অগ্নি রায়
গণমাধ্যম-বিস্ফোরণ পরবর্তী ছাই, স্প্লিণ্টার, লোহাকুচি সমূহে ধূসর এই বিক্ষিপ্ত রোড রেসে দাঁড়িয়ে কীভাবে লেখা হতে পারে আজকের ইউলিসিস?পুতুলরা যখন প্রোগ্রামড হয়ে রয়েছে পূর্ব নির্ধারিত কম্বিনেশনে, তখন তার নাচের ইতিকথা কেমন হবে দেখতে? ক্ষমতার রঙিন ফ্লেভারে (হ্যাঁ, বানানাও যেখানে দামী এবং মোস্ট সট আফটার!) যখন বিক্রী হছে শিল্পমসল্লা – কোন কারুবাসনায় একবারের জন্যও ছুঁয়ে দেওয়া সম্ভব একটি না-লেখা উপন্যাসের নাভি?
অসুস্থতার জন্য ইদানিং কমে এসেছে। না হলে এই তো ক’মাস আগেও প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করেছি নবারুণ ভট্টাচার্যের । তাঁর গভীর প্রশ্রয়ের সুবাদেই। দিল্লিতে থাকার কারণে, বেশিরভাগটাই টেলিফোনে। দিনে, দুপুরে, গভীর রাতেও। এমনি কোনও এক মুহূর্তে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বর্ণিত না-উপন্যাস সংক্রান্ত আলোচনার প্রসঙ্গে সংশয়াচ্ছন্ন আমি, উপরের প্রশ্নগুলি করেছিলাম নবারুণদাকে। যেভাবে লিখলাম সেভাবে অবশ্য নয়। কিন্তু মোদ্দা ব্যাপারটা ছিল এরকমই। যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁরা জানেন যে অনেক কথা বলার লোক নন নবারুণদা। যেটুকু বলেন, সেটুকু নির্ঘাৎ, এবং ভিতরের মর্মটুকু বাঁচিয়ে। সেদিন কিন্তু স্বভাববিরুদ্ধভাবেই অনেক কথা বলেছিলেন। আজ তার সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি নিষ্প্রয়োজন। শুধু এটুকু উল্লেখ থাক, নবারুণ ভট্টাচার্য,যিনি আজকের‘সাহিত্যের সার্কাসে’ স্বঘোষিত ‘আউটসাইডার’-এর ভূমিকা নিয়ে বিপদজনক ট্রাপিজ-আঁধারে তুলকালাম ঝাঁপ দিয়েছিলেন সেই কবে, সেই তিনি আমাকে প্রথম ও শেষবারের মত দু’টি লাইনের মধ্যবর্তী শূন্যতার কথা বলেছিলেন। নতুন ধারার ভাবী উপন্যাস বা লেখালেখি সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ছিল এমনই যে,যেটুকু লেখা হল না, বা লেখা গেল না, সেটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, লিখিত বাক্যসমষ্টির চেয়ে। দু’তিন চার লাইনের চলনের মাঝের ফাঁকফোঁকরের উপর প্রভাব ধরে রাখাটাই আসল মস্তানি। এটাই, তাঁর মতে, আজকের লেখালেখির ধ্রুবপদ।
আজ এই লেখাটি তৈরি করার আপৎকালীন রাতে যখন স্যালাইন, অক্সিজেন, ওরাল টিউব সজ্জিত হয়ে শরশয্যায় লড়াই জারি রেখেছেন হারবার্ট-এর লেখক,তখন বারবার না চাইতেও ওই লজিক মধ্যবর্তী অন্ধকারের কথা মনে এসে যাচ্ছে। আশা করব নবারুণদা এতক্ষণে নিশ্চয়ই নিজের মতো করে বুঝে নিতে শুরু করেছেন সেই অন্ধকার যা আসলেই আলোর অধিক। হয়তো বুঝে নিয়েছেন এই সত্যও যে ব্যাপারটা আসলে অন্ধকারও নয়, এক শূন্য পরিসর, যেখানে কোটি কোটি আলোকবিন্দু সমবেত হচ্ছে, আর সেই অগণিত আলোকবিন্দুর গায়ে গায়ে অগণিত ক্ষুদ্র রহস্যের প্রতিসরণ ঘটছে – যা তাঁর গোটা সাহিত্য যাপনকেই অফুরন্ত করতে করতে চলেছে।
মার্কস-এর থিওরি অব সারপ্লাস ভ্যালুতে বলা হয়েছে, ‘ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বিশেষ কতগুলি বুদ্ধিজীবী শ্রমের (যেমন কবিতা অন্যান্য শিল্প) পরিপন্থী। অর্থাৎ উৎপাদক শক্তি হিসাবে বিজ্ঞান যতই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ততই নিছক ভোগ্যপণ্যতে পরিণত হয় শিল্প। এটাও নিশ্চিতভাবেই দেখা যায় গত শতাব্দী জুড়ে যে তোলপাড়, সেখানে অন্যান্য আর পাঁচটা পণ্যের সঙ্গে শিল্পের তফাৎ ক্রমশই কমে এসেছে। সে যুগের হাওয়া, বড় বণিক বা সওদাগর, বানিয়া বা মার্চেন্ডাইস, কারবারি বা পাটোয়ারের মেজাজ মর্জি বিক্রী বাটোয়ারা লাভ বা লোকসানের উপর খুব করুণভাবে নির্ভর করছে শিল্পবস্তুর কদর ও বাজারের ধারণা। গ্রীক নাটকের বিলাপের মত টেনে টেনে বলতে ইচ্ছা করছে যে, যত সময় গড়িয়েছে ততই বেড়েছে এই নির্ভরতা। সে হয়ে উঠছে ভীষণ ধনবান কোনও আত্মীয়ের বাড়ি এসে বৈঠকখানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা অনাথ ব্যক্তির মতন। কখন ডাক পড়বে কখন দু’টো সাহায্যের কথা মুখ ফুটে বলা যাবে। নবারুণ ভট্টাচার্য যে সময় (নব্বইয়ের গোড়ায়) তাঁর লেখা প্রকাশের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করলেন, তখন এটা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে কেন আকাশ থেকে ফ্যাতাড়ু বর্ষণ করতে হয়েছিল তাঁকে!
‘সোনালী বাঘ-প্রেতের কথাঃ জীবনানন্দের তিনটি গল্প’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধের শেষে নবারুণ নাছোড় ভাবে দেখিয়েছেন এই স্বর্ণপ্রাধান্যের সভ্যতার প্রেক্ষিতেএকজন প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন কবির অসহায়তাকে। তাঁর সঙ্গে আড্ডা বসলেই সেখানে অনিবার্যভাবে হাজির হতেন ‘সাতটি তারার তিমিরের’ কবি। দেশপ্রিয় পার্কের সেই দুর্ঘটনা-বিন্দুটার কথা উঠত, যেখানে তর্কাতীতভাবে আধুনিক বাংলা কবিতার, সবচেয়ে অভিজাত অদৃশ্য কবরটি শোয়ানো রয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে নবারুণদা খুঁজে বের করবেন সেই জায়গাটি যেখানে ট্রাম এসে ধাক্কা মেরেছিল কবিকে। খুঁজে বের করবেন সেই মানুষটিকে, যিনি ট্রামের নিচ থেকে টেনে বের করেছিলেন জীবনানন্দকে। তাঁর মুখ থেকেই শোনা, সেই ব্যক্তি নাকি ছিলেন কাছের একটি রেস্তোঁরার মালিক এবং এক কুস্তিগিরও বটে! উক্ত প্রবন্ধটি নবারুনদা শেষ করেছেন এভাবে – “সেই অশুভ ট্রামে কি হেমেন, অবনীশ, রাখাল, ভবশঙ্কর – এরা বসেছিল? জীবনানন্দ কি অনুভব করেছিলেন যে স্বর্ণপ্রাধান্যের এই লোভী পৃথিবীতে স্বাভাবিক জনমানবের সূর্যালোক পৌঁছানো যাবে না। ধনতান্ত্রিক সুনিয়ম ও সুকৃতির উপরে সৎ সমাজের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে কি হবে না, তা খতিয়ে দেখবে পরবর্তী যুগ। কিন্তু এখন? সৌরকরময় কিছু নেই। তিমির বিনাশ অসম্ভব। অতএব শূকরের মতো মুখের ট্রামের দিকে ধাক্কা খেয়ে ফের এগিয়ে যাওয়া যায়।... আজ টাকা ও টাকাওয়ালাদের নির্লজ্জ রোয়াব দেখলে মনে হয় জীবনানন্দ কি মারাত্মক ভাবে সত্য হয়ে উঠে আমাদের শ্রদ্ধা করে নিচ্ছেন।...”
এক ঐতিহাসিক সমাপতনের মত ঠিক এই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আজ নবারুণ ভট্টাচার্যও কি তাঁর সমসাময়িক বা আগামী পাঠকদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা কেড়ে নিচ্ছেন/নেবেন না? তাঁর নিজের কথায়, “আমি লেখা ব্যাপারটা যেভাবে বুঝি সেটা নিছক আনন্দ দেওয়া বা নেওয়া নয়। আরও গভীর কোনও অ্যালকেমি যেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে।” এটা যে নিছক কথার কথা নয় তা তিন দশক ধরে দেখে যাচ্ছি আমরা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শোয়ার ঘর, শেয়ার ও ইন্সিওরেন্স-শোভিত আলমারি লকার সম্বলিত মধ্যবিত্ত, প্রচারের সাবানমাখা লিলিপুট কবিকূল, সুখী ও ধান্দাবাজ ফিলগুড শ্যাম্পু ঢেলে সিনেমার মা-মাসী করে দেওয়া পরিচালককূল, নিজেদের লিঙ্গ পর্যন্ত মর্টগেজ করে রাখা শিল্পীদের তোষকে ও বালিশে নবারুণ ভট্টাচার্য নামক তীক্ষ্ণ সামুরাইটি একটি একটি করে বিপদজনক ডিনামাইট স্টিক ঢুকিয়ে রেখে যাচ্ছেন। তাঁর উপন্যাসের নকশাল যুবক বিনুর মতই। এগুলিও সেই উন্নতমানের স্টিক যার মশলা অন্ত্যজ ঝাড়খাওয়া বঞ্চিত জীবন থেকে মেপে মেপে সংগ্রহ করা। যথেষ্টমাত্রায় শক গ্রহণে যা সক্ষম।
ব্যক্তিগত পরিচয়ের কোনও প্রয়োজন নেই, নবারুণ-সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের বর্ণপরিচয়টুকু রয়েছে তাঁরা মাত্রই এ কথা জেনে থাকবেন। সাহিত্যগতভাবে দু’জনের অবস্থান দু’রকম। কিন্তু এই শিল্পিত সন্ত্রাসের পথটি হয়তো জীবনানন্দ থেকেই ইনহেরিট করেছিলেন নবারুণ। বেশ কয়েকবছর আগে সাহিত্য অকাদেমিতে জীবনানন্দ সংক্রান্ত আলোচনাসভাতে যিনি বলেছিলেন, “যে জীবনানন্দকে আমরা গদ্যপদ্য মিলিয়ে পাই তাতে তো আমার মনে হয়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটা লড়াই শেষ হয়েছিল চল্লিশের দশকের শেষে, আর সামনে যে লড়াইটা আসছে সে লড়াইতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জীবনানন্দকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।” বাইরের ফ্যাসিবাদের পাশাপাশি এমন এক ফ্যাসিবাদের কথাও হয়তো সেদিন বলতে চেয়েছিলেন তিনি, যা কিনা শব্দের উদ্বৃত্ত অর্থটুকুরও টুঁটি চেপে ধরে। নবারুণ তো লিখতে চেয়েছেন শুধু নিজের যন্ত্রণাকে উন্মোচন করতে নয়। চেয়েছেন পুঁজির সর্বময় সর্বব্যাপী সর্বশক্তিমত্তার চাপে দমবন্ধ হয়ে যাওয়া যন্ত্রণাকেও। তাঁর উপন্যাস যা যাবতীয় লেখালেখি নিছকই একজায়গায় তাই স্থানু হয়ে থাকছে না, অবয়বগতভাবে আধুনিক ফর্মের ভিতরে থেকেও যা আসলে মার্জিনে নড়াচড়া করছে। তাঁর রচনার সিলেক্টিভ মিনিং-এর চারপাশে উদ্বৃত্ত অর্থের যে মণ্ডল তৈরী হচ্ছে সেটি লেখার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে সারপ্লাস মিনিং-এর মত। কিন্তু তিনি যখন তাঁর সময়ে বসে ‘রিডিং বিটুইন দ্য লাইন্সকে’ একটি কৃৎকৌশল হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছেন, তখন পুঁজিতান্ত্রিক নিওফ্যাসিজম কি করছে? সমস্ত সম্ভাবনা বা উদ্বৃত্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সে তখন অন্যান্য অর্থগুলিকে (একা নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রেই যে এটা ঘটছে না,সেটা তিনি নিজেও জানেন, এবং সেই জানাটাও তাঁকে পালটা ঝটকা দেওয়ার জোর এনে দিয়েছে বরাবর) অস্বীকার করছে। অন্য অর্থগুলির কণ্ঠরুদ্ধ করে একটি মাত্র অর্থের পাদপীঠে শিল্পকে বসাতে চাইছে, যে অর্থ তাদের পক্ষে সুবিধা ও স্বস্তিজনক। শাসনের আকার, বহিরঙ্গ বদলিয়েছে। আগে পাগলামিকে অন্ত্যজ ভাষা ও জীবনকে, যৌন বিষয়ে সর্বসমক্ষে আলোচনাকে বহিষ্কার করেছিল ক্ষমতা। এখন তাকে প্রতিষ্ঠানের পেটের ভিতরে নিয়ে আসা হচ্ছে কাউন্সিলিং ওষুধপত্র সাইকো-বটিকা দিয়ে। ব্যাপার হল প্রতিষ্ঠানের বাইরে কিছু থাকছে না। সমস্ত আনগ্রাউন্ডেড ডিসকোর্সকে সে গ্রাউন্ডেড করছে একটি থেকে অন্য সেমিনারের মাধ্যমে। পাঠ্যপুস্তক বানিয়ে। যা যা কিছু ক্ষমতার বাইরে ছিল তাকে সে ভিতরে নিয়ে আসছে। ক্ষমতার যেন কোনও বাহির না থাকে, হে প্রভু তার প্যান অপ্টিক্যান আলো যেন পড়ে সবার উপরেই! এই প্রসঙ্গে নবারুণদার বাছাই করা গালাগালিগুলো এখানে উল্লেখ করলাম না! শুধু এটুকুই বলার যে নবারুণ ভট্টাচার্য আগাগোড়া পুঁজির ক্ষমতার আলোর বাইরে গিয়ে কাজ করার হিম্মৎ দেখালেন এবং তা দেখালেন কি অপূর্ব শিল্পিত পথে। যুক্তি ও ফ্যান্টাসি, অর্থ এবং অর্থহীনতা, যুক্তি কাঠামোর ওপরে বা আউটসাইডে তাঁর লেখাকে নিয়ে গেলেন। আগেও বলেছি আবারও বলি, এবং বারবার চিৎকার করে বলব – এই আলো এবং আঁধারির মাঝখানে তাঁর কাজ নড়াচড়া করতে থাকবে যতদিন সাহিত্যের শ্বাস পড়বে এই গ্রহে। ক্ষমতার চেহারা বদলালেও এই বাক্য মধ্যবর্তী শূন্যতার ওঠা পড়া কমবে না। আমি নিশ্চিত, তার থেকে বিকীর্ণ হতেই থাকবে নতুন নতুন অর্থের ডাকিনী।
লেখকঃ সাংবাদিক। দিল্লীতে কর্মরত।
0 মন্তব্যসমূহ