গ্রন্থলোক : নীহারুল ইসলামের দু’টি গ্রন্থ

‘পঞ্চব্যাধের শিকার পর্ব’ (১৯৯৬), ‘জেনা’ (২০০০), ‘আগুনদৃষ্টি ও কালোবিড়াল’ (২০০৪), ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা (২০০৮)-র মতো গল্পগ্রন্থের পর প্রকাশিত হয়েছে নীহারুল ইসলামের ‘জনম দৌড়’ (উপন্যাস) ও ‘মজনু হবার রূপকথা’ (দু’টি নভেলার সংকলন)। দু’টি গ্রন্থেই নীহারুলের স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গী ও মৌলিক চিন্তা-ভাবনার পরিচয় রয়েছে। বিষয়বস্তুর মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও পটভূমি হিসেবে নীহারুল বেছে নিয়েছেন তাঁর চিরচেনা লালগোলা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশ। আর চরিত্র ও জনজীবন হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মুসলমান সমাজ। মান্যচলিত কথ্যরীতির সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে গদ্যরীতির মধ্যেও নীহারুল অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। দু’টি গ্রন্থেরই উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হ’লো ভাষার গুণেই আখ্যান যেমন বিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে, তেমনি আঞ্চলিকতার গুণে চরিত্রগুলি অত্যন্ত সজীব ও প্রাণবন্ত বলে মনে হয়।


‘জনম দৌড়’ উপন্যাসে নায়ক জনম আর তার প্রেমিকা তৃণার জীবনের পাঁচটি দিনের কথা বর্ণিত হয়েছে। জনমের বাবার মৃত্যুর আগের সন্ধ্যা থেকে কাহিনির সূত্রপাত এবং পরিসমাপ্তি ঘটেছে ‘চাহারূম’ বা চারদিনের পারলৌকিক কাজের সন্ধ্যায়। ম্যানেজমেন্ট পাশ করা চাকুরে মুসলমান যুবক জনমের সঙ্গে হিন্দু মেয়ে তৃণার প্রেম আর এই প্রেমের পরিণতি নিয়ে জনম যখন দ্বিধাগ্রস্ত এমন সময় গ্রামের বাড়ি থেকে অসহায় মায়ের টেলিফোনে কান্না শুনে ব্যাকুল হয়ে জনম বাড়ি গিয়ে দ্যাখে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর চারদিনের পারলৌকিক কাজের আগে মৃতের ‘রূহ’ নিয়ম করে বাড়িতে আসে নিকট আত্মীয়দের খোঁজ নিতে। তাই পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী জনমকে গ্রামের বাড়িতে থেকে যেতে হয়। ছেলেবেলার গ্রাম, সেখানকার মানুষজন তাদের নিয়ে জনমের বাল্যস্মৃতি রোমন্থন এবং আকস্মিক ভাবে শোকসন্তপ্ত জনমকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বাড়িতে শহুরে মেয়ে প্রেমিকা তৃণার আগমন আখ্যানের আকর্ষণকে বাড়িয়ে তুলেছে। উপন্যাসটিতে যৌনতার প্রাচুর্য থাকলেও তার মধ্যে পাপবোধ ও ভয়ঙ্কর পরিণতির যে ইঙ্গিত রয়েছে বাজপাখির মতো জনমকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। জনমের বাবার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জন্য জকিম আর ডিমের আড়তদার পান্নার বাবাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। মিনুর সঙ্গে জনমের বাল্য প্রণয়ে রয়েছে যৌনতার উন্মেষ। চারদিন গ্রামে বসবাসের সূত্রে জনমের কাছে অনেক স্পষ্ট হয়েছে সিরাজভাই, ফকিরভাই, কন্টলনানী, কুড়ানমিস্ত্রি, ডলিভাবি, পটলবুবুর মতো নানা চরিত্র। তৃণা চরিত্রে বাঙালি মেয়ের বৈশিষ্ট্যগুলি নিপুণ ভাবে তুলে ধরায় তৃণা চরিত্রটি সুগঠিত হলেও জনম চরিত্রে একটু ফাঁক থেকে গিয়েছে। জনমকে যতখানি ‘নস্ট্যালজিক’ করে তোলা হয়েছে তার পেশাগত জীবনের জন্য ব্যস্ততা, উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার পরিচয় চরিত্রটিতে আভাসিত হয়নি। গ্রামের পথঘাট, গাছপালা, পুকুরপাড়, গোরস্থান, আর তার সঙ্গে মুসলিম জীবনের নানা সংস্কারে আখ্যানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বাস্তবতার অভাব ঘটেনি। অপরিচিত জনজীবন সম্পর্কে উপন্যাসটি পাঠকদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে তুলবে।

নীহারুলের ‘মজনু হবার রূপকথা’ গ্রন্থে ‘মজনু হবার রূপকথা’ ও ‘প্রজাপতি সফরে এক লাশ ও তার ইতিবৃত্ত’ নামক দু’টি আখ্যান যুক্ত হয়েছে। দু’টি রচনাতেই আঙ্গিকের অভিনবত্ব লক্ষ করা যায়। ‘মজনু হবার রূপকথা’ আখ্যানটিতে সাংঘাতিক পর্দানশীন সাদুল্লা মিঞার এক রকম দেখতে দুই বিটি তোতা ও ময়নাকে নিয়ে গ্রাম্য যুবকদের আকর্ষণ ও স্বপ্ন কামনার কথা নীহারুল গ্রাম্য কথকদের ভঙ্গীতে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “ ...

আমি সখের কথক মাত্র... ... আমার মতো কথকের উপর বিজ্ঞাপনদাতাদের ভরসা নেই।” গ্রাম্য রাখালিয়া গাথা বা প্যাসটোরাল্‌ ব্যালাড সুরনির্ভর। আলোচ্য আখ্যানটিতে নীহারুল যেন গদ্যে গাথাকাব্য রচনা করেছেন। তোতা-ময়নার রূপ-সৌন্দর্য, তাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে এহেসান, মুর্শেদ, রবুর মতো গ্রাম্য যুবকদের আগ্রহ এবং তাদের একজনকে পাওয়ার জন্য মুর্শেদের মর্মযন্ত্রণা ও তার পরিণতির করুন চিত্র আখ্যানটিতে বর্ণিত হয়েছে।

গ্রামের যে সব ছেলে তোতা-ময়নাকে নিয়ে স্বপ্ন দ্যাখে তারা প্রায় সবাই রাখাল না হয় জনমজুর। তাদের মধ্যে একমাত্র মুর্শেদ নিজেকে তোতা-ময়নার উপযুক্ত বলে মনে করে। মুর্শেদের বাপ কলিম মুন্সী সাদুল্লা মিঞার মতো বড় গেরস্থ না হলেও প্রায় একখান হালের জোত তার। তার ওয়ারিশ বলতে মুর্শেদ একা। তাছাড়া মুর্শেদের পেটেও আছে ক্লাস ফাইভের বিদ্যা। মুর্শেদের মায়ের কাছে মায়মুনা বেওয়ার করা তোতা-ময়নার গল্প শুনে মুর্শেদ তার ইচ্ছে পূরণের জন্য মায়মুনা বেওয়ার বাড়ি যায়। মায়মুনা বেওয়া আবার তাকে পাঠায় পীরডাঙার দরবেশের কাছে। দরবেশের কথামতো তাজা রক্ত সংগ্রহ করতে না পেরে নিজের হাত কেটে শিশিতে ক’রে রক্ত নিয়ে পীরডাঙায় দরবেশের কাছে গিয়ে মুর্শেদ দরবেশের সঙ্গে মায়মুনা বেওয়ার অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতে পারে। মায়মুনা বেওয়ার ফিসফাস কথার মধ্যে ভেসে আসে, “... তুমি একটো ভন্ড দরবেশ। কুন ভাগ্যে না হয় হামাকে বশ কর‍্যাছিলা। সে বুলি তোতা-ময়নাকে বশ করা! ক্ষ্যাপা নাকি? সাদুল্লাভাই আর শরিফাভাবী অধের দুই বিটিকে যেমুন তেমুন করি মানুষ করেনি জী তুমার দুয়া-তাবিজে কলিম মুন্সীর বেটা মুর্শেদের লেগি অরা পাগল হুন যাবে!” এসব শুনে মুর্শেদ পীরডাঙার পাশের আকারপুকুরে রক্তের শিশি ছুঁড়ে ফেলে দিলেও সে অসুস্থ হয়ে তোতা-ময়নার স্বপ্ন দেখে যায়।

‘প্রজাপতি সফরে এক লাশ ও তার ইতিবৃত্ত’ আখ্যানের বিষয়বস্তু অতনু ও সুমনার দাম্পত্য জীবনের মধ্যে প্রজাপতির সঙ্গে অতনুর বিবাহ-অতিরিক্ত সম্পর্ক। আখ্যানের আঙ্গিকের মধ্যে নতুনত্বের পরিচয় আছে। গল্পের মধ্যে রয়েছে অতনুর লেখা গল্প ‘প্রজাপতি সফরে এক লাশ ও তার ইতিবৃত্ত’ এবং ‘ছেঁড়াপাতা’ আর প্রজাপতির লেখা ‘এক শালিখের গল্প’। গল্পগুলির বিন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায় অতনু-সুপর্ণা-প্রজাপতির সম্পর্কের টানাপোড়েন। মাঝখানে সংযোজকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে অতনুর লেখকবন্ধু নীহারুলের জীবনভাষ্য। তার মধ্যে রয়েছে রাজদিঘীর জ্যোৎস্না-মাখা জলে দুই পরীর নগ্ন স্নানের দৃশ্য। যে দুই পরী সুপর্ণা আর প্রজাপতি ছাড়া অন্য কেউ।

দু’টি গ্রন্থই উপভোগ্য, পাঠকদের ভালোলাগার মতো নানা উপকরণ তার মধ্যে রয়েছে।



১।‘জনম দৌড়,’ করুণা প্রকাশনী, কলকাতা (২০১২)
২।‘মজনু হবার রূপকথা’ খোঁজ প্রকাশনী, লালগোলা (২০১২)


***

ড. শ্যামল রায় বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শ্রীপৎ সিং কলেজ, জিয়াগজ্ঞ, মুর্শিদাবাদ



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ