এরকম মাঝে মাঝে হয়। খুব ভালো একটা গান শুনলেন বা ভালো একটা সিনেমা দেখলেন বা দারুণ কোনো একটা বই পড়লেন-- তারপরেই যা হয়, এই ভালোটা, ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে আশে-পাশে, পারলে দশদিকে। বলতে ইচ্ছা করে এই ভালোটার রস তুমিও একটু চেখে দেখো, মজাটা একটু নাও, চোখটা মনটা জুড়াক; তাহলেই বুঝতে পারবে পৃথিবীটা, এই জীবনটা, এখনো শুকিয়ে যায় নি, ফুরিয়ে যায় নি; এখনো তা আস্ত একটা জিজ্ঞাসা হয়ে বা আশা হয়ে বা সুন্দর হয়ে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে-- তুমি তা গ্রহণ না বর্জন করবে তা একান্তই তোমার ব্যাপার!
দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, ‘ইঁদুর’ গল্পটি আগে পড়ি নি আমি। এমন অনেক ভালোই যে আমার পড়া হয় নি, দেখা হয় নি তা আমি জানি। তবু ‘ইঁদুর’ পড়ার পর আফসোসটা হলো। ভাবলাম গল্পটা আগে পড়া উচিত ছিলো আমার। তবে ইঁদুর নামটা দেখার পর, এই নামটা পরিচিত মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল গল্পটি আমি পড়েছি...
গল্পটি এলো ফেসবুক ইনবক্সে। প্রশ্ন সমেত। পাঠিয়েছেন কুলদা রায়। বুঝলাম এই ভালোটার ভাগাভাগি করতে চাচ্ছেন তিনি। কাজের চাপ ও স্বাস্থ্যগত কারণে দ্রুত পড়ে শেষ করতে পারি নি গল্পটি, বা এমনও হতে পারে দ্রুত পড়তে চাই নি। এবং পড়ার পর মনে হলো দ্রুত না পড়ে ঠিক কাজটিই করেছিলাম আমি। গল্পটা কচমচ করে পড়ে শেষ করা যেতো না। এ তেমন গল্পই নয়।
কিন্তু কেন? ‘ইঁদুর’ কি তবে সুখপাঠ্য নয়?
প্রশ্নই আসে না। সোমেন চন্দ’র ভাষা নিয়ে এই আমি কিছু বলার আগে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ সবাই নিজের নিজের ইতিবাচক মত প্রকাশ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তো কবুল করছেন এই ‘ইঁদুর’ গল্প পড়েই নাকি তিনি নি¤œ মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার প্রেরণা পেয়েছেন। আমি কেবল দীর্ঘশ্বাসই ফেলি। ভাবি, পূর্বজদের এই উচ্ছ্বাসও আমার জ্ঞাত নয়।
ইঁদুর একটানে পড়া যায়। কিন্তু পড়তে পড়তে চোখের সামনে যে-ছবিগুলো ভেসে ওঠে, আমি নিজে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবেশে বড় হয়েছি, বাস করেছি এবং এখনো করছি বলেই হয়তো, কেমন যেন ধারালো ভাবে বুকে লাগে, ফলে থমকে থমকে যেতে হয়। সে তো গল্পের দোষ নয়, বরং গুণই। বাস্তবতা খুব তীক্ষ্ণ হয়ে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আর ওই গল্পের ইঁদুরগুলো যেন কিলবিল করতে থাকে আমার আশে পাশে। আমি বারবার আমার ঘর দেখি, আশপাশে তাকাই। কী যেন শব্দ শুনতে পাই। মনে হয় আমার অপ্রাপ্তিগুলো ইঁদুরের মতো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। বড় বেগানা ভাবে বেরিয়ে পড়ছে দরিদ্রতা-- ইঁদুরের বেশে।
ইঁদুর ছুটে যাচ্ছে। বাইরে আর ভেতরে। গল্পে আর বাস্তবে। অতীতে আর বাস্তবে। এমনকি ভবিষ্যতেও। ফলে গল্পটি আমাকে নাড়া দেয়। দিয়েই ফুরিয়ে যায় না। দীর্ঘক্ষণ এই নাড়া দেয়ার প্রক্রিয়াটা চলতে থাকে। এবং এক ধরনের চাপ তৈরি করে। চাপটা লেখার এবং না-লেখার। আমি বারবার ভাবি ইঁদুর গল্পটি নিয়ে আমি লিখতে পারবো না, এ আমার সাধ্যের বাইরে। আবার একই সাথে লিখতে ইচ্ছা করে; অন্তত আমার মতো যারা বোকা পাঠক রয়েছে তাদের জন্যই লিখতে ইচ্ছা করে। অন্তত যারা একটা মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পটভূমিতে বেড়ে উঠেছে, যারা অন্যপাঠে এতদিন মগ্ন হয়ে আছে, তাদের কথা ভেবেই লিখতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছাটা বাড়তেই থাকলো। ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছা করলো, গল্পটি পড়ুন। একবার পড়ুন। কথা দিচ্ছি একটা পর্দা চোখের সামনে থেকে সরে যাবে!
কিন্তু পর্দাটা কিসের?
এই গল্পটা কিসের তাহলে? দারিদ্রের? সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীতার? দাঙ্গা বিরোধীতার?
প্রশ্নগুলো কিন্তু এসেছে। আর আমার কাছে মনে হয়েছে এই গল্পটা, এই ইঁদুর নামের গল্পে সোমেন চন্দ’র কী নিদারুণভাবে আসলে ‘জীবন’ লিখেছেন। শুধুই জীবন। এখানে জীবন আছে। আর হ্যাঁ জীবন থাকলে যা হয়, তাতে সব উপাদান সব উদযাপন থাকে। ইঁদুরে তাও আছে। গল্পটায় একটা অস্থির সময়কে আমরা আবিষ্কার করি। কেমন যেন বেরিয়ে যাওয়া, ঘোরলাগা, কিছুই না করতে পারার এক সময়কে পেয়ে যাই। যার অস্থিরতা দ্রিম দ্রিম করে বাজে। আর বাজনাটা একবারও দূরের মনে হয় না। মনে হয়, এই তো, এখানে, আমার চোখের সামনে, আমার মনের ভেতরে চলছে এই অস্থিরতা। মনে প্রশ্ন আসে, এই অস্থির সময় কি গত হয়েছে? ইঁদুর কি তবে অতীতের গল্প? প্রয়োজন ফুরিয়েছে এই গল্পটা?
কে না জানে, এখনকার মতো আর অস্থির সময় বোধহয় আর আসে নি! এখনকার মতো অস্থির আর নিদারুণ! অথচ এই অস্থিরতা নিয়ে তেমন কি লেখা হচ্ছে? আমার পড়াশোনা কম, ফলে আমার হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে; যাদের পড়াশোনা বেশি তাদের জিজ্ঞেস করেও অবশ্য সদুত্তর পাচ্ছি না। তার মানে কি আমরা আমাদের সময়টাকে বাতিল করে দিচ্ছি? আমরা আমাদের সময়ে বাস করছি না? বা সাহিত্যে আমরা আসলে অন্য সময়ে বাস করতে চাইছি?
জানি না।
তবে ইঁদুর পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ১৯২০ সালে জন্ম নেওয়া সোমেন চন্দ’র যদি ইঁদুর গল্পে তাঁর সময়সহ আমাদের সময়কেও ধরতে পারেন তাহলে বোধহয় আমাদের কিছু কর্তব্যও সামনে এসে পড়ে। লেখক হই বা পাঠক হই সেই কর্তব্য, সেই দায়িত্ব, সেই দায় আমরা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না।
দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, ‘ইঁদুর’ গল্পটি আগে পড়ি নি আমি। এমন অনেক ভালোই যে আমার পড়া হয় নি, দেখা হয় নি তা আমি জানি। তবু ‘ইঁদুর’ পড়ার পর আফসোসটা হলো। ভাবলাম গল্পটা আগে পড়া উচিত ছিলো আমার। তবে ইঁদুর নামটা দেখার পর, এই নামটা পরিচিত মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল গল্পটি আমি পড়েছি...
গল্পটি এলো ফেসবুক ইনবক্সে। প্রশ্ন সমেত। পাঠিয়েছেন কুলদা রায়। বুঝলাম এই ভালোটার ভাগাভাগি করতে চাচ্ছেন তিনি। কাজের চাপ ও স্বাস্থ্যগত কারণে দ্রুত পড়ে শেষ করতে পারি নি গল্পটি, বা এমনও হতে পারে দ্রুত পড়তে চাই নি। এবং পড়ার পর মনে হলো দ্রুত না পড়ে ঠিক কাজটিই করেছিলাম আমি। গল্পটা কচমচ করে পড়ে শেষ করা যেতো না। এ তেমন গল্পই নয়।
কিন্তু কেন? ‘ইঁদুর’ কি তবে সুখপাঠ্য নয়?
প্রশ্নই আসে না। সোমেন চন্দ’র ভাষা নিয়ে এই আমি কিছু বলার আগে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ সবাই নিজের নিজের ইতিবাচক মত প্রকাশ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তো কবুল করছেন এই ‘ইঁদুর’ গল্প পড়েই নাকি তিনি নি¤œ মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার প্রেরণা পেয়েছেন। আমি কেবল দীর্ঘশ্বাসই ফেলি। ভাবি, পূর্বজদের এই উচ্ছ্বাসও আমার জ্ঞাত নয়।
ইঁদুর একটানে পড়া যায়। কিন্তু পড়তে পড়তে চোখের সামনে যে-ছবিগুলো ভেসে ওঠে, আমি নিজে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবেশে বড় হয়েছি, বাস করেছি এবং এখনো করছি বলেই হয়তো, কেমন যেন ধারালো ভাবে বুকে লাগে, ফলে থমকে থমকে যেতে হয়। সে তো গল্পের দোষ নয়, বরং গুণই। বাস্তবতা খুব তীক্ষ্ণ হয়ে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আর ওই গল্পের ইঁদুরগুলো যেন কিলবিল করতে থাকে আমার আশে পাশে। আমি বারবার আমার ঘর দেখি, আশপাশে তাকাই। কী যেন শব্দ শুনতে পাই। মনে হয় আমার অপ্রাপ্তিগুলো ইঁদুরের মতো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। বড় বেগানা ভাবে বেরিয়ে পড়ছে দরিদ্রতা-- ইঁদুরের বেশে।
ইঁদুর ছুটে যাচ্ছে। বাইরে আর ভেতরে। গল্পে আর বাস্তবে। অতীতে আর বাস্তবে। এমনকি ভবিষ্যতেও। ফলে গল্পটি আমাকে নাড়া দেয়। দিয়েই ফুরিয়ে যায় না। দীর্ঘক্ষণ এই নাড়া দেয়ার প্রক্রিয়াটা চলতে থাকে। এবং এক ধরনের চাপ তৈরি করে। চাপটা লেখার এবং না-লেখার। আমি বারবার ভাবি ইঁদুর গল্পটি নিয়ে আমি লিখতে পারবো না, এ আমার সাধ্যের বাইরে। আবার একই সাথে লিখতে ইচ্ছা করে; অন্তত আমার মতো যারা বোকা পাঠক রয়েছে তাদের জন্যই লিখতে ইচ্ছা করে। অন্তত যারা একটা মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পটভূমিতে বেড়ে উঠেছে, যারা অন্যপাঠে এতদিন মগ্ন হয়ে আছে, তাদের কথা ভেবেই লিখতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছাটা বাড়তেই থাকলো। ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছা করলো, গল্পটি পড়ুন। একবার পড়ুন। কথা দিচ্ছি একটা পর্দা চোখের সামনে থেকে সরে যাবে!
কিন্তু পর্দাটা কিসের?
এই গল্পটা কিসের তাহলে? দারিদ্রের? সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীতার? দাঙ্গা বিরোধীতার?
প্রশ্নগুলো কিন্তু এসেছে। আর আমার কাছে মনে হয়েছে এই গল্পটা, এই ইঁদুর নামের গল্পে সোমেন চন্দ’র কী নিদারুণভাবে আসলে ‘জীবন’ লিখেছেন। শুধুই জীবন। এখানে জীবন আছে। আর হ্যাঁ জীবন থাকলে যা হয়, তাতে সব উপাদান সব উদযাপন থাকে। ইঁদুরে তাও আছে। গল্পটায় একটা অস্থির সময়কে আমরা আবিষ্কার করি। কেমন যেন বেরিয়ে যাওয়া, ঘোরলাগা, কিছুই না করতে পারার এক সময়কে পেয়ে যাই। যার অস্থিরতা দ্রিম দ্রিম করে বাজে। আর বাজনাটা একবারও দূরের মনে হয় না। মনে হয়, এই তো, এখানে, আমার চোখের সামনে, আমার মনের ভেতরে চলছে এই অস্থিরতা। মনে প্রশ্ন আসে, এই অস্থির সময় কি গত হয়েছে? ইঁদুর কি তবে অতীতের গল্প? প্রয়োজন ফুরিয়েছে এই গল্পটা?
কে না জানে, এখনকার মতো আর অস্থির সময় বোধহয় আর আসে নি! এখনকার মতো অস্থির আর নিদারুণ! অথচ এই অস্থিরতা নিয়ে তেমন কি লেখা হচ্ছে? আমার পড়াশোনা কম, ফলে আমার হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে; যাদের পড়াশোনা বেশি তাদের জিজ্ঞেস করেও অবশ্য সদুত্তর পাচ্ছি না। তার মানে কি আমরা আমাদের সময়টাকে বাতিল করে দিচ্ছি? আমরা আমাদের সময়ে বাস করছি না? বা সাহিত্যে আমরা আসলে অন্য সময়ে বাস করতে চাইছি?
জানি না।
তবে ইঁদুর পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ১৯২০ সালে জন্ম নেওয়া সোমেন চন্দ’র যদি ইঁদুর গল্পে তাঁর সময়সহ আমাদের সময়কেও ধরতে পারেন তাহলে বোধহয় আমাদের কিছু কর্তব্যও সামনে এসে পড়ে। লেখক হই বা পাঠক হই সেই কর্তব্য, সেই দায়িত্ব, সেই দায় আমরা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না।
লেখক পরিচিতি
আহমেদ খান হীরক
জন্মসাল- ১৯৮১
জন্মস্থান- রহনপুর, রাজশাহী, বাংলাদেশ।
বর্তমান আবাসস্থল-ঢাকা, বাংলাদেশ।
পেশা- লেখক, টুন বাংলা এ্যানিমেশন স্টুড...
প্রকাশিত লেখা- উত্তরাধিকার, নতুন ধারা ইত্যাদিসহ বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা।
প্রকাশিত গ্রন্থ- কাব্যগ্রন্থ- আত্মহননের পূর্বপাঠ।
ইমেইল- hirok_khan@yahoo.com
2 মন্তব্যসমূহ
হীরক ভালো লাগলো পড়ে। আদূর গোপাল কৃষ্ণনের একটা ছবি আছে র্যাট ট্র্যাপ। পারলে নিয়ে যাবো। আর ইঁদুর এই গল্পটা বাংলা সাহিত্যে বিরল। আরো লেখ...আরো পড়...। শুভেচ্ছা। কল্লোল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ কল্লোল দা। র্যাট ট্র্যাপটা নিয়ে এলে আরো বড় ধন্যবাদ দেবো। অপেক্ষায় থাকলাম।
উত্তরমুছুন