নবারুণ ভট্টাচার্য এর গল্পঃ খোঁচড়

শার্টের কলারটা শেষ হবার কাছে ঘাড় আর পিঠের মাঝামাঝি ইঞ্চি দুয়েক জায়গায় ওর একটা চুলকুনির অসুখ আছে। চামড়াটা ওখানে নরম, লোম নেই তেলতেলে আর ছিট ছিট দাগ। অসুখটা ইচ্ছের সঙ্গে বাড়ে — কমে। কাউকে খুন করার আগে জায়গাটা ভিজে দাগড়া হয়ে ফুলে ওঠে আর চিড়বিড় করে করে চুলকোয় — রস কাটে — তখন ওর চোখদুটো ঠাণ্ডা বরফকুচি হয়ে আসে আর ও বুঝতে পারে যে কারুর লাশ আনবার সময় এখন খুব কাছে। সমকামনায় সময়ের তোবড়ানো মুখটা ওর মুখে ঘষে। ইচ্ছেটা গায় রোঁয়া রোঁয়া একটা জ্যান্ত মাংসের ডেলা। ডানপকেটে সিগারেটের কালো গুঁড়ো, নোনা ঘাম আর যৌনগন্ধের মধ্যে রিভলভারের কালো কোটরটা চোখ খুলে তাকায়, শরীরটা সাড় আর অসাড় হয় একই সঙ্গে, হাতের আঙুলগুলো অবশ অথচ যান্ত্রিক হয়ে বেঁকে আসে, কালচে থ্যাবড়া নখগুলো হিম হয়ে ওঠে। চুলকুনির পোকাগুলো শিরার মধ্যে কুরতে থাকে, দাঁতের ভিতর দিয়ে হাড়ের মধ্যে চলে যায়। তখন ও মুখে থুথু জমায়, দাঁত চোষে আর জন্তুর মতো দেওয়ালে বা ভ্যানের জালে পিট ঘষে, ছেঁচড়ে গিয়ে চুলকুনিটা জ্বালা করে আর টক উদগ্র এবং বিশেষ ঘামের গন্ধ পায়। ওর ঠোঁটদুটো মোটা আর ছাল ওঠা। হাসি পায় ওর কারণ ও বুঝতে পারে এখন আর কিছুতেই কেউ ঘটনাটা আটকাতে পারবে না, মাংসের ডেলাটা যেন বলে দেয় একটু পরেই ও একটা লাশ নিয়ে ফিরবে — লাশ এখনো বেঁচে আছে — এখনো জানে না সুতরাং সতর্কতা অবান্তর প্রশ্ন। হাতের লোমগুলো সির সির করে দাঁড়িয়ে ওঠে।

লাশটা পায়ের কাছে পড়ে থাকে — উপুড় বা চিত — ও পা দিয়ে লাশটাকে খোঁচা মারে। আর ভ্যানচলার ঝাঁকুনিতে বুঝতে পারে যে মড়াটা থিতোচ্ছে। কখনো কখনো গরম থাকে, ঘিলু পোড়া চামড়া আর রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়। ওর চুলকুনিটা কমে আসে তখন, মুখের থুথুটা গিলে ফেলে শুধু ঘামের টক উগ্র গন্ধটা যায় না। গন্ধটা তাড়াবার জন্যেও সিগারেট ধরায়, সিগারেট খুজতে ডানহাতটা প্রতিবারই রিভলবার রাখার ডান পকেটে চলে যায়, রিভলভারটা ভারী লাগে আর ওর মুখের ওপর, এবড়োখেবড়ো দাঁতের ওপর চলন্ত রাস্তার আলোর ছায়ায় চকমকি কিলবিল করে। ভ্যান চলার ঝাঁকুনিতে লাশটা লাফায়, নড়াচড়া করে, মাথা নাড়ায়, সব কথায় না বলছে বা অন্ধকারের পাস ফিরে শুতে চাইছে বলে মনে হয়। জামার ওপর বুলেটের পোড়া গর্তের চারপাশে রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে থাকে, চোখদুটো অল্প খোলা বা বোজা, কখনো দমকা বাতাসে এসে বেওয়ারিশ চুলগুলো নিয়ে খেলা করে। রাস্তার আলো অন্য পুলিশদের বন্দুকের নলে চকচক করে। সবাই চুপ করে থাকে বা নিচুগলায় দোহাতি হিন্দিতে কথা বলে, হাসে। ও তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে সিগারেট খায়। লাশটার ওপর বা অন্ধকারে ছাই ফেলে, জুতো দিয়ে ছোঁয়। জিভ কাঁপিয়ে গান গায়। ঝাঁকুনিতে আর লজঝড়ে টিনের শব্দে তাল মিলিয়ে লাশটা বোকার মতো নড়াচড়া করে, লাফায়। গাড়িটা থানায় ঢোকাবার আগে জ্বলা পেট্রলের কালো ধোঁয়ায় ওর মৌজটা ভেঙে যায়। ততক্ষণে সরতে সরতে লাশটার একটা ঠাণ্ডা হাত যদি পায়ের ওপর এসে পাড় তবে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। লাশের মার নামে খিস্তি করে।
(মৃতদেহ যখন এ জাতীয় প্রস্তাবের জবাবে রা কাড়ে না তখন মৃতের নির্বাক অস্তিত্ব ও লাশসমেত সামগ্রিকতার উপর ঘাতকের কর্তৃত্ববোধ জন্মে এবং বহু অনুশীলন বা হত্যার পর ঘাতকের এই মানসিকতা যে কোনো জীবনের ন্যায় নিজস্বতা অতিক্রান্ত বিকাশ ও বিবর্তনে ক্রিয়াশীল সুতরাং যে কোনো জীবিত বাক্তিই এখন এই জটিল চিত্তানুযায়ী ক্লীব বা মড়া হইবার উপযোগী। সরকার অনুমোদিত ঘাতকের এই বিচিত্র গুণপনার সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক চৌম্বকক্ষেত্রর কোনো ভৌতিক বাণিজ্য আছে কিনা তাহা রহসাবৃত এবং এই অনুসন্ধান সম্ভবত বিপদজনক।)
লম্বা একটু কুঁজো পিঠটাকে দেওয়ালের গায়ে ঠেকিয়ে ও শুনছিল পুরোনো কেস ফাইল রাখার ধুলোপড়া কাঠের তাকটার ওপারে ভারী একটা বাড়ি মারার শব্দ হচ্ছে — ধুপ! ধুপ! — ওখানে একটা কেঁদো বুড়ো টিকটিকি আছে — ত্যালাপোকা ধরে আর কাঠের গায় আছড়ে আছড়ে মারে। দেওয়ালে মশা মারার দাগ। বিরাট সরকারি ক্যালেন্ডার। দাসের টেবিলে একটা ট্রানজিস্টার — খুব আস্তে নানারকম শব্দের মধ্যে হিন্দি খবর হচ্ছে কিন্তু দাস ঘুমোচ্ছে — আবার গান শুরু হলে ঠিক জেগে উঠবে। দেওয়ালগুলো কালচে বলে জোরালো বাল্বের আলোও মরা। বাল্ব ঝোলাবার তারে মাছি বসে। লক — আপে একটা ছেনতাই ফাঁশা গলায় গান গাইছে — কতকগুলো কথা বলার টুকরো, বুটের মচ্ মচ আওয়াজ — গানটা থেমে যায়, তালা খোলার শব্দ। ওর টেবিলে একটা খালি কোকাকোলার বোতল — একটা মাছি বার বার ভেতরে ঢুকছে আর ওর আঙুলগুলো একটু একটু নড়ছে — রেডিওটা বাজছে। ওর মনে হল একটু একটু করে ঘুম ধরছে চোখে কিন্তু বিকেলবেলা সিঙাড়া খেয়েছিল — পেটের মধ্যে গজ্ গজ্ করছে তবে সুবিধের বিষয়টা এই যে চা পড়লে অম্বলের অস্বস্তিটা দমে আসবে। চা এসে পড়ল বলে। টিকটিকিটা এখনো আরশোলাটাকে আছড়াচ্ছে (কুমীরের বাচ্চা) — তবে এখন অনেক থেমে থেমে — রেডিওর আওয়াজ আর ছেনতাই — এর গান মিশে যাচ্চে — একটু ঝুকে পড়ে ও — টিকটিকিটার পিট হলদেটে আর আরশোলাটাকে কামড়ে ধরে আছে বলে ব্যাটার পাখনাগুলো ছেৎরে আছে (সবুজ চোখদুটো ঠাণ্ডা ... আরশোলার পায় কাঁটা কাঁটা, শুঁয়োদুটো একটু একটু নড়ে, ছেনতাইটা ঝিম ঝিম করে ইনিয়েবিনিয়ে হিন্দি খবর বলছে (সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকার দুজন ঘরের কোণে খড়ের ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে — ছেনতাইটা পা ডলে দিতে বলে — কনস্টেবল হাসে) কালো একটা রং জলে (রক্ত) যেমন করে ছড়ায় তার চেয়ে অনেক আস্তে একটা (হেডলাইট দুটো কালো ঠুলি পরানো ... জলের মধ্যে ছড়াচ্ছে — জলটা চৌবাচ্চার মধ্যে ... অনেকগুলো বোমা ভিজিয়ে রাখা আছে জলে (ডি অ্যাক্টিভেট করার জন্যে) — বোমাগুলো জলের তলায় হাল্কা হয়ে যায় (আর্কিমিদিস) ... টিকটিকির শাদা পেটটা খাবার গেলার পর ফুলে ঢোল হয়ে আছে ব্লব্ ... ব্লব্ ... সাইলেন্সারে গুম হয়ে যায় আওয়াজ ... ওয়েবলি স্কট্ ... ওয়েবলি ... চামর যন্তর ... দাসটা শালা এক নম্বরের ত্যাঁদোড় ... পসথ্যুমাস পুলিশ মেডেলও পাবে না  ... পিকরিক অ্যাসিড, লাশচেরাই — এর ছড়ানো টেবিল, নাইট্রোগ্লিসারিন ... এম্পুল কেমিস্ট্রির দুঁদে দুঁদে ছেলে সব হারামির বাচ্চা — চ্চৌবাচ্চাটার মাধ্যে হাত ডুবিয়ে ও বোমাগুলো ছোঁয় ... ভিজে দড়ি জড়ানো গোল গোল ... ঠাগু অথচ ছোঁবার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাঁশ করে একটু শাদা ধোঁয়া ... ঝিলিক ... আরশোলা মুখে টিকটিকিটা লাফিয়ে গায়ের ওপর পড়ে ঝুরঝুর করে দেওয়ালের বালি নিয়ে ... ভ্যানের মেঝেতে ঝাঁটা দিয়ে ঘষে ঘষে রক্ত ধোবার শক্ত ... ওসি, ... ওসি-র ঘরের পর্দাটা উড়ছে; পাখা ঘুরছে ... টি ... গুম্ ... বিস্ফোরণে সমস্ত বাড়িটা কাঁপে ... হাতে মাল ফেটেছিল সাধনের লাশের চোখগুলো ঝুলে পড়েছিল ... ঝলসানো মুখের কয়লার মাধ্যে দাঁত ...জানালার কাচগুলো খিলখিল করে ভেঙে পড়ে (ব্লু চ্যানেল — ওয়্যাপলেসে অবিশ্রান্ত মেসেজ) ... গন্ধকের হলদে ধোঁয়ায় বোমাগুলো বলের মতো লাফাতে লাফাতে দৌড়ে বেড়ায়...
—“চা খায়েন, চা খায়েন — ঝিমুনি টিমুনি সব চইলা যাইবো” — দাস একহাতে চায়ের গেলাশ নিয়ে কথাগুলো বলছে। বাইফোকাল চশমার ওপারে পরিহাসরত চোখ। দাসের সঙ্গে ওর গোঁফগুলোও হাসছে। ও একটু গলা ঝাড়ে, নিজের গেলাশটা নেয়, অভ্যাসবশত ফু দেয় তারপর সুড়ুৎ করে চুমুক লাগায়। একটা পিঁপড়ে ভাসছিল, আঙুল ডুবিয়ে তুলে এনে টেবিলের নীচে লাগায়। একটু ঘুমিয়ে দাসের চোখ ফুলেছে, দাস বকে চলে — “আইজ দুপরে বোঝলেন, এক প্রফেসার — কি এক কলেজে পড়ায় আসছিল। কয় কিনা ওসি-র কাছে দেখা করব — ক্যান্ ওসি-র কাছে ক্যান? খালি মাথা নাড়ে আর কয় যে হে নাকি আমি বুঝম না। শ্যাষে গেল ওসি-র কাছে। বাকিটা অবশ্য এভিডেন্স — এস আই মল্লিক তহন ওসি-র ঘরে ছিল, মল্লিক কইলো কি য্যান কথাটা — ওই যে সব ক্রিমিনালগোর কথাবার্তার বই লিখতাসে — শোনেন একবার কথা — আরে ওই চোরডাকাতের কথা যেমন। বোঝলাননি ... যেমন আই — বি রে কয় খোঁচর, পিস্তলের কয় চেম্বার ... এইসব লোয়ার ক্লাস কথা আর কি ... ভাবেন একবার কি অবস্থা। রবিঠাকুর শরচ্চন্দ ছাইড়া এইবার পকেটমার আর চোর ধাউড়ের কথা লইয়া টানাটানি। আরে বাবা, তা পুলিশের কাছে আসা ক্যান বাপ? আসল লোকদের জিগাইলে না ঠিক ঠিক কথা জানতে পারতা। হেঁ হেঁ বুঝ করেন একবার — কলেজে পড়ায় আর চোরধাউড়ের বুলি শিখায় ... ভাবতেই পারি না ... হেঁ হেঁ” — দাস বকে চলে আর হাসে। দাস খুব গপ্পোবাজ — লোকটা ভালো — ধান্দাবাজি করে না কিন্তু তবু ওর মনে একটু খিচ আছে — শুধু মনে হয় যে দাস ওকে ভয় পায় — যখন হাসে তখনো চোখে ভয়টা কামড়ে থাকে। ও গভীর তৃপ্তি সহকারে চা খায় আর দাসের কথা শোনে। একটু একটু হাসে। কতকগুলো উত্তেজিত গলার আওয়াজ — গেলাশটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিনি গোলে। বুটের শব্দে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। গল্পটা নিঃসন্দেহে মজার কিন্তু কিছু বলার আগেই দৌড়ে আসে এস আই মল্লিক। তাল সামলাতে চৌকাটে হোঁচট খায়? বয়স কম — উত্তেজনার অস্থির — ওকে গলা নামিয়ে বলে “কালীতলা যুবক সমিতির জলসায় গৌতম বিশ্বাস গান শুনছে। এইমাত্র কোটন বলে গেল — অথেনটিক রিপোর্ঢ।” মল্লিক হাঁপাচ্ছে — কপালের শিরগুলো ফুলে উঠছে — নার্ভাস টাইপ। কথাটা শেষ হবার আগেই ও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের কুঁজো ভাবটা চলে গেছে। চাটা এক চুমুকে তলানি উপুড় করে খায়, ঠক করে গেলাশটা রাখে তারপর বেল্টঢা আঁট করতে করতে বেরোয়। দাস জিজ্ঞেস করে — “কি কইলেন মল্লিকবাবু?” — ওরা ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। দাস ওদের বেরিয়ে যাওয়াটা দেখে তারপর রেডিওতে কান পাতে। ওর রেখে যাওয়া গেলাশের গা বেয়ে চিনি নীচে নামছে। নামছে। জোর করে দেয় রেডিওটা। বাইরে ভ্যান স্টার্ট দেবার শব্দ — চিৎকার — বারান্দা দিয়ে কনেস্টবলের বুট পরা দৌড়ের শব্দ ... ইয়ে আকাশবাণীকে পঞ্চরঙ্গী কারিক্রম...
... গৌতম বিশ্বাস — অ্যাকশান না করলেও ঘোড়েল অর্গানাইজা ... শুয়োরের বাচ্চা বহুদিন বেপাত্তা ... অথেনটিক রিপোর্ট ... অথেনটিক ... ভিড়ের মধ্যে ছেলেটাকে কায়দা করতে হবে ... একবার দৌড়লেই শালা ক্যাঁচাল — বারান্দা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে মল্লিককে জিজ্ঞেস করে — “খুব ভিড়?” — ভিড় আছে, বোম্বের আর্টিস্ট আসছে।”
বোম্বের আর্টিস্ট আসছে তাই খুব ভিড় ... মল্লিক ছেলেটা কাঁচা ... রক্ত দেখলে উলটে দেবে ... গৌতম বিশ্বাস সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে গান শুনছে ... বহুদিন ফেরার ... এ তো সেই মেডিক্যাল কলেজের সেল সেত্রুটারি ...ঘাগু মাল ...এইবার শালার ফাইল বন্ধ হবে ...কাচটা ছোপধরা, জালঢাকা। হেডলাইট ঝলসে উঠতে লম্বা আলোয় থানার গেটটা দেখা যায়।
ও ভ্যান ড্রাইভার গুরুঙের পাশে বসে। চারটে প্লেন ড্রেস লাফিয়ে ওঠে। ভারী দেহের ওজনে কিঁচ কিঁচ স্প্রিঙের শব্দ করে গাড়িটা দোলে। চলন্ত অবস্থায় তারা পেছনের দরজা টেনে বন্ধ করে। জালের মধ্যে গোল গোল ফোকার। ভ্যানটা থানার গেট পার হয়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে রাস্তার মোড় ঘোরে। আলোয় দেখা যায় একট কুকুর রাস্তা থেকে সরে গেল। ওর পিঠটা চুলকোতে শুরু করেছে। চোখগুলো কুতকুতে ছোট আর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মুখ লালা কাটছে। লালায় তামাকের কুচি। ও আঙুলগুলো নাড়ায় — একটু অসাড় আর ঠাণ্ডা। পকেটে হাত দিয়ে রিভলভারটা বের করে, প্যাঁচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাইলেন্সার লাগায়। নলের ওপর আঙুলের ছাপ পড়ে। জটলার মধ্যে ছুটলে গুলি চালানো যাবে না অবশ্য ছুটতে যদি পায়। রাস্তার আলো ওর একটু ফাঁক মুখের মধো দাঁতের ওপর কাঁপে। ছোপ! সাইকেলের ওপর শাদা শার্ট পরা পেছনে চলে আসে। গৌতম বিশ্বাস মুখটা মনে পড়ে ... জ্যান্ত মুখটা না এলেও ফটোগ্রাফটা মনে পড়ে ... নিজের মুখে থুথু জমছে ... গৌতম বিশ্বাস ... স্পষ্ট দেখতে পায় ফটোগ্রাফটা ... ভ্যানটা মোড় ঘোরে আবার ... দারুণ জোরে চলছে ... প্রায়ান্ধকার রাস্তায় কতকগুলো ফুলকি ... চুলে অনেক তেল দেয় বলে মোটা ভারী চুল বাতাসে ওড়ে না ... গাড়িটা ব্রেক কষার জনো কাঁচ করে শব্দ হয় ... হেডলাইটে মেয়েদের ইস্কুলের পাঁচিলটা দেখা যায় ... পোস্টার ... বম্বের আর্টিস্ট আসছে তাই খুব ভিড় ... গাড়িটা আস্তে হয় ... হেডলাইট দুটো নিভিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে ... গান শুনছে এখন, গুরুঙকে ও কালীমন্দিরের উলটোদিকে থামাতে বলে। গাড়িটা গুঁড়ি মেরে চলে। যুবক সমিতির মাঠটা আর কয়েকটা বাড়ি পরে। লাইব্রেরির ইট বের করা ঘরটা শেষ হলে গুরুঙ বড় ভালো চালায় ... সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে আর্মি ট্রাক চালিয়েছিল আরাকানে ... পাকা হাত ... অন্ধকার ভ্যানটা প্রায় শব্দ না করে থামে...
... দরজাটা খুলে নামে ... চোখদুটো এদিক ওদিক লেপটে দেখে নেয় ... কয়েকটা ফালতু লোক দেখছে পিঠে চুলকুনিটা চিড়বিড় করে জ্বালা করে ... হাঁটতে হাঁটতে একবার মুখ খিচিয়ে চুলকোয় — দুজন প্লেনড্রেস ওর হাত কুড়ি পেছনে চলতে থাকে। ওরা দুজন ধুতি, বুট আর টেরিলিনের ঝোলা শার্ট পরা ... কোমরের কাছে গুঁজে রাখা পিস্তল। পা না ঠুকে হাঁটতে চেষ্টা করলেও ওদের জুতোর শব্দ হয়। ... ওর শরীরটা সোজা ... লিকলিকে ... সাপের ছোবল মারার মতো হাঁটার ধরণ ... বাঁ হাতটা অসাড় হয়ে ঝুলছে। ডান হাতটা পকেটে ঢোকানো। আলো আর ভিড় ... অনেক লোক হয়েছে মাইকের শব্দ। ক্লাচ ... টর্চের বোতামের মতো সেফটি কাচটা সামনে এগিয়ে যায়।
মার্কারি আর টিউবে রাত দিন হয়ে গেছে। গিজগিজ করছে লোক। বেঁটে একটা টাকমাথা লোক এতক্ষণ কমিক করছিল — ছেলে পাশের বাড়ির মেয়েকে হিড়িক দেবার জন্যে বাপের আক্ষেপ। লোকেরা হেসে হেসে ঘেমে গেছে কারণ ছেলে শেরে দিকে বাপের পেটে পেটো চমকাব বলে লাফাচ্ছিল। সলজ্জ মেয়েদের দিকে চোখ মেরে যাচ্ছে ছেলেরা এবং প্রতিটি ছেলেই অন্য ছেলেদের দিকে হিংস্র চোখে নজর রাখছে এবং সরফরাজি করছে। মাইকে কিঁ ... ই ... ই করে একটা যান্ত্রিক শব্দ হচ্ছিল শব্দটা থামিয়ে ঘোষণা শোনা যায় — এবার আপনাদের সামনে সংগীত পরিবেশন করছেন শ্রীঅজিত কাপুর ও সম্প্রদায়। বঙ্গোয় সহযোগিতা করছেন মাস্টার লিমবো, পিয়ানো একর্ডিয়ানে গণেশ মোদক, গিটারে পিনাকী বোস।” চুঁই চুঁই সিটির আওয়াজ শোনা যায়। লোকেরা উঁচু হয়ে স্টেজের ওপর দেখতে চেষ্টা করে। বাজিয়েরা বাজনা সাজায়, মাইকওলা এসে মইক্রোফোন ঠিক করে। ঘোষক এবার বেশ নাটকীয় করে গলা চড়িয়ে চেঁচায় “অজিত কাপুর অ্যান্ড হিজ পার্টি।” অনেকটা জায়গা নিয়ে উৎসবের আয়োজন — বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ওপরে সামিয়ানা। ঘেরার দুদিকেই লোক জমাট হয়ে আছে। অজিত কাপুর একহাতে মাইক্রাফোনের গলা ধরে ... লোকের গুঞ্জন কমে আসছে ... হঠাৎ বাঁশের বেড়ার ওপর উঠে একটা ছেলে চিৎকার করে ওঠে — “হরে কৃষ্ণ হরে রাম!” — ছেলেটার সারা মুখে ব্রণ — কতকগুলো সিটির শব্দ শোনা যায় — সেই সঙ্গে “গুরু! গুরু!” চিৎকার। ছেলেটার চিল্লোনো আবদার বোধহয় গায়কের কানে পৌঁছয় না। সে ঘাড় অবধি নেমে আসা চুল ঝাপিয়ে বলে — “হামারা পহেলা গানা হায় ফিল্ম আঁখমিচৌলিসে”। ... আবার কতকগুলো সিটির শব্দ আর উল্লাসধ্বনি (এই সময় ও ভিড়ের মধ্যে ঢুকছিল আর একটা নিরীহ চেহারার লোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে সে ফিসফিস করে দাঁতের তলায় বলেছিল — “স্টেজের সামনে, ডানদিকে …”) — পিয়ানো একর্ডিয়ানটা বেজে ওঠে গিটারে ভ্যাম্প শুরু হয়, বঙ্গোটা টিগ ডিগ্ করে বাজতে থাকে — লাল গুরু শার্ট পরা গায়ক একটু পেছনে হেলে মাথাটা সামনে ছুঁড়ে দেয় সহসা এবং উৎকণ্ঠায় কাতর ছেলেরা মুগ্ধ চোখে দেখে তিনটে ভ্যাম্পের মাথায় একটা হাত কানের ওপর চাপা দেয় গায়ক — চোখ বুজলে কার হিম্মত আছে বলবে যে কিশোরকুমার না ...
... আজা রে আজা — ছুপ ছপকে পেয়ার হাম করেঙ্গে
বাত য়ে কিসি কো মালুম হো না পায়ে
আজা রে আজা...
(পিঠটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, আলোগুলো গলছে, সিটির শব্দ আর ভিড় ঠেলে ও এগোয়, ওর চোখ প্রত্যেকটা মুখে তাকায়, লোক সরিয়ে ও এগিয়ে যায়, ডঁচু হয়ে দেখে, সামনের দিকে চেয়ারে মেয়েরা বসে আছে, তার ডানদিকটা যদিও এখান থেকে একটু দূরে তবু ওখানে ... ‘স্টেজের সামনে, ডানদিকে’...) ...যে ছেলেটা চিৎকার করে ফিল্মের নাম বলেছিল সে তার ক্যাওড়াদের নিয়ে ভিড়ের মধ্যে একটু গোল জায়গা খালি করে নিয়ে নাচছে। রুমাল দিয়ে ঘোমটা বানিয়ে সরাচ্ছে আর ঢেকে দিচ্ছে। খ্যামটার তালে তাল মিলিয়ে হাততালি দিচ্ছে অন্যরা ... কোমর নাচাবার ভঙ্গিতে যৌনমিলনের প্রস্তাব অত্যন্ত স্পষ্ট...
…কিওনা আচ্ছা হায় এ মৌকা
দুনিয়া ভি হো জায়ে ধোকা
জঙ্গল মে জঙ্গল মনায়েঙ্গে হাম
মোহব্বত কী কিসমৎ জগায়েঙ্গে হাম...
... মেয়েরা অবাকবিভোর হয়ে শুনছে কারণ কিছু কিছু গান হরমোনকে সম্মোহিত করে, যৌবন থাকুক বা না থাকুক দেহলিতে অহিফেন-মাদকতা আনে। পিয়ানো একর্ডিয়নের রিডে ছোকরার আঙুলগুলো দুর্দান্ত খেলা করছিল তখন, বঙ্গোবাদকের চুল তার কপালের ওপর এসে পড়েছিল, সে ঝাঁকিয়ে সরিয়ে দেয়। দারুণ জমে গেছে গান, সমস্ত ভিড়টা বুঁদ হয়ে শুনছে (গৌতম বিশ্বাস নীল শার্ট আর পায়জামা পরা ... ফরশা, গানটা শুনছিল না অন্যমনস্ক হয়ে ছিল জানবার কোনো উপায়ই নেই ... ও একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়ায় — একটা লোকের পরেই ... অজান্তে ডানহাতটা পকেট থেকে পিছলে বেরিয়ে আসে রিভলভারটা নিয়ে ... নলের মুখটা নীচের দিকে করে ঝুলিয়ে রাখায় কেউ দেখতে ... ছেলেটা ফরশা ... রুক্ষ চুল ... মুখের মধ্যে একটা মজা পাবার ভাব আছে ... চোখদুটো বড় সুন্দর ... এস ও, এস ... মাত্র একটা লোকের পরেই — ক্যাওড়াদের নাচের হাততালির শব্দ...
... চুলকুনিটা দপ দপ করে লাফায়, চোয়ালটা ঝুলে পড়েছে ... মুখের মধ্যে থুথুর ঘূর্ণি ... চোখদুটো ঠাণ্ডা ... মরা শকুনের চোখ ... ট্রিগারের ওপর কালচে নখওলা আঙুল জুড়িয়ে আছে ... সাপ ... জিভ ধারালো ভাঙা দাঁতে লেগে চিরে যাবার মতো তীব্র একটা মুহূর্তে...
...আজা রে আজা — ছুপছুপকে...
...ও সোজা হয়ে দাঁড়ায় ... সমস্ত আলোর বাল্বগুলো সহসা ঝলসে যায় ছোবলে ... গলা আলোয় নেগেটিভ ছবির লোকটাকে এক ঝটকায় সরিয়ে ও সামনে এসে দাঁড়ায় ... মোটা লোকটাকে সরিয়ে ও সামনে এসে দাঁড়ায় ... মোটা ঠোঁটটা সরিয়ে লালা পড়ছে — বাল্বগুলো গলে টল টল করে তরল আলো পড়ছে ... রিভলভারটা প্রায় পেটের সঙ্গে ঠেকিয়ে ট্রিগার টানে ... ব্লব ... ছেলেটার বিস্ফারিত চোখ ... সাইলেন্সারে গুম হয়ে যাওয়া আওয়াজ ... ওয়াক্ ছেলেটার পেট থেকে রক্ত ছিটকোয় ... মুখটা হাঁ করা বাতাস উগরোয় হাঁটু ভেঙে সামনে এগিয়ে আসে ... চোখদুটো সহসা আঘাতে বিস্ময়ে বোবা ... ওর মুখ থেকে লালা পড়ছে ... ছেলেটা যেন ওকে ছুঁতে আসে ... না পেরে উলটে হাঁটু গেড়ে শরীরটা পড়ে ... ও এক পা সরে আসে তারপর খুলির নীচে গলায় রিভলভারের মুখটা ঠেকিয়ে গুলি করে ব্লব্‌ শরীরটা ছিটকে যায় ... লালা টানার অশ্লীল শব্দ ... হাতদুটো একটু কাঁপে চারপাশে চিৎকার ... ফিকে একটু কর্ডাইট আর রক্তের গন্ধ ... আলোগুলো দুলছে ... লোক দৌড়য় ... চিৎকার ... সমস্ত আলোগুলো থেকে একটা জ্বলন্ত গোলক তৈরি করেছিল ... টগবগ করতে করতে আলোগুলো আলাদা হয়ে ফিরে যায় ... শব্দ ... কানের ওপর টিকটিকিটার শিকার আছড়ানোর শব্দ ... রক্ত মেখে ওলটপালট করে ... লোকের পায়ে জড়িয়ে যায় ... মুখটা মাটিতে ঘষে — হাতটা টানটান হয় ... থেমে যায় ... পায়ের কাছে রক্তাক্ত একটা দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে —
... একটা বুড়োর জুতোয় রক্ত ছিটকে লেগেছে, বুড়োটা পেচ্ছাব করে ফেলেছে একটা মেয়ে দাঁতে দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে গেছে কতকগুলো মেয়ে আর বাচ্চা কাঁদছে। লোকজন দৌড়বার ভিড়ে প্লেনড্রেস দুজন এগোতে পারছে না। কয়েকটা লোক (পুলিশের লোক) চেঁচাচ্ছে — “দৌড়বেন না, দাঁড়ান ... দৌড়বেন না।” সাইলেন্সারের শব্দ (চুরি করে হত্যার অস্ত্র) বেশি দূরে যায় না তবু খুনের খবর চলে গেছে — সবার কাছে। যুবক সমিতির কিছু ছেলে সন্ত্রস্ত মুখে হস্তদন্ত হয়ে লোক আটকাচ্ছে। গায়ক ও তার দলবল স্টেজে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছ — যেন নড়বার সাহসটুকুও নেই ... “দৌড়বেন না, দৌড়বেন না — যে যেখানে আছেন দাঁড়িয়ে যান — কিছু হয়নি।” পুলিশের একজন লোক অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জটলার দিকে যায়া। (সেই লোকটা যে ওকে গৌতম কোথায় আছে বলে দিয়েছিল) ওরা বলাবলি করছিল এরকম একটা ব্যাপারের পর জলসা থামিয়ে দেওয়াই উচিত কারণ গৌতম পাশের পাড়ার ছেলে আর মাংসরক্তের দৃশ্য দেখে সকলেরই যখন গা গুলোচ্ছে। পুলিশের লোকটা কিছুটা অর্ডারের মতো করে চিল্লায় — “শুরু করতে বলুন — জলসা ফলসা থামানো চলবে না, গান হোক, গান চলুক — আমরা লাশ বার করে নিয়ে যাচ্ছি — শুরু করতে বলুন।” স্টেজের দিকে পিস্তল নাচিয়ে লোকটা আর্কেস্ট্রার কন্ডাকটরের মতো করে চেঁচায় — “অ্যানাউন্স করতে বলুন —” — মাইকে ঘোষণা শুরু হয় “আমাদের সংগীতানুষ্ঠান আবার শুরু হচ্ছে — আপনারা একটু ধৈর্য ধরে বসুন — ভয় পাবেন না — ভয় পাবার কোনো কারণ নেই” — গলাটা একটু কেঁপে যায়। যে বলছে তার কথা আটকে যাচ্ছে।
... মৃত্যুর ভারী বাতাস প্রতোকটা লোককে ছুঁয়ে গেছো কয়েকজন হাত তুলে আছে (ভয় পাবেন না, ভয় পাবার কোনো কারণ নেই) ও সামনে যায়, হাতে খোলা রিভলভার। লোকে দুধারে সরে যায় আর আড়ষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকে। দুজন প্লেনড্রেস ছেলেটাকে নিয়ে চলে ওর পরে। একজন একটা হাত, আর একজন একটা পা ধরে ছেলেটাকে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে — রক্তাক্ত গলার পর অসহায় মাথাটা ঝুলছে — চোখটা খোলা — ওদের চলার ধরণে মাথাটা যেন এই বহুদৃষ্ট যাত্রার প্রতি গভীর সম্মতিতে দুলছে। রক্ত ছড়িয়ে গেছে সারা জামা। মুখটা খোলা, কিছুটা বিস্ময় এখনো মুখ থেকে যায়নি। মাটির ওপর আছড়ে পড়েছিল বলে কপালটা ছড়া, মুখে মাটি ঘষে গেছে — রক্ত গলা থেকে গড়িয়ে গিয়ে কানের পাশ দিয়ে চুলে গিয়ে জমছে, মাটিতে পড়ছে। (ভয় পাবেন না, ভয় পাবার কোনো কারণ নেই) — ডান পা মাটিতে ছেঁচড়ে চলে, হাতের আঙুলগুলো টেনে টেনে মাটিতে দাগ কাটতে চেষ্টা করে যেন। লাশের পেছনে পিস্তল নিয়ে সেই লোকটা। মাইকের যান্ত্রিক শব্দটা আবার শুরু হয় — সেটাকে ছাপিয়ে পিয়ানো একর্ডিয়ানের দু-একটা সুর শোনা যায় যে জায়গাটায় ছেলেটা পড়েছিল সেখানে রক্ত থেকে জমাট বেঁধে আছে — ফোঁটায় ফোঁটায় ছড়িয়ে আছে — ছিটকে ছিটকে গেছে — এক পাটি চটি উলটে পড়ে থাকে — কে একজন বলে চুন এনে ছড়িয়ে দিতে — শুষে নেবে — (ভয় পাবেন না ভয় পাবার কোনো কারণ নেই)
(কখনো দাঁড় করিয়ে খুলির পেছনে নল লাগিয়ে বুলেটে মাথা চৌচির করে ঘিলু ছিটকে দেওয়া হয়েছে, কখনো অ্যাসিড ও নুন মাখিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, চলন্ত গাড়ির থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে যাতে রাত্রের শেয়ালরা অভুক্ত না থাকে — এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে কলকাতার কোনো কুকর মানুষের মাংসের স্বাদ পায়নি একথা জোর দিয়ে বলা যায় না — জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে — পচে ফুলে রবারের মতো হয়ে যাবার পর শনাক্তকরণ অসম্ভব এবং বিভিন্ন উচ্চতা থেকে আছড়ানো হয়েছে, লাঠি পিটিয়ে কিমা করে ফেলা হয়েছে ... এবং আরো দেশী বিদেশী যন্ত্র ... রসায়ন ... বিকৃতি ... যা যা করা সম্ভব হয়নি তার মধো নাৎসি ফ্রিজিং মিক্সচার ও গ্যাসচেম্বার বা মার্কিন পদ্ধতিতে উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেবার কথা বলা যায়)
ভয় পাবেন না, ভয় পাবার কোনো কারণ নেই।
ঢাউস ভ্যানটা এগিয়ে এসেছিল। দরজার দুটো পাল্লা হাঁ হয়ে আছে। ও দরজার পাশে দাঁড়িয়ে লাশ ওঠাতে বলে ... হাতটা ধরে ডঁচু করে ঝুলিয়ে একজন ভ্যানের মধো ঢুকে যায় ... মাথাটা একবার ঠুকে যায় পা-দানিতে — পাগুলো বাইরে বেরিয়েছিল ... ভেতর থেকে টানার ফলে অন্ধকারে ঢুকে যায় মৃতদেহ। একপায় চটি ছিল না। খুন! লাশচুরি। সারাটা রাস্তা ফোঁটা ফোঁটা রক্ত! রক্ত মৃতদেহ ... রক্ত কিন্তু এখন আর পুলিশের কুকুর এসে নাক কুঁচকে শুঁকে শুঁকে খুনিকে হদিস করবে না। আজা রে আজা, ছুপছুপকে ... কলজে নিঙড়ে নিচ্ছে গুরু! একটা দায়সারা ময়নাতদন্ত ... ওয়াক্ ... কাঁটাপুকুর মর্গের প্রাতাহিক মোচ্ছব ... রাত্তিরে শ্মশানের সামনে লাশ পাচারের ভ্যান ... ঘুমচোখে অভ্যস্ত ডোম ... ইলেকট্রিক চুল্লির তীব্র লাল কয়েলের ফার্নেসে নিক্ষিপ্ত নগ্ন দেবদূত ... দপ্ করে জ্বলে ওঠা চুল ও কাপড় সমস্ত লোক সাক্ষী, সচক্ষে দেখা সমস্ত ঘটনা ... কিন্তু এবার আর কেউ সাক্ষী দেবে না কেন? কবন্ধ কখনো কথা বলে কে কোথায় শুনেছে? ... থানায় মুখ দেখিয়ে গৌতম চলে যাবে মর্গে ... সেখানে সারারাত একলা ... মুখটা একটু খোলা ... বিস্ময়ে চোখ চেয়ে? ... ঠাণ্ডা ... শক্ত ... আড়ষ্ট রাত্রে বাড়িতে খবর যাবে ... গৌতমের বুড়ো বাবা তস্কর কড়া নাড়ার শব্দে সচকিত হয়ে বালিশের পাশে হাতড়ে চশমা খুজবেন ... কে ... খুলুন, হরেন বিশ্বাস কার নাম ... বৃদ্ধের ভীত মুখের ওপর টর্চের আলো পড়বে ... রাত্রিকে তছনছ করে দেবে ভয় ... বুটের শবদ ... বলা হবে জরুরি প্রয়োজনে আসতে ... চরম আশঙ্কাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করবে সবাই ... কত কি হতে পারে ... মৃত্যু ছাড়া আর সমস্ত কিছু এখন অস্বাভাবিক ... লাশ দেওয়া হবে কি হবে না ... আর এক উল্লাস ... গৌতম এতকিছুর এতটুকুও জানতে পারবে না ... সারাটা রাত একটা স্বল্পালোকিত হিমঘরে একা শুয়ে থাকা শক্ত ঠাণ্ডা আড়ষ্ট ... স্মৃতিফলক হাড়িকাঠ গলগোথা ... জায়গাটায় রক্ত জমাট হয়ে আছে ... মৃগয়ার শিকার ঝুলিয়ে নিয়ে আসার সারাটা পথে রক্তের শুকনো দাগ সমস্ত বাতাস রক্তে ভেজা ... কোনো ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত’ এই হত্যার জন্য হাস্যকৌতুকের আসর হাঁকিয়ে বসবে না ... গৌতম যে কোনো একটা রেপকেস বা ওয়াগনতোড়ের চেয়ে বেশি ইজ্জৎ আশা করতে পারে না। রক্ত শুকিয়ে মাটি হয়ে যাবে ... রক্তের গন্ধ নিশ্বাস হয়ে মানুষের বুকে মিশে থাকবে ... রক্ত খুন রক্ত মৃতদেহ রক্ত কিন্তু এবার আর লাল-বাজারের ডালকুত্তা এসে শুঁকে শুঁকে খুনের হদিশ বের করবে না ... কেন?
হেডলাইট দুটো গেস্টাপোর চোখের মতো ধক্ ধক‌্ করে জ্বলছিল। গাড়িটা জোরে চলছিল তবে এবার ব্যস্ততা অনেক বাম। ও মাঝে মাঝে পা দিয়ে লাশটা ছুঁয়ে দেখছিল আর সিগারেট খাচ্ছিল চোখ বুজে। চুলকুনিটা কমে যাবার পর কমজোর লাগছে। মাথাটা খালি খালি, ভ্যান চলার ঝাকুনিতে লাশটা লাফায়, নড়াচড়া করে।(সত্তরের দশকের প্রথম দিকে গৌতমের মার প্যারালিটিক হয়ে যাবার কারণ কি হিজড়ের ইজ্জৎ নিয়ে বেঁচে থাকতে গৌতমের অস্বীকার করা? প্রোটিনের অভাব? দুর্ঘটনা? গৌতম, “বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার্থে দু রাউন্ড গুলি চালাতে হয়,” — এই খবর কালকে লাখ লাখ লোক পড়তে চলেছে — এ বিষয়ে তুমি কি করতে পারো? বিশাল রোটারি মেশিন থামিয়ে দেবে? সংবাদপত্রের স্বাধীনতা? তোমার এই ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকানোর মধ্যে কিন্তু ম্পষ্ট কোনো নির্দেশ নেই।) একটা পা শুধু ভাঁজ হয়ে আছে ও লাশটার ওপর ছাই ফেলে আর গুন গুন করে একটা সুর ভাঁজে। সিগারেটের ধোঁয়াটা মগজে ধাক্কা দেয়। আলোগুলো কিলবিল করছে মুখের ওপর — একটা প্রাইভেট সামনে রাস্তা দিচ্ছিল না — “আরে মাদার” ড্রাইভার কাঁচা খিস্তি করে — ও হাসে। পকেটে সিগারেটের শুকনো গুঁড়ো, বদ্ধ ঘাম আর যৌনতার গন্ধের মধ্যে রিভলভারের ভারী বোধ। চুলকুনিটা প্রায় নেই। ঘামের টক গন্ধটা অনেক ফিকে হয়ে এসেছে না রক্তের গন্ধটা বাড়ছে? রাস্তার আলো ওর তেলা কপাল আর চোয়াড়ে গালের ওপর কাঁপছে — ফাসিস্ত আদলের মধ্যে প্রাকৃত এক অশিক্ষিত মুখ। ও ঝিমুনির মধ্যে পা দিয়ে লাশটাকে ছোঁয় — এখনো মানুষের মতো, ঘণ্টা দুয়েক পরে কাঠমড়া হতে শুরু করবে। — “সিঁটো শালা সিঁটো।” (বিসর্জনের রাতে ভাসানের ঢাক বাজে না, মানুষ বিগ্রহকে ভুলে থাকতে চায়, তাসা পিটিয়ে ছেলেরা নাচে না। মুখ থেকে ফুঁ দিয়ে পেট্রল জ্বালায় না — এ কেমন আনন্দ? গৌতম, মর্গের ইঁদুরগুলো ও রকম স্বাস্থ্যবান আর মাংসল কি করে হয়? গৌতম! তোমাকে চেরাই করে ওরা কিসের তালাশ করবে? তুমি কোন পূজার অঞ্জলি? তোমার ভয় করে না?) পেট্রলপোড়া কালো ধোঁয়া নাকে আসে। জোর একটা ঝাঁকুনি দেয় ভ্যানটা। সিগারেটটা ঠোঁটে ঠেকান যায় না। লাশটা হুড়ুদ্দুম লাফায়। থানার গেট দিয়ে গাড়িটা ঢুকছে। গর্ গর্ শব্দ করে ইঞ্জিনটা দমে আসে — হেডলাইটের আলোদুটো নিভে যায়।
কালো আর একটা ভ্যান, গায়ে শাদা ক্রশচিহ্ন। দুটো খাকি জামা পরা নড়বড়ে আধবুড়ো লোক আছে। ওরা গৌতমকে বয়ে নিয়ে যাবে ওই ভ্যানটায় — যাতে চড়ে ও চলে যাবে মর্গে। গাড়িটার নাম এম্বুলেন্স ভ্যান হলেও ওতে আহতদের চেয়ে নিহতেরাই বেশি চড়তে পায়। আয়োডোফর্মের গন্ধ ... ফাঁড়াই ... সেলাই ইঁদুর দৌড়বার শব্দ ... গৌতম, তোমার ভয় করবে না?
বেল্টটা ঢিলে করতে করতে ও ঢুকছিল। ওসি-র ঘরে গিয়ে রিপোর্টটা দেয়...
— কোন রেসিসট্যান্স দিয়েছিল নাকি?
— না স্যার টাইম পায়নি।
বেরোতে বেরোতে প্রশ্ন আসে — “ক রাউন্ড?” — “দু রাউন্ড স্যার।” (এক রাউন্ডেই ফেলা যেত কিন্তু হাতটায় খুন ভর করলে আঙুলগুলো থামতে চায় না) ঘরে ঢুকতে শোনে দাসের টেবিলে রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে যদিও কেউ ঘরে নেই। দাস একটু বাদে এসে ঢুকলো। জেনানা লক-আপ থেকে হাসির শব্দ আসে। ও কান খাড়া করে শোনে। দাস বকতে থাকে — “দ্যাহেন একবার কাণ্ডকারখানা — কতকগুলো ছেমড়িরে ধইরা আনছে। আপনেও ডিউটিতে গ্যালেন — ওই গুলারে লইয়া আসল। আনবি তো আন — আমারই কাছে। বাব্‌বাঃ — কি মুখ এক একটার। এক্কেরে সেরদর ... কথা কয় আর হাসে ... কথা কয় আর হাসে ... আউ ছিঃ ছিঃ। এস আই মল্লিক ঘরে এসেছিল। দাস বলে ... “ও মশাই — দুপুরে ওই যে প্রফেসার না কি ছাতা আসছিল ... কি একটা কথা বার বার বলছিল বলেন তো?” মল্লিক বুঝতে পারে না — বলে “কি কথা?” — আরে, ওই যে সব চোর বাটপারের কথা — খোঁচোর, গজ — আরো কত কি।” মল্লিক একটু হেসে বলে — স্ল্যাং স্ল্যাং — উনি একটা আন্ডারওয়ার্লড স্ল্যাঙের ডিক্সনারি লিখছেন।” দাস খুব খুশি — “অয়, অয় — স্লেং এইবার ধরছি — স্লেং কালেক্ট করে। — স্লেং।” দাস বড় মজায় হাসে আর মাথা দোলায়। মেয়েগুলোও লক-আপে খিল খিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে এ ওর গায় ঢলে পড়ছে। ও হাসির শব্দটা মন দিয়ে শোনে। বেশ লাগে শুনতে। পাউডার আর দোক্তার গন্ধ, চওড়া চওড়া, কালোকালো; মোটামোটা ঠোঁট — মাথায় চওড়া নাইলনের রিবন। — “শালা! লুড়কুৎগুলোকে মেরে মেরে হাত পচে গেল।” উঠে পেচ্ছাব খানার দিকে গেল।
(অপরকে বিনষ্ট করিবার অধিকারবোধ আয়ত্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করিবার ইচ্ছার অভেদস্বরূপ নিজের দেহে, রক্তকণিকায়, চৈতন্য ও স্নায়ুতে মৃত্যু ভীতির রূপ ধারণ করিয়া জন্মগ্রহণ করে এবং এই প্রজন্মের নৈরাজ্য দেহকে অতিমাত্রায় জাগ্রত ও হীনবল এবং মনকে সাবধান ও পক্ষপাতগ্রস্ত করিয়া তুলে। এই বিপরীতমুখী ক্ষয়প্রবাহের মধ্যে নেতি চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পায় এবং নিজের সংরক্ষণের ইচ্ছাকে ক্লান্ত ও মন্থর করিয়া তোলে ফলে প্রতিটি হত্যাই নিজের মধ্যে মৃত্যুর অনুঘটক হইয়া কাজ করে ফলে মহামারীর লক্ষ লক্ষ মাছির পাখনার উল্লাস রক্তে ধ্বনিত হয়।)
দরজার কাছের সিটে ও ঘাড় গুঁজে বসেছিল আর ডানদিক বাঁদিক দুলছিল। রিলিফ ভ্যানে রাত করে ফেরবার সময় ঝাঁকুনিতে ওর ঘুম পাচ্ছিল — শুধু মধ্যে মধ্যে পা-টার সামনে এগিয়ে কি একটা খোঁজার অভ্যাস হয়ে গেছে তাই ঝিমুনিটা বার বার চলে যায়। রাত্তিরে সাবান মেখে স্নান করে — চুলকুনিটায় মলম লাগায় — শরীরের ঘাম আর নোংরা ফেনা কলতলার ঝাঁঝরির কাছে গিয়ে পাক খেয়ে তলিয়ে যায়। মাথায় গন্ধতেল মাখে। খুব ঘুম পায় কিন্তু ঘুম কখনো স্বপ্ন ছাড়া আসে না। স্বপ্নের চোখ আছে, তারা প্রশ্ন করে, হাসে, টিন বাজায়, স্বপ্নগুলোর হাত পা ছেঁড়া, টুকরো টুকরো, রক্তাক্ত। যদিও কম কথা বলে কিন্তু বাড়ির লোক বলে ও নাকি ঘুমের মধো কথা বলে ওঠে, কখন গোঙায়, জড়িয়ে জড়িয়ে অর্ডার দেয়। কোনো কোনোদিন ঘুমের মধো পিঠটা এত আঁচড়ে আঁচড়ে চুলকোয় যে সকালে দেখে কেটে গেছে। আগে ভাবত ভূতে খিমচোয়। চুলকুনিটা তারপর সারাটা দিন জ্বালা করে আর ডানহাতটা ছটফট করে। পাশের লোকটাও ঢুলছে। কেউ একজন বিড়ি খাচ্ছে — আগুনটা দপ করে ওঠে। ঝিমুনিতে মাথাটা আলগা হয়ে ঝুলে পড়ে ... কানের মধ্যে শুধু গাড়ি চলার শব্দ ... বাঁ-পাটা সামনে এগিয়ে যায়। আলো যা জ্বলছে রাস্তায় ... অনেক বাড়ির আলো নিভে গেছে। পানের দোকানের সামনে দু-একটা লোক। ট্রামের শ্রমিকরা রাত্তিতে ট্রামলাইন খুঁড়ে কাজ করছে। লাল লাল লণ্ঠন ঢিবি করা কালো মাটির ওপর সার দিয়ে রাখা। ও ঝিমোয় তাই দেখতে পায় না। অন্ধকার সিনেমা হল — নায়িকার বিশাল ছবি — ঠোঁটের কাছটা খোবলানো। রাস্তাঘাট ফাঁকা — শেষ কয়েকটা ট্যাক্সি জোরে বাতাস উড়িয়ে চলে যায় এদিক-ওদিক। ডিউটি শেষ করে প্রাইভেট বাস আলো নিভিয়ে গ্যারেজে ফিরছে। বাঁ হাতে টিফিন বাক্সটা ধরে ও ঝিমোয় কিন্তু প্রখর এক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বলে দেয় এখন কোন রাস্তা চলছে। প্রত্যেকটা মোড় চেনা — তাকালেই চেনা জায়গা দেখা যায়। ওর নিজের অঞ্চলটা শান্ত। ভ্যান থেকে বাড়ির গলিটার মুখে নামিয়ে দেয় রোজ আবার সকালে ওখান থেকে তুলে নেয়। ওর পাড়ার কোন ঝুট ঝামেলা নেই, দেওয়াল কিছু লেখা আছে বটে কিন্তু ওগুলো বে-পাড়ার ছেলেদের কাজ। ও ভালো করেই জানে যে ওর পাড়ার কোনো ছেলে এসব করে না। এইসব কথাগুলো ও রোজ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বাড়ি ফেরবার সময় খতিয়ে ভাবে। প্রত্যেকটা কথা বোঝে, ওজন করে তবু ভয় যায় না। পুরোপুরি আশ্বস্ত হবার কোনো কারণ নেই কারণ সুধীর বোস ওই এক থানাতেই এস-আই ছিল। তারও পাড়ায় কোনো গণ্ডগোল ছিল না, কিন্তু একদম বাড়ির চৌকাঠের সামনে কুপিয়ে দিয়ে গেল ... ডান হাতটা প্যান্টের ওপর দিয়ে বুলিয়ে বুলিয়ে রিভলভারটা খোঁজে। অবশ্য সুধীরের কতগুলো অসুবিধেও ছিল — মোটার দিকে গড়ন থাকার জন্যে হাত-পা বেশ তাড়াতাড়ি খেলত না। ফাঁক পেলেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টেরি কাটত। লোকটা নাকি ঝুলেপড়া নাড়িভুঁড়ি ধরে ছুটেছিল হাত বিশেক। বউ আর দুটো বাচ্চা। সুধীরকে যেদিন ভ্যানের পর ভ্যানের মিছিল করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন ও ছিল। ভালো করে দেখছিল মুখটায় কিছু হয়নি পেটটা ফেঁড়ে দিয়েছিল — তক্ষুনি তক্ষুনি মরেওনি, নল নাকে ঢুকিয়ে বেঁচেছিল দিন দুয়েক। গাড়িটা থামবার আগে ও টিফিন বাক্সটা বাঁ পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। রিভলভারটা ডান পকেট থেকে বার করে — বেশ ভারী — ম্যাগাজিনটা দেখে — সেফটিটা সরিয়ে আবার ট্রিগারে আঙুল রেখে পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখে। গাড়িটা থামে।
ইঞ্জিনটা চলছে বলে একটানা গোঁ গোঁ শব্দ হয়। দরজাটা খুলে লাফ দিয়ে নামে। দরজাটা ঠেলে দেয়। গাড়িটা চলে যায়। ছোট লাল আলোটা শন্দের সঙ্গে দূরে চলে যায়। সামনে পেছনে দেখে। কেউ নেই, ফাঁকা। চাঁদের অসুস্থ পাণ্ডুর আলা। কোনো বাড়িতে আলো জ্বলছে না। দূরে ভ্যানের শব্দটা মিলিয়ে যেতে নিস্তব্ধতা জড়ো হয়ে আসে। ঠাণ্ডা বাতাস আছে। ও গলির মোড়টা ঘোরে বেশ সরু রাস্তা — ভ্যান ঢুকতে পারে না। বাঁদিকের ইটের পাচিলটা ওর হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে পেছনদিকে সরে যায়। পাঁচিলের ওপর সারি দিয়ে লাগানো কাচের ধারালো টুকরো চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করে। শুধু ওর চলার শব্দ। চাঁদের থেকে কিছুটা দূরে একটু মেঘ, একটু দূরে ল্যাম্পপোস্ট ... চকিতে দাঁড়ায় ... নিজের চলার শব্দ নেই ... রিভলভারটা নিয়ে থাবাটা পিছলে বেরিয়ে আসে পকেট থেকে ... খস্ খস্ শব্দটা ওকে ছুঁতে আসে...
..ল্যাম্পপোস্টঢা হঠাৎ খিলখিল করে গডিয়ে পড়ে রাস্তায়। উলটোদিকে ইটের দাঁত বার করা হাড়গিলে পাঁচিলটা হা হা করে হাসে, ফাটলের মধ্যে চোখ ... চোখের পাতা ছেঁড়া, হাইড্রেন্টের খোলা চোয়ালের মধ্যে কারা যেন কান পেতে শোনে ... বদলার একটা ছুরি চিৎকার করে ছিটকে যায়। ঝলসে ওঠে ফলা! পেছন থেকে একটা তীক্ষ্ন আলো পাইপগানের উগরোন গলা এক টুকরো সিসে হয়ে ছুটে আসে! — ও রিভলভারটা হাতে নিয়ে সাপের মতো চারদিকে তাকায় — দেওয়াল আর মিশকালো শ্যাওলা, নিঃশব্দ রাত তবু হলুদ চাঁদটা ছাদের আলসে থেকে গড়িয়ে রাস্তায় আছড়ে পড়ে বার বার অসংখ্য স্পিলনন্টারে ফেটে যাচ্ছে, শরীরের মধ্যে মাংসরক্তের মধ্যে হাড়ের মধ্যে মজ্জা ভয়ে জমে আছে — ভয়। মৃত্যুভয় তারা খসে পড়ার পর ভয়াবহ অন্ধকার বাতাসে শব্দহীন ঘাতক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে চারদিকে পায়ের শব্দে রাস্তা কাঁপিয়ে সংখাতীত অশ্বারোহী প্রতিশোধ — খালি পায়ে দৌড়বার শব্দ ... স্টাবকেস ... হালাল ... নীল শার্ট আর পায়জামা পরা মুখে রুমাল বাঁধা ... গায়ে চাদর জড়িয়ে বোমা ধরে রাখার বিশেষ হাতের নিশানা ... “আমরা নেবোই নেবো” বদলার শব্দ মর্গের ভ্যাপসা আলোয় ... শ্মশানে ও প্রান্তরে ... প্রতিহিংসার প্রতিধ্বনি বাড়ি খেয়ে খেয়ে ফেরে ... রক্তহীন মুখ যুবকের ... ড্যাগার ... রক্তমাখা নীল শার্ট পরা ... শরীরে বুলেটের গর্তগুলো জ্বলছে নিভছে জলছে...
— ও হাঁপায় আর ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে — ভয়ে সমস্ত শরীরটা কুঁকড়ে যায় নিশ্বাস, ব্লাডগ্রুপ, লালা, আইডেনটিটি কার্ড, টিপছাপ, হাসি, রিভলভার, পাসপোর্ট সাইজ ফটো, নিম্ন বুদ্ধঙ্ক, হজম, উল্লাস, ভোগ্যনারী, চেতনা, দেশ, রাশিচক্র — নাপাম জেলির মতো স্বচ্ছ, গাঢ়, বীভৎস — তার সমগ্র অস্তিত্ব ভীত কৃমির মত কুচকে যায়...
খস্ খস্‌ শব্দ। চারদিকে তাকায় — কেউ নেই। খস্ খস্‌ শব্দ! একটা ভোটের পুরোনো পোস্টার আলগা হয়ে ঝুলছে আর বাতাসে দেওয়ালের গায় ঘষছে — খস্ খস্ শব্দ।
সমস্ত শরীরটা টান টান হয়ে ওঠে আবার, শ্লথ ও তৃপ্ত মুখ। ও রিভলভারটা বাঁ হাতে নেয়, ডান হাতের তেলো ঘামে ভিজে গেছে, হাতটা প্যান্টে ঘষে, উত্তেজনায় মুখ থেকে লোল পড়েছিল। মুখটা হাত দিয়ে মোছে আর মোছবার সময় সেই বিশেষ ঘামের টক গন্ধটা পায়। খুন আর ভয়ের জৈব গন্ধ। ওর চলবার শব্দটা জোর হয়। আড় চোখে দেখে চাঁদটা আলশেতে ঠিক ঠেকে আছে। ঠোঁটদুটো সরিয়ে দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে হলুদ — ও হাসে। একটা বেডাল দৌড়ে রান্তা পার হয়ে আঁশটে ছাইগাদা আর ময়লার মধো চলে গেল। ও হাসে। চোখদুটো শুধু সজাগ আর জ্বলন্ত। ওর ছায়াটা রাস্তায় আর দেওয়ালে ভাগাভাগি হয়ে পড়েছে — বুকের মধ্যে দিয়ে নর্দমা। তেরছা কালো টিনে কর্পোরশনের নোটিশ — “এখানে প্রস্রাব করিয়ো” — না’ টা ইঢ দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে দিয়েছে। বমি ওলটানো দুর্গন্ধ। কতকগুলো পোকা রাস্তার আলোর পাশে উড়ছে — ওর পা ফেলার শব্দ তারা শুনতে পায় না। বাড়িগুলো অন্ধকারে বিশাল বিশাল জন্তুর মতো ওত পেতে আছে। অস্বস্তিতে দাঁতগুলো হাসি থামিয়ে আবার ঠোঁটের আড়ালে চলে যায়। মুখের মধ্যে লালা জমে। চাঁদের আলো থিকথিক করছে, বিরক্তিতে হাতের আঙুলগুলো বেঁকে যায়। টক ইচ্ছেটা আঙুল বেয়ে কালচে থ্যাবড়া নখে গিয়ে জমে। শার্টের কলার শেষ হবার পরে ঘাড় আর পিঠের মাঝামাঝি জায়গাটা চুলকোয়?


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. জনগনের পক্ষে শীতল ও ঠান্ডা সন্ত্রাসের
    গল্প। অন্য রকম। নবারুন ভট্টাচার্র আরো লেখা পড়েছি। অন্যগুলোর মতো এটাও ভালো লগেছে। লেখককে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

    উত্তরমুছুন