সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর গল্প : গাছটা বলেছিল

বুড়ি গিয়েছিলো গাছটার তলায় পাতা কুঁড়াতে। গাছটা তাকে বলল, মর্ মর্ মর্। ভয় পেয়ে বুড়ি বাড়ি পালিয়ে এল আর মরে গেল।

আরও একটা বলার কথা, পাতাকুড়ুনো বুড়িটা খ্যাংরা ঝাটাটা কুচুটে গাছটার তলায় পড়েছিল। এমন ভঙ্গিতে পড়েছি, যাতে সেই বুড়ির সহসা ভীষণ ভয় পেয়ে আর তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাওয়া সাব্যস্ত হয়। প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রের তরুণ ডাক্তার বলেছিলেন, হার্ট এ্যাটাক। লোকেরা মুখ তাকাতাকি করেছিল। এক থুত্থুরে গাঁওবুড়ো বলেছিল, কোনও কোনও গাছও কথা বলে। কোনও কোনও গাছ রানী, কুঁচুটে আর নিষ্ঠুর হয়।

কিন্তু গাছেরা কি কথা বলে? বলতে পারে?


বুড়ো বলেছিলো, পারে। তারা বাতাসের ভাষায় কথা বলে। ওই গাছটা বলেছিল। আর তরুণ ডাক্তার শহরের মানুষ। তিনি নিজেকে ভাবতেন নির্বাসিত। দু'দিন তিনদিন অন্তর তার শহরের প্রেমিকাকে বিষাদপূর্ণ প্রেমের চিঠি লিখতেন। তিনি নিজেকে মেঘদূত কাব্যের বিরহী যক্ষ ভাবতেন। তাই ক্রমে, অবশেষে তিনি প্রকৃতিমুখী হয়েছিলেন। হার্ট এ্যাটাক কথাটি বলার পরও সে কারণে তার একটু কৌতুহল জাগে। লোকজনের সঙ্গে গাছটার তলায় যান। পড়ে থাকা ঝুড়ি আর খ্যাংরা ঝাঁটার ভঙ্গিতে একজন মানুষের ত্রাসের টাটকা ছাপ আবিষ্কার করেন। তারপর গাছটার দিকে মুখ তুলে তাকান। উঁচু আর ঝাঁকড়া গাছটাকে ভয়াল জবৈ মনে হয়। পারিপার্শ্বিক অন্যান্য গাছ থেকে ভিন্ন চরিত্রের এক সতেজ গাছ। এও মনে হয়, এমন কোনও গাছ তার অভিজ্ঞতায় নেই। অন্যমনস্ক, ঈষৎ ভীত সেই তরুণ ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে ফিরে যান। কিন্তু তিনি গ্রামীণ মানুষ ছিলেন না বলেই বৃক্ষলতার নিজস্বতা থাকা সম্ভব, এটা তার ধারণায় ছিল না। তবে ভারতীয় অবচেতনাবশে ফেরার পরও কতক্ষণ তার চিন্তা ছিল, গাছটা বাতাসের ভাষায় তাকেও কিছু বলছে কি না! আসলে বিশাল যৌবন, অতৃপ্ত প্রেম। তার হারানোর মতো অনেক কিছুই ছিল, যা এক পাতাকুঁড়ানি গাঁওবুড়ির ছিল না।

আর তখন ছিল বসন্তকাল। হেমন্তের শেষ থেকে যে-সব গাছের পাতা ঝড়ে গিয়েছিলো, তারা সবুজ উজ্জ্বল পাতায় ঝাঁকালো হয়েছিল। আর আধুনিক কৃষির কৃৎকৌশলে চারদিকে ভূ-পৃষ্ঠে গাঢ় শ্যামলতা। এ ছিল এক তীব্র লাবণ্যের কাল। এমন একটা কালে মৃত্যু অপ্রত্যাশিত উপদ্রব। পাতাকুঁড়ুনি বুড়িরও আশা ছিল এবার সে ফসলের শিস কুঁড়ুতে মাঠে যাবে কিন্তু মারাত্মক গাছটা নির্দয় বাতাসের ভাষায় তাকে বলেছিল, মর্ মর্ মর্। দারুণ ভয় পেয়ে সে মরে গিয়েছিল।

গাছেরা কথা বলে। গাছেরা বাতাস থেকে ভাষা শেখে। তাই বলে মানুষের ভাষা শেখে, কোনও কোনও গা্ছও মানুষের ভাষা শেখে।

কিন্তু সত্যিই কি গাছটা বুড়িকে বলেছিল, মর্ মর্ মর্?

গাঁয়ের সেরা অবিশ্বাসী, সতত উন্নাসিক আর সিনিক এক পৌঢ় প্রশ্নটি তোলে। শোনা যায়, তার সিনিসিজমের উৎস ছিল গাঁজা। যার ফলে অলৌকিকের লৌকিকতা অসহ্য হয়।

বুড়ির ছেলের বউ কেঁদে-কেঁদে চিড় খাওয়া গলায় কীভাবে তার শাশুড়ি হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ঢুকেছিল, আর ধপ করে দাওয়ায় বসে জল চেয়েছিল, আর বলেছিল, ও বউ, আমি তবে মরি। কোন না মুখপোড়া গাছটা আমাকে বলল মর্ মর্ মর্ আর জলের গেলাসটা হাত থেকে পড়ে গেল, তার শাশুড়িও হেচকি তুলে সিটিয়ে পড়ল, ইনিয়ে-বিনিয়ে পুরো ঘটনাটি শুনিয়ে দেয়। সে অসংখ্যবার শপথবাক্যও আওড়ায়। হু হু করে চাপা শান্ত কান্না কাঁদতে থাকে, যদিও আর কান্নাকাটির নিষ্ফল ছিল।

সিনিক পৌঢ় নাক কুচকে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে গাছটার তলায় যায়। চির-অবিশ্বাসী চোখে গাছটাকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সে তার বহু লালিত বদ্ধমূল অবিশ্বাসকে চাঙ্গ করতে পড়ে থাকা ঝুড়িটাকে যথেচ্ছ লাথি মারে। ভাংচুর করে ছুঁড়ে ফেলে। খ্যাংরা ঝাঁটাটাকেও গাছটার গুড়িতে প্রচন্ড জোরে মারতে থাকে। বলে, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না!

আসলে তার চিরকালীন ধারণা এই ঘটনায় চোট খেয়েছিল। ধারণার অবস্থা হয়েছিল লেজে পা পড়া গোখরোর মতো। ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত এক মানুষগোখরোয় রূপান্তরিত সে। গাছটাকে শাসাচ্ছিল। মল্লযুদ্ধের ভঙ্গি করছিল। ভাঙ্গা গলায় গর্জন করছিল, বল একবার মরার কথা। বলেই দ্যাখ। যদি তোর সাহস থাকে, আমাকে একবার বল, মর্ মর্ মর্।

আর সহসা মাঠের দিক থেকে একটা বাতাস এল। পারিপার্শ্বিকে, বৃক্ষলতায় আলোড়ন শুরু হলো। আর তারপরেই গাছটা শনশনিয়ে সত্যিই বলল, মর্ মর্ মর্।

চির অবিশ্বাসী লোকটি থমকে গেল। নিজের কানকেও তার অবিশ্বাস। অলৌকিকতার এ লৌকিকতা দু:সহ। সে ক্লান্ত ততক্ষণে, অতিশয় আচ্ছন্ন সে, পূন:গর্জনের চেষ্টা করল, আবার বল্।

আর গাছটা আবার বলল, মর্ মর্ মর্।

সে গাছটার গুড়িতে লাথি মারতে গিয়েই পড়ে গেল। মরে গেল। লোকেরা পরে আবিস্কার করে তার মুখের কষায় চাপচাপ রক্তাক্ত ফেনা। ঠিকরানো লাল চোখ। চিৎ হয়ে পড়ে আছে স্পন্দনহীন এক নশ্বর মানবশরীর।

তবে তার সেই শরীরে চির অবিশ্বাসের সমস্ত ছাপ খুব গাঢ় হয়েই ছিল।...


দুই

এ যাবত বেশ কয়েকটি গাছের গল্প বলেছি। সেই গাছগুলি জৈব চরিত্রের। তাদের কেউ কেউ ভয়াল কি নিষ্ঠুর হলেও কেউ-কেউ ছিল দয়ালু, সহৃদয়। কেউ জীবন আর পৃথিবীর একটা চমৎকার মানেও বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদের নিজস্ব ভাষা ছিল। এই গাছটার মতো তারা কেউ-ই মানুষের ভাষায় কথা বলেনি।





গাছ অনন্ত মৌনের প্রতীক। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত (যার কথা আমি শুধু ছোটদের গল্পে বলেছি) অনেক পরে একদিন কথায়-কথায় বলেছিলেন, বিশ্বব্রহ্মান্ডে সব কিছু জোড়ায় জোড়ায় আছে। মানুষের ডান হাত আর বা হাতের মতো। এই যে গ্যালাক্সির মধ্যে আমরা আছি, তার উলটো একটা গ্যালাক্সিও আছে। আয়নার ভেতর যেমন নিজেকে উল্টো মানুষ দেখতে পান, সেই রকম। কাজেই শব্দ যখন আছে, শব্দহীনতাও আছে।

শব্দহীনতাই মৌন। কিন্তু আয়নার কথা উঠলে বলব, একটি বল কিংবা গেলাসের উলটো আছে কি?

চন্দ্রকান্ত দ্রুত বলেন, গড়ন সমানুপাতিক হওয়া চাই। শব্দ অসমানুপাতিক।

হুউ। সেও অসমানুপাতিক গড়নের। ওই বৃদ্ধকে লক্ষ করুন। মৌনে মধুর হাস্যময়তা। ব্যাপারটা হল, পাদার্থ বিজ্ঞানের ‘ল অব প্যারিটি’ আপনার বিশদভাবে পড়া উচিত।...

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত এ রকম বলেন। তবে এটা ঠিকই, বৃক্ষেরা মৌনের প্রতীক। সেই মৌন যে সত্যি অসমানুপাতিক গড়নের, তাও ভুল কথা নয়। কিন্তু এই গাছটা, যার মৌন ছিল না শুধু তা-ই নয়, মানুষের ভাষা নকলকরার ক্ষমতায় ছিল। কী বিপজ্জনক আর কী চিন্তাযোগ্য উদ্ভিদ, বলার নয়।

এই মারক জৈব উদ্ভিদটি ছিলো আমাদের গ্রামের নো-ম্যানস-ল্যান্ড, সদৃশ জমিতে। কারণ একদিকে মুসলমানপাড়া, অন্যদিকে হিন্দুপাড়া, মাঝখানে পোঁড়ো, কাছিমের পিঠের গড়ন, আগাছা ঢাকা একটুকরো মাটি। এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাতায়াতের রাস্তাটি ছিল তার নিচের দিকটায়। গাছটা ছিল একেবারে কেন্দ্রে। কখনও কেউ তাকে বিস্ময়কর ভাবেনি! সে কারও চিন্তার উদ্রেক করেনি কোনও দিনও। তাঁর চেহাড়ার জৈবতাও ধরা পড়েনি কোনও চোখে। গ্রামের আরও পাঁচটা সচ্চরিত্র গাছের মতো সেও ছিল একটি গাছ। কখনও রাখালেরা কি ছাগল-চরানী মেয়েরা তার ঘনিষ্ট হত। তাকে বুড়ি করে খেলত সেই সব নিরক্ষর ক্ষুৎকাতর বালক-বালিকারা। আর গাছটা ছিল ফলহীন। কোনও ফুলও ফুটতে দেখা যায়নি তার ডালপালার ডগায়। তবু এই বালক-বালিকারা তাঁকে ভালোবাসতো।

গ্রামের মানুষজন বৃক্ষলতা ভালোবাসে। কিন্তু সকলকার নাম জানে না। বিশেষ করে এমন একটা ফুল-ফলহীন বন্ধ্যা গাছের নাম কি জাতবিচার নিয়ে মাথা ঘামানোরও মানে হয় না।

আকন্দ-ফনীমনসা-কেয়া-কালকাসুন্দের থরে-বিথরে প্রসারিত সজ্জার কেন্দ্রে এক সংহত উন্নত গাছ। নিচের রাস্তা দিয়ে জোৎস্নার রাতে যেতে যেতে দৈবাৎ তাকিয়ে দেখেছি। সারা শরীরে চন্দ্রচূর্ণমাখা উজ্জ্বল সে। রহস্যময় সৌন্দর্য! নর নও, নারীও নও। তুমি কি বৃহন্নলা অর্জুন?

তো পাঁড়াগেঁয়ে পৃথিবীতে এক সময় অসংখ্য ভূত ছিলো। ভূতিনী ছিল। যোজনার করুন আর জনপ্রতিনিধির তদবিরে বিদ্যুৎ আসে। ফলে ভুতেরা ভুতিনীরা এত ধারালো আলোর ঘাঁ সইতে না পেরে কে কোথায় পালিয়ে যায়। ভোট কুঁড়ুনো রাজনীতি রীতিমতো বস্তুতান্ত্রিক দর্শনের বাচ্চা প্রসব করে। এতে বুড়ো-বুড়িরা খুব চটে গিয়েছিল বটে; কিন্তু ওই বাচ্চাটি তত কিছু উপদ্রব বাঁধায়নি। পুঁজাআচ্চা, মিলাদ-ইদ-মুহররমের ধুমধাড়াক্কা বরং বেড়ে গিয়েছিল। মাইক্রোফোনের প্রচন্ড নাদগুলি বস্তুতন্ত্রেই জয়জয়কার। ভূত-ভুতিনীদের পালানোর এও কারণ। নো-ম্যানস-ল্যান্ডটির গাছটিতে কোনও অশরীরী আত্মার বসবাস ছিল। কালক্রমে সেও পালিয়ে যায়, যদিও ওই গাছে তার এমন কোনও বসবাসের কথা শুনিনি।

তার মানে, এই গাছটা ছিল গ্রামের একেবারে ফালতু জিনিস। গ্রাহ্যের মধ্যে নয়। কেউ তাকে কোনও গুরুত্ব দেয়নি। অনাথ, আঁতুর, একলাসেড়ে নি-জেতে, মুখ্যসূখ্য, হ্যাংলা এক গাছ। হায়! হায়! কেউ তাঁর ডাল থেকে ঝুলে আত্মহত্যাও করেনি?

গাছটি ছিল যথার্থ প্রোলেটারিয়েট, যার শৃংখল বলতে ভূঁগর্ভে গ্রোথিত শেঁকড়-বাঁকড়, যা ছাড়া, আর তাঁর হারানোর কিছু ছিল না। এ ব্যাখ্যা কারও মন:পূত না হোক, আমি এভাবেই ব্যাপারটা ভেবেছিলেম।

তাহলে সহসা এক বসন্তকালের দুপুরে সে কি অনবিার্য বিপ্লব ঘটাল? সে এক পাতাকুঁড়ুনি বুড়িকে বলল, মর্ মর্ মর্। আর বুড়িটাও দিব্যি মরে গেল। এক চির-অবিশ্বাসী পৌঢ় তার সঙ্গে লড়তে গেল এবং সেও বেঘোরে মারা পড়ল।

সেই দিন সন্ধ্যার মুখে মরিয়া হয়ে, অথচ ভয়ে-ভয়ে, একটা জটিল মানসিকতায় আক্রান্ত আমি গাছটির কাছে সাবধানে গেলাম। পুরোনো স্থাপত্যের মতো গুল্মগুলির নির্মাণশৈলী। দিন-শেষে যেন কোন বৌদ্ধ চত্যৈ-পুঞ্জে অনুপ্রবেশ করছি। প্রকৃতই নির্বানকামী। বলা দরকার, সেদিন আমি মনে মনে মরতেই চেয়েছিলাম। বুড়ির মতো মরতে। কষ্টহীন শান্ত মৃত্যু। আমি চেয়েছিলাম, গাছটি আমাকে মর্ মর্ মর্ বলুক আর আমি তক্ষুনি সিটিয়ে মরে যাই। সেটাই নির্বাণ! কিন্তু কেন?

ব্যর্থ প্রেম?

ধুস!

তা হলে কী?

জানিনা। সত্যিই জানি না। মৃত্যু–ইচ্ছা বলে নাকি একটা ব্যাপার আছে। এক অতর্কিত মুহুর্তে নাকি জীবনের মানে হারিয়ে যায়। হয়তো তাই-ই। আসলে সারাটা দিন আমার মন ভালো ছিল না। কেন যেন মনে হয়েছিল, পিছু হটতে হটতে কিংবা সামনে যেতে যেতে একটা দেয়াল। আর এ তো স্বাভাবিকই, যখন প্রিয়তমা নারী, সন্তানেরা, বইপত্তর, সঙ্গীত, খাদ্য, পোশাক, ঘরবাড়ি এ যাবৎ কোনও দুজ্ঞেয় কারণে নিজস্ব অর্থগুলি খুইয়ে বসে, আর রাবিন্দ্রিক চূড়ান্ত প্রশ্নটি সামনে ফনা তোলে: ‘কিন্তু কেন’ তখন জীবন্মৃত্যু একাকার হ-য-ব-র-ল হয়ে উঠে না কি? কোনও এক মুহুর্তে মনে হয় না কি সমস্ত সভ্যতার বারবার প্রকৃতির কাছে নতজানু হয়ে ভেঙ্গে পড়ে?

গাছটির তলায় আচ্ছন্নতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দিনশেষের বাতাস জনমজুরের ক্লান্তিতে আড়ষ্ট, অতিশয় চুপ। প্রগাঢ় মৌন চারপাশে, এ এক দম আটকানো ক্রান্তি-মুহুর্ত যেন পারমানবিক অস্ত্রের উৎক্ষেপনকেন্দ্রে কাউন্ট ডাউন পর্যায় শুরু, এক...দুই...তিন.....



কিন্তু কিছু ঘটছে না। গাছটার অসমানুপাতিক মৌন অসমানুপাতিক শব্দে রূপান্তরিত হচ্ছে না। বলছে না, মর্ মর্ মর্। আমি আশা করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে চুপ। বৃহন্নলা! কথা বলো!

ডাইনে দুরে সিংহবাহিনীর মন্দিরে কাঁসারঘন্টা বাজলো। বায়ে দুরে মসজিদ-মিনার থেকে আজান ধ্বনিত হল। কোথায় বাজতে থাকলো বাছুরের গলার ঘন্টা আর তার মায়ের হাম্বা ডাক। কোন বালিকা কোন পুকুরের দিকে তাকিয়ে তই তই করে হাঁসগুলিকে ডাকতে লাগল। নিচের রাস্তা দিয়ে নিচু স্বরে কথা বলতে বলতে খাটিয়ে কিছু লোক চলে গেল। আর এই সব অসমানুপাতিক শব্দ আমাকে অন্যমনস্ক করায় গাছটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, তার মৃত্যুদণ্ড মিস করলাম না তো? সে কি ওই আলোড়নের মধ্যে মর্ মর্ মর্ ধ্বনি উচ্চারণ করেছে, আমি শুনিনি?

ম-র্মর ধ্বনি!!

আরে তাই তো! অতি-অতি-অতি প্রাচীণ এই ধ্বনির প্রতিফলন মানবিক ভাষায়। গ্রিক-ল্যাতিন ফার্সি-সংস্কৃত–আরবিতে। মৃত্যুর পাশাপাশি সমান্তরাল হেটে চলা ধ্বনিপ্চ্চঞজ। গাছেরা বলে। চলমান জল বলে। মরুভূমির বালি বলে। পাথরের বুক ঘেঁসে যাওয়া বাতাস বলে। আকাশের মেঘ বলে। মর্মর আর মৃত্যু, হাত হাত।...

ওহে গাছ! নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের বৃহন্নলা গাছ। তুমি সেই অমোঘ ধ্বনি উচ্চারণ করো! বলো, মর্ মর্ মর্।

হতচ্ছাড়া চুপ। মৌন মানেও নিষ্ঠুরতা। সম্মতি নয়। কদাচ রায় পাষানও তো মৌন। কে ওখানে?

চমকে উঠে পিছু ফিরে নীচের রাস্তা থেকে জোরালো টর্চের আলোয় ধরা পড়ি। নিস্ফল মায়া ছত্রভঙ্গ হয়। পুণ: কেউ বলে, ওখানে কী করছেন? তখন বড় লজ্জায় পড়ে যাই।

স্কুলশিক্ষক মনজুর হোসেন আলো ফেতে ফেলতে উঠে-এস খি খি করে খুব হাসেন। তিনি বলেন, যত্তোসব! এই নাইনটিন এইট্টি এইটেও! বলে পূন: শিশুহাস্যের পর সহসা চাঁপা স্বরে প্রশ্ন করেন, কিছু টের পেলেন নাকি?

না:।

মনজুর হোসেন এবার খাপ্পা হয়ে বলেন, গুজবে কান দেবেন না। এরমধ্যে একটা রাজনৈতিক চক্রান্ত আছে।

কী ব্যাপার বলুন তো?

স্রেফ রটনা। মনজুর হোসেন চাঁপাস্বরে শ্বাসপ্রশ্বাসে জড়িয়ে বলেন। এটা একটা সরকারি মাটি। সাধারণের ব্যবহার্য। আমি পুরোনো রেকর্ড দেখেই বলছি আপনাকে। এই যে আমার স্কুল থেকে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। কেন জানেন? লাটুবাবুদের ওখানে তর্কাতর্কি। ক’বছর ধরে এখানে একটা ক্লাবঘর করার কথা। ক্রমাগত বাঁধা আসছে বেপার্টি থেকে। এ নাকি লাটুবাবুদের মাটি। মন্দির ছিল। আচ্ছা, বলুন তো, একটা টুকরো ইট দেখেছেন এখানে? আর এই গাছটা!



তিনি টর্চের আলোয় গাছটাকে জ্বালিয়ে দিতে দিতে বলেন, গাছটার বদনাম দিয়ে হাপিজ করার তাল বুঝলেন তো? ঝুরনবুড়িকে টাকা খাইয়েছিল। সে পাতাকুঁড়ুনি। হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু নেহাত কো–ইনসিডেন্স। আর ওই নোলেদা আপনি তো জানেন, সে ছিল মহা গাঁজাড়ু, মাথা খারাপ আধপাগলা একটা লোক। এমনিতেই মরত। ম-রে-ছে।

মনজুর হোসেন মায়া জাল ফালাফালা করছিলেন। কী আর বলব? চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। স্কুলশিক্ষক বলেন, দু:সময়! বেতো নরেন আবার বলে কী, গাছটা দেবতা।

পুঁজো দাও ঢাকঢোল বাজিয়ে। এটাই নাকি রফা! তাহলে বুঝুন কী অবস্থা। সাধারণের ব্যবহার্য অগত্যা বলি না।

স্কুল শিক্ষক আমার হাত ধরে অন্তরঙ্গভাবে, চলুন। ফেরা যাক....।



তিন

সেই রাতে আবার একটা ঘটনা।

কৃষ্ণপক্ষ। একটু দেরি করে চাঁদ উঠেছিল। পাঁচু চোর তোরাপ হাজির খামার বাড়িতে একটা মরাই ফুঁটো করে ধানের বস্তা ধরেছিল। ঝরঝরিয়ে ধান ঢুকছিল বস্তায়। চাঁদ আর একটু উঠলেই তার অল্প জোৎস্নায় ধরা পড়ার ভয়। তা ছাড়া পুরো বস্তা বয়ে আনার জোরও পাঁচু চোরের পাঁকাটি শরীরে নেই। সে আধ বস্তা পিঠে ঝুলিয়েছে, তখন ফুটো থেকে ঝর ঝর ধান ঝরার শব্দ। তোরাপ হাজির ঘুম চটে যায়। ধান তার প্রাণভোমরা। মশারি ফাঁক করে টর্চ জ্বালেন। তারপর তুলকালাম। ধর ধর, মার মার। পাড়াসুদ্ধ এই চিৎকার।

পাঁচু চোর বেগতিক বুঝে বস্তা ফেলে পালায়।

সে আত্মগোপনের জন্য নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের জঙ্গলে ঢুকেছিল। নীচের রাস্তায় লোকজনের ছুটোছুটি। সে গাছটার গুড়িতে সেটে অপেক্ষা করছিল সুসময়ের। তার মনে দু:খ ছিল ব্যর্থতার! নি:শব্দ হাহাকার ছিল।

সহসা আবার সেই বাতাস এল মাঠের দিক থেকে। আর গাছটা বলল, মর্ মর্ মর্!

পাঁচু চোর আঁতকে উঠে পালিয়ে এল। আর বাড়ি ঢুকেই সেই বুড়ির মতো ধপাস করে বসে বলল, ও বউ পানি দে শিগগির। আমি মরি।

মরণ। প্রতীক্ষায় থাকা তার বউ ফিক করে হেসে বলল কথাটি। পাঁচু চোর হলেও রগুড়ে মানুষ ছিলো!

পানি দে বউ! আমি মরছি!

পাঁচুর বউ অনিচ্ছা আর অবিশ্বাসে অন্ধকারে গেলাস খুঁজে কলসি থেকে জল ঢেলে এসে দ্যাখে, তার চিৎপাত মরদের বুকে দুই হাত। শরীর কোঁকড়ানো। দাওয়ায় আলতো জোৎস্না পড়েছিল সবে। পাঁচুর মুখে কালো ছোপ।

আর সংশয়কুল স্ত্রীলোকটি দ্রুত লম্প জ্বেলেছিল। পাঁচুর মুখ দিয়ে রক্ত। পাঁচু চোর মরে গেছে।...



পিচ রাস্তার ধারে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাইস্কুল, ফাঁড়ি, ডাকঘর, এক চিলতে বাজার। চায়ের দোকানে বসে ছিলেন স্কুলশিক্ষক। আমাকে দেখে বললেন, বুঝলেন কিছু?

কীসের বলুন তো?

বিরক্ত মনজুর হোসেন বললেন, পাঁচুর কথা বলছি।

হু, বেচারা মরে গেল। টি বি রোগি ছিল সে। জানেন কি?

না:।

আপনি ডক্টর বোসকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। বলে স্কুলশিক্ষক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে তর্জনী তুললেন।

কিন্তু ওর বউ বলছে...

বোগাস! মনজুর হোসেন চাঁপা গর্জন করলেন। হয় লাটুবাবুরা, নয়তো বেতো নরেন মেয়েটাকে টাকা খাইয়েছে।গাছটার নামে বদনাম রটাচ্ছে।রীতিমত রাজনৈতিক চক্রান্ত। চা-ওলা ঘোতন বলল, আপনাগো হাজি সায়েবও আছেন লগে।

ঠিক। স্কুলশিক্ষক সায় দিলেন ঘরের শত্রু বিভীষণ! আপনি জানেন, এক নম্বর স্মাগলার?

কে?

আবার কে? ওই হাজি। ওর হজ কবুল হবে ভাবছেন? জাহান্নামি!

বাঁশবাতার বেঞ্চের একধারে বসে ছিলেন রাজনৈতিক হোলটাইমার স্বপন রুদ্র। তিনি স্থানীয় কৃষক সেলে সদ্য এসেছেন। বাকা হেসে বললেন, কমরেড! কুসংস্কার জিনিসটা এক শ্রেনীর ভাইরাস। মহামারী বাধায়।

কথাটা আমাকে নয়, মনজুর হোসেনকে। আর এরপর দুজনের মধ্যে তাত্ত্বিক আলোচনার সুত্রপাত হল। কিন্তু আমি চমকে উঠেছিলাম। কুসংস্কার মহামারী বাঁধায়!! তিনটি মৃত্যু ঘটলো। ক্রমে আরও কি....

বিভীষিকা আমাকে শিহরিত করেছিল। পরবর্তী বাক্যগুলি মন থেকে মুছে দিলাম।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন রোগীর ভীড়। তরুণ ডাক্তার অসীম বোস আমাকে দেখে বললেন, কী? আবার পেট? তিনি হাসতে লাগলেন। পুন: বললেন, জাস্ট এ মিনিট।

না:। পেট নয়, ডাক্তার বোস। ওই গাছটা!

একটি স্ত্রীরুগি তার সামনে হাটু ভাঁজ করে বসে মা কালীর মতো জিভ বের করেছে। খুদে টর্চে ভেতরটা দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ডাক্তার বললেন, কোন গাছটা!

নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের!

ডাক্তার অবাক হলেণন। বুঝলাম না।

যে গাছটা তিন-তিনটি মানুষকে মরতে বলেছে...

তরুণ, নির্বাসিত, সতত অভিমানী চিকিৎসক ফিক করে হাসলেন। তার সঙ্গে কালক্রমে অন্তরঙ্গতার দরুন গোপন প্রেমের কথা আমাকে ফাঁস করেছিলেন। আসলে বসন্তকালের বিকেলে প্রেম জিনিসটা মানুষের কাছে ফুল ফোটার মতোই প্রদর্শনযোগ্য অলংকারের বিষয়। অন্যকে জানিয়ে দেখিয়েই সুখ।ব্যাপারটা এরকম ‌’দ্যাখো, দ্যাখো, আমি প্রেম পেয়েছি! আমার মানবজীবন ধন্য।তুমি কী পেয়েছ? কাচকলাটি!’

তো ওকে হাসতে দেখে বললাম, আপনার কী ধারণা?

কী বিষয়ে?

গাছটা।

তরুণ প্রেমিক ডাক্তার বললেন, তিনটি কেসই দেখেছি। প্রথম দুটি হার্ট অ্যাটাক। তৃতীয়টি লাংস ব্লাস্ট। টি-বি-র লাস্ট স্টেজ আর কী।

কিন্তু তিনটি কেসের সঙ্গেই ওই গাছটা জড়িত ড. বোস।

ডাক্তার কৌতুকহাস্যে বললেন, কতরকম শুনছি মশাই। গ্রামের জটিলতা থাকে জানতাম না। শুনেছিলাম ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়...মাই গুডনেস! এসে হাঁড়ে-হাঁড়ে টের পাচ্ছি ক্রমশ। পলিটিক্যাল চক্রান্ত, মাটির লড়াই, হেন তেন। একটু আগে শুনলাম, থানার দারোগাবাবু এনকোয়ারি করবেন।গভর্ণমেন্ট চান না, মিথ্যে অজুহাতে হাঙ্গামা বাঁধুক।

রোগী দেখতে দেখতে ডাক্তার এই কথাগুলি বলছিলেন।.....

দুপুরে খবর পেলাম, সত্যি দারোগাবাবু এনকোয়ারিতে এসেছেন। ঝুরণবুড়ির বউমা, নোলেবাবুর স্ত্রী, পাচুর বউ, আরও-আরও লোকের সাক্ষ্যসাবুদ নোট করে নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে নীচের রাস্তায় জিপ দাড় করালেন। বেটন হাতে গাছটার দিকে উঠে গেলেন। একটু মর্যাদাজনক দূরত্বে লোকেরা তাকে অণুসরণ করছিল।

গাছটার আপাদমস্তক খুটিয়ে দেখে আইনরক্ষক বললেন, হুম! এই গাছটা?

লোকেরা কোরাসে বলল, হ্যাঁ স্যার! এ-ই সে।

গাছটার গায়ে বেটন ঠুকঠুক করে ঠুকে আইনরক্ষক বক্রহাস্যে বললেন, গাছের আবার মুখ থাকে নাকি? কথাও বলে?

সেই গাঁওবুড়ো নড়ি হাতে কয়েক পা এগিয়ে বললেন, হুজুর! ভয়ে বলি, কী নির্ভয়ে? সে প্রাচীন মানুষ। তার বাকরীতি ভিন্ন।

আইনরক্ষক গাছটার গুড়ির নিচে একটা মোটা শেঁকড়ে বুটজুতো পরা পা রেখেছিলেন। ভূরু কুঁচকে বুড়োকে দেখতে দেখতে বললেন, ঝেঁড়ে কাশো!

হুজুর দারোগাবাবু! এই গাছ আরও অনেক রক্ত খাবে।

আইনরক্ষক অট্টহাস্যের পর বললেন, তার মানে তুমি বলতে চাইছ, এখানে পুঁজো হোক। বলিদান হোক।এই তো?

প্রাচীন মানুষটি কিছু বলতে যাচ্ছিল, হইহল্লা করে তাকে থামিয়ে দেওয়া হল। তারপর দেখি লোকেরা দুরকম কথা বলছে। অথবা তিনরকম কথা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। পুজোঁআচ্চা হবে, কি গাছটা কেটে ফেলতে হবে, কি স্থিতবস্তা বজায় থাকবে, এই সব। হল্লাটা প্রচণ্ড বাড়ছিল- হাতাহাতির মুখে আইনরক্ষক গর্জন করলেন-কনস্টেবলরাও লাঠি তুলে তাড়া করল।আমি একটু আঁড়ালে কেয়াঝোপে আশ্রয় নিলাম। গাছতলায় এখন একা আইনরক্ষক।ক্রুদ্ধ চেহারা।গোফ তিরতির করে কাঁপছিল।

আর এই সময় একটা বাতাস এল। বৃক্ষলতা শনশন করতে থাকল। এ এক চূড়ান্ত মূহুর্ত। সহসা দেখি, আইনরক্ষক গাছটার দিকে মুখ তুললেন।তার মূখ পান্ডর হতে দেখলাম। তিনি হন্তদন্ত ঝোঁপঝাঁড় ঠেলে নীচের রাস্তায় নেমে গেলেন।

আমি যখন গাছটার কাছে, তখন জিপের গরগর ধ্বনি।গাছটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে-ভয়ে বললাম, তুমি কি ওকেও মরতে বললে? তা না হলে উনি অমন করে পালিয়ে গেলেন?

গাছটা চুপ করে রইল। আবার সেই বিরাট ভয়াল মৌন।...

বিকেলে পিচরাস্তায় ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছি। ঘোতনের চায়ের দোকানের কাছে গেলে ঘোতন চাওলা ফিক করে হেসে বলল, ডাক্তারবাবু, শুনছেন নাকি? দারোগাবাবু মরছে।

দুজনেই ঘুরে বললাম, কী?

হ:! ঘোতন দাঁত বের করল। থানায় ফিরছে, বুকে প্যান। সদরে নার্সিংহোম...

আমার হাত ধরে টেনে ক্ষিপ্র ডাক্তার বললেন, আসুন তো মশাই! যত্তোসব।

কিন্তু আমি দেখেছি!

কী দেখেছেন? ডাক্তার চার্জ করলেন। আপনিও দেখছি এক গাইয়া। বলুন, কী দেখেছেন?

হাটতে হাটতে আস্তে বললাম, কিছু না। চলুন।....

আমাদের প্রতি বিকেলের চমতকার বাতাসে সিগারেট টানতে টানতে প্রেমিক ডাক্তার হৃদয় উম্মোচন করলেন।তার ফুরফুরে নাগরিক চুলগুলি যথার্থ ফিল্মি হিরোর মতো উড়ছিলো। তার কপালের বিষাদরখো এ সময়ের বেশ স্পষ্ট হয়। ধোয়ার রিং পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর বললেন, আপনি সকালে যাওয়ার একটু পরে টিনির চিঠি এল। ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না আই’ম সো হেল্পলেস। বন্ডে সই করতে হয়, নয়তো একগাদা টাকা ফেরত, উইথ পেনাল্টি। এদিকে, ও আসবে না গ্রামে। আপনি বলুন, কোয়ার্টারটা কি খারাপ? জাস্ট আ নেচার্স ডেন কি না? একটু গার্ডেনিং করলে করলে কী লাভলি হয়! আর দেখুন, ক্রমশ বুঝেছি নেচারের মধ্যে কী একটা আছে। আই ফিল ইট। হয়তো আউটসাইডার বলেই প্রথম-প্রথম একটু আনক্যানি ফিলিং হতো। রাতের দিকটা অসহ্য লাগত। এখন মনে হয়, সাইলেন্স ইজ রিয়্যালি গোল্ডন। হ্যাঁ, লোকজন একটু বেয়াড়া। দলাদলি, পলিটিক্স, খুনোখুনি আছে। কিন্তু কোথায়, নেই বলুন?

মশাই আমি ডাক্তার। মানুষের বডি নিয়েই আমার জব। প্রায়ই রক্তমাখা বডি আসে। আসবে। রক্ত-টক্ত কোনও ডাক্তারের কাছে ব্যাপারই নয়। তবে দেখুন, হিয়ার ইজ দ্যা নেচার্স ল। নেচার ডাজনট কেয়ার অ্যাবাউট এনিথিং। একটা মানুষ খুন হল, কি মরল, কি যন্ত্রণা পেল। সো হোয়াট?

ব্যর্থ, নির্বাসিত প্রেমিক ডাক্তারটি এভাবে দার্শনিক হন। আমি চুপচাপ ওর কথা শুনি। মাঝে মাঝে বালি, তা-ই। বললাম, আচ্ছা ড. বোস!

চিকিতসক দ্রুত আমার একটা হাত নিলেন। অসীম বলো! আজ থেকে ‘তুমি’। উই আর ফ্রেন্ডস।

আচ্ছা অসীম, জীবনের মানে বলতে কি সত্যি কিছু আছে?

চিকিৎসক একটু হাসলেন। ফ্রয়েড লিখেছিলেন বোনাপার্টের বোনকে, যে মুহুর্তে মানুষ জীবনের মানে খুজতে চায়, অ্যাওয়ান্স হি বিকামস সিক্। কিন্তু আমি অন্য কথা বলি। জীবনের মানে নিয়ে তুমি এই যে প্রশ্নটা তুললে, এতেই বোঝা গেল, তুমি রিয়্যালি সুস্থ। সুস্থ বলেই প্রশ্ন তুলছ।

প্রশ্নের উত্তর না পেলে?

ডাক্তার আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, একটা শক্ত পয়েন্ট তুমি তুলেছ। উত্তর না পেলে? ভাবার মতো কখা। তবে আমার মনে হয়, নিশ্চয় মানে একটা আছে। দা নেচার নোজ দ্যা মিনিং অব লাইফ।

আবার আস্তে বললাম, প্রকৃতি রহস্যময়ী।

ডাক্তার বিষন্ন হাসলেন। তুমি নেচারে ফেমিনিন জেন্ডার বসালে। সায়েবরাও বলে মাদার নেচার। আসলে মেল শোভিনিজম।

চমক খেলে গেল এ কথায়। বললাম, অসীম! তুমি ঠিকই বলেছ। ওই গাছটার কথা মনে পড়ে গেল। প্রকৃতির প্রতীক। না পুরুষ, না নারী। ফুল-ফল কিছুই দেখি না। মহাভারতে পড়েছি, অর্জুন উর্বশীর শাপে....

আই নো, আই নো! বৃহন্নলা!

বৃহন্নলা!

ডাক্তার কালভার্ট থেকে নেমে বললেন, চলো। ফেরা যাক। তুমি ছিলে বলে মনটা ভালো হয়ে ওঠে। অন্তত বিকেলের দিকটায়। কিন্তু রাত্রে একটু লোনলি ফিলিং। অবশ্য ভালোও লাগে। মনে মনে কত কিছু ভাবি।



তোমার প্রেমিকার কথা?

ধুস! শি ইজ হোপলেস। ওকে ভুলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কয়েক পা হেটে প্রেমিক ডাক্তার গলার ভেতর বললেন, ফ্রম নাও অন আই’ল হেট হার।

মুখের জঘণ্য বিকৃতি দেখে বললাম, অসীম।

অসীম!

ডাক্তার থু থু ফেলে বললেন, সব বুঝতে পেরেছি। সেই রমেনটা আবার জুটেছি। শি ইস আর হোর!

অসীম! অসীম!

কিছু দুর চলার পর তরুন চিকিতসক সহসা কৌতুকে বললেন, চলো, বরং তোমাদের সেই গাছটার কাছে যাই। দেখি, সে আমাকে কিছু বলে নাকি।

অসীম! অসীম!

ডাক্তার খ্যা খ্যা হেসে বললেন, তুমি সত্যি গাইয়া! চলো না, ব্যাপারটা দেখি। আসলে বৃহন্নলাকে নিয়ে একটু জোক করে আসি। আজ সত্যি কিছু ভালো লাগছে না। জাস্ট ফর এ ফান! চলো....!

বাকি ঘটনা লিখতে আমার হাত কাপছে। কিন্তু মৃত্যুর আগে আমাকে এসব কথা লিখে যেতেই হবে। আমি যে সত্যিই একমাত্র সাক্ষী।

গতকাল দিনশেষে গাছটার কাছে একা এসে দাঁড়িয়েছিলাম। আজ আমার সঙ্গে এক সুশিক্ষিত ডাক্তার নাগরিক। গাছটার কাছে গিয়ে তিনি সকৌতুকে বললেন, হ্যাল্লো বৃহন্নলা! হোয়াট ডু ইউ স্যে? হোয়াট এ্যাবাউট মি? ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইংলিশ? ওক্কে। বাংলা বোঝো। বলো, কী বলতে চাও।

ওর কাঁধ ধরে বললাম, অসীম! অসীম! তুমি যে নোলেদার মতো পাগলামি শুরু করলে!

সহসা তরুন ডাক্তার চিতকার করে উঠলেন, শুনছ, শুনতে পাচ্ছ? বলছে মর্ মর্ মর্।

এই বলে তিনি ঝোঁপঝাঁড় ঠেলে প্রায় দৌড়ে গেলেন। অন্ধকারে তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। ডাকাডাকি করে গলা ভেঙ্গে গেল। এিই সময় ঝোড়ো হাওয়ায় বৃক্ষলতা তুমুল আলোড়িত হচ্ছিল।

ভয় পেয়ে আমিও পালিয়ে এলাম। সারটি রাত ঘুমোতে পারিনি।

সকালে ডাক্তার অসীম বোসের মৃত্যুর খবরে গ্রামে হইচই পড়ে যায়। এই মৃত্যু একটু অন্যরকম। কারণ বিছানার পাশে স্যুইসাইড্যাল চিরকূট ছিল : ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’।

তিনি ডাক্তার। সাইনাইড খেয়েছিলেন।......


চার

এরপর গাছটি বিপজ্জনক ঘোষিত হয় পঞ্চায়েত অফিস থেকে। গাছটি কেটে ফেলার প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু স্থানীয় কোনও কাঠুরিয়া ঝুকি নিতে চাইল না। দুরে সদরের কাঠগোলার করাতিদের ডেকে আনা হয়েছিল সে কারণে।

তারা সবে এসে পৌঁছেছে, পঞ্চায়েত প্রধানরা খাতির করে তাদের নিয়ে আসছেন, সহসা গাছটার তলায় ঢাকঢোলের শব্দ! কাসির শব্দ। বেতো নরেনবাবু ছড়ি নেড়ে বললেন, পুঁজো হচ্ছে। দেবতা কাঁটা চলবে না।

স্কুলশিক্ষক মনজুর হোসেন চ্যাচামেচি করে বললেন, রেজোলিউশন! আনঅ্যানিমাসলি অ্যাক্সেপ্টেড রেজোলিউশন। লাটুবাবুও সই করেছেন।

লাটুবাবু বেগতিক দেখে কেটে পড়েছেন। ঢাকঢোল কাসিওলারা হাত থামিয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছিল। আমি সেই কেয়াঝোপের অাঁড়ালে। চূড়ান্ত মুহুর্তের জন্য কাউন্ট-ডাউন শুরু। তিন....দুই...এক....

বৃহন্নলা! তুমি কথা বলো! বৃহন্নলা! এই সব দ্বিপদ প্রাণীগুলির তড়পানি কেন সহ্য করছ তুমি?

তুমি স্বয়ং প্রকৃতি এ দৌরাত্ম অসহ্য।

বৃহন্নলা! মুখ খোলো!

আর প্রত্যাশিত বাতাসটা এল। বৃক্ষলতা জুড়ে নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে বিশাল স্লোগান। মার, মার শালাদের। মার, মার, মার....

আচম্বিত একটি বোমা ফাঁটল। আবার বোমা ফাঁটল। হল্লা, রণহুঙ্কার, ক্রমাগত বোমা বারুদের কটু গন্ধ। ধোঁয়া। গাছটা নিশ্চয় বলছিল, মর্ মর্ মর্। আর লোকগুলি মরছিল।

গাছটা বার বার বলে থাকবে, মর্ মর্ মর্। কারণ লোকগুলি বারবার মরছিল। চাপ চাপ রক্ত।

নো-ম্যান্স-ল্যান্ড রক্তে লাল হচ্ছিল। প্রকৃতিতে তখন বসন্তকাল। এ সময় মৃত্যুও রক্তিম সৌন্দর্য হয়।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

10 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ গল্প। একটা গাছের গল্পে যে এতগুলো যুতসই গল্প প্রবাহ! আমাদের মানবিক অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। ঘুরে ফিরে আমরাও যেন সেই নো ম্যানস ল্যান্ডের গাছের দিকে তাকিয়ে আছি। যে বৃহন্নলা!

    উত্তরমুছুন
  2. বৃহন্নলা সিনেমার সাথে এই গল্পটার মিল নেই

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. মিল থাকার কারনে বতিল হলো তো বৃহন্নলা সিনেমার পুরস্কার |

      মুছুন
  3. অসাধারন অনবদ্য একটি গল্প।।

    উত্তরমুছুন
  4. অসাধারন অনবদ্য একটি গল্প।।

    উত্তরমুছুন
  5. ভারত বর্ষ গল্পের নাট্য রূপ যদি দিতেন তাহলে খুব ভালো হয়।

    উত্তরমুছুন
  6. গল্পে উল্লিখিত বিভিন্ন চরিত্রের বন'না দাও।

    উত্তরমুছুন