‘দি আউটসাইডার’ এর শৈলী নিয়ে পাঠ-অনুভূতি যারা যারা ড্যানি বয়েলের ‘The Beach’ মুভিটা দেখেছেন, তারা একটা বিষয় নিশ্চয় খেয়াল করে থাকবেন; পুরোটা মুভি বলা হচ্ছে সেই মুভির নায়ক ডি ক্যাপ্রিও এর জবানিতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নায়ক অনেক বার বিপদের সম্মুখীন হয়, এর ভেতর কয়েকবার তো ভয়াবহ বিপদের সামনে পড়ে, আর তখন আমরা উদ্বেগে প্রমাদ গুণতে থাকি নায়কের জন্য! কিন্তু যারা সতর্ক দর্শক, তাঁরা এমনটা মোটেও করবেন না, করেনও নি খুব সম্ভব, কেননা তারা তো জানেন যে, এই গল্পের নায়ক যেহেতু ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ঘটনাগুলো স্মৃতিচারণ করছেন, সুতরাং এই যে চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে- এগুলো অনেক অতীত ঘটনা এবং নায়ক শেষমেশ বেঁচে-বর্তে আছেন বলেই তো আজ সমুদ্রপাড়ে হেঁটে হেঁটে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলে যেতে পারছেন!
যখন সেই সতর্ক দর্শক এটা বুঝে ফেলেন তখন তার দেখার মত একটা বিষয় থাকে সেই মুভিতে। তা হচ্ছে, সে তখন নির্ভার মনে ঘটনাগুলো ‘কীভাবে’ ঘটছে, তা উপভোগ করে যেতে পারেন। এবং, মোটামুটি নির্ভার চিত্তেই অপেক্ষা করতে পারেন এটা দেখার জন্য যে, নায়ক শেষমেশ কীভাবে সেই দ্বীপ ছেড়ে আবার তার সাধারণ জীবনে ফিরে আসল! অভিজ্ঞ পাঠক বা দর্শকের কাছে যখন সেই বালসুলভ ‘সাসপেন্স’ আবেদন হারিয়ে ফেলে, তখন এমন শৈলী চোখে আরামই দেয় বটে। এবার আসি, ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যু’র বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘দি আউটসাইডার’ বা ‘দি স্ট্যাঞ্জার’ (একি উপন্যাস) এর সম্পর্কে। এনিয়ে রিভিউ লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। খুব সম্ভব রিভিউ লেখার মত পাঠ এখনো করা হয়ে ওঠেনি। আমি শুধু এই উপন্যাসের শৈলী নিয়ে আমার পাঠ-অনুভূতি জানাতে চাই।
যখন সেই সতর্ক দর্শক এটা বুঝে ফেলেন তখন তার দেখার মত একটা বিষয় থাকে সেই মুভিতে। তা হচ্ছে, সে তখন নির্ভার মনে ঘটনাগুলো ‘কীভাবে’ ঘটছে, তা উপভোগ করে যেতে পারেন। এবং, মোটামুটি নির্ভার চিত্তেই অপেক্ষা করতে পারেন এটা দেখার জন্য যে, নায়ক শেষমেশ কীভাবে সেই দ্বীপ ছেড়ে আবার তার সাধারণ জীবনে ফিরে আসল! অভিজ্ঞ পাঠক বা দর্শকের কাছে যখন সেই বালসুলভ ‘সাসপেন্স’ আবেদন হারিয়ে ফেলে, তখন এমন শৈলী চোখে আরামই দেয় বটে। এবার আসি, ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যু’র বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘দি আউটসাইডার’ বা ‘দি স্ট্যাঞ্জার’ (একি উপন্যাস) এর সম্পর্কে। এনিয়ে রিভিউ লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। খুব সম্ভব রিভিউ লেখার মত পাঠ এখনো করা হয়ে ওঠেনি। আমি শুধু এই উপন্যাসের শৈলী নিয়ে আমার পাঠ-অনুভূতি জানাতে চাই।
উপন্যাসটা উত্তম পুরুষে লেখা। গল্পের কথক নায়ক মারসো। অর্থাৎ মারসো পুরো ঘটনাটা বলছেন। কাহিনি খুব সরল। মারসোর মা মারা গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। তারপর সেখানে প্রথানুযায়ী গিয়ে মায়ের শবানুগমন, সেখান থেকে ফিরে নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্মের খুঁটিনাটি বর্ণনা। পাশের ফ্ল্যাটের এক পতিতার দালালের সাথে হৃদ্যতা, তার সাথে ঘুরতে গিয়ে বিচে দালালটার সাথে এক আরবকে ‘ঘটনাচক্রে’ খুন, তারপর গ্রেফতার এবং সবশেষে মারসোর মৃত্যুদন্ড। যারা ‘দি বিচ’ মুভিটা দেখেছেন এবং একিসাথে ‘দি আউটসাইডার’ পড়েছেন, তারা এ দুয়ের মাঝে শৈলীগত মিল-অমিল খুঁজে পাবেন। বইয়ের দ্বিতীয় ভাগ থেকে, বিশেষ করে যখন থেকে তাঁর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন থেকেই মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে যে, গল্পটা ‘দি বিচ’ মুভির মতই স্মৃতিচারণমূলক হয়ে থাকবে; স্বাভাবিকভাবে ধরেই নিয়েছিলাম যে, যেহেতু গল্পটা বলছেন স্বয়ং আসামি, তাই আর যাই হোক নায়কের মৃত্যুদন্ড হবে না। হলেও, শেষতক দেখব বাংলা সিনেমার মত কোন এক ফাঁক গলে ঠিকই বেরিয়ে পড়ছেন। কিন্তু এই উপন্যাসে তা হয় নি। এবং, এটা অতীত স্মৃতিচারণমূলক গল্প নয়, ঘটে যাওয়া বর্তমান অভিজ্ঞতার গল্প। এতে মারসোর মৃত্যুদন্ড হয় এবং তা বলবৎ থাকে। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, তবে গল্পটা নায়ক বলল কখন? তার তো মৃত্যুই হতে যাচ্ছে! আর এতেই হয়ত লুকিয়ে আছে উপন্যাসের মূল চিন্তা!
প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। কাফকার ‘ট্রায়াল’ (বিচার) উপন্যাসের নায়ক একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে জানতে পারেন তিনি অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতার হয়েছেন। তাকে বলা হল, সে তার ইচ্ছে মত চলাফেরা করতে পারবে কিন্তু আইনের চোখে ‘নজরবন্দি’ হয়ে। এটাকে কামু এবং অন্যান্য যারা যারা ড্যানি বয়েলের ‘The Beach’ মুভিটা দেখেছেন, তারা একটা বিষয় নিশ্চয় খেয়াল করে থাকবেন; পুরোটা মুভি বলা হচ্ছে সেই মুভির নায়ক ডি ক্যাপ্রিও এর জবানিতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নায়ক অনেক বার বিপদের সম্মুখীন হয়, এর ভেতর কয়েকবার তো ভয়াবহ বিপদের সামনে পড়ে, আর তখন আমরা উদ্বেগে প্রমাদ গুণতে থাকি নায়কের জন্য! কিন্তু যারা সতর্ক দর্শক, তাঁরা এমনটা মোটেও করবেন না, করেনও নি খুব সম্ভব, কেননা তারা তো জানেন যে, এই গল্পের নায়ক যেহেতু ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ঘটনাগুলো স্মৃতিচারণ করছেন, সুতরাং এই যে চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে- এগুলো অনেক অতীত ঘটনা এবং নায়ক শেষমেশ বেঁচে-বর্তে আছেন বলেই তো আজ সমুদ্রপাড়ে হেঁটে হেঁটে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলে যেতে পারছেন! যখন সেই সতর্ক দর্শক এটা বুঝে ফেলেন তখন তার দেখার মত একটা বিষয় থাকে সেই মুভিতে। তা হচ্ছে, সে তখন নির্ভার মনে ঘটনাগুলো ‘কীভাবে’ ঘটছে, তা উপভোগ করে যেতে পারেন। এবং, মোটামুটি নির্ভার চিত্তেই অপেক্ষা করতে পারেন এটা দেখার জন্য যে, নায়ক শেষমেশ কীভাবে সেই দ্বীপ ছেড়ে আবার তার সাধারণ জীবনে ফিরে আসল! অভিজ্ঞ পাঠক বা দর্শকের কাছে যখন সেই বালসুলভ ‘সাসপেন্স’ আবেদন হারিয়ে ফেলে, তখন এমন শৈলী চোখে আরামই দেয় বটে।
এবার আসি, ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যু’র বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘দি আউটসাইডার’ বা ‘দি স্ট্যাঞ্জার’ (একি উপন্যাস) এর সম্পর্কে। এনিয়ে রিভিউ লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। খুব সম্ভব রিভিউ লেখার মত পাঠ এখনো করা হয়ে ওঠেনি। আমি শুধু এই উপন্যাসের শৈলী নিয়ে আমার পাঠ-অনুভূতি জানাতে চাই।
উপন্যাসটা উত্তম পুরুষে লেখা। গল্পের কথক নায়ক মারসো। অর্থাৎ মারসো পুরো ঘটনাটা বলছেন। কাহিনি খুব সরল। মারসোর মা মারা গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। তারপর সেখানে প্রথানুযায়ী গিয়ে মায়ের শবানুগমন, সেখান থেকে ফিরে নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্মের খুঁটিনাটি বর্ণনা। পাশের ফ্ল্যাটের এক পতিতার দালালের সাথে হৃদ্যতা, তার সাথে ঘুরতে গিয়ে বিচে দালালটার সাথে এক আরবকে ‘ঘটনাচক্রে’ খুন, তারপর গ্রেফতার এবং সবশেষে মারসোর মৃত্যুদন্ড।
যারা ‘দি বিচ’ মুভিটা দেখেছেন এবং একিসাথে ‘দি আউটসাইডার’ পড়েছেন, তারা এ দুয়ের মাঝে শৈলীগত মিল-অমিল খুঁজে পাবেন। বইয়ের দ্বিতীয় ভাগ থেকে, বিশেষ করে যখন থেকে তাঁর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন থেকেই মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে যে, গল্পটা ‘দি বিচ’ মুভির মতই স্মৃতিচারণমূলক হয়ে থাকবে; স্বাভাবিকভাবে ধরেই নিয়েছিলাম যে, যেহেতু গল্পটা বলছেন স্বয়ং আসামি, তাই আর যাই হোক নায়কের মৃত্যুদন্ড হবে না। হলেও, শেষতক দেখব বাংলা সিনেমার মত কোন এক ফাঁক গলে ঠিকই বেরিয়ে পড়ছেন। কিন্তু এই উপন্যাসে তা হয় নি। এবং, এটা অতীত স্মৃতিচারণমূলক গল্প নয়, ঘটে যাওয়া বর্তমান অভিজ্ঞতার গল্প। এতে মারসোর মৃত্যুদন্ড হয় এবং তা বলবৎ থাকে। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, তবে গল্পটা নায়ক বলল কখন? তার তো মৃত্যুই হতে যাচ্ছে! আর এতেই হয়ত লুকিয়ে আছে উপন্যাসের মূল চিন্তা!
প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। কাফকার ‘ট্রায়াল’ (বিচার) উপন্যাসের নায়ক একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে জানতে পারেন তিনি অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতার হয়েছেন। তাকে বলা হল, সে তার ইচ্ছে মত চলাফেরা করতে পারবে কিন্তু আইনের চোখে ‘নজরবন্দি’ হয়ে। এটাকে কামু এবং অন্যান্য অস্তিত্ববাদী দার্শনিকগণ অর্থ করে নিলেন যে, মানুষ জন্মাবধি নিয়তির কাছে বন্দি। তারা স্বর্গে শাস্তিপ্রাপ্ত রাজা সিসিফাসের মত অনন্তকাল এই দন্ড ঘাড়ে বয়ে চলছে। একটা পাথর পাহাড়ের উঁচু থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় আর সিসিফাসের শাস্তি হচ্ছে সে পাথর বয়ে নিয়ে উপরে ওঠা, ওঠার পর আবার ছেড়ে দেওয়া হয়, আবার তাকে তা পাহাড় ঠেলে উপরে ওঠাতে হয়- এইভাবে একি কাজ অনত কাল ধরে সে করতে থাকবে, এটাই তার শাস্তি। অর্থাৎ আমরা হচ্ছি, নিয়তিদন্ডিত প্রাণী। তাদের মতে, জন্মটাই একটা ফাঁদ। যেখানে নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনকে বাছাই করার অধিকার দেওয়া হয়নি। ট্রায়ালের নায়কের মত মৃত্যু অবধি এই ‘শাস্তি’র দন্ড মেনেই চলছে। মিলান কুন্ডেরার এনিয়ে খুবই বিখ্যাত একটা উক্তি আছে, যাতে সমস্ত সারকথা পাওয়া যায়:
‘জীবন যে একটা ফাঁদ সে কথা আমরা সবসময়ই জানি। আমরা জন্ম নিতে চাই কিনা, এটা না জিজ্ঞেস করেই আমাদের জন্ম দেয়া হয়েছে, এমন একটা শরীরে আমাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে যে শরীরটি আমরা নিজেরা পছন্দ করি নি এবং আমাদের জন্যে আবার মৃত্যু অনিবার্য করে রাখা হয়েছে।’
মারসো তার নিয়তিকে মেনে নেন। কারণ, তিনি যে জীবনটা যাপন করেন তা তার নিজের পছন্দের জীবন ছিল না। তাই তিনি জীবন যাপন না করে, একটা নিয়তি দন্ডিত জীবনকে যাপন করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি জীবনের সমস্ত কিছুকে মেনে নেন। এমনকি মৃত্যুদন্ডটাকেও! আর তাই সমাজ বা পরিবারের প্রতি কোনো ‘আন্তরিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত’ দায়িত্ব অনুভব করেন না। মায়ের মৃত্যুতে তাই তার কিছু যায় আসে না। স্মৃতি নিয়েও পড়ে থাকেন না। বর্তমানের ভেতর যা কিছু আসে আগে-পিছে কিছু না ভেবেই নিঃস্পৃহভাবে তা গ্রহণ করেন এবং মেনে নেন। যে জীবন তিনি নিজে বেছে নেন নি, সে জীবন ত তার কাছে বোঝা, এখন একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে তা যেন সহনীয় হয়ে ওঠে যাপনের জন্য, তার চেষ্টা করা- কিন্তু তা যে করতেই হবে, এমন কোনো আন্তরিক তাগিদ তিনি অনুভব করেন না। সমাজে সর্বজন স্বীকৃত সামাজিক দায়-দায়িত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি সামাজিক মুখোশ তিনি মেনে না চলে, মেনে চলেন ‘হৃদয়ের অবিরল যুক্তি’! তিনি যা অনুভব করেন, তাই বলেন ভণিতা ছাড়াই। কিন্তু সমাজ পছন্দ করে সমষ্টিকে শ্রদ্ধা করে, মেনে চলে যারা,- এমন কাউকে। কিন্তু তিনি তার বিপরীত, তাই তিনি সমাজ বা পৃথিবীর একজন আগুন্তুক মাত্র। কবি সজল সমুদ্র মনে করেন, "এজরা পাউন্ডের একটা কথা আছে, ‘শিল্পীরা হলেন সমাজের অ্যান্টেনা।’ কাম্যুকে আমার বরাবর ঐ অ্যান্টেনা মনে হয়। আউটসাইডার-এর নায়ক তার অভিজ্ঞতাকে অর্থহীন বলে মনে করে। তার কাছে জীবন, নৈতিকতা এবং পৃথিবীর কোন অর্থ নেই।’ ঐ সময়ে লেখায় এমন চিন্তা ধারণ করেছেন কাম্যু, ভাবা যায়! জ্যঁ পল সার্ত্র কাম্যু প্রসঙ্গে লিখেছেন-- ‘প্রত্যেকটি স্তব্ধ জীবন, এমন কি কাম্যুর মত একজন যুবকের জীবনও-- একই সঙ্গে বাজতে বাজতে ভেঙ্গে যাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের মত।’"
আর তাই, গল্পটা বলা হচ্ছে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত এক আসামির জবানিতে। যে কিনা জন্ম থেকেই মাথায় এক ধরণের নিয়তি দন্ডিত বন্দি-পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন। তার মুক্তি কখনোই ঘটে নি। এই পরিণতিই তার একিসাথে আত্মিক এবং সামাজিক বাস্তবতা। কেননা, সমাজ ‘অসামাজিক’ কাউকে ঠাঁই দেয় না, এবং, নিজেকে যে নিয়তি দন্ডিত মানুষ মনে করে আত্মিক সংকটে ভুগে।
এই গল্প এইভাবে বলাতে গল্পে যে মেসেজ দেওয়া হয়েছে, তার সমস্ত চিন্তাসূত্র শৈলীতেই লুকিয়ে আছে বলে মনে হয়েছে। অনেকে বলেন, গল্পের শৈলী তেমন বড় কিছু না। সেটা তাদের কাছে সঠিক হতে পারে কিন্তু আমার মনে হয়, মনে রাখা দরকার, শৈলীটা হচ্ছে, গল্পের শরীর। মানুষের বাহ্যিক অঙ্গভঙ্গি, পোশাক-আশাক, কথা বলার ঢং, চলাফেরা- তার ভেতরের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাভাবনা ধারণ করে, তেমনি, গল্পের শৈলীও তেমন। গল্পের মেসেজ ধারণ করে। দি আউটসাইডারের মত।
এবার আসি, ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যু’র বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘দি আউটসাইডার’ বা ‘দি স্ট্যাঞ্জার’ (একি উপন্যাস) এর সম্পর্কে। এনিয়ে রিভিউ লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। খুব সম্ভব রিভিউ লেখার মত পাঠ এখনো করা হয়ে ওঠেনি। আমি শুধু এই উপন্যাসের শৈলী নিয়ে আমার পাঠ-অনুভূতি জানাতে চাই।
উপন্যাসটা উত্তম পুরুষে লেখা। গল্পের কথক নায়ক মারসো। অর্থাৎ মারসো পুরো ঘটনাটা বলছেন। কাহিনি খুব সরল। মারসোর মা মারা গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। তারপর সেখানে প্রথানুযায়ী গিয়ে মায়ের শবানুগমন, সেখান থেকে ফিরে নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্মের খুঁটিনাটি বর্ণনা। পাশের ফ্ল্যাটের এক পতিতার দালালের সাথে হৃদ্যতা, তার সাথে ঘুরতে গিয়ে বিচে দালালটার সাথে এক আরবকে ‘ঘটনাচক্রে’ খুন, তারপর গ্রেফতার এবং সবশেষে মারসোর মৃত্যুদন্ড।
যারা ‘দি বিচ’ মুভিটা দেখেছেন এবং একিসাথে ‘দি আউটসাইডার’ পড়েছেন, তারা এ দুয়ের মাঝে শৈলীগত মিল-অমিল খুঁজে পাবেন। বইয়ের দ্বিতীয় ভাগ থেকে, বিশেষ করে যখন থেকে তাঁর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন থেকেই মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে যে, গল্পটা ‘দি বিচ’ মুভির মতই স্মৃতিচারণমূলক হয়ে থাকবে; স্বাভাবিকভাবে ধরেই নিয়েছিলাম যে, যেহেতু গল্পটা বলছেন স্বয়ং আসামি, তাই আর যাই হোক নায়কের মৃত্যুদন্ড হবে না। হলেও, শেষতক দেখব বাংলা সিনেমার মত কোন এক ফাঁক গলে ঠিকই বেরিয়ে পড়ছেন। কিন্তু এই উপন্যাসে তা হয় নি। এবং, এটা অতীত স্মৃতিচারণমূলক গল্প নয়, ঘটে যাওয়া বর্তমান অভিজ্ঞতার গল্প। এতে মারসোর মৃত্যুদন্ড হয় এবং তা বলবৎ থাকে। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, তবে গল্পটা নায়ক বলল কখন? তার তো মৃত্যুই হতে যাচ্ছে! আর এতেই হয়ত লুকিয়ে আছে উপন্যাসের মূল চিন্তা!
প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। কাফকার ‘ট্রায়াল’ (বিচার) উপন্যাসের নায়ক একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে জানতে পারেন তিনি অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতার হয়েছেন। তাকে বলা হল, সে তার ইচ্ছে মত চলাফেরা করতে পারবে কিন্তু আইনের চোখে ‘নজরবন্দি’ হয়ে। এটাকে কামু এবং অন্যান্য অস্তিত্ববাদী দার্শনিকগণ অর্থ করে নিলেন যে, মানুষ জন্মাবধি নিয়তির কাছে বন্দি। তারা স্বর্গে শাস্তিপ্রাপ্ত রাজা সিসিফাসের মত অনন্তকাল এই দন্ড ঘাড়ে বয়ে চলছে। একটা পাথর পাহাড়ের উঁচু থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় আর সিসিফাসের শাস্তি হচ্ছে সে পাথর বয়ে নিয়ে উপরে ওঠা, ওঠার পর আবার ছেড়ে দেওয়া হয়, আবার তাকে তা পাহাড় ঠেলে উপরে ওঠাতে হয়- এইভাবে একি কাজ অনত কাল ধরে সে করতে থাকবে, এটাই তার শাস্তি। অর্থাৎ আমরা হচ্ছি, নিয়তিদন্ডিত প্রাণী। তাদের মতে, জন্মটাই একটা ফাঁদ। যেখানে নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনকে বাছাই করার অধিকার দেওয়া হয়নি। ট্রায়ালের নায়কের মত মৃত্যু অবধি এই ‘শাস্তি’র দন্ড মেনেই চলছে। মিলান কুন্ডেরার এনিয়ে খুবই বিখ্যাত একটা উক্তি আছে, যাতে সমস্ত সারকথা পাওয়া যায়:
‘জীবন যে একটা ফাঁদ সে কথা আমরা সবসময়ই জানি। আমরা জন্ম নিতে চাই কিনা, এটা না জিজ্ঞেস করেই আমাদের জন্ম দেয়া হয়েছে, এমন একটা শরীরে আমাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে যে শরীরটি আমরা নিজেরা পছন্দ করি নি এবং আমাদের জন্যে আবার মৃত্যু অনিবার্য করে রাখা হয়েছে।’
মারসো তার নিয়তিকে মেনে নেন। কারণ, তিনি যে জীবনটা যাপন করেন তা তার নিজের পছন্দের জীবন ছিল না। তাই তিনি জীবন যাপন না করে, একটা নিয়তি দন্ডিত জীবনকে যাপন করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি জীবনের সমস্ত কিছুকে মেনে নেন। এমনকি মৃত্যুদন্ডটাকেও! আর তাই সমাজ বা পরিবারের প্রতি কোনো ‘আন্তরিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত’ দায়িত্ব অনুভব করেন না। মায়ের মৃত্যুতে তাই তার কিছু যায় আসে না। স্মৃতি নিয়েও পড়ে থাকেন না। বর্তমানের ভেতর যা কিছু আসে আগে-পিছে কিছু না ভেবেই নিঃস্পৃহভাবে তা গ্রহণ করেন এবং মেনে নেন। যে জীবন তিনি নিজে বেছে নেন নি, সে জীবন ত তার কাছে বোঝা, এখন একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে তা যেন সহনীয় হয়ে ওঠে যাপনের জন্য, তার চেষ্টা করা- কিন্তু তা যে করতেই হবে, এমন কোনো আন্তরিক তাগিদ তিনি অনুভব করেন না। সমাজে সর্বজন স্বীকৃত সামাজিক দায়-দায়িত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি সামাজিক মুখোশ তিনি মেনে না চলে, মেনে চলেন ‘হৃদয়ের অবিরল যুক্তি’! তিনি যা অনুভব করেন, তাই বলেন ভণিতা ছাড়াই। কিন্তু সমাজ পছন্দ করে সমষ্টিকে শ্রদ্ধা করে, মেনে চলে যারা,- এমন কাউকে। কিন্তু তিনি তার বিপরীত, তাই তিনি সমাজ বা পৃথিবীর একজন আগুন্তুক মাত্র। কবি সজল সমুদ্র মনে করেন, "এজরা পাউন্ডের একটা কথা আছে, ‘শিল্পীরা হলেন সমাজের অ্যান্টেনা।’ কাম্যুকে আমার বরাবর ঐ অ্যান্টেনা মনে হয়। আউটসাইডার-এর নায়ক তার অভিজ্ঞতাকে অর্থহীন বলে মনে করে। তার কাছে জীবন, নৈতিকতা এবং পৃথিবীর কোন অর্থ নেই।’ ঐ সময়ে লেখায় এমন চিন্তা ধারণ করেছেন কাম্যু, ভাবা যায়! জ্যঁ পল সার্ত্র কাম্যু প্রসঙ্গে লিখেছেন-- ‘প্রত্যেকটি স্তব্ধ জীবন, এমন কি কাম্যুর মত একজন যুবকের জীবনও-- একই সঙ্গে বাজতে বাজতে ভেঙ্গে যাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের মত।’"
আর তাই, গল্পটা বলা হচ্ছে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত এক আসামির জবানিতে। যে কিনা জন্ম থেকেই মাথায় এক ধরণের নিয়তি দন্ডিত বন্দি-পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন। তার মুক্তি কখনোই ঘটে নি। এই পরিণতিই তার একিসাথে আত্মিক এবং সামাজিক বাস্তবতা। কেননা, সমাজ ‘অসামাজিক’ কাউকে ঠাঁই দেয় না, এবং, নিজেকে যে নিয়তি দন্ডিত মানুষ মনে করে আত্মিক সংকটে ভুগে।
এই গল্প এইভাবে বলাতে গল্পে যে মেসেজ দেওয়া হয়েছে, তার সমস্ত চিন্তাসূত্র শৈলীতেই লুকিয়ে আছে বলে মনে হয়েছে। অনেকে বলেন, গল্পের শৈলী তেমন বড় কিছু না। সেটা তাদের কাছে সঠিক হতে পারে কিন্তু আমার মনে হয়, মনে রাখা দরকার, শৈলীটা হচ্ছে, গল্পের শরীর। মানুষের বাহ্যিক অঙ্গভঙ্গি, পোশাক-আশাক, কথা বলার ঢং, চলাফেরা- তার ভেতরের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাভাবনা ধারণ করে, তেমনি, গল্পের শৈলীও তেমন। গল্পের মেসেজ ধারণ করে। দি আউটসাইডারের মত।
লেখক পরিচিতি
কিঙ্কর আহসান
থাকেন জামালপুর, বাংলাদেশে।
গল্পকার, প্রবন্ধকার। ব্লগার।
1 মন্তব্যসমূহ
শৈলী টা হচ্ছে গল্পের শরীর আর গল্পকার হচ্ছে মেইকাপম্যান ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ কিঙ্কর আহসান ।