অদ্বয় দত্ত'র গল্প : কুয়াশা কেটে গেলে

একা পথে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছিলাম। বৃষ্টি শুরু হলো হঠাৎ। ঝিরিঝিরি, মিহিদানার মতো নরম আদুরে বৃষ্টি। আষাঢ় মাস, যখন তখন আকাশ চুইয়ে জল তো ঝরবেই। সকাল থেকে আজ জলভারি মেঘের আনাগোণায় সারা দিনটা সন্ধ্যার আধাঁরে ডুবে ছিল, এখন শেষ বিকেলটা তাই সূর্য ডোবার আগেই সন্ধ্যার ধোঁয়াশায় কত দ্রুত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল! অনেককাল বৃষ্টিতে ভিজিনি। বৃষ্টিভেজার অদ্ভুত আবেশে শৈশবের মতো আজকে হঠাৎ সারা শরীরটা শিরশির করা এক আনন্দের ঝাঁপি খুলে বসল।


ক’দিন ধরে থেমে থেমে জ্বর আসছে, আজ সকালেও এসেছিল; এখন মনে হলো এ বৃষ্টি ধুয়ে মুছে নেবে সেই জ্বর।

মন খারাপ ছিল খুব। অবশ্য মন ভালো থাকলে আমার ভালো লাগে না কিছু। কী এক অপরাধ বোধে ভুগি। মনটা তাই খারাপ না হওয়া পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারি না। এ কি আমার ছাপোষা মানসিক রোগ? নিজের দুর্যোগের দুর্ভোগ-ক্লেশ সহ্য করার ভয় আমার কোথায়? নিজের যে আমার কোনও দুর্যোগই নেই। অথচ এই সামান্য বয়সেই কতো শত বিবশ বোধ আমায় ছিবড়ে নিংড়ে নিচ্ছে।

অন্ধকার নির্জন রাস্তায় পাশ দিয়ে হঠাৎ আমার ডান কাঁধ ঘেঁষে সাঁ করে একটা ট্রাক চলে গেলো। মনে হলো, আহা! কেন যে আমায় চাপা দিয়ে গেলো না! সাহসে কুলায় না নিজেকে উদ্ধার করার মতো এমন দুঃসাহসী কাজ করতে। তাই আকস্মিকভাবে কোনও সহƒদয় বাস কিংবা ট্রাক চালক যদি উপযাচক কিংবা বাধ্য হয়ে আমায় একটু পিষ্ট করে দিয়ে যেত!

সংক্ষিপ্ত পথে বাড়ি ফিরবো বলে রাজপথ ছেড়ে এবার আমি একটা পার্কের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আকাশ কাঁপিয়ে বাজ পড়লো, চড় চড় করে দিগন্তের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ফেড়ে দিয়ে গেল। দুদণ্ড বিরতি না দিতেই আকাশ থেকে আরও একটি অগ্নিবঝলক নেমে এলো মাটির কাছাকাছি। যা নেমে এলো তাতে আগের বজ্রপাতকে নিতান্তই নিরীহ বলে মনে হলো। এরপর পতন ঘটল তিন নম্বর বাজের। আমিই যেন এ বজ্রপাতের প্রধান লক্ষ্যবস্তু! আগের দুটো লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় এবার যেন ঠিক আমার মাথা তাক করেই আছড়ে পড়তে

চেষ্টা করল। জড়বৎ কেমন কাঠ হয়ে গেলাম আমি। ঢপ করে বসে পড়লাম পার্কের একটি শিউলি গাছের ছায়াঢাকা বেঞ্চির ওপর। বজ্রাহত মানুষ যেমন কাটা কলাগাছের মতো আছড়ে পড়ে, ঠিক সেভাবে না হলেও আমার শরীর অনেকটা ঢেউ খেলে খসে পড়া হলুদ পাতার মতো হেলতে দুলতে লুটিয়ে পড়ল। নিজের জ্ঞানলোপের আগে কানের ভেতরে তীব্র অনুরণনে একটানা কু-উ-উ-উ-উ-উ-উ আওয়াজ শুনতে পেলাম শুধু...।



এলিয়ে পড়া বেঞ্চিতে এসে কে যেন চুপিসারে বসল আমার পাশে। নিষ্পলকভাবে সবুজ আর্দ্রচোখে আমার দিকে তাকাল সে। তাঁর রোমশ কোমল হাত আমার গায়ে বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘এতো ভয় পেলে চলে?’

সেই পরশের ছোঁয়ায় চোখ মেলে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর চারদিকে ভালো করে তাকাতে কেমন যেন আরও বোবা হয়ে গেলাম।

দরদী গলায় সে বলল, ‘খুব ভয় পেয়েছো, না? ভেবেছিলে মরে গিয়েছো?’

আমার মুখ থেকে কোনও কথা বের হলো না। কী এক সূক্ষ্ম পরিবর্তনে চারপাশটা কেমন নিখুঁত অবয়বে পাল্টে গিয়েছে। আমার শরীরটা যে ক্ষণিক আগেও কোন এক বিষাক্ত ছোবলে নীলকণ্ঠ হয়ে উঠছিল, তীব্র যন্ত্রণার এক ঢেউ খেলানো স্রোত শরীরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল; সেসব যেন লোপাট হয়ে গেল হঠাৎ।

আমি বললাম,'তোমার কী কোমল হাত!

--‘তোমার কোমল মন আমার কঠিন হাতকে নরম করে তুলেছে। অমন ক্ষ্যাপাটে উদভ্রান্তের মতো হাঁটছিলে কেন?’

--সে অনেক কথা। ব্যক্তিগত। কাউকে বলার মতো নয়।

--তোমাকে খুব বিষাদগ্রস্ত, বিভ্রান্ত লাগছিল।‘

আমি বিরক্ত হলাম,’কিছু মনে কোরো না, আমি একটু একলা থাকতে চাই।‘

--তুমি তো একলাই থাকো, সব সময় এতো নিজের দিকটা দেখলে চলে?’

--আমার কাছে তোমার কোনও দরকার আছে?’

--না। মানুষের সঙ্গে কথা বলা আমার নেশা।‘

--তোমার সেই নেশার রসদ জোগান দেওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই আমার। তুমি যাও ভাই, আমায় একটু একলা থাকতে দাও।‘

--“ঠিক আছে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু একটা দিয়ে যেতে চাই। কি পেলে তোমার ধোঁয়াটে বিষাদবেলায় মিষ্টি রোদ খেলা করবে?”

--“বেশ কাব্য করে বললে তো। তুমি দেবে যা চাই?”

--“দিতেও পারি, আমি কল্পতরুর মতো। অনেক ক্ষমতা।“

কেন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো, এ মানুষটির যা কিছু তাই দিতে পারার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু অনেক ভেবেও আমি চাওয়ার মতো যুৎসই কিছু খুঁজে পেলাম না। তারপর হঠাৎ সেই দিনটার কথা মনে পড়ে মনটা কী রকম চুপসে গেল। বললাম, “ওই দিনটা আবার ফিরিয়ে দেবে, যেদিন আমার বাড়ির পাশের রাস্তায় ডাস্টবিনে একটি এক দিনের শিশু কেঁদে কেঁদে একশেষ হচ্ছিল? তখনও রাত ফুরোয়নি।... দেবে আরেকবার ফিরিয়ে?” আমার চোখ নিজের অজান্তেই আর্দ্র হয়ে উঠল।

--কী করেছিলে তুমি?”

--“কাউকে বলতে পারিনি সেই ভয়ঙ্কর কাহিনি। বলতেও চাই না কাউকে। নিজেকে একট সামলে নিয়ে ভাবলাম, এ কোন আগন্তুক--যার কাছে মনের হাড়ির ঢাকনা খুলে দিচ্ছি?

বললাম, “তুমি কে বলো তো?”

--“আমি তোমার আত্মজন, একজন ভালো বন্ধু। আমায় তুমি সব বলতে পারো।“

--না, পারি না। আমার বলার কিছু নেই।“

--“তুমি বিক্ষিপ্ত, শোকাহত, ঠিক আছে--সময় নাও।“

--“তুমি চলে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।“

--“ভেবে দেখো, কষ্টের কথা মানুষ গাছকে শুনিয়েও শান্তি পায়।“

--“তুমি এতো নাছোড়বান্দা কেন?” আমি গলার ভেতরে জমে থাকা বাষ্প আস্তে আস্তে বায়বীয় হতে শুরু করল। সত্যি আমার কিছু ভালো লাগছে না। মনে হলো বলেই দেখি একটিবার। আমি মৃদু স্বরে বলতে থাকলাম, “একটি শিশু খুব কাঁদছিল। সম্ভবত ঘণ্টা কয়েক আগে জন্ম নিয়েছে। রাতভর শিশুটি ক্ষীণ স্বরে কেঁদে কেঁদে নিঃশেষ হচ্ছিল...। আমি চিরকালই নিশাচর। রাতে রাতে হেঁটে চলে বেড়াতে ভালো লাগে খুব...”

লোকটা কেমন উদাস হয়ে পার্কের দূর প্রান্তে শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিল, অন্যজগতে, একাকী নিঃসঙ্গ এক মানুষের মতো। আমার কথার একবর্ণ যেন তাঁর কানে ঢুকছিল না। এমন গায়ে পড়া অবহেলায় আমার কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। তারপর কী এক মায়ার ছোঁয়ায় পার্কটা যেন পাল্টে গেল অলক্ষ্যে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে বিস্ময়ে ফিসফিস করে বললাম, “তুমি দেখেছো, চারপাশটা কেমন পৌরাণিক কানন হয়ে গিয়েছে! কোনও রাজার যেন শখের প্রমোদ কানন। আমাদের দেখতে পেলে শূলে চড়াতে দেরি করবে না হয়তো।“

মৌনতা ভেঙ্গে লোকটা উদাসীন গলায় বলল, “বর্ষায় হঠাৎ হঠাৎ কোনও এক রাত এমনটি হয়ে যায়। সব আলাদা, অন্যরকম।“

এসব রূপ-বদল নিয়ে লোকটার ভেতর কোনও হেলদোল নেই। মনে হঠাৎ প্রশ্ন এল, এমন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাতে লোকটার কী চাই এখানে? একটু রূঢ়ভাবেই আমি জানতে চাইলাম, “এত ঝড়ের ভেতরে তোমার এখানে কী কাজ?”

--“ঝড় কোথায়? এখানে তুমি ঝড় কোথায় পাবে?”

আমি চারদিকটায় ভালো করে তাকিয়ে কেমন বোকা বনে গেলাম। তারপর খুব হতাশায় বললাম, “ঝড় নেই এখানে?”

“দেখতেই তো পাচ্ছ--চারদিকটা কী নিঝুম শান্ত, মায়াময় সুন্দর! ঝড় নেই বলে হা-হুতাশ করে কেউ? ঝড় কি ভালো কিছু? সব কীরকম লণ্ডভণ্ড করে দেয়।“

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “সব কিছু একসময় একঘেয়ে পুরনো হয়ে যায়, ঝড় না এলে সেই অভ্যাসগত পুরনো আবর্জনা সরে নতুন আসবে কী করে?”

--“শুধু এই?”

--“ঝড়ের সৌন্দর্য। তার তুলনা হয়! কেমন প্রলয়-প্রলয় গন্ধ দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। প্রলয় মানেই তো সব জঞ্জাল ধুয়ে মুছে নতুন করে সব শুরু হওয়া।“

--একই কথা ঘুরিয়ে আবার বললে। জঞ্জালের সঙ্গে কিন্তু হীরা-মানিকও হারিয়ে যায়। সেই সব মহামূল্যবান রত্নের জন্য তখন দুঃখ হবে না তো!”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আমার বাবার মতো তুমি বড় বৈষয়িক প্যাঁচাল পারো!”

--“তোমার আছে তো অঢেল, তাই এমন বৈরাগ্য বিলাসীতায় গা ভাসাতে সাহস করো।“

--“ওসব আমার পিতৃপুরুষের, আমি ছুঁয়েও দেখি না। নিজের মতো কৃচ্ছ্র জীবন বেছে নিয়েছি।“

--“সেও এক বিশেষ রকমের শখ। তা তুমি বোঝো না। রাজার হঠাৎ ছদ্মবেশে ভিখারি হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে হলো। ভিখারির কষ্ট কি রাজা বুঝতে পারবে তাতে?”

আমি তাঁর অদ্ভুত রঙের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম শুধু। চোখের মণি সরু করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল, “মাথা গোজার ঠাঁই নেই তোমার, একবেলা অর্থ রোজগার না করলে পরের বেলা খেতে পারবে না। এমন লোকের দেখা পেয়েছো কখনও?”

আমি হাসলাম, “আমাদের দেশে এমন লোকের অভাব আছে কোনও?”

--শুধু তোমার দেশের কথা বলছো? সারা পৃথিবীতে নিত্যদিন কোটি কোটি অসহায় মানুষ অন্নক্ষুধায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চরম অনিশ্চিত ভয়াল দুর্যোগময় কোটি কোটি জীবন! এদের মতো জন্মগত নরক-জীবন নিজের শরীরে-মনে অমন নিশ্চিত অনিশ্চতায় যাপন না করলে..., দিনের-পর-দিন আধপেটা কিংবা অভুক্ত না থাকলে এদের যন্ত্রণা ঈশ্বরও বুঝতে পারবে না। তাদেরকে খুব কাছ থেকে দেখেছো কখনও?”

--“তুমি তো সবই জানো। এসব একঘেয়ে কথা ভালো লাগছে না আমার।“ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, --“আমার মাথার ওপর যে বাজ পড়ল, আমি বেঁচে আছি কী করে?”

--তুমি আসলে আর দশটা ভেড়ুয়া মানুষের মতো। বিবেকের যাতনা সইতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ভাবো, কোথায় প্রলয়? যাক সে কথা। বাজ তোমার মাথার ওপর পড়েনি, তোমার পাশে একলা দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি গাছটির ওপর পড়েছে। তোমার ওপর তার অনেকখানি হল্কা লেগেছে মাত্র।“

--“শিউলি গাছ! আমার খুব প্রিয়। কোথায় সেটা, দেখতে পাচ্ছি না যে?”

--তোমাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।“

--“ও!” আমি একটু বিষণ্ন মনে চুপ করে রইলাম।

–“তোমার বাড়ির আঙিনায় একটা শিউলি গাছ ছিল, খুব ভালোবাসতে তুমি শিউলি ফুল। গাছটির জন্য মন খারাপ তোমার?”

--“না, ঠিক তা নয়...। আচ্ছা, অতি পাপিষ্ঠকে ঈশ্বর নাকি বজ্রাঘাতে মারেন! আমি কি অতি পাপ করেছি?”

--“তা হলে তো পৃথিবীতে প্রতিদিন কয়েক কোটি মানুষকে বজ্রাঘাতে মেরে ফেলতে হবে। ঈশ্বর বলে কোনও পরম সত্তার প্রতি তোমার একতিল বিশ্বাস নেই বলেই তো জানতাম, বিপদে হঠাৎ ঈশ্বর-প্রীতি জেগে উঠল যে?”

আমি হেসে বললাম, “ওগুলো কথার কথা। তা ছাড়া, জানোই তো মানুষ চিরকালই সুযোগসন্ধানী।“

আমার শেষ কথাকে সে গম্ভীরভাবে টেনে লম্বা করে বলল, “হু। আচ্ছা, তুমি মানুষের মতো এত কুৎসিত সুযোগসন্ধানী নষ্ট-জীব জগতে আর দ্বিতীয়টি দেখেছ?”

এত সিরিয়াস প্যাঁচাল আমার ভালো লাগে না। লোকটা অদ্ভুত। প্রসঙ্গ ঘুরাতে চেষ্টা করলাম, “তুমি কে বলো তো? তখন থেকে গায়ে পড়ে বকবক করে যাচ্ছ! এবার যাও আমি একটু একা থাকব।“

--তুমি তো একাই আছো। আমি কেউ না। শুধু আর একটা কথা জানতে চাই... একটি ছোট্ট শিশু সে রাতে ক্ষীণ স্বরে কেঁদে কেঁদে নিঃশেষ হচ্ছিল...। তারপর?”

কে যেন আমায় টুটি চেপে ধরে সে কুয়াশাঘেরা রাতের আঁধারে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

সদ্যোজাত শিশুটির একটানা দুর্বল কান্নার স্বর আমার মাথার ভেতরে সূচের মতো বিঁধছিল যেন। বললাম, “আমার মফস্বল শহরে শীতের রাত আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরের আধার। কৃষ্ণপক্ষের আধখাওয়া পঞ্চমী ষষ্ঠীর চাঁদ আকাশে ওঠে ঠিক মধ্যরাতের কিছু আগে। তারপর রাত যত বাড়ে ততই যেন রহস্যময় জ্যোৎস্নার জ্যোতি চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। শীতের শেষ রাতের কুয়াশা যেন সেই জ্যোৎস্নাভেজা প্রকৃতিকে আরও বেশি অপার্থিব করে তোলে। এমনি এক পাগল করা জ্যোৎস্না-রাতে সবে জন্ম নেওয়া শিশুটি কেঁদে কেঁদে একশেষ হচ্ছিল। ঠিক আমার একচালা ঘরের সামনে এক চিলতে মাঠের কোণে পড়ে থাকা পৌরসভার ছোট্ট ডাস্টবিনের ভেতর থেকে। শিশুটি সদ্যোজাতই। যারা শিশুটিকে ডাস্টবিনের ভেতর ফেলে রেখে গিয়েছে, শিশুটির সারা গায়ে লেগে থাকা মাতৃগর্ভের রক্তের চিহ্ন মুছে ফেলার ধৈর্য রাখেনি তারা। ক’দিন আগে আমি শখের একটি এসএলআর ক্যামেরা কিনেছি মাত্র। নানা মুন্সিয়ানায় জগতের সবকিছুকেই তখন আমি ফটোগ্রাফির দুর্লভ বিষয়বস্তুর বাইরে আর কিছু ভাবতে পারতাম না। ছুটে গিয়ে আমি এসএলআর ক্যামেরা নিয়ে আসি। স্লো-সাটারে অ্যাপারচার বড় করে আইএসও বাড়িয়ে বিভিন্ন কৌশলে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছিলাম।...”

একটু বিরতি নিয়ে বললাম, “তুমি ধৈর্যহারা হচ্ছো না তো?”

আগন্তুক বিমুগ্ধ হয়ে আমার কথা শুনছিল। বলল, “না, না, তুমি তোমার মতো করে বলে যাও।“

তাঁর এমন মুগ্ধতা দেখে কেমন একটু অস্বস্তি বোধ হলো। পুনরায় বলতে লাগলাম, “এর ভেতরে একটি ভয়ানক দৃশ্য চোখে পড়ল হঠাৎ। সারি সারি লাল পিঁপড়ে নিষ্ঠার সঙ্গে শিশুটির চারদিকে ব্যূহ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দৃশ্যটা আমার কাছে তখন ভয়ানক নয়, ফটোগ্রাফির অন্ধচোখে “দুর্লভ” মাত্র। ভোর হয়ে আসছিল, পুব আকাশের রক্তচ্ছটা তখন ডাস্টবিনের আঁধার কোণে অল্প অল্প করে জমা হচ্ছিল। আমি যান্ত্রিক আনন্দে বিভিন্ন কোণ থেকে বিভিন্ন এক্সপোজারে সাটার রিলিজ করতে শুরু করলাম। আরও বেশি স্লো-সাটারে ছবি তোলার বাসনায় বাড়ি থেকে দৌড়ে গিয়ে ট্রাইপড নিয়ে এলাম। তাতে বাচ্চার মুখের ফোকাস ঠিক রেখে হাত-পা ছোঁড়ার ব্লার-মোশন চমৎকারভাবে ক্যামেরাবন্দি হতে লাগলো। আমি তখন দম আটকানো আনন্দে ভাবছিলাম, কোনও এক ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফিক স্যালুনে আমার এসব ছবি নিশ্চিতভাবে বিশেষ কিছু পুরস্কার ছিনিয়ে আনবে।...”

আমার কথার ছেদ পড়ল। আমার একনিষ্ঠ শ্রোতা বললেন, “কিন্তু আমি তো জানি কোনও ছবির ভেতরে নিষ্ঠুরতা কিংবা অমানবিকতার ছোপ থাকলে তার ঠাঁই হয় সিলেকশন কমিটির ডাস্টবিনে।...”

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,"তুমি ঠিকই জানো। আসলে দুর্লভ ছবির পুরস্কার-স্বপ্নে বিভোর হয়ে আমার এই স্বাভাবিক বোধটুকুও লোপ পেয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, পুলিশের এক টহল গাড়ি সে সময় সারা রাতের ডিউটি শেষে থানায় ফিরছিল হয়তো, আমায় এভাবে কিছু একটার ছবি তুলতে দেখে গাড়ি থামায়। দু’জন পুলিশ নেমে এসে ডাস্টবিনে এমন একটি বাচ্চা দেখে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। হাতে ক্যামেরা দেখে মনে করে আমি বুঝি সাংবাদিক। তাই বিশেষ কোনও উচ্চবাচ্য করল না। বাচ্চাটাকে গাড়িতে তুলে নেওয়ার আগে তাদের ভেতর থেকে একজন শুধু গম্ভীরভাবে বলল, “আসবেন?”

সম্মতি পেয়ে আমি একলাফে পুলিশ ভ্যানের পেছনে গিয়ে বসলাম। থানায় না নিয়ে বাচ্চাটাকে সরাসরি একটি সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলো। বাচ্চাটির জন্য জরুরি চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ফাঁকে কর্তব্যরত ডাক্তার আহাজারি করে বললেন, আধ ঘণ্টা আগে আনলেও হয়তো বাঁচানো সহজ হতো। নিউমোনিয়া এবং লাল পিঁপড়ের অজস্র কামড়ের বিষক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। এরপর মাত্র এক ঘণ্টা পার না হতেই নার্স ডাক্তারের সাধ্যমতো চেষ্টায় শেষরেখা টেনে বাচ্চাটির মৃত্যু ঘটল।...” বলতে বলতে আমার কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে উঠল।

--তারপর?”

--তুমি চিন্তা করতে পারো, মাত্র আধ ঘণ্টার অভাবে বাচ্চাটা মারা গেল! বাচ্চাটাকে আসলে আমিই তো মেরে ফেললাম। কম করে একঘণ্টা ধরে আমি তথাকথিত ওই “দুর্লভ” ছবি তুলেই যাচ্ছিলাম।...”

--তারপর?”

--তারপর দিন দিন কী যে হতে লাগল আমার ভেতরে! নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারলাম না কিছুতেই।“

--এমন তো কতোই ঘটে। কতো ভাবে কত রকম নিষ্ঠুরতা আমাদের চারদিকে জাল বিছিয়ে রেখেছে। তুমি সেই ঘটনাটি মনে করতে পারো, বিশ্বখ্যাত এক ফটোগ্রাফার আফ্রিকায় অপুষ্টিতে কঙ্কালসার এক শিশুর নির্মম কিছু ছবি তুলেছিলেন! ছবিতে মৃত-প্রায় সেই শিশুর পেছনে শিশুটির মৃত্যুর প্রহর গুণছিল এক শকুন।“

--“আমি জানি সে কথা।“

--“তোমার মতোই সেই ফটোগ্রাফার শিশুটিকে না-বাঁচিয়ে অমন ছবি তোলার অনুশোচনায় আত্মদংশনে জর্জরিত হতে হতে একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তুমি চিন্তা করে দেখো, বিশ্বে যথেষ্ট খাদ্য থাকার পরও দিনের পর দিন না-খেতে পেরে প্রতিদিন কত হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে। একটি শিশুর অমন নির্মম ছবি বিশ্বের কত মানুষের বিবেককে তাড়িত করেছে, সেই হিসেবটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।“

--তুমি হয়তো ঠিকই বলেছো। আমিও ওভাবেই ভাবতাম। কিন্তু একটা ফালতু হিসাব আমার মাথা আরও বেশি ঘুলিয়ে দিল। সে কথা তোমার না শোনাই ভালো।“

--“সব ভালো সব সময় ভালো নয়, তুমি বলো।“

--“শুনবে? আচ্ছা ধরো, একটা সমুদ্রের ভেতরে কিছু প্রাণীকে নামিয়ে দেওয়া হলো। জানানো হলো, এ মহাসমুদ্রে কোথাও ঠাঁই নেই, অনেক অনেক দূর সাঁতরে গিয়ে হঠাৎ একটা দ্বীপ পাওয়া যেতে পারে। সেই দ্বীপ জেগে থাকার সম্ভাবনা কয়েক হাজার ভাগের মাত্র একভাগ। তারপরও সেটাই একমাত্র আশ্রয়। প্রাণীটি পাশে তাকিয়ে দেখলে তার মতো কয়েক লাখ প্রতিদ্বন্দ্বী একইভাবে একই উদ্দেশ্যে মহা বিক্রমে সাঁতার কাটছে! তারাও ওই দ্বীপে আশ্রয় চায়। অথচ ওখানে মাত্র একজনের ঠাঁই হবে। এভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে কোনও দ্বীপের হদিস না পেয়ে তাদের সলিল সমাধি হলো। একই ঘটনা অসংখ্যবার ঘটল, কেউই দ্বীপের সন্ধান পেলো না। তারপর একদিন তোমার পালা এলো। তুমি প্রাণপণে সাঁতার কাটলে, দ্বীপের সন্ধান পেলে এবং দ্বীপের ওপর প্রথম পা তুমিই রাখতে পারলে। তুমি বেঁচে গেলে। শুনে মনে হতে পারে--কত সহজে তুমি বাঁচলে। কিন্তু একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে, এ যেন এক অলৌকিক ব্যাপার! খুব সহজ করে বললে, তোমাকে একটা পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়ার পর জানানো হলো, নীচে মৃত্যুকূপ, কয়েক শো কোটি বার পতনে প্রতিবারই নিশ্চিত মৃত্যু। শুধু

কয়েক শো কোটির মধ্যে মাত্র একটিবার মৃত্যুকূপ থাকবে না, তুমি বাঁচতে পারবে। এমন ভয়াল শর্তে তুমি প্র মবারেই নীচে নেমে দেখলে, মৃত্যুকূপ নেই! তুমি একে কী বলবে?”

--“এ কী মিরাকল?”

--“তুমি কে, যে তোমার জন্য মিরাকল ব্যবস্থা থাকবে? তোমার সঙ্গে তোমার কয়েক শো কোটি প্রতিদ্বন্দ্বীর একতিল পার্থক্য নেই। তারা কেন জীবন পেল না? আসলে, মানবী গর্ভে মানবজন্মের পুরো ব্যাপারটাই একটি চরমতম আকস্মিক ঘটনা। ভাগ্যের রসায়নে বললে, একে তুমি “বিস্ময়কর সৌভাগ্য” বলতে পারো।“

--“বুঝলাম।“

--ওই সদ্যোজাত শিশুটিও আমাদের মতো বিস্ময়কর সৌভাগ্যবানদের একজন, আমারই বিলাসী খামখেয়ালিপনায় তার অস্তিত্ব অঙ্কুরেই ঝরে গেল! এ অভিঘাত তুমি কল্পনা করতে পারো?” ভাঁজ করা হাঁটুতে মুখ গুঁজে আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। কতক্ষণ এভাবে হাঁটুতে মুখ গুঁজে পড়ে ছিলাম, মনে করতে পারি না; একটি কোমল হাতের পরশ আমায় অন্যমনস্ক জগৎ থেকে বাস্তবে নিয়ে এলো। তাকিয়ে দেখি, একটি অল্প বয়সী মেয়ে বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আমায় ক্ষমা করো।... ওই লোকটা কোথায় গেল?”

--“কার কথা বলছো? সবুজ চোখের লোকটা? মনে করো, আমিই সে।“

--“তা কী করে হয়? ঠিক করে বলো, কে তুমি?”

--“আমি কেউ না। কিংবা আমায় তুমি এ বাগানের একজন মালি বলতে পারো।“

--“আমাকে যা ইচ্ছে তাই বোঝাচ্ছো?”

--“তুমি জানো না--সরকার এ বাগানে অনেক নতুন মালিকে জায়গা দিয়েছে? আমি তাদেরই একজন।“

--“কিন্তু ফুল দেখি না যে কোথাও।“

--“আমরাই তো ফুল। আমার শরীর থেকে কোনও সুগন্ধ পাচ্ছ না তুমি? আমরা মালি হয়ে নিজেদের “ফুল” বানাই, পরিচর্চা করি, তারপর পেটে-ভাতে বেঁচে থাকার বিনিময়ে প্রতিদিন নিজেদের বেচি, অজস্র কীটদের আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে দিই। তারা মধু খায়।“

--“তোমাকে কেমন চেনা-চেনা লাগছে, কী নাম তোমার?”

--“নাম থাকতে নেই আমাদের। পৃথিবীর সব সুন্দর নামে তুমি আমায় ডাকতে পারো। আমার নিজের পছন্দ, পুষ্প।“

--“আমি বাড়ি যাব, সব কেমন অচেনা লাগছে, রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না, দেখিয়ে দেবে একটু?’

পুষ্প কোনও কথা বলল না। অনেকক্ষণ পর কেমন টলটলে চোখে বিষণ্ন গলায় বলল, “জানো, ওই বাচ্চাটা আমার ছিল।“

খুব বিস্ফারিত বিস্ময়াহত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি!

পুষ্প কান্নাসিক্ত গলায় বলল, “ভাবছ, কী করে পারলাম ডাস্টবিনে ফেলে দিতে? বাচ্চা জন্মের সময় সেই যে আমার জ্ঞান লোপ পেলো, আর ফেরেনি কখনও।“


২.


পরদিন একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে ছোট্ট একটি খবর ছাপা হলো--শিউলি গাছে বজ্রপাত, পাশে আধপোড়া একটি বেওয়ারিশ লাশ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ