অস্থির সময়ের গল্প নিয়ে আলাপ : মেহেদী উল্লাহ--সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী দুটি গোষ্ঠীর একটি যদি সংখ্যালঘু হয়, আরেকটি যদি হয় সংখ্যাগুরু তখনই সমস্যা।

মেহেদী উল্লাহ এ সময়ের গল্পকার। পেশা সাংবাদিকতা। ‘পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্পে’র পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য-২০১৩ পুরস্কার। তিনি শুধু গল্প লেখেন না--সময়কেও লেখেন। সময়ের পরম্পরা তাঁর চিন্তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছভাবে উপস্থিত। ফলে তিনি শেকড়লগ্ন গল্পকার।
সাম্প্রদায়িকতা, দেশভাগ, দাঙ্গা নিয়ে তাঁর সঙ্গে গল্পপাঠের আলাপটি পত্রস্থ হল। 

গল্পপাঠঃ সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী-দাঙ্গা বিরোধী কোন কোন বা কার গল্প পড়েছেন?

মেহেদী উল্লাহ : ঢাকা শহর ও রায়পুর থানায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৪১ সালের এপ্রিলে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয় ১৯৪০ সালে। তখন সক্রিয় হয়ে ওঠেন কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত বিভিন্ন প্রকাশ্য সংগঠনের সদস্যরা। ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে যারা সক্রিয় ছিলেন সোমেন তাদেরই একজন। সেই সোমেনই ১৯৪১ সালে লিখলেন ‘দাঙ্গা’ গল্পটি। এতে তাঁর আত্মজৈবনিকতার প্রভাব পাওয়া যায়। গল্পটিতে ‘নবাব বাড়ী’র উল্লেখ আছে। এটি সেই নবাব বাড়ি, যেটি ১৯৪১-এর দাঙ্গায় মুসলিম লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল।

গল্পটিতে তিনি ছোট ছোট চিত্রের মধ্য দিয়ে দাঙ্গার একটি সাম্প্রদায়িক রূপ তুলে ধরেন। ‘সেখানে বাবা মা বিভ্রান্ত, উদ্বিগ্ন; ছোটভাই ভুল আদশের বিষবাষ্পে সংক্রমিত আর কমিউনিস্ট চিন্তার ধারক বড়ভাই ‘অর্থহীন মানবিক ট্রাজেডি’ দেখে ক্রমাগত উত্তেজিত।’

হাসান হাফিজুর রহমানের ‘আরো দুটি মৃত্যু’ গল্পে এসেছে দাঙ্গা। গল্পের কথক পরিবারটি সহযাত্রী। নারায়ণগঞ্জ থেকে বাহাদুরাবাদ ট্রেনের যাত্রী তারা। দেশব্যাপী তখনও সাম্প্রদায়িকতার রেশ চলছিল। মুসলমান প্রধান এই অঞ্চলটিতে একটি হিন্দু পরিবারকে দেখে বক্তার মন আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে ওঠে। পরিবারটিকে দাঙ্গার ছোবল থেকে রক্ষার জন্য বক্তার মনে প্রার্থনা সঞ্চারিত হয়।

এই গল্পে প্রতীয়মান হয়, দাঙ্গায় অংশ নেওয়া হিন্দু-মুসলমান গোষ্ঠীর বাইরেও সমাজে তখন লোক ছিল যিনি দাঙ্গার ভয়াবহতাকে ভয় পান। মুসলমান হয়েও বক্তা হিন্দু-পরিবারটির মঙ্গল কামনা করছে, যাতে দাঙ্গার শিকার না হয় পরিবারটি। দাঙ্গার সময় চলন্ত ট্রেনও নিরাপদ ছিল না। যেকোনো সময় ট্রেনেও লাশ পড়ে যায়। তাই ট্রেনটা পরিবারটির জন্য অনিরাপদ। গল্পে আশ্রয়হীন, মৃত্যু-চিন্তায় অস্থির, চারিদিকে মৃত্যুর বিভীষিকা অথচ মরতে চাচ্ছেনা। পরিপার্শে¡র সঙ্গে সংগ্রামশীল এমন একটি পরিবেশের জীবন বিপাকের চিত্রায়ণে অস্তিত্বশীল চিন্তাচেতনায় প্রকট ছাপটিই পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য পরে অন্য কারণে মৃত্যু ঘটে পরিবারটির, আসন্নপ্রসবা নারী ও তার আগত প্রায় সন্তানের বীভৎস মৃত্যুতে দাঙ্গা পার্শ্বঘটনা হয়ে যায়। ‘রোগমুক্তির ইতিবৃত্ত’ গল্পে হিংস্র পাশবিক আক্রমণে মনীষার ভালোবাসার মানুষ অশোক নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দাঙ্গার অমানবিক স্বরূপকে প্রত্যক্ষ করেছেন আলউদ্দিন আল আজাদ । গল্পের এই দাঙ্গার স্বরূপও গল্পকার নিয়েছেন ইতিহাস থেকে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত সৃষ্টির অনেক পূর্ব থেকে কংগ্রেস, মুসলিম লীগের বিরোধই উপমহাদেশকে বিভক্তির পথে টেনে আনে। শত শত বছরের হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃত্ববোধের যে সহাবস্থান ছিল তা বিলুপ্ত হয়। ইংরেজ শাসকগণ এদেশে আসার পর তাদের সাম্রাজ্য বিকিয়ে রাখার স্বার্থে ভেদনীতির শাসন চালু করে এবং ‘ডিভাইড এ- রুল’ এর মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মন্ত্র তৈরি করে দেয়। যোগেন মণ্ডলের দাঙ্গার বিবরণ থেকে জানা যায়, একমাত্র বরিশাল জেলাতেই হত্যা করা হয়েছে ২৫০০ জনকে এবং সারা দেশে বলির সংখ্যা ১০ হাজারের ওপর। ১৯৬৩ এবং ১৯৬৯ সালে মুসলিম লীগের উসকানি ও ষড়যন্ত্রে ঢাকা ও খুলনাসহ সারা দেশে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, সেই দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের বাড়িঘর ভস্মীভূত করা হয় এবং লাখ লাখ মানুষ দেশত্যাগ করে। একমাত্র ঢাকার পাশে সাভারের সাত-আটটা গ্রামে ৫-৬ হাজার মানুষের নিধনযজ্ঞ চলে।

মূলত দাঙ্গার এমনই ঐতিহাসিক পটভূমি বিরাজমান, ফলে গল্পকাররা গল্পে দাঙ্গার সত্য নির্মাণ করেছেন। আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পেও দাঙ্গার অমানবিক স্বরূপ-সত্য নির্মিত হয়েছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ব্যাখ্যা করেন, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে সাম্প্রদায়িকতা ক্রমাগত তীব্র হলো, রক্তপাত ঘটলো, ফলে স্বাধীন হলো ভারতবর্ষ। একটি জায়গায় দু’টি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটলো কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা সমস্যার সমাধান হলো না-- না পাকিস্তানে, না ভারতে।

আসলে, দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো, কিন্তু প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহ দ্বি-জাতিতত্ত্ব পরিত্যাগ করলেন। ভারতীয় মুসলমানদের বললেন ভারতীয় হয়ে যেতে এবং পাকিস্তানের সকল ধর্মাবলম্বীদের বললেন রাজনৈতিকভাবে নিজ নিজ ধর্মমত ভুলে গিয়ে খাঁটি পাকিস্তানিতে পরিণত হতে। তিনি ধর্মীয় রাষ্ট্র চাননি, আধুনিক রাষ্ট্রই চেয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিটা তো রয়েই গেলো রাষ্ট্রের মূলে। তাছাড়া পাকিস্তান দ্রুত পরিণত হলো একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে। এর সামরিক বেসামরিক আমলারা রাষ্ট্র পরিচালনায় কর্তৃত্ব দখল করে নিলো এবং নিজেরাই যদিও মোটেই ধার্মিক ছিল না, তথাপি তারা ধর্মকে ব্যবহার করতে চাইল, ঠিক সেই পুরনো কারণেই। শ্রেণি বিভাজনকে অস্পষ্ট করে দেবার জন্য। সেই সঙ্গে উগ্র ভারত বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং সংখ্যাগুরু জনগণকে ধর্ম-চর্চার স্বাধীনতা (আসলে একমাত্র স্বাধীনতা) দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নিপীড়নমূলক চরিত্রকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করলো। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান এতে সন্তুষ্ট হয়নি। অভিজ্ঞতা সেখানকার মানুষকে দ্রুত বলে দিয়েছে যে, ধর্মীয় বিভাজন যদিও মিথ্যা হয়, তবু তার চেয়ে অনেক বড় সত্য ভাষার বিভাজন। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জায়গায় তাই নতুন চেতনা গড়ে উঠলো-- সেটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়বাদ। ১৯৫২-এর রাষ্ট্র ভাষা-আন্দোলন পূর্বপাকিস্তানের প্রথম ব্যাপক রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন। ভাষা পুরোপুরি ইহজাগতিক, ভাষা-আন্দোলনও ছিল তাই। এখানে ধর্মের জন্য কোনো জায়গা ছিল না।

সাম্প্রদায়িক হিংস্রতায় ক্ষতবিক্ষত সংখ্যালঘু মানুষের প্রাত্যহিক অস্তিত্ব, নাগরিক জটিলতা তাড়িত আধুনিক মানুষের দুর্জ্ঞেয় মনোজগৎ এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সামূহিক মানুষের বিচূর্ণ প্রত্যাশা ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা প্রভৃতি বিশাল কালবিধৃত ঘটনাবলী গল্পে সৃষ্টি করেছে বিচিত্র বর্ণাঢ্য ভুবন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি শ্রেণিবিভক্ত সমাজের তীব্র বৈষম্য, বুভুক্ষা, রিরংসা, সম্ভাবনালুপ্ত মৃত সময়ের যাবতীয় ক্লেদ, সমাজ ও ব্যক্তির নিঃশিকড় অস্তিত্বের রূপায়ণে গল্পকাররা এপর্যায়ে নির্মোহ দৃষ্টির অধিকারী।

দেশভাগের পরিণামে হিন্দু-মুসলামান সম্পর্ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজেদের মধ্যে থাকা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্প্রদায়গত সম্প্রীতিতে চিড় ধরে। সৃষ্টি হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার।

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ববঙ্গ বিধানসভায় বাজেট অধিবেশন চলাকালীন কংগ্রেস বিধায়করা কালশিরা ও নাচোলের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার অনুমতি চেয়ে দুটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু প্রস্তাব দুটি নাকচ করে দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, নাচোল হলো রাজশাহী জেলার একটি গ্রাম, যেখানে কমিউনিস্ট দমনের নামে পুলিশ ও মুসলিম লীগের গুণ্রাডা স্থানীয় হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে এবং তাদের সহায়-সম্পত্তি দখল করে ভারতে তাড়িয়ে দেয়। আর কালশিরা হলো খুলনা জেলার মোল্লাহাট থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম, যেখানে ১৯৪৯ এবং ২০ ডিসেম্বর ঠা-া মাথায় পুলিশ ন্যাক্কারজনক নৃশংস হত্যাকা- ও পাশবিকতা চালায়। এটাও ছিল কমিউনিস্ট অজুহাতে হিন্দু মহিলাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার ও হত্যাকা-। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে সে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, এটাও সম্ভবত প্রধান কারণ। যোগেন্দ্র মণ্ডল তাঁর পুস্তকে স্বচক্ষে দেখা ও অভিজ্ঞতার বিবরণে বলেছেন, ‘কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে ঢাকা-নায়ারণগঞ্জ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে হাজার হাজার নিরাপরাধী নর-নারীর হত্যালীলা আমাকে সাংঘাতিকভাবে বিচলিত করে। এরপরের দিন আমি পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে দেখা করি এবং দাঙ্গা যাতে আরও ছড়িয়ে না পড়ে তার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করি। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ সালে আমি বরিশাল পৌঁছাই, জেলা শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল পরিধির মধ্যে মোটর রাস্তা দ্বারা যুক্ত কাশীপুর, মাধবপাশা এবং লাকুটিয়ার মতো স্থানেও দাঙ্গাবাজরা বীভৎস তা-ব সৃষ্টি করে। মাধবপাশার জমিদার বাড়িতে ২০০ জনকে হত্যা, মূলাদিতে ৩০০ জনকে হত্যা এবং শত শত নারীকে ধর্ষণ করা হয়।’ তিনি আরো উল্লেখ করেন-- রাজাপুর ও তার আশপাশে রাস্তা ও নদীর ধারে অসংখ্য নর-নারীর মৃতদেহ কুকুর-শকুনেরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

দেশভাগের কারণে সৃষ্টি হয় বহুধরনের সামাজিক সংকট ও দুর্গতি। বিভাগোত্তর কালের ছোটগল্পে জাতীয় জীবনের এই দুর্গতিকে ধারণ করতে চেষ্টা করেছেন সমসাময়িক গল্পকারগণ। এছাড়া এসেছে উদ্বাস্তু সমস্যা। একথা ঠিক, শুধু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বললে বস্তুত একপেশে হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেমনি দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দিয়ে স্বাভাবিক শান্তি, সৌহার্দ্য ও একতাবোধকে নষ্ট করে, আবার তেমনি দাঙ্গা চলাকালীন সময়ে দুটি সম্প্রদায়ের লোকজন একে অপরকে বিভাজিত হতে না দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছে।

দাঙ্গা ও সম্প্রীতির পাশাপাশি তীব্র হয়ে দেখা দেয় উদ্বাস্তু সমস্যা। মানুষ নিজ দেশেই দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। বাধ্য হয়ে নিজ দেশত্যাগ করে হয়ে পড়ে উদ্বাস্তু। বদরুদ্দীন উমরের লেখাপত্র পড়ে জানতে পারি, সাতচল্লিশের দেশভাগের কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ আপন জন্মভূমিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও নির্যাতনের কারণে চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। আর এই অনিশ্চয়তা থেকে নিশ্চয়তা পেতে দলে দলে মানুষ স্বদেশ ত্যাগ করে পরদেশে উদ্বাস্তু জীবন গ্রহণ করে।

এই উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের গল্পকারগণ গল্প লিখেছেন। বিশেষত, পূর্ববাংলার মানুষজন উদ্বাস্তু সমস্যায় পড়লে, নিজ দেশের গল্পকাররাই এই জাতীয় জীবনের সংকট নিয়ে গল্প লিখতে উদ্যোগী হন। হাসান আজিজুল হক একটি লেখায় জানিয়েছেন, ১৯৪৭ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে পূর্ববাংলার অধিবাসীরাও তাদের স্বদেশ ও স্বাদেশিক অঙ্গিত্মকে অধিকার করতে গিয়ে দেখেছেন যে, তারা মূলত বাস্তুচ্যুত, নিজদেশে পরবাসী।

আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘উজান তরঙ্গ’ গল্পে দেখানো হয়েছে যে, একটি দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবারের এক নারী ধর্ষিত হয়েছে। তারপরেও জন্মভূমি ছেড়ে তার উদ্বাস্তু না হওয়ার ঘটনা। পঞ্চাশের দাঙ্গায় জেলে পাড়ার সবাই গাঁ ছেড়ে চলে গেলেও নিতাই যায় না। তার জাল নেই, নৌকা নেই, তবুও সে পিতৃ-মাতৃভূমিতেই থাকার জেদ ধরে। সঙ্গে থেকে যায় কন্যা যমুনা এবং স্বামী। সে বিশ্বাস করে ভগবান তাকে ভুখা রাখবে না। কিন্তু এক রাতে গুণ্ডারা এসে যমুনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে ফেলে রাখে। এর পরদিন জামাই দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেলেও নিতাই দেশমাতাকে ছাড়ে না। এভাবেই নিতাইয়ের জীবনে দেশভাগের প্রভাব পড়ে এবং সে অসহায় জীবন-যাপন করে।

হাসান আজিজুল হকের ‘পরবসী’ গল্পে দাঙ্গার মাধ্যমে হত্যা লুণ্ঠনের নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে। সেখানে দাঙ্গার শিকার সহজ-সরল খেটে খাওয়া মানুষ, যারা রাজনীতির কিছুই বোঝে না। অথচ তাদেরই রাজনীতির বলি হতে দেখা যায়। গল্পের বসির, ওয়াজউদ্দিন, ভক্তরা দিনমজুর। তারা রাতের শেষ প্রহর থেকে জোতদার বিশে কত্তার জমিতে ধান কাটে। দাঙ্গার দিনেও যথারীতি তারা ধান কাটতে চলে যায় এবং এ বিষয়ে ফিসফাস শুনলেও মনে তোলে না। বরং নিজেদের সংগ্রামশীল জীবন নিয়েই তারা তুষ্ট।

ক্ষুধা ও দারিদ্র্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে দেশভাগ ও রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না এরা। কিন্তু তবুও এর প্রভাব তাদের উপর পড়ে। সারাদিন স্বাভাবিক কাজ-কর্ম সেরে ওয়াজেদ্দি দাঙ্গাকারীদের হাতে নিহত হয়। সহকর্মী বশির বাড়ি ফিরে দেখে দাঙ্গাকারীরা তার সাত বছরের বাচ্চাকে বল্লম দিয়ে মাটির সাথে গেঁথে রেখেছে। আর তার ছাব্বিশ বছরের বউ তাদের লাগানো আগুনে পুড়ে গেছে। এরপর পরদেশের উদ্দেশ্যে পালায় বশির। সীমান্তে পৌঁছে তার মতোই আরেক উদ্বাস্তু ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের মুখোমুখি হয় সে। লোকটিকে দেখে নিজের স্ত্রী পুত্রের কথা মনে পড়ে যায়, প্রচ- ক্রোধে আঘাত করে লোকটিকে। কিন্তু লোকটির মৃত্যুযন্ত্রণা কাতর মুখের সাথে নিহত ওয়াজেদ্দির কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না বশির। অর্থাৎ গল্পকার বুঝিয়ে দেন, মানুষের রক্তের ধরন এক, মৃত্যুর ধরনে কোনো সম্প্রদায়গত বিভেদ নেই। আলাউদ্দিন আল আজাদের আরো দুটি গল্প ‘ছুরি’ ও ‘শিকড়’ গল্পেও এমন দাঙ্গার চিত্র চোখে পড়ে।

রাহাত খানের ‘আমাদের বিষবৃক্ষ’ গল্পে দাঙ্গায় নিহত হয় পুরো একটি পরিবার। গল্পে আতাউর, রায়হান এবং মাখন লাল বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী। কবিরাজ জ্ঞানমোহন চক্রবর্তীর মেয়ে দীপালীও ছোটবেলায় তাদের খেলার সাথী ছিল। এমতবস্থায় চারদিকে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে কবিরাজ জ্ঞানমোহন চক্রবর্তীসহ পুরো পরিবার নিহত হয়।

শওকত ওসমানের ‘আখেরী সংক্রান্ত’ গল্পে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। সেখানে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব মহররমের অনুষ্ঠানের জন্য একজন ঢুলির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত এলাকার ব্যাপারটা সহজ ছিল না। তারপরও যখন একজন হিন্দুপাড়ায় গিয়ে বললেন, ঢোল দরকার, ঢুলি দরকার, পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও; একথা বলার পরে জবাবে পাওয়া যায় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে চিত্র।

সমাজের অভিজাত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেশভাগের প্রভাব ছুঁতে পারেনি। এর প্রমাণ মেলে হরিপদ দত্তের ‘অগ্নিভুক অজগর’ গল্পে। লুটেরাদের কাছে জায়গা জমি বিক্রি করে নিশ্চিন্তে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ভবানী চৌধুরী-- কারণ শোষকরা কোনো নির্দিষ্ট দেশগণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। দেশত্যাগ করলেও অন্য দেশেও তারা শোষক এবং সাধারণ মানুষ তাদের অধিন্যস্ত ও ক্রীড়নক। এই গল্পে দেখানো হয়, দেশভাগের ফলে ভবানী চৌধুরীদের জায়গা দখল করে আলী হোসেন মোক্তারেরা। আর শত অত্যাচার নির্যাতন ভোগ করে অপরিবর্তনীয় থাকে সাধারণদের অবস্থা।

হাসান আজিজুল হক দেশভাগের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে আরো কিছু গল্প রচনা করেছেন। ‘সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য’ গ্রন্থের ‘উত্তর বসন্তে’; ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গ্রন্থের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘নারী’ এবং ‘জীবন ঘষে আগুন’ গ্রন্থের ‘খাঁচা’ অন্যতম।

‘উত্তর বসন্ত’ গল্পে দেশবিভাগের ফলে ভারত থেকে পূর্ববাংলায় চলে আসা একটি মুসলিম পরিবারের হতাশা চিত্রিত হয়েছে। বাবা-মা-ভাই-বোনসহ বাণীদের পরিবার দেশভাগের পর বিনিময় ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ভারতের বর্ধমান শহর থেকে বাংলাদেশের এক জেলা শহরে চলে আসে। এতে তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। প্রেমিক কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বাণীর বোন লিপি আত্মহত্যা করে। এতে লিপির বাবা-মা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকদিন পর বাণী কবীরকে কলেজের ইতিহাসের নতুন অধ্যাপক হিসেবে দেখতে পায় এবং যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয় তাদের। কিন্তু কবীর বাণীকে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখালে সে রাজি হয় না।

‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পে উঠে এসেছে উদ্বাস্তু জীবনের অর্থনৈতিক অনিরাপত্তা, জীবনযাপনে ন্যূনতম চাহিদা পূরণে অক্ষম নিন্মবিত্তের বেকারত্ব ও মনুষ্যত্ব বিক্রয়ে বাধ্য হওয়া প্রভৃতি বিষয়। গল্পে দেখা যায়, স্কুল জীবন থেকে ছিটকে পরা তিন বখাটে যুবক ইনাম, ফেকু, সুহাসের নিত্যকর্ম চৌর্যবৃত্তি, ছিনতাই, পকেটমারা প্রভৃতি। এরা দেশভাগের ফলে ভারত থেকে চলে আসা একটি উদ্বাস্তু পরিবারের অসহায়ত্বের সুযোগ গ্রহণ করে। তারা যুবতী কন্যা রুকুর দেহসম্ভোগের সব আয়োজন সম্পন্ন করে। বৃদ্ধ পিতা তাই মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে কন্যার দেহবিক্রির টাকায় বাধ্য হয়ে সংসার চলায়। বৃদ্ধ বাড়ির উঠানে রোপিত করবী গাছের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে জানায়, করবী ফুলের বীজে চমৎকার বীজ হয়। কন্যার সম্ভ্রামের বিনিময়ে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা মেনে নিয়ে বৃদ্ধ যেন বিষপানে নীলকণ্ঠ, জীবন্মৃত।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘অনুধ্বনি’ গল্পে বিবৃত হয়েছে, হুজুগ ও গুজবে মেতে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ এবং অচিরেই ভগ্নহৃদয় ও ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে আবার স্বদেশে ফিরে আসার কাহিনি। গল্পে দেখা যায়, বরিশালের চর একঝকরিয়া গ্রাম উজাড় করে চলে যাচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এই সুযোগে তাদের জমি-জমা ঘর-বাড়ি পানির দামে কিনে নিচ্ছে আজিজ মৃধাদের মতো সুযোগ সন্ধানী মানুষ। রমজান শেখ তিনকড়ি মণ্ডলকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিরস্ত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু তিনু মণ্ডলর আচরণ ও বক্তব্য এক্ষেত্রে রহস্যময়।


গল্পপাঠঃ আপনি কি মনে করেন এ ধরনের অস্থির সময় নিয়ে গল্প খুব কম লেখা হচ্ছে?

মেহেদী উল্লাহ : আসলে, অস্থির সময় নিয়ে গল্প লেখাই উচিত নয়, ‘অস্থির’ সময়কে মনে মনে ‘স্থির’ করেই লেখকের উচিত গল্প লেখা। তাহলে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। কোনো পক্ষের প্রতি সিমপ্যাথি জাগে না। সোমেন চন্দের ‘দাঙ্গা’ গল্পটি স্থির আর নির্লিপ্ত। এর ফলে গভীরভাবে উঠে এসেছে দাঙ্গার ভয়াবহতা। ‘অস্থির সময়ে’র গল্প কম হোক আর বেশি হোক তা কখনো ভালো সাহিত্য হতে পারে না। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাসগুলো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন একটা উপন্যাসের অপেক্ষা করছি, যার লেখক ওই নয় মাসকে ‘স্থির’ সময় ধরে পাঠককে অস্থির করে তুলবেন। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটা ‘স্থির’ উপন্যাসের অপেক্ষায় আছি। কবে কে লিখতে পারবেন, জানি না।


গল্পপাঠঃ একজন গল্পকার হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা বিষয় নিয়ে লেখাকে কি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? করলে কেনো মনে? আর না মনে করলে--কেনো করেন না?

মেহেদী উল্লাহ : একজন লেখকের কাছে এজাতীয় গল্প একই সঙ্গে দুটি অর্থ বহন করে। প্রথমত, এটি একটি ইভেন্ট বা আইডিয়া। দ্বিতীয়ত, এর ভেতর দিয়ে লেখক জাতীয়তা বোধ জাগ্রত করতে পারেন। সমস্যাটা লেখা নিয়ে নয়, সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু নিয়ে। সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী দুটি গোষ্ঠীর একটি যদি সংখ্যালঘু হয়, আরেকটি যদি হয় সংখ্যাগুরু তখনই সমস্যা। বাঙালী যখন বিহারি মারে কিংবা হত্যা করে তখন সেই ঘটনাকে কেউ ‘দাঙ্গা’ বলছে না। এটাও একটা রাজনীতি। আসলে, সংখ্যাগুরুটা একে দাঙ্গা হিসেবে অভহিত করতেই চাইছে না। সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী এই আখ্যাদানের নিয়ন্ত্রক। ফলে সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়েই যাবে। নরেন্দ্র মোদীর জীবন-ইতিহাসও দাঙ্গা সংশ্লিষ্ট। গুজরাটে শতবার মুসলমান নিপীড়ন করা হলেও বা হিন্দু-মুসলমান হাঙ্গামা করলেও তাকে চল্লিশের দশকের মতো এখন আর ‘দাঙ্গা’ হিসেবে দেখাবে না নিয়ন্ত্রক শক্তি। সেখানে মুসলমান সংখ্যালঘু। ৪৭ এর দাঙ্গাকে বড় করে দেখারও দুটি রাজনৈতিক কারণ আছে। প্রথমত, পাকিস্তান আর ভারত নিজেরাই আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছে, এর মূলে সাম্প্রদায়িকতা। দ্বিতীয়ত, হিন্দু-মুসলমান সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ব্যাপারটি ছিল না, খোদ বৃটিশরাই শাসনের সুবিধার্থে দুটি ধর্মীয় শক্তিকে বিভেদ করে রেখেছিল।

সাম্প্রদায়িকতা বিষয় নিয়ে লেখার একটা বড় মুশকিল রয়ে গেছে, এটা যে কোনো ইতিহাস আশ্রিত রচনার ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে, গল্পকারদের অধিকাংশই একে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস বানিয়ে ফেলেছেন। একটি গল্প কখনোই ইতিহাসসর্বস্ব হওয়া ঠিক নয়। ইতিহাসই যদি রচনা করতে হয়, তবে ইতিহাস লেখাই ভালো। লেখক সাম্প্রদায়িক কিংবা অসাম্প্রদায়িক কিছুই হবেন না, তিনি যে চরিত্র সৃষ্টি করবেন তারা কেউ সাম্প্রদায়িক কেউ অসাম্প্রদায়িক হবেন। তবে লেখকের একটা উদ্দেশ্য থাকবে। উদ্দেশ্যটা যেন এমন না হয়, মুসলমান লেখক হিসেবে আমি শুধু দাঙ্গা আর দেশভাগের ফলে এ বাংলার মুসলমানরা কি রকম ভাবে বিপদে পড়লো শুধু তাকেই গল্প করে তুলবো, এটা ওপার বাংলা বা ভারতের লেখকদের ক্ষেত্রেও সত্য। সমস্যা হলো, সিমপ্যাথি। ধরেন, কিছুদিন আগে এখানে বাঙালি বিহারি মেরেছে, এখন এই ঘটনা নিয়ে যদি কেউ গল্প লেখেন, তবে অধিকাংশই যেটা করবেন তা হচ্ছে বিহারিদের প্রতি সিমপ্যাথি দেখিয়ে গল্প ফাঁদবেন। এটা ঠিক নয়, লেখকের বাঙালি বা বিহারি কারো প্রতিই সিমপ্যাথি দেখানো উচিত হবে না, এক্ষেত্রে গল্পের বিহারি ও বাঙালি উভয়পক্ষই লেখকের প্রতি সিমপ্যাথি দেখাবে। যেটা শতভাগ করতে পেরেছেন ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’তে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। সেই গল্পে লেখক কারো প্রতি সিমপ্যাথি দেখান নি, বরং গল্পের প্রতিটি চরিত্রই লেখকের প্রতি সিমপ্যাথি প্রদর্শন করেছেন। সেই হিন্দু মহিলা থেকে শুরু করে যুবক-পুলিশ এমনকি কংক্রিটের বাঁকানো ধনুকের প্রতিটি পুলটিও।

ফলে, উপরিউক্ত মতে সাম্প্রদায়িতা বিষয় নিয়ে লেখা যেতে পারে। আমার কাছে এটি অবশ্যই ইভেন্ট বা আইডিয়া হিসেবে খারাপ না। এক্ষেত্রে আমি কখনোই অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা গল্পে তুলে ধরবো না, কারণ আমি নিশ্চিত, এটি আমার সাম্প্রদায়িকতাকেই প্রথম ও একমাত্রভাবে সামনে নিয়ে আসবে। একইভাবে আমি সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকেও গল্পে তুলে ধরবো না। কারণ, এতে মুসলমান হয়ে ‘হিন্দু’ কে ঠকানো হয় কিংবা ‘হিন্দু’ হয়ে মুসলমানকে ঠকানো হয়। আর নিস্তার পেয়ে যায় একটা মধ্যভোগী ষড়যন্ত্রকারী শক্তি, যে কি-না অনেকটা ঘষেটি বেগম কিংবা স্পষ্ট করে বললে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে ব্রিটিশ শাসন। একটা উপনিবেশ। আমি আমার গল্পকে উপনিবেশমুক্তই রাখতে চাই। এটি করতে পারলেই গল্পটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।


গল্পপাঠঃ একটা বিষয় দেখতে পাই--পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের মধ্যে দেশভাগ, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যেভাবে, যে সংখ্যা, যে মানে গল্প, কবিতা--উপন্যাস, প্রবন্ধ লেখা হয়েছে--বাংলাদেশে সেভাবে লেখা পাওয়া যায় না। এর কারণ কি বলে মনে করেন?

মেহেদী উল্লাহ : লেখা যে কম হয়েছে তাও নয়। আসলে, আমাদের এখানেও বিচ্ছিন্নভাবে কাজ হচ্ছে। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে যে লেখকরা বাংলাদেশে চলে এসেছেন, তারা সুযোগ পেলেই লেখাপত্র কিংবা সাক্ষাতকারে দেশভাগের স্মৃতি আওড়েছেন। হাসান আজিজুল হক ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন তার গল্পকে দেশভাগ নিয়ে লিখে। এখন ধরেন, মিহির সেন গুপ্ত, উনি দেশভাগ নিয়ে লিখেছেন। উনাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম একই কথা। উনি বলেছেন, যে যায় সে বোঝে, যে হারায় সে জানে। তারপর চুপ করেছিলেন। আসলে, যে হিন্দুরা দলে দলে ভারতে চলে গেলেন তার সংখ্যা বেশি, ওখান থেকে আগত মুসলমানরা বরং বেশিরভাগই স্বেচ্ছায় এপার বাংলায় চলে এলেন হিন্দুদের সঙ্গে ঘর-বাড়ি বিনিময় করে।

এর কারণ তারা মনে করেছিল, মুসলমান মুসলমান ভাই-ভাই । কিন্তু এপার বাংলার অধিকাংশ হিন্দু পরিবারকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, মিহির সেন গুপ্তের একটা সাক্ষাতকারে পড়েছিলাম, তিনি বলেছেন, শৈশবে খেলাধুলার সময় তার সঙ্গিরা তাকে প্রায়ই বলতো, তোদের দেশে যাবি না। কারণ সামাজিক ইশারা-ইঙ্গিতে দুধের বাচ্চারাও বুঝতে পরেছিল, হিন্দুদের দেশ এটা না, ভারতে। এটা মুসলমানের দেশ বলেই মনে করা হয়েছিল। আরেকটা ঘটনা খুব সূক্ষ্মভাবে ঘটেছিল এখানে, দেশভাগের পর যে যে লেখকরা কলকাতা থেকে চলে এলেন তাদের অনেকেই কলকাতায় মাঝারি মানের সাহিত্যিক ছিলেন। তারা যখন ঢাকায় এলেন, বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের পর তারা ঢাকাকে কলকাতার আদলে গড়তে চাইলেন।

এখন কলকাতার তো আসলে কিছু গড়ার নেই, ফলে তাদের যে লেখকরা এখান থেকে বাস্তুহারা হয়ে গিয়েছেন কলকাতায় তারা অতিমাত্রায় দেশভাগের কারণে নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন বলেই মনে হয়, তাদের বাই জেনারেশনে দুঃখ, কান্না, দুঃসহ স্মৃতি সংক্রমিত হয়েছিল বলেই সেখানে হয়তো দেশভাগ এত গুরুত্বপূর্ণ।

আর এখানে ১৯৭১ সালে একটা যুদ্ধ হয়ে গেল। সবকিছু নতুন করে শুরু হলো। ফলে প্রথম দাগের চেয়ে দ্বিতীয় দাগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক ও স্বাধীন হওয়ার বিষয়টিই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিক ভাবে আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধ দেশভাগের চেয়ে বেশি আলোচিত। এছাড়া দেশভাগ আরো একটা রাজনৈতিক কারণে বেশি উহ্য, তাহলো, দেশভাগ এদেশের মানুষের যন্ত্রণাকে আরো বড় করেছে, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান একসঙ্গে অথচ মাঝখানে বিশাল দূরত্ব, আবার পশ্চিমারা পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে কলোনি মানসিকতা পোষণের কারণে স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্খা জেগে উঠেছিল ভাষা আন্দোলনের পর পরই। এসব কারণে দেশভাগের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ এখানে বড় একটা আশাপূর্ণতার প্রতিফলন। এটা নিয়েই বেশি কাজ হচ্ছে। এখানকার নতুন প্রজন্ম হয়তো ভাবে, কলকাতার কিছু কিছু পরিবারের জন্য দেশভাগ অস্বাভাবিক হলেও দেশভাগের কারণে ভারতের স্বাধীনতা এসেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে তারও অনেক পরে। তাই একাত্তর বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ

  1. এখন কলকাতার তো আসলে কিছু গড়ার নেই, ফলে তাদের যে লেখকরা এখান থেকে বাস্তুহারা হয়ে গিয়েছেন কলকাতায় তারা অতিমাত্রায় দেশভাগের কারণে নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন বলেই মনে হয়, তাদের বাই জেনারেশনে দুঃখ, কান্না, দুঃসহ স্মৃতি সংক্রমিত হয়েছিল বলেই সেখানে হয়তো দেশভাগ এত গুরুত্বপূর্ণ।

    উত্তরমুছুন
  2. শাহ ইয়াছিন বাহাদুর১২ জুলাই, ২০১৪ এ ৪:৩০ AM

    এখন কলকাতার তো আসলে কিছু গড়ার নেই, ফলে তাদের যে লেখকরা এখান থেকে বাস্তুহারা হয়ে গিয়েছেন কলকাতায় তারা অতিমাত্রায় দেশভাগের কারণে নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন বলেই মনে হয়, তাদের বাই জেনারেশনে দুঃখ, কান্না, দুঃসহ স্মৃতি সংক্রমিত হয়েছিল বলেই সেখানে হয়তো দেশভাগ এত গুরুত্বপূর্ণ। .................................. ভীষণ ভাল লাগলো মেহেদী। আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।

    উত্তরমুছুন
  3. একটি অসাধারন পর্যবেক্ষন...
    ওখান থেকে আগত মুসলমানরা বরং বেশিরভাগই স্বেচ্ছায় এপার বাংলায় চলে এলেন হিন্দুদের সঙ্গে ঘর-বাড়ি বিনিময় করে।

    এর কারণ তারা মনে করেছিল, মুসলমান মুসলমান ভাই-ভাই...

    দেশ ভাগ ও সমকালীন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়ীক পরিস্থিতি বিশ্লেষনে িএটা খুবই গুরুত্বপূর্ন তথ্য...

    উত্তরমুছুন
  4. হুম! ম্যালাকিছু ভাগ্যিস জন্ম নেই নাই পুর্বে

    উত্তরমুছুন
  5. অনেক গুরুত্ববহ ইতিহাস এবং ব্যাখ্যা জানতে পারলাম কথোপকথনটির মধ্য দিয়ে।

    উত্তরমুছুন