ্বীপ আবার বলে, আপনার গল্প অনেক মিস করছি। নতুন কী লিখছেন? লিখছি। তোমার ই-মেইল এড্রেস দাও পাঠিয়ে দেব। দ্বীপের ঠোঁটবাকানো অদ্ভূত হাসি দেখে বুঝে নিই, জি-মেইল, ফেইসবুক ইত্যাদি সময়োপযোগি টেকনোলজি থেকে সে কতো দূরে। যদিও দেশের সামগ্রিক চিত্রানুসারে এটা কোনো ব্যাপার না যেখানে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল পর্যন্ত ফেইসবুক এমনকি টেলিভিশন বিরোধী (অবশ্য ব্যাপারটাকে আমার পশ্চাৎপদ তাই মনে হয়)। কিন্তু যে মেয়েটি শিল্পের উপর আঘাতের কারণে ছেলেদের হাত ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলো সে নিশ্চয়ই এমন হতে চায়নি। ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন দ্বীপের নাম ধরে ডাকলে সে হাতের ইশারায় তাকে কী যেন বোঝাতে চাইল। তারপর বিনয়াবনত কণ্ঠে বলল, একটু দাঁড়ান। যাবেন না কিন্তু। কিছু কথা আছে। দ্বীপের কিছু কথা-কে পিছে ফেলে ফেরারির মতো চুপি চুপি শিল্পকলা থেকে বেরিয়ে পড়ি। দৈনিক আজকের দেশ পত্রিকা অফিস যা কি-না আমাদের সাহিত্যচর্চার প্রথম পিঠ সে-টা পেরিয়ে যেতে যেতে রুদ্রের লেখা একটি কবিতার কিছু লাইনকে কোল বালিশের মতো আঁকড়ে ধরি- দূরত্ব জানে শুধু একদিন খুব বেশি নিকটে ছিলাম, একদিন শরীরের ঘ্রাণ শুঁকে তুমি বোলে দিতে : অমিতাভ আজ সমুদ্রে যেও না, আজ খুব ঝড় হবে।

আখড়াবাজারের মোড়ে এলে দেখি শিল্পকলার চেয়ে ঢের হট্টগোল। গ্রুপে গ্রুপে ছড়াকারদের হৈচৈ। ততোক্ষণে যা কিছু তাড়া করছিলো এতোক্ষণ তা-থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সুযোগ আসে। চা খাওয়ার জন্য মান্না আর পাশাকে নিয়ে একটা খুপড়িমত দোকানে ঢুকি। ঢোকার আগে একটা গ্রুপে আটকে থাকা বাবুল ভাইকে ইশারা দিয়ে আাসি। সাহিত্যের কাগজ শব্দস্রোত আর একদা এই মফস্বলে শীতল বাতাসের মতো একোণ ওকোণ বয়ে বেড়ানো নীপাকে নিয়ে যিনি আমোদে আহ্লাদেই আছেন। চেয়ারে বসতে বসতে মান্না স্বভাবসুলভ চেঁচিয়ে উঠে, মামা ৩টা চা। পাশা বলে, বাবুল ভাই আইতাছে। বলতে বলতে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কফি হাউজের অমলের মতো জানি ঢোকে। একটা সময় সারাদিনমান হর্টিকালচারের নানান ঝুপড়িতে সময় কাটানো জানিকে বেশ হতাশ আর ক্লান্ত লাগে। চশমাটা খুলে চোখ মুছতে মুছতে জানি যখন বসে, পাশাকে লক্ষ করি সে একি রকম বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন। মান্নাকে ঈঙ্গিত করার আগে মনে হয় সে এই ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তবু সে-ই জানিকে জিজ্ঞেস করে, কীরে কী হইছে? জানি কিছু বলে না। নীরবে চা’র কাপে চুমুক লাগায়। পাশা আমার দিকে গোল্ডলিফ এগিয়ে দিয়ে নিজে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় পাইলট ধরায়। জানি কখনও চুরুট-মুরুট টানে না। তার নেশা বলতে পদ্য আর অস্পৃশ্য নারীর সুধা পান। মান্নার ব্যাপারটা একি। তবে মেয়েদের প্রতি তার দারুণ অনীহা। সেই কবে লিজা নামটা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আর কোথাও সম্পৃক্ততার খবর আমাদের জানা নেই। শুনেছি ইদানিং বিয়ে করার জন্য পারিপার্শ্বিক চাপে থাকলেও সে এখনও বিয়ের ব্যাপারটা কিছুতেই আমলে নিচ্ছে না। আমি যখন পাশাকে তার ভাঙা মনের কারণ জিজ্ঞেস করতে চাই তখন হাতে একটা ট্যাবলয়েড পত্রিকা নিয়ে বাবুল ভাই আসে। পত্রিকার সাথে একটা গোল্ডলিফ রাখে আমার সম্মুখে টেবিলের উপর। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করার আগে পূর্বেরটা শেষ হওয়ার আগেই নতুন সিগেরেটটা দু’ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিই। তারপর মাথা তুলে একটু আগে যা খেয়াল করিনি সেটা এখন খুব মজা আর মনযোগ দিয়ে লক্ষ করি। বাবুল ভাই তার মাথাভর্তি চুলগুচ্ছকে নতুন বউয়ের মেহেদিরাঙা হাতের মতো খুব যত্ন করে রঙ করিয়েছে। এটা নিশ্চয়ই নীপার সাথে জুটি বাঁধার পরের কা-। কারণ তাদের দু’জনের একত্রিত হওয়ার পর এই প্রথম তার সাথে আমার দেখা। আমি পত্রিকাটা আদ্যপান্ত নাড়াচাড়া করে সাপের ছোবলের মতো ফস করে ধোঁয়া ছেড়ে উচ্চশব্দে হেসে উঠি। তারপর সবার বিমূর্ত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সশব্দে বলে উঠি, এই তবে আপনার বউসংখ্যা? মানে? তখন পাশা তার চড়–ই পাখির সত্ত্বাটাকে উন্মোচিত করতে গিয়ে আমার মতোই খানিক ধোঁয়াচ্ছন্ন ঘরটাকে কাঁপিয়ে তোলে। কিন্তু উপভোগের দারুণ মুহুর্তটাকে পাশ কাটিয়ে আমি বোকার মতো বলে উঠি, বাবুল ভাই পাশা আর জানিকে এতোক্ষণ খুব আপসেট লাগতাছিল। তাই নাকি, কেন, কী হইছে? পাশা এবার ঠোঁট গোল করে ধোঁয়ার কু-লি ছেড়ে সিগেরেট হাতের বুড়ো আঙুল কপালে ঘষতে ঘষতে বলে, এটা কোনো কথা হইল, ছড়াকার সংসদ প্রতিষ্ঠা থেকে এত্তো বড়ো প্রোগ্রাম করতে কইতে গেলে মাথার ঘাম পায়ে ফালাইছি। অথচ কিনা এখন দেখি সব কৃতিত্ব রায়হান ভাইয়ের। বাবুল ভাই আপনিই কন, আমরা ক’জন যদি না থাকতাম তাইলে কী এই প্রোগ্রাম করা সম্ভব হইতো? এতোক্ষণ বিড়ালের মতো শান্ত বসে থাকা মান্না এবার বানরের মতো লাফিয়ে উঠে। টেবিলে চাপড় মেরে চেঁচিয়ে বলে, সবকিছুর শেষেও তো ওখানেই তোমাদের যতো মধু। এখন বুঝতে পারি আসলে ছড়াকার সংসদ অথবা ছড়া সম্মেলনের ব্যাপারে মান্না অতোটা ইনভলব না। কিন্তু হঠাৎ কেউ মান্নাকে এমতাবস্থায় দেখলে নিশ্চিত চোখ কপালে উঠে যাবে। আর মান্না তো এমন-ই। সত্যি কথাটা খুব স্বাভাবিকভাবে মুখ ফসকে বলে ফেলে। যেমন একদিন আমাদের শহরের এক ভারপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবিকে বলে বসেছিল, কীসের ভিত্তিতে আপনি বুদ্ধিজীবি? বেচারা বুদ্ধিজীবি এমন থতমত খেয়েছিলেন যে প্রায় দু’বছর তাদের দু’জনের মধ্যে কোনও কথা হয়নি। যদিও ক্ষেত্রটা এখন আলাদা কিন্তু আমি বুঝি মান্না আমার মতোই পাশার দারুণ শুভাকাঙ্খী। ঠিক তাই এমন আগাছা হওয়াটা আমাদের পছন্দ না। যেহেতু পাশা বাঁধন দা’র মতো ধরেই নিয়েছে যে রায়হান ভাই-ই তাদের উপরে ওঠার সিঁড়ি এমনকি মাপকাঠি সুতরাং এই পরনির্ভরশীলতাকে আমরা হীনমন্যতা হিসেবেই দেখি। অবশ্য এখানে অনেক ব্যাপার আমাদের সন্দেহ হয় কিন্তু স্পষ্টত জানি না। অর্থাৎ রায়হান ভাই দারুণ একজন ব্যবহারকারী কি-না আমরা জানি না এবং তিনি তাদের সুচারু আর চমৎকারভাবে ব্যবহার করছেন তাও জানি না। উপরন্তু আমরা জানি না বাকীরা রুমাল হয়েই থাকতে পছন্দ করে কি-না। আমি মজা করে বলি, আমিতো এটাকে রায়হান ভাইয়ের কৃতিত্ব হিসেবেই দেখি। উনি তোমাদের ইউজ করেন আর তোমরা ... অবশ্য জানি না তোমরা এখানেই জীবনানন্দ খুঁজে পাও কি না। হে হে হে... তারপর প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলি, বাবুল ভাই কি আজকে আছেন? মনে হয় না। তন্ময়ের প্রোগ্রামে গেছিলেন? না, আমিতো আজই আইলাম। শুনলাম দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান ছিল। তুমি ছিলা নাকি? কাল রাতে গেছিলাম। নবীর সাথে দেখা করতে। রবিউল আলম নবী। দীর্ঘদিন পর গতরাত নয়টার দিকে দ্বিতীয়বার দেখা। প্রথমবার যখন দেখেছিলাম সেবার এই প্রোগ্রামটা জেলা পরিষদে হয়েছিল। অর্থাৎ তখনও ছড়া পরিচালনা পর্ষদ পূর্বের ভুল-ত্রুটি হজম করে রায়হান ভাইকেই সমন্বয়ক রেখেছিল। তখনকার নিমন্ত্রিত অতিথি নবীকে দেখতে বেশ লাজুক ছিপছিপে ঘরানার একটা ছেলে হিসেবে দেখেছিলাম। এবার রঙমহলের সামনে সোডিয়ামের টিমটিমে আলোয় তাকে অনেকটা সুঠাম আর উচ্ছ্বল মনে হল। কিন্তু তার শরীর ঘেঁষে এটা কে? আমি কারিমা। নবীর বান্ধবী। ভালো আছেন? গলায় ওড়না পেচানো হালকা আবরণে একটা স্তন খোলা বাতাসে ছড়িয়ে রাখা কারিমার গায়ের রঙ ময়লা হলেও বেশ আবেদনময়ী বলেই মনে হলো। কিন্তু আমার কাছে অবাক আর কিছুটা হিংসা লাগলো এই জন্য যে নবী কতো সহজেই আমার মফস্বলে এই রাতে এমন একটা সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করছে। আমি হলে কি জনসম্মুখে এরকম পারতাম? হয়তো কখনও সুযোগ এলে নবীর শহরে সম্ভব হবে। কিন্তু এখানে নিশ্চয়ই না। আমি বলি, নবী চলো কফি খাই। না, আমি চা খাব। মান্না বলে, কফিই চলুক না। কারিমা বলে, চলুন চা-ই খাই। মান্না নীরবতার কথা বলে একটা গ্যাঞ্জাইম্যা চা স্টলে নিয়ে ঢোকে। ঢুকেই চেঁচিয়ে ওঠে, মামা ৪ কাপ চা। খুব দ্রুতই মামারূপী ছেলেটা চা নিয়ে আসে। চা’র কাপ হাতে নিতে নিতে দেখি পাশের টুলে বসা দু’জন মধ্যবয়সী লোক পূর্বের কথার প্রেক্ষাপটে উত্তেজিত হয়ে উঠে। বেডা তুই আস্তা একটা নাস্তিক। হ উছিত কথা কইলেই নাস্তিক। তোরার মৌলানাতো মক্কার খেজুর। সংগ্রামের সময় যে আকাম কুকাম করছে হেইডা কী বুইল্যা গেছস? তোর ছাচিরে যে এক রেজেকার লেংডা করছিন মনে নাই? হালার পুতাইনের ফাঁসি হওয়ারই দরকার। সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর টোটাল দেশটা স্পষ্টত একটা চালবাজি ইস্যুতে আস্তিক নাস্তিক পর্বে দু’ভাগ হয়ে গেছে। আরও গভীরে গেলে মনে হচ্ছে শাহবাগ কেন্দ্রিক গণজাগরণ মঞ্চকে স্বীকৃতি-অস্বীকৃতিটা হয়ে উঠছে ধর্মবিশ্বাসের মাপকাঠি। কাপ ধু’তে ধু’তে দোকানের ছেলেটা ঘাড় ঘুরিয়ে শীতল কণ্ঠে ওয়ার্নিং দেয়, মামারা এইহানে রাজনীতির আলাপ নিষেধ। লোক দু’টি হঠাৎ-ই চুপ মারে। আমরা এবার খানিক ধোঁয়ার ভেতর নীরবে কাপে চুমুক দিই। চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে নবীকে দেখি। শুনি তার বাম হাতে পিরিচের উপর হঠাৎ হঠাৎ কাপ রাখার ফলে উৎপন্ন চিকন শব্দগুচ্চ। দেখি কারিমার বুকের এক পাশ বেয়ে তার ওড়নাটা সাপের মতো বক্রাকারে নেমে গেছে উরুসন্ধিতে। শুনি গরম চা’তে পাকা ডালিম ফাটা ঠোঁটে চুমুক নেওয়ার শব্দ। আর দেখি মান্নার চোরা চোখ। সাপের মতো ফোস ফোস শব্দে চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে অবহেলায় পড়ে থাকা কারিমার স্তনের ওপর দুধের মতো গড়িয়ে পড়া তার দৃষ্টি। তারপর সাড়ে দশটার দিকে জমাট বেঁধে ঠান্ডা নামতে শুরু করলে রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করে। দু’একটা রিকশা আর মোটর বাইক অতিক্রম করে আমরা আওয়ামী লীগ অফিসের পাশ ঘেঁষে একটা গলিতে ঢুকি। কারিমাকে কচ্ছপের মতো গুটিয়ে যেতে দেখে বলি, আপনার শীতের পোশাক আনেননি? এনেছি তো। কিন্তু বোকার মতো হোটেল রুমে ফেলে এসেছি। হাঁটতে হাঁটতে কারিমা নবীর সাথে সম্ভবত উষ্ণতার জন্য চামড়ার মতো মিশে থাকে। আড়চোখে মান্নার বিরক্তিটা স্পষ্ট লক্ষ করি। শাহ আজিজ কাকার বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মান্নার মনোযোগে মোড় ঘোরাতে বলি, পিপি হওয়ার পর দীর্ঘদিন দেখা নাই। একবার বাসায় উঁকি দেবো নাকি? আরে নাহ্। এমন সময় বুদ্ হয়ে থাকে। তাছাড়া এখন তিনি আগের ওনি নাই। বইদলা গ্যাছে। একদিন চেম্বারে যাও দেখবা কথা কওয়ার সুযোগ পাইবা না। এই ক’বছরে অনেক কিছুর সাথে অনেকের পরিবর্তন অথবা বিশেষ ব্যক্তিমতে বিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। তেমনি সেলিম আল দ্বীন, হুমায়ুন ফরিদী, হুমায়ূন আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন এমনকি ফেলানী আর বিশ্বজিৎ-এর মৃত্যু আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জাতীয় জীবনে ব্যাপক আলোচ্য বিষয়। তন্মধ্যে ফরহাদ মজহারের ব্যাপারটা আমাদের চোখে খুবই দৃষ্টিকটু। যিনি বছর বিশেক আগে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ না করে এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে চমৎকার একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন তিনি এখন হেফাজতের পিঠ চুলকাচ্ছেন। বেচারা আল মাহমুদ, সোনালি কাবিনের মতো কালজয়ী কাব্যগ্রন্থের জনক হয়েও মৌলবাদকে সমর্থনের দায়ে হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত আধুনিক কবিতা গ্রন্থে স্থান পাননি। জায়গা পেয়েছিলেন ফরহাদ মজহার। আজ হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই নিজের কপালে নিজেই চপেটাঘাত করতেন। এমনি কিছু ছোট ছোট পরিসর ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলেও আমাদের স্বত্তার ভেতর দারুণ দ্বিধা আর নিঃসঙ্গতার জন্ম দিয়েছে। আমরা এখন একে অন্যকে প্রশ্ন করি, প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তি আসলে কী চান? যদিও প্রত্যেকের গভীরে এক অনিবার্য জিজ্ঞাসা - আমরা আসলে কী চাই? তাহলে কি যাবো না? কইলাম তো এখন তার কোনো কথাই বুঝবা না। নবী কারিমার বাহুবেষ্টন এড়িয়ে বলে, যে কারণে আপনার সাথে দেখা করা তা হলো কলকাতায় আমরা ক’জন বন্ধু মিলে একটা সেক্সুয়েল সংখ্যা বের করছি। বলতে পারেন গবেষণামূলক। আপনার একটা লেখা চাই। কিন্তু প্রবন্ধে তো আমার হাত ফাঁকা। গল্পই দিন। প্রয়োজনে একবার সোনাগাচি থেকে ঘুরে আসুন। মান্না টের পায় বলে মনে হয় না। এমন সূক্ষ বিষয় নিয়ে তার মাথা ব্যথাও নেই। কিন্তু ভণিতা কি-না বুঝি না, আলো আঁধারিতে কারিমাকে লক্ষ্য করি কাদামাটির মতো দলা হয়ে যায়। মুখে বলি না কিন্তু দু’ঠোঁটের জিলেপি হাসিতে ফুটিয়ে তুলি তাদের দু’জনের গবেষণালব্ধ আশু রাত্রিযাপন। রাত এগারোটার দিকে তন্ময়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানস্থলে এসে বিরক্তি জেগে উঠে। তার ঘার কাঁতকরা উপস্থাপনায় গান-নৃত্যে ব্যবহৃত বাদ্যবাজনা কালীবাড়ির কীর্তনের চেয়ে অগোচালো লাগে। তাই তার সাথে দেখা না করেই দ্রুত রাস্তায় নেমে পড়ি। তারপর নবী-কারিমাকে মুক্ত করে দিই। আবার দেখা হবে। আশা করছি রাতটা দারুণ কাটবে। নবী নতুন বরের মতো নিষ্পাপ হাসিমুখে বলে, লেখাটার অপেক্ষায় থাকলাম। প্রয়োজনে ... প্রয়োজনের কথাটা আমি জানি। আর জানি রাতভর নবী তার দশ আঙুলে কাদামাটির ভাঁজ ভাঙবে আর আমি শরীরে উত্তেজনার ঢেউ তুলে সোনাগাচির নতুন রাস্তা খুঁজব!

বাবুল ভাই সিগেরেটে শেষ টান দিয়ে একটা লম্বা হাই তোলেন। তারপর পাশা আর জানিকে লক্ষ করে বলেন, দুঃখ নিওনা। সিদ্ধি লাভের জন্য পীরের লাথি গুতার দরকার আছে। মান্নার মুখে এবার কুটিল হাসি ফুটে উঠে। আমি বলি, উঠবেন নাকি? হুম। চলো প্রোগ্রামে যাই।

ছড়া সম্মেলন শেষে কিছুদিনের মধ্যে পাশা এবং তার ছড়াকার সতীর্থরা প্রোগ্রামে তাদের প্রতি অবজ্ঞা বেমালুম ভুলে নতুন উদ্যমে ছড়াকার সংসদীয় কার্যক্রম শুরু করে। এবং পাশা একটা চমৎকার আইডিয়া নিয়ে আসে। সেই অনুসারে প্রতি পূর্ণিমায় স্বতন্ত্র লোকেশনে চান্নিপশর নামে একটি ছড়া সম্মেলন হবে। এবং তাতে যথারীতি পৌরিহিত্য করবেন রায়হান ভাই। যদিও চারটি সম্মেলন শেষেও তারা স্থান পরিবর্তন করতে পারেনি। তবে গুরুদয়াল সরকারী কলেজের পাশে নরসুন্দার কোল ঘেঁষে জোঁক আর মশাদের সঙ্গে মানুষের উপস্থিতিও নাকি উল্লেখযোগ্য ছিল। তেমনি এক মেঘে ঢাকা অমাবস্যাময় পূর্ণিমা রাতে তাদের সম্মেলনে আমার পদচিহ্ন মেখেছিলাম। তবে সম্মেলন শেষে পাঁচজনের আড্ডাটাই বরং প্রাণোচ্ছ্বল লাগে। যদিও বরুণ ভাই কর্তৃক অনুপস্থিত পাঠান স্যারের বিষোদগারের ভঙ্গিটা বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এই ফাডার ঘরের ফাডা যে কেরে আমরা দুই ভাইয়ের গীবত গায় বুঝলাম না। হের ক্ষেতের লগে আমরার ক্ষেত নাই, ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্ব নাই তবুও আমরার পিছে লাইগ্যা রইছে। বেডা নাস্তিকের ঘরের নাস্তিক। আরে বেডা নাস্তিক অইলে যোগ্যতা লাগে। তুই নামাজ পড়ছ না কারণ ওঠবোস পারস না। রোজা রাহস না কারণ না খাইয়া থাকতে পাড়স না। এইডারে নাস্তিক কয়? আমি বরুণ ভাইয়ের দিকে একটা গোল্ডলিফ এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ভাই নাস্তিকের সংজ্ঞা কী? উত্তেজিত বরুণ ভাই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তিনি বাতাসে প্রদীপ শিখার মতো দপ করে চুপসে যান। তারপর দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, তুমি কি নাস্তিক? সত্যি বলতে আমিও এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিলাম না। তাবৎ বিশ্বে ১২০ কোটি মানুষের কোনো ধর্ম নেই। কিন্তু তারা কি আসলেই নাস্তিক? আমাদের মফস্বলের পারভেজ ভাই। মানে সেলিম পারভেজ। অর্ধশতাব্দীর পরিচ্ছন্ন যুবক। আমরা ধরেই নিয়েছি বিয়ে-টিয়ে তিনি আর করবেন না। প্রচারবিমুখ দারুণ পড়–য়া লোক। বামধারার পার্টিজান সাহিত্য-সংস্কৃতি আর কর্মের দিকে তার খুব মনোযোগ। টি-স্টল অথবা তার অগোছালো খুপড়িমত ঘরে প্রায়ই আড্ডা হয়। আমার তো মনে হয় আচমকা এই প্রশ্নে তিনিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবেন। অথবা অধ্যাপক যতীন সরকার যাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাব দৃষ্টিগ্রাহ্য। যাঁর ঈশ্বর ভাবনা, ঈশ্বর নির্মাণ আর বিভিন্ন সেমিনারে দেয়া বক্তব্য অন্যদের মতো আমাকেও মন্ত্রমুগ্ধ করে। কিন্তু আমার খালি মনে হয় এখানে এলে তাঁর চোখ সবার আগে সুভাষ রায়কে খোঁজে। বরুণ ভাইয়ের এই প্রশ্ন যা পুরো জাতিকে আজ দ্বিধান্বিত করে রেখেছে আমি তা এড়িয়ে যাই। জোঁকের ভয়কে উপেক্ষা করে যৌবন সায়াহ্নে আসা পতিতার তুলতুলে স্তনের মতো ঘাসে হাত-পা ছড়িয়ে লম্বা হাই তুলে বলি, এই বুঝি আমার আরাধ্য অস্থি; তুমি চিরুনি হাতে আদর দিলে আমার উর্বর পটভূমি কিন্তু তুমি কে, কে তুমি? আমার পরম জন্মপিতা? শুনেছি আমাতেই আমার উৎপত্তি; আমাতেই বহ্নিশিখা।

চমৎকার আড্ডা শেষে রাতে নির্ভেজাল এক ঝরঝরে ঘুম হয় এবং দীর্ঘ ঘুমের পর বেশ দেরি করেই বিছানা ছাড়ি। তারপর দশটার দিকে টিভি অন করে মুখোমুখি হই এক ভয়াবহ খবরের। প্রথমে চোখে ধাঁ ধাঁ লাগে। প্রতিটা চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখি একই নিউজ। দেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। অনুমোদনহীন আটতলা রানা প্লাজা ধসে আটকে গেছে হাজার হাজার গার্মেন্টস কর্মী। ১৬তম দিনে যখন উদ্ধার অভিযান শেষ হয় ততোদিনে মৃতের সংখ্যা সহস্রাধিক। হাত-পা কাটা জীবিত মানুষের ভবিষ্যত জীবন কবরের অন্ধকার। এই নিয়ে দেশজুড়ে দুঃখময় বিলাপের শুরুর দিকে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপহার দিলেন হাস্যকর বিবৃতি। বললেন, বিরোধীদলের কিছু লোকের ঠেলাঠেলিতে রানা প্লাজা ধসে যেতে পারে। ব্যর্থতার দায়ে দেশের প্রথম মহিলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অপসারিত হয়ে দুর্ভাগ্যের ক্রমানুসারে এই শিক্ষিত পাগলসম লোক তার স্থলাভিষিক্ত হলেন যিনি সভা-সেমিনারে ক্রমাগত বাচালের মতো বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। নব্বই পরবর্তী গণতন্ত্রের পর থেকে জাতির দুর্ভাগ্যের এই ক্রমধারা থেকে যেন আমাদের মুক্তিই মিলছে না। বড় বড় অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী প্রেসব্রিফিংয়ে হাসিমুখে বিবৃতি দেন। বিএসএফের হাতে ক্রমাগত মৃত্যুর পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের ভোঁজসভায় হাসিমুখে গালগপ্পো করেন। আহারে দুঃখবতী পদ্মাদেশের ফেলানি! তোমার নদীর ইঁলিশ ভাঁজা খেয়ে তারা তৃপ্তির উলুধ্বনি দেয় আর বুলেটবিদ্ধ হয়ে ছেড়া পতাকার মতো তোমার লাশ ঝুলে থাকে সীমান্ততারে। একি তোমার লাশ-না বাংলাদেশের দীর্ঘশ্বাস? তারা উলুধ্বনি দেয় আর আমরা নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বলি হয়ে ধনুকের মতো আরেকটু বেঁকে মেরুদন্ডহীনের মতো ইন্নালিল্লা... বলে তোমাকে কবরে শুইয়ে রাখি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু অধিকাংশ সময় সবকিছুর জন্য বিরোধীদলের ষড়যন্ত্রের গন্ধ শুঁকে হাসিমুখে হাফ ছাড়েন। কী সুন্দর মুখ, শিশুর সারল্যে পবিত্র হাসি। শুধু আমাদের মুখে দুর্ভাগ্যের ক্ষত, তৃপ্তির হাসি নেই। এই যখন পরিবেশ তখন আমরা কী-ইবা করতে পারি। বড়জোর কাচুমাচু হয়ে অক্ষম সন্তানের মতো হাঁটু গেড়ে প্রার্থনার ঢঙে বলতে পারি, মা-মাগো, চাইলে তোমরা অন্তঃসত্ত্বা হও। কিন্তু আমরা জারজ সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে চাই।



লেখক পরিচিতি

অনিন্দ্য আসিফ
জন্ম ১৯৮১।
কিশোরগঞ্জে বেড়ে ওঠা।
গল্পকার।
                                                      


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ