মোমিনুল আজম এর গল্প : সর্প দংশনে ছেলেটি কি মারা গিয়েছিল?


তখনও রাতের আঁধার কাটেনি। মসজিদ থেকে কিছুক্ষন আগে আজান শোনা গেছে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে সে আজান একাকার হয়ে অন্যরকম এক আওয়াজ তৈরি করেছিল। জমাট বাঁধা মেঘ না থাকলে ঈষান কোনে এতোক্ষণে ধুসর আভা টের পাওয়া যেত। গত দুদিনের বৃষ্টি সে মেঘের জমাট ভাব এতোটুকু কমাতে পারেনি। থেকে থেকে হালকা ও ভারী বৃষ্টি এই শেষ রাতের গুমোটভাবটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।


এমনি এক বর্ষণমুখর সকালে ফজরের আজানের পর লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে মাথাল মাথায় বেরিয়ে পড়ে কুটি পাড়ার ছমির উদ্দিনের ছেলে মোজাম্মেল। অনেকক্ষন বিছানায় উসখুস করছিল আজানের অপেক্ষায়। সে যখন ঘর থেকে বের হয় তখন তার বাবা কুয়োতলায় অজুর পানি মুখে দিয়ে গড়গড়া করছে। কপাট খোলার শব্দে পিছন ফিরে মোজাম্মেলকে দেখে। মুখের পানি ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে-

; কই যাস রে মোজাম্মেল?

; জাল তুলতে।

; একটু পরে যা, আলোটা ফুটুক।

; নাহ! কেউ আবার জাল তুলে নিয়ে যাবে। আজ অনেক মাছ পড়বে জালে। মাছ দেখে অনেকে লোভ সামলাতে পারে না।

খালি পায়ে শ্যাওলা পড়া উঠোনে পায়ের আঙ্গুলগুলো বাঁকা করে সাবধানে পা ফেলে সে চলে যায় জাল তুলতে। বাসপাতার তৈরি মাথালে বৃষ্টির ফোটা পড়ে টপটপ শব্দ হতে থাকে।


মুসলধারে বৃষ্টি আর ঘন কালো মেঘ দুদিন থেকে এমনভাবে চেপে বসেছে যে দিনের বেলাতেও রাতের অন্ধকার নেমে আসে। এ তো বৃষ্টি না যেন আকাশ ভেঙ্গে অবিরাম জল পড়া। সে জলে টইটুম্বুর হয়ে আছে বাড়ীর আশপাশের ডোবা নালা। কিছুদিন আগে লাগানো লকলকিয়ে ওঠা ধানের সবুজ চারাগুলো গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে শুধু মাথাটা ভাসিয়ে রেখেছে। মৃদু বাতাসে মাথাটা এদিক ওদিক নাড়ছে! দেখে মনে হয়, চারাগুলো বলছে- পানিতে আমাদের এভাবে আর কষ্ট দিও না। বাড়ীর একপাশের ছোট নালা দিয়ে জমে থাকা পানি খরস্রোতা নদীর মতো খলবল করে গিয়ে পড়ছে পিছনের নদীতে। সে স্রোতের উজান বেয়ে শরীরে রুপালী আশের দুপাশে সিদুর লাগানো পুটি তিরতির করে এগিয়ে যেতে চায় কিন্তু স্রোতের কারনে তা মাঝে মাঝেই বাধাগ্রস্থ হয়। পাখনা মেলে স্রোতের প্রতিকুলে দল বেঁধে তারা এক স্থানে জড়ো হয়ে থাকার চেষ্টা করে।


বৃষ্টিতে জমির আইলে, ক্ষেতে বিচিত্র সব মাছের আনাগোনা। কৈ, মাগুর, শিং, পুটি খলবল করে ছুটে বেড়াচ্ছে। যেখানে পানির একটু স্রোত, সেখানে মাছের আনাগোনা বেশি। এতো মাছ দেখে সন্ধ্যার আগে আগে মোজাম্মেল ঘরের মাচা থেকে জাল বের করে পেতে রেখেছিল পুলের আগে ধান ক্ষেতের আইল বরাবর। মাছের আনাগোনা দেখে পুলের গোড়ায় মুটজাল নিয়ে মাছ ধরায় মেতে উঠেছিল দু- তিনজন। মোজাম্মেলের মুটজাল নেই, থাকলে সেও সামিল হতো একাজে। অনেক রাত পর্যন্ত সে পুলের ওপর বসে মাছ ধরা দেখছিল। সন্ধার পর সারা পাথার জোনাকি পোকার মতো আলোয় ভরে গিয়েছিল। সবাই নেমেছিল হ্যারিকেন, ভুটা নিয়ে কোঁচা হাতে মাছ শিকারে। এতো মাছ দেখে মোজাম্মেল রাতেই ভেবেছিল- আজ জালে অনেক মাছ পড়বে। রাতে খেতে বসে তার মাকে বলেছিল-


'জাল পেতেছি, পুলের গোড়ায় মুটজালে যে হারে কৈ মাগুর উঠছে তাতে আমার জালেও কাল অনেক কৈ মাগুর পাব। তুই মা কাল কৈ মাছের সুরুয়া রানবি।'


'আচ্ছা বাবা, আগে মাছ বাধুক জালে, তারপর না সুরুয়া খাবি।'


কোমর পানি মাড়িয়ে আবছা অন্ধকারে জাল তুলতে গিয়েছিল সে। গতকাল সন্ধ্যায় যেখানে জাল পেতেছিল সেখানে জালের কোন চিহ্ন নেই। তার মনে একটু দুঃশ্চিন্তা দেখা দিল। কেউ আবার জাল চুরি করে নিয়ে যায়নি তো? খোঁজাখুঁজির পর সে জালের কোনা পেল ধান ক্ষেতের কিছুটা ভেতরে, দোমড়ানো-মোচড়ানো। কোনা ধরে তুলতেই সে দেখতে পেল কৈ, মাগুড়ে জাল দলা পাকানো। খলুই নিয়ে গিয়েছিল সে, মাছ ছাড়িয়ে রাখার জন্য। এতো মাছ সে ছাড়াবে কখন? অগত্যা কোনমতে দলা পাকিয়ে জাল তুলতে থাকে সে। বিশ হাত জাল তুলতে তার সময় লাগে অনেক। মাছের ওজনে তা এমন হয়, পানির ভিতর দিয়ে টেনে আনতে হয় ।


মাছসহ জাল তুলে সে যখন রাস্তার ওপর রাখে তখন অন্ধকারে বুঝতে পারে না কত মাছ উঠেছে তবে পানি থেকে জাল ডাঙ্গায় তোলার সময় মাছের লাফালাফি, অস্থিরতায় বুঝতে পারে অনেক মাছ জালে বেঁধেছে। এতো মাছ জাল থেকে খুলতে অনেক সময় লাগবে তাই সে মাছসহ জাল বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলো, সবাই মিলে মাছ খুলবে, কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো জালে আটকা প্রায় সব মাছ জ্যাতা। মাছ লাফালাফি করছে, কৈ-মাগুরের কো-কো শব্দ জাল থেকে ভেসে আসছে। তারমানে প্রায় সব মাছ জালে আটকা পড়েছে শেষ রাতের দিকে। এ সময়টাতেই মাছের আনাগোনাও বেশি হয়। তাই সে মাছ খুলে আবার জাল পেতে রাখতে চায়, সকালের দিকে আরও একবার মাছ পাবে এ আশায়। দক্ষ হাতে সে মাছ খুলে রাখে বাশের তৈরি খলুইয়ে। কয়েকদিন আগেই তার বাবা এটি বানিয়ে দিয়েছিল তাকে। জ্যান্ত মাগুর কৈ এর কাঁটা তাকে মাঝে মাঝে খোঁচা দিতে থাকে। রক্তও বের হলো মনে হলো কিন্তু কোন দিকেই তার খেয়াল নাই। মাছের কাঁটায় তার হাত ভালোমতোই ছিড়ে গেল। তিরতির করে ব্যথা করছে। মোজাম্মেল ভাবলো এটা নিশ্চয়ই মোটাতাজা সিং মাছের খোঁচা কারন চিকন শিং মাছ এ জালে আটকানোর কথা নয়। শিং মাছের কাঁটা সে অনেকবার খেয়েছে। একটু পর আবার সেরে যায় তাই ওদিকে খেয়াল না করে ব্যথা নিয়েই মাছ খুলতে থাকে। কিছুক্ষন পর মনে হলো তার হাত-পা অবস হয়ে আসছে। চোখে অন্ধকার দেখে। সূবেহ সাদেকের পর অনেকক্ষন হলো। আকাশে আলো ফোঁটার কথা। কিন্তু তার মনে হলো আরও ঘন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে সবকিছু।


২.

সূর্য ওঠার সাথে সাথে আশেপাশের দু'চার গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ল, ছমির উদ্দিনের ছেলে মোজাম্মেল সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। মোজাম্মেলের মৃত্যুর খবরের চেয়ে আলোচনার বড় বিষয় হয়ে দাড়ালো সাপের জাত-পাত। কি সাপের কামড়ে মোজাম্মেলের এ অবস্থা হলো তা কেউ দেখেনি তবে লোকজনের মুখে তা কখনও কেউটে, কখনও কাল নাগিনী বা গোমা, আলাদ নাম ধারণ করে ছড়িয়ে পরতে লাগলো। উত্তর পাড়ার সিনেমা পাগল দুই কিশোরের ধারণা, বৃষ্টির মধ্যে সাপ এসেছিল জলপরীর বেশ ধরে। মোজাম্মেলকে সাপ হয়ে দংশন করে আবার জলপরী হয়ে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও।


সূর্য মাথার ওপর ওঠার আগেই ছমির উদ্দিনের ছোট বাড়ীর উঠোনে লোক ধারণের জায়গা হচ্ছে না। লোকজন পাশের বাড়ীর বোরো ধান ক্ষেতের ওপর দাড়িয়ে সাপের জাত-পাত নিয়ে আলোচনা করছে। ভাতিজা মোজাম্মেলের সাপের দংশনের চেয়ে মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট ক্ষেতের শোক ময়েজ উদ্দিনের বড় করে দেখা দিয়েছে। এই একটি মাত্র জমি তার। অনেক যত্ন করে সার-গোবর দিয়ে বোরো ধান লাগিয়েছে। এখান থেকে যা ধান পায় তা দিয়ে তার মাস দুয়েক চলে যায়। এ দু'মাস তার ঠাট-বাট একটু বজায় থাকে। এ সময় কেউ কামলা-কিষানের জন্য ডাকলে তার পছন্দ হলে যায়, না হলে যায় না। ময়েজের এ চালচলন দেখে গেরস্ত বাড়ীর লোকজন যারা কামলা নিতে আসে তারা তার মুখের ওপর বলে যায় -"দুদিনের বৈরাগী, ভাতরে কয় অন্ন।" সেই ক্ষেতের এ অবস্থা দেখে আইলের কাছে দাড়িয়ে হাত জোড় করে অনুরোধ করছে ক্ষেত না মাড়ানোর জন্য। অন্য সময় হলে সে জ্ঞাতি-গোষ্টি নিয়ে গালাগাল করতো বা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতো মারতে। ময়েজ উদ্দিনের অনুরোধ, সতর্ক পাহারা কোন কিছুই কাজে আসছে না। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই ক্ষেত মারিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সাপে কাটা মোজাম্মেলকে দেখার জন্য।


মোজাম্মেলকে রাখা হয়েছে দক্ষিন দুয়ারি ঘরের বারান্দায়। চৌকির উপর। মৃত ব্যক্তির মতো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়নি তার শরীর। তাদের ধারণা, সাপের বিষে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মোজাম্মেল। বিষটা কেটে গেলেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ভাত খেতে চাইবে তর মার কাছে। পাশে বসে সুর করে কান্নাকাটি করছে তার মা আমিনা বেগম। কান্নার মুল বিষয়- বাবা তুই ভাল হয়ে ওঠ, তোকে আজ কৈ মাছের সুরুয়া করে ভাত রেঁধে দিব। মোজাম্মেলকে বাড়িতে আনার পর থেকে তার বাবা ছমির উদ্দিন, যিনি সংসারের কাজ করার চেয়ে ধর্মের কাজ করাকে বেশি গুরুত্ব দেন, তিনি বসে পড়েছেন ঘরের বাইরে রাখা জলচৌকির উপর, নামাজে। কোনদিকেই তার ভ্রুক্ষেপ নাই। মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে দুহাত তুলে মোনাজাত করছেন-হে আল্লা, তুমি আমার সোনার মতো ছেলেটাকে ভালো করে দাও। বাকী জীবন আমি তোমার খেদমতে কাটিয়ে দেব। ছোট বোনটি, বয়স কত হবে? আট-নয়, সে তর মার পাশে বসে ভাইয়ের হীম শীতল হাতটি ধরে চুপচাপ বসে আছে। মাঝে মাঝে তার মাকে বলছে- মা, ভাইয়ার হাত এতো ঠান্ডা কেন? হাতের তালুগুলো কেমন জানি নীল হয়ে গেছে। মেয়ের কথা শুনে মায়ের কান্নার সুর আরও বেড়ে যায়। বড় ভাই বদরুল, যে বাজারের হাইস্কুলে পড়ে, উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছে। থানকুনির পাতা পিষে হাতের উল্টো পিঠে সাপে কাটার জায়গায় লাগিয়ে দিয়েছে, মসজিদের ইমামকে ডেকে নিয়ে এসে ঝাড়ফুক করিয়েছে। কে একজন পড়াপানি নিয়ে এসেছে ঘোড়াঘাট থেকে, এটি সাপে কাঁটা রোগীর ভিতরে দিতে পারলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা একশত ভাগ। বদরুল, ছোট ভাইয়ের পাশে চৌকিতে বসে কাসার গ্লাসে করে পড়া পানি নিয়ে মুখটা ফাঁক করে অর্ধেকটা ঢেলে দিল। দুগাল বেয়ে সে পানি পড়ে গেল চৌকিতে। তা দেখে মা-বোন ডুকরে কেঁদে উঠলো।


সূর্য যখন পশ্চিম দিকে একটু হেলে পড়েছে, তখন আসলেন গ্রামের মাতবর ইয়াসিন মৃধা। তিনি ফজরের নামাজ পড়ে গিয়েছিলেন থানা সদরে। জমিজমা সংক্রান্ত একটা কেসে। হাকিম কোর্টে উঠতে দেরি করায় তার আসতে এতো বেলা। খবর সে ভোররাতেই পেয়েছিল। কিন্তু কেসের তারিখ আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো বলে তখনই আসতে পারে নি। ইয়াসিন মৃধাকে বাড়ীর ভিতর ঢুকতে দেখে আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন ক্ষেত আবার মাড়িয়ে ভিড় করে বাড়ীর ভিতর ঢুকলো। ইয়াসিন মৃধা মোজাম্মেলের সাপে কাটা হাত, চোখের নীচ, বুক পেট ভালো করে দেখে বললেন-

-"ছমির উদ্দিন কই?"

ইয়াসিন মৃধাকে বাড়ীর ভিতর ঢুকতে দেখে ছমির উদ্দিন নামাজ ছেড়ে তার পিছনে এসে দাড়িয়েছে।

-"মুই তোমার পিছনোত বাহে"-বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

ইয়াসিন মৃধা পিছন ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে বলে-

-"নাহ থাক, তোমাক দিয়া এ কাজ হবার নয়। বদরুল কই?"

বদরুল পাশ থেকে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। সে কান্না সংক্রমিত হয় তার বাবা, মা আর বোনের ভিতর। মোটামুটি জোরেসোরে একটা কান্নার রোল পড়ে বাড়িতে।


ইয়াসিন মৃধা বদরুলের ঘাড়ে হাত রেখে বলে-

"আল্লার বান্ধা, আল্লা চাইলে নিয়া যাবেন, আবার তিনি চাইলে রেখে যাবেন। এর ওপর আমাগোর কোন হাত নাই। মোজাম্মেলের কথা শুনে আমি সব খবর আনছি। রংপুরের ডোমারে এক ওঝা আছে। নাম শংকর। আশে পাশের তিনচার থানার সবাই তাকে চেনে। শুনছি, তার কাছে সবচেয়ে বিষধর সাপের মনিও আছে। তাকে নিয়া আসতে পারলে মোজাম্মেলকে বাঁচানো সম্ভব। "


ইয়াসিন মৃধার কাছ থেকে নাম ঠিকানা নিয়ে, ঘরের বাশের খুটির ভিতর তার কিছু জমানো টাকা আছে। দা দিয়ে এক কোপে তা কেটে সব টাকা পয়সা কোচায় ভরে রওনা দেয় বদরুল। রওনা দেয়ার সময় ইয়াসিন মৃধা বিশ টাকা বদরুলের হাতে দিয়ে বলে-"শংকর ওঝা খুব ব্যস্ত মানুষ। সারা বছর এজেলা থেকে ও জেলা সাপে কাঁটা রুগীর চিকিৎসা করে বেড়ায়। তাকে বাড়ীতে পাওয়ার সম্ভবনা কম। তবে যেখানেই যাক বাড়ীতে ঠিকানা রেখে যায়। তুই যদি তাকে বাড়ীতে না পাস তবে তার বাড়ী থেকে ঠিকানা নিয়ে যে করেই হোক তাকে আনার ব্যবস্থা করবি।" তিনি যাতায়াতের রাস্তা বাতলে দিয়ে বলেন, "সাইকেল নিয়ে যাবি শহরে, সেখান থেকে ট্রেনে রংপুর। রংপুর থেকে বাকীটা পথ হেঁটেও যেতে পারবি। বাসের কোন ঠিক ঠিকানা নাই আর বাসের রাস্তাঘাটের অবস্থাও ভাল না।"


৩.

সারাদিন ছমির উদ্দিনের বাড়ীতে লোকজনের ভীড় লেগেই থাকলো। দু'চার ক্রোশ দুর থেকেও লোকজন আসছে মোজাম্মেলকে দেখার জন্য। নানা জন নানা কথাও বলছে। ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠলো-
-" ওমা একি! মোজাম্মেল তো মারা গেছে, ওর দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা দরকার।"

কথাটা মোজাম্মেলের মার কানে যায়। কান্না থামিয়ে চৌকির উপর দাড়িয়ে যায় সে-

"-কেটা কইলো রে এ কথা, কেটা? ছেলে হামার ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে আছে। হ, হামার ছৌল মরলে তো তোমাগোর ভাল লাগবে. ."


আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল মোজাম্মেলের মা কিন্তু কান্না উতলে ওঠায় বলতে পারলো না, রাগ এবং কান্নার ভারে ঠোঁট তার থিরথির করে কাঁপতে থাকে। পাশের বাড়ীর দু'জন বউ তাকে জোর করে বসায়। মোজাম্মেলের শরীরের ওপর শুয়ে আবার সুর করে কান্না জুড়ে দেয়। পরিস্থিতির কারনে এতো ভীড়েও সবাই চুপ করে থাকে, মোজাম্মেলের মার সুর করে কান্নার শব্দ অনেকদুর থেকে শোনা যায়।

এর মাঝে বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা চলতে থাকে। বিভিন্ন গাছ-গাছান্তের পাতা বেটে সাপে কাঁটার স্থানে লাগানো হয়, পানি পড়া খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়, হুজুরের ঝাড়ফুঁক চলতেই থাকে। সন্ধ্যার পর আসে বাজারের ওসমান। সাহসী লোক হিসেবে তার খ্যাতি আছে। বিষাক্ত সাপের লেজ ধরে গর্ত থেকে টেনে বের করে মারে। সাপের কামড়ের টোটকা চিকিৎসাও করে সে। হ্যারিকেনের আলোতে উল্টে পাল্টে দেখে মোজাম্মেলকে। চৌকির ওপর থেকে মোজম্মেলের মা, বোনসহ সকলকে নামানো হয়। মোজাম্মেলের পাশে চৌকির ওপরে এখন শুধু ওসমান। সে তার পকেট থেকে বের করে চকচকে চাকু। ওসমানের হাতের উল্টো পিঠ যেখানে সাপে কামড় দিয়েছে সেখানটায় চাকু দিয়ে ইঞ্চি পরিমান আড়াআড়ি করে কেঁটে ফেলে। তার কাজ দেখে লোকে লোকারণ্য পুরো বাড়ী নিঃস্তব্দ। মোজাম্মেলের মা আর বোন তা দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

কাঁটা হাত থেকে কোন রক্ত বের হয় না। ওসমান হাতটা তুলে কাঁটা স্থানে মুখ লাগিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চুষতে থাকে। তার দু গাল বাটির মতো মুখের ভিতর বসে যায়। এভাবে কিছুক্ষণ চোষার পর সে তার মুখ থেকে সবকিছু উগড়ে দেয় একটি কাঁসার বাটিতে। কিছু কালো রক্ত আর থুথু ছাড়া লোকজন তেমন কিছুই দেখতে পায় না। কিছুক্ষন পর ওসমান তার কাজে ক্ষান্ত দেয়। 'জাত সাপ' বলে সে চৌকি থেকে নেমে কারো সাথে কথা না বলে হাটা দেয় বাজারের দিকে। তার পিছে পিছে ছমির উদ্দিন কিছুদুর গিয়ে আবার ফেরত আসে।

রাত চলে যায় ভীত সন্ত্রস্ত লোকজনের আনাগোনায়। মোজাম্মেল মৃত না জীবিত তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এরকম একটা গল্প ছড়িয়ে পড়েছে যে- রাতের অন্ধকারে দংশনকারি শাপ এসে যদি মোজাম্মেলের হাতের কাটা অংশে মুখ লাগিয়ে বিষ শুষে নেয় তাহলে সে সাথে সাথে ভালো হয়ে যাবে। এরকম কথাবার্তা সারাদিনই শুনেছে মোজাম্মেলের মা, বাবা, বোন। বিপদে পড়া মানুষের মন আশা ভরসার সব কথাই বিশ্বাস করতে চায়।

গভীর রাতে লোকজনের আনাগোনা যখন কমে আসে তখন মা-বোন মোজাম্মেলের কাছ থেকে দুরে গিয়ে অন্য একটি জলচৌকির ওপর চুপচাপ বসে ঢুলুঢুলু চোখে চৌকির নীচে তাকিয়ে থাকে। মোজাম্মেলের শাপে কাটা হাতটা কাথার ভেতর থেকে বের করে রাখে । বাবা অন্য একটি ঘরের বারান্দায় চটের বস্তার ওপর বসে দুহাত উপরে তুলে অনুচ্চ স্বরে অবিরাম মোনাজাত করতে থাকে, যার বেশির ভাগ কান্নার শব্দ। আত্নীয় স্বজন যারা এসেছিল তাদের অর্ধেকেরও বেশি সন্ধ্যার পরপরই চলে গেছে, বাকী যারা আছে তারা ঘরের ভিতর শুয়ে বসে সুরা কলেমা পড়ে ভোররাতের অপেক্ষা করছে।


৪.

কোন প্রকার আশার বাণী ছাড়াই বাবা-মার চোখের জলে ভাসিয়ে রাত ভোর হলো। ভোর হওয়ার সাথে সাথে মা-বোন আবার এসে বসে মোজাম্মেলের পাশে চৌকির ওপর। ভাইয়ের হাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে তার ছোট বোন জিজ্ঞেস করে-

"মা, ভাইজানের হাতটা ফোলা ক্যান, কাল তো এমন ছিল না!"

মেয়ের কথায় মা হাতটা তার হাতের মধ্যে নেয়। সেও একটু অবাক হয়। ঠিক যেমন ছোট বেলায় হাত ছিল মোজাম্মেলের। নাদুস নুদুস শরীরে তার হাতটা ছিল সাইকেলের টিউবের মতো পাম্প করা। অনেকে বলতো রুটি বেলা বেলনের মতো। মেয়ের কথায় নিজে নিজে উত্তর বের করে-

"বিষে রে বিষে, সাপের বিষে মোর বাবার সারা শরীর ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।"

দ্বিপ্রহরের কিছু আগে বাড়ীতে আসে ইয়াসিন মৃধা। তিনি এসেই বদরুলের খোঁজ নেন, তারপর ঘরের কোনায় দাড়িয়ে ছমির উদ্দিনের সাথে কিছু শলাপরামশর্ করেন। বাড়ীতে উপস্থিত সকলের উদ্দেশে্য বলেন-

"বদরুল হয়তো ঘুরছে শংকর ওঝার পথে পথে। এ সময়টায় সাপের উপদ্রুপ বেশি। তাই তার ব্যস্ততাও বেশি। শংকর ওঝা ঘুরে বেড়ায় সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায়। জানিনা বদরুল তার দেখা পেয়েছে কি না!"

তিনি মোজাম্মেলের কাছে গিয়ে সবকিছু দেখে বলেন-

"আর অপেক্ষা করা মনে হয় ঠিক হবে না। লাশের সৎকারের ব্যবস্থা করা দরকার।"

বাড়ীতে থাকা স্থানীয় ময়-মুরুব্বীরা ইয়াসিন মৃধার কথায় সায় দিয়ে বলেন-

"যত দেরি করা হবে মোজাম্মেলের আত্নার ওপর আজাব তত বেশি হবে।"

এসব কথা শুনে ঢোড়া সাপের মতো ফোঁস করে ওঠে মোজাম্মেলের মা আমিনা বেগম। ছমির উদ্দিন তাকে কিছু বোঝাতে গেলে সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে তার ওপর। কাঁদতে কাঁদতে বলে-

"তুমি তো বলবাই। ছেলে তুমি মানুষ করছ? ক্ষেতে কামলা দেয়া ছাড়া তুমি আর কিছু জানো। কি খাইলো না খাইলো তার কোনদিন খোঁজ নিছো? আর এখন আসছে অন্যের কথায় তাল দিতে।"


আমিনা বেগম দৌড়ে চৌকির ওপর উঠে দু'হাত দিয়ে মোজাম্মেলকে জড়িয়ে ধরে, গলা ছাড়িয়ে যতটা সম্ভব জোরে কাঁদতে থাকে। চোখের জলে, নাকের জলে হিক্কা ধরা সুরের কান্নার ভিতর থেকে পাড়া-প্রতিবেশি আর মোজাম্মেলকে দেখতে আসা বাড়ী ভর্তি লোকজন যা উদ্ধার করলো তার মর্মার্থ হলো-বদরুল ফিরে না আসা পর্যন্ত মোজাম্মেলের ব্যাপারে কাউকে কোন কিছু করতে দিবে না।


মায়ের মন-ক্ষীন আলোও আগলে রাখে দপ করে জ্বলে ওঠার আশায়।







লেখক পরিচিতি


মোমিনুল আজম










জন্মেছেন - ১৯৬৫ সালে, গাইবান্ধায়


পড়াশুনা করেছেন- শের ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে


কাজ করেন- বাংলাদেশ ডাক বিভাগে


বর্তমানে- কানাডায় থাকেন


ফিলাটেলি- ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ নামে একটি প্রকাশনা আছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ