শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে : অরুণ চক্রবর্তী

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩

----------------------
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তখন সাহিত্যের বাঘ, আমি যখন আনন্দবাজারে তার সহকর্মী হলাম। আমি টগবগেযুবক, যুদ্ধ ফেরত সাংবাদিক, সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক গর্ব। নানা কথায় প্রায়ই খোটাখুটি লাগত দুজনের। খানিক মান অভিমান, কথাবার্তা বন্ধ, আবার চা খাওয়াখায়ী, শ্যামলদাকে অমান্য করবে কে?একদিনের কথা বলি।


আমাদের রাতের ডিউটি। একদিন ‘ইমপ্রিন্ট’ পত্রিকায় সদ্য জন্ম নেয়া বাংলাদেশের ওপরে কুলদীপনায়ারের একটা লেখা পড়ে দারুণ লেগেছে বলছিলাম আমার সমবয়সী কলিগ রথীন্দ্র মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শ্যামলদা টেবিলের ওপারে এসে বসে সব শুনলেন। মাথা নাড়লেন।

পরদিন ডিউটিতে এসেই শ্যামলদার পেশীবহুল খিঁচোনো মুখের সামনে। ভাগ্যিস ভগবান তাঁর চিকণ দাঁতের পাটি মুখের হা-র ভেতরে সেট করেছেন, নইলে..., ‘তোরা সাংবাদিকতা করিস? ইউনিভার্সিটিরডিগ্রি আছে বলেই মস্ত সাংবাদিক? মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা গোলাগুলি লাফিয়ে গেল আর অমনি বড়সাংবাদিক?...’ কিছু বোঝার আগেই রথীনের চোখে ইশারা ঝলকে ওঠে। চুপ করে থাকি। দুম করে ‘ইমপ্রিন্ট’র পরিচিত কপিটা ছুটে গায়ে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে পড়ল। ‘খামোকা তোদের কথা শুনে পয়সাখরচ করে কিনতে হল! প্রভাতদা, আজকের লীড নিউজটা অরুণ লিখব আমি মূর্খ। লিখব না।‘ রাগ নাবালাই ষাট। সেই আমার প্রথম লীড নিউজ লেখা। শ্যামলদার সঙ্গে কথা বন্ধ। পাতা ছেড়ে আমরা যে যারটেবিলে যার যার বিছানা পেতে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।


তখনও ভোর কাকের বুকের মতোও ধোঁয়াশা নয়। কে যেন, আস্তে আস্তে আদরে ঘুম ভাঙাচ্ছেআমার,’ অরুণ, ভাইরে আমার। উঠে পড়্‌, চল আমার বাড়িতে। চা খাব তিনজনে। এই তোর পা ধরি,ভাই আমার, এমন ভুল আর করব না! আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠি। দেখি, রথীনকে তার আগেইজগিয়ে দিয়েছেন শ্যামালদা। সে বিছানায় বসে পা দুলাচ্ছে...


১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩
------------------
সেই প্রথম শ্যামলদার (গঙ্গোপাধ্যায়) দিল্লি আসা। ১৯৮৭। আমার উদ্যোগে এক সর্বভারতীয় লেখক সমাবেশে। সঙ্গে শক্তিদা (চট্টোপাধ্যায়)। এর আগে শ্যামলদাকে কেউ কখনো বাংলা সীমান্তের বাইরে কোন সাহিত্য সভায় আমন্ত্রণ জানান নি। সবার এক কথা, ‘হি ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু ম্যানেজ।‘ সত্যি, তিনি ডিফিকাল্টই শুধু নন, আনকনট্রোলেব্ল্। কিন্তু কোথাও তিনি একবারের জন্যও ভুল নন। শ্যামলদাকে অসৎ, অন্যয্য হতে দেখিনি একবারও।

শক্তিদা কোথাও গেলেই সারা শহর জুড়ে হুল্লোড় পড়ে যায়। সেটা কবিতার মতই শক্তিদার পাত্রে-অপাত্রে ভালোবাসা বিলোবার ফল। অন্যদিকে শ্যামলদা সঠিক আর অতল তীক্ষ্ণ দৃষ্টির গল্পকার, তার ভালোবাসা অপাত্রে উপচে পড়ে না কখনই। তাই রেল বোর্ডের এক জেনারেল ম্যানেজার, আগে লেখালেখি করতেন, পড়েছি কিছু কিছু, যখন বললেন, ‘শনিবার রাতে আমার বাড়িতে ডিনার। শক্তিদা শ্যামলদাকে বলে গেলাম, আপনিও আসবেন।‘ আমার রাজি না-রাজির সুযোগ ছিল না। শক্তিদা আমার দ্বিধা দেখেই বলে বসলেন, ‘সঙ্গে মিহির (রায়চৌধুরি) না-থাকলে যাব না।‘


বিকেল চারটে-পাঁচটা নাগাদ, রিং রোডের হায়াৎ রিজেন্সীর উলটো দিকে ঢাউস ঢাউস ফ্ল্যাটের সুরক্ষিত রেল অফিসার্স কলোনীতে পোঁছে গেলাম। লালমতি দত্ত (নামটা পালটে দিলাম) সস্ত্রীক দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। মস্ত ড্রইং রুমের সুসজ্জিত লম্বা ডাইনিং টেবিল পাক দিয়ে আমরা আরও লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে ঢাউস এক বারান্দায় পৌঁছে গেলাম। পাঁচতলা উচ্চতায় এত বড় বারান্দা? মিহিরদা কানে কানে বললেন, ‘এই পরিবেশে স্কচ। অরুণ, দারুণ জমবে!’--‘সাবধান মিহিরদা, হিমাদ্রি দত্তের বাড়িতে, সুনীলদার জন্য স্কচ আর আমার-আপনার জন্য এরিস্টোক্র্যাট, ভুলে গেলেন? আঁচাতে তো দিন!’

লালমতিদা ঝকঝকে ট্রে’র ওপরে চারটি জলভরা গ্লাস নিয়ে এলেন। নিজেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘আজ ঝি চাকর বাবুর্চিদের ছুটি দিয়েছি।‘ কেউ বাড়িতে এলে, ইলেক্ট্রিসিয়ান হলেও, জল খাওয়ানো দিল্লির দস্তুর। শক্তিদা-শ্যামলদার তা জানার কথা নয়। ওরা ভ্রূ কোঁচকালেন। ‘আনব আনব!’, লালামতিদা হাসলেন, শক্তিদাকে ডাকলেন, ‘আসুন, শক্তিদা।‘ ওরা দুজন ভেতরে চলে গেলেন। খানিক পরে শক্তিদা এলেন, হাতে হীরের মতো কাট গ্লাসে হুইস্কি। মিহিরদা লোভীর মত তাকাতেই, ‘লালামতি আনছে’, শক্তিদা আমাদের আগাম খবর দিলেন। আমি শ্যামলদার পাশে, মুখ লাল, কারণ ঠাহর করতে পারি না, বললেন, ‘ এবার জানবে ব্যাটা, শ্যামল গাঙ্গুলি কার নাম।‘ হয়ে গেল! আমি চারিদিকে দামামার বাজনা শুনি। ভয়ে মিহিরদার দিকে তাকাই। মিহিরদা শক্তিদার সঙ্গে গল্পে মশগুল।

রেলের এক জেনারেল ম্যানেজার লালমতি দত্ত। ঝকঝকে কাট গ্লাসে মিষ্টি সোনা রঙের হুইস্কি প্রথমে শ্যামলদার দিকে এগিয়ে দিলেন। শ্যামলদা অভয় মুদ্রায় হাত তোলেন, লালমতিদার দিকে তাচ্ছিল্যে না তাকিয়েই বললেন, ‘নো। ওই হুইস্কি আমি খাব না।‘ লালমতিদা থতমত। আমরা তিনজন হেসে উঠি। লালমতিদা সহজ হন, ‘যাঃ! ধরুন না, শ্যামলদা!’

‘আই অ্যাম সিরিয়াস। খাবো না। শক্তিকে ডেকে নিয়ে আলাদা গ্লাস ধরিয়ে আপনি আমারটাতে বিষ মিশিয়েছেন। আমাকে মেরে ফেলার জন্য।‘ শ্যামলদা যেন গর্জে ওঠা থেকে নিজেকে সংযত করলেন মাত্র। আমি অপমানে, হতাশায় মাটিতে মিশে যাই আর কি। বাকি দুজনের কার কি রিয়্যাকশন এখন মনে করতে পারছি না। রেলবোর্ডের অন্যতম জিএম লালমতি দত্ত রক্তবর্ণ, নতমুখ। আমাদের কারো দিকে তাকাচ্ছেন না।

শ্যামলদা এবার বাঁ পায়ে ডান পা ক্রস করে বেতের চেয়ারে হেলান দিলেন রাজার মতো ডানহাতের তর্জনী নেড়ে নেড়ে বললেন, ‘আগে আপনি গ্লাসটাতে চুমুক দিন, তারপর আমি নেব।‘

আমি কি প্রতিবাদ করিনি? নিশ্চয়ই করেছি, কিন্তু ঘটনার ঘণঘটায় এখন আর মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে, লালমতিদা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে শ্যামলদার দিকে এগিয়ে দিলেন, শ্যামলদা তাতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। এবার স্ন্যাক্স নেব...



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ