মোমিনুল আজম এর গল্প- হুরমত আলী ও তার ষ্টেনো সম্পর্কিত সমাচার

হুরমত আলী নামটি কার দেয়া তা এখন আর কারও স্মরণে নেই। চারটি সন্তানের জন্মের পর আর একটি সন্তানের জন্ম মধ্যম আয়ের একটি সংসারে কোন তাৎপযর্ বহন করে না। বিষয়টি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটেছে বলে আলাদা কোন উৎসব বা আনুষ্টানিকতার আয়োজন ছিল না, উত্তর পাড়ার ধাই আকালুর মা এসে আছরের ওয়াক্তের পর আতুর ঘর থেকে নবজাতকে বের করে যখন তার দাদীর কোলে দিল তখন পাড়ার অনেকেই বলাবলি করছিল-ওমা একি, ছেলে তো দেহি বান্দরের লাহান মুখ আর হাড়ির পাছার মতো রঙ পেয়েছে। ধারণা করা হয় ওমন একটি নবজাতকের মুখ দেখে তার গেরস্থ পিতামহ নিতান্ত দায়সারা গোছের এ নামটি রেখেছিলেন। নাম যাই হোক না কেন পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির হুরমত আলী এরশাদের আমলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ দিয়ে এক্কেবারে প্রথম শ্রেনীর চাকুরি পেয়ে গেল । শোনা যায় এ চাকুরি প্রাপ্তি উপলক্ষে তার গলায় ফুলের মালা পড়িয়ে পুরো ইউনিয়ন ঘোরানো হয়। এ আয়োজন অবশ্য হুরমত আলীর নয়। এলাকার চেয়ারম্যানের ভাই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েছিল, কিন্তু সে পাশ করতে পারে নাই। হুরমত আলীর বড় ভাইয়ের সাথে এলাকা চেয়ারম্যানের বনিবনা কম। চেয়ারম্যানের গায়ে একটু আগুনের আঁচ দেয়ার জন্য হুরমত আলীর বড় ভাই এ কাজ করেছিল।


মধ্যম মানের ছাত্র হিসেবে গ্রামের স্কুল শেষ করে হুরমত আলী ভর্তি হয়েছিল কলেজে। জায়গির থেকে সে কলেজ পাশ করেছিল। বিয়ে করেছিল কলেজ জীবনে। বংশের  মেধাবী ছেলেটি পড়তে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ; বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশা,  দিনদুপুরে গাছের নীচে মেয়েদের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকে ছেলেরা, মেয়েরা সন্ধ্যার পরও হলের বাইরে ঘোরাঘুরি করে ; ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভত্তর্ি পরীক্ষা দিতে নিয়ে গিয়ে এসব দেখেছিল হুরমত আলীর বাবাI । এসব দেখে চুপ করে ছিল সে কিন্তু ছেলে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেল তখন হুরমত আলীর বাবা আর দেরি করে নি, ছেলের বিয়ে দিয়েছিল গ্রামের এক অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ের সাথে। বলাতো যায় না, বিশ্যবিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ছেলে আবার কি করে ফেলে। বিনিময়ে হুরমত আলীর বাবা বেঁচে গিয়েছিল ছেলের প্রতিমাসের পড়াশুনার খরচ দেয়া থেকে। এ নিয়ে জান্নাতবাসী বাবার প্রতি তার সামান্য ক্ষোভ আছে। প্রথম শ্রেনীর চাকুরি পাওয়ার পর তার যে রেট বেড়ে গিয়েছিল তার সদব্যবহার সে করতে পারে নি। তাছাড়া তার সোসাইটিতে তার বউ এখন বেমানান। যে কারণে কর্মস্থলে তিনি তার বউসহ থেকেছেন এমনটি কেউ কখনও দেখে নি।

সেই হুরমত আলী এখন একটি সরকারি দপ্তরের মধ্যগোছের ক্ষমতাধর কর্মকর্তা। সারা জীবন মফস্বল শহরে কাজ করে ঢাকায় থিতু হয়ে ক্ষমতা সম্পন্ন একটা পদ বাগিয়ে  নিয়েছে। এটি কিভাবে সম্ভব হলো তা নিয়ে অনেকেরই বিস্ময়। জনশ্রুতি আছে, হুরমত আলী মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সময় বসদের জন্য কাটারিভোগের চাল , সুন্দরবনের মধু , চট্টগ্রামের শুটকি নিয়মত সরবরাহ করতো। এক স্তর উপরের কর্মকর্তাও তার এলাকায় ট্যুরে গেলে তার খেদমতে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তো। বড় কর্মকর্তারা গেলে সে নাওয়া খাওয়া ভুলে তাদের রেষ্ট হাউজের রুমের সামনে সারাদিন দাড়িয়ে থাকতো। শীর্ষ এক কর্মকর্তা তার এলাকায় ট্যুরে গেলে তার জন্য রাতের বেলা অতিরিক্ত কিছূ করতে হতো এবং তা করতে তার আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না।  এ নিয়ে বন্ধুরা তাকে গালমন্দ করতো, হাসাহাসি করতো কিন্তু সে তা গায়ে মাখতো না। সুযোগ পেলেই সে বন্ধুদের বলতো -

'চাকুরি করা মানে হলো উপরওয়ালার সার্ভেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা,  সার্ভেন্ট হিসেবে মনিবের মনোরঞ্জন না করতে পারলে তো আর ভাল থাকা যায় না। তাছাড়া বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে তো তাই শিখিয়েছে; সিভিল সার্ভিসের দুটি রুল - ইওর বস ইজ অলওয়েজ রাইট, হোয়েন দ্য বস ইজ রং,  রেফার টু রুল নম্বর -১,  তো তাদের আদেশ বা মতামতের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কোথায়?  নাচতে নেমে ঘোমটা দিয়ে লাভ কি? '

এসব কথা বলার সময় তার মাঝে কোন হিনমন্যতা কাজ করে না; সে যা বিশ্বাস করে সে মোতাবেক সে দায়িত্বপালন করে এবং তা অবলীলায় প্রকাশ করে। তার এই সরলতা সেবাগ্রহণকারি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের খুবই পছন্দের। বাৎসরিক কোন সমাবেশে অনেক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা হুরমত আলীর নাম উল্লেখ করে তা প্রকাশ্যে বলে থাকে। এসব প্রশংসা হুরমত আলীর সহকর্মীরা যে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে না তা সে ভালভাবেই জানে। তা নিয়ে হুরমত আলীর কোন মাথা ব্যথা নেই। সে জানে এবং বিশ্বাস করে মনিবের প্রশংসা হলো ভৃত্যের চলার পথে আর্শীর্বাদ।



উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের আতিথেয়তায় হুরমত আলীর কোন জুরি নেই। কর্মদক্ষতা নিয়ে তার এতো বাড়াবাড়ি নেই। আতিথেয়তার গুণে মাঝে মাঝে দক্ষ অফিসার হিসেবেও তাকে উল্লেখ করা হয়। তার এই দক্ষতার জন্য তাকে ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে। একবার এক শীর্ষ কর্মকর্তা তার এলাকায় সফরে গেলেন! সাথে ড্রাইভার, আর্দালী, পি এ, স্টেনো, ইন্সপেক্টরসহ ছয় জনের এক বিশাল বহর , সবার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো বিভাগীয় রেস্ট হাউসে। শুধু শীর্ষ কর্মকর্তা থাকবেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের রেস্ট হাউসে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাসহ নিরিবিলি পরিবেশ তাঁর পছন্দ, এ বিষয়টি মাথায় রেখে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন। ছোট  দেশী মুরগির ঝোল, বাজারে নতুন আশা সবজি, বড় পাবদা মাছের দোঁপেয়াজা, চিংড়ি মাছের ভুনা, মুগের ঘন ডাল।  অরিজিনাল পাকিস্তানি বাসমতি চালটি নিয়ে আসা হয়েছ ঢাকা থেকে। যদিও বর্তমান সময়ে পাকিস্তান তার অপছন্দের তালিকায় থাকা একটি দেশ তবুও সে দেশের বাসমতি চালের সাদা ভাত তার পছন্দের শীর্ষে। এটি পিএ'র মাধ্যমে তিনি ফোনে চুপচাপ বলে দিয়েছেন হুরমত আলীকে। শীর্ষ কর্মকর্তার জন্য একটি স্পেশাল আইটেম করা হয়েছে। এটি গরুর মাংসের কালা ভুনা, যেটি তাকে সরবরাহ করা হবে রাত একটু গভীর হলে।

শীর্ষ কর্মকর্তার সফর সঙ্গীর তদারকি করছেন হুরমত আলী নিজে, বসের কাছাকাছি থাকা এসব কর্মচারীর সাথে সারের অনেক কথা হয় , হুরমত আলীর নামে খারাপ কিছু যাতে বলতে না পারে সে জন্য নিজ হাতে খাওয়া দাওয়ার তদারকি করছেন। বলাতো যায়না আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে এদের সুপারিশে তার আরো ভালো জায়গায় পোস্টিং হয়ে যেতে পারে।

দেশী মুরগীর রান পুরোটা মুখে দিয়ে সারের অর্ডারলি ফজলু বলে ফেললো :

স্যার কী আমাদের পোলাও রোস্ট খাওয়াবেন না ?

-অবশ্যই ! বলেই তিনি তার পি এ কে পরেরদিন পোলাও রোষ্টের ব্যবস্থা করার আদেশ দিলেন।

শীর্ষ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কর্মচারী সামলিয়ে তিনি ছুটলেন স্যারের কাছে। স্যার বিশাল আয়োজনের তেমন কিছুই খেলেন না ; ডাইনিং রুমে বসে হুরমত আলীর সাথে অফিসের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে আলোচনা করছেন -

- গত অর্থবছরে আসবাবপত্র মেরামত খাতে আপনি দু লক্ষ টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছেন কিন্তু অফিসের আসবাবপত্রের করুণ অবস্থা কেন ?
-সম্পদ সংরক্ষন খাতে খরচ করলেন সবটাকা কিন্তু অফিসের চেহারাতো  ক্যান্সার রুগীর চেয়ে খারাপ;

শীর্ষ কর্মকর্তার সামনের চেয়ারে বসে হুরমত আলী ঘামছে ; ফ্যাকাসে মুখে একবার টেবিলের উপর রাখা খালি গেলাসের দিকে আর একবার স্যারের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। খালি গেলাসের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, সার্ভিস রেকর্ড তার খালি হয়ে গেল; চেয়ারে বসে থেকেও তার মেরুদন্ড বাঁকা হতে থাকে। সে নিজেকে সজাগ করে মনে মনে বলে;

- হুরমত আলী , তোমাকে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না , বুদ্ধি খাটাতে হবে , তুমি স্যারের চাহিদা জানো , অতএব সে মোতাবেক কাজ করো ;

সম্বিত ফিরে হুরমত আলি ব্যস্ত  হয়ে বলে -

- স্যার আপনার জন্য গরুর কালা ভুনা রেডি করা আছে আর পোর্ট থেকে গত সপ্তাহে একটা বিদেশী নিয়ে এসেছি।

-গুড, বলেই স্যার তার বেড রুমে ঢুকে পড়লেন।

তিন মিনিট পরে হুরমত আলীর ডাক পড়ল স্যারের বেড রুমে। রুমে ঢুকে হুরমত আলীর মনে হলো স্যার কিছু একটা বলতে সংকোচ করছেন , হুরমত আলী স্যারের সংকোচ কমানোর জন্য বললো -

- স্যার এই হুরমত আলী আপনার খেদমত করার জন্য সদা প্রস্তুত। আপনি বললে আমি বাঘের চোখও এনে দিতে পারি।
হুরমত আলীর ছোটখাটো ভাষনে শীর্ষ কর্মকর্তা নিশ্চিত হলেন , অনেকটা সংকোচ নিয়ে বললেন -

- এখানে পাহাড়ি পাওয়া যায় ?

হুরমত আলী মনে মনে ভাবলো , সে যে পোর্ট থেকে বিদেশী মদ সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে তা কি স্যার বুঝতে পারেন নি ? নাকি স্যার এখানে এসে লোকাল জিনিস টেষ্ট করতে চাচ্ছেন। হবে হয়তো, বড় কর্মকর্তাদের মেজাজ মর্জি বোঝা দায়।

- স্যার কোনটার ব্যবস্থা করবো ? দো চোয়ানি না তিন চোয়ানি ?

আমি তো তা বলি নি , বলেই বিরক্তি প্রকাশ করে শীর্ষ কর্মকর্তা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন। হুরমত আলীর বুঝতে বাকি রইলো না স্যার আসলে কি চাচ্ছেন।

' স্যার একবার চেষ্টা করে দেখি ' বলে টাউন ইন্সপেক্টরকে নিয়ে ছুটলেন।

ঘন্টা খানেক পর শীর্ষ কর্মকর্তার রুমে পাহাড়ি ঢুকিয়ে, পোর্ট থেকে আনা বিদেশী আর গরুর মাংসের কালা ভুনা সরবরাহ করে মধ্যরাতে বাসায় ফিরে সন্তুষ্ট চিত্তে ঘুমোতে গেলেন।

খুব ভোরে শীর্ষ কর্মকর্তার ফোন পেয়ে হুরমত আলির ঘুম ভেঙ্গে গেল। ড্রাইভার আসতে দেরি হবে তাই রিকশা নিয়ে বেসরকারি রেস্ট হাউসের দিকে ছুটলেন। দশ মিনিটের রাস্তা আসতে তিনি কত কিছু ভাবলেন। স্যার কি কোন কারনে তার উপর অসন্তুষ্ট, স্যারের কি পাহাড়ি পছন্দ হয়নি কিংবা পাহাড়ি কি স্যারের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, বিদেশি জিনিসে কি ভেজাল ছিল ইত্যাদি হাজারো বিষয় চিন্তা করতে করতে সে এসে রেষ্ট হাউজের পাশে রিক্সা থেকে নামলো। রেস্ট হাউসের সামনে জটলা দেখে তার খারাপ কিছু সন্দেহ হলো। জটলার কাছাকাছি গিয়ে মাথা খারাপ। গতকালের সেই পাহাড়িকে ঘির রেখেছে রেস্ট হাউসের কর্তা, গার্ডসহ কয়েকজন।

আজ ভোরে যখন পাহাড়ি রেস্ট হাউস থেকে বের হয়ে আসে তখন গার্ড  তাকে দেখে ফেলায় আটক করে তার বসকে খবর দেয়। বস সবকিছু শুনে রেস্ট হাউস বরাদ্ধগ্রহণকারীর সাথে কথা বলতে চায় এবং ঠিক সে সময়ে হুরমত আলি এসে হাজির হয়।

পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ তার জীবনের সবচেয়ে অপমানজনক অধ্যায় । স্যারের পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া, মুচলেকা দেয়া, অধ:স্তন কর্মচারীর কাছ থেকে ব্যাঙ্গোক্তি হজম করতে হয়।  পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসলে কাউকে না বলে শীর্ষ কর্মকর্তা বেসরকারি রেস্ট হাউস ত্যাগ করেন । সন্ধায় স্থানীয় অফিসাসর্ ক্লাব হুরমত আলিকে  অবাঞ্ছিত ঘোষণা  করে, পরের দিন কয়েকটি পত্রিকায় এ সম্পর্কিত খবর বক্স নিউজ আকারে ছাপে এবং স্থানীয় পত্রিকা হুরমত আলির ছবিসহ তিন কলামের লিড নিউজ করে !



হুরমত আলী সরকারি দপ্তরের মধ্যগোছের ক্ষমতাধর কর্মকর্তা।  এ পদটি তাকে দখল করতে হয়েছে একজনকে সরিয়ে। ছয়মাসের ব্যবধানে একজনকে সরিয়ে কিভাবে সে এ পদে বসলো সে সম্পর্কে হুরমত আলী কিছু বলে না, তবে এতে যে উদ্ধর্তন কতৃপক্ষের সম্মতি ছিল সে সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত। সরকারি চাকুরির ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিটি পদে আসীন হওয়া যে এক একটি প্রতিযোগিতা এবং এখানে সারভাইভাল থিওরির উপর টিকে থাকতে হয় সে সম্পর্কে মাঝে মাঝেই সে তার নাতিদীঘর্ বক্তৃতা জুনিয়র কর্মকর্তাদের সামনে দিয়ে থাকে। ক্ষমতাধর কর্মকর্তা বনে যাওয়ার পর তার চালচলন ও কথাবার্তায় পরিবর্তন আসে। তার রুমে এখন মাঝে মাঝেই সমস্তরের কর্মকর্তাদের আড্ডা বসে।  আড্ডার ছলে হুরমত আলী তাকে নিয়ে হাসি মসকরার জবাব দেয়-

'শোন মিয়ারা, ক্ষমতা হলো সুন্দরি নারী, তাকে ছলে বলে কৌশলে ব্যবহার করতে হয়। যে তা পারে সে হয় ক্ষমতাবান। যে পারে না সে দুর থেকে দেখে  লালা ফেলে, নিজেকে সৎ দাবি করে, শেষ সময়ে নপুংশকের মতো দৃশ্যপট থেকে বাইরে চলে যায়।' হুরমত আলীর এসব কথা সহ্য করতে না পেরে দু একজন বন্ধু আড্ডা ত্যাগ করে বেরিয়ে যায় কিন্তু মুখের ওপর কিছু বলার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না কারন তাদের আমল নামার ফাইল হুরত আলীর মাধ্যমেই যায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। বাকীরা মাথা ঝুকিয়ে হে হে করে হুরমত আলীর কথায় সায় দেয়। জুনিয়র কর্মকর্তাদের রুমে ডেকে ডেকে উপদেশ বাণী শোনায়, সার্ভিস কোড অব কন্ডাক্ট বলতে গিয়ে  উর্দ্ধতণ কর্মকর্তাদের কিভাবে মনোরঞ্জন করতে হবে সে সম্পর্কেই বেশি কথা বলে। এসব কথা বলার সময় হুরমত আলীর পা দুটো চেয়ারের নীচে ঝুলতে থাকে। পা ঝুলিয়ে অনবরত কথা বলতে থাকেন তিনি। তার কথা শুনে জুনিয়র কর্মকর্তারা কেউ ডাইনে কেউ বামে মাথা দুলিয়ে তার কথার সম্মতি দেয়। কেউবা অতি গদগদ হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে থুতনি দিয়ে বুকে আঘাত করতে থাকে।

হুরমত আলীর আগের ক্ষমতা ছিল সীমিত, এখন তার ক্ষমতার পরিধি অনেকদুর। হুরমত আলী ভাবে- ক্ষমতার জন্মই হয়েছে তা ব্যবহার করার জন্য। অকার্যকর ক্ষমতার কোন মূল্য নেই। তার আগে ফরমান আলী এপদে থেকে দুটো গাড়ী ব্যবহার করেছে, তার সেবা করার জন্য সবাই উদগ্রীব থাকতো। বিভাগে তার ক্ষমতার কথা সবাই জানতো। কিন্তু নীরিহ গোবেচারা আবিদ রেজা সারাদিন রুমে বসে কাজ করতো, প্রশাসন চালানোয় তার কোন হুমকি ধামকি ছিল না, ক্ষমতার ব্যবহার না থাকায় কেউ তাকে সেভাবে চিনতো না। কর্মচারিরা এখনও বলে 'খুব কড়া অফিসার  ছিলেন ফরমান আলী'।  যখন ট্যুরে যেত, যাত্রাপথের সমস্ত অফিস টতস্থ থাকতো। একবার তার অফিসের উপর দিয়ে ফরমান আলী যাবেন চিটাগাং, সে কথা তিনি জানিয়ে ছিলেন হুরমত আলীকে। হুরমত আলী স্যারের রওনা হওয়ার ঘন্টাখানেক পর এসে দাড়িয়েছিলেন রাস্তার ওপর। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও স্যারের গাড়ীর দেখা না পেয়ে হুরমত আলী অস্থির হয়ে পড়েন। সে সময়ে মোবাইলের সুযোগ না থাকায় কোন খবরও নেয়া সম্ভব ছিল না। স্যারের গাড়ীবহর যখন তার অফিসের সামনে আসে তখন মধ্যরাত, দুচারজন চাপরাশি ছাড়া হুরমত আলীর আসেপাশে তখন আর কেউ নেই। পৌষের শীতে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পায়ের মধ্যপ্রদেশ আর মাড়ি ঠকঠক করে কাপতে থাকে; কথা বলতে গিয়ে ফরমান আলী তা বুঝতে পারের। ফরমান আলী যদিও মুখে বলেন- 'কি দরকার ছিল এই শীতের রাতে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকার'  কিন্তু তিনি যে মনে মনে খুশি হয়েছেন তা তার পরবর্তী কথাবার্তায় বুঝতে পারা যায়। সে চায় ফরমান আলীর চেয়েও ডাক সাইটের কর্মকর্তা হতে; যাকে সবাই মনে রাখবে অনেকদিন!

হুরমত আলীর মাঝে এখন দুধরনের ক্ষমতার বাহ্যিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।। অনাবশ্যকভাবে তিনি কিছু কিছু অধস্তনদের উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন আবার কারো প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল । সংবেদনশীলতার মাত্রা অতিক্রম করে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিনত হয় তার স্টেনো রুহী | রুহী শুধু একজন ক্ষমতাধর কর্মকর্তাকে গ্রাস করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, সে এখন অনেকের ভাগ্য নিয়ন্তা। যে কারও রুটি রুজির পথকে সে সহজ  বা কঠিন করে তুলতে পারে। সে তার থাবা বাড়িয়েছে অফিসের সর্বত্র; উর্ধ্বতন অধস্তন সবার প্রতি। কর্মকর্তারাও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কোন ফল পায় না।

একজন ক্ষমতাবান কর্মকর্তার ষ্টেনো হওয়ার জন্য যে জ্যেষ্টোতা ও দক্ষতার প্রয়োজন রুহীর তা নেই কিন্তু তার আছে বাঁকা চাহনি ; সে চাহনিতে কুপোকাত হয়ে পড়ে হুরমত আলীর মতো অনেক মধ্যবয়সী কর্মকর্তা। সাদা চামড়ার জৌলুস এখনো হারিয়ে যায়নি তার। কলেজ পাশ করে পাচ বছর আগে চাকুরিতে ঢুকে তার সাথের অনেককে ডিঙিয়ে সে এখন দফতরের ক্ষমতাধর বাক্তির স্টেনো। স্টেনো হিসেবে রুহীকে বাছাই করেনি হুরমত আলী , তার আগেই রুহী খুঁজে নিয়েছে হুরমত আলীকে।

যোগদান করে প্রথম যেদিন হুরমত আলী অফিসে আসে সেদিন ছিলো সাক্ষাৎকারের পালা। জুনিয়র কর্মকর্তাদের দেখা করা যখন শেষ পর্যায়ে তখন রুহী ঢুকে পড়ে হুরমত আলীর রুমে। প্রাথমিক পরিচয়ের পর রুহী ব্যস্ত হয়ে পরে তার ডান পাশের সেলফ গোছানোর কাজে। চালচলনের আড়ষ্টতা আর বাঁকা চাহনি উভয়ের হৃদস্পন্দন কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। এক ফাঁকে রুহী তার  আঁচলের বাঁধন কিছুটা শিথিল করে দেয়।। তা দেখে হুরমত আলীর লালসার ফণা বিষধর সাপের মতো হিস হিস করতে থাকে।  হুরমত আলীর চোখ সেদিকে গেল কিনা তা আড়চোখে লক্ষ করে । চোখাচোখী হওয়ার পর রুহী মিষ্টি হেসে আব্রু ঠিক করে এবং যাওয়ার সময় রুহী তার স্টেনো হবার ইচ্ছে পোষণ করে। এবং পরেরদিন সকালে রুহী দফতরের ক্ষমতাধর বাক্তির স্টেনো হিসেবে নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে যায়।

কাজের চাপে হুরমত আলী অনেকদিন বাড়িতে যায়নি। কাজ বুঝতে ও গুছিয়ে নিতে বেশ সময় লাগলো। রুহী সার্বক্ষণিক সাথে থেকে তাকে সাহায্য করেছে।  হুরমত আলীর বাসা এবং অফিসের সবকিছুর দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে সে! সবকিছু যখন ঠিকঠাক তখন এক বিকেলে হুরমত আলী এককাপ চা নিয়ে স্টেনো রুহীর সাথে দফতরের বিষয়ের বাইরে গিয়ে হালকা খোশগল্প করছিল তখন সে টের পেল আর রিপুর তাড়না। সে তাড়নায় হালকা মশকরা , চায়ের কাপ নিতে গিয়ে আঙ্গুলে ঠোকাঠুকি , রুমে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা লেগে হেসে ওঠা এর সবকিছুই উপভোগ করে তারা।

তিনমাসেই হুরমত আলী আর রুহীর সম্পর্ক মুখরোচক আলোচনার বিষয় হয়। এসব আলোচনায় যারা সামনের কাতারে তাদেরকে একহাত দেখে নেয়ার হুমকি দেয় রুহী। পরবর্তী এক সপ্তাহে দেখা যায় কারো শাখা পরিবর্তন করে কম গুরুত্বপূর্ণ শাখায় বদলী করা হয়েছে , ১৫ মিনিট দেরিতে উপস্থিতির জন্য কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি করা হয়েছে জয়নালের। সে রুহীর বাচ্মেট এবং তার বড় সমালোচক , সামান্য কারনে তাকে বদলি করা হয়েছে খুলনা। জয়নাল ডাক্তারী সনদসহ দীর্ঘ ছুটির আবেদন করে তার বাড়ি চিটাগাং এ গিয়ে বসে আছে।

ক্ষমতা আর ষড়যন্ত্র পাশাপাশি চলে। একছত্র ক্ষমতার ব্যবহার সেই ষড়যন্ত্রকে আরও উস্কে দেয়। রুহীর কথামতো হুরমত আলীর ক্ষমতা প্রয়োগ উভয়ের অনেক শত্রু তৈরী করে, তারা মুখে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে ফন্দি আটতে থাকে। আলোচনা সমালোচনা এমন পযায়ে পৌছায় যে হুরমত আলীর বাচ্মেটরা তাকে রুহীর বাপারে সতর্ক হতে বলে। কিন্তু ক্ষমতা আর অনৈতিক সম্পর্কের মোহ তাকে অন্ধ করে রাখে।

হুরমত আলীর দায়িতগ্রহণের সপ্তম মাসের এক সকাল , প্রতিদিনের মতো নতুন রেজার এ সেভ করে , ক্রিম কালারের শার্টের উপর কালো ব্লেজার চাপিয়ে সে যখন দফতরের গেটে গাড়ী থেকে নেমেছে তখন গেটের কাছে জটলা পাকিয়ে থাকা কিছু কর্মচারী তাকে সালাম না দিয়ে মুচ্কি হেসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এমনটি সাধারণত হওয়ার কথা নয়; এসকল কর্মচারির ভাগ্য নিয়ন্তা সে। এক কলমের খোঁচায় তাদের চাকুরির বারোটা বেজে যেতে পারে, তাদের এ আচরণ তাকে বিস্মিত করে। প্রতিদিন এ সময়ে লিফ্ট্মান লিফট থামিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে , আজ একই সময়ে সে এসেছে , কিন্তু লিফটম্যান নাই অগত্তা একা একা উঠে এসেছে পাঁচ তলায়। রুমে ঢুকতে গিয়ে স্টেনোর রুমে উকি দেয়া তার নিত্যদিনের কাজ , আজও তার ব্যাত্যয় হয়নি, প্রতিদিন খিল খিল করে হেসে সালাম দিতো রূহী , আজ হুরমত আলীকে দেখেও গোমড়া মুখে চেয়ারে বসে থাকলো , সালাম পর্যন্ত দিলো না।

সামগ্রিক ঘটনায় হুরমত আলী ক্ষিপ্ত , রুমে ঢুকে বেল বাজিয়ে পিয়নকে চা দিতে বলে প্রতিদিনের সংবাদপত্রে চোখ বুলাতে লাগলো । প্রথম পাতার এক কোনায় এসে তার চোখ আটকে গেল। " অফিস কক্ষে কর্মকর্তার গোপন ভিডিও নিয়ে তোলপাড় " শীর্ষক খবরের ভিতর যে তার নাম। ল্যাপটপ ওপেন করে খবরের ভিতর দেয়া লিংক টাইপ করে সে যা দেখল তাতে তার চোখ ছানাবড়া।  তৎক্ষনাৎ বাসায় এসে ঘর অন্ধকার করে একরাশ অস্বস্থি নিয়ে শুয়ে থাকলো । ঘরের অন্ধকার মাঝে মাঝেই তাকে চেপে ধরতে লাগলো । রাতের অন্ধকারে বোবায় ধরা রোগীর মতো সে চিৎকার করে, হাত পা ছুড়ে নিস্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সবকিছু তার অবস হয়ে আসে, গোঙ্গানী ছাড়া মুখ থেকে আর কোন শব্দ বের হয় না।




লেখক পরিচিতি
মোমিনুল আজম

জন্মেছেন - ১৯৬৫ সালে, গাইবান্ধায়
পড়াশুনা করেছেন- শের ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে
কাজ করেন- বাংলাদেশ ডাক বিভাগে
বর্তমানে- কানাডায় থাকেন
ফিলাটেলি- ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ নামে একটি প্রকাশনা আছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ