পাঠপ্রতিক্রিয়া : শামীম আহমেদের উপন্যাস সাত আসমান

বনি আমিন

“শামিম আহমেদ গল্প লিখতে জানেন। তাঁর লেখার শৈলী পরিণত। তিনি জানেন চরিত্রের মধ্যে কী করে টেনশন তৈরী করতে হয়। কী করে আখ্যানের মধ্যে সাসপেন্স গড়তে হয় সেটাও তাঁর অনায়াসলদ্ধ। যখন তাঁর গল্পটি পড়া শেষ হয় তখন আমরা বুঝতে পারি--এতোক্ষণ শামিম আহমেদ পাঠকের সঙ্গে কানামাছি খেলছিলেন। বর্ণিত গল্পের আড়ালে ভীন্ন একটি গল্পকে তিনি লুকিয়ে বলে গেলেন।

বাবার মৃত্যু”

হ্যা, ঠিক উপরের উদ্ধৃত অংশটি লিখেছিলেন কুলদা রায় তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে এবং তারপর লিংক দিয়েছিলেন বাবার মৃত্যু গল্পের। বাংলা ছোটগল্পের জগতে কুলদা রায়ের আমি নতুন আবিষ্কৃত এক ফ্যান। সুতরাং তাঁর মন্তব্য করা গল্প পড়তে আর দেরি করিনা। পড়া শেষ করে আমি মন্তব্য লেখি - “অন্তত এই গল্পটা পড়ে কুলদা রায় যা লিখেছেন উপরে, তা আমার মনে হয়নি। কোন টেনশন, সাসপেন্স আমি পাঠক হিসাবে আমার মধ্যে হয়নি। বরং আমি গল্পের রিয়ালিটিতে মুগ্ধ হচ্ছিলাম - নগর জীবনের ঘুনে খাওয়া দাম্পত্য সম্পর্কের রিয়ালিটি। শশ্মানঘাটে যে কিশোরটি এসেছে, সে যে কে হবে তা আমাদের বাংলাদেশের সস্তা সিনেমার মতো বোঝা যাচ্ছিল”।

আমার উপর্যুক্ত মন্তব্যে সহমত পোষণ করেন শ্রাবণী সেন দাসগুপ্তা নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী, যার সাথে আমি ফেসবুকেও পরিচিত নই। তো বিষয়টা নিয়ে কুলদা রায়ের সাথে সামান্য বহস হলে কুলদা রায় আমাকে শামিম আহমদের একটি উপন্যাসের পিডিএফ সংস্করণ পাঠাবেন মর্মে আমার ই-মেইল আইডি চান। সে মতে আমি আমার আইডিটা তাঁর ইনবক্সে সেন্ট করলে তিনি তৎক্ষণাৎ আমার আইডিতে সেটি পাঠিয়ে দিয়ে লেখেন আইডির ইনবক্স চেক করেন। আমি কুলদা রায়ের আইডি জানিনা। তবে তাঁর নাম চলে আসায় বুঝতে অসুবিধা হয়না। ফেসবুকের ইনবক্সে উনি জানান উপন্যাসটির নাম সাত আসমান। এটেস্ট ফাইলটি বেশ বড়, ২৭ মেগাবাইট। আমার ধীরগতির অন্তর্জালে সেটি ডাউনলোড করতে ঘন্টা কাবার। 

উপন্যাসটি বই আকারে কাগজে প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার গাঙচিল প্রকাশনি থেকে ২০১২-র নভেম্বর মাসে। আমি দেখলাম, প্রকাশিত কাগজের বইটিরই স্কান করা কপি পিডিএফ ফরমেট করা হয়েছে এবং শামিম আহমেদ কুলদা রায়ের আইডিতে সেটি মেইল করে পাঠিয়েছেন এবং ইংরেজিতে বইটি পড়ে দেখবার অনুরোধ করেছেন। কুলদা রায় আমাকে সেই মেসেজটিই ফরওয়ার্ড করেছেন। আর এভাবেই পেয়ে যাই আমি সাধারণ বাঙাল মুলুকের এক অজগ্রাম থেকে “সাত আসমান” নামক এক অসাধারণ ফিকশনের ঠিকানা।

প্রসঙ্গ
একশ চার পৃষ্টার এ কাহিনীটির পটভূমিকা দেশ বিভাগ। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ইংরেজরা এই দেশের(ভারতবর্ষের - বর্তমান ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান) শাসন ক্ষমতা এ দেশের মানুষের নিকট হস্তান্তর করে, তাদের স্বদেশে ফিরে যায় যে ব্যবস্থার মধ্যে সেটাকেই দেশ বিভাগ বলা হচ্ছে। আরেক ভাষায় বলা যায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফলতার মুখ দেখে যে প্রেক্ষিতে সেটাই দেশ বিভাগ। বিষয়টা নিয়ে ভাববার সময় ফুরিয়ে যায়নি, তাই দেখা যায় অনেক চিন্তক ভাবুকজন এ জামানার, যারা দেশবিভাগ দেখেননি, তারাও বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন।আর যারা এই ভাবুক-চিন্তকদের দল অন্তর্ভুক্ত তারা ঐ দেশবিভাগকে একটি ভুল, কতিপয় ক্ষমতালোভীর দেশের সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত হিসাবে ঘৃণার সাথে ধিক্কার জানান সর্বত। এই দলভুক্ত মানুষেরা যতটা না ধার্মিক তারচেয়ে বেশি মানবিক, তারা যতটা না রাজনৈতিক তারচেয়ে বেশি মানবিক, তারা যতটা না নগদ সুবিধালোভী তারচেয়ে বেশি মানবিক - অর্থাৎ তারা সর্বত্র মানবিকতার বিপর্যায়কে বড় করে দেখেন, তা বাদে অন্য কোনকিছুকে নয়। শামিম আহমদ তাঁর এই উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে সেই দলভুক্ত হয়েছেন তা নিশ্চয় করে বলা যায়। যদিও তিনি সুনির্দিষ্ট করে কোথাও সেটি উল্লেখ করেননি; তবে তাঁর এ উপন্যাস পড়ে আমার সেরকমই বোধ হয়েছে।

মনুষত্ববোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, মানবিকতাকে যারা করেন শিরোধার্য সেই মুক্ত মানবিক চেতনার মনীষীরা যতই ধর্মকে ছিড়ে-কেটে দূরে রাখতে চান না কেন ধর্ম কিন্তু এসেই যায় যেন কেমন এক অনিবার্যতার পথ বেয়ে। সেটা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে হোক আর অন্য যে-কোনভাবে হোক সে হয়ে যায় আলোচনার ভেতরের একটি অংশ। দেশবিভাগের আলোচনার প্রেক্ষাপটে ধর্মের বিষয়টি সেরকমই একটি বিষয়। আর যে দেশ বিভাগ প্রধানতই ধর্মকেন্দ্রিক সেখানে ধর্মতো হয়ে আছে প্রধানতর অবস্থানে। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের। তাদের ভেতরকার দাঙ্গা-ফ্যাসাদ দূর করার জন্য তৈরি হলো দুটো আলাদা রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু সকল হিসেব কি সব সময় মেলানো যায় ? সুতরাং বহু মানুষ তার যথাযথ নিরাপত্তার খাতিরে দেশ বিভাগের পর এপার ওপার করলো। এবং এই এপার ওপারে ওইসব মানুষের ভেতরে সৃষ্টি হলো জাপানের হিরোসিমা নাগাসাকির চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত।

শামিম আহমদ নাম দেখে বোঝা যায় তিনি মুসলিম। বর্তমান বাসস্থান হিন্দুস্থান অর্থাৎ ভারতের তিনি নাগরিক । তাঁর পূর্বপুরুষ দেশ বিভাগের পরে যথাযথ সুবিধা পাওয়ার আশায় পাকিস্তানে চলে আসেননি, তাদের আদি আবাসভূমিতেই রয়ে গেছেন। দেশবিভাগের ফলে যারা এপার ওপার করেছে তাদের ভেতরেই সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত কিন্তু যাদেরকে দেশ ছাড়তে হয় নি বা দেশভাগের পরেও ভাগ্যচক্রে জুতসই দেশে রয়ে গেছেন তাদের ভেতরে এই ক্ষতের কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু জুতসই দেশ না পাওয়ার পরেও যারা মুসলমান হয়ে হিন্দুস্তানে রয়ে গেছেন এবং যারা হিন্দু হয়েও সাবেক পাকিস্তানে রয়ে গেছেন তারা উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই সংগ্রামশীল এবং সুবিধাভোগী নন হয়ত। সাত আসমান এ উপন্যাসে শামিম আহমদ তার মাতৃ বংশের এক পুরুষ আগের নানাজানের সময়কার গল্প বর্ণনা করেছেন। গ্রাম প্রধান ভারতের একটা সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার, যারা শিক্ষিত, সচেতন এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ধর্মবোধ, দৈনন্দিন জীবন-যাপনের কথা উঠে এসেছে। ঐ পরিবারের মানুষের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত হয়েছে তৎকালীন ভারতীয় মুসলমানের মানস-চৈতন্য। একটা নির্দিষ্ট সময়ের (১৯৪১/৪৪/৪৫ থেকে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের শেষদিক। যদিও উপন্যাসে কোন সুনির্দিষ্ট সন তারিখ নেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিতে আনুমানিক সময় দেওয়া হলো।) প্রেক্ষাপটে যেহেতু উপন্যাসের কাহিনী বিস্তৃত এবং উপন্যাসের চরিত্রদের অবস্থান, সেহেতু ওই সময়ে ঘটে যাওয়া ২য় বিশ্বযুদ্ধের ফলে দুর্ভিক্ষ, ৪৬-র হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ভারতের স্বাধীনতা -এই বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে।


কাহিনী বস্তু

জর্মান মিয়া একজন আলেম মানুষ - দ্বীনদার, প্রকৃত ধর্মভীরু, স্বচ্ছল গৃহস্ত, বয়স আনুমানিক ২০/২১, বিবাহিত। তার স্ত্রী কামরুনেনসা বিবি প্রসব করছেন তার প্রথম সন্তান সেখান থেকেই এই সাত আসমান উপন্যাসের কাহিনী শুরু। জর্মান হোসেন ওরফে জর্মান মিয়া বিচিত্র ভয় পাওয়া খোয়াব দ্যাখেন, সে খোয়াব দেখা যেমন জাগরণে, তেমনি নিদ্রিত অবস্থায়। ভীতিকর দৃশ্য ভোরবেলা ফজরের সময় দেখে তিনি লুঙ্গিতেই প্রাত:কৃত সেরে দেন এবং মূর্ছিত হয়ে পড়ে যান। এলাকার তিনি আবার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় নানান কিছিমের ডাক্তার কবিরাজ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এলাকার ডাকসাইটে মৌলভী সাহেবের ব্যবস্থা পত্রই বহাল রয়ে যায়।কিন্তু জর্মান মিঞার খোয়াব দেখা ছোটেনা। দেশের যুদ্ধ রাজনৈতিক অস্থিরতা দুর্ভিক্ষের মধ্যে চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং জর্মান মিঞা আবার ভীতিকর সব খোয়াব দেখতে থাকেন। সেবার যেন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছেন এবার যখন আবার জ্বিন-ভুতের আছর যুক্ত খোয়াব দেখতে শুরু করেছেন তো বাড়ির কর্তা জর্মান মিঞার মেজ ভাই আনোয়ার মিঞা সিদ্ধান্ত নেন যে, তার ছোট ভাইটির উপর থেকে এই জ্বিন-ভুতের আছর সরাতে হলে তাকে পার্শ্ববর্তী মুর্শিদাবাদ জেলার সালারে অবস্থিত শাহ রুস্তমের মাজারে নিয়ে যেতে হবে। সেই মতে জর্মান মিঞাকে সালারে নিয়ে যাওয়া হয়। আনোয়ার মিঞা দায়িত্বশীল গৃহকর্তা ছোট ভাইয়ের খোয়াব ব্যাধীটাকে স্থায়ীভাবে তাড়ানোর জন্য নিজের বন্ধু বাড়িতে তাকে রেখে নিজে বাড়ি চলে গেলেন। জুলফিকার মিয়াই এখন জর্মান মিঞার অভিভাবক। মেজ ভাইয়ের সাথে সরাসরি তার কোন যোগাযোগ হয় না। জুলফিকার মিঞার মাধ্যমেই সকল যোগাযোগ থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত। অল্প কিছুদিন বাদে জুলফিকার মিঞা জানান জর্মান মিঞার জন্য মাজারে কাছাকাছি একটি জায়গা দেখা হচ্ছে। সেখানেই বাড়ি করে, জমি-জিরাত আরো কিছু কিনে সংবৎসরের খরচ মিটে যায় এমন ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন পরিবার কর্তা মেজ ভাই। তার বিবি-বাচ্চাদেরও এখানে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। খোয়াব দেখা অসুস্থ মানুষ তাকে কিছুই করতে হবে না। তিনি শুধু তার স্বপ্নের সুলুক সন্ধান করুন। সেই খোয়াবের ব্যাখ্যা দিতে পারেন আরেকজন ব্যক্তি, তিনি হলেন বদরুদ্দোজা। এমনিভাবে জর্মান মিয়া আরেকজন আলেম তথা কথায় কথায় জ্ঞানগর্ভ গল্প বলতে পারেন এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন। এর মধ্যে রায়েত সংঘটিত হয় এবং রায়েতের পরে আসে দেশ স্বাধীনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। তখন ছিল রোজার শেষ আর ঈদ-উল ফিতরের আগমন দিন। জর্মান মিয়া নতুন বাড়িতে এসে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। তার মনে দৃঢ় আশা মুর্শিদাবাদ এবং মালদাহ জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকা হওয়ায় পাকিস্তানের অংশ হবে। আর তার আদি বাড়ি বীরভূম হিন্দু রাষ্ট্র ভারতেরই অংশ হয়ে থাকবে। সুতরাং তিনি আর তার আদি বাড়িতে ফিরে যেতে চান না। নতুন বাড়ি মুর্শিদাবাদেই থেকে যেতে চান মুসলমানের সাচ্চা দেশ কল্পনা করে। মুর্শিদাবাদে পাকিস্তানের পতাকা উড়লো, জর্মান মিঞা শোকরানা নামাজ আদায় করলেন, নতুন রাষ্ট্রের পিতার শুভেচ্ছা বক্তৃতা রেডিওতে শুনলেন। বাইরের জগত থেকে রাতে বিবির কাছে গেলে জর্মান মিঞা শোনেন অন্য খবর। বিবি তার চেয়ে বেশি ভেতরের খবর রাখেন। কারণ তার সই বিপ্লবী দলের সদস্য। সেই সই মারফত জানতে পেরেছেন মুর্শিদাবাদ জেলা কলকাতা বন্দরের জন্য ভারতের দরকার আর মালদাহ ভারতের উত্তর অংশের সাথে যাতায়াতের জন্য প্রয়োজন। সুতরাং এ দুটো জেলা বাদ দিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্র হচ্ছে। জর্মান মিঞার স্বপ্ন প্রত্যাশা বৃথা। পরের দিন সে কথার সত্যতা ফললো। মুর্শিদাবাদে হিন্দু রাষ্ট্রের পতাকা উঠল - সংখ্যালঘু হিন্দুরা তারই উৎসব আনন্দ করলো। আর জর্মান মিঞা আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে বীরভূমের পুরনো বাড়িতে যাত্রা করলো। আর এটুকুই সাত আসমান উপন্যাসের কাহিনী বস্তু। কাহিনীটি লেখক তাঁর নানির নিকট থেকে সংক্ষেপে এভাবেও শুনতে পারেন - শোন নাতিন, সেবার তোমার মা যখন আমার কোলে এলো তখন তোমার নানার এক খোয়াব বাতিক দেখা দেল। সেই খোয়াব ব্যাধি সারানোর জন্য তোমার মেজ নানা তাকে শাহ রুস্তমের মাজারে রেখে আসল। ওদিকে আবার শুরু হলো দেশ ভাগের হাংগামা। দেশ ভাগ হলে তোমার নানার বীরভূম জেলাতো ভারতের অংশ হয়ে যাবে কিন্তু মালদাহ মুর্শিদাবাদ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট জেলা হিসাবে অবশ্যই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। সেই আশায় তোমার নানারে মুর্শিদাবাদে বাড়ি, জমি-জিরাত কিনে দিল। স্বপ্নের স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের আশা করে তোমার নানা সপরিবারে সেই মুর্শিদাবাদেই বসবাস করতে লাগলেন। দেশ ভাগের প্রথম খবরও তাই হলো যে, মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানের অংশ হয়েছে। কিন্তু একদিন বাদে নতুন খবর এলো যে, মুর্শিদাবাদ, মালদাহ পাকিস্তানে নয়, ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর তোমার নানা আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে তখন বীরভূমে ফিরে এলেন। এটুকু সরল কাহিনীর মধ্যেই গল্পের শেষ। কিন্তু শামিমের কৃতিত্ব অন্যত্র। তিনি অতোটুকু কাহিনী বস্তুর মধ্যে আরো অসংখ্য গল্পের ফানুস তৈরি করেছেন। সেখানেই এই সাত আসমান উপন্যাসের অনন্যতা অসাধারণ।



আমার শিল্পপ্রকরণ বোধ: ম্যাজিক রিয়ালিটি থেকে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি

প্রথমত সব বিবরণ না লেখাই শ্রেয়। তো আমি ম্যাজিক রিয়ালিজম খুঁজতে গিয়ে যখন রীতিমতো গলদঘর্ম তখন পেয়ে যাই কিছু শোনা অশোনা নাম - কার্লোস ফুয়েন্তাস, হুয়ান রুলফো, আলিজে ক্যার পেনতিয়ার এবং সর্বশেষ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। গত ১৭ এপ্রিল মার্কেজ মৃত্যুবরণ করায় দেখি তিনিই বেশি আমার কাছে এ বিষয়ক জীয়ন্ত। দেখি, হাসান আজিজুল হক মার্কেজ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ম্যাজিক রিয়ালিজম ত্যাগ করতে পারেননি - “মার্কেজ প্রসঙ্গে অনেকেই ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা বলেন। সৃজনশীল সাহিত্যে আমি কোনো রকম ইজম বা মতবাদের পক্ষপাতী না। আমি মনে করি যে, ইজম করে কেউ কোনদিন লেখক হয় না। মার্কেজ কখনোই নিজেকে ম্যাজিক রিয়ালিস্ট দাবী করেন নি। …..কিন্তু তাই বলে তো আর ‘ আগুনপাখি’ মার্কেজ প্রভাবিত নয়। কিন্তু এক ধরণের ম্যাজিক রিয়ালিস্ট তো বটেই”। কেঁচো খুড়তে সাপ আর কি। আমি জানতে চাচ্ছিলাম ম্যাজিক রিয়ালিজম আর হাসান মারফত জানতে পারলাম, তাঁর ‘আগুনপাখি’ ম্যাজিক রিয়ালিস্ট। তখন আমি ‘আগুনপাখি’ খুঁজতে এক বন্ধুর সাহায্য প্রার্থী হলাম যে কিনা সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে, হাসান আজিজুল হক স্যারের খুলনার ফুলতলার বাড়ির আসে-পাশে যাতায়াত করে। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ কিন্তু আমি আর ‘আগুনপাখি’ পাইনা হাতে। খুলনার সৃজনশীল বই স্টল নিউজ কর্ণারে খোঁজ নিই কিন্তু পাইনা আগুনপাখিকে কিন্তু কি এক দৈববশে পেয়ে যাই সাত আসমান - ম্যাজিক রিয়ালিস্ট বলতে যে সত্য-মিথ্যার গোজামিল এবং রসপরিণতিতে রূঢ় বাস্তবতার অনুরণন যদি বুঝায় তাতে।

ম্যাজিক রিয়ালিস্ট যাদু বাস্তবতা এ শব্দদ্বয়ের মধ্যে দুটো বিপরীত বিষয় আছে একই সঙ্গে। যাদু কখনো সত্য নয়, তা এক মিথ্যার জগৎ। অন্যদিকে রিয়াল অর্থাৎ বাস্তব খাটিরকমে সত্য। তো কথা সাহিত্য প্রকাশের রীতি যখন এমন দুটো বিষয়কে একীভূত করে এগিয়ে যায় এবং চরম পরিণতিতে বাস্তবতাকেই তুলে ধরে তখন সেটা একটা জুতসই আঙ্গিকে পরিণতি লাভ করে। আমি যদি এই বাক্যবন্ধনে যাদু বাস্তবতাকে বুঝাতে পারি তাহলে শামিমের এই ‘সাত আসমান’ উপন্যাসটি একটি উৎকৃষ্ট ম্যাজিক রিয়ালিস্ট সৃষ্টি। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ অবধি এক আগোয়ান রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা দেশের মানুষকে তার বিশাল পেটের গহ্বরে নিতে ব্যস্ত। যেন রাজনৈতিক বাস্তবতাটা এক বিশাল আফ্রিকান কুমির, যে কিনা হা করে আছে আর তার পেটের ভেতর একে একে ঢুকে যাচ্ছে পুরো ভারতবর্ষের মানুষ। বা কুমিরটা হলো ক্ষুধা দারিদ্র অপুষ্টি যার ক্ষিপ্র চোয়ালের দাপটে সব সাধারণ মানুষ চালান হয়ে যাচ্ছে। আমি ঠিক বুঝাতে পারছি কিনা জানিনা তবে বুঝাতে চাচ্ছি এই গল্পে রিয়ালিটির দিকটা। যেখানে আছে দুটো বিষয়: ক. রাজনৈতিক বাস্তবতা, দেশভাগ। এবং খ. ক্ষুধা দুর্ভিক্ষ অপুষ্টি। উপন্যাসের শুরুর দিকটায় নানিরুপী কামরুন্নেসা বিবি তার ভুল বানানের ডায়রিতে লিখছেন সেই দুর্ভিক্ষের কথা - “আমার একটি সুন্দরী মেয়ে হইয়াছে। উহার নাম লক্ষ্মী রাখিব মনস্থ করিয়াছিলাম… চারিদিকে লক্ষ্মীর বড় খুব আকাল পড়িয়াছে, এমত অবস্থায় উহার নাম লক্ষ্মী রাখিলে দেশের মানুষের উপর বেইনসাফি করা হইবে। দুনিয়াময় মারামারি লাগিয়াছে”। বা “এই বাড়িতে রোজ গন্ডা গন্ডা লোক ভাত চাইতে আসে।…. গায়েঁর মানুষ দুই মুঠি চালের জন্য হালের গরু বেচিয়া দিতেছে।…… বীরভূম জিলার একটি গায়েঁ নাকি দেড় মণ ধানের বদলে একটি মেয়ে বিক্রয় হইয়াছে। মেদিনীপুরের এক মুসলমান তাতিঁ বিবি বাচ্চাকে খাইতে দিতে না পারিয়া কাঁসাই নদীতে ডুবিয়া মরিয়াছে। তাহার বিবি ইহার পরে তাতিঁর ছোট ছেলেটাকে কাঁসাই নদীতে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছে। বড় ছেলেকে গর্ত খুড়িঁয়া পুতিয়া দিতেছিল, এমনকালে এক ছোট জাতের হিন্দু তাহাকে উদ্ধার করিয়াছে….” জর্মান মিঞার স্ত্রী কামরুন্নেসার ডায়রির এই দুর্ভিক্ষ বর্ণনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফল, এক কঠিন বাস্তবতা। উপন্যাসের শেষের দিকেও সেই দুর্ভিক্ষ, অপুষ্টির করাল গ্রাস। আর সে দুর্ভিক্ষের কারণ হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা ৪৬-র হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে জর্মান মিঞা তার পুরনো বাড়ি বীরভূমে ফিরে যাচ্ছেন। তখন দুর্ভিক্ষের চিত্রটি এসেছে জর্মান মিঞার মনে অনেকটা স্বপ্ন বাস্তবতার ভেতর - “তেঁতুলির পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে গোটা তিনেক অপুষ্টিতে মারা যায়। বেচারা নিজেও শেষ পর্যন্ত মরলো। মুর্শিদাবাদে চলে আসার পর প্রায়ই মৃত্যুর খবর আসত। রোজ কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। এই মৃত্যুর সারির মধ্যে স্বাধীনতা এল। তামাম এলাকার মানুষ খেতে পায়না।…… কচু তুলে নেওয়ার পর জমিতে যে সামান্য গেড়ো পড়ে থাকে, তা খোঁজার জন্য জমিতে নেমে পড়ে শয়ে শয়ে বুভুক্ষুর দল।…….রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আলো-আঁধারিতে দু’পাশে অনেক কবরস্থান দেখতে পান জর্মান মিঞা। সেটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু তার মনে হলো ওইসব গোরস্থানে বেশির ভাগ কবরই টাটকা।……. দুর্ভিক্ষে যে সব মানুষ মারা গিয়েছে, তারা তো মরেছেই ; যারা বেঁচে ছিল তারা না মরেই বেঁচে ছিল। তাদের অবস্থা মৃতদের থেকেও খারাপ। অপুষ্টি আর নানা রোগ নিয়ে বেশি দিন লড়াই করতে পারেনি। গরিব মানুষের ঘরে এমনিতেই সারা বছর দুর্ভিক্ষ আর মহামারি লেগেই থাকে। এই সব লোকের স্বপ্ন ছিল, দেশ স্বাধীন হলে তারা দু বেলা খেতে পাবে। সেই স্বপ্ন সত্যি বা মিথ্যা হওয়ার আগেই অনেকে মারা গেল। এ সব তাদেরই কবর”। - এই দুর্ভিক্ষের রিয়ালিটি মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চিরকাল ধরে ঘটে আসা রাজনৈতিক কু ইচ্ছার ফল স্বরুপ। বাস্তবতার ক. নম্বরটির উদাহরণ হাজির করে আমি আর লেখার কলেবর বাড়াতে চাইছি না।

এবার আসা যাক তবে যাদুর দিকটাতে। অর্থাৎ যা আপাত সত্য কিন্তু মূলত তা একটি মিথ্যার ফানুস। জর্মান মিঞার স্বপ্ন দেখা, তার বিচিত্র ভাবনা, জুলফিকার মিঞা এবং বদরোদ্দজার বিচিত্র অলৌকিক গল্প এবং উপনাসের শেষ অংশে সুমাই গাড়োয়ানের সর্বজ্ঞাতার ভূমিকা তাতেই নিবদ্ব হয়ে আছে গল্পের ম্যাজিক দিকটি। এই উপন্যাসের নির্মাণশৈলীটাতে যে বৈঠকী ঢঙ(বৈঠক ঘরে বসে কোনো বিষয় নিয়ে কথা উঠলোতো শুরু হলো উদাহরণ টেনে নানান গল্প এবং সেই গল্পের ভেতর দিয়ে বুঝানো হলো বক্তব্য) ব্যবহৃত হয়েছে, যাকে আমরা আজকের জামানায় মার্কেজ তৈরিকৃত নানি-দাদির মুখ থেকে শোনা গল্প বলে যাওয়ার রীতি বলছি । লক্ষ্যণীয় মার্কেজ তাঁর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তাঁর শ্রেষ্ট কর্ম ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস সলিচ্যুড উপন্যাসের রচনার স্টাইল সম্পর্কে বলছেন- “ আমি সব সময় যা করতে চাইতাম সে বিষয়ে আমার একটা পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেখানে প্রচুর অভাব ছিল এবং সেটা যে কিসের অভাব সে বিষয়ে আমি নিশ্চিৎ ছিলাম না, যতদিন পর্যন্ত না আমি সঠিক সূরটি আবিস্কার করলাম - সেই সূর যা অবশেষে আমি একশত বছরের নি:সঙ্গতা বইয়ে ব্যবহার করেছি। আমার দাদীমা (নানি) গল্প বলতে যে ভঙ্গী ব্যবহার করতেন এটার ভিত্তি ছিল সেটা। তিনি যে বিষয়ে বলতেন সেটা শুনতে অলৌকিক এবং অবাস্তব মনে হতো, কিন্তু সেটাকেই তিনি একেবারে পরিপূর্ণ স্বাভাবিকতার সঙ্গে বলতেন। শেষ পর্যন্ত আমি যখন এই সুরটি আবিস্কার করলাম ওটাকে আমাকে ব্যবহার করতে হলো-“। 

হাসান আজিজুল হক মার্কেজ সম্পর্কে ঐ একই কথা বলেছেন - “ল্য্যাতিন আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থা অনেকটা আমাদের ভারতবর্ষের মতো - নানা-নানি দাদা-দাদীর কাছে সন্তান রেখে মানুষ করা ইত্যাদি আমাদের মতো তাদেরও ছিল। যাহোক তিনি (মার্কেজ) নানির কাছে মানুষ হওয়ার সময় নানি তাকে নানা গল্প বলতেন। গল্পগুলো এমনভাবে বলতেন যে, সত্য মিথ্যার কোনো প্রভেদ থাকতো না”। শামিম আহমেদ তার সাত আসমান উপন্যাসে সেই একই রীতি গ্রহণ করেননি তাই বা কে বলবে ? মার্কেজের লেখায় তাঁর আত্মজীবনের ছাপ আছে। শামিম তাঁর এ উপন্যাসে তাঁর মাতৃ বংশীয় এক পুরুষ আগের মানুষদের কথা লিখেছেন তা পাঠকের কাছে সহজেই যেন বোধগম্য হতে থাকে। লক্ষ্যণীয় শামিম তাঁর এ উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর নানি কামরুন্নেসাকে এবং কামরুন্নেসা চরিত্রটি উপন্যাসে স্বয়ং হাজির। 

মুর্শিদাবাদের সালারের কথা উপন্যাসের বর্ণিত ভূগোল এবং এই সালারেই শামিমের জন্ম এবং হয়ত নানা বাড়িতে এবং পেয়েছেন শৈশব-কৈশোরে নানির সান্নিধ্য। আমি এই আলোচনার কাহিনী অংশে তার ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছি। লক্ষণীয় ‘তিনি যে বিষয়ে বলতেন সেটা শুনতে অলৌকিক এবং অবাস্তব মনে হতো, কিন্তু সেটাকেই তিনি একেবারে পরিপূর্ণ স্বাভাবিকতার সঙ্গে বলতেন’। অর্থাৎ মার্কেজের নানি যে গল্পগুলো বলতেন। 

শামিমের সাত আসমান শুরুই হয়েছে সেরকম অলৌকিকতা এবং অবাস্তবতা দিয়ে - রুনার নানার প্রথম সন্তান যখন দুনিয়ার মুখ দেখতে যাচ্ছে তখন ভোর বেলা তিনি প্রাত:কালীন প্রার্থনার নিমিত্তে প্রাত:কৃত সারতে যাচ্ছেন আর তখন দেখতে পান অদ্ভুত দৃশ্য - “.. তখন দেখেন পায়খানার পাশের পুকুরপাড়ে এক যুবক দাঁড়িয়ে। ঊষা-লগ্নের আলো-আঁধারীতে নানা তাকে রবিন বলে চিনতে পারেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ঠেকে এইটা যে, রবিনের মুখটা যেন পেছন দিকে মানে পিঠের দিকে বসানো। সেই দেখে নানা তাঁর পায়খানার বেগ চেপে রাখতে পারেন না।….. তিনি রবিনের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে লক্ষ করেন, রবিন তাঁর দিকেই মুখ করে হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু নানা ও রবিনের মধ্যবর্তী দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রমশ। অজ্ঞান অবস্থায় নানাকে তুলে আনা হয়”। এই অদ্ভুত অলৌকিক ঘটনাকেই যদি এ উপন্যাসের কার্যকারণ সূত্র বলি তাহলে ভুল বলা হবেনা। কারণ নানা জর্মান হোসেন মিঞাই এ কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং তাঁর এইসব অদ্ভুত অবলোকন, স্বপ্ন, স্বপ্নের ব্যাখ্যাদাতাদের খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা এবং এই যে ভুতে পাওয়া বা জ্বিনে ধরা অবস্থার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কার্যাবলীই এ উপন্যাসের মূল কাহিনী বস্তু। এই যে অদ্ভুত যাদু দর্শন এটা উপন্যাসের শুরুতে যেমন আছে, তেমনি আছে শেষটাতেও। 

জর্মান মিঞা আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে নিজের পুরনো আবাসভূমিতে ফিরে যাচ্ছেন। মেজ ভাই জর্মানের পরিবারসহ তাকে নিতে মহিষের গাড়ি পাঠিয়েছেন সংগে নতুন গাড়োয়ানও। পুরনো গাড়োয়ান তেতুলি মারা যাওয়ার পর এই গাড়োয়ানকে রাখা হয়েছে। মধ্যরাতে যাত্রা শুরু করেছেন। গাড়ির ভেতরে স্ত্রী কামরুন্নেসা, তাদের দুই কন্যা, কামরুন্নেসার ভাইপো, সুমাই গাড়োয়ান গাড়ি চালাচ্ছেন হাকিয়ে আর নানান বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ গল্প বলছেন। সুমাই গাড়োয়ানের বিচিত্র বিষয়ে জ্ঞান, বিচক্ষণতা দেখে জর্মান মিঞা অভিভূত। এর মধে ভোরের দিকে গাড়ি বাড়ির কাছাকাছি চলে এলে জর্মান মিঞা দেখতে পান রাস্তার পাশ দিয়ে অসংখ্য কাঁচা কবর। সুমাইয়ের কাছে জিঙ্গেস করে জানতে পারেন, এ-সব হলো রায়তের ফলে দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া মানুষের কবর। এরপর বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানের কাছে চলে এলে দেখতে পান তাদের গোরস্থানেও কাঁচা কবর। দুর্ভিক্ষে তাদের বাড়ির কেউ মারা যায়নি, তবে এই কাঁচা কবরগুলো কাদের জানতে চাইলে সুমাই গাড়োয়ান জানায় যে, এ-সব হলো সেই-সব মানুষের কবর যাদের নিজস্ব কবরস্থান নেই, তার মেজভাইজান তাদের গোরস্থানেই দয়া করে জায়গা দিয়েছেন। এরপর ভোরের আলোয় জর্মান মিঞা দেখতে পান গাড়োয়ানের লাঠি-আসন ফেলে সুমাই গোরস্থানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং কাঁচা কবরগুলোর পাশে গিয়ে নাম ধরে ধরে জর্মান মিঞাকে জানাচ্ছেন কোনটা কার কবর। এমন দেখাতে দেখাতে সুমাই কোন একটা কবরের ভেতর নিজেই ঢুকে গেল এবং সেটি তার নিজেরই কবর কিনা তাই। এমন ম্যাজিক রিয়ালিজম দৃশ্যের মাধ্যমে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে শামিম আহমেদ আমাদেরকে উপহার দেন এক নতুনতর ম্যাজিক রিয়ারিস্টিক ফিকশন।

মার্কেজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরেকটা বিষয় জানা যায়, আর সেটা হলো - কথাকার এখানে এক সর্বজ্ঞ জ্ঞাতার ভূমিকায় আর্বিভূত হন। অর্থাৎ তিনি যে বিষয়কে কেন্দ্র করে গল্পটি লিখছেন সে বিষয়ে বা তার আনুষঙ্গিক বিষয়ে এমন কিছু নেই যা তিনি জানেন না। শামিম তাঁর এ উপন্যাসে প্রধান চরিত্রের মাধ্যমে দুটো বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন যার একটি হলো দেশ বিভাগকালীন সময়ের ভারতের রাজনীতি এবং দ্বিতীয়টি হলো উক্ত সময়ে ভারতীয় মুসলিম মানস। আর দুটো বিষয়কেই উপস্থাপন করেছেন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জর্মান মিঞার মাধ্যমে এবং আরো দুটি চরিত্র যথাক্রমে জুলফিকার মিঞা এবং বদরুদ্দোজা মিঞা সহায়ক হিসেবে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, দেশভাগের সময় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির বিস্তৃত পরিচয় এখানে না এলেও, এসেছে তার সার-সংক্ষেপ। দেশভাগ যে হয়েছিল উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে নয়, বরং তাদের স্বার্থের কথা ব্যবহার করে কতিপয় ক্ষমতালোভী সুবিধাভোগীর স্বার্থে সেই কথাটি উপন্যাসের কাহিনী কাঠামোয় পরিস্কার হয়েছে। এবং সেটি প্রকাশ করতে শামিম কোন কৃত্রিমতার আশ্রয় নেননি; বরং কাহিনীর স্বাভাবিকতায় সেটি প্রকাশিত হয়েছে। 

ভারতীয় মুসলিম মানস প্রতিফলিত হয়েছে জর্মান মিঞার স্বপ্ন, চিন্তা-চেতনা, মানসিকতার দ্বন্দ্ব প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। এটি পুরুষ পরম্পরায় জর্মান মিঞার মধ্যে এসেছে। ‘জর্মান’ এই নামকরণটি একটু অদ্ভুত ধরনের। সাধারণত বাঙালী মুসলমানদের নাম আরবি-ফারসি শব্দ থেকে বা তার ঐতিহ্য থেকে রাখা হয়ে থাকে কিন্তু জর্মান এই নামটি রাখা হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসের একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতকে স্মরণ করে রাখার জন্য।“ জর্মান মিঞা মায়ের কাছ থেকে শুনেছেন, তাঁর জম্মের সময় সারা দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ চলেছিল। আরব দেশেও চলছিল টালমাটাল অবস্থা । শেরিফ হোসেন বিন আলি নামের আরব দেশের এক লোক তুর্কি রাজাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করে। ভয়ঙ্কর গেরিলা কায়দায় চলছিল সেই জঙ্গ। এই যুদ্ধকে আবশ্য বাংলার শিক্ষিত মুসলমান মানতে পারেনি। তাঁরা শেরিফ হোসেনের বিরোধীতা করেছিল। জর্মান মিঞার মা উর্দু ও আরবি ভাষা খুব ভাল জানতেন। তিনি তুরস্কের খলিফাকে খুব মান্য করতেন। খলিফা না থাকলে সারা দুনিয়ার মুসলমান কোন ছাতার নিচে দাঁড়াবে ! সেই খলিফার হাত থেকে, তুরস্কের রাজার কবল হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য আরবেও শুরু হলো যুদ্ধ। তাঁরা সিরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত নিজেদের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। তুরস্কের রাজাকে সঙ্গ দিয়েছিল জর্মানি। বাংলার মুসলমান বুঝতে পারেন, জর্মানিই হলো তাদেঁর প্রকৃত বন্ধু। জর্মান মিঞার মা তাই ছেলের নাম রেখেছিলেন, সেই দেশের প্রতি সম্মান জানাতে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে”

ইসলামের ইতিহাসের এমন খুটি-নাটি বিষয় যেমন উঠে এসেছে লেখকের সর্বজ্ঞতার পরিচয় স্বরুপ, তেমনি এসেছে বিবি বিলকিসের সাথে সুলেমান নবীর কথোপকথন - এসেছে নবী মোহাম্মদের মেরাজ ভ্রমণের বিস্তৃত বিবরণ। এ-সব বিষয়ে শামিমের শুধু যে সঠিক জ্ঞান আছে তাইনা, বরং পান্ডিত্যও আছে অনুমিত হয়। আমি আশ্চর্য্য হয়েছি এটা অনুসন্ধান করে যে, মেরাজে রসুল মোহাম্মদ সাত আসমান ভ্রমণে প্রতি আসমানে কোন কোন নবীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তার নির্ভুলতায়। আমি আমার ফাজিল(ডিগ্রি) কামিল(এমএ) পাঠদান করেন এমন মাওলানা সাহেবদের জিঙ্গেস করেছিলাম কিন্তু তাদেরকে উত্তর দিতে হলো তাফসীরে জালালাইন খুজেঁ । আর শামিম কি অবলীলায় তার উপন্যাসে সেই তথ্য নির্ভুল ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই না, যে-সব নবী-রসুলদের প্রসঙ্গ তার কাহিনীর মধ্যে এসেছে । তাদের পরিচয়ের মৌলিক অংশটি মুল কুরআন অনুসারে সংক্ষিপ্তকারে সুন্দর উপস্থাপন করেছেন। এর সমর্থনে একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে চাই। ইউসুফ নবীর পরিচয় দিতে গিয়ে শামিম লিখছেন - এই দুনিয়ায় সবচেয়ে সুন্দর দেখতে মানুষ হজরত ইউসুফের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল।(৩য় আসমানে) গোটা দুনিয়ার অর্ধেক সৌন্দর্য্য নিয়ে আল্লাহতালা এই নবীকে গড়েছিলেন।….. ইউসুফ নবী ছিলেন নামকরা স্বপ্নব্যাখ্যাকারী”। কুরআনে নবী ইউসুফ(আ:) কে এই দুই মৌলিক বৈশেষ্ট্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। শামিম তার অসাধারণ গদ্যে ইউসুফ নবীর কাহিনীটি সংক্ষেপে অথচ মূল কাহিনীর কোনকিছুই বাদ না দিয়ে বর্ণনা করেছেন অসাধারণ ভঙ্গীমায়। মুর্র্শিদাবাদের সালারের পীরের প্রসঙ্গটেও এসেছে ইতিহাসের সত্যের প্রেক্ষাপটে কিন্তু সেই সত্য বর্ণনা বা কসুসুল আম্বিয়ার কাহিনী বর্ণনা করা কিন্তু শামিমের উদ্দেশ্য নয়। মূল কাহিনী বর্ণনায় এ-গুলো হলো খোলস। সেই খোলসের ভেতরে ঢুকিয়ে একজন আয়েসী, স্বপ্নবাদী, সর্বদা স্বপ্নের সুলুক সন্ধানী মানুষ স্বপ্নভঙ্গের শিকার হয়েছেন সেই বেদনা বোধের কথা বয়ানই তার মূল উদ্দেশ্য।

যাদু বাস্তবতা শামিমের এ উপন্যাসে আছে, সেটা পাঠক মাত্রেরই বোধে খুব সহজেই এসে যাবে। এবং সেটা সব পাঠকের নিকট রসানুভূতির নিয়ামক হবে। কিন্তু আমার নিজের বোধে আরেকটি অনুষঙ্গ আমার রসানুভূতিকে বাড়িয়ে তুলেছে, আর সেটি হলো ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। সখের বশে একদিন তথ্য প্রযুক্তির শিক্ষক হয়েছিলাম। সেখানে প্রথম পাঠটাই ভার্চুয়াল রিয়ালিটির ওপর। সে দেখি আরেক মিথ্যার ফানুস। কম্পিউটার ল্যাবে মানব এ শরীরে কিছু যন্ত্রপাতি লাগিয়ে পাওয়া যাবে সমুদ্র তলে বিচরণের স্বাদ বা জুরাসিক পার্কে বিশালাকৃতির ডাইনেসরদের কবলে পড়ে দৌড়ানোর স্বাদ। তথ্য প্রযুক্তির এ এমন এক কার্যাবলী যার মারফত পাওয়া যাবে, যা আমার হবেনা কখনো তা প্রাপ্তির অনুভূতির স্বাদ। উগ্র রোমান্টিসিজমকে সে যেন আজ বাস্তব করে তুলছে। আমরা অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটে বন্ধুত্ব করি, সম্পর্ক তৈরি করি, পেয়ে যাই ছবি, গান, সাহিত্য এসব সব কি এক অর্থে সেই ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগৎ নয় কি ? ফেসবুকে অনেক ধরণের বন্ধু থাকে, যাদের কাউকে কাউকে আমরা আমাদের দেখা বা পরিচয় সূত্রে জানা হয়না। তারা শুধু ঐ ভার্চুয়ালেরই বাসিন্দা। কুলদা রায় আমার কাছে তেমনই এক বন্ধু। তাঁকে যেমন আমি দৈবাৎভাবে ঐ ভার্চুয়ালেই পেয়ে যাই, ঠিক তেমনিভাবে তার মাধ্যমেই আমি শামিম আহমেদকে পেয়ে যাই এবং পেয়ে যাই তাঁর ‘সাত আসমান’। আমার আসে-পাশে দেখা জানা-শোনা পরিচিতজনদের মতো তারা কেউ নয়। ভার্চুয়ালের মোদ্দা কথা হলো - তা কৃত্রিম সৃষ্টি করা এক জগৎ কিন্তু অনুভব করায়, অনুভূতি জাগায়। শামিম আহমেদের ‘সাত আসমান’ তেমনি এক অনুভূতি জাগরুক, না ভুলবার গল্প জাগরুক এক অসাধারণ উপন্যাস।



লেখক পরিচিতি
বনি আমিন

জন্মস্থান: সাতক্ষীরা (সুন্দরবনের পাশ ঘেষে শেষ জনপদে) লেখাপড়া এবং বেড়ে ওঠা ওখানেই(মাধ্যমিক পর্যন্ত) এরপর খুলনা এবং রাজশাহী। 
কর্মস্থল: গোপালগঞ্জ--দিগনগর গ্রামে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ