বিপুল দাসের নিজের গল্প নিয়ে নিজের কথা

আমার এক বন্ধুর কাছে গল্প শুনেছিলাম, বারো বছর বয়সেই সে প্রথম লিঙ্গোত্থান ব্যাপারটি বুঝতে পারে। এ গল্প সে আমাদের কাছে অনেক পরে বেশ রসিয়ে বলেছিল। কৌশলী বাক্যের নির্মাণ সবাই অল্পবিস্তর শিখেছি। সুতরাং বাবলুর গল্পে দুধ ও জলের অনুপাত বুঝতে পেরেছিলাম। মূল ঘটনা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য ছিল। এখন বুঝতে পারি, হ্যাঁ, ওরকম হতেই পারে।
সিড়িঙ্গে বাবলু বোকার মত কলাগাছ বেয়ে কিছুটা উঠেছিল। তাকে কলাপাতা জোগাড় করতে বলা হয়েছিল। অনেক কায়দা কসরত করে সে কিছুটা ওঠেও। তারপর হড়হড় করে নেমে আসার সময় সে দুহাত, দুপায়ের বেড় দিয়ে গাছ চেপে ধরেছিল। তবুও সে নামতে থাকে। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল এই ঘর্ষণ। কিন্তু ওই স্বল্পকালের ভেতরেই এক চিরন্তন উত্থান হয়। নারীর সুপুষ্ট উরুর মত কলাগাছ সে তার দুপায়ের মাঝে চেপে ধরেছিল। সরসর পতনে যে সংঘর্ষ হয়, তার ফলে বারো বছর বয়সের এক বালকের শরীর জেগে ওঠে।

কোথা থেকে আসে সংকেত ? বালক তো জানে না কদলী-কান্ডের বিখ্যাত উপমা। তবে কি প্রয়োজনীয় ঘর্ষণই প্রস্তুত করে জন্মগাথায় শস্ত্রের নির্মাণ ? ভুবনজোড়া মাটি, বিস্তৃত প্রকৃতি অপেক্ষা করে থাকে সমর্থ একটি লাঙলের ফালে বিদীর্ণ হবে বলে। দীর্ণ হতে হতে মাটির শীৎকার – এ কী আনন্দ, এ কী আনন্দ। এই আনন্দ আসলে প্রাণের গোপন কথা। সৃষ্টির কথা। জীবনপ্রবাহে অনন্ত অমৃতধারার কথা। আসলে চাই ঘর্ষণ। একটা ফেনোমেনন। বর্ষণসম্ভব কালো মেঘেঢাকা আকাশে চকিত তড়িৎ-মোক্ষণ। এই ‘ক্বচিৎ তড়িৎ আলোক’ কেউ বারো বছর বয়সেই টের পায়, কেউ সারা জীবনেও টের পায় না আক্রমণটা কখন হল, কীভাবে হল।
বড় হতে থাকি। বন্ধুরা ষাট ফোঁটা রক্তের আসল তাৎপর্য বুঝিয়ে দেয়। হঠকারী কাজকর্মের জন্য অনুশোচনা হয়। মালা সিনহা, আশা পারেখ, নন্দা, সায়রা বানুর বুক ও পেছনের তুল্যমূল্য আলোচনায় বেশ জ্ঞান হয়। কিন্তু দাদার ভয়ে সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরতে হয়। বন্ধুরা পি ডাব্লু ডির মাঠে হেলা-শিরীষ গাছে বসে পা দোলায়। দীপক আয়ি মিলন কি বেলার গান অ্যাকিউরেট সুরে গায়। শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারে স্টুডেন্টদের চাঁদা চার আনা। আমি মেম্বার হয়ে গেলাম। ওই চার আনাই ছিল চিচিং ফাঁকের মন্ত্র। তখন স্বর্গের দরজা খুলিয়া গেল।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি লিটল ম্যাগাজিন করার পরিকল্পনা হল। মূলত আমি, গীতাংশু কর আর নিখিল বসু ছিলাম এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনার পুরোভাগে। কলকাতা থেকে লেখা সংগ্রহ, পটলডাঙার ‘অমি প্রেস’-এ ছাপানোর দেখভালের দায়িত্ব অনেকটাই স্বেচ্ছায় নিয়েছিল বন্ধু অঞ্জন সেন, কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল ও নিশীথ ভড়। আমার কাছে ‘ফিরে এসো চাকা’ আছে শুনে নিখিল অবাক হয়ে যায়। পত্রিকার নাম ‘পাহাড়তলি’ ও-ই ঠিক করে। আমাকে বলে – তুমি গল্প লিখবে। বুঝি, ব্যাপারটা সিরিয়াস। এমনি সময় তো ‘তুই’ করে বলে।
‘অ্যান্টিবায়োটিক’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম। অনেকে এখনও গল্পটার কথা বলে। ওই গল্পটাই আমার গল্পের জগতে যাত্রার সবুজ-সংকেত। ওই গল্পটাই আমাকে পেছন থেকে লাথ মেরে অপার দুঃখের জগতে ঠেলে দিয়েছে। মাঝে কিছুদিন নাটক নিয়ে এবং বেশ কিছুদিন সেতার রগড়ে আবার গল্পের কাছে ফিরে এসে অসহায় আত্ম-সমর্পণ করি। মাঝের সময়ে লেখালাখি করেছি, কিন্তু অনিয়মিত, টেনশন ছাড়া। ওভাবে গল্প হয় না। দুটি অসমতলের ঘর্ষণ ছাড়া, নিজেকে সংকটাপন্ন করে তুলতে না পারলে লেখা হয় না। এ সত্য আমাকে শিখিয়ে গেছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কাছে আমি জীবন ও শিল্প সম্বন্ধে অনেক গূঢ় কথা জেনেছি।
লেখক তো স্রষ্টা। সৃষ্টির রসায়ন তার চৈতন্যে সব সময় কাজ করতে থাকে। এই ক্রিয়াশীলতা সব সময় চেষ্টা করে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে। দড়িটা ছুঁয়ে দিলে একটা গল্পের জন্ম হয়। এখন ‘জন্ম’ এই শব্দ তার প্রচলিত অর্থ অতিক্রম করলে অনেক রক্ত দেখা যাবে। এই শব্দের আগে উঁকি দেয় “নিষেক’ নামে আর একটি শব্দ। শক্তিপ্রবাহ থেকে সাঁতরে উঠে আসা একটি কণা কোনও এক আধারের প্রাচীর ভেদ করে। রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয় গর্ভমন্দিরের পিচ্ছিল অন্ধকারে। পাবলিক বলে যে – কনসিভ করেছে।
কার সঙ্গে কার নিষেক ? একটি গল্পের বীজ সার্থক জন্মের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে কোথায় আঘাতটা করবে ? প্রত্যেক মানুষই দ্রষ্টা। কিন্তু লেখক, তিনি যেমনই লিখুন, দ্রষ্টার সংজ্ঞা পার হয়ে স্রষ্টার ভূমিকায় আসেন শুধুমাত্র ওই বীজ বপন করার ক্ষমতার ফলে। সৃষ্টির রসায়ন তার চৈতন্যে সব সময় কাজ করে। যে সমাজে লেখকের শেকড়, যে বাতাসে তার রেসপিরেশন, সেই মাটির গর্ভে চলে যায় তার বোধের শেকড়। সেই বাতাস থেকে নেয় মেধার অক্সিজেন। দুচোখ, দুকান দিয়ে শুষে নেওয়া এই সব উপাদান – যুদ্ধ, ভালোবাসা, ঘৃণা, দেওয়ালে-পিঠ-ঠেকেযাওয়া মানুষের সামনের দিকে মরণ-ঝাঁপ, পাহাড় ও নদী – মানুষের অস্থিমজ্জারক্তে শোষিত হতে থাকে। রক্তের ভেতরে ঘোরাফেরা করে। গোপনে একটি বীজের জন্ম হয়। সৃষ্টির জন্য একটা প্যাশান কাজ করতে শুরু করে। শেষে এইসব ঘটনাবলী, আপাতভাবে হয়তো তুচ্ছ, লেখকের মননের বকযন্ত্রে চোলাই হয়। একটি শায়ক তৈরি হয়।
তারপর অপেক্ষা। বাসের ভেতরে দেখা কোনও ঘটনা, ট্রেনের জানালা দিয়ে এক ঝলক দেখা কোনও দৃশ্য, খবরের কাগজে পড়া কোনও খবর হঠাৎ মগজে আলোড়ন তোলে। সেই বীজের ঘুম ভাঙে। সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিদ্ধ করবে বলে তার গমন শুরু হয়।
এরপর আঘাত। এই আঘাত হয় সম্ভাব্যতার ওপর। দেখা, শোনা ও পাঠের অভিজ্ঞতায় লেখকের মনোজগতে যে তীক্ষ্ণ শায়কটি তৈরি হয়েছে, সেই আয়ুধ এখন ছুটে যায় এক সেট সম্ভাব্য ঘটনাবলীর দিকে। ওই সেটের ভেতর থেকে একটি সম্ভাব্য ঘটনার আধারকে বিদ্ধ করে বীজ। ওই আধারের প্রাচীরকে ভেদ করতে পারলে ওই বীজ নিষিক্ত করে ‘ঘটতে পারে’ এমন এক সম্ভবনাকে।
এরপর তো লেখকের চতুরালি। বাক্যবিন্যাস, শব্দচয়ন, শৈলী ইত্যাদির কেরামতি। ভ্রূণের হাতপা গজায়, জীবনবোধের ‘জিন’ ঠিক করে দেয় সেই ভ্রূণের চোখের মণির রং, চুলের বৈশিষ্ট্য, সেই গল্পের মেজাজ। মেদমাংসরক্ত নিয়ে একটি গল্পপ্রতিমা গড়ে ওঠে। দেখা, শোনা ও পাঠের অভিজ্ঞতা লেখকের মনোজগতে জারিত হতে হতে যে জীবনবোধ গড়ে ওঠে, সেই বোধ এখন এক প্লাসেন্টা হয়। তার ভেতরে জেগে ওঠে গল্পপ্রতিমা। আস্তে আস্তে একমেটে হয়, দোমেটে হয়। ডাকের সাজ ও গর্জন তেলে প্রতিমা ঝলমল করে ওঠে।
কী হবে আমার জীবনবোধ, আমি কী লিখব – বেশ কিছু ফ্যাক্টর অবশ্যই নির্ভর করে আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, যা গড়ে উঠেছে আমার নিজস্ব ন্যায়নীতিবিবেকবোধ থেকে। আমার রাজনৈতিক আদর্শ, ব্যক্তিগত সততা-অসততা সম্পর্কে ধারণার ওপর। দেশি পুঁজি, বিদেশি পুঁজির সমস্যা অতটা না জানলেও চলে, কিন্তু দেওয়ালে-পিঠ-ঠেকে-যাওয়া-মানুষের সামনের দিকে মরণ-ঝাঁপ, ঠাকুর শিউপ্রসাদের নাগরার নীচে ধর্ষিতা ফুলমোতিয়ার অসহায় কান্না, মানুষের বিপন্নতা, জীবনের দিকে ঘৃণা ও ভালোবাসা –এসব তো খুব তীক্ষ্ণ হয়ে জেগে থাকার লক্ষণ। কী লিখতে চাই –এসব ক্ষেত্রে কোনও সমস্যার সৃষ্টি করে না।
প্রাণের রসায়ণ দেখে আমি খুব অবাক হয়ে যাই। অনেক গল্প এই রহস্য নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। প্রাণের এই ফুটে ওঠা, শুকনো পাথর ফাটিয়ে অশ্বত্থের বেঁচে থাকা, সীমাহীন বরফের প্রান্তর, যেই বসন্ত এলো, বরফ গলতে শুরু করল। ছোট ছোট সবুজ মাথা তুলে দাঁড়াল। কোথায় ছিল প্রাণ ? কে আড়াল করে রেখেছিল ? কত বিপর্যয় পার হয়ে বেঁচে আছে আরশোলা, সিলাকান্থ মাছ। পদ্মফুলের বীজ একশ বছর বেঁচে থাকে। এর মাঝে জল, অন্ধকারে নরম কাদামাটি পেলেই জেগে ওঠে।
ডারউইন, ল্যামার্ক, মার্ক্স, ফ্রয়েডের বিশ্লেষনের পরও আর কিছু আছে নাকি ? এ প্রশ্ন আমার অনেক দিনের। বিমা কোম্পানির হাতের আড়ালে সলতেটুকু জ্বলতে থাকা, বৃতির আড়ালে কুঁড়ির সুরক্ষা – ও প্রাণ, এসো প্রাণ.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ