বাবার জীবনে একটি ব্যক্তিরই গভীর প্রভাব ছিল৷ আমার ঠাকুর্দা, বিজন ভট্টাচার্য, যিনি একাধারে ছিলেন বাবার পিতা , মাতা এবং ‘মেন্টর ’৷ ’ লিখছেন তথাগত ভট্টাচার্য
কুকুর , বিড়াল এবং পাখি আমাদের বাগানটার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে থাকত৷ পশু , পাখি , পোকামাকড় , ঝোপঝাড় , আগাছা সবই বাবার পৃথিবীতে খুব গভীর জায়গা নিয়ে হাজির ছিল৷
বাবার চলে যাওয়ার মুহূর্তে আপনারা অনেকেই জানিয়েছেন , পাশে আছি৷ ‘সলিডারিটি ’-র সেই সব বার্তা (হঁ্যা , ‘সলিডারিটি ’-ই বলব , ‘শোক ’ শব্দটা এখানে অপ্রয়োজনীয় ) আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করি৷ প্রত্যেককে আলাদা ভাবে উত্তর দেওয়া অঙ্কের হিসেবেই অসম্ভব , তার জন্য দুঃখিত৷ আমার বাবা এমন কিছু নীতিতে (‘প্রিন্সিপল ’ অর্থে) আস্থা রাখতেন , যেগুলো আজকের দুনিয়ার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না৷ হয়তো ভালোই হয়েছে যে এই পৃথিবীটা তাঁকে আর বেশিদিন সহ্য করতে হল না৷ তবে , যত দিন বাংলা ভাষা থাকবে , গরিব , লুম্পেন , দুনিয়ার যত বাতিল , ক্ষমতাহীন মানুষেরা থাকবেন , তত দিন বাবার লেখালিখি সম্ভবত প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না৷
২০০৩ -এ অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমরা একটা মাসিক সাহিত্যপত্রিকা শুরু করেছিলাম , ভাষাবন্ধন৷ পরে সেটা ত্রৈমাসিক হয়ে যায়৷ সেই অভিযাত্রা বন্ধ হবে না৷ বাবার পক্ষে পত্রিকাটা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ কোনও রকম প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃত ছিলেন তিনি৷ মেরুদণ্ডটি ছিল ঋজু, বাংলার হালফিল বুদ্ধিজীবী মহলে যেটা কার্যত দুর্লভই বলা চলে৷ তবে , আপনারা যদি পত্রিকাটি চালানোর ব্যাপারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনও রকম সাহায্য করতে চান , স্বাগত জানাব৷
চতুর্দিকে যে ভাবে নানাবিধ গুজব , দাবি -দাওয়া ইত্যাদি উড়ছে , সেই সূত্রে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া জরুরি৷ ১. আমার বাবা কোনও রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানের থেকে কোনও রকম সাহায্য পাননি৷ চানওনি কখনও৷ আমাদের পরিবারও এই রকম কোনও সাহায্য প্রার্থনা করেনি বা গ্রহণ করেনি৷ তাঁর কোনও সাহায্য দরকারই ছিল না৷ ২. বাবার জীবনে মাত্র একটি ব্যক্তিরই গভীর প্রভাব ছিল৷ তিনি আমার ঠাকুর্দা, বিজন ভট্টাচার্য, যিনি একাধারে ছিলেন বাবার পিতা , মাতা এবং ‘মেন্টর ’ (জানি না , এই শব্দটির যথাযথ বাংলা প্রতিশব্দ কী হবে )৷ আমার বাবাকে বুঝতে হলে , তিনি যে অনমনীয় শিরদাঁড়াটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন , তার একটা আঁচ অন্তত পেতে হলে ‘পদাতিক ’ ছবিটি দেখতে পারেন , বিশেষ করে ছবিটির শেষের দিকে সেই অংশটুকু যেখানে আমার ঠাকুর্দা বলছেন , ‘আমি কিন্ত্ত কখনও কোনও কম্প্রোমাইজ করিনি ’৷ এটাই আমাদের পরিবার৷ বাবার জীবনে আর যাঁরা এসেছেন , তাঁরা বিখ্যাত হোন বা না -ই হোন , তাঁদের সঙ্গে তাঁর রক্তের সম্পর্ক থাক বা না -ই থাক , বলে রাখা ভালো , বাবার কাছে তাঁরা সকলেই ছিলেন সেই পেটের অসুখটার মতো , যা চার বছরে এক বার দিন তিনেকের জন্য হবেই৷
৩ . জীবনের অন্তিম শ্বাসটি পর্যন্ত বাবা মার্কসবাদে আস্থা হারাননি৷ তবে , যে শ্রেণিহীন , ন্যায়বান বিশ্বে তিনি আস্থা রাখতেন , সেটা নিছক এই মানুষী সমাজের গণ্ডিতে বন্দি থাকেনি৷ আপনারা অনেকেই , যাঁরা আমাকে ছোটবেলায় দেখেছেন , আমাদের বাড়ি আসতেন , তাঁদের মনে পড়তে পারে আমাদের বাড়িটা ছিল দিব্যি একটা পশুপাখির পুনর্বাসন কেন্দ্র গোছের , সেখানে কুকুর , বিড়াল এবং পাখি (আহত এবং নাদুসনুদুস উভয়ই ) আমাদের বাগানটার মধ্যে বেশ ঠাসাঠাসি করে থাকত৷ পশু , পাখি , পোকামাকড় , ছোটখাট ঝোপঝাড় , আগাছা এই সবই বাবার নিজস্ব পৃথিবীতে খুব গভীর জায়গা নিয়ে হাজির ছিল৷
৪ . বাবা ছিলেন খুব গভীর অর্থে ‘স্পিরিচুয়াল ’, যদিও প্রথা -আচার ইত্যাদিতে একেবারেই বিশ্বাস করতেন না৷ তাঁর একটা ‘ফেথ ’ ছিল৷ জানি , আপনাদের কারও কারও খটকা লাগবে , কিন্ত্ত এক বার যদি মার্কসবাদের যুক্তিটাকে নিছক এই মানবসমাজের বাইরে আরও ছড়ানো একটা পৃথিবীর প্রেক্ষিতে দেখেন , বুঝতে পারবেন , আলোটা কোথায়৷ আপনাকে ঘুরতে হবে , খুঁটিয়ে দেখতে হবে , অনুভব করতে হবে জীবনের নানা কোণ -কুলুঙ্গি৷ এই জীবনটার সঙ্গে জুড়ে থাকতে হবে , আবার একই সঙ্গে তাকে বাইরে থেকে দেখাটাও জরুরি৷ এটাও উপলব্ধি করা জরুরি যে , সরল , অনাড়ম্বর জীবনযাপনের একমাত্র রাস্তা হল অহিংসা৷ আপনাদের অনেকের পক্ষেই এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে , মার্শাল ভদি , মেজর বল্লভ বক্সি , ফ্যাতাড়ুদের স্রষ্টার অন্দরমহলটি এ রকম ছিল , কিন্ত্ত কিছু কিছু বিষয় তো সত্যি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায় , শুধুমাত্র সন্তানই তার বাবা সম্পর্কে যে সব কথা জানতে পারে , অন্য কেউ না৷ বাবা বৌদ্ধ এবং হিন্দুধর্ম নিয়ে গভীর ভাবে পড়াশোনা করতেন৷ একটা বিশেষ জায়গা ছিল , যেখানে তিনি ধ্যানে বসতেন৷ আমরা জানি , এখনও বসেন , যদিও তাঁর শরীরটা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে৷
বাবা যে পরিমাণ স্বীকৃতি , কাল্ট স্টেটাস এবং পাঠকমণ্ডলী অর্জন করেছিলেন , সেটাই হয়তো প্রমাণ করে দশকের পর দশক তাঁর লেখালিখি একই রকম প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে৷ এই সূত্রে আমি জানাতে চাই যে , নিউ ইয়র্ক-স্থিত নিউ ডিরেকশনস ‘হারবার্ট’ ছাপছে৷ একটি জার্মান সংস্করণেরও কাজ চলছে৷ ভারতের একটি নামি প্রকাশনা সংস্থা তাঁর অন্য পাঁচটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক স্তরে৷ বাবার লেখা ছিল বিশিষ্ট ভাবে আধুনিক , অন্তর্দৃষ্টিতে ক্ষুরধার , আন্তর্জাতিক এবং আরবান৷ বাবার পড়াশোনা ছিল যাকে বলে ‘এনসাইক্লোপিডিক ’৷ প্রায় যে কোনও বিষয় নিয়েই তাঁর সামনে খাপ খোলাটা কঠিন ছিল৷ দেখেশুনে মনে হচ্ছে , পুকুরের তেলাপিয়া আর গঙ্গাসাগরে পেঁৗছেই খুশি নয় , এ বার সে হুমকি দিচ্ছে , নির্ঘাত্ মহাসাগর পেরোবে৷
ব্যক্তিগত জীবনে বাবা আশ্চর্য একটি সহযাত্রী পেয়েছিলেন৷ আমার মা৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিনষ্ট হওয়ার পর বাবা যখন কর্মহীন , মায়ের অপরিসীম শক্তি এবং সাহচর্যেই সেই দুঃসময়ে ভেসে থাকতে পেরেছিলেন৷ আমার স্ত্রী এবং পুত্রের সঙ্গেও বাবার যোগাযোগ ছিল দারুণ৷ এই সূত্রে জানাই , আইটিইউ -য়ের অন্তিম সন্ত্রাসে প্রবেশের আগে বাবা শুনেছিলেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম ’৷ বাবার শোনা শেষ গান৷ নীলা , আমার স্ত্রী , গেয়েছিল৷ আমার ছেলে স্বয়ম ওঁকে ‘বাপ্পা ’ বলত৷ বাবা ‘দাদু’ ডাকের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন , বুড়োই তো হননি , তা হলে ‘দাদু’ কীসের ? যে পাত্রে বাবার ভস্মাবশেষ রাখা আছে , তাকে স্বয়ম এখনও ‘বাপ্পা ’ই বলে৷ বাবার দেহাবশেষ আমরা গঙ্গায় ভাসাইনি৷ তিনি বাড়িতে আমাদের সঙ্গেই থাকবেন৷
সে দিন নীলা গানটি গাওয়ার আগে বাবাকে আমি দুটো গান শুনিয়েছিলাম৷ ফোন থেকে৷ বাবার খুব প্রিয় দুটো গান৷ লেওনার্ড কোহেন -এর ‘ওয়েটিং ফর দ্য মিরাকল ’ আর মুকেশের গলায় ‘জিনা ইহাঁ মরনা ইহাঁ’৷ তখন বাবা প্রায় বাক্শক্তিরহিত৷ স্মিত হাসির রেখা ফুটল মুখে , চোখদুটো বন্ধ করলেন৷ মুকেশ তখন গাইছেন , ‘কাল খেল মে হম হো না হো , গর্দিশ মে তারে রহেঙ্গে সদা /ভুলেঙ্গে হম ভুলেঙ্গে উও , পর হম তুমহারে রহেঙ্গে সদা ’!ব্যক্তিগত জীবনে বাবা শুধু একটি জিনিস থেকেই বঞ্চিত ছিলেন৷ মাতৃস্নেহ৷ কিন্ত্ত , জন্মদাত্রীর সেই শূন্যস্থানটি পূর্ণ করে দিয়েছিলেন বাবার বাবা , বিজন ভট্টাচার্য৷ বন্ধু, সহকর্মী , সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের মধ্যে অনেক আশ্চর্য সাথী পেয়েছিলেন তিনি৷ সিপিআইএমএল লিবারেশনের সদস্যরা তাঁর অন্তিম দিনটি পর্যন্ত পাশে ছিলেন৷ ছিলেন ভাষাবন্ধন -এর সহকর্মীরা৷
গত মে মাসের শেষে বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি প্রসঙ্গে জনৈক পাঠক তাঁকে একটি মেসেজ করেন৷ বাবা জবাব দেন ১ অগস্ট৷ বাবার সেই জবাবি মেসেজ তিনি আমাকে ফরওয়ার্ড করেছেন৷ দেখছি , বাবা তাঁকে লিখছেন , ‘কেঁদো না৷ আমি এখন যে অবস্থায় আছি , তাকে এগজিস্টেনশিয়ালিস্টরা বলেন বর্ডারলাইন সিচুয়েশন৷ আত্মমর্যাদা এবং সাহস অক্ষুণ্ণ রেখে আমাকে তার মুখোমুখি হতে হবে --- নবারুণ ’৷
(সংক্ষেপিত )
কুকুর , বিড়াল এবং পাখি আমাদের বাগানটার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে থাকত৷ পশু , পাখি , পোকামাকড় , ঝোপঝাড় , আগাছা সবই বাবার পৃথিবীতে খুব গভীর জায়গা নিয়ে হাজির ছিল৷
বাবার চলে যাওয়ার মুহূর্তে আপনারা অনেকেই জানিয়েছেন , পাশে আছি৷ ‘সলিডারিটি ’-র সেই সব বার্তা (হঁ্যা , ‘সলিডারিটি ’-ই বলব , ‘শোক ’ শব্দটা এখানে অপ্রয়োজনীয় ) আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করি৷ প্রত্যেককে আলাদা ভাবে উত্তর দেওয়া অঙ্কের হিসেবেই অসম্ভব , তার জন্য দুঃখিত৷ আমার বাবা এমন কিছু নীতিতে (‘প্রিন্সিপল ’ অর্থে) আস্থা রাখতেন , যেগুলো আজকের দুনিয়ার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না৷ হয়তো ভালোই হয়েছে যে এই পৃথিবীটা তাঁকে আর বেশিদিন সহ্য করতে হল না৷ তবে , যত দিন বাংলা ভাষা থাকবে , গরিব , লুম্পেন , দুনিয়ার যত বাতিল , ক্ষমতাহীন মানুষেরা থাকবেন , তত দিন বাবার লেখালিখি সম্ভবত প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না৷
২০০৩ -এ অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমরা একটা মাসিক সাহিত্যপত্রিকা শুরু করেছিলাম , ভাষাবন্ধন৷ পরে সেটা ত্রৈমাসিক হয়ে যায়৷ সেই অভিযাত্রা বন্ধ হবে না৷ বাবার পক্ষে পত্রিকাটা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ কোনও রকম প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃত ছিলেন তিনি৷ মেরুদণ্ডটি ছিল ঋজু, বাংলার হালফিল বুদ্ধিজীবী মহলে যেটা কার্যত দুর্লভই বলা চলে৷ তবে , আপনারা যদি পত্রিকাটি চালানোর ব্যাপারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনও রকম সাহায্য করতে চান , স্বাগত জানাব৷
চতুর্দিকে যে ভাবে নানাবিধ গুজব , দাবি -দাওয়া ইত্যাদি উড়ছে , সেই সূত্রে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া জরুরি৷ ১. আমার বাবা কোনও রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানের থেকে কোনও রকম সাহায্য পাননি৷ চানওনি কখনও৷ আমাদের পরিবারও এই রকম কোনও সাহায্য প্রার্থনা করেনি বা গ্রহণ করেনি৷ তাঁর কোনও সাহায্য দরকারই ছিল না৷ ২. বাবার জীবনে মাত্র একটি ব্যক্তিরই গভীর প্রভাব ছিল৷ তিনি আমার ঠাকুর্দা, বিজন ভট্টাচার্য, যিনি একাধারে ছিলেন বাবার পিতা , মাতা এবং ‘মেন্টর ’ (জানি না , এই শব্দটির যথাযথ বাংলা প্রতিশব্দ কী হবে )৷ আমার বাবাকে বুঝতে হলে , তিনি যে অনমনীয় শিরদাঁড়াটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন , তার একটা আঁচ অন্তত পেতে হলে ‘পদাতিক ’ ছবিটি দেখতে পারেন , বিশেষ করে ছবিটির শেষের দিকে সেই অংশটুকু যেখানে আমার ঠাকুর্দা বলছেন , ‘আমি কিন্ত্ত কখনও কোনও কম্প্রোমাইজ করিনি ’৷ এটাই আমাদের পরিবার৷ বাবার জীবনে আর যাঁরা এসেছেন , তাঁরা বিখ্যাত হোন বা না -ই হোন , তাঁদের সঙ্গে তাঁর রক্তের সম্পর্ক থাক বা না -ই থাক , বলে রাখা ভালো , বাবার কাছে তাঁরা সকলেই ছিলেন সেই পেটের অসুখটার মতো , যা চার বছরে এক বার দিন তিনেকের জন্য হবেই৷
৩ . জীবনের অন্তিম শ্বাসটি পর্যন্ত বাবা মার্কসবাদে আস্থা হারাননি৷ তবে , যে শ্রেণিহীন , ন্যায়বান বিশ্বে তিনি আস্থা রাখতেন , সেটা নিছক এই মানুষী সমাজের গণ্ডিতে বন্দি থাকেনি৷ আপনারা অনেকেই , যাঁরা আমাকে ছোটবেলায় দেখেছেন , আমাদের বাড়ি আসতেন , তাঁদের মনে পড়তে পারে আমাদের বাড়িটা ছিল দিব্যি একটা পশুপাখির পুনর্বাসন কেন্দ্র গোছের , সেখানে কুকুর , বিড়াল এবং পাখি (আহত এবং নাদুসনুদুস উভয়ই ) আমাদের বাগানটার মধ্যে বেশ ঠাসাঠাসি করে থাকত৷ পশু , পাখি , পোকামাকড় , ছোটখাট ঝোপঝাড় , আগাছা এই সবই বাবার নিজস্ব পৃথিবীতে খুব গভীর জায়গা নিয়ে হাজির ছিল৷
৪ . বাবা ছিলেন খুব গভীর অর্থে ‘স্পিরিচুয়াল ’, যদিও প্রথা -আচার ইত্যাদিতে একেবারেই বিশ্বাস করতেন না৷ তাঁর একটা ‘ফেথ ’ ছিল৷ জানি , আপনাদের কারও কারও খটকা লাগবে , কিন্ত্ত এক বার যদি মার্কসবাদের যুক্তিটাকে নিছক এই মানবসমাজের বাইরে আরও ছড়ানো একটা পৃথিবীর প্রেক্ষিতে দেখেন , বুঝতে পারবেন , আলোটা কোথায়৷ আপনাকে ঘুরতে হবে , খুঁটিয়ে দেখতে হবে , অনুভব করতে হবে জীবনের নানা কোণ -কুলুঙ্গি৷ এই জীবনটার সঙ্গে জুড়ে থাকতে হবে , আবার একই সঙ্গে তাকে বাইরে থেকে দেখাটাও জরুরি৷ এটাও উপলব্ধি করা জরুরি যে , সরল , অনাড়ম্বর জীবনযাপনের একমাত্র রাস্তা হল অহিংসা৷ আপনাদের অনেকের পক্ষেই এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে , মার্শাল ভদি , মেজর বল্লভ বক্সি , ফ্যাতাড়ুদের স্রষ্টার অন্দরমহলটি এ রকম ছিল , কিন্ত্ত কিছু কিছু বিষয় তো সত্যি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায় , শুধুমাত্র সন্তানই তার বাবা সম্পর্কে যে সব কথা জানতে পারে , অন্য কেউ না৷ বাবা বৌদ্ধ এবং হিন্দুধর্ম নিয়ে গভীর ভাবে পড়াশোনা করতেন৷ একটা বিশেষ জায়গা ছিল , যেখানে তিনি ধ্যানে বসতেন৷ আমরা জানি , এখনও বসেন , যদিও তাঁর শরীরটা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে৷
বাবা যে পরিমাণ স্বীকৃতি , কাল্ট স্টেটাস এবং পাঠকমণ্ডলী অর্জন করেছিলেন , সেটাই হয়তো প্রমাণ করে দশকের পর দশক তাঁর লেখালিখি একই রকম প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে৷ এই সূত্রে আমি জানাতে চাই যে , নিউ ইয়র্ক-স্থিত নিউ ডিরেকশনস ‘হারবার্ট’ ছাপছে৷ একটি জার্মান সংস্করণেরও কাজ চলছে৷ ভারতের একটি নামি প্রকাশনা সংস্থা তাঁর অন্য পাঁচটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক স্তরে৷ বাবার লেখা ছিল বিশিষ্ট ভাবে আধুনিক , অন্তর্দৃষ্টিতে ক্ষুরধার , আন্তর্জাতিক এবং আরবান৷ বাবার পড়াশোনা ছিল যাকে বলে ‘এনসাইক্লোপিডিক ’৷ প্রায় যে কোনও বিষয় নিয়েই তাঁর সামনে খাপ খোলাটা কঠিন ছিল৷ দেখেশুনে মনে হচ্ছে , পুকুরের তেলাপিয়া আর গঙ্গাসাগরে পেঁৗছেই খুশি নয় , এ বার সে হুমকি দিচ্ছে , নির্ঘাত্ মহাসাগর পেরোবে৷
ব্যক্তিগত জীবনে বাবা আশ্চর্য একটি সহযাত্রী পেয়েছিলেন৷ আমার মা৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিনষ্ট হওয়ার পর বাবা যখন কর্মহীন , মায়ের অপরিসীম শক্তি এবং সাহচর্যেই সেই দুঃসময়ে ভেসে থাকতে পেরেছিলেন৷ আমার স্ত্রী এবং পুত্রের সঙ্গেও বাবার যোগাযোগ ছিল দারুণ৷ এই সূত্রে জানাই , আইটিইউ -য়ের অন্তিম সন্ত্রাসে প্রবেশের আগে বাবা শুনেছিলেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম ’৷ বাবার শোনা শেষ গান৷ নীলা , আমার স্ত্রী , গেয়েছিল৷ আমার ছেলে স্বয়ম ওঁকে ‘বাপ্পা ’ বলত৷ বাবা ‘দাদু’ ডাকের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন , বুড়োই তো হননি , তা হলে ‘দাদু’ কীসের ? যে পাত্রে বাবার ভস্মাবশেষ রাখা আছে , তাকে স্বয়ম এখনও ‘বাপ্পা ’ই বলে৷ বাবার দেহাবশেষ আমরা গঙ্গায় ভাসাইনি৷ তিনি বাড়িতে আমাদের সঙ্গেই থাকবেন৷
সে দিন নীলা গানটি গাওয়ার আগে বাবাকে আমি দুটো গান শুনিয়েছিলাম৷ ফোন থেকে৷ বাবার খুব প্রিয় দুটো গান৷ লেওনার্ড কোহেন -এর ‘ওয়েটিং ফর দ্য মিরাকল ’ আর মুকেশের গলায় ‘জিনা ইহাঁ মরনা ইহাঁ’৷ তখন বাবা প্রায় বাক্শক্তিরহিত৷ স্মিত হাসির রেখা ফুটল মুখে , চোখদুটো বন্ধ করলেন৷ মুকেশ তখন গাইছেন , ‘কাল খেল মে হম হো না হো , গর্দিশ মে তারে রহেঙ্গে সদা /ভুলেঙ্গে হম ভুলেঙ্গে উও , পর হম তুমহারে রহেঙ্গে সদা ’!ব্যক্তিগত জীবনে বাবা শুধু একটি জিনিস থেকেই বঞ্চিত ছিলেন৷ মাতৃস্নেহ৷ কিন্ত্ত , জন্মদাত্রীর সেই শূন্যস্থানটি পূর্ণ করে দিয়েছিলেন বাবার বাবা , বিজন ভট্টাচার্য৷ বন্ধু, সহকর্মী , সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের মধ্যে অনেক আশ্চর্য সাথী পেয়েছিলেন তিনি৷ সিপিআইএমএল লিবারেশনের সদস্যরা তাঁর অন্তিম দিনটি পর্যন্ত পাশে ছিলেন৷ ছিলেন ভাষাবন্ধন -এর সহকর্মীরা৷
গত মে মাসের শেষে বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি প্রসঙ্গে জনৈক পাঠক তাঁকে একটি মেসেজ করেন৷ বাবা জবাব দেন ১ অগস্ট৷ বাবার সেই জবাবি মেসেজ তিনি আমাকে ফরওয়ার্ড করেছেন৷ দেখছি , বাবা তাঁকে লিখছেন , ‘কেঁদো না৷ আমি এখন যে অবস্থায় আছি , তাকে এগজিস্টেনশিয়ালিস্টরা বলেন বর্ডারলাইন সিচুয়েশন৷ আত্মমর্যাদা এবং সাহস অক্ষুণ্ণ রেখে আমাকে তার মুখোমুখি হতে হবে --- নবারুণ ’৷
(সংক্ষেপিত )
2 মন্তব্যসমূহ
Awsadharon!
উত্তরমুছুননিবিড় জীবনবোধে তাড়িত নবারুণ ভট্টাচার্য।লেখাটি পড়ে ভেতরটি জ্বলছে।
উত্তরমুছুন