১.
গোধূলির রাঙা আলোয় লোহার গ্রিলের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে আমিরন। মীরার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বিস্ময়। এক নাতিদীর্ঘ তিক্ত-কাহিনী। পরনে বেনারসি-জর্জেটের বদলে সাদা অরগান্ডি। কব্জি-ছোঁয়া আস্তিনের সাদা ব্লাউজ। খোঁপায় তুলে দেয়া ত্রিকোণ ঘোমটা, যার নিচের দুগাছি পিঙ্গল-বরণ চুল অসীম শূন্যে ডানা মেলা পাখি যেন। কি আশ্চর্য, পায়ে খুর-তোলা জুতো নেই, দু’ফিতার পাতলা চটি!
জাল-সাজিস বোধ করি একেই বলে – মরচে ধরা তালা খুলতে খুলতে এক ঝলক ভাবে মীরা। এর বেশি কিছু ভাবার আগেই দরজায় ফাঁক দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে আমিরন, পেছনে খাবারের ট্রে হাতে এক গাল হাসিসমেত তরুণী ঝি। মেয়েটা মীরার চেনা। নাম রূপবান, গেটের ভেতরের চেয়ে বাইরেই দেখা যায় বেশি। পাড়ার ষণ্ডা-গুণ্ডারা যেন ওর ইয়ারদোস্ত – খোলা রাস্তায় হাতাহাতি-পাছড়াপাছড়ি লেগেই থাকে। একদিন এক ছোড়ার আধপোড়া সিগারেট নিয়ে মস্তিসে ফুক ফুক টান দিতেও তাকে দেখেছে মীরা। শুভ্র-বসনা আমিরন তাহলে এ রূপবানের মালকিন!
‘ওমা, আমারে তুমি চিনতে পারো নাই! আমি তো তোমারে পয়লা দিনই দোতালা থেকে দেইখ্যা চিনছি।’ চেয়ারে পা ক্রশ করে বসে পান-খাওয়া দাঁতে হাসে আমিরন।
পয়লা দিন মানে মাস খানেক আগে, যেদিন মীরা ইঁট-বিছানো প্যাসেজ দিয়ে সুটকেস টানতে টানতে এ বাড়ির পেছন দিককার এক কামরার আবাসে ওঠে! এখনো ঘরে আসবাব বলতে একখানা কাঠের চেয়ার। মেঝেতে তোষকহীন জাজিম। পানির গেলাশও একখান। হাতের ট্রে মাটিতে নামিয়ে সেটি ঘরের কোণের সিংক থেকে তুলে ঢগঢগ করে পানি খায় রূপবান। কোনো পরোয়াই করে না। মালকিনেরও ভাবে-সাবে মনে হয়, এতে আপত্তি করার কিছু নেই। ঘরে-বাইরে অপার স্বাধীনতাই ভোগ করে রূপবান। সেই ঘরটা যারই হোক বা বাইরে যেই থাকুক। তখনো মেঝেতে শালু কাপড়ে ঢাকা ট্রে যেন পীরের মকবরা, কেমন উঁচু আর টানটান, লোবানের গন্ধ জড়ানো। চেয়ারে বসেই আমিরন উবু হয়ে শালু কাপড়ের ঢাকনা সরায়। তসতরি বোঝাই এক কাঁড়ি নিমকি, এর ওপর দুইখান জিলিপি বিড়া পাকিয়ে সসম্ভ্রমে বসে আছে। তবারুকের বাক্স ঝেড়ে-পুছে ভাড়াটেদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা হচ্ছে খুব সম্ভব।
আমিরন চাকরানি নিয়ে বেরিয়ে গেলে বিছানার এক কোনায় ঠায় বসে থাকে মীরা। সামনে নিমকির পাহাড়, ওপরে চিনির শিরায় জবজবে মহামান্য জিলিপিদ্বয়। আমিরনের শ্বশুরের চল্লিশার তবারুক। সকালে মীরার নাকের ডগায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে আঙ্গিনায় শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। বাদ আসর মাইকে টানা মিলাদ-মহফিল। মুসল্লিরা হাঁকডাক ছেড়ে বেরিয়ে যেতে, বলা নেই কওয়া নেই আমিরন খাবার ট্রে হাতে চাকরানি নিয়ে হাজির। আজ ঘুম ভেঙে কার মুখ দেখেছিল মীরা? এক যুগ পরও কি কারও মনে অসূয়া থাকে! না থাকা সমীচীন!
২.
তখন সত্তর দশক শেষে আশি ছুঁই ছুঁই। এক যুগ আগের স্মৃতির খেরোখাতা খুলে বসে মীরা। হলের ঘাসছাটা লনে খুঁটি গেড়ে বাল্ব জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। প্রথম বর্ষে টানা চলেছে ইংরেজি টিভি সিরিয়াল ডালাস, তখনকার একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভিতে। ইংরেজি বোল-চাল রপ্ত করায় এসব লম্বা সিরিয়াল দেখার নাকি জুড়ি নেই – আমরা এ বিশ্বাসে বুঁদ হয়ে কমনরুমের সোফায় ঠাসাঠাসি বসে থাকতাম। টিএসসিতে চলছে কবিতা-আবৃতি, নাটক, বিতর্কের রিহার্সেল। হল-অডিটোরিয়ামের বাদুড়-চামচিকা-আড়শোলা ঝেটিয়ে উঁচু দেয়াল, কড়িকাঠ, জরাজীর্ণ গদির আসন সব দফায় দফায় হোসপাইপে জল ছিটিয়ে সাফ করা হলো। আঙ্গিনাজুড়ে ঝাঁক ঝাঁক বাস্তুহারা কবুতর। এদের ঝরা পাখনা, ন্যাদা পরিষ্কার করো। শাহবাগ পুলিশ ফাঁড়ির ছাড়পত্রও চাই, তা আবাসিকদের ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও। যেখানে বাধা সেইখানেই ভাঙার প্রবণতা – গানে-কবিতায়। অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সে এক স্বর্ণযুগ। আমিরন তখন ম্যাদম্যাদা গন্ধযুক্ত ইঁটচাপা হলদেটে ঘাস যেন, লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল। এরপর ভাসে যখন তিমিমাছের মতো তোলপাড় করে…
তখন জলপাইরঙা পোশাকের তল থেকে সবে ছাত্ররাজনীতির বাচ্চা ফুটেছে। জারুল-কৃষ্ণচূড়ার ছায়াতল প্রকল্পিত করে হলের সামনে মোটর বাইকের আনাগোনা। আরোহীরা আমাদেরই সহপাঠি। ক্লাশ-টিউটোরিয়ালের বালাই নেই। সরকারি ছাত্রদলের খাতায় নাম লিখিয়ে রাতারাতি নেতা বনে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে তাদের প্রেমিকাও জুটে গেল – ভুনা পাঙ্গাস মাছের কোলের টুকরা কি ইসলামপুর আড়তের চটকদার কাটপিসের বিনিময়ে। সকাল-বিকাল হোন্ডার ব্যাক-সিটে চড়ে দাবড়ে বেড়ানোটা ছিল উপরি পাওনা। আর মেডিকেলের ক্যান্টিনে যেদিন ভরপেট খেয়ে মৌরি চিবাতে চিবাতে হলে ফিরতো, সেদিন যেন একেকজন মহারানি, দেমাকে মাটিতে পা পড়তো না।
এদের ওপর টেক্কা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে নামে আমিরন। অনেকদিনের ইঁট-চাপা ঘাস। সঙ্গে নেত্রী গোছের একটি সিনিয়র মেয়ে। সাক্ষাৎ গন্ধগোকুল। চোখ দুটিও কুতকুতে। কোথাও পাত না পেয়ে নতুন দলে শামিল হয়েছে। এক সন্ধ্যায় আমি ওদের গেটের লাগোয়া মেঘশিরিষের গুঁড়ি ধরে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। দুই জোড়া চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল। বাত্তির অভাবে চড়া সাজ-গোজ যদিও নজরে পড়েনি, পারফিউমের তীব্র ঘ্রাণ নাকে লাগতে ঘুরে তাকালাম। অনেকগুলি জোনাকপোকা যেন হল্লা করে জ্বলে উঠলো। হয়তো বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছে, তাই জরি-চুমকির এমন বাহারি পোশাক। তবে আরেকজনের লেবাস কঙ্কণদাসীর কেন? হপ্তা না গড়াতেই সারা হল চাউর হয়ে গেল – আমিরন এক বৃদ্ধ মন্ত্রীর রক্ষিতা। একদিন অন্তর অন্তর মন্ত্রীগমনে যায়। একটা কয়লা-রঙা টয়োটা ওর বাহন। আর দীঘল দেহী নেত্রীর কি হাল! রাত এগারোটা বাজুক বারোটা বাজুক আমিরন যতোক্ষণ বাইরে, বন্ধ-গেট থেকে তার চোখ সরে না। চটাস চটাস মশা মারে হলের অফিসঘরের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে। টাকা দিয়ে আগেভাগেই দারোয়ানদের হাত করা হয়ে গেছে। তবু মা-মাসীর মতোই ওর বিড়ম্বনা।
তখনো দুজনের আলাদা আলাদা রুম। রাতদুপুরে বিশেষ ব্যবস্থায় গেট খুলে গেলে আমিরনকে টানতে টানতে নেত্রী ছোটে হলের আরেক প্রান্তের অডিটোরিয়ামের দিকে। বাগান বিলাস ঝাঁপিয়ে নেমে জায়গাটা দিনদুপুরেও স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। বিশেষ পালাপারবনে এর কারুকাজময় কাঠের আগল খোলা হতো। সিঁড়িটাও বিনাযত্নে আস্তর-খসা, শ্যাওলা-পড়া। তাতে পেপার বিছিয়ে দুজন বাবু হয়ে বসে বন্ধ দুয়ারে পিঠ দিয়ে। আমিরনের হাতের খাবারের পার্সেলের প্লাস্টিকের গেরো খুলতেই নেত্রীর চোখ ছানাবড়া। একেক দিন একেক পদ। সে এক এলাহি কাণ্ড! গন্ধ শুঁকে শুঁকে হলের কুকুরগুলিও দৌড়ে চলে আসে। লম্বা জিব ঝুলিয়ে বসে বসে লেজ দোলায়। এতে নেত্রীর চেয়ে আমিরনই নাখোশ হয় বেশি। হয়তো মন্ত্রীর সকাশে ছুরি-কাঁটার অত্যাচারে ওর পেট ভরতো না। তা না হলে উচ্ছিষ্টের পার্সেল লয়ে রাত দুপুরে দুজন মানুষের কাড়াকাড়ি, আর কুকুরগুলিও এমন পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়! হাউজ টিউটর রুমে নালিশ গেল নাইটগার্ডের তরফ থেকে। মেট্রন আপাও ঘটনার পূরবাপর বয়ান করে জোরালো সাক্ষ্য দিলেন। আলামত বলতে পাছার নিচে থ্যাঁতলানো পূরবাণীর প্যাস্ট্রি, যা কাড়াকাড়ির সময় মোড়কশুদ্ধ পড়ে যায়। তবে এসব হ্যাপা সামলানোর জন্য নেত্রী একাই একশো। আর বাইরে আছে হোন্ডাঅলা গুণ্ডার দল। হাউজ টিউটরের কোয়ার্টারের জানালার শার্সিতে ঢিল পড়তে সব ধামাচাপা পড়ে গেল। আমিরন যেন তেলতেলা কচুপাতা, এক ফোঁটা পানির ভারও বইতে হলো না।
দ্বিতীয় বর্ষের মেয়ের এমন ধাষ্টামি অবিশ্বাস্য। সব চেয়ে অবিশ্বাস্য – মেট্রন আপা ফিসফিসিয়ে বলতেন, বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে সহবাস, তা-ও নাম ভাঁড়িয়ে। (সাক্ষ্য দেওয়ার পর চাকরি হারানোর ভয়ে তিনি সর্বদা কাঁটা হয়ে থাকতেন।) আমরা শুধু জানতাম ঘাসের কার্পেট মোড়া রমনাপার্কের ওপাশের নিবিড় বীথিপথটা মিন্টুরোড, যার ধারে ধারে মন্ত্রীদের রাজসিক আবাস। ঢাকার আশপাশে বাগানবাড়ি, প্রমোদভবন নিদেন কটেজ-টটেজ আছে কিনা জানা ছিল না। জাতীয় উদ্যানের গহিনে থাকলেও থাকতে পারে। কিংবা কোনাবাড়ি বা চন্দ্রায়। তখনো ঢাকাশহর মাথা ঠেলে নতুন এয়ারপোর্ট ছাড়ায় নাই। উত্তরায় হয়তো বিল্ডিং উঠছে ক্ষেতখামারের জায়গা ছেড়ে ছেড়ে। আমাদের দৌড় নীলক্ষেত, পলাশির কাঁচাবাজার বা নিউমার্কেটের ডিম্বাকৃতির চাঁতাল পরয্যন্ত। রোকেয়া হলের ফুটপাত ধরে এগিয়ে ভিসির বাংলো, এরপর ব্রিটিশ কাউন্সিল ডানে রেখে আমাদের হলের সামনে এসে মনে হতো পৃথিবীটা সত্যিই গোল। আর পথের মধ্যের লাল ইটের বাড়িটা কোনো এক হতভাগ্য জমিদারের পরিত্যক্ত মহল। (এ বাড়ি নিয়ে সেসময় অজস্র কিংবদন্তি চালু ছিল।) এর বাইরে যে অদেখা বিশাল জগত, তা আমাদেরই বয়সী কাতান-বেনারসি-জড়োয়ায় আচ্ছন্ন সুদূরতমার একচেটেয়া।
প্রেম বয়সেরই ধর্ম, সে অনেকেই করে। রুমে রুমে হিটারের লাইন কাটতে এসে মেট্রন আপা নিচু স্বরে আলাপ জুড়ে দিতেন। হাতে টুলবক্স, চোখ কপালে – তা বলে এমন বেলেল্লাপনা! এমন যৌনগন্ধময় জাঁকালো শরীরী উপস্থিতি কজনার? (চিরকুমারী মেট্রন আপা হাতকাটা ব্লাউজের বগলে টেলকম পাউডার মাখতেন পুরো করে। কাঁচা-পাকা চুলে জবাকুসুম।) আমাদেরও চোখ ফোটে। বইয়ের একঘেয়ে বর্ণমালা থেকে নজর সরিয়ে দেখি, আমিরনের ঝরা-বাঁশপাতা-বর্ণের ত্বকে লালিমা লেগেছে। দেহের অন্ধি-সন্ধিতে অযথা মাংসের ভার, যা অসংস্কৃত, মোটা দাগের। সেটি আড়াল করার ভব্যতাটুকুও নেই। বিশেষত অভিসারের দিনে। সেদিন ক্লাশ-লাইব্রেরি-ডাইনিংয়েও সে গরহাজির। নেত্রীর সিঙ্গল রুমে উঠে আসার পর সকাল সকাল মাথায় ডিম ভেঙে ব্যালকনির রোদে বসে থাকতো। বেলা গড়ালেই হাতে-মুখে কাঁচা হলুদের গাঢ় প্রলেপ। সেই অবস্থায় বারান্দার লতানো গাছের টবে পানি দিচ্ছে। বা লাল পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের মেঝেটা সাফ করছে ব্রাশ দিয়ে ডলে ডলে। শান্ত আবার বন্য। সন্ধ্যা লাগলেই উগ্র সাজ। লো-কাটের গলার ব্লাউজ, নিচে স্টেডিয়াম মার্কেটের বুলেট ব্রা, আঁচল উড়িয়ে হিল খটখটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সবার নাকের ডগা দিয়ে।
তবে এ তেজি ঘোটকীর আড়ালে যে একটি সদা শঙ্কিত টিকটিকি বাস করে, তা বোঝা গেল একদিন।
সেদিন আমরা লনের ছাটা ঘাসে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। কয়লারঙা টয়োটা নোঙর করে আছে গেটের বাইরে মেঘ শিরিষের নিচে। পেন্সিল হিলের ঝড় তুলে খোলা চত্বরটা ত্বরিত পেরিয়ে যাচ্ছিল আমিরন। নেত্রী ছুটছে পেছন পেছন। সেদিন আমিরনের পরনে ছিল মেরুন বেনারসি। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে শাড়ির ফলের নিচ দিয়ে বিঘত খানেক সবুজ পেটিকোট বেরিয়ে পড়ে। মেরুন শাড়িতে সবুজ পেটিকোট! এ যেন বৃদ্ধ মন্ত্রীগমনের চেয়েও বিসদৃশ। কোমরে পাশের জনের গোত্তা খেয়ে আমি মুখে আঙুল পুরে প্রাণপণে আওয়াজ দিই। সঙ্গে সঙ্গে কাটা কলাগাছের মতো দড়াম করে মাটিতে পড়ে আমিরন। ওমা এ দি ফুলের ঘায়ে মুর্ছা গেল! হয়তো হাঁটার স্পিড বেশি থাকায় শিসের ধাক্কা সামলাতে পারে নাই। পেন্সিল হিল থেকে পড়ে গেছে। আমার শিস বাজানোটা পূরবপরিকল্পিত ছিল না। কিন্তু নেত্রীর সে কি চোখ রাঙানি আর চোটপাট! ‘অ মাগিরা, হোন্ডাঅলারা যখন গেটের মুখ থেইক্কা জনে জনে তুইল্যা নিবো, কোন বাপ তোগরে বাঁচায় – দেখুম নে!’ আমরা টু শব্দটি করি না। কথা বাড়ালেই বাড়ে। তাছাড়া এ শহরে আমাদের বাপ তো দূরের কথা ভাইবেরাদরও নাই। ভয়ে ঘাসের সঙ্গে পোকার মতো সেঁটে থাকি। ভাবখানা এমন, কার না কার সঙ্গে নেত্রীর বচসা চলছে, আমরা এর মাথামুণ্ড জানি না। এর মধ্যে আমিরন নেত্রীর গলা ধরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে গিয়ে বসে গাড়িতে।
ম্যাডামের পায়ে চোট খাওয়ায় জরুরিভিত্তিতে মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক ডাকা হয়েছিল কিনা জানি না, গেটের সামনে হোন্ডার টহলদারি বেড়ে গেল। চেনা ছেলেগুলোর সঙ্গে বেশ কটা খুনি খুনি চেহারার অপরিচিত মুখ। কপালে লাল ফেটি, পরনে হাঁটুর কাছে রোঁয়া-ওঠা জিন্স। এরা একেক শিফটে পালা করে আসে। টংঘর থেকে পয়সা না দিয়ে চা খায়, প্লেট প্লেট ফুচকা সাবাড় করে চলে যায়। আরেকদল আসে। সেদিনের ঘাসে বসা আমরা চারজনই সন্দেহের তালিকায়। তিনতলার ব্যালকনি থেকে হোন্ডাঅলাদের ওপর নজর রাখি। তা-ও পালা করে। ক্লাশে যাওয়া চাঙ্গে উঠেছে। জ্বরজারি হলেও ডাক্তারখানায় যাই না। পুরোদমে বিবরবাসী। হপ্তাখানেক এ নিয়ে রোমাঞ্চ হলেও পরে তিতা লাগতে শুরু করে। সবাই আমায় দুষছে। যেন কোমরে গোত্তা মারাটা কোনো ইন্ধন ছিল না। মনে খুব দুঃখ হচ্ছিল – সব জন্তুই মোট বয় ধরা পড়ে গাধা…। একা একা হলের মধ্যে ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াই। মুখে খাবার রোচে না। পড়ালেখা তো আগেই গোল্লায় গেছে।
আমাদের মধ্যে সবচেয়ে একরোখা মেয়েটি একদিন কাঁধে ব্যাগ ফেলে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমরা তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছি – সে হলের কোনার ছোট্ট আইল্যান্ডটাও ছাড়াতে পারে নাই, মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরেছে হোন্ডাগুলি। একজন ব্যাগ ধরে টানে তো আরেকজন হাতে ওড়না প্যাঁচায়। (তখনো ভারতীয় সরকারি চ্যানেল দূরদর্শনে মহাভারত সিরিয়াল শুরু হতে কয়েক বছর বাকি। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ তো আরো পরের কথা।) ওদিকে ভিড় জমে গেছে। আমিরন তখন ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে উল্টা দিকের ফুটপাত দিয়ে আসছিল। সে-ই আমার নাম প্রকাশ্যে বলে মেয়েটিকে বাঁচায়। আন্দাজেই হয়তো বলেছে, কিন্তু দুনিয়াটা তখন আমার একার জন্যই বৈরি। আমিরনের বাবা-মাকে উড়া চিঠি লেখার জন্য যিনি সরবক্ষণ তাতাতেন, সেই মেট্রন আপাও আমায় না চেনার ভান করেন। একদিন রুমে ঢুকে বেদম বকাঝকা করে গেলেন, যদিও আমাদের রান্নার হিটার ছিল না। সবকিছু অসার মনে হলো। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে যখন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি, তখন মন্ত্রীমশাই অক্কা পেলেন। আপনা হতে অবরোধ উঠে গেল। ফের আমাদের দরজায় জবাকুসুম আর তোষামোদি হাসি। ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়, আমি একঘেয়ে বর্ণমালা থেকে আর মুখ তুলি না। পরে শুনেছি, মন্ত্রীর দাফন-কাফনের পরদিনই পুরান কাপড়চোপড়ের ট্রাঙ্কটা বারান্দায় আছাড় মেরে ফেলে আমিরনকে রুম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নেত্রী। পুনর্মূষিক বারান্দার থামে কপাল ঠেকিয়ে কেঁদেছে ফুলে ফুলে। দামী শাড়ি-গহনা সব বেহাত হয়ে গেছে। হাতে শুধু ঢাকা ডায়িংয়ের আকাশি নীল বেডকাভার, যা অশ্রু-শিকনিতে মাখামাখি। কি এক রহস্যজনক কারণে আগের ফোর সিটের রুমেও আমিরনের ফেরা হলো না। হোস্টেলই ছাড়তে হলো শেষমেশ। তখনো সেকেন্ড ইয়ার পেরোয়নি। আমরা বছর শেষে লাস্ট সেমিস্টারের জন্য তৈরি হচ্ছি।
৩.
বহুদিন আমিরনের খেদ ছিল পাকেচক্রে পড়ে ওর পড়াশোনাটা আর হলো না। দুই বছরের মাথায় কোনো সনদপত্র ছাড়াই টিনের চালের বেড়ার ঘরে ফিরতে হয়েছিল। বিখ্যাত লোকের সঙ্গে ওঠবোস করার বিড়ম্বনা অনেক। কোনো কিছুই গোপন থাকে না। মফস্বল শহরেও এ নিয়ে বিস্তর কানাঘুষা। দিনের বিক্রিবাটার হিসেব মিলিয়ে আব্বা যখন ফুটপাতের বেসাতি গুটিয়ে কাপড়ের গাঁটরি লয়ে বাসায় ফিরতেন, তখন তার চোখ থেকে অপমানের জ্বালা আগুন হয়ে ঠিকরে বেরোতো। মা না আগলালে তখন-তখন আমিরনের তাতে ভস্ম হয়ে যাওয়ার কথা। রোজ রাতে ছোট দুটি ভাই পাল্লা দিয়ে বিছানা ভিজায়। সেসব টুটাফাটা কাঁথার স্তূপে এক রকম গা-ঢাকা দিয়েই সে থাকতো রাত থেকে সকাল দশটায় আব্বার বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। দমকে-দমকে ছেঁড়া কাঁথা থেকে উঠে আসা পেশাবের গন্ধেও ওর ঘোর ভাঙতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ছয়মাস অনিঃশেষ স্বপ্নের মতো। বৃদ্ধ লোক এমন চটকদার হয়! গায়ে চড়া-রঙের ফুলেল শার্ট। আঙুল বোঝাই রুবি, পান্না, টোপাজের দামী দামী সব পাথরের আংটি। ঠোঁটে পানিরঙা লিপগ্লস। রোজ ডাবের জলে মুখ ধুয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে অফিস করতে যেতেন। দুপুরে শসা-আপেলের লাঞ্চ, খোসা ছাড়িয়ে সালাদের মতো চাক চাক কাটা। এমন লোকের ফোলা গালে লালিমা ঠিকরাবে না তো কি। তবে সূরয্য ডোবার পর যেন অন্য মানুষ, খানাপিনায় কোনো লাগাম ছিল না। খানার চেয়ে পিনাই আসল। দেয়ালে লেপ্টে থাকা সাদাটে কাঁকলাসের রাঙা মুলো হয়ে যাওয়ার মতো দ্রুত পাল্টে যেতেন। মাঝরাত অব্দি হোটেল-স্যুটের স্প্রিংয়ের গদিতে হুলো বিড়ালের ইঁদুর লয়ে জাপটা-জাপটি। ফাঁকে-ফাঁকে ঘড়ি দেখা। সব শেষে জ্বলন্ত সিগারেট আঙুলে চেপে যখন হাত নেড়ে গাড়িতে উঠতেন তখন আরেক মানুষ। স্ত্রী-সন্তান অন্তপ্রাণ গোবেচারা লোকটি যেন তড়িঘড়ি বাসায় ফিরছেন। যদিও ঘড়ির কাঁটা তখন জোড়হাতের ভঙ্গিতে বারোটার ঘরে।
পয়লা দর্শনে মন্ত্রী চাচার গলায় সিরাজগঞ্জের হালকা টানই শুধু আমিরনের আপন মনে হয়েছিল। সে তসতরি থেকে এক ফালি শসা কাঁটা চামচে গেঁথে নেয়, একবার সাধা মাত্র। এলাকার চেয়ারম্যান তখন সামনে।
লোকটা অসম্ভব ধুরন্ধর। সবসময় বিড়ালের মতো ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বেড়ায়। ওদিকে এলাকার লোক হলেও যথার্থ ভেট ছাড়া মন্ত্রীদের দুয়ারে পৌঁছানো যায় না। ঢাকায় পা দিয়েই তিনি সোজা চলে এসেছিলেন পাড়াতুতো ভাগ্নি আমিরনের হলের গেটে। ফুটপাতের বেপারি বাপ যে টাকা পাঠায়, তা দিয়ে মেয়েটার মাসের অর্ধেকও চলে না। বিদেশ-বিভুঁইয়ে ধারই বা কে দেয়। একটা খণ্ডকালীন চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার কথা, গেল বার আমিরনের মা পই পই করে বলে দিয়েছিল। পেটে ভাত না জুটলেও মহিলার মুখে বড় দড়। ‘তোমার দল পাওয়ারে আছে, ভাগ্নিরে একটা চাকরি দিতে পারো না, কেমন চেয়ারম্যান অইছো তুমি? পরের বার ভোট চাইতে আসো – দেখবো আনে।’ সেই চাকরির নাম শুনে আমিরনও নেচে উঠলো। পরদিন ট্যাক্সি করে মামা-ভাগ্নি সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছে। আমিরনের পরনে টাঙ্গাইল শাড়িকুটির থেকে মামার কেনা তুঁত রঙের তাঁতের শাড়ি। কপালে লাল টিপ। দুই হাতে শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা ডজন খানেক কাচের চুড়ি।
সেদিন আপেল-শসা খাওয়ার এক ফাঁকে মন্ত্রী চাচা তার হাতটা আলতো করে নিজের হাতে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। পুরুষের স্পর্শ সেই প্রথম। যদিও তিনি চুড়ির রঙ তারিফ করেই হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবু আমিরনের কাঁপুনি থামেনি। এতো কোমল হয় মানুষের হাত! সেদিন চাকরি নিয়ে কোনো কথা হলো না। যা কিছু বাতচিত চেয়ারম্যান-মন্ত্রীতে। দুজনেরই বাড়ি কাছাকাছি, যমুনার এপার-ওপার – কথাও তাই ফুরাচ্ছিল না। উঠে আসার সময় ভিজিটিং কার্ডটা শুধু আমিরনের দিকে তিনি আলতো করে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
হলের কয়েনবক্স ফোনে প্রচুর আধুলি খরচা করার পর টায়ে টায়ে দশ দিনের মাথায় আমিরনের ডাক পড়ে। এবার আর সচিবালয় নয়, ঢাকা ক্লাব। চেয়ারম্যান মামাই বেবি ট্যাক্সিতে গাড়ি বারান্দা অব্দি পৌঁছে দেন। ঢোকার মুখে দরজা আগলে রাখা পাগড়িধারী দারোয়ান। ওখানে আমিরনের এক দণ্ডও দাঁড়াতে হলো না। সিঁড়ির এক ধাপ নেমে মন্ত্রী চাচা থাবা বাড়িয়ে ওর হাত ধরলেন। স্পর্শে এবার কোমলতা নেই। শক্তিমত্তা জাহিরের সচেষ্টতা ছিল। মাথার ওপর উঁচু সিলিং, নিচে পুরু কার্পেট। এ কেমন জায়গা! হিল পায়ে সে বারকয় হোঁচট খায়। দেয়ালে-দেয়ালে ভদ্রলোকদের পরিচ্ছন্ন ছবি। অথচ নিচের টেবিল-ঘিরে বা সোফা সেটে সব বুড়ো বাজ, তাকে চোখ দিয়ে আঁচড়ে-কামড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। তাতেই যেন তার চেতন ফিরে, সে শক্ত থাবায় হাত সঁপে তরতরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে যায়। এ ঊর্ধে ওঠার যেন শেষ ছিল না। ক্লাব থেকে হোটেল, ঘন্টা খানেকের ড্রাইভে গজারি-শাল-শাল্মলির ধারের বাগানবাড়ি। কল্পনার অগম্য তুলতুলে নরম বিছানা, যথোচ্ছ আদর-সোহাগ, সুস্বাদু খাবার, হরেক পদের পানীয় – মাটির পৃথিবীতে বেহেশত নেমে আসে। বা পৃথিবীটাই লাফ দিয়ে উঠে যায় আসমানে। ফেরাউন-এর মতো পালঙ্কের পায়ায় ক্ষুধার্ত শকুন আর মাংসের পুটলি বেঁধে তাকে সাত আসমানে উড়তে হয়নি, এমনিই আমিরন ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ছাত্রনেতারা দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতো। হলের নেত্রী তো নোকরানিই বনে গেলেন। মাত্র ছয় মাসেই এত্তো সব।
বুকের তলায় পেসমেকারের বদৌলতেই যে ঘড়ির কাঁটার মতো হৃৎপিণ্ডটা টিক টিক করছে, আমিরন তা পরে পরে শুনলেও, চাচা কখনো বুঝতে দেন নাই। তার চোখের কোলের পানির পুটলি দুটি ক্রমে ভারী হচ্ছিল। দিনদুপুরে চোখের পাতা টেনে আসতো ঘুমে। সরু করে তাকাতেন যখন আঁখি দুটি প্রায় বন্ধই হয়ে যেতো। অল্পতেই হাঁপাতে শুরু করতেন। তবে শেষ দিন পরয্যন্ত, যেন বিশাল জনসভার মঞ্চে উঠছেন, তার মুখের হাসিটা ছিল দিলখোলা, অমলিন। বুকে হাত চেপে নির্দিষ্ট সময়ের ঘন্টা খানেক আগে যখন গাড়িতে উঠে বসলেন, তখনো। এই শেষ দেখা। পরদিনের পতাকা মোড়া কাঠের কফিনটা যে কারোরই হতে পারতো। রাষ্ট্রীয় মরয্যাদায় দাফনের আগে বিউগল বেজে ওঠে, সঙ্গে সৈন্যদের বুট ঠোকাঠুকি আর সগর্জন কুচকাওয়াজ।
সেই ছয় মাসে আমিরনদের ঘরের বেড়ায় ঠেস দিয়ে সাইকেল দাঁড় করিয়ে পোস্টাফিসের লোক সবশুদ্ধ তিন বার হাঁক দিয়েছে। তখন বাড়িতে চিঠি লেখার মতো সুসংহত মনের অবস্থা আমিরনের ছিল না। মা নিরবিকার মুখে সই করে টাকা নিতেন। কাঁচা টাকা ঘরে রাখা ঠিক নয়। আব্বাকে জানালেও বিপদ। দুপুর-দুপুর বোরকা পরে স্যাঁকরার দোকানে গিয়ে সাত তাড়াতাড়ি গড়িয়ে নিলেন হাতের বাউটি, গলার নেকলেস, কানের ঝুমকা। দেশশুদ্ধ যখন ঢি ঢি পড়ে গেছে, মেয়ে বিয়ে দেয়ার হাউস উনিই কেবল ছাড়তে পারেন নাই।
তার ইচ্ছারই জয় হলো।
বছর ঘুরে গেছে। প্রাইভেটে বিএ দেওয়ার জন্য আমিরন যখন তৈরি হচ্ছে, তখনই ঘটনাটা ঘটে।
মূলিবাঁশের পার্টিশন দেয়া ছোট ছোট তিন কামরায় দুই থেকে বাইশ বছর বয়সী ছয় সন্তান নিয়ে আব্বা-আম্মার সংসার। বাড়িতে কোনো গোসলখানা ছিল না। বাসার পেছনে ডিসির বাংলোর উদলা পুকুরে সন্ধ্যার আগ দিয়ে মা গোসল করে ভিজা কাপড়ে বাড়ি ফিরতেন। আব্রু বলতে কাঁচা ঘাটের ওপর নুয়ে পড়া ডুমুর গাছ। এ থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ে আমিরনদের সব ভাইবোন সাঁতার কাটা শিখেছে। বড় হওয়ার পর থেকে আমিরন উঠানে তক্তা বিছিয়ে তোলা-জলেই কাক স্নান করতো। তখন বিএ পরীক্ষার তোড়জোড়। মা ছাপরা ঘরে চেলাকাঠের আঁটি খুলছিলেন, খানিকবাদে রাতের রান্না চড়াবেন। আমিরন হাত-মুখ ধোওয়ার কথা বলে চলে আসে পুকুরঘাটে। পানিটা এখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ। টোপা টোপা ফলের ডুমুর গাছটা আগের মতোই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আছে। সে-ই শুধু বন্দিনী রাজকুমারী। রাজকুমারী না দাসী। এতো বড় মেয়ের এক বালতি পানিতে গোসল হয়! শরীর ভরে গেছে একজিমায়। রাতভর চুলকায়। সে এক ঝটকায় শাড়িটা খুলে, পাড় থেকেই লাফিয়ে পড়ে পানিতে। এভাবে পর পর দুদিন।
শেষ দিনে তা অপর পাড় থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ডিসির মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী শ্যালক। অন্ধকার গাঢ় হতে সে মাধবীলতার ঝাড় ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সন্তর্পণে ঝোপ-জাংলার পাড় ধরে এগোয়। এসব স্থানে সাপ-খোপ থাকা বিচিত্র নয়। চোরা-গর্তও থাকতে পারে লতাপাতার আড়ালে-আবডালে। তবে সহিসালামতে ঠিকই সে জায়গামতো পৌঁছে যায়। আমিরন পুকুরে থাকতেই ওদের বাইরের দরজায় কড়া নাড়ে। তখন ছোট ছোট ভাইবোনেরা কেরোসিনের লম্প জ্বেলে নাকি সুরে ক্লাশের পড়া মুখস্থ করছিল। আব্বার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত। আম্মাই মাথায় হেঁটো শাড়ির আঁচল টানতে টানতে এগিয়ে গেলেন। সরাসরি বিয়ের পয়গাম, তাও আত্মীয়-কুটুমের তরফ থেকে নয়, ছেলের মুখ থেকে! তিনি মোটেও ঘাবড়ালেন না। যেন জানাই ছিল – তার রূপবতী কন্যা আইবুড়ো থাকার জন্য জন্মায় নাই। চাঁদের গায়েও কলঙ্ক থাকে। তিনি ছেলের জ্ঞাতি-গোষ্টির খবর নেয়ার ফাঁকে তক্তপোষ থেকে তেলচিটচিট বালিশ দুটি গায়েব করে দিলেন। এর আগে মলাটহীন, পাতা-ছেঁড়া বইখাতাসহ পুত্র-কন্যাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এদের কোনোটাই ডিসির শ্যালকের সামনে দাঁড়ানোর মতো না। আমিরনই গোবরে পদ্মফুল। সে তখন উঠানে দাঁড়িয়ে গামছায় চুল ঝাড়ছে। বিশ্বজয়ের বার্তা তখনো ওর কানে পৌঁছায় নাই। তবে বাড়িতে অসম্ভব কিছু ঘটছে। বলক ওঠা ভাত নামিয়ে চুলায় চা বসিয়েছে পিঠাপিঠি বোন আমিনা। শালপাতার ঠোঙায় মোড়ের দোকানের গরম ডালপুরী। একটা তসতরিতে গোটা চারেক ওভালটিন বিস্কুট। আরেকটায় খোসা ছাড়ানো আস্ত কমলা। ছোট ভাই-বোনগুলি অদূরে ঘুর ঘুর করছিল।
শেষ দিনে তা অপর পাড় থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ডিসির মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী শ্যালক। অন্ধকার গাঢ় হতে সে মাধবীলতার ঝাড় ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সন্তর্পণে ঝোপ-জাংলার পাড় ধরে এগোয়। এসব স্থানে সাপ-খোপ থাকা বিচিত্র নয়। চোরা-গর্তও থাকতে পারে লতাপাতার আড়ালে-আবডালে। তবে সহিসালামতে ঠিকই সে জায়গামতো পৌঁছে যায়। আমিরন পুকুরে থাকতেই ওদের বাইরের দরজায় কড়া নাড়ে। তখন ছোট ছোট ভাইবোনেরা কেরোসিনের লম্প জ্বেলে নাকি সুরে ক্লাশের পড়া মুখস্থ করছিল। আব্বার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত। আম্মাই মাথায় হেঁটো শাড়ির আঁচল টানতে টানতে এগিয়ে গেলেন। সরাসরি বিয়ের পয়গাম, তাও আত্মীয়-কুটুমের তরফ থেকে নয়, ছেলের মুখ থেকে! তিনি মোটেও ঘাবড়ালেন না। যেন জানাই ছিল – তার রূপবতী কন্যা আইবুড়ো থাকার জন্য জন্মায় নাই। চাঁদের গায়েও কলঙ্ক থাকে। তিনি ছেলের জ্ঞাতি-গোষ্টির খবর নেয়ার ফাঁকে তক্তপোষ থেকে তেলচিটচিট বালিশ দুটি গায়েব করে দিলেন। এর আগে মলাটহীন, পাতা-ছেঁড়া বইখাতাসহ পুত্র-কন্যাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এদের কোনোটাই ডিসির শ্যালকের সামনে দাঁড়ানোর মতো না। আমিরনই গোবরে পদ্মফুল। সে তখন উঠানে দাঁড়িয়ে গামছায় চুল ঝাড়ছে। বিশ্বজয়ের বার্তা তখনো ওর কানে পৌঁছায় নাই। তবে বাড়িতে অসম্ভব কিছু ঘটছে। বলক ওঠা ভাত নামিয়ে চুলায় চা বসিয়েছে পিঠাপিঠি বোন আমিনা। শালপাতার ঠোঙায় মোড়ের দোকানের গরম ডালপুরী। একটা তসতরিতে গোটা চারেক ওভালটিন বিস্কুট। আরেকটায় খোসা ছাড়ানো আস্ত কমলা। ছোট ভাই-বোনগুলি অদূরে ঘুর ঘুর করছিল।
‘আমাগো ঘর-দুয়ারের হাল-হকিকত দেখলা তো বাবা।’ চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলেন মা। ‘খোদার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। কিন্তুক আমার একখান আরজি। বিয়েটা ঢাকা শহরে হওন চাই।’ একটুও গলা কাঁপলো না মায়ের! আমিরনের বুক ধড়ফড় করে। কমলার কোয়া, ডালপুরী, ওভালটিন বিস্কুট তসতরিতে পড়ে রয়েছে। পাত্রের মুখের পাশ দেখে ভালো-মন্দ ঠাহয় হচ্ছে না। মূলির বেড়ার ফোঁকল থেকে চোখ সরিয়ে নেয় আমিরন। বিয়ে-ভাঙানি দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই। তাই বিয়েটা রাতারাতি মা চালান করে দিয়েছেন মফস্বল থেকে ঢাকা শহরে। চেয়ারম্যান মামার তত্ত্বাবধানে।
বিয়েতে ডিসি সাহেবের প্রবল আপত্তি ছিল। তিনি যে শহরের প্রশাসক, মেয়ের বাপ ফুটপাতের দোকানদার। বেআইনি ব্যবসা করে। কিন্তু তার তো বদলির চাকরি, ওই শহরে তিনি আর কয়দিন, মানুষের বিয়ে তো সারা জীবনের। শ্বশুরবাড়ি পাত পেলেন না ডিসি জামাই। এর কারণ মেয়ের রূপ আর ছেলেরও ছুটি ফুরিয়ে আসছিল। মন্ত্রী মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায়, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে আমিরন।
৪.
বছর বছর দফায় দফায় পরীক্ষা, ক্লাশে নোট নেয়া, রাতজাগা – আখেরে কী লাভ হলো! সার্টিফিকেট ভেজিয়ে কোথাও চাকরি নিল না মীরা। কারও দাসত্ব করবে না, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতাই সই। পত্র-পত্রিকায় খুচরা লিখে অনিয়মিত যে রোজগার, তাতে বেইলিরোড কি নীলখেতের চাকরিজীবী মহিলা হোস্টেলের সিটভাড়া আর মাসচুক্তি খাওয়া খরচেরই সংস্থান হয় না। দিন-রাতে এক বেলা খেয়েও অর্থের টানাটানি। এ অবস্থায় বাঁধা চাকরির সন্ধান করে জানা গেল, ও পথেও কাঁটা পড়ে গেছে। একে দিয়ে হবে না। পাখনা গজাই গেছে। ওরেব্বাস মেয়ে বাউন্ডুলে সাংঘাতিক চিজ – শিকলিকাটা পাখির মতো। ফের খাঁচার পোরো, ওড়ার লোভ দেখিয়ে পোষমানাদেরও ভাগাবে। এসব হাঙ্গাম অবশ্য মফস্বলের সরকারি কলেজের মাস্টারিতে নেই। সময়মতো বিসিএস দিলে অনায়াসে সে তা বাগাতেও পারতো। সঙ্গে সকাল-বিকাল বারান্দার ইজিচেয়ার পেতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া সহকর্মী স্বামী। মেয়েদের কুড়িতে বুড়ি’র জমানা শেষ। এ দুর্মূল্যের বাজারে একার রোজগারে যে সংসার চলে না, তা বাঁধা মাইনের অধ্যাপকদের চেয়ে কে বেশি বোঝে!
মীরার না আছে গাঁটের জোর, না আছে খুঁটির ভর। অবশ্য সাংসারিক বুদ্ধির খাটতিটাই সব থেকে বেশি। আর সব কিছুর মতো বিয়ের ভাবনাটাও বিলম্বেই আসে। ইতোমধ্যে বিস্তর নিস্ফলা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গেছে সে। পচা শামুকে ঘন ঘন পা কাটার ঘটনা যখন আকছার ঘটতে লাগলো, সে সময় এক পৌঢ় আমলার সাক্ষাৎকারের অ্যাসাইনমেন্ট পায়। বিষয়টা জটিল। সরকারি খাস জমি লিজ নিয়ে হাসপাতাল গড়ার নামে আবাসন প্রকল্প। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল কামরায় মুখোমুখি দুজন। মধ্যিখানে টলটলে পুকুরের মতো স্বচ্ছ কাচ মোড়া টেবিল। কথা বলতে বলতে এক সময় মনে হলো, লোকটাকে সে হবু বর ভাবছে। বিপত্নীক তথ্যটা জানার পর থেকে সম্ভবত। তা সমঝে নিয়ে ঝানু লোকটা আত্মম্ভরিতা মেশানো আহ্লাদে গরগর করে, যেন তাদের মাঝখানে একটা পুকুর বা টেবিল, বয়স কোনো বাধাই নয়। মীরার মাথায় জুতার খুরের তান্ডব। মেরুন বেনারসির পাড় জড়িয়ে সুতানলি সাপের মতো সবুজ পেটিকোট লতিয়ে উঠছে। চেয়ারে বসা না থাকলে সে হয়তো দড়াম করে পড়েই যেত, যদিও পেছন থেকে কেউ শিস বাজায়নি। ছিঃ এতো নিচে নেমে গেছে সে, নিজের অজান্তে! কখন আপেল, স্যান্ডউইচ, কোকাকোলায় টেবিল ভর্তি হয়ে গেছে, মীরা জানে না। হঠাৎ সামনে দেখে সাদা তসতরির ওপর ডাঁসা-সবুজ এক জোড়া আপেল, কাছেই পেপারওয়েট। কোনটা তুলে নেবে মাথায় বাড়ি মারতে! সে দ্রুত নোটবুক, ক্যাসেট প্লেয়ার ব্যাগে ভরতে শুরু করে। হাত কাঁপছে। পা টলছে। বাকি কথা পরে হবে জাতীয় কিছু বলে সে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। এরপর তাড়া-খাওয়া জন্তুর মতো লম্বা করিডরে প্রলয়-ঘূর্ণি তুলে ছুটতে থাকে।
ঘটনাটা ছিল ব্যস্ত রাস্তার মোড়ের অনির্দিষ্ট দিকচিহ্নের মতো। বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেল। ছেলে মীরারই বয়সী। ব্যাংকে বড় চাকরি করে। দুর্মূল্যের বাজারে একজনের রোজগারেই তাদের সংসার চলবে – বিয়ের রাতেই ঘোষণা দেয় শাহজাদ। মীরা মনে মনে ভাবে, মানুষের ভাগ্য বলেও কিছু থাকে, যা আপনা থেকে ধরা দেয়। ওর বেলায় চাকরি ছাড়াটাই আসল। ঘর-সংসার মহার্ঘ।
হোস্টেলের বারোয়ারি জীবন ছেড়ে এসে সবকিছুই ভালো লাগছিল। দুজনের আন্দাজে ভাত রান্নার অ্যালুমিনিয়ামের ডেগ, ছোট ছোট তরকারির কড়াই, ফ্রাইপেন, ঝুলন্ত তাকে সাজানো মশলার বৈয়ম – সব। জানালার দিকে মুখ করে খেতে বসে মনটা ভরে যেতো। ভরদুপুরে কাকের কর্কশ ডাকও কত মধুর। কালো কালো ধূর্ত চোখের এ বড় সুন্দর পাখি। মাথার মেঘবরণ কেশ যেন কড়া জেলের সুবাদে নিপাট আর খাড়া খাড়া। চারপাশের ছোট ছোট জিনিস ভালো করে ঠাহর করলে, এসবে যে দিন-রাত আনন্দের ফোয়ারা বয়, তা দেখতে পাওয়া যায়। বেহুদাই মেট্রন আপা ছাত্রীদের প্রেম-প্রীতির আর ইলেকট্রিক হিটারের লাইনের বৈধতা তল্লাশ করে জীবনটা বরবাদ করলেন। চিনির কৌটার দিকে ধাবমান পিঁপড়ার সারির দিকে তাকিয়ে মীরা আপন মনে হাসে। কোনো কিছুতে তাড়া নেই। দুপুর গড়ালে গোসলখানায় ঢুকে মনে হয়, সন্ধ্যা পরয্যন্ত এখানে শুয়ে-বসে থাকলেও কেউ দুমদাম দরজা কিলাবে না। মাস ছয়েক ঘরের বাইরের জগতটার কথা সে ভুলেই রইলো।
বাসায় ফোন লাগার পর লম্বা দুপুরে মীরার বাড়তি কাজ – ডিরেক্টরি খুঁজে খুঁজে পুরোনো বন্ধুদের ফোন করা। একজনের কাছ থেকে আরেকজনের – এভাবে ফোনে ফোনে একটি অদৃশ্য জগত গড়ে ওঠে। সবাই যার যার মতো চাকরি-বাকরি করছে। কারও প্রমোশন হচ্ছে, ঘন ঘন অফিস বদলাচ্ছে কেউ কেউ। ওর মতো হাত-পা গুটিয়ে তারা বসে নেই। এ শহরের রাস্তার ওপর যে জারুল-সোনালু ফোটে, সামান্য বৃষ্টিতে পথ-ঘাট নর্দমার পানিতে ভরে যায় – এসব থেকে মীরা কত দূরে! ফোনটা যেন স্মৃতি জাগানিয়া সুখের, কষ্টের। ফোন করার মতো একটা অযৌন কাজ, ওপাশে ছেলে বা মেয়ে থাকুক, শাহজাদের কাছে লুকোনোর কথা কখনো ওর মাথায় আসেনি। দুজনে খেতে বসেছে, ফোন আসলো, ও উঠে গিয়ে বাম হাতে রিসিভার তুলে নিয়েছে। কথা শেষ হচ্ছে না। হাতে লেগে থাকা ভাতের কণা শুকিয়ে চুলকাতে শুরু করেছে – এমনও হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী শুতে যাবার পরও কড়কড়িয়ে ফোন বাজে। এরা রাতের শিফটে কাজ করা দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক। যদিও এ জাতীয় ফোন কালেভদ্রে আসতো, ধরাও হয়নি কখনো, শাহজাদ একসময় বিগড়ে গেল। আপাদমস্তক কুচুটে, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। মীরা বারো ভাতার মাড়ানি বেশ্যা তো! কেবল ফোনে কথা বলে না, দুপুর দুপুর খালি বাসায় পুরানা কাস্টমার লয়ে বিছানায় শুদ্ধ যায় – শাহজাদের বিড়বিড়ানি ক্রমে পাড়া-কাঁপানো চিৎকারে পরিণত হলো। আজ এ জন, কাল আরেকজনের সঙ্গে তুমুল সেক্স করাতে লাগলো তর্জনীকে শিশ্ম বানিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি করে। বেমক্কা কোমর দোলাতে দোলাতে কেমন যেন ভায়োলেন্টও হয়ে ওঠে। মীরা অবাক হওয়ারও ফুরসত পায় না। টেলিফোনটা আছড়ে আছড়ে ভাঙার পর শাহজাদ যেদিন ওকে উপরয্যপরি কিল-ঘুষি-লাথি মারে, সেদিনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে, আমি স্বামীর হাতে মার খাচ্ছি এ-ও সম্ভব! শাহজাদকে আর চেনা যায় না, বউকে গলা টিপে খুনও করতে পারে। নিজের লেখা ফেমিসাইডের রিপোর্টগুলির কথা ভেবে কেমন হাসিই পায় মীরার। থানায় জিডি করবে? না থাক। সুটকেস টানতে টানতে সে যখন এ বাড়িতে ঢোকে, তখন কপালে আড়াআড়ি একটা কাটা দাগ, চামড়া উঠে গোলাপি কৃমির মতো লেপ্টে আছে। তা দোতলা থেকে আমিরনের হয়তো নজরে পড়ে নাই।
৫.
মীরার সঙ্গে মোলাকাতের জন্য একটা উপলক্ষ দরকার ছিল আমিরনের। শ্বশুর সদ্য মারা গেছেন। শোকের বাড়ি। অথচ কোনো কিছুই থেমে নেই। মাসের শুরুতে পেছনের সিঙ্গল ফ্ল্যাটে ভাড়াটে আসলো। আমিরন তখন বারান্দায় কাপড় মেলে তন্ন তন্ন করে ক্লিপ খুঁজছে। পঙ্গপালের মতো বাড়ি-ভরা মানুষ, হাতের কাছে সময়মতো যদি কিছু পাওয়া যায়! ফাগুন-চৈত্রের উদ্দাম বাতাস, দড়িতে মেলা-কাপড় না আটকালেও নয়। রূপবানকে ডাকতে গিয়ে ওর নজর পড়ে গেটের মুখে। এক যুগ কি কম সময়! তবু মেয়েটিকে ওপর থেকে দেখে গোপন ডায়েরির সেলাই করা পৃষ্ঠাগুলি যেন পট পট করে খুলে গেল। আমি নিজের অজান্তে ভিজা কাপড়ের আড়ালে চলে এলাম। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এতো বড় শহরে ঘর ভাড়া করার আর জায়গা পেল না মেয়েটা! তবে অসামান্যা এমন ধুঁকে ধুঁকে হাঁটছেন কেন। সুটকেসের চাকার গড়গড়ানিতে যেন বুক-ভাঙা কান্না গুমরে গুমরে ফিরছে! দুনিয়াশুদ্ধ মানুষের চোখে ধুলা দিতে পারলেও আমার মতো মেয়েকে ফাঁকি দেয়া সহজ নয়। কিন্তু মেধাবী ছাত্রী, বিতর্কেও হল-চ্যাম্পিয়ান – ওর এ দশা কী করে হলো?
রূপবান আমার ডানহাত। বারো শরিকের বড়লোকের বাড়িতে সবচেয়ে আগে নোকরানিকেই যে হাত করতে হয়, সে আমি ঠেকে ঠেকে শিখেছি। এর ওপর আছে আমার আত্মঘাতী অতীত, যার চোরা-টান পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিতে চায় এমন শক্তিধর। তা না হলে বনানীর গোরস্থানে আমি বছর বছর ফুল দিতে যাব কেন! তবে মৃত্যুদিবসের অন্তিমে, যখন উঁচু উঁচু লাইটপোস্টের কমলা বাত্তির নিচে বৈধ আত্মীয়দের তাজা ফুলগুলি ডাঁটিশুদ্ধ নেতিয়ে পড়ে, তখন টেক্সি করে রূপবানকে নিয়ে আমি ওখানে যাই। সতর্কতাবশত সঙ্গে গাড়ি নেই না। আমার গায়ে থাকে মুখ-ঢাকা কালো বোরকা, হাতে তার প্রিয় শিউলি ফুল। (মৃত্যুটাও শিউলি-ফোটা শরৎকালে, কি অসম্ভব কাকতাল!) হাত ধরে ধরে ঠিক কবরের মাথার কাছটায় আমাকে দাঁড় করায় রূপবান। সে-ই মীরার ওপর গোয়েন্দাগিরি করে গত এক মাসে তামাম খবরা-খবর দাখিল করেছে। পাড়ার দোকানে মেয়েটার সওদা-পাতি বলতে চাল-ডাল-আলু, কালেভদ্রে কলা বা ডিম এক হালি। বিছানায় পাতার তোশক নেই। কপালে মস্তবড় কাটাদাগ। সিম্পল লিভিং হাই থিংকিংয়ের উন্নাসিক মেয়েটা তবে ভালো রকমের দাগা খেয়েছে! তবু আমার চোখে সে এখনো মহিয়সী। পড়ন্ত বেলায় মীরা যখন অলস পায়ে গেটের দিকে হেঁটে যায়, ওপর থেকে আমি চোরা চোখে চেয়ে থাকি। পায়ে পাতলা চটি, চিরুনিহীন ঘন চুল উঁচু করে রঙিন ব্যান্ডে বাঁধা, পরনে লম্বা হাতার সুতির কোর্তা – কোনো কিছুতেই ওকে বেমানান লাগে না। বরং চলনে-বলনে গরিমা ফুটে ওঠে। সম্ভবত একেই বলে বিদ্যার জ্যোতি।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। শ্বশুরের মৃত্যুকালে আমার স্বামী দেশে আসতে পারে নাই। চল্লিশার খতম বেয়াল্লিশ দিনে পড়ানো সাব্যস্থ হলো ওর ছুটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আমার বড় ছেলের বয়স এখন দশ, ছোটটা আটে পড়বে এ মাসেই। তবু বাপের ছোঁক ছোঁক ভাব গেল না। দুই বছর অন্তর অন্তর দেশে আসে, হপ্তা না গড়াতেই স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী বউ বাসী। এমন লোক বিদেশ-বিভুঁইয়ে কি আঙুল চোষে! সে খবরে আমার কাজ কী? আমি কি ড্রাইভার জামালের স্ত্রী-সঙ্গমের হিসাব রাখি? ঝিমমারা দুপুরে দুই ছেলের স্কুল থেকে স্কুলে যেতে-আসতে ওর স্টিয়ারিং হুইলের হাতসমেত লোমশ ঘাড়ের কি জনসমক্ষে তারিফ করি আমি? ওরা কেউ তার মতো আমার ভালোবাসার মানুষ নয়, যে আমার আড়ষ্ট দেহের ভাঁজে প্রথম কদম ফুল ফুটিয়েছিল, মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় যার মুখে ধরা ছিল অমলিন হাসি। আমার যতো ভাবনা মীরাকে নিয়ে। বলা ভালো আমার স্বামীই আমার অজাতশত্রু। ওর কি সিঙ্গল রুমের ফ্ল্যাটে নজর পড়বে না! গ্রিল যতোই মজবুত হোক, ঘরের ইঁদুরই তো বেড়া কাটে। আগেভাগে মীরাকে সতর্ক করে দিতে হবে, যাতে আমার অতীত ঝোলা থেকে বেরিয়ে না পড়ে। গৌরচন্দ্রিকা মিলাদের দিনই হয়ে গেছে। এখন কাহিনীটা শুধু বলা বাকি।
চল্লিশার পরদিন বাসা খালি করে সবাই দেশের বাড়ি চলে গেল। শ্বশুরের কবর জিয়ারত করবে। উপলক্ষ যদিও আমার স্বামী, শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে আমি বাসাতেই রয়ে গেলাম। ছাদে বিকালের চায়ের আয়োজন করলো রূপবান। চটপটি, কচুরি, ঘন দুধের পায়েস সব হাতে হাতে সাজিয়ে নিজেই গেলাম মীরাকে ডাকতে। যা দেমাগি মেয়ে, রূপবানকে একবার ফিরিয়ে দিলে, আমি হাতে-পায়ে ধরেও রাজি করাতে পারবো না।
বিছানাভর্তি রাশি-রাশি কাগজ, বুকের নিচে বালিশ ঠেসে উপুড় হয়ে শুয়ে খসখসিয়ে লিখছে মীরা। কত বড় কইলজা মেয়েটার, গ্রিলের বারান্দার দরজাটাও হাট করে খুলে রেখেছে! আমি আজ চেয়ার সরিয়ে বিছানার কিনারে বসলাম। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে এক রত্তি হাসলো মেয়েটা। কপালের দাগ মেয়েমানুষকে বড্ড ভোগায়। ও কি গাল ফুলিয়ে শিস দেয় এখনো! পত্রিকার ফরমায়েসি লেখা। কাগজগুলি যেনেতেনভাবে বালিশ-চাপা দিয়ে সে উঠে পড়লো।
একান্নবর্তী পরিবারে ছাদটাই আমার নিজস্ব মহল। ছেলে দুটির কচি মুখের গড়নে-হাসিতে আমি যাকে খুঁজি – পাই না। ছাদে আমি নিজেকে খুঁজে পাই তীব্র যন্ত্রণা আর ফূর্তিসমেত। দুপুর-বিকাল টোকা মাথায় কবুতরের খাঁচা সাফ করি, টবের ঘাস নিড়াই। মাচানে তুলে দেই গোল্ডেন বেইল, হলুদ আলমান্ডা, বেগুনি অপরাজিতা। চাড়ির পানিতে ভাসা চাঁদমালার গোল গোল পাতা থেকে পোকা বাছি, শ্যাওলা তুলি।
এমন সবুজ-সজল বনানী – কচুরির কিনার ভাঙতে ভাঙতে মীরা খুব তারিফ করে। আকাশে আলো আছে এখনো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ফট ফট তুড়ি বাজাই। উড়তে উড়তে নিঃসীম শূন্যে পাখিগুলি বিন্দু হয়ে যায়। জাতে গিরিবাজ কিনা! কবুতরের রাঙা পায়ের খসখসানি, আহ্লাদি স্বগতোক্তি, ডানার ঝাপট – সব কিছুতে অপার শান্তি। মীরার মতো আলোকপ্রাপ্ত লোকজন অন্তত তাই বলে। ওর পীড়াপীড়িতে কবুতরের খোপ থেকে আমি একটা তুলতুলে ছানা ধরে আনি। ও বাচ্চাটার কালো-বাদামী রোঁয়ায় আনমনে হাত বুলায়। ওর চশমার পুরু কাচে সন্ধ্যাকাশের বেগুনি-নীল ছায়া। শরতের মেঘের মতো উদাস দৃষ্টি। ঠাণ্ডা হওয়ার আগে আমি আরেক দফা চা পরিবেশন করি, জরি-পাড়ের ফকফকা সাদা কাপে। সঙ্গে পায়েশের বাটি এগিয়ে দেই। এসব আসলে সার্কাস শুরুর আগে শরীর তাতানো বা মঞ্চের সুরেলা বাজনা যবনিকা ওঠার আগের।
আমি চুলায় বসানো দুধের মতো উতরাতে থাকি। সব চেয়ে কঠিন – কথা শুরু করা। কোত্থেকে এবং কীভাবে? মুখোমুখি বসে, না খরখরা শানের ওপর পায়ের স্যান্ডেল খুলে চলতে চলতে? নুড়ি পাথর আর মোটা দানাদার ঝুরঝুরে বালুতে নানা জাতের ক্যাকটাসের কর্নার। মীরা চায়ের কাপ হাতে আমার পেছন পেছন উঠে আসে – ‘আরে এ দেখি মরুদ্যান! একটা খেজুর চারা লাগাও নাই ক্যান ওই পাশটায়?’ ওর গলায় যদিও রগরগে শ্লেষ, আমার মনে হয় আমি কথার সূত্র পেয়ে গেছি। বাচ্চাদের পড়াশোনার দোহাই দিয়ে তিন বছরের মাথায় স্বামীর কর্মস্থল যে মরুশহর ছেড়ে চলে এসেছিলাম, ওখান থেকে শুরু হতে পারে আমার গল্প। তবে আমি মনে মনে কিড়া কাটি মীরাকে সত্য বই মিথ্যা বলবো না। স্বামীর পরনারী আসক্তি বা আমার বনানীর গোরস্থানে পুষ্পার্ঘ্য অরপণ – সবই আমাকে বলতে হবে লুকোছাপা না করে। যেভাবে মানুষ ডাক্তার বা উকিলকে বলে।
আমার শুরুর উড়া-উড়া কথাগুলি যেন বিরক্তিকর মশা-মাছি – অদৃশ্য হাতে তাড়াচ্ছে মীরা। ওতে ওর মন নেই অচিরেই বুঝতে পারি। নেহায়েত দায়ে পড়ে বসে আছে। ভরপেট সুস্বাদু নাশতা, ছাদের সুগন্ধি হাওয়া, নীলাকাশে গিরিবাজের ডিগবাজি – এসবের দাম শোধ করছে হয়তো অন্ধকারে পা দোলাতে দোলাতে। ভেতরে ভেতরে ফরমাইসি লেখাটা শেষ করার তাড়াও আছে খুব সম্ভব। আমি পানের বোঁটায় চুন লাগিয়ে আরও একটি পান সাজাই।
হোটেলের সমুদ্রময় ওয়াল পেপারে যুগল মৈথুনের ডুবসাঁতারের ছায়া পড়েছে। মাঝপথে গভীর যন্ত্রণাময় কাতরোক্তি। আমাকে আলগোছে লতার মতো বুক থেকে নামিয়ে দিলেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভয়ার্ত সাইরেন কানে এলো। তিনতলার জানালায় ছুটে গিয়ে দেখি, রাস্তা দেখা যায় না। হোটেল রিসিপশনে আমার ফোন করায় বাধা দিলেন তিনি। ততোক্ষণে দাঁতে দাঁত চেপে কাপড় পরা হয়ে গেছে। ঠাইয়ের নটও বেঁধেছেন নিখুঁতভাবে। তেমনি ধীরেসুস্থে পার্স খালি করে বুক-পকেটে রাখলেন। সেই বুকে হাত রেখেই চলে গেলেন গাড়িতে চেপে।
উঁচু উঁচু লাইটপোস্টের কমলা আলোয় গোরস্থান ভেসে যাচ্ছে। নিকষ কালো বোরকার পিচ্ছিল গায় এর সোনালী ঝিলিক। সখীর হাত ধরে অন্ধ রানি ধীরে ধীরে চলেছেন গোপন কোনো অভিসারে। হাতের সাজিতে খইয়ের মতো সাদা সাদা শিউলি ফুল।
চশমা খুলে গাছের গুঁড়ির টেবিলে রাখে মীরা। নীলচে তারার নিচে চেহারাটা কেমন নরম দেখায়। আগের সেই ধার নেই। নেই ক্ষমাহীন ক্রর দৃষ্টি। আমি নিজেকে কখনও ট্র্যাজেডির নায়িকা ভাবেনি। সব শুনে আশৈশব কাব্যকলায় ডুবে থাকা মীরা নির্ঘাত ভাবছে। রাত অনেক হয়েছে। আমি ওকে রাতের খাবার খেয়ে যেতে বলি। বিকালে নাশতা-টাশতা করলে রাতের খাওয়া বাদ দেয় – এরকম কিছু বিড়বিড়িয়ে বলে ও চশমাটা নাকের ওপর ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমার স্বামী আর ড্রাইভার জামাল – এ দুটি চরিত্র নিয়ে ওর ভাবনার হদিস পেলাম না। তবু তিন তাশের খেলায় এইমাত্র যেন আমার জিতে উঠেছি, সেইভাবে আমি চেয়ার থেকে গা তুলি।
৬.
বামুনের ছায়া এতো দীর্ঘ হয়! (এসব ডায়েরিতে লেখার কথা ভাবে মীরা।) এ সাপের শরীরের মতো লম্বাই হবে টানতে থাকলে। আমিরন-শাহজাদের বিয়ে হলে কেমন হতো – আমি ভাবনাটা বেশিদূর গড়াতে দেই না। ছাদ থেকে ফিরে ত্রস্ত হাতে কাগজ-পত্র টেনে লিখতে বসি। অল্পই বাকি ছিল বস্তামোড়া বেশ্যার লাশের ইতিবৃত্তের। গোড়া থেকে পড়তে গিয়ে লাইনে লাইনে হোঁচট খাচ্ছি। কেমন তাল-কাটা আর কড়া মাড়ের কাপড়ে ইস্ত্রি টানার মতো নিপাট সমান। টানবাজারের উঁচু দালানের তিনতলা থেকে লাশটা বন্দর পরয্যন্ত কীভাবে গেল শ’খানেক মেয়ের চোখ এড়িয়ে – এর বয়ান পত্রিকার পাতায় ছাড়া-ছাড়া। বছর চারেক আগের একটি খুপরি রুম, দেয়ালে ঝোলানো পারদ-ওঠা ছোট্ট আয়নায় লাল লিপস্টিকের দাগ আর মেঝেয় রোল করা একটি পরিত্যক্ত বিছানা আমার চোখে ভাসে। তাছাড়া অন্ধি-সন্ধির গোলকধাঁধা আর ঢোকার মুখের হংস সিনেমা হল – এ পরয্যন্তই। ফের স্পটে না গেলে লেখায় ডিটেইল আসবে ভুঁই ফুঁড়ে! নারায়ণগঞ্জের বাস এখন কোন জায়গা থেকে ছাড়ে – ভাবতে ভাবতে আমি কলমের ক্যাপ বন্ধ করি।
বজ্রে, বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি… গানের গুনগুনানির মধ্যে সত্যি সত্যি কড়কড়িয়ে বাজ পড়লো। অন্ধকার ঘরে এর তির্যক সাদা আলো। অঝোর ধারার বৃষ্টি পড়ছে। বাজে-বিদ্যুতে চরাচর মাখামাখি। শিথানের বালিশটাও ভিজে গেছে। স্বপ্ন দেখছিলাম আমি জাদুর চাদরে শুয়ে গান গাইতে গাইতে মেঘের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছি। এ কেবল আরব্য রজনীতেই সম্ভব। মাঝরাত অব্দি ছাদে বসে আজ কি গান শোনালো আমিরন! আগে যা ছিল খারাপ জেরোক্স কপির মতো আবছা আবছা, কালিমাখা, এর কী জান্তব রূপ! মৃত্যুর এক যুগ পর বৃদ্ধ লোকটা যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলো। ভেজা কাগজের অবয়বহীন মন্ড যেন। আমিরনকে কী বলা যায়? ধ্রুপদী প্রেমিকা! ওর অবারিত বুকে লোকটা মহাভারতের রাজা পান্ডুর মতো মরে ঢলে পড়তে পারতো। মৃত্যুর পরোয়ানা আগেই জারি হয়েছিল। চোখের সামনে সুক্ষ্ম বস্ত্রের তরুণী ভারযা মাদ্রী শিখার মতো জ্বলছে। পতঙ্গের তাড়নায় ঝাঁপ দিলেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মহামহিম রাজন। তখন যা হওয়ার তাই হয়েছে। মাদ্রীর সপত্নী কুন্তী তো মৃগয়ার ধারে-কাছেই সন্তানদের আগলাচ্ছিলেন, দৌড়ে এসে স্বামীর মরা মুখ দেখে ছি ছি করার জন্য। পরের ছেলের নিজের বুকে লাফানোর ক্ষেত্রজ সন্তানের যুগ শেষ। লোকটা নিশ্চয় জিবের তলে নাইট্রোমিন্ট স্প্রে করেছিল আমিরনের অগোচরে, মরণ আসলেও যেন দুণ্ড পরে আসে! নিদেন বেগানা নারী ছেড়ে, বিগতযৌবনা স্ত্রীর শেষরাতের শয্যায় গড়িয়ে ওঠা পরয্যন্ত। কি বোকা মেয়েটা। এ চাতুরিটুকু মহান ভাবছে। আসলে নিজেকে সুন্দরী ভেবে ভেবে মাথাটাই বিগড়ে গেছে। কম বুদ্ধির লোকের যা হয়, খারাপ পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল আশা করে। তা না হলে শরীর বেচাকিনির হাটে অমূল্য প্রেমের খোয়াব দেখবে কেন! গোরস্থানের ফ্লাড লাইটে মুখের নেকাব নামিয়ে এক যুগ তো পার করলো। আর কত। আমিরনকে জন্মের মতো ডুবাবে ওই রূপবান, যে ওর ডানহাত।
সকালেও বৃষ্টি ধরার নাম নেই। নারায়ণগঞ্জ সফর বাদ দিতে হলো। লেখাটা আর ছুঁতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে হাত খালি। বিয়ের হীরার আংটি বেচে কিছু অর্থ সমাগম হয়েছিল। আগাম ঘরভাড়া আর টুকিটাকি কেনাকাটায় ফুরিয়ে গেছে। পায়ের মলজোড়া রূপার। এ আর কি দরে বিকাবে। আব্বা মারার যাওয়ার পর মা বড়ভাইয়ের বাসা আজিমপুর উঠেছেন। ‘হায় খোদা এমন মাইয়্যা পেটে ধরছিলাম, যে নিজের ভালা-বুরা বোঝে না!’- দেখা করতে গেলেই আম্মা শুরু করেন খোদার আরশ কাঁপানো আহাজারি।
দুপুরে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছে শাহজাদের বন্ধু তোফায়েল। ‘কত দিন ভাবী, আপনের হাতের কোরমা খাই না! আমারই কপাল মন্দ। অভাগা একবেলা ডাল-ভাত খাওয়াইতে চায়, আপত্তি করেন ক্যান?’ ভাবী ডাক শুনলেই আজকাল আমার গা রি রি করে। রূপবানের তেল-মাখা-মুড়ির মতো মুড়মড়ানো ভাবী ডাক কেমন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে আমিরন। মেয়েটার গাছেরটা খাওয়া তলারটা কুড়ানো আর গেল না।
তোফায়েলের ডাল-ভাতের লাঞ্চ যাচ্ছেতাই। বেছে বেছে এমন সস্তা টাইপের চাইনিজ হোটেল সে কোত্থেকে জোগাড় করলো! ভাতের ফ্যানের মতো নুন ময়লা কর্ন স্যুপ, ফ্রায়েড রাইসটাও ঠাণ্ডা-শক্ত যেন শীতের সকালের কড়কড়া ভাত। সবচেয়ে খারাপ ছিল, শাহজাদের পক্ষ নিয়ে ওর ওকালতি। বন্ধুরা সবাই তাই করে। কোনো যুক্তি ছিল না, আমি ক্ষেপে উঠলাম। ইচ্ছা করছিল খাবারগুলি বমি করে চলে আসি। কি কথা! ভালোবাসাত থাইক্যা নাকি শাহজাদ বউ মারতো। আর কে না বউ মারে! তবে ‘আপনে অরে চরম শিক্ষা দিসেন ভাবী। আর ইহজনমে গায়ে হাত তোলার সাহস করবো না হারামজাদা। কত টাকার বাজি!’
‘তাইলে তো ভালোও বাসবো না ইহজন্মে।’ খালি প্লেটটা সামনে ঠেলে দিয়ে এতোক্ষণে চেয়ারে গা এলিয়ে বসি আমি। কে যেন বলেছিল – পাতের প্রতিটি কণা লক্ষ্মীর দানা, মা সকলরা ঝুটা করবা না! আরেক লক্ষ্মীর ঠাকুরমা সম্ভবত। বড় পরিশ্রান্ত লাগে। সামনের দেয়াল জুড়ে রঙিন কাগজের শিকলি টাঙ্গানো। সিলিং থেকে ঝুলছে ক্ষীণ লাল আলোর ডোম। গায়ে গায়ে অজস্র বেলুন হরেক রঙের, নানা আকৃতির। ফুলশয্যার রাত যেন। দিনদুপুরে ঘর অন্ধকার করে রাখে কেন এসব রেস্টুরেন্টগুলি? তোফায়েল গুনে গুনে ব্যাংকের কড়কড়া নোট হাফ প্লেটের ধনিয়া ভাজার ওপর রাখছে। এ টাকা শাহজাদের – আমি জানি। ও আরও কত কত টাকা-পয়সা পথে-ঘাটে ছড়াবে খোদা মালুম। স্বামী ভালোবাসাত থাইক্যা বউ খুন করে। এ ঠাণ্ডা মাথার খুন নয়, গরম মাথার। সেই অপ্রকৃতিস্থ চোখ আমি দেখেছি।
‘এই আফা, হুনেন না? কুমবালা থেইক্যা চা খাইবার ডাকতাছি!’ বিকালের মেঘকাটা রাঙা আলোয় ঝলকাচ্ছে রূপবান। গ্রিলের দরজায় তালা না থাকলে ও ঠিক বারান্দা ডিঙিয়ে এসে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতো, এমন আঁটঘাট বেঁধে এসেছে। ঘরের খোলা দরজা দিয়ে আমাকে চশমা পরতে দেখে রূপবান রঙিলা হাসি দেয় – ‘দেইখ্যেন আনে, ছাদে ভাইজানও আছে আইজ। তিনজনের চা লাগাইছি – জুড়ায় গেল, আইয়েন আইয়েন!’
হাতে রেস্ত নাই। দুপুর-বিকাল ভোজ। একেক জনের একেক মতলব। আমি ছাদে যাবো কি যাবো না। লেখাটা তোলা রয়েছে, এক পাক নারায়ণগঞ্জ ঘুরে না এলে আর হাত দেওয়া যাচ্ছে না। আস্ত একটা রাত সামনে – জাদুর চাদরে শুয়ে পরীর দেশে চলে যাওয়ার। আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। রূপবানের হাতে সোনার কঙ্কণ, শারজা এয়ারপোর্ট থেকে ভাইজানের কেনা। আমিরনের ছোট ছেলেটা নিচে নেমে গেল জেব্রা-ডোরার আনকোরা বল লোফাতে লোফাতে। একটু আগেই বোধ হয় মিডল ইস্ট থেকে বয়ে আনা সুটকেস আনলোড হয়েছে। কয়েক ধাপ নেমে আমাকে আগবাড়িয়ে ছাদে নিতে আসে আমিরন। পরনে সরু আকাশি পাড়ের গোলাপি জর্জেট, ব্লাউজটা রঙচটা মেরুন। স্বামীকে খুশি করতে ব্লাউজ না পাল্টেই পাটভাঙা শাড়িটা পরেছে খুব সম্ভব। আজ নতুন সেটে তিনজনের আড্ডা হবে। আমার হাত হাতে নিয়ে মৃদু চাপ দেয় আমিরন। ওর হাতটা ঘুরিয়ে এনে আমিও চেপে ধরি। মৃগীরোগীর মতো কাঁপছে ও তিরতিরিয়ে। আজ সমঝে কথা বলতে হবে আমাকে। যেন আমিরনের অতীত ঝোলা থেকে বেরিয়ে না পড়ে। তবে ওর বিশেষ অনুরোধ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘এ রাত তোমার-আমার’ আমি যেন শিস দিয়ে গাই। গানটা স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই পছন্দের।
রচনা : ২০১১
গোধূলির রাঙা আলোয় লোহার গ্রিলের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে আমিরন। মীরার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বিস্ময়। এক নাতিদীর্ঘ তিক্ত-কাহিনী। পরনে বেনারসি-জর্জেটের বদলে সাদা অরগান্ডি। কব্জি-ছোঁয়া আস্তিনের সাদা ব্লাউজ। খোঁপায় তুলে দেয়া ত্রিকোণ ঘোমটা, যার নিচের দুগাছি পিঙ্গল-বরণ চুল অসীম শূন্যে ডানা মেলা পাখি যেন। কি আশ্চর্য, পায়ে খুর-তোলা জুতো নেই, দু’ফিতার পাতলা চটি!
জাল-সাজিস বোধ করি একেই বলে – মরচে ধরা তালা খুলতে খুলতে এক ঝলক ভাবে মীরা। এর বেশি কিছু ভাবার আগেই দরজায় ফাঁক দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে আমিরন, পেছনে খাবারের ট্রে হাতে এক গাল হাসিসমেত তরুণী ঝি। মেয়েটা মীরার চেনা। নাম রূপবান, গেটের ভেতরের চেয়ে বাইরেই দেখা যায় বেশি। পাড়ার ষণ্ডা-গুণ্ডারা যেন ওর ইয়ারদোস্ত – খোলা রাস্তায় হাতাহাতি-পাছড়াপাছড়ি লেগেই থাকে। একদিন এক ছোড়ার আধপোড়া সিগারেট নিয়ে মস্তিসে ফুক ফুক টান দিতেও তাকে দেখেছে মীরা। শুভ্র-বসনা আমিরন তাহলে এ রূপবানের মালকিন!
‘ওমা, আমারে তুমি চিনতে পারো নাই! আমি তো তোমারে পয়লা দিনই দোতালা থেকে দেইখ্যা চিনছি।’ চেয়ারে পা ক্রশ করে বসে পান-খাওয়া দাঁতে হাসে আমিরন।
পয়লা দিন মানে মাস খানেক আগে, যেদিন মীরা ইঁট-বিছানো প্যাসেজ দিয়ে সুটকেস টানতে টানতে এ বাড়ির পেছন দিককার এক কামরার আবাসে ওঠে! এখনো ঘরে আসবাব বলতে একখানা কাঠের চেয়ার। মেঝেতে তোষকহীন জাজিম। পানির গেলাশও একখান। হাতের ট্রে মাটিতে নামিয়ে সেটি ঘরের কোণের সিংক থেকে তুলে ঢগঢগ করে পানি খায় রূপবান। কোনো পরোয়াই করে না। মালকিনেরও ভাবে-সাবে মনে হয়, এতে আপত্তি করার কিছু নেই। ঘরে-বাইরে অপার স্বাধীনতাই ভোগ করে রূপবান। সেই ঘরটা যারই হোক বা বাইরে যেই থাকুক। তখনো মেঝেতে শালু কাপড়ে ঢাকা ট্রে যেন পীরের মকবরা, কেমন উঁচু আর টানটান, লোবানের গন্ধ জড়ানো। চেয়ারে বসেই আমিরন উবু হয়ে শালু কাপড়ের ঢাকনা সরায়। তসতরি বোঝাই এক কাঁড়ি নিমকি, এর ওপর দুইখান জিলিপি বিড়া পাকিয়ে সসম্ভ্রমে বসে আছে। তবারুকের বাক্স ঝেড়ে-পুছে ভাড়াটেদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা হচ্ছে খুব সম্ভব।
আমিরন চাকরানি নিয়ে বেরিয়ে গেলে বিছানার এক কোনায় ঠায় বসে থাকে মীরা। সামনে নিমকির পাহাড়, ওপরে চিনির শিরায় জবজবে মহামান্য জিলিপিদ্বয়। আমিরনের শ্বশুরের চল্লিশার তবারুক। সকালে মীরার নাকের ডগায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে আঙ্গিনায় শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। বাদ আসর মাইকে টানা মিলাদ-মহফিল। মুসল্লিরা হাঁকডাক ছেড়ে বেরিয়ে যেতে, বলা নেই কওয়া নেই আমিরন খাবার ট্রে হাতে চাকরানি নিয়ে হাজির। আজ ঘুম ভেঙে কার মুখ দেখেছিল মীরা? এক যুগ পরও কি কারও মনে অসূয়া থাকে! না থাকা সমীচীন!
২.
তখন সত্তর দশক শেষে আশি ছুঁই ছুঁই। এক যুগ আগের স্মৃতির খেরোখাতা খুলে বসে মীরা। হলের ঘাসছাটা লনে খুঁটি গেড়ে বাল্ব জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। প্রথম বর্ষে টানা চলেছে ইংরেজি টিভি সিরিয়াল ডালাস, তখনকার একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভিতে। ইংরেজি বোল-চাল রপ্ত করায় এসব লম্বা সিরিয়াল দেখার নাকি জুড়ি নেই – আমরা এ বিশ্বাসে বুঁদ হয়ে কমনরুমের সোফায় ঠাসাঠাসি বসে থাকতাম। টিএসসিতে চলছে কবিতা-আবৃতি, নাটক, বিতর্কের রিহার্সেল। হল-অডিটোরিয়ামের বাদুড়-চামচিকা-আড়শোলা ঝেটিয়ে উঁচু দেয়াল, কড়িকাঠ, জরাজীর্ণ গদির আসন সব দফায় দফায় হোসপাইপে জল ছিটিয়ে সাফ করা হলো। আঙ্গিনাজুড়ে ঝাঁক ঝাঁক বাস্তুহারা কবুতর। এদের ঝরা পাখনা, ন্যাদা পরিষ্কার করো। শাহবাগ পুলিশ ফাঁড়ির ছাড়পত্রও চাই, তা আবাসিকদের ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও। যেখানে বাধা সেইখানেই ভাঙার প্রবণতা – গানে-কবিতায়। অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সে এক স্বর্ণযুগ। আমিরন তখন ম্যাদম্যাদা গন্ধযুক্ত ইঁটচাপা হলদেটে ঘাস যেন, লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল। এরপর ভাসে যখন তিমিমাছের মতো তোলপাড় করে…
তখন জলপাইরঙা পোশাকের তল থেকে সবে ছাত্ররাজনীতির বাচ্চা ফুটেছে। জারুল-কৃষ্ণচূড়ার ছায়াতল প্রকল্পিত করে হলের সামনে মোটর বাইকের আনাগোনা। আরোহীরা আমাদেরই সহপাঠি। ক্লাশ-টিউটোরিয়ালের বালাই নেই। সরকারি ছাত্রদলের খাতায় নাম লিখিয়ে রাতারাতি নেতা বনে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে তাদের প্রেমিকাও জুটে গেল – ভুনা পাঙ্গাস মাছের কোলের টুকরা কি ইসলামপুর আড়তের চটকদার কাটপিসের বিনিময়ে। সকাল-বিকাল হোন্ডার ব্যাক-সিটে চড়ে দাবড়ে বেড়ানোটা ছিল উপরি পাওনা। আর মেডিকেলের ক্যান্টিনে যেদিন ভরপেট খেয়ে মৌরি চিবাতে চিবাতে হলে ফিরতো, সেদিন যেন একেকজন মহারানি, দেমাকে মাটিতে পা পড়তো না।
এদের ওপর টেক্কা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে নামে আমিরন। অনেকদিনের ইঁট-চাপা ঘাস। সঙ্গে নেত্রী গোছের একটি সিনিয়র মেয়ে। সাক্ষাৎ গন্ধগোকুল। চোখ দুটিও কুতকুতে। কোথাও পাত না পেয়ে নতুন দলে শামিল হয়েছে। এক সন্ধ্যায় আমি ওদের গেটের লাগোয়া মেঘশিরিষের গুঁড়ি ধরে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। দুই জোড়া চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল। বাত্তির অভাবে চড়া সাজ-গোজ যদিও নজরে পড়েনি, পারফিউমের তীব্র ঘ্রাণ নাকে লাগতে ঘুরে তাকালাম। অনেকগুলি জোনাকপোকা যেন হল্লা করে জ্বলে উঠলো। হয়তো বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছে, তাই জরি-চুমকির এমন বাহারি পোশাক। তবে আরেকজনের লেবাস কঙ্কণদাসীর কেন? হপ্তা না গড়াতেই সারা হল চাউর হয়ে গেল – আমিরন এক বৃদ্ধ মন্ত্রীর রক্ষিতা। একদিন অন্তর অন্তর মন্ত্রীগমনে যায়। একটা কয়লা-রঙা টয়োটা ওর বাহন। আর দীঘল দেহী নেত্রীর কি হাল! রাত এগারোটা বাজুক বারোটা বাজুক আমিরন যতোক্ষণ বাইরে, বন্ধ-গেট থেকে তার চোখ সরে না। চটাস চটাস মশা মারে হলের অফিসঘরের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে। টাকা দিয়ে আগেভাগেই দারোয়ানদের হাত করা হয়ে গেছে। তবু মা-মাসীর মতোই ওর বিড়ম্বনা।
তখনো দুজনের আলাদা আলাদা রুম। রাতদুপুরে বিশেষ ব্যবস্থায় গেট খুলে গেলে আমিরনকে টানতে টানতে নেত্রী ছোটে হলের আরেক প্রান্তের অডিটোরিয়ামের দিকে। বাগান বিলাস ঝাঁপিয়ে নেমে জায়গাটা দিনদুপুরেও স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। বিশেষ পালাপারবনে এর কারুকাজময় কাঠের আগল খোলা হতো। সিঁড়িটাও বিনাযত্নে আস্তর-খসা, শ্যাওলা-পড়া। তাতে পেপার বিছিয়ে দুজন বাবু হয়ে বসে বন্ধ দুয়ারে পিঠ দিয়ে। আমিরনের হাতের খাবারের পার্সেলের প্লাস্টিকের গেরো খুলতেই নেত্রীর চোখ ছানাবড়া। একেক দিন একেক পদ। সে এক এলাহি কাণ্ড! গন্ধ শুঁকে শুঁকে হলের কুকুরগুলিও দৌড়ে চলে আসে। লম্বা জিব ঝুলিয়ে বসে বসে লেজ দোলায়। এতে নেত্রীর চেয়ে আমিরনই নাখোশ হয় বেশি। হয়তো মন্ত্রীর সকাশে ছুরি-কাঁটার অত্যাচারে ওর পেট ভরতো না। তা না হলে উচ্ছিষ্টের পার্সেল লয়ে রাত দুপুরে দুজন মানুষের কাড়াকাড়ি, আর কুকুরগুলিও এমন পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়! হাউজ টিউটর রুমে নালিশ গেল নাইটগার্ডের তরফ থেকে। মেট্রন আপাও ঘটনার পূরবাপর বয়ান করে জোরালো সাক্ষ্য দিলেন। আলামত বলতে পাছার নিচে থ্যাঁতলানো পূরবাণীর প্যাস্ট্রি, যা কাড়াকাড়ির সময় মোড়কশুদ্ধ পড়ে যায়। তবে এসব হ্যাপা সামলানোর জন্য নেত্রী একাই একশো। আর বাইরে আছে হোন্ডাঅলা গুণ্ডার দল। হাউজ টিউটরের কোয়ার্টারের জানালার শার্সিতে ঢিল পড়তে সব ধামাচাপা পড়ে গেল। আমিরন যেন তেলতেলা কচুপাতা, এক ফোঁটা পানির ভারও বইতে হলো না।
দ্বিতীয় বর্ষের মেয়ের এমন ধাষ্টামি অবিশ্বাস্য। সব চেয়ে অবিশ্বাস্য – মেট্রন আপা ফিসফিসিয়ে বলতেন, বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে সহবাস, তা-ও নাম ভাঁড়িয়ে। (সাক্ষ্য দেওয়ার পর চাকরি হারানোর ভয়ে তিনি সর্বদা কাঁটা হয়ে থাকতেন।) আমরা শুধু জানতাম ঘাসের কার্পেট মোড়া রমনাপার্কের ওপাশের নিবিড় বীথিপথটা মিন্টুরোড, যার ধারে ধারে মন্ত্রীদের রাজসিক আবাস। ঢাকার আশপাশে বাগানবাড়ি, প্রমোদভবন নিদেন কটেজ-টটেজ আছে কিনা জানা ছিল না। জাতীয় উদ্যানের গহিনে থাকলেও থাকতে পারে। কিংবা কোনাবাড়ি বা চন্দ্রায়। তখনো ঢাকাশহর মাথা ঠেলে নতুন এয়ারপোর্ট ছাড়ায় নাই। উত্তরায় হয়তো বিল্ডিং উঠছে ক্ষেতখামারের জায়গা ছেড়ে ছেড়ে। আমাদের দৌড় নীলক্ষেত, পলাশির কাঁচাবাজার বা নিউমার্কেটের ডিম্বাকৃতির চাঁতাল পরয্যন্ত। রোকেয়া হলের ফুটপাত ধরে এগিয়ে ভিসির বাংলো, এরপর ব্রিটিশ কাউন্সিল ডানে রেখে আমাদের হলের সামনে এসে মনে হতো পৃথিবীটা সত্যিই গোল। আর পথের মধ্যের লাল ইটের বাড়িটা কোনো এক হতভাগ্য জমিদারের পরিত্যক্ত মহল। (এ বাড়ি নিয়ে সেসময় অজস্র কিংবদন্তি চালু ছিল।) এর বাইরে যে অদেখা বিশাল জগত, তা আমাদেরই বয়সী কাতান-বেনারসি-জড়োয়ায় আচ্ছন্ন সুদূরতমার একচেটেয়া।
প্রেম বয়সেরই ধর্ম, সে অনেকেই করে। রুমে রুমে হিটারের লাইন কাটতে এসে মেট্রন আপা নিচু স্বরে আলাপ জুড়ে দিতেন। হাতে টুলবক্স, চোখ কপালে – তা বলে এমন বেলেল্লাপনা! এমন যৌনগন্ধময় জাঁকালো শরীরী উপস্থিতি কজনার? (চিরকুমারী মেট্রন আপা হাতকাটা ব্লাউজের বগলে টেলকম পাউডার মাখতেন পুরো করে। কাঁচা-পাকা চুলে জবাকুসুম।) আমাদেরও চোখ ফোটে। বইয়ের একঘেয়ে বর্ণমালা থেকে নজর সরিয়ে দেখি, আমিরনের ঝরা-বাঁশপাতা-বর্ণের ত্বকে লালিমা লেগেছে। দেহের অন্ধি-সন্ধিতে অযথা মাংসের ভার, যা অসংস্কৃত, মোটা দাগের। সেটি আড়াল করার ভব্যতাটুকুও নেই। বিশেষত অভিসারের দিনে। সেদিন ক্লাশ-লাইব্রেরি-ডাইনিংয়েও সে গরহাজির। নেত্রীর সিঙ্গল রুমে উঠে আসার পর সকাল সকাল মাথায় ডিম ভেঙে ব্যালকনির রোদে বসে থাকতো। বেলা গড়ালেই হাতে-মুখে কাঁচা হলুদের গাঢ় প্রলেপ। সেই অবস্থায় বারান্দার লতানো গাছের টবে পানি দিচ্ছে। বা লাল পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের মেঝেটা সাফ করছে ব্রাশ দিয়ে ডলে ডলে। শান্ত আবার বন্য। সন্ধ্যা লাগলেই উগ্র সাজ। লো-কাটের গলার ব্লাউজ, নিচে স্টেডিয়াম মার্কেটের বুলেট ব্রা, আঁচল উড়িয়ে হিল খটখটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সবার নাকের ডগা দিয়ে।
তবে এ তেজি ঘোটকীর আড়ালে যে একটি সদা শঙ্কিত টিকটিকি বাস করে, তা বোঝা গেল একদিন।
সেদিন আমরা লনের ছাটা ঘাসে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। কয়লারঙা টয়োটা নোঙর করে আছে গেটের বাইরে মেঘ শিরিষের নিচে। পেন্সিল হিলের ঝড় তুলে খোলা চত্বরটা ত্বরিত পেরিয়ে যাচ্ছিল আমিরন। নেত্রী ছুটছে পেছন পেছন। সেদিন আমিরনের পরনে ছিল মেরুন বেনারসি। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে শাড়ির ফলের নিচ দিয়ে বিঘত খানেক সবুজ পেটিকোট বেরিয়ে পড়ে। মেরুন শাড়িতে সবুজ পেটিকোট! এ যেন বৃদ্ধ মন্ত্রীগমনের চেয়েও বিসদৃশ। কোমরে পাশের জনের গোত্তা খেয়ে আমি মুখে আঙুল পুরে প্রাণপণে আওয়াজ দিই। সঙ্গে সঙ্গে কাটা কলাগাছের মতো দড়াম করে মাটিতে পড়ে আমিরন। ওমা এ দি ফুলের ঘায়ে মুর্ছা গেল! হয়তো হাঁটার স্পিড বেশি থাকায় শিসের ধাক্কা সামলাতে পারে নাই। পেন্সিল হিল থেকে পড়ে গেছে। আমার শিস বাজানোটা পূরবপরিকল্পিত ছিল না। কিন্তু নেত্রীর সে কি চোখ রাঙানি আর চোটপাট! ‘অ মাগিরা, হোন্ডাঅলারা যখন গেটের মুখ থেইক্কা জনে জনে তুইল্যা নিবো, কোন বাপ তোগরে বাঁচায় – দেখুম নে!’ আমরা টু শব্দটি করি না। কথা বাড়ালেই বাড়ে। তাছাড়া এ শহরে আমাদের বাপ তো দূরের কথা ভাইবেরাদরও নাই। ভয়ে ঘাসের সঙ্গে পোকার মতো সেঁটে থাকি। ভাবখানা এমন, কার না কার সঙ্গে নেত্রীর বচসা চলছে, আমরা এর মাথামুণ্ড জানি না। এর মধ্যে আমিরন নেত্রীর গলা ধরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে গিয়ে বসে গাড়িতে।
ম্যাডামের পায়ে চোট খাওয়ায় জরুরিভিত্তিতে মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক ডাকা হয়েছিল কিনা জানি না, গেটের সামনে হোন্ডার টহলদারি বেড়ে গেল। চেনা ছেলেগুলোর সঙ্গে বেশ কটা খুনি খুনি চেহারার অপরিচিত মুখ। কপালে লাল ফেটি, পরনে হাঁটুর কাছে রোঁয়া-ওঠা জিন্স। এরা একেক শিফটে পালা করে আসে। টংঘর থেকে পয়সা না দিয়ে চা খায়, প্লেট প্লেট ফুচকা সাবাড় করে চলে যায়। আরেকদল আসে। সেদিনের ঘাসে বসা আমরা চারজনই সন্দেহের তালিকায়। তিনতলার ব্যালকনি থেকে হোন্ডাঅলাদের ওপর নজর রাখি। তা-ও পালা করে। ক্লাশে যাওয়া চাঙ্গে উঠেছে। জ্বরজারি হলেও ডাক্তারখানায় যাই না। পুরোদমে বিবরবাসী। হপ্তাখানেক এ নিয়ে রোমাঞ্চ হলেও পরে তিতা লাগতে শুরু করে। সবাই আমায় দুষছে। যেন কোমরে গোত্তা মারাটা কোনো ইন্ধন ছিল না। মনে খুব দুঃখ হচ্ছিল – সব জন্তুই মোট বয় ধরা পড়ে গাধা…। একা একা হলের মধ্যে ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াই। মুখে খাবার রোচে না। পড়ালেখা তো আগেই গোল্লায় গেছে।
আমাদের মধ্যে সবচেয়ে একরোখা মেয়েটি একদিন কাঁধে ব্যাগ ফেলে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমরা তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছি – সে হলের কোনার ছোট্ট আইল্যান্ডটাও ছাড়াতে পারে নাই, মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরেছে হোন্ডাগুলি। একজন ব্যাগ ধরে টানে তো আরেকজন হাতে ওড়না প্যাঁচায়। (তখনো ভারতীয় সরকারি চ্যানেল দূরদর্শনে মহাভারত সিরিয়াল শুরু হতে কয়েক বছর বাকি। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ তো আরো পরের কথা।) ওদিকে ভিড় জমে গেছে। আমিরন তখন ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে উল্টা দিকের ফুটপাত দিয়ে আসছিল। সে-ই আমার নাম প্রকাশ্যে বলে মেয়েটিকে বাঁচায়। আন্দাজেই হয়তো বলেছে, কিন্তু দুনিয়াটা তখন আমার একার জন্যই বৈরি। আমিরনের বাবা-মাকে উড়া চিঠি লেখার জন্য যিনি সরবক্ষণ তাতাতেন, সেই মেট্রন আপাও আমায় না চেনার ভান করেন। একদিন রুমে ঢুকে বেদম বকাঝকা করে গেলেন, যদিও আমাদের রান্নার হিটার ছিল না। সবকিছু অসার মনে হলো। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে যখন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি, তখন মন্ত্রীমশাই অক্কা পেলেন। আপনা হতে অবরোধ উঠে গেল। ফের আমাদের দরজায় জবাকুসুম আর তোষামোদি হাসি। ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়, আমি একঘেয়ে বর্ণমালা থেকে আর মুখ তুলি না। পরে শুনেছি, মন্ত্রীর দাফন-কাফনের পরদিনই পুরান কাপড়চোপড়ের ট্রাঙ্কটা বারান্দায় আছাড় মেরে ফেলে আমিরনকে রুম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নেত্রী। পুনর্মূষিক বারান্দার থামে কপাল ঠেকিয়ে কেঁদেছে ফুলে ফুলে। দামী শাড়ি-গহনা সব বেহাত হয়ে গেছে। হাতে শুধু ঢাকা ডায়িংয়ের আকাশি নীল বেডকাভার, যা অশ্রু-শিকনিতে মাখামাখি। কি এক রহস্যজনক কারণে আগের ফোর সিটের রুমেও আমিরনের ফেরা হলো না। হোস্টেলই ছাড়তে হলো শেষমেশ। তখনো সেকেন্ড ইয়ার পেরোয়নি। আমরা বছর শেষে লাস্ট সেমিস্টারের জন্য তৈরি হচ্ছি।
৩.
বহুদিন আমিরনের খেদ ছিল পাকেচক্রে পড়ে ওর পড়াশোনাটা আর হলো না। দুই বছরের মাথায় কোনো সনদপত্র ছাড়াই টিনের চালের বেড়ার ঘরে ফিরতে হয়েছিল। বিখ্যাত লোকের সঙ্গে ওঠবোস করার বিড়ম্বনা অনেক। কোনো কিছুই গোপন থাকে না। মফস্বল শহরেও এ নিয়ে বিস্তর কানাঘুষা। দিনের বিক্রিবাটার হিসেব মিলিয়ে আব্বা যখন ফুটপাতের বেসাতি গুটিয়ে কাপড়ের গাঁটরি লয়ে বাসায় ফিরতেন, তখন তার চোখ থেকে অপমানের জ্বালা আগুন হয়ে ঠিকরে বেরোতো। মা না আগলালে তখন-তখন আমিরনের তাতে ভস্ম হয়ে যাওয়ার কথা। রোজ রাতে ছোট দুটি ভাই পাল্লা দিয়ে বিছানা ভিজায়। সেসব টুটাফাটা কাঁথার স্তূপে এক রকম গা-ঢাকা দিয়েই সে থাকতো রাত থেকে সকাল দশটায় আব্বার বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। দমকে-দমকে ছেঁড়া কাঁথা থেকে উঠে আসা পেশাবের গন্ধেও ওর ঘোর ভাঙতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ছয়মাস অনিঃশেষ স্বপ্নের মতো। বৃদ্ধ লোক এমন চটকদার হয়! গায়ে চড়া-রঙের ফুলেল শার্ট। আঙুল বোঝাই রুবি, পান্না, টোপাজের দামী দামী সব পাথরের আংটি। ঠোঁটে পানিরঙা লিপগ্লস। রোজ ডাবের জলে মুখ ধুয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে অফিস করতে যেতেন। দুপুরে শসা-আপেলের লাঞ্চ, খোসা ছাড়িয়ে সালাদের মতো চাক চাক কাটা। এমন লোকের ফোলা গালে লালিমা ঠিকরাবে না তো কি। তবে সূরয্য ডোবার পর যেন অন্য মানুষ, খানাপিনায় কোনো লাগাম ছিল না। খানার চেয়ে পিনাই আসল। দেয়ালে লেপ্টে থাকা সাদাটে কাঁকলাসের রাঙা মুলো হয়ে যাওয়ার মতো দ্রুত পাল্টে যেতেন। মাঝরাত অব্দি হোটেল-স্যুটের স্প্রিংয়ের গদিতে হুলো বিড়ালের ইঁদুর লয়ে জাপটা-জাপটি। ফাঁকে-ফাঁকে ঘড়ি দেখা। সব শেষে জ্বলন্ত সিগারেট আঙুলে চেপে যখন হাত নেড়ে গাড়িতে উঠতেন তখন আরেক মানুষ। স্ত্রী-সন্তান অন্তপ্রাণ গোবেচারা লোকটি যেন তড়িঘড়ি বাসায় ফিরছেন। যদিও ঘড়ির কাঁটা তখন জোড়হাতের ভঙ্গিতে বারোটার ঘরে।
পয়লা দর্শনে মন্ত্রী চাচার গলায় সিরাজগঞ্জের হালকা টানই শুধু আমিরনের আপন মনে হয়েছিল। সে তসতরি থেকে এক ফালি শসা কাঁটা চামচে গেঁথে নেয়, একবার সাধা মাত্র। এলাকার চেয়ারম্যান তখন সামনে।
লোকটা অসম্ভব ধুরন্ধর। সবসময় বিড়ালের মতো ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বেড়ায়। ওদিকে এলাকার লোক হলেও যথার্থ ভেট ছাড়া মন্ত্রীদের দুয়ারে পৌঁছানো যায় না। ঢাকায় পা দিয়েই তিনি সোজা চলে এসেছিলেন পাড়াতুতো ভাগ্নি আমিরনের হলের গেটে। ফুটপাতের বেপারি বাপ যে টাকা পাঠায়, তা দিয়ে মেয়েটার মাসের অর্ধেকও চলে না। বিদেশ-বিভুঁইয়ে ধারই বা কে দেয়। একটা খণ্ডকালীন চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার কথা, গেল বার আমিরনের মা পই পই করে বলে দিয়েছিল। পেটে ভাত না জুটলেও মহিলার মুখে বড় দড়। ‘তোমার দল পাওয়ারে আছে, ভাগ্নিরে একটা চাকরি দিতে পারো না, কেমন চেয়ারম্যান অইছো তুমি? পরের বার ভোট চাইতে আসো – দেখবো আনে।’ সেই চাকরির নাম শুনে আমিরনও নেচে উঠলো। পরদিন ট্যাক্সি করে মামা-ভাগ্নি সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছে। আমিরনের পরনে টাঙ্গাইল শাড়িকুটির থেকে মামার কেনা তুঁত রঙের তাঁতের শাড়ি। কপালে লাল টিপ। দুই হাতে শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা ডজন খানেক কাচের চুড়ি।
সেদিন আপেল-শসা খাওয়ার এক ফাঁকে মন্ত্রী চাচা তার হাতটা আলতো করে নিজের হাতে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। পুরুষের স্পর্শ সেই প্রথম। যদিও তিনি চুড়ির রঙ তারিফ করেই হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবু আমিরনের কাঁপুনি থামেনি। এতো কোমল হয় মানুষের হাত! সেদিন চাকরি নিয়ে কোনো কথা হলো না। যা কিছু বাতচিত চেয়ারম্যান-মন্ত্রীতে। দুজনেরই বাড়ি কাছাকাছি, যমুনার এপার-ওপার – কথাও তাই ফুরাচ্ছিল না। উঠে আসার সময় ভিজিটিং কার্ডটা শুধু আমিরনের দিকে তিনি আলতো করে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
হলের কয়েনবক্স ফোনে প্রচুর আধুলি খরচা করার পর টায়ে টায়ে দশ দিনের মাথায় আমিরনের ডাক পড়ে। এবার আর সচিবালয় নয়, ঢাকা ক্লাব। চেয়ারম্যান মামাই বেবি ট্যাক্সিতে গাড়ি বারান্দা অব্দি পৌঁছে দেন। ঢোকার মুখে দরজা আগলে রাখা পাগড়িধারী দারোয়ান। ওখানে আমিরনের এক দণ্ডও দাঁড়াতে হলো না। সিঁড়ির এক ধাপ নেমে মন্ত্রী চাচা থাবা বাড়িয়ে ওর হাত ধরলেন। স্পর্শে এবার কোমলতা নেই। শক্তিমত্তা জাহিরের সচেষ্টতা ছিল। মাথার ওপর উঁচু সিলিং, নিচে পুরু কার্পেট। এ কেমন জায়গা! হিল পায়ে সে বারকয় হোঁচট খায়। দেয়ালে-দেয়ালে ভদ্রলোকদের পরিচ্ছন্ন ছবি। অথচ নিচের টেবিল-ঘিরে বা সোফা সেটে সব বুড়ো বাজ, তাকে চোখ দিয়ে আঁচড়ে-কামড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। তাতেই যেন তার চেতন ফিরে, সে শক্ত থাবায় হাত সঁপে তরতরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে যায়। এ ঊর্ধে ওঠার যেন শেষ ছিল না। ক্লাব থেকে হোটেল, ঘন্টা খানেকের ড্রাইভে গজারি-শাল-শাল্মলির ধারের বাগানবাড়ি। কল্পনার অগম্য তুলতুলে নরম বিছানা, যথোচ্ছ আদর-সোহাগ, সুস্বাদু খাবার, হরেক পদের পানীয় – মাটির পৃথিবীতে বেহেশত নেমে আসে। বা পৃথিবীটাই লাফ দিয়ে উঠে যায় আসমানে। ফেরাউন-এর মতো পালঙ্কের পায়ায় ক্ষুধার্ত শকুন আর মাংসের পুটলি বেঁধে তাকে সাত আসমানে উড়তে হয়নি, এমনিই আমিরন ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ছাত্রনেতারা দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতো। হলের নেত্রী তো নোকরানিই বনে গেলেন। মাত্র ছয় মাসেই এত্তো সব।
বুকের তলায় পেসমেকারের বদৌলতেই যে ঘড়ির কাঁটার মতো হৃৎপিণ্ডটা টিক টিক করছে, আমিরন তা পরে পরে শুনলেও, চাচা কখনো বুঝতে দেন নাই। তার চোখের কোলের পানির পুটলি দুটি ক্রমে ভারী হচ্ছিল। দিনদুপুরে চোখের পাতা টেনে আসতো ঘুমে। সরু করে তাকাতেন যখন আঁখি দুটি প্রায় বন্ধই হয়ে যেতো। অল্পতেই হাঁপাতে শুরু করতেন। তবে শেষ দিন পরয্যন্ত, যেন বিশাল জনসভার মঞ্চে উঠছেন, তার মুখের হাসিটা ছিল দিলখোলা, অমলিন। বুকে হাত চেপে নির্দিষ্ট সময়ের ঘন্টা খানেক আগে যখন গাড়িতে উঠে বসলেন, তখনো। এই শেষ দেখা। পরদিনের পতাকা মোড়া কাঠের কফিনটা যে কারোরই হতে পারতো। রাষ্ট্রীয় মরয্যাদায় দাফনের আগে বিউগল বেজে ওঠে, সঙ্গে সৈন্যদের বুট ঠোকাঠুকি আর সগর্জন কুচকাওয়াজ।
সেই ছয় মাসে আমিরনদের ঘরের বেড়ায় ঠেস দিয়ে সাইকেল দাঁড় করিয়ে পোস্টাফিসের লোক সবশুদ্ধ তিন বার হাঁক দিয়েছে। তখন বাড়িতে চিঠি লেখার মতো সুসংহত মনের অবস্থা আমিরনের ছিল না। মা নিরবিকার মুখে সই করে টাকা নিতেন। কাঁচা টাকা ঘরে রাখা ঠিক নয়। আব্বাকে জানালেও বিপদ। দুপুর-দুপুর বোরকা পরে স্যাঁকরার দোকানে গিয়ে সাত তাড়াতাড়ি গড়িয়ে নিলেন হাতের বাউটি, গলার নেকলেস, কানের ঝুমকা। দেশশুদ্ধ যখন ঢি ঢি পড়ে গেছে, মেয়ে বিয়ে দেয়ার হাউস উনিই কেবল ছাড়তে পারেন নাই।
তার ইচ্ছারই জয় হলো।
বছর ঘুরে গেছে। প্রাইভেটে বিএ দেওয়ার জন্য আমিরন যখন তৈরি হচ্ছে, তখনই ঘটনাটা ঘটে।
মূলিবাঁশের পার্টিশন দেয়া ছোট ছোট তিন কামরায় দুই থেকে বাইশ বছর বয়সী ছয় সন্তান নিয়ে আব্বা-আম্মার সংসার। বাড়িতে কোনো গোসলখানা ছিল না। বাসার পেছনে ডিসির বাংলোর উদলা পুকুরে সন্ধ্যার আগ দিয়ে মা গোসল করে ভিজা কাপড়ে বাড়ি ফিরতেন। আব্রু বলতে কাঁচা ঘাটের ওপর নুয়ে পড়া ডুমুর গাছ। এ থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ে আমিরনদের সব ভাইবোন সাঁতার কাটা শিখেছে। বড় হওয়ার পর থেকে আমিরন উঠানে তক্তা বিছিয়ে তোলা-জলেই কাক স্নান করতো। তখন বিএ পরীক্ষার তোড়জোড়। মা ছাপরা ঘরে চেলাকাঠের আঁটি খুলছিলেন, খানিকবাদে রাতের রান্না চড়াবেন। আমিরন হাত-মুখ ধোওয়ার কথা বলে চলে আসে পুকুরঘাটে। পানিটা এখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ। টোপা টোপা ফলের ডুমুর গাছটা আগের মতোই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আছে। সে-ই শুধু বন্দিনী রাজকুমারী। রাজকুমারী না দাসী। এতো বড় মেয়ের এক বালতি পানিতে গোসল হয়! শরীর ভরে গেছে একজিমায়। রাতভর চুলকায়। সে এক ঝটকায় শাড়িটা খুলে, পাড় থেকেই লাফিয়ে পড়ে পানিতে। এভাবে পর পর দুদিন।
শেষ দিনে তা অপর পাড় থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ডিসির মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী শ্যালক। অন্ধকার গাঢ় হতে সে মাধবীলতার ঝাড় ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সন্তর্পণে ঝোপ-জাংলার পাড় ধরে এগোয়। এসব স্থানে সাপ-খোপ থাকা বিচিত্র নয়। চোরা-গর্তও থাকতে পারে লতাপাতার আড়ালে-আবডালে। তবে সহিসালামতে ঠিকই সে জায়গামতো পৌঁছে যায়। আমিরন পুকুরে থাকতেই ওদের বাইরের দরজায় কড়া নাড়ে। তখন ছোট ছোট ভাইবোনেরা কেরোসিনের লম্প জ্বেলে নাকি সুরে ক্লাশের পড়া মুখস্থ করছিল। আব্বার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত। আম্মাই মাথায় হেঁটো শাড়ির আঁচল টানতে টানতে এগিয়ে গেলেন। সরাসরি বিয়ের পয়গাম, তাও আত্মীয়-কুটুমের তরফ থেকে নয়, ছেলের মুখ থেকে! তিনি মোটেও ঘাবড়ালেন না। যেন জানাই ছিল – তার রূপবতী কন্যা আইবুড়ো থাকার জন্য জন্মায় নাই। চাঁদের গায়েও কলঙ্ক থাকে। তিনি ছেলের জ্ঞাতি-গোষ্টির খবর নেয়ার ফাঁকে তক্তপোষ থেকে তেলচিটচিট বালিশ দুটি গায়েব করে দিলেন। এর আগে মলাটহীন, পাতা-ছেঁড়া বইখাতাসহ পুত্র-কন্যাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এদের কোনোটাই ডিসির শ্যালকের সামনে দাঁড়ানোর মতো না। আমিরনই গোবরে পদ্মফুল। সে তখন উঠানে দাঁড়িয়ে গামছায় চুল ঝাড়ছে। বিশ্বজয়ের বার্তা তখনো ওর কানে পৌঁছায় নাই। তবে বাড়িতে অসম্ভব কিছু ঘটছে। বলক ওঠা ভাত নামিয়ে চুলায় চা বসিয়েছে পিঠাপিঠি বোন আমিনা। শালপাতার ঠোঙায় মোড়ের দোকানের গরম ডালপুরী। একটা তসতরিতে গোটা চারেক ওভালটিন বিস্কুট। আরেকটায় খোসা ছাড়ানো আস্ত কমলা। ছোট ভাই-বোনগুলি অদূরে ঘুর ঘুর করছিল।
শেষ দিনে তা অপর পাড় থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ডিসির মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী শ্যালক। অন্ধকার গাঢ় হতে সে মাধবীলতার ঝাড় ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সন্তর্পণে ঝোপ-জাংলার পাড় ধরে এগোয়। এসব স্থানে সাপ-খোপ থাকা বিচিত্র নয়। চোরা-গর্তও থাকতে পারে লতাপাতার আড়ালে-আবডালে। তবে সহিসালামতে ঠিকই সে জায়গামতো পৌঁছে যায়। আমিরন পুকুরে থাকতেই ওদের বাইরের দরজায় কড়া নাড়ে। তখন ছোট ছোট ভাইবোনেরা কেরোসিনের লম্প জ্বেলে নাকি সুরে ক্লাশের পড়া মুখস্থ করছিল। আব্বার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত। আম্মাই মাথায় হেঁটো শাড়ির আঁচল টানতে টানতে এগিয়ে গেলেন। সরাসরি বিয়ের পয়গাম, তাও আত্মীয়-কুটুমের তরফ থেকে নয়, ছেলের মুখ থেকে! তিনি মোটেও ঘাবড়ালেন না। যেন জানাই ছিল – তার রূপবতী কন্যা আইবুড়ো থাকার জন্য জন্মায় নাই। চাঁদের গায়েও কলঙ্ক থাকে। তিনি ছেলের জ্ঞাতি-গোষ্টির খবর নেয়ার ফাঁকে তক্তপোষ থেকে তেলচিটচিট বালিশ দুটি গায়েব করে দিলেন। এর আগে মলাটহীন, পাতা-ছেঁড়া বইখাতাসহ পুত্র-কন্যাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এদের কোনোটাই ডিসির শ্যালকের সামনে দাঁড়ানোর মতো না। আমিরনই গোবরে পদ্মফুল। সে তখন উঠানে দাঁড়িয়ে গামছায় চুল ঝাড়ছে। বিশ্বজয়ের বার্তা তখনো ওর কানে পৌঁছায় নাই। তবে বাড়িতে অসম্ভব কিছু ঘটছে। বলক ওঠা ভাত নামিয়ে চুলায় চা বসিয়েছে পিঠাপিঠি বোন আমিনা। শালপাতার ঠোঙায় মোড়ের দোকানের গরম ডালপুরী। একটা তসতরিতে গোটা চারেক ওভালটিন বিস্কুট। আরেকটায় খোসা ছাড়ানো আস্ত কমলা। ছোট ভাই-বোনগুলি অদূরে ঘুর ঘুর করছিল।
‘আমাগো ঘর-দুয়ারের হাল-হকিকত দেখলা তো বাবা।’ চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলেন মা। ‘খোদার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। কিন্তুক আমার একখান আরজি। বিয়েটা ঢাকা শহরে হওন চাই।’ একটুও গলা কাঁপলো না মায়ের! আমিরনের বুক ধড়ফড় করে। কমলার কোয়া, ডালপুরী, ওভালটিন বিস্কুট তসতরিতে পড়ে রয়েছে। পাত্রের মুখের পাশ দেখে ভালো-মন্দ ঠাহয় হচ্ছে না। মূলির বেড়ার ফোঁকল থেকে চোখ সরিয়ে নেয় আমিরন। বিয়ে-ভাঙানি দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই। তাই বিয়েটা রাতারাতি মা চালান করে দিয়েছেন মফস্বল থেকে ঢাকা শহরে। চেয়ারম্যান মামার তত্ত্বাবধানে।
বিয়েতে ডিসি সাহেবের প্রবল আপত্তি ছিল। তিনি যে শহরের প্রশাসক, মেয়ের বাপ ফুটপাতের দোকানদার। বেআইনি ব্যবসা করে। কিন্তু তার তো বদলির চাকরি, ওই শহরে তিনি আর কয়দিন, মানুষের বিয়ে তো সারা জীবনের। শ্বশুরবাড়ি পাত পেলেন না ডিসি জামাই। এর কারণ মেয়ের রূপ আর ছেলেরও ছুটি ফুরিয়ে আসছিল। মন্ত্রী মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায়, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে আমিরন।
৪.
বছর বছর দফায় দফায় পরীক্ষা, ক্লাশে নোট নেয়া, রাতজাগা – আখেরে কী লাভ হলো! সার্টিফিকেট ভেজিয়ে কোথাও চাকরি নিল না মীরা। কারও দাসত্ব করবে না, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতাই সই। পত্র-পত্রিকায় খুচরা লিখে অনিয়মিত যে রোজগার, তাতে বেইলিরোড কি নীলখেতের চাকরিজীবী মহিলা হোস্টেলের সিটভাড়া আর মাসচুক্তি খাওয়া খরচেরই সংস্থান হয় না। দিন-রাতে এক বেলা খেয়েও অর্থের টানাটানি। এ অবস্থায় বাঁধা চাকরির সন্ধান করে জানা গেল, ও পথেও কাঁটা পড়ে গেছে। একে দিয়ে হবে না। পাখনা গজাই গেছে। ওরেব্বাস মেয়ে বাউন্ডুলে সাংঘাতিক চিজ – শিকলিকাটা পাখির মতো। ফের খাঁচার পোরো, ওড়ার লোভ দেখিয়ে পোষমানাদেরও ভাগাবে। এসব হাঙ্গাম অবশ্য মফস্বলের সরকারি কলেজের মাস্টারিতে নেই। সময়মতো বিসিএস দিলে অনায়াসে সে তা বাগাতেও পারতো। সঙ্গে সকাল-বিকাল বারান্দার ইজিচেয়ার পেতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া সহকর্মী স্বামী। মেয়েদের কুড়িতে বুড়ি’র জমানা শেষ। এ দুর্মূল্যের বাজারে একার রোজগারে যে সংসার চলে না, তা বাঁধা মাইনের অধ্যাপকদের চেয়ে কে বেশি বোঝে!
মীরার না আছে গাঁটের জোর, না আছে খুঁটির ভর। অবশ্য সাংসারিক বুদ্ধির খাটতিটাই সব থেকে বেশি। আর সব কিছুর মতো বিয়ের ভাবনাটাও বিলম্বেই আসে। ইতোমধ্যে বিস্তর নিস্ফলা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গেছে সে। পচা শামুকে ঘন ঘন পা কাটার ঘটনা যখন আকছার ঘটতে লাগলো, সে সময় এক পৌঢ় আমলার সাক্ষাৎকারের অ্যাসাইনমেন্ট পায়। বিষয়টা জটিল। সরকারি খাস জমি লিজ নিয়ে হাসপাতাল গড়ার নামে আবাসন প্রকল্প। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল কামরায় মুখোমুখি দুজন। মধ্যিখানে টলটলে পুকুরের মতো স্বচ্ছ কাচ মোড়া টেবিল। কথা বলতে বলতে এক সময় মনে হলো, লোকটাকে সে হবু বর ভাবছে। বিপত্নীক তথ্যটা জানার পর থেকে সম্ভবত। তা সমঝে নিয়ে ঝানু লোকটা আত্মম্ভরিতা মেশানো আহ্লাদে গরগর করে, যেন তাদের মাঝখানে একটা পুকুর বা টেবিল, বয়স কোনো বাধাই নয়। মীরার মাথায় জুতার খুরের তান্ডব। মেরুন বেনারসির পাড় জড়িয়ে সুতানলি সাপের মতো সবুজ পেটিকোট লতিয়ে উঠছে। চেয়ারে বসা না থাকলে সে হয়তো দড়াম করে পড়েই যেত, যদিও পেছন থেকে কেউ শিস বাজায়নি। ছিঃ এতো নিচে নেমে গেছে সে, নিজের অজান্তে! কখন আপেল, স্যান্ডউইচ, কোকাকোলায় টেবিল ভর্তি হয়ে গেছে, মীরা জানে না। হঠাৎ সামনে দেখে সাদা তসতরির ওপর ডাঁসা-সবুজ এক জোড়া আপেল, কাছেই পেপারওয়েট। কোনটা তুলে নেবে মাথায় বাড়ি মারতে! সে দ্রুত নোটবুক, ক্যাসেট প্লেয়ার ব্যাগে ভরতে শুরু করে। হাত কাঁপছে। পা টলছে। বাকি কথা পরে হবে জাতীয় কিছু বলে সে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। এরপর তাড়া-খাওয়া জন্তুর মতো লম্বা করিডরে প্রলয়-ঘূর্ণি তুলে ছুটতে থাকে।
ঘটনাটা ছিল ব্যস্ত রাস্তার মোড়ের অনির্দিষ্ট দিকচিহ্নের মতো। বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেল। ছেলে মীরারই বয়সী। ব্যাংকে বড় চাকরি করে। দুর্মূল্যের বাজারে একজনের রোজগারেই তাদের সংসার চলবে – বিয়ের রাতেই ঘোষণা দেয় শাহজাদ। মীরা মনে মনে ভাবে, মানুষের ভাগ্য বলেও কিছু থাকে, যা আপনা থেকে ধরা দেয়। ওর বেলায় চাকরি ছাড়াটাই আসল। ঘর-সংসার মহার্ঘ।
হোস্টেলের বারোয়ারি জীবন ছেড়ে এসে সবকিছুই ভালো লাগছিল। দুজনের আন্দাজে ভাত রান্নার অ্যালুমিনিয়ামের ডেগ, ছোট ছোট তরকারির কড়াই, ফ্রাইপেন, ঝুলন্ত তাকে সাজানো মশলার বৈয়ম – সব। জানালার দিকে মুখ করে খেতে বসে মনটা ভরে যেতো। ভরদুপুরে কাকের কর্কশ ডাকও কত মধুর। কালো কালো ধূর্ত চোখের এ বড় সুন্দর পাখি। মাথার মেঘবরণ কেশ যেন কড়া জেলের সুবাদে নিপাট আর খাড়া খাড়া। চারপাশের ছোট ছোট জিনিস ভালো করে ঠাহর করলে, এসবে যে দিন-রাত আনন্দের ফোয়ারা বয়, তা দেখতে পাওয়া যায়। বেহুদাই মেট্রন আপা ছাত্রীদের প্রেম-প্রীতির আর ইলেকট্রিক হিটারের লাইনের বৈধতা তল্লাশ করে জীবনটা বরবাদ করলেন। চিনির কৌটার দিকে ধাবমান পিঁপড়ার সারির দিকে তাকিয়ে মীরা আপন মনে হাসে। কোনো কিছুতে তাড়া নেই। দুপুর গড়ালে গোসলখানায় ঢুকে মনে হয়, সন্ধ্যা পরয্যন্ত এখানে শুয়ে-বসে থাকলেও কেউ দুমদাম দরজা কিলাবে না। মাস ছয়েক ঘরের বাইরের জগতটার কথা সে ভুলেই রইলো।
বাসায় ফোন লাগার পর লম্বা দুপুরে মীরার বাড়তি কাজ – ডিরেক্টরি খুঁজে খুঁজে পুরোনো বন্ধুদের ফোন করা। একজনের কাছ থেকে আরেকজনের – এভাবে ফোনে ফোনে একটি অদৃশ্য জগত গড়ে ওঠে। সবাই যার যার মতো চাকরি-বাকরি করছে। কারও প্রমোশন হচ্ছে, ঘন ঘন অফিস বদলাচ্ছে কেউ কেউ। ওর মতো হাত-পা গুটিয়ে তারা বসে নেই। এ শহরের রাস্তার ওপর যে জারুল-সোনালু ফোটে, সামান্য বৃষ্টিতে পথ-ঘাট নর্দমার পানিতে ভরে যায় – এসব থেকে মীরা কত দূরে! ফোনটা যেন স্মৃতি জাগানিয়া সুখের, কষ্টের। ফোন করার মতো একটা অযৌন কাজ, ওপাশে ছেলে বা মেয়ে থাকুক, শাহজাদের কাছে লুকোনোর কথা কখনো ওর মাথায় আসেনি। দুজনে খেতে বসেছে, ফোন আসলো, ও উঠে গিয়ে বাম হাতে রিসিভার তুলে নিয়েছে। কথা শেষ হচ্ছে না। হাতে লেগে থাকা ভাতের কণা শুকিয়ে চুলকাতে শুরু করেছে – এমনও হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী শুতে যাবার পরও কড়কড়িয়ে ফোন বাজে। এরা রাতের শিফটে কাজ করা দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক। যদিও এ জাতীয় ফোন কালেভদ্রে আসতো, ধরাও হয়নি কখনো, শাহজাদ একসময় বিগড়ে গেল। আপাদমস্তক কুচুটে, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। মীরা বারো ভাতার মাড়ানি বেশ্যা তো! কেবল ফোনে কথা বলে না, দুপুর দুপুর খালি বাসায় পুরানা কাস্টমার লয়ে বিছানায় শুদ্ধ যায় – শাহজাদের বিড়বিড়ানি ক্রমে পাড়া-কাঁপানো চিৎকারে পরিণত হলো। আজ এ জন, কাল আরেকজনের সঙ্গে তুমুল সেক্স করাতে লাগলো তর্জনীকে শিশ্ম বানিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি করে। বেমক্কা কোমর দোলাতে দোলাতে কেমন যেন ভায়োলেন্টও হয়ে ওঠে। মীরা অবাক হওয়ারও ফুরসত পায় না। টেলিফোনটা আছড়ে আছড়ে ভাঙার পর শাহজাদ যেদিন ওকে উপরয্যপরি কিল-ঘুষি-লাথি মারে, সেদিনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে, আমি স্বামীর হাতে মার খাচ্ছি এ-ও সম্ভব! শাহজাদকে আর চেনা যায় না, বউকে গলা টিপে খুনও করতে পারে। নিজের লেখা ফেমিসাইডের রিপোর্টগুলির কথা ভেবে কেমন হাসিই পায় মীরার। থানায় জিডি করবে? না থাক। সুটকেস টানতে টানতে সে যখন এ বাড়িতে ঢোকে, তখন কপালে আড়াআড়ি একটা কাটা দাগ, চামড়া উঠে গোলাপি কৃমির মতো লেপ্টে আছে। তা দোতলা থেকে আমিরনের হয়তো নজরে পড়ে নাই।
৫.
মীরার সঙ্গে মোলাকাতের জন্য একটা উপলক্ষ দরকার ছিল আমিরনের। শ্বশুর সদ্য মারা গেছেন। শোকের বাড়ি। অথচ কোনো কিছুই থেমে নেই। মাসের শুরুতে পেছনের সিঙ্গল ফ্ল্যাটে ভাড়াটে আসলো। আমিরন তখন বারান্দায় কাপড় মেলে তন্ন তন্ন করে ক্লিপ খুঁজছে। পঙ্গপালের মতো বাড়ি-ভরা মানুষ, হাতের কাছে সময়মতো যদি কিছু পাওয়া যায়! ফাগুন-চৈত্রের উদ্দাম বাতাস, দড়িতে মেলা-কাপড় না আটকালেও নয়। রূপবানকে ডাকতে গিয়ে ওর নজর পড়ে গেটের মুখে। এক যুগ কি কম সময়! তবু মেয়েটিকে ওপর থেকে দেখে গোপন ডায়েরির সেলাই করা পৃষ্ঠাগুলি যেন পট পট করে খুলে গেল। আমি নিজের অজান্তে ভিজা কাপড়ের আড়ালে চলে এলাম। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এতো বড় শহরে ঘর ভাড়া করার আর জায়গা পেল না মেয়েটা! তবে অসামান্যা এমন ধুঁকে ধুঁকে হাঁটছেন কেন। সুটকেসের চাকার গড়গড়ানিতে যেন বুক-ভাঙা কান্না গুমরে গুমরে ফিরছে! দুনিয়াশুদ্ধ মানুষের চোখে ধুলা দিতে পারলেও আমার মতো মেয়েকে ফাঁকি দেয়া সহজ নয়। কিন্তু মেধাবী ছাত্রী, বিতর্কেও হল-চ্যাম্পিয়ান – ওর এ দশা কী করে হলো?
রূপবান আমার ডানহাত। বারো শরিকের বড়লোকের বাড়িতে সবচেয়ে আগে নোকরানিকেই যে হাত করতে হয়, সে আমি ঠেকে ঠেকে শিখেছি। এর ওপর আছে আমার আত্মঘাতী অতীত, যার চোরা-টান পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিতে চায় এমন শক্তিধর। তা না হলে বনানীর গোরস্থানে আমি বছর বছর ফুল দিতে যাব কেন! তবে মৃত্যুদিবসের অন্তিমে, যখন উঁচু উঁচু লাইটপোস্টের কমলা বাত্তির নিচে বৈধ আত্মীয়দের তাজা ফুলগুলি ডাঁটিশুদ্ধ নেতিয়ে পড়ে, তখন টেক্সি করে রূপবানকে নিয়ে আমি ওখানে যাই। সতর্কতাবশত সঙ্গে গাড়ি নেই না। আমার গায়ে থাকে মুখ-ঢাকা কালো বোরকা, হাতে তার প্রিয় শিউলি ফুল। (মৃত্যুটাও শিউলি-ফোটা শরৎকালে, কি অসম্ভব কাকতাল!) হাত ধরে ধরে ঠিক কবরের মাথার কাছটায় আমাকে দাঁড় করায় রূপবান। সে-ই মীরার ওপর গোয়েন্দাগিরি করে গত এক মাসে তামাম খবরা-খবর দাখিল করেছে। পাড়ার দোকানে মেয়েটার সওদা-পাতি বলতে চাল-ডাল-আলু, কালেভদ্রে কলা বা ডিম এক হালি। বিছানায় পাতার তোশক নেই। কপালে মস্তবড় কাটাদাগ। সিম্পল লিভিং হাই থিংকিংয়ের উন্নাসিক মেয়েটা তবে ভালো রকমের দাগা খেয়েছে! তবু আমার চোখে সে এখনো মহিয়সী। পড়ন্ত বেলায় মীরা যখন অলস পায়ে গেটের দিকে হেঁটে যায়, ওপর থেকে আমি চোরা চোখে চেয়ে থাকি। পায়ে পাতলা চটি, চিরুনিহীন ঘন চুল উঁচু করে রঙিন ব্যান্ডে বাঁধা, পরনে লম্বা হাতার সুতির কোর্তা – কোনো কিছুতেই ওকে বেমানান লাগে না। বরং চলনে-বলনে গরিমা ফুটে ওঠে। সম্ভবত একেই বলে বিদ্যার জ্যোতি।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। শ্বশুরের মৃত্যুকালে আমার স্বামী দেশে আসতে পারে নাই। চল্লিশার খতম বেয়াল্লিশ দিনে পড়ানো সাব্যস্থ হলো ওর ছুটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আমার বড় ছেলের বয়স এখন দশ, ছোটটা আটে পড়বে এ মাসেই। তবু বাপের ছোঁক ছোঁক ভাব গেল না। দুই বছর অন্তর অন্তর দেশে আসে, হপ্তা না গড়াতেই স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী বউ বাসী। এমন লোক বিদেশ-বিভুঁইয়ে কি আঙুল চোষে! সে খবরে আমার কাজ কী? আমি কি ড্রাইভার জামালের স্ত্রী-সঙ্গমের হিসাব রাখি? ঝিমমারা দুপুরে দুই ছেলের স্কুল থেকে স্কুলে যেতে-আসতে ওর স্টিয়ারিং হুইলের হাতসমেত লোমশ ঘাড়ের কি জনসমক্ষে তারিফ করি আমি? ওরা কেউ তার মতো আমার ভালোবাসার মানুষ নয়, যে আমার আড়ষ্ট দেহের ভাঁজে প্রথম কদম ফুল ফুটিয়েছিল, মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় যার মুখে ধরা ছিল অমলিন হাসি। আমার যতো ভাবনা মীরাকে নিয়ে। বলা ভালো আমার স্বামীই আমার অজাতশত্রু। ওর কি সিঙ্গল রুমের ফ্ল্যাটে নজর পড়বে না! গ্রিল যতোই মজবুত হোক, ঘরের ইঁদুরই তো বেড়া কাটে। আগেভাগে মীরাকে সতর্ক করে দিতে হবে, যাতে আমার অতীত ঝোলা থেকে বেরিয়ে না পড়ে। গৌরচন্দ্রিকা মিলাদের দিনই হয়ে গেছে। এখন কাহিনীটা শুধু বলা বাকি।
চল্লিশার পরদিন বাসা খালি করে সবাই দেশের বাড়ি চলে গেল। শ্বশুরের কবর জিয়ারত করবে। উপলক্ষ যদিও আমার স্বামী, শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে আমি বাসাতেই রয়ে গেলাম। ছাদে বিকালের চায়ের আয়োজন করলো রূপবান। চটপটি, কচুরি, ঘন দুধের পায়েস সব হাতে হাতে সাজিয়ে নিজেই গেলাম মীরাকে ডাকতে। যা দেমাগি মেয়ে, রূপবানকে একবার ফিরিয়ে দিলে, আমি হাতে-পায়ে ধরেও রাজি করাতে পারবো না।
বিছানাভর্তি রাশি-রাশি কাগজ, বুকের নিচে বালিশ ঠেসে উপুড় হয়ে শুয়ে খসখসিয়ে লিখছে মীরা। কত বড় কইলজা মেয়েটার, গ্রিলের বারান্দার দরজাটাও হাট করে খুলে রেখেছে! আমি আজ চেয়ার সরিয়ে বিছানার কিনারে বসলাম। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে এক রত্তি হাসলো মেয়েটা। কপালের দাগ মেয়েমানুষকে বড্ড ভোগায়। ও কি গাল ফুলিয়ে শিস দেয় এখনো! পত্রিকার ফরমায়েসি লেখা। কাগজগুলি যেনেতেনভাবে বালিশ-চাপা দিয়ে সে উঠে পড়লো।
একান্নবর্তী পরিবারে ছাদটাই আমার নিজস্ব মহল। ছেলে দুটির কচি মুখের গড়নে-হাসিতে আমি যাকে খুঁজি – পাই না। ছাদে আমি নিজেকে খুঁজে পাই তীব্র যন্ত্রণা আর ফূর্তিসমেত। দুপুর-বিকাল টোকা মাথায় কবুতরের খাঁচা সাফ করি, টবের ঘাস নিড়াই। মাচানে তুলে দেই গোল্ডেন বেইল, হলুদ আলমান্ডা, বেগুনি অপরাজিতা। চাড়ির পানিতে ভাসা চাঁদমালার গোল গোল পাতা থেকে পোকা বাছি, শ্যাওলা তুলি।
এমন সবুজ-সজল বনানী – কচুরির কিনার ভাঙতে ভাঙতে মীরা খুব তারিফ করে। আকাশে আলো আছে এখনো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ফট ফট তুড়ি বাজাই। উড়তে উড়তে নিঃসীম শূন্যে পাখিগুলি বিন্দু হয়ে যায়। জাতে গিরিবাজ কিনা! কবুতরের রাঙা পায়ের খসখসানি, আহ্লাদি স্বগতোক্তি, ডানার ঝাপট – সব কিছুতে অপার শান্তি। মীরার মতো আলোকপ্রাপ্ত লোকজন অন্তত তাই বলে। ওর পীড়াপীড়িতে কবুতরের খোপ থেকে আমি একটা তুলতুলে ছানা ধরে আনি। ও বাচ্চাটার কালো-বাদামী রোঁয়ায় আনমনে হাত বুলায়। ওর চশমার পুরু কাচে সন্ধ্যাকাশের বেগুনি-নীল ছায়া। শরতের মেঘের মতো উদাস দৃষ্টি। ঠাণ্ডা হওয়ার আগে আমি আরেক দফা চা পরিবেশন করি, জরি-পাড়ের ফকফকা সাদা কাপে। সঙ্গে পায়েশের বাটি এগিয়ে দেই। এসব আসলে সার্কাস শুরুর আগে শরীর তাতানো বা মঞ্চের সুরেলা বাজনা যবনিকা ওঠার আগের।
আমি চুলায় বসানো দুধের মতো উতরাতে থাকি। সব চেয়ে কঠিন – কথা শুরু করা। কোত্থেকে এবং কীভাবে? মুখোমুখি বসে, না খরখরা শানের ওপর পায়ের স্যান্ডেল খুলে চলতে চলতে? নুড়ি পাথর আর মোটা দানাদার ঝুরঝুরে বালুতে নানা জাতের ক্যাকটাসের কর্নার। মীরা চায়ের কাপ হাতে আমার পেছন পেছন উঠে আসে – ‘আরে এ দেখি মরুদ্যান! একটা খেজুর চারা লাগাও নাই ক্যান ওই পাশটায়?’ ওর গলায় যদিও রগরগে শ্লেষ, আমার মনে হয় আমি কথার সূত্র পেয়ে গেছি। বাচ্চাদের পড়াশোনার দোহাই দিয়ে তিন বছরের মাথায় স্বামীর কর্মস্থল যে মরুশহর ছেড়ে চলে এসেছিলাম, ওখান থেকে শুরু হতে পারে আমার গল্প। তবে আমি মনে মনে কিড়া কাটি মীরাকে সত্য বই মিথ্যা বলবো না। স্বামীর পরনারী আসক্তি বা আমার বনানীর গোরস্থানে পুষ্পার্ঘ্য অরপণ – সবই আমাকে বলতে হবে লুকোছাপা না করে। যেভাবে মানুষ ডাক্তার বা উকিলকে বলে।
আমার শুরুর উড়া-উড়া কথাগুলি যেন বিরক্তিকর মশা-মাছি – অদৃশ্য হাতে তাড়াচ্ছে মীরা। ওতে ওর মন নেই অচিরেই বুঝতে পারি। নেহায়েত দায়ে পড়ে বসে আছে। ভরপেট সুস্বাদু নাশতা, ছাদের সুগন্ধি হাওয়া, নীলাকাশে গিরিবাজের ডিগবাজি – এসবের দাম শোধ করছে হয়তো অন্ধকারে পা দোলাতে দোলাতে। ভেতরে ভেতরে ফরমাইসি লেখাটা শেষ করার তাড়াও আছে খুব সম্ভব। আমি পানের বোঁটায় চুন লাগিয়ে আরও একটি পান সাজাই।
হোটেলের সমুদ্রময় ওয়াল পেপারে যুগল মৈথুনের ডুবসাঁতারের ছায়া পড়েছে। মাঝপথে গভীর যন্ত্রণাময় কাতরোক্তি। আমাকে আলগোছে লতার মতো বুক থেকে নামিয়ে দিলেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভয়ার্ত সাইরেন কানে এলো। তিনতলার জানালায় ছুটে গিয়ে দেখি, রাস্তা দেখা যায় না। হোটেল রিসিপশনে আমার ফোন করায় বাধা দিলেন তিনি। ততোক্ষণে দাঁতে দাঁত চেপে কাপড় পরা হয়ে গেছে। ঠাইয়ের নটও বেঁধেছেন নিখুঁতভাবে। তেমনি ধীরেসুস্থে পার্স খালি করে বুক-পকেটে রাখলেন। সেই বুকে হাত রেখেই চলে গেলেন গাড়িতে চেপে।
উঁচু উঁচু লাইটপোস্টের কমলা আলোয় গোরস্থান ভেসে যাচ্ছে। নিকষ কালো বোরকার পিচ্ছিল গায় এর সোনালী ঝিলিক। সখীর হাত ধরে অন্ধ রানি ধীরে ধীরে চলেছেন গোপন কোনো অভিসারে। হাতের সাজিতে খইয়ের মতো সাদা সাদা শিউলি ফুল।
চশমা খুলে গাছের গুঁড়ির টেবিলে রাখে মীরা। নীলচে তারার নিচে চেহারাটা কেমন নরম দেখায়। আগের সেই ধার নেই। নেই ক্ষমাহীন ক্রর দৃষ্টি। আমি নিজেকে কখনও ট্র্যাজেডির নায়িকা ভাবেনি। সব শুনে আশৈশব কাব্যকলায় ডুবে থাকা মীরা নির্ঘাত ভাবছে। রাত অনেক হয়েছে। আমি ওকে রাতের খাবার খেয়ে যেতে বলি। বিকালে নাশতা-টাশতা করলে রাতের খাওয়া বাদ দেয় – এরকম কিছু বিড়বিড়িয়ে বলে ও চশমাটা নাকের ওপর ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমার স্বামী আর ড্রাইভার জামাল – এ দুটি চরিত্র নিয়ে ওর ভাবনার হদিস পেলাম না। তবু তিন তাশের খেলায় এইমাত্র যেন আমার জিতে উঠেছি, সেইভাবে আমি চেয়ার থেকে গা তুলি।
৬.
বামুনের ছায়া এতো দীর্ঘ হয়! (এসব ডায়েরিতে লেখার কথা ভাবে মীরা।) এ সাপের শরীরের মতো লম্বাই হবে টানতে থাকলে। আমিরন-শাহজাদের বিয়ে হলে কেমন হতো – আমি ভাবনাটা বেশিদূর গড়াতে দেই না। ছাদ থেকে ফিরে ত্রস্ত হাতে কাগজ-পত্র টেনে লিখতে বসি। অল্পই বাকি ছিল বস্তামোড়া বেশ্যার লাশের ইতিবৃত্তের। গোড়া থেকে পড়তে গিয়ে লাইনে লাইনে হোঁচট খাচ্ছি। কেমন তাল-কাটা আর কড়া মাড়ের কাপড়ে ইস্ত্রি টানার মতো নিপাট সমান। টানবাজারের উঁচু দালানের তিনতলা থেকে লাশটা বন্দর পরয্যন্ত কীভাবে গেল শ’খানেক মেয়ের চোখ এড়িয়ে – এর বয়ান পত্রিকার পাতায় ছাড়া-ছাড়া। বছর চারেক আগের একটি খুপরি রুম, দেয়ালে ঝোলানো পারদ-ওঠা ছোট্ট আয়নায় লাল লিপস্টিকের দাগ আর মেঝেয় রোল করা একটি পরিত্যক্ত বিছানা আমার চোখে ভাসে। তাছাড়া অন্ধি-সন্ধির গোলকধাঁধা আর ঢোকার মুখের হংস সিনেমা হল – এ পরয্যন্তই। ফের স্পটে না গেলে লেখায় ডিটেইল আসবে ভুঁই ফুঁড়ে! নারায়ণগঞ্জের বাস এখন কোন জায়গা থেকে ছাড়ে – ভাবতে ভাবতে আমি কলমের ক্যাপ বন্ধ করি।
বজ্রে, বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি… গানের গুনগুনানির মধ্যে সত্যি সত্যি কড়কড়িয়ে বাজ পড়লো। অন্ধকার ঘরে এর তির্যক সাদা আলো। অঝোর ধারার বৃষ্টি পড়ছে। বাজে-বিদ্যুতে চরাচর মাখামাখি। শিথানের বালিশটাও ভিজে গেছে। স্বপ্ন দেখছিলাম আমি জাদুর চাদরে শুয়ে গান গাইতে গাইতে মেঘের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছি। এ কেবল আরব্য রজনীতেই সম্ভব। মাঝরাত অব্দি ছাদে বসে আজ কি গান শোনালো আমিরন! আগে যা ছিল খারাপ জেরোক্স কপির মতো আবছা আবছা, কালিমাখা, এর কী জান্তব রূপ! মৃত্যুর এক যুগ পর বৃদ্ধ লোকটা যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলো। ভেজা কাগজের অবয়বহীন মন্ড যেন। আমিরনকে কী বলা যায়? ধ্রুপদী প্রেমিকা! ওর অবারিত বুকে লোকটা মহাভারতের রাজা পান্ডুর মতো মরে ঢলে পড়তে পারতো। মৃত্যুর পরোয়ানা আগেই জারি হয়েছিল। চোখের সামনে সুক্ষ্ম বস্ত্রের তরুণী ভারযা মাদ্রী শিখার মতো জ্বলছে। পতঙ্গের তাড়নায় ঝাঁপ দিলেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মহামহিম রাজন। তখন যা হওয়ার তাই হয়েছে। মাদ্রীর সপত্নী কুন্তী তো মৃগয়ার ধারে-কাছেই সন্তানদের আগলাচ্ছিলেন, দৌড়ে এসে স্বামীর মরা মুখ দেখে ছি ছি করার জন্য। পরের ছেলের নিজের বুকে লাফানোর ক্ষেত্রজ সন্তানের যুগ শেষ। লোকটা নিশ্চয় জিবের তলে নাইট্রোমিন্ট স্প্রে করেছিল আমিরনের অগোচরে, মরণ আসলেও যেন দুণ্ড পরে আসে! নিদেন বেগানা নারী ছেড়ে, বিগতযৌবনা স্ত্রীর শেষরাতের শয্যায় গড়িয়ে ওঠা পরয্যন্ত। কি বোকা মেয়েটা। এ চাতুরিটুকু মহান ভাবছে। আসলে নিজেকে সুন্দরী ভেবে ভেবে মাথাটাই বিগড়ে গেছে। কম বুদ্ধির লোকের যা হয়, খারাপ পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল আশা করে। তা না হলে শরীর বেচাকিনির হাটে অমূল্য প্রেমের খোয়াব দেখবে কেন! গোরস্থানের ফ্লাড লাইটে মুখের নেকাব নামিয়ে এক যুগ তো পার করলো। আর কত। আমিরনকে জন্মের মতো ডুবাবে ওই রূপবান, যে ওর ডানহাত।
সকালেও বৃষ্টি ধরার নাম নেই। নারায়ণগঞ্জ সফর বাদ দিতে হলো। লেখাটা আর ছুঁতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে হাত খালি। বিয়ের হীরার আংটি বেচে কিছু অর্থ সমাগম হয়েছিল। আগাম ঘরভাড়া আর টুকিটাকি কেনাকাটায় ফুরিয়ে গেছে। পায়ের মলজোড়া রূপার। এ আর কি দরে বিকাবে। আব্বা মারার যাওয়ার পর মা বড়ভাইয়ের বাসা আজিমপুর উঠেছেন। ‘হায় খোদা এমন মাইয়্যা পেটে ধরছিলাম, যে নিজের ভালা-বুরা বোঝে না!’- দেখা করতে গেলেই আম্মা শুরু করেন খোদার আরশ কাঁপানো আহাজারি।
দুপুরে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছে শাহজাদের বন্ধু তোফায়েল। ‘কত দিন ভাবী, আপনের হাতের কোরমা খাই না! আমারই কপাল মন্দ। অভাগা একবেলা ডাল-ভাত খাওয়াইতে চায়, আপত্তি করেন ক্যান?’ ভাবী ডাক শুনলেই আজকাল আমার গা রি রি করে। রূপবানের তেল-মাখা-মুড়ির মতো মুড়মড়ানো ভাবী ডাক কেমন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে আমিরন। মেয়েটার গাছেরটা খাওয়া তলারটা কুড়ানো আর গেল না।
তোফায়েলের ডাল-ভাতের লাঞ্চ যাচ্ছেতাই। বেছে বেছে এমন সস্তা টাইপের চাইনিজ হোটেল সে কোত্থেকে জোগাড় করলো! ভাতের ফ্যানের মতো নুন ময়লা কর্ন স্যুপ, ফ্রায়েড রাইসটাও ঠাণ্ডা-শক্ত যেন শীতের সকালের কড়কড়া ভাত। সবচেয়ে খারাপ ছিল, শাহজাদের পক্ষ নিয়ে ওর ওকালতি। বন্ধুরা সবাই তাই করে। কোনো যুক্তি ছিল না, আমি ক্ষেপে উঠলাম। ইচ্ছা করছিল খাবারগুলি বমি করে চলে আসি। কি কথা! ভালোবাসাত থাইক্যা নাকি শাহজাদ বউ মারতো। আর কে না বউ মারে! তবে ‘আপনে অরে চরম শিক্ষা দিসেন ভাবী। আর ইহজনমে গায়ে হাত তোলার সাহস করবো না হারামজাদা। কত টাকার বাজি!’
‘তাইলে তো ভালোও বাসবো না ইহজন্মে।’ খালি প্লেটটা সামনে ঠেলে দিয়ে এতোক্ষণে চেয়ারে গা এলিয়ে বসি আমি। কে যেন বলেছিল – পাতের প্রতিটি কণা লক্ষ্মীর দানা, মা সকলরা ঝুটা করবা না! আরেক লক্ষ্মীর ঠাকুরমা সম্ভবত। বড় পরিশ্রান্ত লাগে। সামনের দেয়াল জুড়ে রঙিন কাগজের শিকলি টাঙ্গানো। সিলিং থেকে ঝুলছে ক্ষীণ লাল আলোর ডোম। গায়ে গায়ে অজস্র বেলুন হরেক রঙের, নানা আকৃতির। ফুলশয্যার রাত যেন। দিনদুপুরে ঘর অন্ধকার করে রাখে কেন এসব রেস্টুরেন্টগুলি? তোফায়েল গুনে গুনে ব্যাংকের কড়কড়া নোট হাফ প্লেটের ধনিয়া ভাজার ওপর রাখছে। এ টাকা শাহজাদের – আমি জানি। ও আরও কত কত টাকা-পয়সা পথে-ঘাটে ছড়াবে খোদা মালুম। স্বামী ভালোবাসাত থাইক্যা বউ খুন করে। এ ঠাণ্ডা মাথার খুন নয়, গরম মাথার। সেই অপ্রকৃতিস্থ চোখ আমি দেখেছি।
‘এই আফা, হুনেন না? কুমবালা থেইক্যা চা খাইবার ডাকতাছি!’ বিকালের মেঘকাটা রাঙা আলোয় ঝলকাচ্ছে রূপবান। গ্রিলের দরজায় তালা না থাকলে ও ঠিক বারান্দা ডিঙিয়ে এসে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতো, এমন আঁটঘাট বেঁধে এসেছে। ঘরের খোলা দরজা দিয়ে আমাকে চশমা পরতে দেখে রূপবান রঙিলা হাসি দেয় – ‘দেইখ্যেন আনে, ছাদে ভাইজানও আছে আইজ। তিনজনের চা লাগাইছি – জুড়ায় গেল, আইয়েন আইয়েন!’
হাতে রেস্ত নাই। দুপুর-বিকাল ভোজ। একেক জনের একেক মতলব। আমি ছাদে যাবো কি যাবো না। লেখাটা তোলা রয়েছে, এক পাক নারায়ণগঞ্জ ঘুরে না এলে আর হাত দেওয়া যাচ্ছে না। আস্ত একটা রাত সামনে – জাদুর চাদরে শুয়ে পরীর দেশে চলে যাওয়ার। আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। রূপবানের হাতে সোনার কঙ্কণ, শারজা এয়ারপোর্ট থেকে ভাইজানের কেনা। আমিরনের ছোট ছেলেটা নিচে নেমে গেল জেব্রা-ডোরার আনকোরা বল লোফাতে লোফাতে। একটু আগেই বোধ হয় মিডল ইস্ট থেকে বয়ে আনা সুটকেস আনলোড হয়েছে। কয়েক ধাপ নেমে আমাকে আগবাড়িয়ে ছাদে নিতে আসে আমিরন। পরনে সরু আকাশি পাড়ের গোলাপি জর্জেট, ব্লাউজটা রঙচটা মেরুন। স্বামীকে খুশি করতে ব্লাউজ না পাল্টেই পাটভাঙা শাড়িটা পরেছে খুব সম্ভব। আজ নতুন সেটে তিনজনের আড্ডা হবে। আমার হাত হাতে নিয়ে মৃদু চাপ দেয় আমিরন। ওর হাতটা ঘুরিয়ে এনে আমিও চেপে ধরি। মৃগীরোগীর মতো কাঁপছে ও তিরতিরিয়ে। আজ সমঝে কথা বলতে হবে আমাকে। যেন আমিরনের অতীত ঝোলা থেকে বেরিয়ে না পড়ে। তবে ওর বিশেষ অনুরোধ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘এ রাত তোমার-আমার’ আমি যেন শিস দিয়ে গাই। গানটা স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই পছন্দের।
রচনা : ২০১১
লেখক পরিচিতি
শাহীন আখতার
বিগত দুই দশক ধরে শাহীন আখতার লেখালেখি করছেন। ইতোমধ্যে সিরিয়াস লেখক হিসেবে সাহিত্য জগতে সুনাম অর্জনও করেছেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘তালাশ’ প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪১০ পুরস্কার লাভ করে। তিনি গল্প ও উপন্যাসের পাশাপাশি বেশ কিছু সাহিত্য সম্পৃক্ত বই সম্পাদনা করেছেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সতী ও স্বতন্ত্ররা- বাংলা সাহিত্যে নারী’ তিন খণ্ড অন্যতম। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে শাহীনের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘ময়ূর সিংহাসন।’শাহীন আখতার
0 মন্তব্যসমূহ