মেহেদী উল্লাহ'র গল্প : রিসতা

তারপর আমি জিতকে বললাম, ‘জিত! ঘটনা শেষ। তালি দি ফালাও।’ শুনে জিত হতভম্ব! ব্যাপক উৎসাহ আর কৌতূহলে জানতে চাইলো, ‘তারপর কী ভাই? তারপর?’ আমি তাকে এবারো বললাম, ‘তারপরের আর পর নাই। ঘটনা এইখানে শেষ। তালি দি ফালাও।’ কাছের ছোটভাই জিত মুখখানা ফ্যাকাশে করে জড়তাভরে দুইহাত জড়ো করে হাততালি দিয়ে ফেললো। তারপর সে অবশ্য নিজের মতো এতক্ষণের শোনা ঘটনা রি-অ্যারেঞ্জ করতেছে বোধহয় মনে মনে। তার সামনের ডেস্কটপে দুইখানা টাব একযোগে মহাসমারোহে চলিতেছিল। একখানায় ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশি পর্নো স্টার সুলতানা, মিনিমাইজ করা। অন্যটায় জিতের নতুন বানানো মিউজিক ভিডিও। ক্যামেরাকে আমি অতটা চিনি না, তবুও প্রণিধানযোগ্য, জিত নতুন একটা ডিএসএলআর কিনছে। সময় নাই, গময় নাই ওইটা দিয়ে সে খালি ভিডিও করে, আর তার মধ্যে মিউজিক বসিয়ে মিউজিক ভিডিও বানায়। তার কাছে এইটা এখন দুধ-ভাত। ঘটনাটা শুনে জিত মিউজিক ভিডিও প্লাস অ্যাডাল্ট ফিল্ম দুইটাই মিনিমাইজ করে দিলো, তার আগে সাউন্ড অফ। তাই বুঝলাম, মনে হয় সে মনে মনে ঘটনা সাজাইতেছে অথবা অন্যের ঘটনা ভেবে ভেবে পুলকিত হইতেছে। সে যাই হোক গা!


একটা ঘোড়ার কথা ধরা যাক, তেজি আর বলবান ঘোড়া। রেসে দৌড়ানোর জন্য যার জন্ম। দৌড়াইতে পারে মাইলের পর মাইল। সেই রকম একটা ঘোড়াকে মাত্র একশ মিটারের রেসে দৌড় দেয়ানোর পর সে যখন টাস লাইনে পৌঁছে দেখে আর দৌড়ানোর জায়গা নাই সে মুহূর্তে ঘোড়াটার যেমন লাগে আমারও ঠিক একবছর আগে একদিন এমন মনে হইতেছিল। আমার ভেতর প্রেমের ভাণ্ডার! আমি মাইলের পর মাইল প্রেম করার মতো বুক নিয়া জন্মাইছি। কিন্তু এমন একটা মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেমটা হইছে, যে একবছর প্রেম করার পর আমাকে জীর্ণ-পুরাতন-মলিন ভেবে হয়রান হয়ে গেলে আমার মনে হলো, কয় কী? মাত্র একবছর! আমি তো তার সঙ্গে বছরের পর বছর ধরিয়া থাকতে চাইছি। অবশেষে সেই ঘোড়াটার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত টাসলাইনে পৌঁছে মাথাটা গেল বিগড়ে। কী করি বা করবো তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। প্রেমের দৌড় তো থামানো যায় না!

সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগে আমরা একদিন কেএফসিতে খাইতে গেছিলাম। আমার জানা মতে, এই শহরে বড় বড় প্রেমের তিনটা সৌন্দর্য আছে। নতুন ডিজাইনের কোনো ড্রেস এলে একজন আরেক জনকে গিফট করে, নতুন কোনো ফোন সেট এলেও কিনে দেয় আর খাইতে যায় প্রেমিক-প্রেমিকারা। তিনটা সৌন্দর্যের মধ্যে দুইটাই আমি ফেল, শুধু খাইতে যাই মাঝেমধ্যে। আর সে কিনা বলে, ‘শোনো, তোমার সঙ্গে এখন আর খেয়ে তৃপ্তি পাইতেছি না।’ আমি চিকেন ফ্রাইয়ের এক টুকরো খাওয়ার জন্য তখন ‘হা’ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

২.
আমার নানি ঢাকায় এলেন খালার বাসায় বেড়াতে। তিনি আমার সঙ্গে অনেক ফ্রি। মানে, ঠাট্টা-মশকরার রিসতা তার সঙ্গে আমার। ছোটবেলায় নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে আমি আর নানি বিকেলে হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম। মুরব্বি গোছের কেউ দেখে ফেললে বলতো, ‘জামাই-বউ হাঁটতে বের হইচনি!’ আমার নানা মারা গেছেন আমার আম্মার বয়স এগারো থাকতে। তারপর থেকে আমার নানি দুই মেয়ে, পাঁচ ছেলে নিয়ে একা ফাইট করছেন সংসার নিয়ে। আগের সংসারের স্মৃতির ভার এত এত যে ইচ্ছে থাকলেও, এমনকি বিধবা হওয়ার সময় তাঁর বয়স পঁচিশ-কি ছাব্বিশ থাকলেও তিনি আর নতুন বন্ধনে জড়াননি। উল্টো বড় ছেলেকে বাদ দিয়ে মেঝে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। কারণ জামাই মারা গেছে এই সূত্রে তার প্রচুর রেস্ট দরকার। বড় ছেলে লেখাপড়া করবে বলে রাজি হয়নি। তো, সেই নানির বয়স এখন ষাটের মতো। আমার শৈশবের স্মৃতি মোতাবেক আর আমার কোনো এক পড়শির কথামতো আমার ‘বউ’ ঢাকায় বেড়াতে আসছে শুনে আমি ছুটে গেলাম! কিছুদিন যেতেই তার সঙ্গে আমার সেই পুরনো রিসতাটা জেগে উঠলো, যেন আমি বড়ই হইনি, যেন আমি একটা প্রেম করে ধরা খাইনি, যেন আমি এম.এ পাস করিনি, যেন আমি কারো সঙ্গে কখনো আলিঙ্গন করিনি, যেন আমি এখনো কোমরে বেল্ট বাঁধতে শুরু করিনি, যেন আমি সেই ছোটটিই রয়ে গেছি। দেখলাম, তাঁরও বয়স বাড়েনি। ছোটবেলায় যে নানিকে দেখেছি, সেই একই মনের মানুষ। শুধু সারা শরীরে ঢিলে চামড়ার ঢেউ। মনে যৌবনের তরঙ্গ তার। খালার বাসায় গেলে তিনি আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আইসিস! ব, চল একথালায় ভাত মেখে খাই।’ তখন দুপুর ছিল, আর তার চোখে আমি সেই ছোট্টটি।

আমি আরো একটা জিনিস দেখলাম, তিনি এখনো সেই আগের মতোই উল্টাপাল্টা। ছোটবেলায় যেমন দেখেছি, যখন-তখন মন চাইলেই গোসল করতেন, আমাকে পুকুরের ঘাটে বসিয়ে তার কাপড় ধরে রাখতে বলতেন, তারপর গোসল শেষে আমি একটা একটা করে সিরিয়ালি দিতাম তাকে। প্রথমে গামছা, তারপর পেটিকোট, তারপর ব্লাউজ, তারপর... তারপর শাড়ি। গোসল শেষে হাত ধরাধরি করে আমরা বাড়ি যেতাম। আমাদের নানি-নাতির এই দৃশ্য আজকের মতো শেষ জেনে পেছনে খা খা করতো একটা পুকুরের ঘাট! আজও তিনি খাওয়ার আধঘণ্টা পর গোসল করতে ঢুকলেন বাথরুমে। খানিক পরে, মনে হয় গোসল শেষে আমাকে ডেকে বললেন, ‘এইদিকে আয়, গামছা নিতে ভুলে গেছি, দে তো!’ আমিও হালকা ফাঁক করে ধরা দরজার মধ্য দিয়ে গামছা দিতে দিতে মশকরা করে জানতে চাইলাম, ‘বাকি সব নিছো তো!’ শুনে তিনি হাসলেন! আমি বুঝি না, ঠিক একই হাসি তিনি ছোটবেলায়ও হেসেছিলেন। ত্রিশবছর একই রকম হাসি মানুষ কিভাবে ধরে রাখে।

তো, সবমিলিয়ে কয়েকদিনেই তার সঙ্গে আমার এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল তাকে কিভাবে ডিফাইন করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। খালা মনে করিয়ে দিলেন কথাটা। আমাদের ভাবগতিক দেখে তিনিই করলেন প্রশ্নখানা। বললেন, ‘তোরা কী রে! নাতি-নানি মিলে তো আমারে জ্বালাইয়া খাইলি।’ শুনে মনে এলো কথাটা, আসলেই তো! আমরা কী? আমরা কারা? আমরা কি শুধুই নানি-নাতি? মনে হলো, আমরা কী করছি? আসলে আমাদের সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা নাই। তাহা অনাবিষ্কৃত। তা নিয়ে কোনো নৃতাত্ত্বিক এখনো কাজ করেন নাই। তবে আমি বলতে পারি, আমাদের দু’জনের সম্পর্কটা প্রেমও নয়, ভালোবাসাও নয়, অন্যকিছু। কী সেটা? ষাট বছরের বৃদ্ধা আর যুবকে যে অভুতপূর্ব সম্পর্কটা হতে পারে আমাদের আসলে তাই। আমার নানি আমার বিশাল আকাশ। আমি যখন খুশি উড়ে বেড়াই, ঘুরে বেড়াই। আমি তার কী? আমি তার শান্ত পুকুর। আকাশের ছায়া পড়ে পুকুরের গায়গায়!

কয়েকদিন আগে আমি আর নানি ঘুরতে গেলাম গাজীপুরের শালবনে। আমরা অনেক আনন্দ করেছিলাম। অবশ্য তা বলার মতো ঘটনা না। নানি আমাকে যে আনন্দটা দিয়েছিলেন, তা আমি কিছুদিন আগে আমাকে ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকার কাছেও পাইনি। যাওয়ার আগে নানি বললেন, শোন আমার একটা প্রস্তাব আছে। শালবনে গিয়ে আমরা মোড়া পেতে গল্প করবো সকাল থেকে সন্ধ্যা— ছায়ায় ছায়ায়। আমি হেসে শেষ। কিছু আর বলিনি। শুধু ভাবলাম, নানি শালবনকে ভেবেছেন তার গ্রামের বাড়ির ঘরের পেছনের সুপারিবাগান! নইলে গহীন বনে হাঁটার পথে মোড়া আসে কোত্থেকে?

যাই হোক, আমার নানির একটা আবিষ্কারে আমি যারপরনাই বিস্মিত! নানি আমেরিকা আবিষ্কারের চেয়েও একটা বড় আবিষ্কার করে ফেলেছেন। যা আমার সাবেক প্রেমিকার মাথায় কোনো দিনও আসে নি। একদিন নানিকে নিয়ে এটিএম বুথে গেলাম টাকা তুলতে। উদ্দেশ্য তাকে দেখাবে কেমন করে চাবি টিপলে টাকা বের হয় মেশিন থেকে। বের হওয়ার পর কথাটা বললেন তিনি। আমাকে বললেন, আচ্ছা, কখনো ভেবেছিস? আমি বললাম, কী? তিনি বলেই গেলেন তারপর, আমি শুধু শুনলাম। বললেন, ‘তোর জীবনটা তো চলতেছে নাম্বারের ওপর ভর কইরা।’ আমি জানতে চাইলাম, কেমনে? বুঝিয়ে বলো তো। তিনি বললেন, ‘এই যে টাকা তোলার আগে নম্বর চাপলি, তারপর ফেসবুকে ঢোকার আগে নম্বর চাপিস, হেরপর মোবাইলেও নম্বর, আরো কত কত নম্বর!’ আমি অবাক হয়ে গেলেও তাকে বুঝতে দিলাম না, তিনি কত বড় একটা আবিষ্কার করেছেন। আবিষ্কারটা বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে দেখে আমি আবহটা হালকা করার জন্য তাকে খোঁচা দিলাম, ‘খালি নম্বর আর নম্বর! তা, তোমার নম্বর কত?’ তিনি বললেন, ‘ছয়ত্রিশ’। আমি অবাক হয়ে বললাম, ’এখনো ছততিরিশ!’ তারপর আমরা হাসতে হাসতে রিকশায় উঠলাম।

এরমধ্যে ভাবলাম, নানিকে ঘটনাটা বলি। কিন্তু কেমনে বলি! তিনি আবার কিভাবে নেন বিষয়টা। অবশ্য নানি সব ভুলিয়ে দিয়েছেন। আমি নানিকে নিয়েও কেএফসিতে যাই। আমার পুরনো প্রেমিকার মুখ নানির মুখে ভেসে ওঠে না শোকে বরং নানির প্রাণবন্ত মুখই তার মুখ ঢেকে দেয়। তাই বলার কোনো চান্সই পেলাম না। থাক না গোপনে।

ভাবলাম নানিকে নিয়ে আর কী করা যায়? এজন্য তাকে একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিলাম। শিখিয়ে দিলাম কিভাবে চালাতে হয়। তিনি তো মহাখুশি, খুশির ঠেলায় ঠিকঠাক মতোই চালাইতে পারছেন। খোলার দিন তার কাছে জানতে চাইলাম, নানি কী ছবি দেবো? তিনি বললেন, এখনকার ছবি দিস না। আগের ছবি দে। ফলে পড়লাম বিপদে। তার আগের কোনো ছবিই নাই যে প্রোফাইল পিকচারে দেওয়া যায়। বিষয়টা নিয়ে তার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বললাম। তিনিই ভরসা দিলেন আমাকে। বললেন, ওই ছবিটা থেইকা খালি আমারটা কেটে নে, বাকিটা ফেলে দে। আমি বললাম, এটা কি ঠিক হবে? তিনি কোনো কথা না বাড়িয়ে নির্দেশ দিলেন,‘যা কইছি তাই কর।’

তারপর তার কথা মতো, আমি খালার বাসার অ্যালবামটা থেকে ছবিটা নিয়ে স্ক্যান করালাম। এরপর নানাকে কেটে শুধু তার চেহারাটাই দিলাম। ছবিটায় নানির সঙ্গে নানা কি সুন্দর দাঁড়িয়ে আছেন। নানির বয়স তখন হবে হয়তো, বিশ-একুশ। ভরযুবতী। যুবতীর ছবিটাই এই গ্রহে ছড়িয়ে পড়লো। নানা বাদ! নানির ফেসবুকিং অবশ্য বেশি দূর এগোলো না। তিনি টাইপ পারেন না বলে, চ্যাট করতে পারেন না। স্ট্যাটাস দিতে পারেন না। শুধু লাইক দিতে পারেন। আমার সবকিছুতে তিনি ‘লাইক’ দেন। অবশ্য তার হয়ে আমি স্ট্যাটাস দিয়ে দিই। একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘একটা টেটাস দে তো, লেখ, তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন, দু’জন দু’জনার কত যে আপন, কেউ জানে না...’। আমি দিয়ে দিলাম। তারপর জানতে চাইলাম, নানি ‘তুমি’টা কে? তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘কেনো, তুই! কোনো অসুবিধা আছে তোর?’ আমিও হাসলাম। কী বলবো? পরে অবশ্য তার স্ট্যাটাসে আমি একাই লাইক দিয়েছি। কারণ আমি ছাড়া তার কোনো বন্ধু নাই!

৩.
নানি আসার আগে ও আমার প্রেমিকা চলে যাওয়ার পরের দিনগুলিতে আমি প্রেম নিয়া মহা মুছিবতে আছিলাম। প্রেমের সে-কি ধাক্কা। ধাক্কারে! প্রেমের ঝর্ণা এক প্রেমিকার পাহাড় বাইয়া গড়াইয়া নিচে পড়ছে তো কি হইছে, সেই ঝর্ণা এখন সাগরের দিকে যাইতে চাইতেছে। আমার প্রেম অবশেষে সাগরেই পতিত হইলো। আমি আরেকখানা প্রেমে পড়ছি। প্রেমিকা অন্যের বউ। আমি নিজেই অবাক। কেমনে কী? অন্যের বউয়ের সঙ্গে রিসতা পাতাইয়া ফেললাম! দু’একজন বন্ধু বিষয়টা টের পেয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় বললো, ‘পর্সকিরিয়া’। আমি বললাম,‘সে-কি! সুন্দর করে বল্, পরকীয়া।’

সূদুর চীন থেকে আগত অন্যের বউয়ের সঙ্গে আমার প্রেমটা স্থায়ী হইছিল মাত্র পাঁচদিন। কি এক অতি ঘোরে স্বামী দূরে থাকায় সে যুবকের প্রেমে পড়েছিল। শহরের রাস্তায় প্রতিদিন কত প্রেম হয়, ভাঙে আমাদেরও হয়ে গেল, তা নিয়ে পথিকের কোনো টেনশন নাই। নতুন প্রেমিকার নাম প্রসন্ন। আমিই দিয়েছি নামটা। পাঁচ দিনের প্রেমে আমরা কিছু করতে বাকি রাখি নাই। ভাবখানা এমন ছিল, এই আমাদের দেখা, এই শেষ। আবার দেখা হবে আমাদের শেষবয়সে। তখন কোনো কথা হবে না আমাদের। আমরা কেবল চোখাচোখি করবো। আর মধ্যবয়সে যদি ভুলেও দেখা হয়ে যায়, তবে তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বলবো, বাহ! দেখতে ঠিক মায়ের মতো হয়েছে। এছাড়া আমার বউয়ের কোলে যদি আমার কোনো সন্তান সে দেখতে পায় তবে সেও বলবে, ‘কী ফুটফুটে! দেখতে ঠিক বাবার মতো হয়েছে।’ এই তো। মাত্র পাঁচদিনে আমাদের জীবনের ইতিহাসের বিরলতম দিনগুলো পার করলাম আমরা। আমার জন্য বলতে গেলে ‘জার্নি বাই প্রসন্ন’। আমরা মাওয়া ঘাট হয়ে লঞ্চে ঘুরতে ঘুরতে মিছামিছি স্বপ্ন দেখছিলাম দিনের বেলায়।

আমরা লঞ্চের ছাদে গিয়ে বসলাম। পদ্মা নিরিবিলি। আরো বড় নদীতে ভাসার সৌভাগ্য হতে পারতো আমাদের, যদি না পদ্মায় চর জাগতো আর শীতকাল না থাকতো। নদী আমাদের কোনো কথাই শুনতে নারাজ। গোধূলি কাটতে কাটতে সন্ধ্যা নামার ক্ষণে সে লঞ্চের ভেঁপুর সঙ্গে আর ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে স্বর তুলে গভীর এক গোঙানিতে যা তা বলতেছে। প্রসন্ন এই ক্ষণে এসে বায়না ধরলো, আমার চোখ দিয়া নদীর পানি দেখবে! খুশিতে তাহারও চোখে পানি। আমি রাজি হলাম না! বললাম, এ বিষয়ে কবির মতো কী জানো? নদী বা নারী একসঙ্গে দেখা যায় না, যে কোনো একটা দেখতে হয়, নইলে কোনোটাই দেখা হয় না।

আন্ধার নেমে আসলে আমি আকাশের দিকে তাকাই থাকি। প্রসন্ন আমার দিকে তাকাই থাকে। এ কার সঙ্গে এসেছে! আমি তার দিকে তাকাই না কেন? দূরে পদ্মার চরে বসতি দেখে তিতাসের গ্রাম-সমাজের কথা মনে পড়ে। তার আগে মনে পড়ে কলেজে থাকতে পড়া সেই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের কথা। তিতাস তো নদীরই নাম, তাই না? আমাদের ক্লাসের তিতাসকে আমরা দেখলেই খেপাতাম, তিতাস একটি নদীর নাম বলে। সে পাল্টা উত্তর করতো, না, তিতাস একটি ছেলের নাম। ধুৎ, এখন এসব ভাবতেছি ক্যান! বরং জিত যাতে ঘটনা রি-অ্যারেঞ্জ করতে পারে সেজন্য তারে জানানো উচিত। তো, ইস্! বড় সাধ জাগে, প্রসন্নকে লইয়া যদি এই লোকালয়ে ঘর বান্ধিতে পারিতাম! কেউ ঠিকানা জানিতো না। প্রসন্নকে বললাম, চল্, আমরা এখানে থেকে যাই! সে শুনে বললো, হু? রাজি না নারাজি না নিমরাজি— ভাষা বোঝা গেল না। দেখলাম, এখানে থাকিবার কথা শুনে নয়, নদীকে বাদ দিয়া তার তীরে আসায় সে যারপরনাই খুশি। তাকে বললাম, একপ্যাঁচে শাড়ি পরিতে পারিস? সে উত্তর দিলো— চরের গরম রোদে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে যাবে। তারপর বললাম, তোর পয়লা সন্তানের নাম কী দিবি? সে ঠুস করে জানালো, কেন আবার পদ্মা! জানলি কী করে ছেলে না মেয়ে হবে? বিয়ের পর চরের মতো শূন্য উদ্যানে একপ্যাঁচে শাড়ি পরে ঘুরলে কন্যা হয়! ধুর, পাগল! যা চীন যা!!! লঞ্চ মাওয়া ঘাটে পৌঁছবে পৌঁছবে ভাব।


৪.
প্রেমিকাকে হারিয়ে প্রসন্নকে পেয়েছিলাম। তবুও আমার প্রেমের স্রোত থামে না। বুকের মধ্যে একটা প্রেমের টাওয়ার আকাশে উঁকি মেরে শুধু নেটওয়ার্ক বিলিবণ্টন করিতেছে। নানিকে সব বলা দরকার। শুধু দুই প্রেমিকার দুইটা চিরায়ত বাণী ছাড়া। সেই বাণীদ্বয় আমার কাছে দুইটা বিদায় ভাষণ। যাই হোক। নানিকে বললাম, নানি তুমি কি জানো, এইবার তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আমার দুইটা প্রেম আছিল। দুইটাই ছুইটা গেছে। একটা মেলা বছরের প্রেম আর আরেকটা মাত্র পাঁচদিনের। আমার মনে হইতেছে, তাদের সঙ্গে আমার যা যা অপূর্ণ রয়ে গেছিল তা তা তোমার সঙ্গে হইতেছে। সব অপূর্ণতা একসঙ্গে পূর্ণতা পাইছে। তাদের সঙ্গে প্রেম করার সময় যে যে জানলাগুলো বন্ধ ছিল তোমার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার পর আমার সেই জানালাগুলো খুলে গেছে। তারা কখনোই আমাকে গোসলের সঙ্গী করে নাই। তারা কখনোই তোমার মতো বলতে সাহস পায় নাই, চল্ আজ রাতে তবে একবালিশে ঘুমাই, তারা কখনোই আমার সঙ্গে রিকশায় উঠে তোমার মতো বলে নাই, রাস্তা দেখাইস না, যাক রিকশাওয়ালা তার মতো, তারা কখনোই তোমার মতো বলে নাই, শাড়িটাতে আমাকে কেমন মানিয়েছে, তারা কখনোই তোমার মতো বলে নাই ফেসবুকে আমার হয়ে তুই একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দে, তারা বলে নাই, গোসলের সময় যেভাবে অপেক্ষা-পাহারা আর সহায়তায় ছিলি মরণের পরেও থাকবি তো, তারা কখনোই বলে নাই, আহ্ শহরটা কত সুন্দর, তারা কখনোই এই আমাকে বলে নাই, চল আমরা জড়াজড়ি করে প্রিয় মানুষের জন্য কান্দি। তারা শুধুই বলেছে— শহরটা বিশ্রী, জঘন্য, এখানে প্রেম গঠিত হয় মিলিয়ে যাবার জন্যে। সেই শহরেই তুমি আমার কত কী সুন্দর!

৫.
তারপর ষাট বছরের একখানা দেহ আর পঁচিশ বছরের তরুণীর একটা মন নিয়ে আমার নানি মারা গেলে আমি জিতকে নিয়ে একরাতে বসলাম। তবুও আমার প্রেম অতৃপ্ত। জিতকে আমি শোনালাম আমার প্রেমিকাদ্বয়ের বিদায় বাণী। প্রথম প্রেমিকা, জেদ করে যার নাম আমি মুখেও আনি না, আমার সঙ্গে তার শেষ কথোপকথন ছিল এরকম— ‘তুমি খুব ওল্ড। ওল্ড ইজ গোল্ড সবসময় খাটে না।’ প্রসন্ন চীনে ফিরে গেছিল স্বামীর কাছে। সেখানে গিয়ে একদিন ভোরে আমাকে ম্যাসেজ পাঠাইছে, ‘জানো কাল রাতে আমরা সেক্স করেছি। নিজেকে মৃত বলে মনে হয়েছে।’ তাই আমি দুইভাবে দায়ী। প্রথম প্রেমিকার কাছে আমি সেকেলে মানুষ এবং দ্বিতীয় প্রেমিকার কাছে একটি ধর্ষণের জন্য দায়ী। আমার ব্যাপারে আমার নানির কোনো বিদায় বাণী ছিল না। মৃত্যুমুখে তিনি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমার প্রতি দুইটি আঙ্গুল তাক করেছিলেন। এর অর্থ কি তাহলে এই দাঁড়ায়, তিনি আমাকে সব দিয়েছিলেন, শুধু উপরিউক্ত দুইটি জিনিস ছাড়া। অনেক ভাবার বিষয়। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে জিতকে বললাম, ‘জিত! ঘটনা শেষ। তালি দি ফালাও।’


লেখক পরিচিতি
মেহেদী উল্লাহ

তরুণ গল্পকার।
‘পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্পে’র পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছেন  জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য-২০১৩ পুরস্কার।  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. শাহ ইয়াছিন বাহাদুর১২ জুলাই, ২০১৪ এ ৫:০৫ AM

    খুব ভাল লাগলো।

    উত্তরমুছুন
  2. তারা শুধুই বলেছে— শহরটা বিশ্রী, জঘন্য, এখানে প্রেম গঠিত হয় মিলিয়ে যাবার জন্যে। সেই শহরেই তুমি আমার কত কী সুন্দর!
    তিনটি নারী চরিত্র, তিন বয়সের, নিয়ে দারুণ খেলেছেন। ভালো লাগলো পড়ে।

    উত্তরমুছুন
  3. lekhok hoito khelechen valo...jodeep er montobbo mene nile...pathok hisebe ami kono golpo pai nai...

    উত্তরমুছুন
  4. খেলা আর খেলা গল্প সে-তো অনেক দূর কি বাত

    উত্তরমুছুন