নবারুণ ভট্টাচার্যের অনাথ ‘হারবার্ট’ যদি জন্মাতো বাংলাদেশে…

অদিতি ফাল্গুনী


বছর কয়েক আগে হারবার্ট যখন প্রথম পড়ি তখন সত্যি বলতে এই বইটি নিয়ে বিপুল আলোচনার প্রেক্ষিতে আমার ভেতর যে ঐকান্তিক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল ঠিক ততটাই যে অভিনব লেগেছিল ‘হারবার্ট’ প্রথম পড়ায় তা’ কিন্ত নয়। সত্যি বলতে যতটা বিষ্মিত হয়েছিলাম নবারুণ ভট্টাচার্যেরই মা মহাশ্বেতা দেবীর বই ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’ প্রথম পড়ায় তা’ কিন্ত ‘হারবার্ট’ পড়ে হইনি। কিন্ত পরে বইটি পড়ে ধীরে ধীরে কেমন লাগে সেটা এ লেখার শেষে গিয়ে আলোচনা করব।


সাহিত্যের পাঠক মূলত: দু’ধরণের। সিরিয়াস সাহিত্যের পাঠক ও হাল্কা সাহিত্যের পাঠক ছাড়াও আরও একটি বড় বিভাজন আছে। কিছু পাঠক চান চেনা বিষয়, চেনা আবহ ও চেনা চরিত্রগুলো নিয়েই পাঠ করতে। আর এক শ্রেণীর পাঠক সব সময়ই চান নতুন বিষয়, নতুন আবহ বা নতুন চরিত্র। এবং লেখকও লেখকের পাঠকসত্ত্বা দিয়েই নির্দ্ধারিত হয়। যে পাঠক নতুন বিষয় বা নতুন আবহ চান, তিনি লিখতে গেলেও ভিন্ন বিষয়, ভিন্ন জীবন নিয়ে চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাই বলে চেনা জীবন নিয়ে লিখলেই যে বড় কাজ হবে না তা’ কখনোই নয়। মহাশ্বেতা দেবী বা আরো পূর্ববর্তী প্রজন্মের তারাশঙ্করের লেখায় চেনা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের বাইরে যে বিপুল জনজীবন পাওয়া যায় (মহাশ্বেতার লেখায় বিহার-মধ্যপ্রদেশ-ছত্তিশগড় বা বাংলারই অসংখ্য আদিবাসী গোত্রের জীবন সংগ্রাম…বর্তমান মহাশ্বেতার রাজনৈতিক বিশ্বাস কি না কি আমি তা’ অতটা জানিও না বা আভাসে কিছু শুনেছি কিংবা তারাশঙ্করের লেখায় রাঢ়-বীরভূম অঞ্চলের বাগদি, কাহার, দুলে সহ নানা অন্ত্যজ শ্রেণীর যে অদ্ভুত বৈচিত্র্যময় জীবন পাওয়া যায়) তা’ কিন্তু বিভূতিভূষণের লেখায় বিশ শতকের শুরুর বাংলার গ্রামের এক নিম্নবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের আলেখ্যে নেই। তাই বলে কি বাতিল করা সম্ভব ‘পথের পাঁচালী?’ সেই ধৃষ্টতাই হবে না আমাদের। মাণিকের লেখায় তারাশঙ্করের মত অমন বিপুল জনজীবন না থাকলেও তার স্মার্টনেস আবার অনেক বেশি নাগরিক (ক্ষমা করবেন)। এবং মাণিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ভিন্ন ধরণের চরিত্র, প্রতিবেশ নিয়ে লেখার চেষ্টা সত্ত্বেও তুলনামূলক ভাবে পরিচিত সেই বিশ শতকের শুরুর পূর্ব বাংলার একটি গ্রামের উচ্চ ও মধ্যবর্ণের বাঙালী হিন্দু কিছু পরিবারের নিস্তরঙ্গ জীবন নিয়ে লেখা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ই এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আধুনিক, সবচেয়ে তীক্ষ্ণ ও বিমূঢ় করে দেওয়া উপাখ্যান। কমলকুমার আর অমিয়ভূষণ ত’ আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই মায়েস্ত্রো। বিষয়বস্ত ত’ বটেই… স্রেফ ভাষারীতি আর শব্দের খেলায় তারা যে অভিনবত্ব সৃষ্টি করতে পারেন তা ব্যখ্যা করা কঠিন। সত্যি বলতে ‘হারবার্ট’ শুরুতে পড়ে আমি একটু নিরাশই হয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল প্রতিবার পূজার সময় ওপার থেকে যে ঢাউস ঢাউস ‘পূজা সংখ্যা’গুলো আসে সেখানেও অসংখ্য লেখকের অসংখ্য লেখায় এমন একান্নবর্তী তবে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসা বনেদী বাড়ি, তাদের নিশ্চল গতানুগতিকতা, ক্লান্তি ও ক্ষীণতার কাহিনী আমি পড়েছি। হয়তো তারা সেই আখ্যানের সাথে কিছু বাণিজ্যিক চটক যুক্ত করেন যা এখানে নেই তবু তেমন নতুন কিছু ত’ এখানে আমি পাচ্ছি না। সত্যি বলতে শুরুতে আমার একটু হতাশাও লেগেছে।

দেশভাগের পর সঙ্গতভাবেই দুই বাংলার জীবন ও সেই সাথে সাহিত্যের বিষয়েও কিছু ভিন্নতা ত’ এসেছেই। এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে খ্যাতনামা লেখক শাহীন আখতার বা শাহীন আপা যিনি তার প্রথম বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রে বছর দুই কলকাতায় ছিলেন একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘কলকাতার জীবনের সাথে ঢাকার জীবনের বড় পার্থক্য হলো এক ঢাকার অধিকাংশ পরিবারেরই কোন না কোন ছেলে বা মেয়ে…শিক্ষিত পরিবারের হলে উচ্চশিক্ষায় বা চাকরির জন্য ইউরোপ-আমেরিকা বা সবচেয়ে গরীব পরিবারের ছেলেটিও শ্রমিক হতে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর যেতে নিজেকে কখনো প্লেনের চাকায় বাঁধছে, কখনো ভিন্ন দেশে যেতে আশি দিন সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্ত আমাদের জীবনে গতিশীলতা বেশি। এমনকি তুমি-আমি যারা সারা জীবন ঢাকা শহরে থাকার মতো কুঁড়ে তারাও হয়তো তিন বছর পর পর বাসা বদলাচ্ছি। আজো ঢাকার অধিকাংশ নাগরিক ভাড়াটিয়া। তিনশো বছরের শহর কলকাতায় অনেক পরিবার আছে যাদের ঐ শহরে নিজেদের বাড়ির বয়স হয়তো দেড়শো বছর। একান্নবর্তী এসব পরিবারে কেউ কাজ করে, কেউ করে না। পুরণো বাড়ি বদলায়ও না। হয়তো জায়গায় জায়গায় সংস্কার করে থাকছে। ঢাকার অধিকাংশ পরিবার নিউক্লিয়ার। কলকাতায় আজো একান্নবর্তীতা বেশি। ফলে ঝগড়া-ঝাটি করেও দিনের পর দিন, বছরের পর বছর…এমনো হয় যে একটি মানুষ একই বাড়ি, একই পাড়ায় জন্ম থেকে মৃত্যু কাটিয়ে দিল।’

শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বেশ বড়সর রাষ্ট্র পাকিস্থানের গণহত্যাকে চ্যালেঞ্জ করে। অবশ্যই ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নের মত বড় দেশগুলোর সর্বাত্মক সমর্থন আমাদের সাহায্য করেছে। তারপরও একটি ছোট্ট ভূখণ্ডের দেশ যখন স্বাধীন হয়, চাক বা না চাক তার অবস্থা হয় বড় বাড়ির বিদ্রোহ করে বের হয়ে যাওয়া ছেলে বা মেয়েটির মতোই। তার যে ভাই বা বোণ বিদ্রোহ না করে বড় বাড়িতে মানিয়ে নিল, তার ঝড়-ঝাপটা কম, বিকশিত হবার সুযোগও কম। বাংলাদেশ দু’বার বিদ্রোহ করে ঘর পালানো ছেলে। প্রচণ্ড দূর্বল অর্থনীতি…প্রথমে বৃটিশ আমলে আর পরে পাক আমলে কোন কল-কারখানা হয়নি…কোথায় তার কর্মসংস্থান? হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৪-এ ওআইসিতে যোগ দেওয়া (যার মূল্য হয়তো তার জীবনের উপর দিয়ে গেছে) বা ১৯৭৫ পরবর্তী ইসলামীকরণের সুযোগে হোক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় স্রেফ ঝাড়ুদার, রাস্তা বানানোর মজুর থেকে শুরু করে সব ধরণের কাজে যোগ দান করতে জমি-জমা, ঘর-বাড়ি বিক্রি করে ছুটলো লক্ষ লক্ষ যুবক। এর অসম্ভব ভাল কিছু সুফলও পাওয়া গেলো। এই যুবকদের হাড়-মাংস নিংড়ে অর্জিত পেট্রো ডলারে বাংলাদেশে নতুন নতুন রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি নির্মিত হতে থাকলো। একটু একটু করে পাওয়া যেতে থাকলো বৈদেশিক বিনিয়োগ, প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য। আজ বাংলাদেশের জিডিপি ছয় শতাংশের বেশি যার দু’টো প্রধান স্তম্ভ হলো বৈদেশিক রেমিট্যান্স ও পোশাক কারখানার রপ্তানী। সবটাই বড় বাড়ি থেকে দু’বার বিদ্রোহ করে পালানো ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর গল্প।

পাশাপাশি ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’র বিপুল বৌদ্ধিক-সৃজনশীল-মননশীল সাফল্যের সম্ভারের ঐতিহ্য নিয়েও স্বাধীর রাষ্ট্রের তুলনায় একটি প্রদেশের আর্থিক অবিকাশমানতা, গতিহীনতা বা স্থবিরতা কিছুটা হলেও ভর করেছে কি ওপার বাংলায়? এবং সেই সাথে তার সাহিত্যেও? সেই একই রকমের আড্ডা, চায়ের দোকানে বেকার ছেলেদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলতানি মারার দৃশ্য…একই যেন ছবি! দেশভাগের সময় গোটা বাংলা ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ পাওয়া বাংলাদেশে আজো দুই প্রজন্ম ধরে রাজধানীবাসী মানুষের শতাংশ হার খুবই কম। প্রতি ঈদে, পূজায় বা এমনকি সপ্তাহান্তেও অসংখ্য মানুষ নানা কাজে ‘দেশের বাড়ি’ যান। পোশাক কারখানার বিপ্লব গ্রাম থেকে ৯০ লাখ বা এক কোটির মত নারী শ্রমিককে শহরের কারখানায় তুলে এনেছে। এনজিওদের কাজের কারণেও নারীর শ্রম গতিশীলতা অনেক বেশি। বাংলাদেশে তাই আমি এনজিও খাতে কাজ করা অনেক দম্পতি দেখেছি যাদের স্বামীটি হয়তো উত্তর বাংলায় দিনাজপুরে আর স্ত্রী সমুদ্র শহর কক্সবাজারে কাজ করছেন। মূল লক্ষ্য বেশি আয়, সন্তানের জন্য উন্নততর জীবন যাপন। সন্তান হয়তো মানুষ হচ্ছে মা বা শাশুড়ির কাছে। না, ধর্ম এক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা নয়। এমনকি হিজাবি নারীরাও কেউ কেউ স্বামীকে দেশের এক প্রান্তে ফেলে আর এক প্রান্তে চাকরি করছেন। পাশাপাশি কোলকাতার টেলি সিরিয়ালগুলোতে দেখছি সারাদিনই একান্নবর্তী সংসারে বিবিধ আত্মীয়তার বুনোট…তার ক্লেদ-হিংসা-লড়াই, অদ্ভুত সব কূটকচালী মেয়েলীপনা…কর্মজীবী নারী চরিত্র খুব কম এবং যারা আছে তারা সবাই খল চরিত্র। পাশাপাশি ঢাকার টিভি বিজ্ঞাপনে আজ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা নারী শ্রমিকের মাস শেষে দেশের বাড়ি মোবাইলে গরীব বাবা-মা’কে টাকা ‘বিকাশ’ করে পাঠানোর দৃশ্য! তরুণ নারী শ্রমিকের শহরে আসার পথে বাবার সাথে মোবাইল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত থাকার আশ্বাসের বিজ্ঞাপন। সব দেখে-শুনে বিষ্ময় লাগে দেখে যে ৩৪ বছরের সিপিএম শাসিত পশ্চিম বাংলায় নারীর অবস্থান কি তবে আজো শ্বশুরবাড়ির প্রতিটি আত্মীয়ের মন যুগিয়ে চলায়? কই, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গীবাদ বা পলিটিক্যাল ইসলামের কিছু উত্থানের পরও আজ এখানে একজন মসজিদের মাওলানাও একজন কর্মজীবী নারীকে তার আয় করা বা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ণের কারণে সম্ভ্রমের চোখেই দ্যাখেন? সংসারের আর্থিক উন্নতি বা বাঁচার সংগ্রামে অসংখ্য নারী স্বামী-সন্তান থেকে দূরে চাকরি করলেও সেটা নিয়ে ত’ কোন সমস্যা নেই? আমাদের সাহিত্যেও তাই আজ ঢাকায় চাকরিরত বরের কাছে চট্টগ্রাম থেকে উইক-এণ্ডে বাসে ফেরা বউয়ের গল্প আসছে। কলকাতার সাহিত্য পড়লে ইদানীং আমার বোধ হয় গোটা পশ্চিম বাংলাই কি কলকাতা নামে একটা শহরের ভেতর বাস করে? একটা প্রকা- বড় নগরী এবং তার বাইরে কিচ্ছু নেই? কিচ্ছুই কি নেই? কেমন হাঁসফাঁস লাগতে থাকে!

মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে চলে যাবার কারণে দু:খিত। ‘হারবার্ট’ প্রথম পড়ায় যে কারণে আমার ভাল লাগেনি তা’ হলো সেই একই পাড়ার গলি, রোয়াক বা রকের আড্ডা, একই অচল একটা জীবনের গতানুগতিকতা। তবে যেকারণে এই উপন্যাস ওপার বাংলার অসংখ্য মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে তা’ হয়তো দেশভাগোত্তর গতিহীন সেই জীবনেরই অনুপুঙ্খ বর্ণনা…বাংলাদেশে হলে ‘হারবার্ট’ হয়তো বাবা-মা’র মৃত্যুর পর রাস্তায় বড় হতো। বাংলাদেশে একান্নবর্তী পরিবার নেই তা’ বলবো না। পিতৃব্যরা ‘দায়িত্ব’ করে না তা-ও নয়। তবে, হয়তো ভ্রাতুষ্পুত্রের হাতে মার খাওয়া হয় হারবার্টের যে পুরণো, জড়গ্রস্থ সংসারের ‘ছায়া’য়, তেমন ‘ছায়া’ এপারে নেই। বাংলাদেশে হারবার্ট হয়তো এতিম খানায় বড় হতো। কিংবা এতিমখানায়ও না। সে হয়তো রাস্তায় ‘টোকাই’ হতো। এলোমেলো জঞ্জাল কুড়াতো, আওয়ামি লীগ বা বিএনপির মিছিলে শ্লোগান দিয়ে বিশ টাকা আয় করতো, বড় হয়ে ফুটপাথে জিনিষপত্র বেচতো, হকার হতো বা ফেন্সিডিলের ব্যবসা করতো। হয়তো এর ভেতরেই সামান্য আয়েই সে বিয়ে করতো। সে বড় ব্যবসায়ীও হয়ে যেতে পারতো। আবার কোন রাজনৈতিক দলের ভাড়া খাটা আর্মস ক্যাডার হিসেবে মারাও যেতে পারতো। হয়তো সে মালয়েশিয়ার কোন রাস্তায় অবৈধ নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জেলখানায় ধরা পড়তো। তার লাশ আসতো কফিনে বয়ে। কফিনে লাশ আসার আগে হয়তো মালয়েশিয়ায় কোন চৈনিক গণিকার সাথে তার কিছু সম্পর্কও হতো। কিন্তু এই যে ক্ষয়িষ্ণু হলেও একান্নবর্তী, মধ্যবিত্ত সংসারে পিতৃ-মাতৃহীণ এবং মূলত: ভৃত্যের স্ট্যাটাসেই হয়তো একটি মানুষের ঘোর একাকী ও সম্মানহীন জীবন পার করা, ব্যর্থ নকশাল বিপ্লবের পর সেই ব্যর্থ বিপ্লবের উত্তর প্রজন্ম হারবার্টের জ্যোতিষীর সুনাম পাওয়া ও সেটাও ব্যর্থ হওয়া…ঠিক এই জীবনটা বাংলাদেশের ‘হারবার্টে’র হতো না। দেশভাগোত্তর পশ্চিম বাংলার কিছুটা গতিহীন, ক্ষয়গ্রস্থ মধ্যবিত্ত জীবনের এই কালো চিত্রই কি এঁকেছিলেন নবারুণ?

শার্ল বোদল্যেয়ার কথিত সেই ‘লে ফ্লরস দ্যু মাল’ বা অশুভ পুষ্পায়ণ যা পুরণো মদের মতই যে কোন বড় ও বনেদি নগরীর নাগরিকত্বের চিত্র যা কলকাতার সাহিত্যে পাওয়া গেলেও মাত্র ষাট বছর ধরে নাগরিক হয়ে উঠতে থাকা…সদ্য কৃষিজীবী হতে উত্থিত একটি জনগোষ্ঠির নগরী ঢাকার সাহিত্যে যা পাওয়া যায় না? ফরাসী ভাষায় যাকে বলা হয় ‘এন্যুই’ বা ক্লান্তিকর, নাগরিক নির্বেদ তা ত’ আমাদের আজও নেই। আমাদের এখানে আজও কয়েকশ নদীতে বছরে দু’বার বন্যা হয়। ঢাকার বাজারে টাটকা কাঁচা সব্জির মতোই খুনাখুনি আর মৃত্যুর ভেতরেও জীবন এখানে ভয়ানক জীবন্ত। কারখানায় পুড়ে মরার আশঙ্কা মাথায় নিয়েই ফুলবানু-রহিমা-পরীরা মাস শেষে লিপস্টিক-কাজল-আলতা কেনার স্বপ্ন নিয়েই প্রতি সকালে হৈ চৈ করতে করতে কারখানায়ও যায়? সে পুড়ে মরলে মরবে; না মরলে ত’ মাস শেষে লিপস্টিক আর চুড়ি কিনতে পারবেই! তার জীবনের এক প্রান্তে প্রতিমূহুর্তে পুড়ে কয়লা হওয়ার ভয় ও আর এক প্রান্তে মাস শেষে বাবা-মা’কে গ্রামে টাকা পাঠানো ও চুড়ি-কাজল কেনার জীবন্ত স্বপ্ন! এক রাতে যে চরবাসী কৃষকের চর ডুবে যায় আবার নতুন চর ওঠে সেই চরের মানসিকতা এটা। অসম্ভব গোঁয়াড় ও জীবনকে শেষপর্যন্ত দেখে নেবার সঙ্কল্প যা দু’তিন শতাব্দীর ‘ভদ্রলোকি’ সাহিত্যে নেই সেই ‘ভদ্রলোকি’ সাহিত্যের সব অর্জন সহই। সম্ভবত: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরই কোন উপন্যাসে পড়েছিলাম যে কৃষকের জীবনে ‘ভিটামিন’ থাকে। এত রাজনৈতিক অস্থিরতার পরও আমাদের সদ্য কৃষক জীবন পার করা ঢাকায় ‘ভিটামিন’ আছে। এই কাঁচা সজীবতার উচ্ছাস আমাদের জীবনে ও খানিকটা সাহিত্যেও। মুস্কিল হলো যখন আমাদের লেখকেরা কলকাতার সাহিত্য নকল করেন। এ জন্যই বাংলাদেশের খুবই বিচিত্র, ঘটনাবহুল জীবনটা আমরা যথাযথভাবে সাহিত্যে আনতে পারছি না। মাথায় তিনশো বছরের কর্তৃত্ববাদী সাহিত্যের ফ্রেম। ঠিক যেভাবে মেয়েরা ছেলেদের মত লিখতে চায়। তা’ কেন? কৃষক কৃষকের ভাষায় লিখবে- পুরোহিতের ভাষায় নয়। নারীও নারীর ভাষায় লিখবে- পুরুষের মতো নয়।

সত্যি কথা বলতে সাম্প্রতিক সময়ের পশ্চিম বাংলার ফিকশন পড়ে ঠিক এই কারণেই আমি পূর্ণ স্বাদ পাই না। যেন ফ্রিজের বহুদিনের মাছ রাঁধুনীর নানা কারিগরী ও মশলায় সিক্ত। আমাদের এখানে রাঁধুনীরা আজো কাঁচা, মশলা নিতান্ত কম তবে মাছ ও সব্জি টাটকা। দু:খিত প্রায় স্থূল উদাহরণের জন্য।

নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘হারবার্টে’র একইসাথে বিপুল পাঠক ও সমালোচক নন্দিত হওয়ার কারণ বোধ করি এটাই যে তিনশো বছরের পুরণো একটি নগরীর ক্ষয়গ্রস্থ, গতিহীন মধ্যবিত্ত জীবনের (হয়তো মনমোহন সিংয়ের নিউ লিবারেলিজমের পর সেই জড়তা ভালই হোক বা মন্দই হোক কাটতে শুরু করেছে…শুনছি নতুন প্রজন্মের অনেকেই ভারতের অন্য বড় নানা শহরে কাজের জন্য যাচ্ছেন এবং সেখানেও গতিশীলতা আসছে…তবে হারবার্ট যে সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে সেটা নকশাল আন্দোলনের পর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাবে ব্যর্থ সময়েরই কাহিনি) চূড়ান্ত ব্যর্থতার কালো কাহিনী এঁকেছেন তিনি। নিজেরই গর্ভধারীনী মা ও কালোত্তীর্ণ লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর মতো সাঁওতাল-কোল-ভীল-মুন্ডার অন্যতর ভূগোল ও ইতিহাসে সন্ধান না করে প্রতিদিনের নষ্ট নাগরিকতা ও দিনযাপনের অসহ্য গ্লানির মধ্যবিত্ত পাপক্ষয়ের কাহিনী শোনায় বলেই ‘হারবার্ট’ এত প্রিয় হয়েছে পাঠক ও সমালোচকেরও।

ব্যক্তিগতভাবে আমি নবারুণের কবিতার বেশি অনুরাগী তাঁর কথা সাহিত্যের চেয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. "ঢাকার বাজারে টাটকা কাঁচা সব্জির মতোই খুনাখুনি আর মৃত্যুর ভেতরেও জীবন এখানে ভয়ানক জীবন্ত। কারখানায় পুড়ে মরার আশঙ্কা মাথায় নিয়েই ফুলবানু-রহিমা-পরীরা মাস শেষে লিপস্টিক-কাজল-আলতা কেনার স্বপ্ন নিয়েই প্রতি সকালে হৈ চৈ করতে করতে কারখানায়ও যায়? সে পুড়ে মরলে মরবে; না মরলে ত’ মাস শেষে লিপস্টিক আর চুড়ি কিনতে পারবেই! তার জীবনের এক প্রান্তে প্রতিমূহুর্তে পুড়ে কয়লা হওয়ার ভয় ও আর এক প্রান্তে মাস শেষে বাবা-মা’কে গ্রামে টাকা পাঠানো ও চুড়ি-কাজল কেনার জীবন্ত স্বপ্ন!" কী সত্যি !!!

    উত্তরমুছুন