নবনীতা মুখোপাধ্যায়
ভারতের স্বাধীনতা লাভের আগে স্বপ্নবিলাসী জর্মান হোসেন হঠাৎ কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লিগের জোরদার সমর্থক হয়ে ওঠেন। বীরভূমের ভিটেমাটি ছেড়ে মুর্শিদাবাদের সালারে আসেন এই আশায়, পাকিস্তান তৈরি হলে সালার ওই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হবে। সালারের নক্ষত্রখচিত আকাশ, খোয়াবে আসা জ্বিনের বাদশা এবং ধর্মীয়-রাজনৈতিক নানা স্বপ্ন-বাস্তবতা পেরিয়ে তিনি ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার মুখোমুখি হন। বাংলার তখতে তখন হোসেন শহিদ সুহরাবর্দি। দাঙ্গার ঠিক এক বছর পরে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা পায়। মুর্শিদাবাদ প্রাথমিক ভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। নানা টানাপোড়েনে তিন দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর জর্মান মিঞার স্বপ্নভঙ্গ হয়। মুর্শিদাবাদ পুনরায় ভারতে ফিরে আসে। জর্মান হোসেন ঠিক করেন তিনি নিজের গ্রাম বীরভূমে ফিরে যাবেন, সেই মোতাবেক তিনি যাত্রা শুরু করেন।
আপাতদৃষ্টিতে “সাত আসমান” উপন্যাসের এই হল বিষয়। কিন্তু শামিম আহমেদের আখ্যানটিকে এ ভাবে চিত্রিত করলে তার প্রতি সুবিচার করা হবে না। উপন্যাসটির সাতটি পর্ব আছে। প্রথম অংশটির নাম “আল মকাম আল আমিন” যার অর্থ হল নিরাপদ স্থান। স্বপ্নবিলাসী জর্মান হোসেন বীরভূমের এক গ্রামের সম্পন্ন পরিবারের সদস্য। তাঁর স্ত্রীর প্রসব-বেদনা যখন তীব্রতর হল, তখন প্রাকৃতিক ডাকে মিঞা বাইরে গিয়ে এক অদ্ভুত জিনিস দেখেন। যে কেবলই তাকে উলটো পথে নিয়ে যেতে চায়। সেটা ১৯৪২ সাল। এক দিকে বিশ্বযুদ্ধ, অন্য দিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দলনের ঢেউ এসে পড়েছে এই গ্রামে। সবার উপরে রয়েছে মন্বন্তর। অসামান্য বিবরণ তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। খোয়াববিলাসী জর্মান হোসেনের স্বপ্ন-রোগ সারাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মুর্শিদাবাদের সালারে। সেখানে আছে এক জাগ্রত মাজার। গ্রামের লিগ-কংগ্রেস ঝগড়া ত্যাগ করে তিনি যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু পথে দেখলেন এক মৃতদেহকে। এই সেই মৃতদেহ যা জর্মান মিঞাকে সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায়।
ফেরেশতা-জ্বিন-জিন্নাহ-শ্যামাপ্রসাদ-নেহরু-গান্ধী-মাদানি সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে দার-উল-মকাম অর্থাৎ গৃহে প্রবেশ করেন জর্মান হোসেন। এটি উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ। “মেজ মিঞা ধুতিটা পরেছিলেন মালকোঁচা দিয়ে। তা দেখে একটু ক্ষুব্ধ হলেন শাহ রুস্তমের মাজারের খাদিম। ও আবার কী রকমের হিঁদুয়ানি! তিনি মুখে কিছু না বলে শুধু হুকুমের স্বরে মেজ মিঞাকে ধুতিটা খুলে লুঙ্গির মতো করে পরতে বললেন। তারপর উপবিষ্ট লোকজনের উদ্দেশ্যে হেদায়েত দান করতে লাগলেন, কেন মুসলমানের ভারতের হয়ে যুদ্ধ করা উচিত। জর্মান মিঞা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যান, এই লোকটা আসলে দেওবন্দি...............”
এই পর্বের সবচেয়ে আগ্রহের চরিত্র হলেন জুলফিকার মিঞা। যিনি আসলে তুর্কি, শিয়া আলেভি। তার সঙ্গে জর্মান মিঞার কথোপকথন অসামান্য। জ্বিনের বাদশা, বদরেদ্দোজা এই পর্বেই ঢুকে নিজেদের পাকা আসন করে নেন উপন্যাসের ইতিবৃত্তে। জর্মান মিঞা সালারে বাস করবেন ঠিক করলেন। তিনি কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লিগের সমর্থক হয়ে ওঠেন। পাকিস্তান হলে সালার তার মধ্যেই পড়বে, অতএব এখানেই বাস করবেন তিনি। নতুন বাড়িতে এলেন তিনি উপন্যাসের তৃতীয় অংশে। এখানে তাঁর উপর ভর করল দুই নেশা। এক, কলের গান যেখানে মাঝেমধ্যে বেজে ওঠে কুন্দনলাল সায়গল আর আমিরবাঈয়ের গাওয়া সেই গানঃ
কেয়া হামনে বিগাড়া হ্যায়
কিঁউ হামকো সাঁতাতে হো...
হাম খেলেঙ্গে জিস দিলসে
উস দিলকো ছুপাতে হো...
কখনও বা মুকেশের কন্ঠে বেজে ওঠে,
দিল জ্বলতা হ্যায় য়ো জ্বলনে দে
আঁসু না বাহা পার ইয়াদানা করকে
তু পর্দানশীঁ কা আশিক হ্যায়...
আর দু নম্বর নেশা হল এক পর্দানশিন আওরত, জানলা খুললেই যাকে দেখা যায় পুকুরের অন্য প্রান্তে।
চলছে রাজনীতি। ভোটপর্ব। নিখুঁত বর্ণনায় আর দক্ষতায় তা উঠে এসেছে শামিমের ধারালো কলমে। মুর্শিদাবাদের প্রিন্স কাজেম আলি মির্জা যার বাবা নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা আর মুর্তাজা রেজা নির্বাচনে জয়ী দুই লিগ নেতা চান এই জেলা পাকিস্তানে যাক, কিন্তু নবাব চান ভারতে থাকতে। এর পেছনের রহস্যটা কী! ও দিকে বাংলার তখতে বসলেন হোসেন শহিদ সুহরাবর্দি। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের বিবি এক রুশ নর্তকী, প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছেন বহু কাল। কে এই রুশ নর্তকী, যিনি লিগের হয়ে কংগ্রেসের সভাপতি কিরণশঙ্কর রায়ের সঙ্গে কী দর কষলেন! কীভাবেই বা তিনি ভারতে এলেন! রাশিয়ার নাগরিক ওই নর্তকী আদতে পোলিশ। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় জর্মানিতে, এক রুশ যুবকের সঙ্গে যিনি আবার গ্রিক অর্থোডক্স। তাঁদের বিয়ে ভাঙে কলকাতার আদালতে। চেখভের স্ত্রীর শিষ্যা ওই রুশ নর্তকী ভেরা নাখোদা মসজিদে গিয়ে ধর্মান্তরিত হন, তাঁর নাম হয় বেগম নুরজাহান। এই পর্বে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র দেখা যায়, যাদের চিত্রায়ন উপন্যাসটিকে অনেক খানি উচ্চতায় তুলে ধরে। রেজাউল করিম, সরোজ রায়চৌধুরী, বিজন ভট্টাচার্যের ঠাকুর্দা রাসবিহারী ভট্টাচার্য প্রমুখ।
পরের অংশটি সম্ভবত এই আখ্যানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। সুহরাবর্দির ভূমিকা। কলকাতা মায় বাংলায় ঠিক কী হয়েছিল সে দিন! লেখকের নির্মোহ বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে।
পরের বছর এল স্বাধীনতা। ১৪ অগস্ট মুর্শিদাবাদ স্বাধীনতা পেল। হাজারদুয়ারির চূড়ায় উঠল সবুজ পতাকা। সালারের ঠিক পাশেই বর্ধমান জেলা, সেখান থেকে মুসলমানেরা আসতে লাগলেন, পাকিস্তানে থাকবেন বলে। মুর্শিদাবাদের এই এলাকার হিন্দুরা ভারতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। কিন্তু তিন দিন কেটে যাওয়ার পরে সেই সংবাদ এল, তা সুসংবাদ নয়া দুঃসংবাদ, তা বোঝা যায় না। জর্মান মিঞা নিজের গ্রাম বীরভূমে ফিরে যাবেন ঠিক করলেন। কিন্তু নিজস্ব মকামে পৌঁছতে গিয়ে তিনি কীসের মুখোমুখি হলেন! সেই কাহিনি বলে দিলে উপন্যাসটির ভবিষ্যত-পাঠকের প্রতি অবিচার করা হবে।
জর্মান হোসেনের স্ত্রী কামরুন্নেসা এই কাহিনির সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র। শুরুতেই তাঁর ডায়েরি পাওয়া যাচ্ছে যেখানে তিনি লিখছেনঃ
...দুনিয়াময় মারামারি লাগিয়াছে। আর এই বাড়িতে রোজ গণ্ডা গণ্ডা লোক ভাত চাহিতে আসে......দেড় মণ ধানের বদলে মেয়ে, একটি ছাগলের বদলে একখানা লুঙ্গি কেনা হইতেছে।...
এ দিকে নেতাজি ভারত ছাড়িয়া চলিয়া গিয়েছেন...। শ্যামাবাবু হক সাহেবের সঙ্গ ছাড়িয়াছে।...
এই কামরুন্নেসার কাছ থেকে মানসিকভাবে বিপন্ন জর্মান মিঞা রাজনৈতিক পাঠ নেন। র্যাডক্লিফের জটিল অঙ্ক বুঝতেও দ্বারস্থ হতে হয় কামরুন্নেসার। কে এই কামরুন্নেসা? তাঁর অন্যএক অতীত আছে। সে অতীত বড়ই রহস্যময়। পুরনো দিনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখেন তাঁর এক অলটার-ইগোর মাধ্যমে।
উপন্যাসটির অন্যতম সম্পদ হল এর ভাষা। লেখক যে ভাষায় এটি লিখেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। বিশেষ করে জর্মান মিঞার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত বর্ণনায় এমন ভাষা খুব প্রয়োজনীয় ছিল। সাত আসমানের স্বপ্নগুলো সাইকো-অ্যানালিসিসের নিরিখে দেখলে বহু মণি-রত্নের সন্ধান পাওয়া যাবে। উপন্যাসে আছে প্রচুর ইসলামি মিথ। তবে তার বুনোট কাহিনির সঙ্গে খাপ খেয়েছে চমৎকার। যেমন সাত আসমানের কোথায় কোন নবি আছেন, সেই আসমানগুলোর নাম কী, সেই আসমানের সঙ্গে জর্মান মিঞার জীবনের পর্বগুলোরই বা কি মিল! পাশাপাশি শামিম এ বিষয়ে একটি উপন্যাসে যা লিখেছেন তাতে অনায়াসে আরও সাতটি উপন্যাস হয়ে যেত। বাংলা সাহিত্যে এমন উপন্যাস ক্লাসিকের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। সাত আসমানকে নিছক পার্টিশন লিটারেচর ভাবলে ভুল ভাবা হবে। দেশভাগের যন্ত্রণার পাশাপাশি সমাজ, ধর্ম আর ব্যক্তি্র অন্তরমহলে যে ভাবে এই আখ্যান ঢুকে পড়েছে, তাতে বিস্মিত হতে হয়।
১৯৪২ থেকে ১৯৪৭-এর ১৮ অগস্ট, এই উপন্যাসের সময়কাল। আপাতভাবে স্থান দুটি। এক, বীরভূমের একটি গ্রাম; দুই, মুর্শিদাবাদের সালার। কিন্তু এই দুটি স্থান যে শূন্যে ভাসমান নয়, তা বোঝা যায় উপন্যাসের প্রতিটি ছত্রে। বাংলার রাজনীতি, ভারতবর্ষের পরাধীনতা, আন্তর্জাতিক হালচাল অবধারিতভাবে ধরা দিয়েছে এই আখ্যানে। “সাত আসমান” তাই যথার্থ অর্থে একটি আন্তর্জাতিক উপন্যাস। খুব শীঘ্র আখ্যানটি একটি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে ইংরেজি ভাষায় বের হবে। কলকাতার গাঙচিল বাংলা এই উপন্যাসের প্রকাশক।
সাত আসমান, শামিম আহমেদ, গাঙচিল, কলকাতা, নভেম্বর ২০১২, দামঃ ১৭৫ টাকা
(ই-বুক পাওয়া যায়। যোগাযোগঃ shamim.phil@gmail.com)
** ডঃ নবনীতা মুখোপাধ্যায় হাওড়া বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপিকা। মূলত কবি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৩।
ভারতের স্বাধীনতা লাভের আগে স্বপ্নবিলাসী জর্মান হোসেন হঠাৎ কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লিগের জোরদার সমর্থক হয়ে ওঠেন। বীরভূমের ভিটেমাটি ছেড়ে মুর্শিদাবাদের সালারে আসেন এই আশায়, পাকিস্তান তৈরি হলে সালার ওই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হবে। সালারের নক্ষত্রখচিত আকাশ, খোয়াবে আসা জ্বিনের বাদশা এবং ধর্মীয়-রাজনৈতিক নানা স্বপ্ন-বাস্তবতা পেরিয়ে তিনি ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার মুখোমুখি হন। বাংলার তখতে তখন হোসেন শহিদ সুহরাবর্দি। দাঙ্গার ঠিক এক বছর পরে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা পায়। মুর্শিদাবাদ প্রাথমিক ভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। নানা টানাপোড়েনে তিন দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর জর্মান মিঞার স্বপ্নভঙ্গ হয়। মুর্শিদাবাদ পুনরায় ভারতে ফিরে আসে। জর্মান হোসেন ঠিক করেন তিনি নিজের গ্রাম বীরভূমে ফিরে যাবেন, সেই মোতাবেক তিনি যাত্রা শুরু করেন।
আপাতদৃষ্টিতে “সাত আসমান” উপন্যাসের এই হল বিষয়। কিন্তু শামিম আহমেদের আখ্যানটিকে এ ভাবে চিত্রিত করলে তার প্রতি সুবিচার করা হবে না। উপন্যাসটির সাতটি পর্ব আছে। প্রথম অংশটির নাম “আল মকাম আল আমিন” যার অর্থ হল নিরাপদ স্থান। স্বপ্নবিলাসী জর্মান হোসেন বীরভূমের এক গ্রামের সম্পন্ন পরিবারের সদস্য। তাঁর স্ত্রীর প্রসব-বেদনা যখন তীব্রতর হল, তখন প্রাকৃতিক ডাকে মিঞা বাইরে গিয়ে এক অদ্ভুত জিনিস দেখেন। যে কেবলই তাকে উলটো পথে নিয়ে যেতে চায়। সেটা ১৯৪২ সাল। এক দিকে বিশ্বযুদ্ধ, অন্য দিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দলনের ঢেউ এসে পড়েছে এই গ্রামে। সবার উপরে রয়েছে মন্বন্তর। অসামান্য বিবরণ তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। খোয়াববিলাসী জর্মান হোসেনের স্বপ্ন-রোগ সারাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মুর্শিদাবাদের সালারে। সেখানে আছে এক জাগ্রত মাজার। গ্রামের লিগ-কংগ্রেস ঝগড়া ত্যাগ করে তিনি যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু পথে দেখলেন এক মৃতদেহকে। এই সেই মৃতদেহ যা জর্মান মিঞাকে সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায়।
ফেরেশতা-জ্বিন-জিন্নাহ-শ্যামাপ্রসাদ-নেহরু-গান্ধী-মাদানি সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে দার-উল-মকাম অর্থাৎ গৃহে প্রবেশ করেন জর্মান হোসেন। এটি উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ। “মেজ মিঞা ধুতিটা পরেছিলেন মালকোঁচা দিয়ে। তা দেখে একটু ক্ষুব্ধ হলেন শাহ রুস্তমের মাজারের খাদিম। ও আবার কী রকমের হিঁদুয়ানি! তিনি মুখে কিছু না বলে শুধু হুকুমের স্বরে মেজ মিঞাকে ধুতিটা খুলে লুঙ্গির মতো করে পরতে বললেন। তারপর উপবিষ্ট লোকজনের উদ্দেশ্যে হেদায়েত দান করতে লাগলেন, কেন মুসলমানের ভারতের হয়ে যুদ্ধ করা উচিত। জর্মান মিঞা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যান, এই লোকটা আসলে দেওবন্দি...............”
এই পর্বের সবচেয়ে আগ্রহের চরিত্র হলেন জুলফিকার মিঞা। যিনি আসলে তুর্কি, শিয়া আলেভি। তার সঙ্গে জর্মান মিঞার কথোপকথন অসামান্য। জ্বিনের বাদশা, বদরেদ্দোজা এই পর্বেই ঢুকে নিজেদের পাকা আসন করে নেন উপন্যাসের ইতিবৃত্তে। জর্মান মিঞা সালারে বাস করবেন ঠিক করলেন। তিনি কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লিগের সমর্থক হয়ে ওঠেন। পাকিস্তান হলে সালার তার মধ্যেই পড়বে, অতএব এখানেই বাস করবেন তিনি। নতুন বাড়িতে এলেন তিনি উপন্যাসের তৃতীয় অংশে। এখানে তাঁর উপর ভর করল দুই নেশা। এক, কলের গান যেখানে মাঝেমধ্যে বেজে ওঠে কুন্দনলাল সায়গল আর আমিরবাঈয়ের গাওয়া সেই গানঃ
কেয়া হামনে বিগাড়া হ্যায়
কিঁউ হামকো সাঁতাতে হো...
হাম খেলেঙ্গে জিস দিলসে
উস দিলকো ছুপাতে হো...
কখনও বা মুকেশের কন্ঠে বেজে ওঠে,
দিল জ্বলতা হ্যায় য়ো জ্বলনে দে
আঁসু না বাহা পার ইয়াদানা করকে
তু পর্দানশীঁ কা আশিক হ্যায়...
আর দু নম্বর নেশা হল এক পর্দানশিন আওরত, জানলা খুললেই যাকে দেখা যায় পুকুরের অন্য প্রান্তে।
চলছে রাজনীতি। ভোটপর্ব। নিখুঁত বর্ণনায় আর দক্ষতায় তা উঠে এসেছে শামিমের ধারালো কলমে। মুর্শিদাবাদের প্রিন্স কাজেম আলি মির্জা যার বাবা নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা আর মুর্তাজা রেজা নির্বাচনে জয়ী দুই লিগ নেতা চান এই জেলা পাকিস্তানে যাক, কিন্তু নবাব চান ভারতে থাকতে। এর পেছনের রহস্যটা কী! ও দিকে বাংলার তখতে বসলেন হোসেন শহিদ সুহরাবর্দি। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের বিবি এক রুশ নর্তকী, প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছেন বহু কাল। কে এই রুশ নর্তকী, যিনি লিগের হয়ে কংগ্রেসের সভাপতি কিরণশঙ্কর রায়ের সঙ্গে কী দর কষলেন! কীভাবেই বা তিনি ভারতে এলেন! রাশিয়ার নাগরিক ওই নর্তকী আদতে পোলিশ। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় জর্মানিতে, এক রুশ যুবকের সঙ্গে যিনি আবার গ্রিক অর্থোডক্স। তাঁদের বিয়ে ভাঙে কলকাতার আদালতে। চেখভের স্ত্রীর শিষ্যা ওই রুশ নর্তকী ভেরা নাখোদা মসজিদে গিয়ে ধর্মান্তরিত হন, তাঁর নাম হয় বেগম নুরজাহান। এই পর্বে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র দেখা যায়, যাদের চিত্রায়ন উপন্যাসটিকে অনেক খানি উচ্চতায় তুলে ধরে। রেজাউল করিম, সরোজ রায়চৌধুরী, বিজন ভট্টাচার্যের ঠাকুর্দা রাসবিহারী ভট্টাচার্য প্রমুখ।
পরের অংশটি সম্ভবত এই আখ্যানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। সুহরাবর্দির ভূমিকা। কলকাতা মায় বাংলায় ঠিক কী হয়েছিল সে দিন! লেখকের নির্মোহ বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে।
পরের বছর এল স্বাধীনতা। ১৪ অগস্ট মুর্শিদাবাদ স্বাধীনতা পেল। হাজারদুয়ারির চূড়ায় উঠল সবুজ পতাকা। সালারের ঠিক পাশেই বর্ধমান জেলা, সেখান থেকে মুসলমানেরা আসতে লাগলেন, পাকিস্তানে থাকবেন বলে। মুর্শিদাবাদের এই এলাকার হিন্দুরা ভারতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। কিন্তু তিন দিন কেটে যাওয়ার পরে সেই সংবাদ এল, তা সুসংবাদ নয়া দুঃসংবাদ, তা বোঝা যায় না। জর্মান মিঞা নিজের গ্রাম বীরভূমে ফিরে যাবেন ঠিক করলেন। কিন্তু নিজস্ব মকামে পৌঁছতে গিয়ে তিনি কীসের মুখোমুখি হলেন! সেই কাহিনি বলে দিলে উপন্যাসটির ভবিষ্যত-পাঠকের প্রতি অবিচার করা হবে।
জর্মান হোসেনের স্ত্রী কামরুন্নেসা এই কাহিনির সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র। শুরুতেই তাঁর ডায়েরি পাওয়া যাচ্ছে যেখানে তিনি লিখছেনঃ
...দুনিয়াময় মারামারি লাগিয়াছে। আর এই বাড়িতে রোজ গণ্ডা গণ্ডা লোক ভাত চাহিতে আসে......দেড় মণ ধানের বদলে মেয়ে, একটি ছাগলের বদলে একখানা লুঙ্গি কেনা হইতেছে।...
এ দিকে নেতাজি ভারত ছাড়িয়া চলিয়া গিয়েছেন...। শ্যামাবাবু হক সাহেবের সঙ্গ ছাড়িয়াছে।...
এই কামরুন্নেসার কাছ থেকে মানসিকভাবে বিপন্ন জর্মান মিঞা রাজনৈতিক পাঠ নেন। র্যাডক্লিফের জটিল অঙ্ক বুঝতেও দ্বারস্থ হতে হয় কামরুন্নেসার। কে এই কামরুন্নেসা? তাঁর অন্যএক অতীত আছে। সে অতীত বড়ই রহস্যময়। পুরনো দিনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখেন তাঁর এক অলটার-ইগোর মাধ্যমে।
উপন্যাসটির অন্যতম সম্পদ হল এর ভাষা। লেখক যে ভাষায় এটি লিখেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। বিশেষ করে জর্মান মিঞার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত বর্ণনায় এমন ভাষা খুব প্রয়োজনীয় ছিল। সাত আসমানের স্বপ্নগুলো সাইকো-অ্যানালিসিসের নিরিখে দেখলে বহু মণি-রত্নের সন্ধান পাওয়া যাবে। উপন্যাসে আছে প্রচুর ইসলামি মিথ। তবে তার বুনোট কাহিনির সঙ্গে খাপ খেয়েছে চমৎকার। যেমন সাত আসমানের কোথায় কোন নবি আছেন, সেই আসমানগুলোর নাম কী, সেই আসমানের সঙ্গে জর্মান মিঞার জীবনের পর্বগুলোরই বা কি মিল! পাশাপাশি শামিম এ বিষয়ে একটি উপন্যাসে যা লিখেছেন তাতে অনায়াসে আরও সাতটি উপন্যাস হয়ে যেত। বাংলা সাহিত্যে এমন উপন্যাস ক্লাসিকের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। সাত আসমানকে নিছক পার্টিশন লিটারেচর ভাবলে ভুল ভাবা হবে। দেশভাগের যন্ত্রণার পাশাপাশি সমাজ, ধর্ম আর ব্যক্তি্র অন্তরমহলে যে ভাবে এই আখ্যান ঢুকে পড়েছে, তাতে বিস্মিত হতে হয়।
১৯৪২ থেকে ১৯৪৭-এর ১৮ অগস্ট, এই উপন্যাসের সময়কাল। আপাতভাবে স্থান দুটি। এক, বীরভূমের একটি গ্রাম; দুই, মুর্শিদাবাদের সালার। কিন্তু এই দুটি স্থান যে শূন্যে ভাসমান নয়, তা বোঝা যায় উপন্যাসের প্রতিটি ছত্রে। বাংলার রাজনীতি, ভারতবর্ষের পরাধীনতা, আন্তর্জাতিক হালচাল অবধারিতভাবে ধরা দিয়েছে এই আখ্যানে। “সাত আসমান” তাই যথার্থ অর্থে একটি আন্তর্জাতিক উপন্যাস। খুব শীঘ্র আখ্যানটি একটি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে ইংরেজি ভাষায় বের হবে। কলকাতার গাঙচিল বাংলা এই উপন্যাসের প্রকাশক।
সাত আসমান, শামিম আহমেদ, গাঙচিল, কলকাতা, নভেম্বর ২০১২, দামঃ ১৭৫ টাকা
(ই-বুক পাওয়া যায়। যোগাযোগঃ shamim.phil@gmail.com)
** ডঃ নবনীতা মুখোপাধ্যায় হাওড়া বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপিকা। মূলত কবি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৩।
0 মন্তব্যসমূহ