গল্পপাঠঃ সোমেন চন্দের ইঁদুর গল্পটি পড়েছেন?
মেহেদী উল্লাহ : হ্যাঁ পড়েছি।
গল্পপাঠঃ পড়লে কখন পড়েছেন?
মেহেদী উল্লাহ : সম্ভবত ২০১০ সালের মার্চ-এপ্রিলের কোনো এক রাতে। কোনো বিরতি ছাড়াই এক শোয়ায় পড়ে শেষ করেছি। মনে আছে সেরাতে বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যার দিকে তুফান হয়েছিল বলে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমি ঢাকা থেকে হলে ফিরেছি রাত সাড়ে নয়টার দিকে, ফলে তুফান দেখিনি। তুফানের পরিণামের ভোগ হিসেবে বিদ্যুৎ ছাড়াই হলে ফিরেছিলাম। মোবাইলের টর্চের আলোতে গল্পটা পড়তে পড়তে একসময় শহীদুল জহিরের কথা মনে পড়লো। শুরুতে মনে পড়েছিল তাঁর গল্প ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’র কথা। অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে, দুটি গল্পে ইঁদুর আছে। অথচ কতটা তফাত!
গল্পপাঠঃ কার মাধ্যমে বা কিভাবে গল্পটি পেয়েছিলেন?
মেহেদী উল্লাহ : আজহার সাহেবের একটা ঢাঁউস বই আছে। বাংলাদেশের ছোটগল্প : বিষয়-ভাবনা স্বরূপ ও শিল্পমূল্য। এই বইটা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা বিভাগে ছোটগল্প সম্পর্কে বিস্তারিত ও সহজে জানার ‘বাইবেল’। এটা এমন একটা বই, অনেকে গল্প না পড়েই শুধু এই বইটির পাতা উল্টিয়ে এমন শক্ত আলোচনা করতে পারেন গল্পটি নিয়ে যাতে মনে হয় নির্ঘাত গল্পটি একাধিকবার পড়েছেন। যাই হোক, তো আজহার ইসলামের বইটি সেই সময় আমার হাতে আসে। বইটি পড়তে গিয়েই প্রথম জানলাম, বাংলা ভাষায় এমন একটা গল্প আছে যা বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এমনকি, মার্কসবাদী সাহিত্য-ধারায় রচিত গল্পগুলোর পথিকৃত। সেই গল্পটার নাম ‘ইঁদুর। আরো জানতে পারলাম, গল্পটির লেখক মাত্র ২২ বছর বেঁচেছিলেন। অল্পকালের সাহিত্যচর্চায় লেখকের নিজের তো অবশ্যই, বাংলাসাহিত্যের গল্পগুলোর মধ্যে ‘ম্যাগনাম ওপাস’ এটি।
২০১০ সালের একুশে বইমেলায় ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের সম্পাদনায় কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় সোমেন চন্দ রচনাসমগ্র। বইটা কিনলাম। সেই বই থেকেই প্রথম পড়ি ‘ইঁদুর’ গল্পটি।
গল্পপাঠঃ গল্পটি পড়ার পরে আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
মেহেদী উল্লাহ : প্রথম পাঠে গল্পটি নিয়ে যা যা মনে হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল, এটি সোমেনের ২৬টি গল্পের মধ্যে অন্যতম সফল গল্প, ভালো লাগার মতো গল্প। আরো যেটা মনে হয়েছে পরবর্তীকালে দেখলাম, লেখক হুমায়ূন আহমেদেরও তাই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, গল্পটি নিু মধ্যবিত্তদের নিয়ে লেখা। এই গল্পটির প্রভাব হুমায়ূন সাহিত্যের একটা অংশে পড়েছে। ‘ইঁদুর’ গল্প প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ উল্লেখ করেছিলেন, সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পর নিম্ন মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার ও মনসুবিজন নামে তিনটি আলাদা গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি। আসলে, শুধু এই তিনটি গল্পই নয়। হুমায়ূন আহমেদ সারাজীবনে নিুমধ্যবিত্ত নিয়ে যা লিখেছেন সবটার প্রাণ-ভোমরা সোমেনের ইঁদুর। সোমেনের একটামাত্র গল্প একজন লেখককে দিয়ে হাজার-হাজার পৃষ্ঠা লিখিয়ে নিয়েছে। এতটাই শক্তিশালী সোমেন আর ইঁদুর!
এবার আসি মূল পাঠ প্রতিক্রিয়ায়। এতক্ষণ যা বললাম, তা শুধু ইঁদুরের ওপর ভর করেই বললাম। যখন আমি ‘টেক্সটই সব নয়’-- এমনটি ভাববো, তখনই সেখানে আনতে পারি গল্পটির লেখকের জীবানদর্শসহ নানা অ্যাসেন্স। তখন গল্পটাকে মাকর্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা করা যাচ্ছে। নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সোমেন চন্দ পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন বিপ্লবে। মাকর্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে গল্পটি রচিত হতেই পারে। ফলে সেখানে শাসক-শোষিত সম্পর্ক খোঁজ করা যেতেই পারে। নিত্যদিনের ঘরকন্নার মধ্য দিয়ে তিনি অবলীলায় দেখিয়ে দিতেই পারেন শাসনযন্ত্রের কুটিল চালপ্রয়োগ, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষমতার সুক্ষ্ম জাল। ফলে ইঁদুর হয়ে ওঠে. মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা ।
ইঁদুরগুলো যেন দারিদ্রেরই কিলবিলে রূপ। ক্রমাগত শ্রেণীস্বাতন্ত্র টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে রত নিম্ন মধ্যবিত্ত। এলিটের সাপেক্ষে তারা এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস যতদিনের শ্রেণি-শাসনের ইতিহাসও ততদিনের। শিকারী সমাজ থেকে শুরু করে আজকের পুঁজিবাদী সমাজেও তা বিদ্যমান।
গল্পপাঠঃ এই সময়ে গল্পটি বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মেহেদী উল্লাহ : বাংলা কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য যে অর্থে সচেতনভাবে প্রথম মার্কসবাদী কবিতা লিখেছিলেন তেমনি সোমেন চন্দের ইঁদুরও প্রথম সফল-সচেতন মার্কসবাদী ছোটগল্প। কোনো কোনো সমালোচক জানিয়েছেন, সোমেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকের দ্বারা প্রভাবিত। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মানিকের রাজনৈতিক গল্পগুলো লেখা হয়েছে তার লেখক জীবনের দ্বিতীয় অংশে, ততদিনে সোমেনের গল্প রচিত হয়ে গেছে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত মাত্র পাঁচ বছর ছিল সোমেন চন্দের লেখক জীবনের পরিধি। ফলে, একটি আদর্শ বামধারার গল্প ইঁদুর। প্রগতিশীল মাসর্কবাদী জীবনদৃষ্টিসম্পন্ন সোমেনের গল্পে নিন্মবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রাম ও কর্মমুখরতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লক্ষণীয়। ব্যক্তিজীবনে নিন্মবিত্ত সোমেন চন্দ সমাজের বিত্তহীন জীবনযাপন এবং শোষিত শ্রেণির জীবনসংগ্রাম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। গল্পে এ পর্যবেক্ষণের শিল্পিত রূপ ফুটে উঠেছে। মূলত, বিশ শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকে অস্থির দ্বন্দ্বময় সমাজ-সময়ের অন্তঃস্রোত, সভ্যতা ও মানব-অস্তিত্বের বহুকৌণিক জিজ্ঞসার পটভূমিতে সোমেন চন্দ গল্পে সচেতনভাবে নিয়ে আসেন সাম্যবাদী চিন্তা-ধারা। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এই গল্পটি লিখেছিলেন তিনি।
দারিদ্র্যপীড়িত মধ্যবিত্ত পরিবার এই গল্পের উপলক্ষ। পরিবারটিকে কেন্দ্র করেই বিস্তার কাহিনির। সংসারের অবধারিত আনন্দহীনতা আর দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন এমনিতেই নিরানন্দময় আর অসহ্য, সেখানে ইঁদুর এত বেশি বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না। গল্পে ইঁদুর আর দারিদ্র্য সম-প্রতীকি। মধ্যবিত্তের তথাকথিত গৌরবময়তার আসল চেহারার আড়ালে যে মেকি ভাব আছে তা তুলে ধরেন গল্পকার। ইঁদুরের মতো সদা-সন্ত্রস্ত শ্রেণিটি। ইঁদুরের দুধ ফেলে দেওয়াকে কেন্দ্র করে মায়ের গরুর মতো করুন চোখ, বাবা আর মায়ের ঝগড়া, অগত্যা মায়ের ছেলে ঘরে ঘুমাতে যাওয়া--সবই যেন মধ্যবিত্তের করুন কাহিনি। এরপর মধ্যরাতে বাবা আবার মাকে ডাকেন অতি নিচুস্বরে, ‘কনক, ও কনক, ঘুমুচ্ছো?’ গল্পের কথক সুকুমার তখন মনে মনে বাবাকে তার বয়েস ফিরিয়ে দিয়ে ভাবে; যুবক সুকুমার একদিন তার বৌকেও এমনি নাম ধরে ডাকবে, চিৎকার করে ডেকে প্রত্যেকটি ঘর এমনি সঙ্গীতে প্রতিধ্বনিত করে তুলবে। পরদিন বাবা হাসেন। মা’ও হাসেন। এসবই মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বমুখর জীবন, যেন, এই মেঘ, এই রোদ্র--কারো কোথাও যাওয়ার জায়গাটি নেই, মাথা গুঁজার ঠাঁই নেই। দোদুল্যমান অবস্থান জীবনকে সবসময় উত্তর-দক্ষিণ করে রাখে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দেয় না। সবসময় একটা সংকোচ কাজ করে, নিজেকে আড়াল করে রাখার প্রবণতা। লজ্জা-শরমের মাথা না খেয়ে নিজের মাথাটি চারদেয়ালে লুকিয়ে রাখা। অল্পতেই খুশি হয়ে যাওয়া। যেমন,’আরো ক’দিন বাদে রাস্তায় বাবা বোকার মতো হাসতে লাগলেন। ব্যাপার কিছুই নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে।’
মত্তবিধ্যের জীবন এভাবেই স্বর্গের পথ রুদ্ধ হলে মধ্যপথে এসে দাঁড়ায়, জীবন ওদের কুক্ষিগত করলেও জীবনকে প্রচুর অবহেলা করে, প্রকৃতির করাঘাতে ডাক্তারের বদনাম গায়, অথবা ঊর্ধবাহু সন্ন্যাসী হয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করে। এসব দেখে একদিন নিজেদেরই মনে পড়ে, দুঃখের সমুদ্রে যদি কেউ গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে তবে তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বটে, কিন্তু না খেয়ে মরে। যে ফুল অনাদরে শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে এরা তাই। এরা তৈরি করছে বাগান, অথচ ফুলের শোভা দেখেনি। পেটের ভিতর সুঁচ বিঁধছে প্রচুর, কিন্তু ভিক্ষাপাত্রও নয়। পরিহাস! পরিহাস!
মেহেদী উল্লাহ : হ্যাঁ পড়েছি।
গল্পপাঠঃ পড়লে কখন পড়েছেন?
মেহেদী উল্লাহ : সম্ভবত ২০১০ সালের মার্চ-এপ্রিলের কোনো এক রাতে। কোনো বিরতি ছাড়াই এক শোয়ায় পড়ে শেষ করেছি। মনে আছে সেরাতে বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যার দিকে তুফান হয়েছিল বলে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমি ঢাকা থেকে হলে ফিরেছি রাত সাড়ে নয়টার দিকে, ফলে তুফান দেখিনি। তুফানের পরিণামের ভোগ হিসেবে বিদ্যুৎ ছাড়াই হলে ফিরেছিলাম। মোবাইলের টর্চের আলোতে গল্পটা পড়তে পড়তে একসময় শহীদুল জহিরের কথা মনে পড়লো। শুরুতে মনে পড়েছিল তাঁর গল্প ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’র কথা। অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে, দুটি গল্পে ইঁদুর আছে। অথচ কতটা তফাত!
গল্পপাঠঃ কার মাধ্যমে বা কিভাবে গল্পটি পেয়েছিলেন?
মেহেদী উল্লাহ : আজহার সাহেবের একটা ঢাঁউস বই আছে। বাংলাদেশের ছোটগল্প : বিষয়-ভাবনা স্বরূপ ও শিল্পমূল্য। এই বইটা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা বিভাগে ছোটগল্প সম্পর্কে বিস্তারিত ও সহজে জানার ‘বাইবেল’। এটা এমন একটা বই, অনেকে গল্প না পড়েই শুধু এই বইটির পাতা উল্টিয়ে এমন শক্ত আলোচনা করতে পারেন গল্পটি নিয়ে যাতে মনে হয় নির্ঘাত গল্পটি একাধিকবার পড়েছেন। যাই হোক, তো আজহার ইসলামের বইটি সেই সময় আমার হাতে আসে। বইটি পড়তে গিয়েই প্রথম জানলাম, বাংলা ভাষায় এমন একটা গল্প আছে যা বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এমনকি, মার্কসবাদী সাহিত্য-ধারায় রচিত গল্পগুলোর পথিকৃত। সেই গল্পটার নাম ‘ইঁদুর। আরো জানতে পারলাম, গল্পটির লেখক মাত্র ২২ বছর বেঁচেছিলেন। অল্পকালের সাহিত্যচর্চায় লেখকের নিজের তো অবশ্যই, বাংলাসাহিত্যের গল্পগুলোর মধ্যে ‘ম্যাগনাম ওপাস’ এটি।
২০১০ সালের একুশে বইমেলায় ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের সম্পাদনায় কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় সোমেন চন্দ রচনাসমগ্র। বইটা কিনলাম। সেই বই থেকেই প্রথম পড়ি ‘ইঁদুর’ গল্পটি।
গল্পপাঠঃ গল্পটি পড়ার পরে আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
মেহেদী উল্লাহ : প্রথম পাঠে গল্পটি নিয়ে যা যা মনে হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল, এটি সোমেনের ২৬টি গল্পের মধ্যে অন্যতম সফল গল্প, ভালো লাগার মতো গল্প। আরো যেটা মনে হয়েছে পরবর্তীকালে দেখলাম, লেখক হুমায়ূন আহমেদেরও তাই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, গল্পটি নিু মধ্যবিত্তদের নিয়ে লেখা। এই গল্পটির প্রভাব হুমায়ূন সাহিত্যের একটা অংশে পড়েছে। ‘ইঁদুর’ গল্প প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ উল্লেখ করেছিলেন, সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পর নিম্ন মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার ও মনসুবিজন নামে তিনটি আলাদা গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি। আসলে, শুধু এই তিনটি গল্পই নয়। হুমায়ূন আহমেদ সারাজীবনে নিুমধ্যবিত্ত নিয়ে যা লিখেছেন সবটার প্রাণ-ভোমরা সোমেনের ইঁদুর। সোমেনের একটামাত্র গল্প একজন লেখককে দিয়ে হাজার-হাজার পৃষ্ঠা লিখিয়ে নিয়েছে। এতটাই শক্তিশালী সোমেন আর ইঁদুর!
এবার আসি মূল পাঠ প্রতিক্রিয়ায়। এতক্ষণ যা বললাম, তা শুধু ইঁদুরের ওপর ভর করেই বললাম। যখন আমি ‘টেক্সটই সব নয়’-- এমনটি ভাববো, তখনই সেখানে আনতে পারি গল্পটির লেখকের জীবানদর্শসহ নানা অ্যাসেন্স। তখন গল্পটাকে মাকর্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা করা যাচ্ছে। নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সোমেন চন্দ পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন বিপ্লবে। মাকর্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে গল্পটি রচিত হতেই পারে। ফলে সেখানে শাসক-শোষিত সম্পর্ক খোঁজ করা যেতেই পারে। নিত্যদিনের ঘরকন্নার মধ্য দিয়ে তিনি অবলীলায় দেখিয়ে দিতেই পারেন শাসনযন্ত্রের কুটিল চালপ্রয়োগ, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষমতার সুক্ষ্ম জাল। ফলে ইঁদুর হয়ে ওঠে. মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা ।
ইঁদুরগুলো যেন দারিদ্রেরই কিলবিলে রূপ। ক্রমাগত শ্রেণীস্বাতন্ত্র টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে রত নিম্ন মধ্যবিত্ত। এলিটের সাপেক্ষে তারা এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস যতদিনের শ্রেণি-শাসনের ইতিহাসও ততদিনের। শিকারী সমাজ থেকে শুরু করে আজকের পুঁজিবাদী সমাজেও তা বিদ্যমান।
গল্পপাঠঃ এই সময়ে গল্পটি বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মেহেদী উল্লাহ : বাংলা কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য যে অর্থে সচেতনভাবে প্রথম মার্কসবাদী কবিতা লিখেছিলেন তেমনি সোমেন চন্দের ইঁদুরও প্রথম সফল-সচেতন মার্কসবাদী ছোটগল্প। কোনো কোনো সমালোচক জানিয়েছেন, সোমেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকের দ্বারা প্রভাবিত। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মানিকের রাজনৈতিক গল্পগুলো লেখা হয়েছে তার লেখক জীবনের দ্বিতীয় অংশে, ততদিনে সোমেনের গল্প রচিত হয়ে গেছে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত মাত্র পাঁচ বছর ছিল সোমেন চন্দের লেখক জীবনের পরিধি। ফলে, একটি আদর্শ বামধারার গল্প ইঁদুর। প্রগতিশীল মাসর্কবাদী জীবনদৃষ্টিসম্পন্ন সোমেনের গল্পে নিন্মবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রাম ও কর্মমুখরতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লক্ষণীয়। ব্যক্তিজীবনে নিন্মবিত্ত সোমেন চন্দ সমাজের বিত্তহীন জীবনযাপন এবং শোষিত শ্রেণির জীবনসংগ্রাম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। গল্পে এ পর্যবেক্ষণের শিল্পিত রূপ ফুটে উঠেছে। মূলত, বিশ শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকে অস্থির দ্বন্দ্বময় সমাজ-সময়ের অন্তঃস্রোত, সভ্যতা ও মানব-অস্তিত্বের বহুকৌণিক জিজ্ঞসার পটভূমিতে সোমেন চন্দ গল্পে সচেতনভাবে নিয়ে আসেন সাম্যবাদী চিন্তা-ধারা। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এই গল্পটি লিখেছিলেন তিনি।
দারিদ্র্যপীড়িত মধ্যবিত্ত পরিবার এই গল্পের উপলক্ষ। পরিবারটিকে কেন্দ্র করেই বিস্তার কাহিনির। সংসারের অবধারিত আনন্দহীনতা আর দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন এমনিতেই নিরানন্দময় আর অসহ্য, সেখানে ইঁদুর এত বেশি বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না। গল্পে ইঁদুর আর দারিদ্র্য সম-প্রতীকি। মধ্যবিত্তের তথাকথিত গৌরবময়তার আসল চেহারার আড়ালে যে মেকি ভাব আছে তা তুলে ধরেন গল্পকার। ইঁদুরের মতো সদা-সন্ত্রস্ত শ্রেণিটি। ইঁদুরের দুধ ফেলে দেওয়াকে কেন্দ্র করে মায়ের গরুর মতো করুন চোখ, বাবা আর মায়ের ঝগড়া, অগত্যা মায়ের ছেলে ঘরে ঘুমাতে যাওয়া--সবই যেন মধ্যবিত্তের করুন কাহিনি। এরপর মধ্যরাতে বাবা আবার মাকে ডাকেন অতি নিচুস্বরে, ‘কনক, ও কনক, ঘুমুচ্ছো?’ গল্পের কথক সুকুমার তখন মনে মনে বাবাকে তার বয়েস ফিরিয়ে দিয়ে ভাবে; যুবক সুকুমার একদিন তার বৌকেও এমনি নাম ধরে ডাকবে, চিৎকার করে ডেকে প্রত্যেকটি ঘর এমনি সঙ্গীতে প্রতিধ্বনিত করে তুলবে। পরদিন বাবা হাসেন। মা’ও হাসেন। এসবই মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বমুখর জীবন, যেন, এই মেঘ, এই রোদ্র--কারো কোথাও যাওয়ার জায়গাটি নেই, মাথা গুঁজার ঠাঁই নেই। দোদুল্যমান অবস্থান জীবনকে সবসময় উত্তর-দক্ষিণ করে রাখে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দেয় না। সবসময় একটা সংকোচ কাজ করে, নিজেকে আড়াল করে রাখার প্রবণতা। লজ্জা-শরমের মাথা না খেয়ে নিজের মাথাটি চারদেয়ালে লুকিয়ে রাখা। অল্পতেই খুশি হয়ে যাওয়া। যেমন,’আরো ক’দিন বাদে রাস্তায় বাবা বোকার মতো হাসতে লাগলেন। ব্যাপার কিছুই নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে।’
মত্তবিধ্যের জীবন এভাবেই স্বর্গের পথ রুদ্ধ হলে মধ্যপথে এসে দাঁড়ায়, জীবন ওদের কুক্ষিগত করলেও জীবনকে প্রচুর অবহেলা করে, প্রকৃতির করাঘাতে ডাক্তারের বদনাম গায়, অথবা ঊর্ধবাহু সন্ন্যাসী হয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করে। এসব দেখে একদিন নিজেদেরই মনে পড়ে, দুঃখের সমুদ্রে যদি কেউ গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে তবে তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বটে, কিন্তু না খেয়ে মরে। যে ফুল অনাদরে শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে এরা তাই। এরা তৈরি করছে বাগান, অথচ ফুলের শোভা দেখেনি। পেটের ভিতর সুঁচ বিঁধছে প্রচুর, কিন্তু ভিক্ষাপাত্রও নয়। পরিহাস! পরিহাস!
লেখক পরিচিতি
মেহেদী উল্লাহ
তরুণ গল্পকার।
‘পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্পে’র পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য-২০১৩ পুরস্কার।
তরুণ গল্পকার।
‘পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্পে’র পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য-২০১৩ পুরস্কার।
0 মন্তব্যসমূহ