আমাদের অন্তত বমি করার স্বাধীনতা ছিল নবারুণ৷ ‘পিস হ্যাভেন ’-এ তুমি ঘুমিয়ে থাকবে৷ কিন্ত্ত সেখানেও পরিত্যক্তদের জন্য কোনও আলাদা কক্ষ নেই৷ এই সভ্যতা সবাইকেই অ্যাকোমোডেট করে৷ যারা চে গুয়েভারা হতে চেয়েছিল তারা চাপরাশি হতে পেরেছে৷ নবারুণ তোমায় চলে যাওয়াই ভালো৷ ’ লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়৷
যারা চেকভের কেরানি , ভগবান ও শয়তানের এলাকার বাইরে যারা , সেই সব তুচ্ছ, জীর্ণ নরনারী যারা সংগঠনে নেই , ফেসবুকেও না , তাদের জন্য ইস্তাহার লিখে গেল নবারুণ ভট্টাচার্য৷ নবারুণের লেখা আসলে বমনরহস্য৷ অবাধ্যতার অনার্য মস্করা৷ অথচ নবারুণ দেখেছিল বাতাসে বিপদের গন্ধ।
গাজায় তিন জন অবরুদ্ধ শিশু দেওয়ালের ফাটল দিয়ে দেখছিল আকাশের দেবতা তাদের জন্য উড়োজাহাজ থেকে লজেন্স ফেলে দিচ্ছেন৷ মিরাটে কারফিউ শিথিল হলে জনৈকা গৃহবধূ কেরোসিন আনতে গিয়ে দেখলেন দোকানের ঝাপ বন্ধ৷ জনৈক বিচারপতি সে দিনের মতো অধিবেশন সমান্তির ঘোষণা করতে চলেছেন৷ বিকেল চারটে বেজে কুড়ি মিনিট৷ আমার বন্ধু নবারুণ শেষ বার , এই শেষ বার ছোটোলোকেদের গায়ের ঘামের গন্ধ জড়ানো হাওয়া ফুসফুসে ঢুকিয়ে নিলেন৷ আর না ---কোথায় গেল ভান গখের ছবি --- ছেঁড়া মেঘের আক্রোশ ? কোথায় গেল ঋত্বিক ঘটকের ছবির মতো বিপন্নতা ? মেট্রো স্টেশন থেকে মেয়েরা গলগল করে বেরিয়ে আসছে --- শিশু ও মুদ্রা তাদের জঠরে৷ বি -মুভির অরণ্যদেব লোকাল আশালতাকে এসএমএস করে৷ রাষ্ট্রপুঞ্জে চাঁদ উঠবে ঃ পেট্রোডলারের বিষাদপ্রতিমা৷ আর ময়নাগুড়ি ও ভেনিজুয়েলায় ক্ষুধা মানুষকে চাবুক মারবে রোরুদ্যমানিনী আফ্রিকার মতো৷ নবারুণ আমি বুঝতে পারছি শেষ পর্যন্ত রাগের সাদা ফেনা ছাড়া কিছুই থাকবে না৷
কবরডাঙা পার হয়ে ঠাকুরপুকুর পৌঁছতে পৌঁছতে আমার পাঁচটা হবেই৷ আবার ‘টেরিবল ফাইভ ইন দি আফটার নুন’৷ মনে আছে তোমার , চল্লিশ বছর আগে দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে আমাদের চোয়াল শক্ত হতে জানত --- ‘ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে … কি মারাত্মক পাঁচটা বাজল তখন !’ আমরা জানতাম ইতিহাসের ঘর যে রাতে ঝড়ে ভেঙে পড়ে , বিপর্যয় যদি ধাবমান মহিষের শিংয়ে নটরাজ হয়ে দেখা দেয় তবে ও তত্ক্ষণাত্ লোরকা ইগনাশিওর জন্য শোকগাথা লিখে উঠতে পারেন৷ মৃত্যু যেখানে নারীর স্তনদ্বয়ের মতো প্রলয়তুল্য৷ তুমি ছিলে আমাদের শেষ মাতাদর যে তাচ্ছিল্য নিয়ে থুতু ফেলতে পারত৷ আজ আমাদের রক্তের গলি উপগলিতে আর কোনও ব্যারিকেড রইল না নবারুণ৷ এই সব চ্যানেল আর পুচকে সাংবাদিক এখন তোমার অসমান্ত আত্মজীবনী নিজেরাই সমান্ত করার দায়িত্ব নেবে৷ চল , আবার , রাসবিহারীর মোড়ে আড্ডা দেই৷ চল , আমি তোমায় রেখে আসি ঈশ্বরের হাতে৷ স্বর্গের অবিনশ্বর রেস্তোরাঁয় তুমি সমস্ত বন্ধুপরিজনকে ফিরে পাবে --- তোমার বাবা বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক থেকে অনন্য পর্যন্ত সব্বাইকে৷ নবারুণ এমন যন্ত্রণা নেই যা তোমার নির্যাতিত লালের তুলনা৷ আজ তুমি মুক্ত৷ আজ তোমার অভ্যর্থনা৷ তোমার সেই যুবকবেলার আলো আর সুর তুমি ফিরে পাবে৷
মনে আছে তোমার --- রাজা রাজেন্দ্র রোডে প্রথম দিনের আড্ডা৷ অদূরে বিজনবাবু দাঁত মাজছিলেন , আমি একটু থমকে দাঁড়াই৷ তোমার ছোট্টো ঘর --- মায়াকোভস্কির ছবি --- তুমি কপট গাম্ভীর্যে বলেছিলে --- ‘এই তোশকে বিজন ভট্টাচার্য ঋত্বিক ঘটকের বমির দাগ আছে৷ এখানে কোন মাজাকি চলবে না গুরু!’ নবারুণ আমরা তো ‘মাজাকি ’ ছাড়াই দেখতাম অবসন্ন ঋত্বিক চন্দ্রকুমার স্টোর্স-এর সিঁড়িতে এলিয়ে আছেন , আমরা দেখতাম জর্জ বিশ্বাস পানের দোকানে , তুমি বিষ্ণু দে’র বাড়ি থেকে এসে অনন্যর খোঁজ করতে --- নবারুণ আমরা তখন ‘খোচড় ’দের চিনতে পারতাম৷ ভিয়েতনাম ছিল , গিনি বিসাও ছিল , চুল্লির প্রহরে আমরা আত্মা সেঁকে নিতে পারতাম৷ ‘প্রত্যাখ্যান ’ শব্দটা বলা হলেই মনে হত মধুবাতা ঋতায়তে৷ ‘প্রত্যাখ্যাত ’ মানিক -ঋত্বিক -জীবনানন্দের নামে সমুদ্রের নোনা জল মধুগন্ধী হয়ে উঠত৷ আমাদের অন্তত বমি করার স্বাধীনতা ছিল নবারুণ৷ আজ ‘পিস হ্যাভেন ’-এ তুমি ঘুমিয়ে থাকবে৷ কিন্ত্ত সেখানেও পরিত্যক্তদের জন্য কোনও আলাদা কক্ষ নেই৷ এই সভ্যতা সবাইকেই অ্যাকোমোডেট করে৷ যারা চে গুয়েভারা হতে চেয়েছিল তারা চাপরাশি হতে পেরেছে৷ নবারুণ তোমায় চলে যাওয়াই ভালো৷ আজ হোচিমিন সরণি জুড়ে শপিংমল৷
আমি জানি তুমি তোমার মতো করে ভবিতব্য বুঝতে পেরেছিলে৷ আমাদের কথা হত৷ পাতাল থেকে আমরা চিরকুট বিনিময় করতাম৷ আমরা দেখতাম হ্যামলিনের বাঁশি কেউ বাজায় না তবু যত ইঁদুর নদী তীরে দাঁড়িয়ে৷ কিছু একটা হতে চাইছে আজকের কলকাতার লোক৷ ডিজিটাল প্রশাসন ঠোঁটে বমির দাগ রাখার অনুমতি দেয় না৷ তা -ই পূজ্যপাদদের বিবস্ত্র করে আমোদ পেতে হল তোমার৷ হূদয় নামক বস্ত্তটি বুকের বাঁ দিকে থাকে বলেই মানুষের ধারণা৷ উপরন্ত্ত মানুষ যূথবদ্ধ জীব৷ তবু আত্মার বামফ্রন্ট গড়ে ওঠেনি আজও৷ ভাগ্যক্রমে একা করবার মতো কিছু কাজ মানুষের কররেখায় নির্দিষ্ট হয়ে আছে৷ যেমন কবিতা লেখা৷ যেমন শ্রাবণের অন্ধকারে বিদ্যুল্লতার মতো বিদ্রুপে ঝলসে উঠে নিজেকে চিরে ফালাফালা করা৷
মনে হয় একবার ভিকতর উগো বলেছিলেন রাজতন্ত্রে আলসে লোক থাকে , প্রজাতন্ত্রে ভবঘুরে৷ তা হলে আমরা আজ কারা ? আমরা কি শিল্পসমাজে , অলীক শহরে , পুনরুত্থিত গণতন্ত্রে , ঝুপড়ি ও আকাশচুম্বনে উদ্বৃত্ত থেকে যাব নবারুণ? আমাদের চিঠিতে সিলমোহর পড়বে না ? দেশজুড়ে রূপসীরা প্রসব করছে ব্যাঙ্কলোনের ইতিকথা , ক্যুইজ সফল যুবক পা মিলিয়ে নিচ্ছে আবৃত্তির মিছিলে , বাথরুমের দরজা হাট করে খুলে রেখে সাবানসুন্দরীরা স্নান সেরে নিল টিভির পর্দায়৷ ভান গখ , উন্মাদ ও নিঃসঙ্গ , বারোটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন নক্ষত্রখচিত রাত্রি৷ হেগেল বলেছিলেন মিনার্ভার প্যাঁচা অন্ধকারেই ওড়ে৷ নবারুণের ফ্যাতাড়ুদেরও ডানা আছে৷
বিদায়মুহূর্তে মানুষকে একা দেখতে ভালো লাগে৷ তন্ত উনুনের আঁচে কি বিভা ! নবারুণকে দেবদূতেদের মতো অপরূপ দেখায়৷ অন্তর্ঘাতের উত্তরাধিকার জমা রেখে সে চলে গেল৷ ‘এক সাথে বেড়াল ও বেড়ালের -মুখে -ধরা -ইঁদুর হাসাতে এমন আশ্চর্য শক্তি ছিলো ভূয়োদর্শী যুবার ’--- যে তার শোকপ্রস্তাব লেখার জন্য কি জীবনানন্দকে ডাকা জরুরি ? জানি না , কিন্ত্ত যারা চেকভের কেরানি , ভগবান ও শয়তানের এলাকার বাইরে যারা , সেই সব তুচ্ছ, জীর্ণ নরনারী যারা সংগঠনে নেই , ফেসবুকেও না তাদের জন্য ইস্তাহার লিখে গেল নবারুণ ভট্টাচার্য৷ নবারুণের লেখা আসলে বমনরহস্য৷ অবাধ্যতার অনার্য মস্করা৷ অথচ নবারুণ দেখেছিল বাতাসে বিপদের গন্ধ ঢের৷ সে নিজের রচনার সূত্রে বিদ্রোহ -বিপণি খুলে ফেলছে না তো ? নিজের লেখা থেকে তৈরি এক ছায়াছবির পোস্টার প্রসঙ্গে এক দিন আমার কাছে সে ভয়ের কথা প্রকাশ করেওছিল৷ এই উত্তর -বিশ্বায়ন নাগরিক যে বাতানুকুল আড্ডায় অভ্যস্ত তার কাপুচিনোর চুমুকে সাহিত্য পড়ার যে মলাট বিলাসিতা সেই পরিসরে তো চে গুয়েভারাও টি-শার্টে! এই যুবক বা যুবতী খিস্তি তরঙ্গেও এক ধরনের অজ্ঞাতকে জানার সুযোগ পেয়ে যায়৷ নবারুণকে তার বিপন্ন ঘাতক মনে হবে ? ‘চুদুরবুদুর ’ তার রসনাবিলাস নির্মাণ করতেই পারে৷ নতুন গন্ধনাশক , নতুন বাথরুম টাইলসের মতোই নতুন এ ভাষা৷ শহরের উদীয়মান মধ্যবিত্ত , বাংলা উপন্যাসের দাম যেহেতু কম , সস্তার বেঙ্গল প্যাকেজে , দুঃখদুর্দশা সত্ত্বেও গরিবেরাও সে আমোদ পায় , তার যে গোপন সুড়ঙ্গ আছে --- নবারুণের সৌজন্যে এ তথ্য জানতে পারে৷ এ ইচ্ছে মধ্যবিত্ত অপরাধবোধকে প্রশমিত করার মুদ্রিত ভায়াগ্রা যার সম্মানমূল্য আছে --- আমার এই কথার উত্তরে নবারুণকে আমি বিষণ্ণ ও চিন্তিত দেখেছিলাম৷
আসলে তো সমস্ত জীবন ধরে সে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুঃশাসনীয় ’ গল্পের একটি সংযোজনী ও প্রতি -প্রস্তাব জুড়তে চেয়েছিল যাতে বাচ্চাদের কাছে হাসি -খুশি মুখে গোপন ধাঁধাটি ফাস করা যায় যে ‘এ মা তুমি ল্যাংটো !’ তার প্রয়াস কত দূর সফল হল না জানি না কিন্ত্ত আমাদের চেনা উপাখ্যানে নবারুণ , আমাদের সহজীবী ও সহযোদ্ধা , অন্য রকম ওয়াচ টাওয়ার৷ তার দেখা পরিচিত স্তনবিভাজিকা ও সুরেলা ব্যর্থতার থেকে অনেক দূরে সদ্য মৃত ইতিহাস ও সদ্যোজাত নাগরিকের সংলাপের অন্তর্বর্তী বেদনার !
যারা চেকভের কেরানি , ভগবান ও শয়তানের এলাকার বাইরে যারা , সেই সব তুচ্ছ, জীর্ণ নরনারী যারা সংগঠনে নেই , ফেসবুকেও না , তাদের জন্য ইস্তাহার লিখে গেল নবারুণ ভট্টাচার্য৷ নবারুণের লেখা আসলে বমনরহস্য৷ অবাধ্যতার অনার্য মস্করা৷ অথচ নবারুণ দেখেছিল বাতাসে বিপদের গন্ধ।
গাজায় তিন জন অবরুদ্ধ শিশু দেওয়ালের ফাটল দিয়ে দেখছিল আকাশের দেবতা তাদের জন্য উড়োজাহাজ থেকে লজেন্স ফেলে দিচ্ছেন৷ মিরাটে কারফিউ শিথিল হলে জনৈকা গৃহবধূ কেরোসিন আনতে গিয়ে দেখলেন দোকানের ঝাপ বন্ধ৷ জনৈক বিচারপতি সে দিনের মতো অধিবেশন সমান্তির ঘোষণা করতে চলেছেন৷ বিকেল চারটে বেজে কুড়ি মিনিট৷ আমার বন্ধু নবারুণ শেষ বার , এই শেষ বার ছোটোলোকেদের গায়ের ঘামের গন্ধ জড়ানো হাওয়া ফুসফুসে ঢুকিয়ে নিলেন৷ আর না ---কোথায় গেল ভান গখের ছবি --- ছেঁড়া মেঘের আক্রোশ ? কোথায় গেল ঋত্বিক ঘটকের ছবির মতো বিপন্নতা ? মেট্রো স্টেশন থেকে মেয়েরা গলগল করে বেরিয়ে আসছে --- শিশু ও মুদ্রা তাদের জঠরে৷ বি -মুভির অরণ্যদেব লোকাল আশালতাকে এসএমএস করে৷ রাষ্ট্রপুঞ্জে চাঁদ উঠবে ঃ পেট্রোডলারের বিষাদপ্রতিমা৷ আর ময়নাগুড়ি ও ভেনিজুয়েলায় ক্ষুধা মানুষকে চাবুক মারবে রোরুদ্যমানিনী আফ্রিকার মতো৷ নবারুণ আমি বুঝতে পারছি শেষ পর্যন্ত রাগের সাদা ফেনা ছাড়া কিছুই থাকবে না৷
কবরডাঙা পার হয়ে ঠাকুরপুকুর পৌঁছতে পৌঁছতে আমার পাঁচটা হবেই৷ আবার ‘টেরিবল ফাইভ ইন দি আফটার নুন’৷ মনে আছে তোমার , চল্লিশ বছর আগে দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে আমাদের চোয়াল শক্ত হতে জানত --- ‘ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে … কি মারাত্মক পাঁচটা বাজল তখন !’ আমরা জানতাম ইতিহাসের ঘর যে রাতে ঝড়ে ভেঙে পড়ে , বিপর্যয় যদি ধাবমান মহিষের শিংয়ে নটরাজ হয়ে দেখা দেয় তবে ও তত্ক্ষণাত্ লোরকা ইগনাশিওর জন্য শোকগাথা লিখে উঠতে পারেন৷ মৃত্যু যেখানে নারীর স্তনদ্বয়ের মতো প্রলয়তুল্য৷ তুমি ছিলে আমাদের শেষ মাতাদর যে তাচ্ছিল্য নিয়ে থুতু ফেলতে পারত৷ আজ আমাদের রক্তের গলি উপগলিতে আর কোনও ব্যারিকেড রইল না নবারুণ৷ এই সব চ্যানেল আর পুচকে সাংবাদিক এখন তোমার অসমান্ত আত্মজীবনী নিজেরাই সমান্ত করার দায়িত্ব নেবে৷ চল , আবার , রাসবিহারীর মোড়ে আড্ডা দেই৷ চল , আমি তোমায় রেখে আসি ঈশ্বরের হাতে৷ স্বর্গের অবিনশ্বর রেস্তোরাঁয় তুমি সমস্ত বন্ধুপরিজনকে ফিরে পাবে --- তোমার বাবা বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক থেকে অনন্য পর্যন্ত সব্বাইকে৷ নবারুণ এমন যন্ত্রণা নেই যা তোমার নির্যাতিত লালের তুলনা৷ আজ তুমি মুক্ত৷ আজ তোমার অভ্যর্থনা৷ তোমার সেই যুবকবেলার আলো আর সুর তুমি ফিরে পাবে৷
মনে আছে তোমার --- রাজা রাজেন্দ্র রোডে প্রথম দিনের আড্ডা৷ অদূরে বিজনবাবু দাঁত মাজছিলেন , আমি একটু থমকে দাঁড়াই৷ তোমার ছোট্টো ঘর --- মায়াকোভস্কির ছবি --- তুমি কপট গাম্ভীর্যে বলেছিলে --- ‘এই তোশকে বিজন ভট্টাচার্য ঋত্বিক ঘটকের বমির দাগ আছে৷ এখানে কোন মাজাকি চলবে না গুরু!’ নবারুণ আমরা তো ‘মাজাকি ’ ছাড়াই দেখতাম অবসন্ন ঋত্বিক চন্দ্রকুমার স্টোর্স-এর সিঁড়িতে এলিয়ে আছেন , আমরা দেখতাম জর্জ বিশ্বাস পানের দোকানে , তুমি বিষ্ণু দে’র বাড়ি থেকে এসে অনন্যর খোঁজ করতে --- নবারুণ আমরা তখন ‘খোচড় ’দের চিনতে পারতাম৷ ভিয়েতনাম ছিল , গিনি বিসাও ছিল , চুল্লির প্রহরে আমরা আত্মা সেঁকে নিতে পারতাম৷ ‘প্রত্যাখ্যান ’ শব্দটা বলা হলেই মনে হত মধুবাতা ঋতায়তে৷ ‘প্রত্যাখ্যাত ’ মানিক -ঋত্বিক -জীবনানন্দের নামে সমুদ্রের নোনা জল মধুগন্ধী হয়ে উঠত৷ আমাদের অন্তত বমি করার স্বাধীনতা ছিল নবারুণ৷ আজ ‘পিস হ্যাভেন ’-এ তুমি ঘুমিয়ে থাকবে৷ কিন্ত্ত সেখানেও পরিত্যক্তদের জন্য কোনও আলাদা কক্ষ নেই৷ এই সভ্যতা সবাইকেই অ্যাকোমোডেট করে৷ যারা চে গুয়েভারা হতে চেয়েছিল তারা চাপরাশি হতে পেরেছে৷ নবারুণ তোমায় চলে যাওয়াই ভালো৷ আজ হোচিমিন সরণি জুড়ে শপিংমল৷
আমি জানি তুমি তোমার মতো করে ভবিতব্য বুঝতে পেরেছিলে৷ আমাদের কথা হত৷ পাতাল থেকে আমরা চিরকুট বিনিময় করতাম৷ আমরা দেখতাম হ্যামলিনের বাঁশি কেউ বাজায় না তবু যত ইঁদুর নদী তীরে দাঁড়িয়ে৷ কিছু একটা হতে চাইছে আজকের কলকাতার লোক৷ ডিজিটাল প্রশাসন ঠোঁটে বমির দাগ রাখার অনুমতি দেয় না৷ তা -ই পূজ্যপাদদের বিবস্ত্র করে আমোদ পেতে হল তোমার৷ হূদয় নামক বস্ত্তটি বুকের বাঁ দিকে থাকে বলেই মানুষের ধারণা৷ উপরন্ত্ত মানুষ যূথবদ্ধ জীব৷ তবু আত্মার বামফ্রন্ট গড়ে ওঠেনি আজও৷ ভাগ্যক্রমে একা করবার মতো কিছু কাজ মানুষের কররেখায় নির্দিষ্ট হয়ে আছে৷ যেমন কবিতা লেখা৷ যেমন শ্রাবণের অন্ধকারে বিদ্যুল্লতার মতো বিদ্রুপে ঝলসে উঠে নিজেকে চিরে ফালাফালা করা৷
মনে হয় একবার ভিকতর উগো বলেছিলেন রাজতন্ত্রে আলসে লোক থাকে , প্রজাতন্ত্রে ভবঘুরে৷ তা হলে আমরা আজ কারা ? আমরা কি শিল্পসমাজে , অলীক শহরে , পুনরুত্থিত গণতন্ত্রে , ঝুপড়ি ও আকাশচুম্বনে উদ্বৃত্ত থেকে যাব নবারুণ? আমাদের চিঠিতে সিলমোহর পড়বে না ? দেশজুড়ে রূপসীরা প্রসব করছে ব্যাঙ্কলোনের ইতিকথা , ক্যুইজ সফল যুবক পা মিলিয়ে নিচ্ছে আবৃত্তির মিছিলে , বাথরুমের দরজা হাট করে খুলে রেখে সাবানসুন্দরীরা স্নান সেরে নিল টিভির পর্দায়৷ ভান গখ , উন্মাদ ও নিঃসঙ্গ , বারোটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন নক্ষত্রখচিত রাত্রি৷ হেগেল বলেছিলেন মিনার্ভার প্যাঁচা অন্ধকারেই ওড়ে৷ নবারুণের ফ্যাতাড়ুদেরও ডানা আছে৷
বিদায়মুহূর্তে মানুষকে একা দেখতে ভালো লাগে৷ তন্ত উনুনের আঁচে কি বিভা ! নবারুণকে দেবদূতেদের মতো অপরূপ দেখায়৷ অন্তর্ঘাতের উত্তরাধিকার জমা রেখে সে চলে গেল৷ ‘এক সাথে বেড়াল ও বেড়ালের -মুখে -ধরা -ইঁদুর হাসাতে এমন আশ্চর্য শক্তি ছিলো ভূয়োদর্শী যুবার ’--- যে তার শোকপ্রস্তাব লেখার জন্য কি জীবনানন্দকে ডাকা জরুরি ? জানি না , কিন্ত্ত যারা চেকভের কেরানি , ভগবান ও শয়তানের এলাকার বাইরে যারা , সেই সব তুচ্ছ, জীর্ণ নরনারী যারা সংগঠনে নেই , ফেসবুকেও না তাদের জন্য ইস্তাহার লিখে গেল নবারুণ ভট্টাচার্য৷ নবারুণের লেখা আসলে বমনরহস্য৷ অবাধ্যতার অনার্য মস্করা৷ অথচ নবারুণ দেখেছিল বাতাসে বিপদের গন্ধ ঢের৷ সে নিজের রচনার সূত্রে বিদ্রোহ -বিপণি খুলে ফেলছে না তো ? নিজের লেখা থেকে তৈরি এক ছায়াছবির পোস্টার প্রসঙ্গে এক দিন আমার কাছে সে ভয়ের কথা প্রকাশ করেওছিল৷ এই উত্তর -বিশ্বায়ন নাগরিক যে বাতানুকুল আড্ডায় অভ্যস্ত তার কাপুচিনোর চুমুকে সাহিত্য পড়ার যে মলাট বিলাসিতা সেই পরিসরে তো চে গুয়েভারাও টি-শার্টে! এই যুবক বা যুবতী খিস্তি তরঙ্গেও এক ধরনের অজ্ঞাতকে জানার সুযোগ পেয়ে যায়৷ নবারুণকে তার বিপন্ন ঘাতক মনে হবে ? ‘চুদুরবুদুর ’ তার রসনাবিলাস নির্মাণ করতেই পারে৷ নতুন গন্ধনাশক , নতুন বাথরুম টাইলসের মতোই নতুন এ ভাষা৷ শহরের উদীয়মান মধ্যবিত্ত , বাংলা উপন্যাসের দাম যেহেতু কম , সস্তার বেঙ্গল প্যাকেজে , দুঃখদুর্দশা সত্ত্বেও গরিবেরাও সে আমোদ পায় , তার যে গোপন সুড়ঙ্গ আছে --- নবারুণের সৌজন্যে এ তথ্য জানতে পারে৷ এ ইচ্ছে মধ্যবিত্ত অপরাধবোধকে প্রশমিত করার মুদ্রিত ভায়াগ্রা যার সম্মানমূল্য আছে --- আমার এই কথার উত্তরে নবারুণকে আমি বিষণ্ণ ও চিন্তিত দেখেছিলাম৷
আসলে তো সমস্ত জীবন ধরে সে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুঃশাসনীয় ’ গল্পের একটি সংযোজনী ও প্রতি -প্রস্তাব জুড়তে চেয়েছিল যাতে বাচ্চাদের কাছে হাসি -খুশি মুখে গোপন ধাঁধাটি ফাস করা যায় যে ‘এ মা তুমি ল্যাংটো !’ তার প্রয়াস কত দূর সফল হল না জানি না কিন্ত্ত আমাদের চেনা উপাখ্যানে নবারুণ , আমাদের সহজীবী ও সহযোদ্ধা , অন্য রকম ওয়াচ টাওয়ার৷ তার দেখা পরিচিত স্তনবিভাজিকা ও সুরেলা ব্যর্থতার থেকে অনেক দূরে সদ্য মৃত ইতিহাস ও সদ্যোজাত নাগরিকের সংলাপের অন্তর্বর্তী বেদনার !
0 মন্তব্যসমূহ